#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
৫
৫
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করতে করতে বারোর ঘরে গিয়ে থেমেছে। তোহফার ছোট্ট একটা বইয়ের তাক আছে, যেখানে তার প্রিয় কিছু বই সাজিয়ে রাখা। যখন তার খুব বেশি ভালো লাগে বা মন খারাপ হয় তখন সে বইগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। আজও ব্যতিক্রম কিছু নয়। বইগুলো ঘাটাঘাটি করে আবারও সাজিয়ে রেখে দিয়ে বিছানার কোণে গিয়ে বসলো। মাথার বালিশটা হেলান দিয়ে বসে কিছুক্ষণ ফোন হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলো। হঠাৎ করেই মেসেজ টোন বেজে উঠতেই তোহফা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তার ভাবনা এমন ছিলো সে যেনো এই মেসেজের অপেক্ষাতেই ছিলো। মেসেজ সিন করলো। তার আন্দাজ ঠিক, মেসেজটা আওয়াদ দিয়েছে। লিখেছে,
“ভেবেছিলাম বিয়ের খবর শুনে কাজল চোখের মেয়ে জ্ঞান হারাবে। তার পরিবার আমাকে ফোন দিয়ে বলবে একটা মনের ডাক্তার খুঁজে আনতে! তবে কেসটা দেখি উল্টো পথে মোড় নিলো। বুঝলাম না কাজল চোখের মেয়ের ভয় কি সব তুলো হয়ে উড়ে গেলো?”
আওয়াদের ঠাট্টা করা মেসেজ দেখে তোহফার ভীষণ রাগ হলো। সে নিজেও একটা মেসেজ লিখলো। তোহফা নিশ্চিত এই মেসেজটা আওয়াদের মেসেজের পাল্টা জবাব দেওয়া হয়ে যাবে। আওয়াদ রাগ না হলেও সাথে সাথেই ফোন করবে। আর তোহফা তখন ফোনটা ধরবে না। ফোনটা মিউট (Mute) করে সে এখন লম্বা একটা ঘুম দেবে। তন্দ্রাঘোরে বিভোর হয়ে সে স্বপ্নের দেশে বেড়াতে যাবে। তাকে নিয়ে মজা তাই না, আজ রাতের ঘুম হারাম করে দিবে আওয়াদের। তোহফা কি জিনিস তা হয়তো আওয়াদ জানে না। আজই প্রথম এবং শেষ তোহফাকে নিয়ে মজা করা।
ফোন মিউট করে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পরে। অন্যদিকে আওয়াদ একনাগাড়ে ফোন দিতেই থাকে তোহফার নাম্বারে। ফোন বাজছে তবে কেউ ধরছে না। তোহফা মেসেজে লিখেছে,
“আমি একজনকে ভালোবাসি সেই ক্লাস নাইন থেকে। বাবা-মাকে ভয়ে বলতে পারিনি তাই আপনাকে বিয়ে করবো বলে হ্যাঁ বলে দিয়েছি। আপনি প্লিজ আমার হয়ে না করে দিন। আমি জানি, এখন আপনিই আমার ভরসা।”
এই মুহূর্তেটা কতোটা ভয়াবহ সেটা কাউকে খুলে বলা সম্ভব না আওয়াদের। সে কিনা একজন তৃতীয় মানুষ হয়ে তোহফার জীবনে প্রবেশ করলো। জীবনের আঠাশটা বসন্ত চলে গিয়ে যখন ঊনত্রিশে এসে বসন্ত দেখা দিলো তাও কিনা এমন একটা মানুষের সাথে যে অনেক আগেই মন থেকে অন্য কারো হয়ে গেছে। আওয়াদের উচিত ছিলো আগে তোহফার সাথে কথা বলে সবটা ঠিক করে পরিবারের কাছে প্রস্তাব রাখা। এখন সে কীভাবে বলবে, সে তোহফাকে বিয়ে করতে পারবে না? যেচে পরে প্রস্তাব দিয়ে এখন কীভাবে সে নাকচ করবে? তবে সব একদিকে আর তার ভাঙা হৃদয়টা যে অন্যদিকে চলে গেলো। এই ভাঙা হৃদয়কে কীভাবে জোড়া লাগাবে? তোহফা অন্য কাউকে ভালোবাসে, এটা শুনেই তো কেমন যেনো ছন্নছাড়া লাগছে নিজেকে। এভাবেই কেনো তার প্রথম বসন্ত এসেও আবার হারিয়ে গেলো! আওয়াদ কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর ঝটপট একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। সত্যি বলতে তার বসয়টা পাগলামি করার জায়গায় আর নেই। তাকে বাস্তবতা বুঝতে হবে। সে যে বয়সে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে তোহফাকে পাগলামি করে পেতে চাওয়াটা বোকামি। আওয়াদ ঝটপট একটা মেসেজ লিখলো তোহফার নাম্বারে।
“সত্যি বলতে আমি তোমায় ভালোবাসি কিনা বলতে পারবো না। তবে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো শুনে কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে এটার বিশ্লেষণ চেয়েও না প্লিজ। আমি মন থেকে চাই তুমি তোমার ভালোবাসাকে নিজের করে পাও! যদি সেখানে আমাকে সরে দাঁড়িয়ে তোমাদের দুজনকে এক করতে হয় আমি করবো। তবে কথা দাও, ভয়বিহীন একটা পড়ন্ত বিকেলে আমার সাথে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা রং চা খাবে। খুব ইচ্ছে আমার। তবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম প্রথম যাকে মন দিবো তার সাথেই এমন একটা সুখময় দিন কাটাবো। হয়তো তুমি আমার নও, তবে একটা বিকেল না হয় আমার হয়েই থেকো। কথা দিচ্ছি তোমার খুব বেশি সময় নিবো না। তবে দিও কিন্তু?”
মেসেজেটা পাঠিয়ে কপালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো। এপাশ থেকে ওপাশ, সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট, ঘন্টা শেষ হয়ে গোটা একটা রাত শেষ হলো তবুও আওয়াদের চোখে ঘুম পরী নেমে এলো না। দূরের মসজিদ থেকে যখন ভেসে এলো, “আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।” ঠিক তখন আওয়াদ বিছানা ছেড়ে উঠে বসে চোখ দুটো কচলে ওজু করতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো। ওজু শেষ হতেই নামাজের জন্য তৈরি হলো। যাওয়ার পথে তার মাকে ঘুম থেকে তুলে দিতে ভুললো না। সেলিনা বেগম উঠতেই আওয়াদ চলে গেলো নামাজ পড়তে মসজিদে। অন্য দিকে আওয়াদের ঘুম হারাম করে তোহফা সে খুব আরামেই ঘুমিয়ে আছে। তাকে পনেরো মিনিট ধরে তার ভাবি লিমা ডেকে চলেছে নামাজ পড়ার জন্য, সেটা তার কর্ণকুহরে পৌঁছায়নি । সে মোড়ামুড়ি করেও আবার গভীর তন্দ্রায় ডুব দিলো। অবশেষে লিমা হতাশ হয়ে তার শাশুড়ীর কাছে গিয়ে বললো, “তোহফা উঠছে না।” জাহানারা বেগম রেগে গেলেন। মেয়েটা দিনকে দিন খুব খারাপ হচ্ছে, সেই সাথে খারাপ হচ্ছে তার নিত্য দিনের আচরণগুলো। জাহানারা বেগম ওজু শেষ করেই মেয়ের ঘরের দরজা টোকা দিলেন।
“তোহফা, তোহফা শুনছো? নামাজের সময় হয়েছে এখনি উঠো বলছি। তোহফা, আমি কিন্তু বকবো।”
তোহফার ঘুম ছুটে গেলো। তবে সে পুরোপুরি নিদ্রা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঘুমঘুম কণ্ঠেই মায়ের উদ্দেশ্য বলে,
“আর একটু ঘুমাই মা। শরীরটা দুর্বল লাগছে দু’দিন আগেই তো জ্বর ছিলো। তাই প্লিজ মা আর একটু।”
তোহফা ভালোই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে পারে যেটা জাহানারা বেগমের অজনা নয়। তবে তিনি আবেগী কথায় গলে যাওয়ার মানুষ নন। তিনি আদেশের সুরে বললেন,
“ফ্রেশ হয়ে জায়নামাজে দাঁড়াও দেখবে অর্ধেক ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে ইনশাআল্লাহ। বাকি অর্ধেক নামাজ শেষ করে কোরআন তেলওয়াত করো বা তোমার ভাবিরা পড়বে সেটা শুনো। অবশেষে অন্ধকার কাটতেই ভাইদের সাথে একটু বাহির থেকে ঘুরে আসো ইনশাআল্লাহ পুরোপুরি ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। উঠো বলছি তোহফা। তুমি যদি না ওঠো আমি আজ পটল ভাজি করবো সাথে কিন্তু কৈ মাছ ভুনাও করবো বলে রাখলা—
” উঠেছি। তুমি যেগুলো বলেছো সেসব করবো, তবুও তুমি পটল ভাজি আর কৈ মাছ রান্না করো না প্লিজ মা।”
জাহানারা বেগম কথা শেষ করার আগেই তোহফা দরজা খুলে তার মায়ের উদ্দেশ্য কথাগুলো বললো। জাহানারা বেগম আড়ালে মুখ লুকিয়ে মুচকি হাসলেন। তিনি তার এই আদরে বখে যাওয়া মেয়েকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় সেটা ভালো করেই জানেন। জাহানারা বেগম ঠিক আছে বলে চলে গেলেন। অন্যদিকে তোহফা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতেই নামাজের প্রস্তুতি নিতে চলো গেলো রুমের ভেতরে।
শুভ্র নির্মল আকাশে ঝলমল করতে করতে সূর্য্যি মামার আগমন হচ্ছে ধীরগতিতে। ফুরফুরে শৈথিল্য হাওয়া মনপ্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষণেক্ষণে। পাখিরা নিজ বাসা থেকে তাড়া নিয়ে বেরিয়ে পরছে খাবারের সন্ধানে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে মাথায় ঘোমটা ও টুপি দিয়ে ছেলেমেয়ে চলেছে মকতবখানায়। দু একজন মানুষের আনাগোনা ছাড়া তেমন কারো দেখা নেই পথের বাঁকে। সেই পথের বাঁক ধরেই তিনজন মানুষের মাঝে মধ্যমনি হয়ে হেঁটে চলেছে তোহফা। কিছুক্ষণ পর পর বাবা, ভাইয়েদের কথায় খিলখিল করে হাসছে সে। আকাশী রঙের থ্রি পিছ পরিধান করে সাধারণ ঘরের মেয়ে হয়েই হেঁটে চলেছে। তার ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হতেই তা মুগ্ধ হয়ে দেখছে তৌসিফ, তৌহিদ সাথে তাদের বাবা আরিফুল ইসলাম। তাদের এই মধ্যমনি হাসলে যেনো মুক্ত ঝড়ে, আর তার কান্না যেনো একটা ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ের সমান। তোহফা ছোট্ট বাচ্চাদের মতো একবার বাবার হাত তো অন্যবার বড় ভাই এবং ছোট ভাইয়ের হাত পাল্টাপাল্টি করে হেঁটে চলেছে। ওর এমন বাচ্চামি তারাও উপভোগ করছে মন থেকে। এভাবেই সময় গড়িয়ে যখন সাতটায় গিয়ে থেমেছে তখন তারা বাড়ির পথে রওনা হয়েছে। তাদের চারজনের দিকে লক্ষ করে আশেপাশের অনেকেই কানাকানি করতে ভুলছে না। এটা রোজ হয়। তাই তাদের নতুন করে বলা বা শোনার মতো কিছু নেই। এলাকার অনেক মানুষ তোহফাকে দেখে হিংসা অনুভব করে, কেউবা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভালো খারাপ দু’টো মিলিয়েই জীবন সংসার। এখানে আপনি শুধু ভালো পাবেন না, দু’টো মিলেমিশে ছিলো এবং থাকবে। তোহফা বড় ভাইয়ের হাত ধরেই আপন মনে হাঁটছে, হঠাৎ তার ভাইয়ের চলন্ত পা জোড়া থেমে যেতেই তোহফাও থেমে গেলো৷ ভাই কারো দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। ভাইয়ের দৃষ্টি লক্ষ করে তোহফাও তাকায়। তখন সে দেখতে পায় খানিকটা দূরেই আওয়াদ একটি চায়ের দোকানে চা খাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারও গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্তেই চা শেষ হয়ে গেলো। বিল মিটিয়ে দিয়েই আওয়াদ পিছুপা হতেই মুখোমুখি হয়ে গেলো তোহফা ও তৌসিফের। তৌসিফের পাশে তোহফাকে দেখে আওয়াদের ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠলো, তবে তা স্থায়ী হলো না তোহফার লেখা মেজেসের কথাটা মনে পরতেই। আওয়াদ হাসিমুখে হাতটা বাড়িয়ে দিলো তৌসিফের দিকে।
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন?”
তৌসিফ উত্তর দিয়ে আওয়াদের বাড়িয়ে দেওয়ার হাতে হাত মেলায়। বুকে জড়িয়ে নিতে ভুলে না। এমন সময় তোহফার চোখে চোখ পরে যায় আওয়াদের। ধক করে উঠে বুক। হার্টবিট টিপটিপ করে আওয়াজ তোলে। আওয়াদের ক্লান্ত চোখ দেখে আঁতকে উঠে তোহফা। টিপটিপ করে উঠা হৃদয়ে হুট করেই ব্যথা অনুভব হয়। মেসেজটা দিয়ে কি বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে নাকি? কয়েক মুহূর্ত ভেবে তোহফা মনে মনেই বলে, “না, সে ভুল করেনি। মানুষটা তাকে নিয়ে মজা করেছে। মজা করার শাস্তিস্বরূপ এটাই তার পাওনা ছিলো। ”
আওয়াদ তোহফার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা অস্বস্তির জন্য ঠিকমতো তাকাতে পারছে না তার দিকে। বারবার তার আঁখি পল্লব জোড়া এদিক ওদিকে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। আওয়াদ তবে ভুল মানুষের কাছে শেষে কিনা মন দিয়ে বসলো। ভালোবাসার মানুষের কাছে অপরাধী হবার থেকে না হয় আওয়াদ পরোপকারী মানুষ হিসেবে রইলো। আওয়াদ যখন নিজের মনের সাথে কথোপকথনে ব্যস্ত তখন তৌসিফ বললো,
“এতো সকাল সকাল এদিকে কোন কাজ ছিলো বুঝি?”
আওয়াদ অমনোযোগী থাকায় প্রথমে খেয়াল করলো না তৌসিফের কথা। তাই সে হুম বলতেই তৌসিফ বলে,
“চলো একসাথে নাস্তা করবে আমাদের সাথে। মা তোমায় দেখলে খুশি হবে অনেক।”
“না ভাইয়া। আজ না অন্য কোনোদিন। আজ একটু তাড়া আছে তাই আসি।”
আওয়াদ বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আওয়াদের যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তোহফা। তার হঠাৎ করেই খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতরে। কেনো হচ্ছে জানে না। সকালে নামাজ শেষ করেই ভাইদের সঙ্গে হাঁটতে চলে এসেছে, তাই ফোনটা চেক করা হয়নি। আওয়াদ কোনো মেসেজ দিয়েছে কিনা সেটাও দেখা হয়নি। এখনি বাড়িতে গিয়ে ফোনটা চেক করতে হবে। তোহফা ভাইয়ের হাত ধরেই জোর পায়ে হাঁটতে রইলো। আচমকা বোনের গতিপথ পাল্টে যেতেই ভারি অবাক হলো তৌসিফ। তবে তেমন কিছু প্রকাশ করলো না। বোনটা যে অবুঝ, চঞ্চল চড়ুই পাখি।
টেবিলের উপরে বাজতে থাকা ফোনটির দিকে বিরক্তের দৃষ্টিতে তাকালো লিমা। মেজাজটা তার বিগড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ফোন নামক এই যন্ত্রকে আছাড় মেরে ভেঙে দিতে। তবে চাইলেও কি সব সম্ভব? একবার দু’বার করে ফোনটা এই পর্যন্ত নয় বার বেজেছে তবুও তার বেজে যাওয়া আওয়াজ কমছে না। এবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে অসহায় কন্ঠে একজন বললো,
“রাগ করছিস কেনো? খুব প্রয়োজন না হলে তোকে কি বলতাম বল মা? তোর বাবার প্রেশারের ঔষধটা শেষ। বাড়িওয়ালা এসে কাল রাতে ঝগড়া করে গেছে। কোনোভাবে যদি বেশি না পাঁচটা হাজার টাকা দিতি খুব উপকার হতো।”
জোরে নিশ্বাস ছেড়ে দম নিলো লিমা। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো,
“এটা আমার শ্বশুর বাড়ি, কোনো টাকার গোডাউন না যে যখন তখন চাইলেই টাকা দিবে। গেছে মাসেও তো তোমার জামাইয়ের থেকে চেয়ে পনেরো হাজার টাকা দিলাম, এই মাসে কীভাবে আবার চেয়ে দেই বলবা একটু।”
মেয়ের কথায় লতিফা বেগম কষ্টে কেঁদে দিলেন। কথাটা যে একশো ভাগ সত্যি বলেছে তার মেয়ে লিমা। তবে খুব দরকার না হলে এভাবে বেহায়ার মতো চাইতো না সে। তারও লজ্জা লাগে, বিবেক বাঁধা দেয় এভাবে চাইতে। তবে কথায় বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। কিছুটা ওরকমই অবস্থা লতিফা বেগমের এখন। ঘরের একমাত্র কর্ম করা লোকটা যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে রেখে চলে গেছে। আজ যদি তার কিছু না হতো, নিশ্চয়ই তাদের পরিস্থিতি এমন হতো না। কষ্টের চোটে লতিফা বেগমের সকল কথা বরফের মতো জমে গেলো। দলা পাকিয়ে আটকে গেলো গলায়। অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারলেন না। তাই বাধ্য হয়ে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো। এদিকে মায়ের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে লিমা বার কয়েক মা, মা বলে ডাকলো। তবে ওপাশ থেকে কোনো টু শব্দ এলো না। তাই ফোনটা কান থেকে সরিয়ে পল্লব জোড়ার সামনে আনতেই বুঝলো তার মা ফোনটা কেটে দিয়েছে। ফোনটা বুকে জড়িয়ে লিমা কিছুক্ষণ চোখের জল বির্সজন দিলো। তারও যে নিজেকে অসহায় লাগে। মনে হয় এমন অসহায়ত্বের থেকে মুক্তি পেতে মরে যাই। তবে কীভাবে কি হবে? চাইলেই সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে না। আচমকা পিঠে কারো স্পর্শ পেতেই চমকে ওঠে লিমা। তৌহিদের ফেরার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়ই ও ফিরে এসেছে। লিমাকে এভাবে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবে। পরবর্তীতে এক প্রকার জোর করেই সবটা শুনবে। তারপর? তারপর নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করবে সাহায্য করার। তবে রোজ রোজ স্বামীর থেকে এমন হাত পেতে টাকা নিয়ে নিজের পরিবারকে দিতে ভালো লাগে না। একটু হলেও নিজের আত্মসম্মানবোধ আছে যে। নিজেকে সামলে পেছন ফিরতেই আরো চমকে যায় লিমা। কারণ পেছনে তার স্বামী নয়, ননদ দাঁড়িয়ে আছে। তোহফাকে এই অসময়ে তার ঘরে দেখে লিমা অবাক হলো। স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবে তোহফা?”
“হুম।”
“বলো।”
“এটা দিতে এলাম। অনেক আগেই চেয়েছি তবে কিছু ঝামেলার জন্য হয়ে ওঠেনি।”
তোহফা কিছু টাকা লিমার দিকে এগিয়ে দিলো। লিমা অবাক চোখে তাকিয়ে কিছু প্রশ্ন করার আগেই তোহফা বললো,
“সারাদিন বোন, বোন করে মাথা খাও, অথচ নিজের মনের খবর একটুও বলো না। কেনো? সেদিন আন্টির সাথে বলা তোমার সব কথা শুনে নিয়েছি। আজও শুনলাম। তাই আর দেরি না করে নিয়ে এলাম, ধরো।”
তোহফা টাকাগুলো এগিয়ে দিলো। লিমা এই মুহূর্তে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তবুও কিছু বলতে চেয়ে পারলো না, কথাগুলো গলায় আটকে গেলো। তোহফা লিমার এমন করুণ অবস্থা দেখে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
“ভালোবাসার মাপ নেই। তাই আপন মানুষের কাছে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলাও কোনো অপরাধ নয়। এমনকি সম্মানে আঘাত লাগতে পারে ভেবে চুপ করেও থাকতে নেই। প্রয়োজন সবারই হয়, আজ বা কাল। আজ যে রাজা কাল সে ফকির। ছোট ভাবো কেনো নিজেকে? আর তুমিই তো বলো, গুরুজনের সাথে খারাপ আচরণ করতে নেই। বিকালে গিয়ে টাকা গুলো দিবে এবং ক্ষমা চেয়ে আসবে। মনে থাকবে?”
লিমা মাথা নাড়ায়। তোহফাকে জড়িয়ে সে নীরবে চোখের জল ফেলতে থাকে। এর মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করে তৌহিদ। বোন আর বউকে এভাবে দেখে প্রশ্ন করে,
“কি করছেন আপনারা এভাবে? ”
তোহফা ভাইয়ের কথায় পিছন ফিরে তবে ভাবিকে কিছুটা আড়াল করে। লিমা যেনো নিজেকে সংযত করে নিতে পারে এই জন্য। লিমা নিজেকে সামলে নেয়। তোহফা এগিয়ে গিয়ে বলে,
“অভিযোগ করছিলাম ভাবির কাছে।”.
“কার প্রতি অভিযোগ?”
“তোমার।”
বোনের সোজাসাপ্টা উত্তরে তৌহিদ অবাক নয়নে তাকালো। তোহফা বলে,
“আমার হাত খরচ কোথায়? আজ মাসের নয় তারিখ। এখনো পেলাম না যে।”
তৌহিদ বোনের কথায় জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,
“ইসস! ভুলে গিয়েছিলাম। এক্ষুনি দিচ্ছি।”
তৌহিদ আলমারি থেকে টাকা বের করে তোহফার দিকে এগিয়ে দিলো। তোহফা নিজেরটা বুঝে নিয়ে বললো,
“ভাবিরটা কোথায়?”
তৌহিদ বাম হাত থেকে ডান হাতে এনে তোহফাকে দেখিয়ে বললো,
“এই যে তোর ভাবির।”
তোহফা হেসে উঠলো খিলখিল করে। তৌহিদ আলাদা ভাবে দুটো ভাগ করে লিমাকে টাকা দিলো।
“এখানে যেটা আছে এটা তোমার। আর এটা মাকে পাঠিয়ে দিও। ওখানে চার হাজার আছে। লাগলে বলো আরো দিবো। ”
তোহফা লিমার দিকে ইশারা করলো টাকাটা নিতে। লিমা টাকা নিতেই এক ছুটে তোহফা নিজের ঘরে চলে এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে এলো বেলকনিতে। মেসেজ চেক করতেই আওয়াদের দেওয়া মেসেজটা চোখে পরে। তোহফা নতুন মেসেজ লিখলো।
“একটা বিকেল দিলেই আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দিবেন, কথা দিচ্ছেন তো?”
মিনিট সময় পার হতেই আওয়াদ মেসেজ দিলো,
“হুম।”
তোহফা মুখ টিপ হাসলো। আওয়াদ মনে মনে যে খুব কষ্ট পাচ্ছে সেটা ভালোই বুঝলো। তোহফা লিখলো,
“বাবা-মাকে বলবেন না, আমি বিয়েটা করবো না।”
“বলবো না।”
“সত্যি?”
“তিন সত্যি। ”
“সরি আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য। কি করবো বলুন, আমি যে অন্য কাউকে ভালোবাসি।”
“অসুবিধা নেই। বুঝতে পেরেছি।”
“অভিশাপ দিবেন না তো?”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“শুনেছি কেউ কাউকে না পেলে নাকি অভিশাপ দেয়। সেই অভিশাপে মানুষ—”
“মানুষ কি? ”
“জানি না, তবে অভিশাপ দিবেন না প্লিজ।”
“দিবো না।”
” তাহলে পরশু দেখা করি।”
“শিওর?”
“হুম।“
“অসুবিধা হবে না? যদি আমার সাথে দেখা করলে তোমার ভালোবাসার মানুষ কিছু মনে করে।”
“সে আমাকে বিশ্বাস করে। কিছু মনে করার কোনো চান্সই নেই।
“এতো শক্তি ভালোবাসায়?”
“জি, কাউকে ভালোবাসুন তাহলে বুঝবেন। আচ্ছা ভালো থাকবেন, মা ডাকছে। কোথায় কখন দেখা করবো আপনায় মেসেজ করে জানিয়ে দিবো।
আওয়াদের মেসেজের অপেক্ষা না করেই তোহফা ফোনটা রেখে দিলো। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে আর আপন মনে হাসছে। লোকটা বোকা, একটু বেশিই বোকা। ওদিকে আওয়াদের বুকটা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। তোহফা তাকে কিনা বলছে, “কাউকে ভালোবাসুন তাহলে বুঝবেন।” অথচ মেয়েটা জানেই না ভালো না বেসেই আওয়াদ প্রেম রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ভালোবাসে না বলছে কেনো? বাসে তো। হয়তো সময়সীমা অল্প।
তার ইচ্ছে হচ্ছে সময়টা এখানেই থেমে থাক। তার আর তোহফার কথোপকথনের সময়টা এভাবেই বন্দী হয়ে বুকের বাম পাশে চিরস্থায়ী হয়ে বসবাস করুক। যেহেতু মেয়েটা তার নয় তাহলে কেন সে চাইবে মেয়েটা অন্য কারো হোক। যতোই হোক আওয়াদ যে মেয়েটাকে পছন্দ করে। ভীষণ রকমের পছন্দ, যাকে বলে প্রেম অসুখ।
ইন শা আল্লাহ চলবে……