#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব তেরো
মিনিট পনেরোর মধ্যে ঘরে ঢুকল নির্ঝর। স্বামীর বুকে আছে আছড়ে পড়ল সৃজিতা। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-তুমি সত্যি করে বলো মা কেমন আছে?
অনেকক্ষণ ধরে মাকে লক্ষ্য করছে ছোট্ট বুবলাই। মায়ের কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে অস্থির হয়ে উঠছিল। ঠিক কী কারণে মা কাঁদছে তা বোঝার ক্ষমতা একরত্তি শিশুর নেই। ভয় পেয়ে, কিছুটা সমব্যথী জানাতে নিজেও ভ্যা করে কেঁদে উঠল। ছেলের চোখের জল দেখে আরো অস্থির হয়ে উঠল।
-এই সৃজি শান্ত হও। দেখো ছেলেটা কেমন কাঁদছে।
আয় বাবা আয়।
দুই হাত দিয়ে মায়ের পা শক্ত ভাবে ধরে আরো জোরে কাঁদতে থাকল বুবলাই।
-আরে পুরো ব্যপারটা শোনো। তারপর কাঁদবে..
ছেলেকে কোলে নিয়ে কিছুটা শান্ত হল সৃজিতা।
-সবটা বলো..কিচ্ছু লোকাবে না।
-অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে দুই দিন আগেই। যতটা শুনলাম তাতে সেটাই বুঝলাম। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পেরিয়ে ব্লসমে যাচ্ছিল। তখন একটা গাড়ি ধাক্কা মারে। পড়ে যান উনি। ডান হাতটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
-বাপরে!
দুই চোখ উপচে জল ঝরতে থাকে।
-তুমি কি ওনাকে দেখতে যেতে চাও?
ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল সৃজিতা।
-তোমার দিদিকে ফোন করো। কখন গেলে দেখতে পাবে জিজ্ঞাসা করো। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
-দিদি অতবড় খবরটা আমাকে জানাল না? মায়ের কিছু অঘটন হলে কি জানত?
আবারো চোখের জলে ভাসল সৃজিতা।
-এইসব কথা এখন ছাড়ো। একবার ফোন করো। দেখো কী বলে..
-হ্যাঁ..তুমি বুবলাইকে একটু পরিষ্কার করিয়ে দাও।
সারা গায়ে ভাত মেখেছে বুবলাই। সে সব শুকিয়েও গেছে। তারে মেলা গামছা তুলে জলে ভেজাল নির্ঝর। তারপর ছেলের হাত ধরে টেনে জামা খুলিয়ে মুখ, গা মুছিয়ে দিল। কোলে করে ঘরে নিয়ে গিয়ে পরিষ্কার জামা পরিয়ে দিল।
-দিদিকে ফোন করলাম..
-কী বলল?
ছেলের মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞাসা করল নির্ঝর।
-মা এখন ঠিক আছে। অপারেশন সাকসেস ফুল। কাল জ্ঞান ফিরেছে।
-তারপর?
-আমাকে কাল যেতে বলল। মানে কাল বিকেল চারটায়। রিশেপসনে ভিজিটিং কার্ডটা থাকবে। নিয়ে নিতে হবে।
-কথা বলে হাল্কা হলে তো?
-মাকে দেখে কাল হবো।
স্মিত হাসল সৃজিতা।
স্ত্রীর হাসিতে একটু নিশ্চিন্ত হল নির্ঝর।
-তুমি দস্যিটাকে খেলনা দিয়ে বসাও। আমি খাবার দিচ্ছি।
চলে গেল সৃজিতা। খাটের তলা থেকে প্ল্যাস্টিকের গামলা বের করল নির্ঝর।তাতে খেলনা ভর্তি। ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে গামলাটা সামনে রাখল। গামলাটা গায়ে ঢেলে নিল বুবলাই। ওকে সামলানোর আগেই ফোন বেজে উঠল। ফোন কানে নিল নির্ঝর।
-আচ্ছা আচ্ছা..আমি যাচ্ছি। এই সৃজি..
ফোন রেখেই সৃজিতাকে ডাকল সৃজিতা।
-কী হল?
-আমি বেরচ্ছি। খেতে পারব না। ম্যানেজার স্যার ফোনে বলল স্টোরে এখুনি যেতে।
-কিছু মুখে দাও..
-না সৃজি..কিছু খেয়ে নেব।
ব্যস্ততার সাথে গাড়ির চাবি হাতে নিল নির্ঝর। কিছু না বলে ভাতের থালা নিয়ে ভাত মেখে দু মুঠো খাইয়ে শান্তি পেল সৃজিতা।
***
একদিন যেন পেরচ্ছে না। মাকে দেখার জন্য ছটফট করছে সৃজিতা। সর্বদা মায়ের সুস্থতা কামনা করছে। মাকে জন্য কিছু নিয়ে যাবে কিনা সেটা ভেবেই কাহিল হল সৃজিতা। যতই না খাক, কিংবা এখন না খেতে পাক তবুও মায়ের পছন্দের কিছু ফল নিয়ে যাবে সৃজিতা। সেই মত নির্ঝরকে ফর্দ করে দিল। সেইমত বেতের ট্রেতে সমস্ত জিনিস সুন্দর ভাবে প্যাকিং করে নিয়ে নির্ঝর। ছেলেকে নির্ঝরের কাছে রেখে পায়ে পায়ে আঠারো বি কেবিনে পৌঁছাল সৃজিতা।
উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছে সৃজিতা। প্রায় তিনবছর, তিনমাস পর মাকে দেখবে মেয়ে।
সাড়ে তিনটা থেকে ঘড়ির দিকে ঘনঘন তাকাচ্ছিল হৈমপ্রভা। সংযুক্তা সকালেই জানিয়েছে, বিকেলে সে নয় সৃজিতা মায়ের সাথে দেখা করতে আসবে। খবরটাতে নিশ্চিন্ত হয়েছিল হৈমপ্রভা। জ্ঞান ফেরার পর জৈষ্ঠ কন্যার পাশে কনিষ্ঠাকেও দেখতে মন চেয়েছিল। নিরাশ হয়েছিল হৈমপ্রভা। সংযুক্তার কথায় অনুচ্চারিত থাকলেও খুশি হয়েছে। কতদিন পর মেয়েকে দেখতে পাবে। মেয়েকে কী কী বলবে, জিজ্ঞাসা করবে তা একবার আউড়ে নিচ্ছিল।
দরজা খোলার শব্দে চোখ বন্ধ করল হৈমপ্রভা। মনে ইচ্ছে সৃজিতা যেন মা বলে প্রথমে ডাকে..
পায়ে পায়ে সৃজিতা বেডের কাছে এগিয়ে গেল। দেখল ওর মা ঘুমাচ্ছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
-মা!
সেই শব্দ হৈভপ্রভার কর্ণকুহরে পবেশ করে মস্তিষ্ক ও শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে গেল। ইচ্ছে পূর্ণ হল হৈমপ্রভার। চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
-কে?
তারপর পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে আবার বলল,
-সুজি?
হৈমপ্রভা ভেবেছিল কে বলেই থেমে যাবে, “কে “এর উত্তর সৃজিতা নিজে দিক। কিন্তু আপন আত্মজার কন্ঠে মন উতলা হয়ে উঠেছে। মস্তিষ্ককে হারিয়ে মেয়ের নাম উচ্চারণ করল হৈমপ্রভা।
মায়ের পায়ে হাত দিল সৃজিতা। সজল চোখে বলল,
-হ্যাঁ মা আমি..
চলবে:
#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_চোদ্দো
-কেমন আছিস তুই?
মেয়েকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আগেভাগেই প্রশ্ন করল হৈমপ্রভা। দুই চোখ উপচে জল এল সৃজিতার। নিজেকে লোকাতে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে তর্জনীর সাহায্যে চোখের জল ঝেড়ে ফেলল।
“মা তোমার এতই যদি চিন্তা তাহলে এতদিন খবর নাওনি কেন? আমাকে কি একেবারে ভুলে গিয়েছিলে”
অভিমান দূরে সরিয়ে মুখ খুলল সৃজিতা।
-ভালো আছি মা। তুমি এখন কেমন আছো?
হৈমপ্রভার অন্তরে উথালপাতাল শুরু হয়েছে। নিজের উপর সংযত থাকছে না। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে মন চাইছে। মস্তিষ্ক বাধা দিচ্ছে। বারংবার মনে করাচ্ছে সে হৈমপ্রভা সান্যাল। নিজের দুর্বলতা অন্যের নিকট প্রকাশ করা তার সাজে না।
-কেন যে মরলাম না..
না চাইলেও হৈমপ্রভার মুখ থেকে এই বাক্য উচ্চারিত হল।
-এসব আবার কী কথা মা? তোমার কিছু হলে আমাদের দুই বোনের কী হবে বলো তো..
-বস না এখানে..
বেডের পাশে টুল থাকতেও মায়ের গা ঘেঁষে বসল সৃজিতা। নার্স হেই হেই করে উঠল।
-ও আমার ছোটো মেয়ে। ও পাশে বসলে কিছু হবে না।
এই কি ওর সেই মা? যে ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল। বিশ্বাস হচ্ছে না সৃজিতার।
মায়ের চুলে হাত বোলাতে থাকল।
-বেশ ব্যথা রে..রাস্তা পার হচ্ছিলাম। তার মধ্যে মেরে দিল। এই বয়েসে কি আর সোজা হতে পারব?
-কেন পারবে না? ওষুধ ঠিক মতো খেলে আর খাবার খেলে ঠিক ভালো হয়ে যাবে। মা তোমার মাইগ্রেনের ব্যথাটা কমেছে।
-না রে মাঝেমধ্যেই ব্যথাটা জ্বালাতন করে।
-তুই কিসে এলি?
-ওর সাথে..ছেলেকে নিয়ে ও নিচে আছে।
থামল সৃজিতা। তারপর আবার বলল,
-ছেলেটাকে নিয়ে আসতাম। এখানে তো অ্যালাও করবে না।
-না না ভালো করেছিস। কত বড় হল?
-দু বছর তিন মাস। ফটো দেখবে?
ব্যাগ থেকে ফোন বার করে বুবলাইয়ের ছবি হৈমপ্রভার সম্মুখে ধরল সৃজিতা। এক মুখ হাসল হৈমপ্রভা।
-এ তো গোপাল ঠাকুর। হ্যাঁ রে খুব দুষ্টু হয়েছে?
মায়ের হাসি দেখে শান্তি পেল সৃজিতা।
-খুব দস্যি গো। সামলানো যায় না। কিচ্ছু খেতে চায় না। তবে ফলের উপর খুব ভক্তি। জানো মা, তোমার মতন সবেদা খেতে খুব ভালোবাসে।
-তাই..
মাকে কী কী প্রশ্ন করবে সেই মহড়া গতকাল থেকে আজ নাসিংহোমে ঢোকা অব্দি চলছিল। মাকে দেখে সব ভুলে গেল। কে বলবে তিন বছরের বিচ্ছেদ ছিল দুজনের, যেন ক্ষানিকক্ষণ আগের না বলা কথা সম্পূর্ণ করছে। এমনই ছিল মা-মেয়ের কথোপকথন..
বেশ গল্প জমেছিল মা-মেয়ের..
-ম্যাডাম ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ।
নার্স কঠিন সত্যটা জানিয়ে দিল। দুজনে থমথমে মুখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল। যেন আসামীকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে।
উঠে দাঁড়াল সৃজিতা।
-এবার যাই মা। তুমি ভালো থেকো।
মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল সৃজিতা। হৈমপ্রভাও মেয়ের চিবুক স্পর্শ করে চুম্বন করল। বাইরের দিকে পা বাড়ালো সৃজিতা। দরজা পৌঁছেও ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। অন্তঃস্থল কেঁপে উঠল হৈমপ্রভার। মেয়ের স্পর্শে কেমন স্তব্দ হয়ে গেল। এর মধ্যেই গেট ঠেলে বাইরে চলে গেল সৃজিতা।
কষ্ট পেলেও হৈমপ্রভা নিজের অহং ত্যাগ করে মেয়েকে নিমন্ত্রণ জানাতে পারল না। সৃজিতাও হৈমপ্রভার কন্যা। সান্যাল ম্যানসন নিয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করল না। বাড়ি ফেরার প্রসঙ্গ দুজনের কাছেই অব্যক্ত থাকল।
সজল চোখে নির্ঝরের কাছে পৌঁছাল সৃজিতা।
-কেমন আছেন উনি?
-ভালো।
-তাহলে কাঁদছ কেন? কদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।
-মা আমাকে একবারো বাড়িতে যেতে বলল না..
মনে মনে প্রমাদ গুনল নির্ঝর।
-তুমি যেমন..এই সময় কি তার মনে থাকে? ওষুধের ঘোরের মধ্যে থাকবেন।
-মা ঠিক আছে। জ্ঞানও টনটনে। কিন্তু বলল না..আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরব না। কখনো ফিরব না।
অভিমানে টসটস করছে সৃজিতা। ছেলেকে কোলে নিয়ে স্ত্রী হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল।
***
পরেদিন, সকাল সাড়ে দশটা:
শুয়ে শুয়ে সময় দেখছে হৈমপ্রভা। কাল ওর ছুটি হবে। সকালের ভিজিটিং আওয়ার্সে কেউ আসবে না। সংযুক্তা একেবারে বিকেলে আসবে। হসপিটালের বেডে শুয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। ডাক্তার যদি অনুমতি দিলে বাড়ির ফেরার সময় ব্লসম হয়ে যাবে। হেম ফ্যাক্টারী নিয়ে চিন্তা নেই, ম্যানেজার সামলে নেবে। দুশ্চিন্তা শুধু ব্লসমকে নিয়ে…
চোখ বন্ধ করে মনে মনে হিসাব করছিল।
-হৈমপ্রভা..
পরিচিত অথচ অনিয়মিত কন্ঠে মস্তিষ্ক সজাগ হল। চোখে খুলে সোজা হয়ে বসল। সাদা গোলাপের ফুলের তোড়া পাশে উঁকি মারছে সেই পৌঢ়ের মুখাবয়ব।
বুকে মধ্যে দশটা হাতুড়ি পেটানো শুরু হল হৈমপ্রভার।
-আপনি?
চলবে: