অতঃপর গল্পটা তোমার পর্ব-১৭

0
1

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
১৭

রাতের আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর। এই সৌন্দর্য দেখতে হলে তোমাকে রাত জাগতে হবে। রাতের আকাশের সবথেকে সুন্দর দৃশ্য দেখতে হলে তোমায় যেতে হবে নদীর পাড়ে কিনাবা কোনো খোলা মাঠে। নদীর ঢেউ যখন খেলা করবে, ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে পাড়ে মিলিয়ে যাবে তখন বুঝবে পৃথিবী ঠিক কত সুন্দর? অথবা সবুজ ঘাসের বুকে মাথা এলিয়ে দিবে তোমার চুলকে বালিশ করে! রাতের আসমান পানে চোখ রেখে আকাশ দেখার মজাই আলাদা। মাটির বুকে মাথা গুঁজে আকাশের কাছে দুঃখ সুখের কথা বলা যেন পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর মুহূর্ত। এই মুহূর্ত জীবনে সব সময় আসে না। এই মুহূর্ত বিশেষ কোনো মানুষের হাত ধরে আসে। কখনো বা আসে বিশেষ কোনো দুঃখের সাথে। তবে তোহফা নামের মেয়েটার জীবনে দুঃখ বলে আপাদমস্তক কোনো শব্দ নেই। তাই তো তার এই আকাশ দেখার মজা তার প্রিয় মানুষটির হাত ধরেই এসেছে। এই নরম তুলতুলে ঘাসের বুকে পিঠ বিছিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে তোহফা। তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে মুগ্ধতা। তোহফার চেহারার মুগ্ধতা যেন কথা বলছে। কথা বলছে তার হাসি, চোখ। রাতের আকাশের ওই মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা যেন তোহফাকে দু’হাতে আঁকড়ে ডাকছে। এমন সুখি মেয়েকে দেখে তারাদেরও আজ হিংসে হচ্ছে। আকাশে চাঁদ নেই। আছে লক্ষ্য তারার সমাহার। তবে চাঁদের আলো বিহীন এই গগণ কিন্তু দেখতে মন্দ নয়। রাতের অন্ধকারও যেন কাবু করতে পারেনি এই সৌন্দর্যকে ধরে রাখতে। তোহফা যখন মুগ্ধ হয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে তখন পাশ থেকে আওয়াদ বলল,

“তোহফা?”

তোহফা নিঃশব্দে উত্তর দিলো,

“হুম।”

“কখনো এমন করে আকাশ দেখেছো? খোলা মাঠ, নরম ঘাসের বিছানা। চুলের খোঁপা বালিশ, ক্ষণেক্ষণে বয়ে চলা শীতল হাওয়ায় শিরশির করে ওঠা শরীর। অনুভূতি যেন আকাশ ছোঁয়ার মতোই।”

“না।”

“কেন?”

“আপনার সাথে দেখবো বলেই হয়তো দেখা হয়নি।”

আওয়াদ হাসে। হাসি হাসি মুখেই বলে,

“আজকের এই আকাশ, তারা সকলে কি বলছে জানো?”

“কি!”

“বলছে আওয়াদ তুমি তোমার তোহফাকে খুব শীগ্রই তোমার করে নাও। ”

“যাহ্ আকাশ কী কথা বলে?”

“কিন্তু আমি তো শুনছি।”

“মিথ্যা।”

তোহফার কথায় আওয়াদ পাশ থেকে উল্টে তোহফাকে নিজের বাহুডোরে আঁটকে নেয়। ঘাসের দু’পাশে হাত রেখে মধ্যেখানে তোহফাকে আগলে নেয়। ধীর গতিতে তোহফার নিকট এগিয়ে আসে। দু’জনার নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে দু’জনার মুখ-মন্ডলে। তোহফার বুকে যেন কেউ ঢিপ ঢিপ করে হাতুড়ি পেটাতে থাকে। লজ্জায় চোখ জোরা বন্ধ করে ফেলে। লাল হয়ে যাওয়া লাজুক নাকে আওয়াদ নিজের নাক ঘসে। বলে,

“আমার আজ তোমাকে ভিষণ করে আদর করতে ইচ্ছে করছে তোহফা।”

তোহফা লজ্জায় চোখ পিটপিট করতে থাকে। কাঁপতে থাকা চোখের পাতায় আওয়াদ নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিতেই তোহফার পিঠ বেয়ে বয়ে যায় শীতল পরশ। গলা বেয়ে নামতে থাকে ভয়ের স্রোত। তোহফাকে আরো লজ্জা দিতেই আওয়াদ তোহফার ডান গালে আবারও তার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দেয়। তোহফার লজ্জায় এবার মরিমরি অবস্থা। বুকের মাঝে বেঁধে রাখা হাত দুটো দিয়ে আওয়াদের পিঠ খামচে ধরে। তোহফার থেকে এমন কিছুরই যেন আশা করেছিলো আওয়াদ। তাই তো এবার থরথর করে কাঁপতে থাকা তোহফার গোলাপি ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দেয়। তোহফা নিজের ধারালো নখ দিয়ে এবার যেন আওয়াদের পিঠকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। তবে আওয়াদ, তাকে কে থামায় আজ। সে যে সকল ভালোবাসা শুষে নিতে ব্যস্ত। সকল ভালোবাসা নিংড়ে দেওয়ার মাঝে বিভোর। মিনিট যেতেই তোহফাকে এক ঝটকায় নিজের বুকের মাঝে নেয়। জোরে শ্বাস নিতে থাকে দু’জনেই। লজ্জায় তোহফা চোখ খুলে তাকাতেই পারছে না। তোহফার লজ্জা মিশ্রিত চেহারায় চুমু খায় আবারও। আওয়াদ তোহফাকে বুকে রেখেই বলে,

“এই বুকটা কখনোই খালি হতে দিও না তোহফা। তোমার বিরহ এই বুকটা নিতে পারবে না। হয়তো বেঁচে থেকে-ও বাঁচা হবে না। ”

তোহফা কিছু বলতে পারে না। সে চুপচাপ শুনতে থাকে আওয়াদের হৃৎস্পন্দন। যে স্পন্দন দ্রিম দ্রিম করছে। যেন বলছে, তোহফা তুমিহীন আওয়াদ শূন্য মরুভূমি। সেথায় শুধু বিরহের অনলে পোড়া ঝুরঝুরে বালি ছাড়া কিছু নেই। নেই একফোঁটা তৃষ্ণা মেটানোর পানি। তুমি আওয়াদের ভালোবাসার অঙ্কুর।”

“তোহফা আজকে প্রথম কেন যেন তোমাকে হারানোর ভয় হয়। কেন হচ্ছে বলতে পারো? তুমি আমার সাথে মিশে আছো তবুও যেন মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। কেন মনে হচ্ছে আমার বলবে?”

তোহফা আওয়াদের বুকে মাথা রেখেই বলল

“আপনার অচেতন মনটা চাচ্ছে এটা বলতে, আওয়াদ যতদ্রুত সম্ভব তোহফাকে তুমি তোমার ঘরে নিয়ে যাও।”

আওয়াদ তোহফার বাচ্চামো কথায় হাসে।

“আমারও মনে হয় তোমাকে যতক্ষণ আমার ঘরে না নিতে পারবো ততক্ষণ শান্তি হবে না।”

“তাহলে অপেক্ষা কেন? নিয়ে নিন।”

“তোমার দেখছি খুব তাড়া।”

তোহফা আওয়াদের বুকে দু’টো ঘুসি মেরে বলল,

“নিজের বুঝি কোনো তাড়া নেই?”

“আমার তাড়া নেই বলছো! আমি পারলে এখনি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাই।”

“সুন্দর বলতে আপনি কি বুঝেন আওয়াদ।”

“সুন্দর বলতে আমি তোমাকে বুঝি তোহফা। তোমার সরল চাহনী, শীতল পরশ আমার কাছে পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর। ”

“আমি ওই সৌন্দর্যের কথা বলিনি!”

“তাহলে?”

“আপনার চোখে আমি কতটুকু সুন্দর ?”

“সৌন্দর্য হচ্ছে সামনের মানুষটা আমার হৃদয়ে কতটুকু জায়গা নিয়ে বসবাস করছে তার উপর ডিফেন্ড। ভালোবাসার মানুষটি পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর তোহফা। আমার চোখে আমার ভালোবাসা ওই রাতের আকাশের বুকে একফালি চাঁদের মতো। মেঘলা আকাশের শীতল হাওয়া, পরন্ত বিকেলে মিষ্টি রোদ। খুব অস্থিরতায় একরাশ স্বস্তি। ”

আওয়াদ তোহফাকে নিয়ে ঘাসের বুক থেকে উঠে দাঁড়ায়। চারিদিকে তাকিয়ে বলে,

“এই যে প্রকৃতির এত রূপ সেটাও আমার তোহফা রাণীর কাছে ফিকে। চলো অনেক রাত হয়েছে এবার আমাদের ফেরা উচিত। ”

তোহফা আওয়াদকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। এই মানুষটা ঠিক তাকে কতটুকু ভালোবাসে এটা যদি সে মাপতে বসে হয়তো মাপার মেশিনটাও মাথা নুইয়ে পরবে। জীবনে এমন একটা মানুষ থাকলে আর কি লাগে? তোহফা চিন্তা রেখে মাথা দুলায়। এরপর দু’জনে দু’জনার হাত আঁকড়ে সামনে দিকে এগিয়ে চলে। সময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাতের অন্ধকারকে সঙ্গী করে তারা বাড়ি ফেরার পথে হাঁটে। তোহফা আওয়াদের হাত ধরে বলে,

“আমরা ফের একদিন এখানে আসবো। সেদিন আমাদের মাঝে আরো একজন থাকবে। আমরা সেদিন সুজন থেকে তিনজন হবো! ঠিক আছে?”

আওয়াদ মিষ্টি হেসে উত্তর দেয়,

“তার আগে কেন আসবে না?”

“কারণ কিছু মুহূর্ত জীবনে একবার আসাই ভালো। আজ যেমন আমরা দু’জনে ছিলাম! সেদিন আমরা তিনজন থাকবো। হয় সে আমার কোলে না-হয় সে আমার…..

বাকি কথাটা তোহফা শেষ করতে পারে না। তবে আওয়াদ তো লজ্জা শরমের আজ মাথা খেয়ে বসে আছে। তাই নিজ থেকেই বলল,

“নাহয় সে এখানে থাকবে।”

তোহফার পেটে হাত দিয়ে কথাটা বলে ওঠে আওয়াদ। তোহফা লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। এই ছেলে আজ তাকে লজ্জা দিয়ে দিয়ে মেরেই ফেলবে বলে বোধহয় ঠিক করেছে।

তোহফা ও আওয়াদ যখন বাড়ির গেট অবধি আসে তখন দূর হতে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের সুমধুর সুর। তোহফা ভয়ে আওয়াদের হাত চেপে ধরে বলে,

“মা নিশ্চয়ই নামাজ পরার জন্য উঠে গেছে। আমাকে দেখে ফেললে কি বলবো?”

আওয়াদ ভরসা সরূপ বলে,

“দূরের মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। এখানে দিতে হয়তো আরো কয়েক মিনিট সময় লাগবে। যদি সমস্যা হয় তাহলে চলো আমিও যাই।”

তোহফা বাঁধা দিয়ে বলে,

“না থাক।”

তোহফা এগিয়ে যেতেই আওয়াদ তোহফার হাত আঁটকে কাছে টেনে নেয়। তোহফার দুগালে হাত দিয়ে বলে,

“সাবধানে থাকবে।”

তোহফা মাথা দুলায়। আওয়াদ তোহফার কপালে চুমু একে দেয়। ইশারা করে বাড়ির ভেতরে যেতে। তোহফা মুচকি হেসে বাড়ির ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আওয়াদ নিচুস্বরে বলে,

“বেলকনিতে এসো একবার।”

তোহফা উত্তর না দিয়ে ভেতরে চলে যায়। ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে ঘরে প্রবেশ করে। ভয়ে তার মুখটা একটুখানি হয়ে গেছে। ভয় হচ্ছে পাছে কেউ তাকে দেখে না ফেলে। সদর দরজা খুলে কোনো সাড়া না দিয়েই নিজের ঘরে গিয়ে টুক করে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তখনই মনে পরে আওয়াদ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত পায়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। হাত নাড়িয়ে আওয়াদকে বোঝায় সে ঠিক আছে। কেউ দেখেনি। আওয়াদ চলে যায়। তোহফা ঘড়ির কাঁটায় সময় দেখে বুঝে এখন শুয়ে পরলে তার মা মিনিট পাঁচেক পরেই ডাকবে নামাজের জন্য। তার থেকে ভালো নামাজ পরে না-হয় ঘুমাবে আজ। যেই ভাবা সেই কাজ। চটজলদি ফ্রেশ হতে চলে যায় ওয়াশরুমে। ওজু শেষ করে ঘরে প্রবেশ করতেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ ভেসে আসে। দরজার ওপাশে ইলা ডাকছে,

“তোহফা উঠে পরো। ”

তোহফা মুখ মুছতে মুছতে বলে,

“আমি উঠে গেছি ভাবি। মা’কে বলো।”

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইলা যেন চমকে উঠলো। যে মেয়েকে ভয় দেখানো না পর্যন্ত ঘুম থেকে ওঠে না সে আজ নিজে থেকেই ঘুম থেকে উঠে গেছে আশ্চর্য। ইলা নিজের কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে বলেই বসলো,

“রাতে কি জেগে ছিলে ননদী রাণী! আজ ডাকার আগেই উঠলে যে।”

ইলার কথায় তোহফা দরজা খুলতে খুলতে বলল,

“কেন? আমি কি উঠতে পারি না?”

“হ্যাঁ পারো। তবে তোমাকে দেখে কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি রাতে ঘুমাও নি।”

তোহফা কিছুটা থতমত খেয়ে বলল,

“কি যে বলো না ভাবি। যাও তুমিও নামাজে গিয়ে দাঁড়াও। ”

একপ্রকার পালাই পালই ভাব নিয়ে তোহফা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ায়। ইলা কিছুক্ষণ ননদকে দেখে আচমকা কি ভেবে বিছানায় তাকায়। হায় আল্লাহ বিছানাও একদম পরিপাটি। তারমানে….. যা বোঝার বুঝে গেছে ইলা৷ মুচকি হেসে মনে মনে বলল,

“তাই তো বলি সদর দরজা খোলা কেন? ”

ইন শা আল্লাহ চলবে…….