অস্তরাগের কলি পর্ব-৫+৬

0
479

#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_পাঁচ

সাদা ফুল হাতা শার্ট আর ডেনিম পরে ‘সোনা’ ফ‍্যাক্টারির অফিসে প্রবেশ করছিল নির্ঝর। ঢোকার মুখে সিকিউরিটি রাস্তা আটকালো।
-কাকে চায়?
-আমাকে তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত ডেকেছেন।
-ও স‍্যার? কী দরকার? অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছেন?
ফোনের মেসেজটা খুলে দেখাল নির্ঝর।
-যান ওখানে গিয়ে বসুন। আমি রিসেপশনে বলে দিচ্ছি।
কালো সোফাতে গিয়ে বসল নির্ঝর। সামনের রিসেপশনের ছেলেটা তাকালো নির্ঝরের দিকে..
অফিসটা তেমন কিছু আহামরি নয়। সিকিউরিটি আর রিসেপশনের ছেলেটা ছাড়া কেউ নেই। হয়ত এই ভাবে কেউ আসে না..
এটাই ভাবল নির্ঝর।

বসে থেকে এদিক ওদিক পর্যবেক্ষণ করছিল নির্ঝর। তখুনি কোণে সি সি ক‍্যামেরাটা নজরে এল। সোজা হয়ে বসল নির্ঝর। কে বলতে পারে অন‍্য কোনো রুম থেকে যদি তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত নজর রাখে। এই ভাবে আরো মিনিট পাঁচ কাটল। রিসেপশনের ছেলেটা লম্বা হাই তুলল। ছোঁয়াচে রোগের মতন নির্ঝরের উপর সেই প্রভাব পড়ল। লম্বা হাই তুলল নির্ঝরও। হাইয়ের আর দোষ কী! পেটে ভাত পড়লে তো ঘুম পাবেই..
-এই দুপুরে কেউ ডাকে?? আজব মানুষ বাবা!
ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হচ্ছে নির্ঝর।
-হ‍্যালো ইয়ং ম‍্যান..কতক্ষণ এসেছো?

নির্ঝরের সামনে একজন ঋজুকায় পৌঢ় এসে দাঁড়াল। সঠিক বয়স নির্ধারণ করা নির্ঝরের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল।
জোর করে চোয়াল খুলল নির্ঝর।
-মাত্র কিছুক্ষণ আগে।
নির্ঝরের কথায় বিনয়। বাইরে থেকে তীর্থঙ্করকে আসতে দেখে নিশ্চিন্ত হল।
-উহু..স্ক্রিন বলছে তুমি প্রায় কুড়ি মিনিট আগে এসেছো। শেষের দিকে তুমি বিরক্ত হয়ে পড়েছিলে। তোমার ঘুম আসছিল..

তীর্থঙ্করের কথায় প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে বুঝল ফোনের স্ক্রিনে উনি নির্ঝরকে লক্ষ্য করছিলেন।
“আচ্ছা ঘোড়েল লোক তো!
-না.. মানে..অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে হাই উঠছিল।
প্রথম উক্তি মনে রেখে, দ্বিতীয় বাক‍্যটা উচ্চারণ করল নির্ঝর।
-এমনি সিচুয়েশন পরে আসতে পারে। তখনো কি তুমি ঘুমাবে?
গা জ্বলে উঠল নির্ঝরের। এইভাবে ডেকে অপমান করার মানে কী? হৈমপ্রভা সান‍্যালের ঝাল কি ওর উপর মেটাবে?
সৃজিতার উপর অসন্তোষ্ট হল নির্ঝর।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল নির্ঝর।
-আরে কেবিনে এসো।
একটা কাঁচের দরজা ঠেলে ভিরতে ঢুকল তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত। আদেশ পেয়ে নির্ঝর তাকে অনুসরণ করল..
একটা আট বাই আটের ছোট্ট কেবিন। ঘরে রাখা একটা কাঠের টেবিল। টেবিলের এক পাশে নরম গদির আধুনিক চেয়ার। অন‍্য পাশে দুটো কাঠের চেয়ার। নরম গদির চেয়ারে নিজে বসে নির্ঝরকে বসতে আমন্ত্রণ জানাল।
-তুমি কি জানো আমি তোমাকে কেন ডেকেছি?

সম্পূর্ণ ঘরে চোখ বোলানোর আগেই তীর্থঙ্করের প্রশ্ন ধেয়ে এল।
-না..
সহজ ভাবেই উত্তর দিল নির্ঝর।
-তুমি হৈমপ্রভার জামাই তো?
-আমি নির্ঝর সেন। আমার স্ত্রীর নাম সৃজিতা সান‍্যাল।
বিরক্ত গোপন করে বলল নির্ঝর।
-আচ্ছা আচ্ছা..যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। বর্তমান চাকুরীতে যা টাকা পাও তাতে সংসার চলে যায়? ঘরে অসুস্থ মাও আছে না?
সামান‍্য অবাক হল নির্ঝর। এই লোকটা ওর দৈনন্দিন জীবনে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে যেনে আরো বিরক্ত হল।
-ইয়ং ম‍্যান আমার উপর বিরক্ত হচ্ছো? আর ধৈর্য্য রাখতে পারছ না?
-না না তাই নয়..
কাষ্ঠ হাসল নির্ঝর।
-ধৈর্য‍্য রাখতে হবে। পরিশ্রমী হতে হবে নাহলে হৈমপ্রভার মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে কী ভাবে?
ভিতরে ভিতরে উতপ্ত হচ্ছে নির্ঝর।
-আপনি ঠিক কী জন‍্য আমাকে ডেকেছেন?
নির্ঝরের কথায় বাঁকা হাসল তীর্থঙ্কর।
-হৈমপ্রভার মেয়েকে বিয়ে কেন করলে? টাকা-সম্পত্তির লোভে?

লোকটা সত‍্যি কি হৈমপ্রভার প্রতিদ্বন্দ্বী! না মিত্র? ভাবাচ্ছে নির্ঝরকে..কান গরম হয়ে উঠল। আর সহ‍্য হল না নির্ঝরের। টেবিল চাপড়ে উঠে দাঁড়াল।
-আপনার কী মনে হয়? আমি টাকার জন‍্য সৃজিতাকে বিয়ে করেছি? বিয়ে যখন করেছি, যাবতীয় দায়িত্ব আমিই নেব। কারুর কাছে হাত পাতব না। এই ভাবে ডেকে অপমান করবেন জানলে আসতাম না..
বাইরের পথ ধরছিল নির্ঝর।
-আরে আরে চটছো কেন? কথা তো এখনো শুরু হয়নি।
তীর্থঙ্কর কথা না শুনে কেবিনের বাইরে পা রাখল নির্ঝর।
-নির্ঝর!
তীর্থঙ্করে কন্ঠের তীব্রতায় পদযুগল থমকে গেল নির্ঝরের। এক রাশ রাগ নিয়ে ফিরে তাকাল।
-মাথা ঠান্ডা করে এখানে বসো। অসিত এক গ্লাস জল আনো তো..বসো এখানে।
আবার চেয়ারে বসল নির্ঝর।
-আমি এতক্ষণ তোমার তেজ দেখছিলাম। যা দেখার আমার দেখা হয়ে গেছে। তুমি সোনা কোম্পানিতে সুপার ভাইজার পোস্টে জয়েন করেছ।
অবাক হল নির্ঝর। চোখের পাতা ঘন ঘন পড়তে থাকল।
-এখন ত্রিশের মতন হাতে পাবে। ছয়মাস পর বাড়বে।
মুখ থেকে কথা সরছে না নির্ঝরের। বারো থেকে মাইনে এক ঢাক্কায় ত্রিশ। লোকটা সত‍্যি বলছে তো?
-এখন বাড়ি যাও। কাল মেয়েকে নিয়ে আসবে।
-মেয়ে?
-হ‍্যাঁ আমার মেয়ে। তোমার স্ত্রী সৃজিতা সেন..
অবাক হওয়ার পালা শেষ হচ্ছেনা নির্ঝরের। ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
-আনব..

আরো কিছু কথা মিটিয়ে পনেরো মিনিটের মধ‍্যে চলে গেল নির্ঝর। নির্ঝর যেতেই ডিম্বাকৃতি স্বচ্ছ পেপার ওয়েটটা টেবিলে লাট্টুর ন‍্যায় ঘোরাতে থাকল তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত। মুখে বাঁকা হাসি এনে বলল,
-আজ থেকে নতুন খেলা শুরু হল।
চলবে:

#অস্তরাগের_কলি
#সঞ্চারী_চ্যাটার্জী
#পর্ব_ছয়

দশ দিন পর:
দুপুর তিনটা, সবে পেপার খুলে চেয়ারে বসেছে হৈমপ্রভা। বিগত নয় দিনে ওর দৈনন্দিন নিঘন্ট এলোমেলো হয়েছিল। আজ আবার পূর্বের রুটিন পুনরাবৃত্তি হয়েছে। দিন সাত ফ‍্যাক্টারির অফিসে যায়নি। এমন কি এক্সক্লুসিভ শো রুমে এখনো পা রাখে নি। সবটা ওর বিশ্বস্ত লোকজন সামলাচ্ছে।
শুধু মন না শরীরের দিক থেকে ভেঙে পড়েছেন। একধাক্কায় বয়স অনেকটা বেড়ে গেছে। চোখের তলায় কালি। কাচা পাকা চুলে জট পড়েছে।
বড় মেয়ে সংযুক্তাকে সঠিক সময়ে পাত্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। জামাই যথেষ্ট ভালো, হৈমপ্রভার মনের মতন। উচ্চ পোষ্টে চাকরীজীবি, তাছাড়া পারিবারিক ব‍্যবসাও আছে। সংযুক্তা “ব্লসম” শোরুমে দায়িত্বে আছে। এখন ছেলে ছোট, তাই নিয়মিত যেতে পারে না। ছোট মেয়েকে “হৈম” ফ‍্যাক্টারির দায়িত্ব দেওয়ার ইচ্ছে ছিল ওর। কিন্তু কোন দিনই ব‍্যবসার ভালো মন্দের দিকে মাথাব্যথা ছিল না সৃজিতার। নিজের খেয়ালে চলত। মেয়েদের নিয়মানুবর্তিতার মধ‍্যে রাখলেও দুই মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন । মেয়েরাও স্বাধীনতার অপব্যবহার করে নি। এম.বি. এ শেষ করার পর বড় মেয়ের সম্মতি নিয়ে বিবাহ স্থির করেছিলেন হৈমপ্রভা। ছোট মেয়ের ক্ষেত্রেও তাই করত। কিন্তু তার আগেই কঠিন সত‍‍্যিটা মাকে জানিয়েছিল সৃজিতা। ভালোবেসে বিয়েতে কোনোদিনই অমত ছিল না হৈমপ্রভা সান‍্যালের। চাওয়ার মধ‍্যে ছিল।
ছেলেকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তার পরিবারও যেন অভিজাত হয়। ছোট মেয়েকে নিয়ে ওঁর কোনো স্বপ্ন সত‍্যি হল না। মুখে কালি লেপন করে, মান সম্মান ধুলোতে মিশিয়ে, একরাশ কষ্ট উপহার দিয়ে ঘর ছেড়েছে সৃজিতা।
একজন মা সর্বদা চাই তার সন্তান যেন সৎ ও প্রতিষ্ঠিত পাত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। ভবিষ্যত জীবন যেন তার সুরক্ষিত থাকে। মোটকথা সন্তান যেন ভালো থাকে। এই চাওয়ার মধ‍্যে কোনো অন‍্যায় নেই। আছে অনেকটা দায়িত্ববোধ আর এক আকাশ অন্ধ স্নেহ।
প্রথম পাতার হেডিংয়ে চোখ বুলিয়ে ভিতরে পাতা গুলো খুলল হৈমপ্রভা সান‍্যাল। একটা লম্বা হাই তুলল। মন অস্থির থাকলে বোধহয় শরীরও তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পড়তে ইচ্ছে করছিল না।পেপারটা ভাঁজ করে ভাত ঘুমের জন‍্য প্রস্তুতি নিচ্ছছিল হৈমপ্রভা। সেই মত পেপারটাকে ভাঁজ করে বালিশের পাশে রাখতে উদ‍্যত হল। চশমা খোলার সময় আবার নজর পড়লো পেপারের তিন নম্বর পাতার মিডিয়াম সাইজের হেডিংয়ে। ভাঁজ করা পেপারটা বিছানায় মেলে ধরল হৈমপ্রভা।
তাতে লেখা ” বিখ‍্যাত শিল্প পতি তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত একজন অনাথ ছেলেকে সোনা কোম্পানির গুরুদায়িত্ব দিল”
নিজস্ব সংবাদদাতা: তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত নামটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। কিন্তু তার দরাজ মনের খবর অনেকেই জানেন না।” হৈম” কম্পানির বর্তমান মালিক হৈমপ্রভা সান‍্যালের কনিষ্ঠা কন‍্যা এক বেকার যুবককে বিবাহ করেন। ফলস্বরূপ কন‍্যা ও জামাইকে ত‍্যাগ করেন হৈমপ্রভা দেবী। খবরটা জানতে পেরে সেই ছেলেটাকে ডেকে পাঠান উনি….
সম্পূর্ণ খরবটা পড়ার রুচি বা ইচ্ছে কোনটায় তার হল না হৈমপ্রভার। পেপারটাকে দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। যত রাগ গিয়ে পড়লো প্রতিবেদকের উপর। তারপর “তীর্থঙ্কর দাশগুপ্ত” নামটাতে রাগে ফেটে পড়ল বছর সাতান্নের পৌঢ়া।
-সব ঐ লোকটার কারসাজি। বুড়ো বয়েসেও শত্রুতা গেল না। আমাদের কোম্পানিকে অপদস্ত করে উনি কী সুখ পান কি জানি! ছেলেটা ঐ বুড়োর পূর্ব পরিচিত নয় তো? হয়তো ইচ্ছে করেই সুজির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। ওর আর আমাদের ক্ষতি করার জন‍্য… হওয়ার চ‍্যান্স প্রবল।
মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করতেই আবারো কান্নায় ভেঙে পড়ল হৈমপ্রভা। সাথে সাথেই মুখে কাপড় চাপা দিল। ওর কান্না একান্ত, একবারে একান্ত। মানুষের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে ওর প্রবল আপত্তি। বাইরের মানুষজনদের নিজের অন্তরের অবস্থা দেখাতে চায় না। নিজের দুর্বলতাকে সর্বদা ঢেকে রাখে হৈমপ্রভা।
-বৌদি মনি একবার দরজা খুলবে?
দরজায় টোকা পড়ল। সেই সাথে শোনা গেল দিপালীর গলা।
দরজা ঠেসানো আছে, দিপালিও সেটা জানে। আসার অনুমতি চাইছে মাত্র। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চোখ মুখে নিজেকে সামলালো হৈমপ্রভা। এক ঢোক জল খেল তারপর দিপালীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-একটু দরকার আছে বৌদি মনি, তাই ডিসটার্ব করছি।
-ভিতরে এসো।
অনুমতি পাওয়া মাত্র ভিতরে এল দিপালী।
একটা খাম বাড়িয়ে দিল হৈমপ্রভার অভিমুখে।
-আর্জেন্ট লেখা আছে, তাই এই সময় এলাম।
-আচ্ছা। তুমি যে ইংরেজিটা পড়তে পেরেছো দেখে আমি খুশি হয়েছি।
নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল হৈমপ্রভা।
গৃহকর্ত্রীর প্রশংসায় খুশি হল দিপালী।
চওড়া হেসে সেই স্থান ত‍্যাগ করল। গোলাপি খামটা হাতে নাড়াচাড়া করতে থাকল। ভিতরটা বেশ ভারী। কৌতূহল বাড়ছে।
খামে প্রেরণ কর্তার নাম লেখা নেই। দুরুদুরু বুকে খাম খুলল হৈমপ্রভা। তারপর দুই নয়ন স্থির হল..

-এসব কী!
চিৎকার করল হৈমপ্রভা।
চলবে: