#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
১৬
অতিরিক্ত গরমে প্রতিটি মানুষের অবস্থা খুব শোচনীয়। গরমে মানুষের অবস্থা অনেকটা তৃষ্ণার্ত পাখির মতো। প্রতিটা মানুষের ছটফটানি চোখে বাঁধার মতো। তোহফা নিজের বেলকনিতে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে হঠাৎ পিছন থেকে আওয়াদ তাকে জড়িয়ে ধরতেই তোহফা চমকে পিছু ফিরে তাকায়। আওয়াদকে দেখে নিষ্পলক চোখে হাসে। তারপর প্রশ্ন করে,
“এত তোড়জোড় করে কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা?”
আওয়াদ তোহফার চোখের চাহনি অনুসরণ করে সামনে তাকায়, দেখতে পায় একজোড়া চড়ুই বেলকনিতে রাখা পানির টপ থেকে পানি পান করছে আর একে অপরের সাথে কথা আদান-প্রদান করছে। দৃশ্যটা এতটা সুন্দর যে আওয়াদ তা ক্যামেরা বন্দি না করে পারলো না। টপাটপ কিছু ছবি তুলে তোহফার কথার উত্তরে বলল,
“একটা কাজে গিয়েছিলাম! তবে এখন বলবো না পরে বলবো।”
তোহফা আওয়াদের মুখোমুখি হয়ে বলে,
“গতকাল থেকে আমার খুব মন খারাপ। ”
“জানি।”
আওয়াদের জানি শব্দটা হয়তো তোহফা আশা করেনি তাই অবাক নয়নে তাকিয়ে বলল,
“কীভাবে?”
“তোমার চোখের অস্থিরতা দেখে। ”
“কোথায়? আমি তো স্বাভাবিক আছি।”
“একটা কথা কী জানো তোহফা! যে যত নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চায় বা দেখায় সে ততটাই বেসামাল ভেতর থাকে। এই মুহূর্তে তোমার পরিস্থিতি ঠিক তেমন।”
“আচ্ছা আপনি এত অল্প সময়ে আমাকে বুঝে নিলেন কীভাবে?”
“জানি না, তবে শুধু জানি তোমাকে ভালোবাসার পর আমার সব কিছুতেই সুখ সুখ অনুভব হয়।”
“এই সুখ সুখ অনুভব কীভাবে হয়? একটু দেখান তো।”
“বোকার মতো প্রশ্ন করো না তোহফা! সুখ দেখায় কীভাবে? এটা দেখানো যায় না! শুধু অনুভব করানো যায়।”
“তাহলে অনুভব করান আমায়, আমিও একটু অনুভব করি। যদি তাতে আমার মন খারাপ একটু হলে-ও দূর হয়।”
“সত্যি তুমি অনুভব করতে চাও?”
“সত্যি। ”
“তাহলে চোখ বন্ধ করো।”
“অনুভব করতে হলে চোখ বন্ধ করবো কেন?”
“কারণ কিছু অনুভূতি অনুভব করতে হয় চোখ বুজে তাই।”
“আচ্ছা।”
“কোনভাবেই চোখ খুলবে না কিন্তু।”
“হুম।”
একথা বলেই তোহফা চোখ বন্ধ করে। আওয়াদ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে তোহফার কোমর জড়িয়ে আওয়াদ খানিকটা তোহফাকে কাছে টেনে আনে। তোহফা শিউরে চোখ খুলতে চাইলে আওয়াদ হাত দিয়ে চোখ আগলে বলে,
“উঁহু চোখ বন্ধ। ”
তোহফা ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকে। তোহফার ওঠানামা করতে থাকা পেট দেখে আওয়াদ মুচকি হাসে। তারপর খুব কাছাকাছি এসে তোহফার বন্ধ চোখে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দেয়। তোহফার শিরা-উপশিরায় বয়ে যায় শীতল হাওয়া। তোহফা অস্থির হয়ে আরো জোরে শ্বাস নিতে থাকে। তোহফারা এমন অস্থিরতা দেখে আওয়াদ এবার আরো ভয়াবহ কাজ করে ফেলে। নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে তোহফার ওষ্ঠদ্বয় এক করে নেয়। তোহফা খামচে ধরে আওয়াদের পিঠ। আওয়াদ তোহফাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“সুখ অনুভব হলো।”
তোহফা চুপ।
“কী হলো বলো।”
তোহফা এবারও চুপ। আওয়াদ আচমকা তোহফার হাত নিয়ে নিজের হার্টবিটের উপর রাখে। আওয়াদের ঢিপঢিপ করতে থাকা হার্টবিট প্রোডাকশনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে চোখ খুলে তাকায়। তাকাতেই আওয়াদের দুষ্ট হাসি চোখে পরে। তোহফা আবারও চোখ বুজে ফেলে। চোখ বন্ধ করেই বলে,
“এই সুখের অনুভূতি গুলো আমি আমার শেষ বয়সেও মনে করবো।”
“তোহফা রাণী।”
আওয়াদের নেশাময় কন্ঠে পুলকিত হয় তোহফা। মাথা নিচু করে বলে,
“হু।”
“তুমি আমার শুকিয়ে যাওয়া বকুল ফুল হবে? যার গন্ধে রোজ আমি মাতাল হব।”
তোহফা আওয়াদের কথায় কিছু বলে না, তবে খুব শক্ত করে আওয়াদকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। পারলে হয়তো বুকের ভেতরের হৃদয়ের কোণে জমা করতো আওয়াদ নামের ভালোবাসার মানুষটার সকল অনুভূতিকে।
সময় বহমান নদীর মতো করে বয়ে গেছে প্রায় পনেরটা দিন। আওয়াদ সুস্থ হয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেছে তা-ও দু’দিন হয়ে গেল। আজকাল আওয়াদকে একটু বেশিই মনে পরে তোহফার। মানুষটার সাথে কাটানা প্রায় তেরোটা দিন যেন সুখের অধ্যায় ছিলো। মানুষটাকে ছাড়া প্রতিটা দিন, ক্ষণ, সময় সব যেন অনুভূতিশূন্য লাগে তোহফার কাছে। আওয়াদ চলে যাওয়াতে তোহফার যতটা মন খারাপ হয়েছে তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার অনুপস্থিতি । মনে হয় প্রতিটা দিন যেন বছরের সমান। মানুষটা খুব ব্যস্ত সময় পার করছে তাই তো তোহফাকে খুব একটা ফোন করে কথা বলতে পারে না। দুপুরে ফোন করে সরি বলেছে সময় দিতে না পারার জন্য। তবে আওয়াদের সরি তোহফার অভিমান কমাতে পারেনি, আরো একরাশ অভিমান বেড়েছে তাতে। তোহফার ইচ্ছে হয় বলতে, ‘আপনি খুব কঠিন হৃদয়ের মানুষ। আপনার কোন অধিকার নেই তোহফার প্রেমিক পুরুষ হবার। আপনার সাথে আমার হাজার বছরের আঁড়ি হোক।’ তবে পরমূহুর্তেই তোহফা ভাবে হাজার বছরের আঁড়ি কেন একদিনের জন্য মানুষটা আঁড়ি করলে তোহফা দম আঁটকে মরে যাবে। তার থেকে ভালো এভাবেই থাকুক। এমন হাজারো জল্পনা-কল্পনা করতে করতে তোহফা ঘড়ির কাঁটার দিকে নজর দেয়। সময় তখন রাত একটা পঁয়তাল্লিশ। তোহফা এপাশ থেকে ওপাশে ফিরে হাতটা বাড়িয়ে এতদিন যে বালিশে আওয়াদ ঘুমিয়েছে তাতে হাত বোলালো। মানুষটার শূন্যতা ভালোভাবেই তোহফাকে গ্রাস করেছে। তোহফা আবার নিজের ভাবনার গভীরে পা ফেলার আগমুহূর্তে ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনকলের শব্দ পেয়ে তোহফার চোখেমুখ চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। সে মুচকি হাসতে হাসতে ফোনটা রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে আওয়াদ বলে,
“খুব মিস্ করছি।”
তোহফা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আমিও।”
“তাহলে চলে আসো।”
“কোথায়?”
“আমার কাছে।”
“রাত কত বাজে দেখেছেন, সময়ের কোনো ভাবনা নেই নাকি?”
“তোমার অনুপস্থিতিতে সময়টাও যেতে চায় না।”
“হয়েছে এখন এসব বলে আমাকে গলাতে হবে না।”
“তুমি কী মোম যে আমি গলাবো।”
“আপনার সাথে আমি ভিষণ রকমের অভিমান করেছি।”
“জানি তো।”
“কিচ্ছু জানেন না, জানলে বুঝতেন এতরাত অবধি জেগে থাকার কারণ। ”
“তুমি যে কারণে ঘুমাতে পারোনি, আমিও সে কারণে ঘুমাতে পারিনি।”
“কচু।”
“একটু বেলকনিতে আসবে?”
“কিহ্।”
“বেলকনিতে এসো।”
“কেন?”
“আগে এসো তারপর বলছি।”
তোহফা একছুটে বিছানা ছেড়ে বেলকনতি যায়। সে দেখতে পায় আওয়াদ রাস্তার দাঁড়িয়ে আছে। সোডিয়ামের হলুদ আলোয় আওয়াদকে কিছুটা ভিন্ন লাগছে। আওয়াদকে এভাবে এখানে তোহফা আশা করেনি! তাই তো তার হার্টবিট দ্রুত গতিতে ঢিপঢিপ করছে। তোহফা আওয়াদকে কিছু বলার আগেই আওয়াদ বলল,
“তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই চলে এলাম।”
“আপনি পাগল, এতরাতে কেউ এতটা পথ অতিক্রম করে।”
“আমার কেন জানি খুব অস্থির লাগছিল তোহফা। মনে হচ্ছিল একপলক তোমায় দেখতে না পেলে আমি দমবন্ধ হয়ে মরে যাব এখনি।”
“ছিহ! এসব কী বলছেন।”
“তোহফা।”
“হুম।”
“নিচে আসবে একটু।”
“আসছি।”
তোহফা ফোন কেটে দিয়ে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গেইট খুলে দৌড়ে আওয়াদের নিকট ছুটে যায়। ছুটে গিয়ে আওয়াদকে জড়িয়ে ধরতেই আওয়াদ টাল সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে যায়। তবে নিজেকে সে সামলে নিয়ে তোহফাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। অজস্র ক্ষুদ্র চুমুতে তোহফার মুখ ভরিয়ে দেয়। আওয়াদের এমন উন্মাদ আচরণের কারণ তোহফা বুঝতে পারে না! তবে সে অনুভব করে আওয়াদের নিখুঁত ভালোবাসাকে। আওয়াদের এই উন্মাদ আচরণের কারণ কী কোনো বিশেষ?
ইন শা আল্লাহ চলবে…..