আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৩৭

0
521

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৩৭.

সমারোহর বুকে মাথা রেখে চুপচাপ আধশোয়া হয়ে আছে কুহেলী। একদম শান্ত আর চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। মাঝে মধ্যে হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। রাত তখন নয়টা। ঘরের এক কোণে কেরোসিনের কুপির ঢিমঢিমে আগুন বাতাসের হেঁয়ালিপনায় নেচে চলেছে অনবরত। সে লালচে আভা যখন কুহেলীর মুখে পড়ে মেয়েটাকে ভীষণ রকম মায়াবী মনে হয়। অপলক আকাশে চেয়ে থাকা মেয়েটার চেহারার প্রগাঢ় অশুভংকর চাহনি উতলা করে তোলে সমারোহর হৃদয়। সমারোহ সামলে চলতে পারেনা, নিজেকে খুব দুর্বল মনে হয় কুহেলীর কাছে। মনে চলে তোলপাড়। কি আছে এই কল্পলতার মৃত চাহনিতে? জানে না সমারোহ। জানতে ইচ্ছে ও করে না। কেবলই এই মেয়েকে খুশি দেখতে চায় সে। তার ঠোঁটের একটুকরো হাসির জন্য যত ব্যাকুলতা তার। অথচ কুহেলী তার মনে খবর জানেই না! সমারোহ তপ্তশ্বাস ফেলে। কুহেলীর চুলে বিলি কাটতে কাটতে অস্ফুট স্বরে বলে,

‘ একদিন তোমাকে আমাকে, আমাদের সবাইকে যেতে হবে পৃথিবী ছেড়ে। কেউ আগে যাবে আর কেউ পরে এই কেবল পার্থক্য! আমরা আল্লাহর জন্য এসেছি এবং তারই কাছে ফিরে যাবো। আমরা প্রিয় কারো মৃত্যুতে কান্না করি। বিচ্ছেদের কষ্ট! তবে পুনরায় অনন্তকালের জন্য মিলিত হওয়ার জন্য এই সামান্য বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কি কম নয়! ‘

কুহেলী একবার মাথা তুলে সমারোহর দিকে তাকায়। সমারোহর বুক ছ্যাৎ করে উঠে। কুহেলীর চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। অনুভূতিশূন্য চাহনি তার। যা বলছিল আউরে যায় সব। সুর কেটে যায় কথার। সমারোহ খুঁজে পায়না কেনো এই মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে দুনিয়া ভুলে বসে সে! এই চোখেই একদিন ভয়ংকর মৃত্যু হবে তার! সমারোহকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে সমারোহর কাছ থেকে সামান্য সরে বসে কুহেলী। সমারোহ চোখ সরিয়ে নিয়ে কুহেলীকে আবার কাছে টেনে নেয়। আকাশে তাকিয়ে বলে,

‘ একজন মানুষ যখন মারা যান তখন তার জন্য কাঁদতে নেই। মৃত ব্যক্তির জন্য চিৎকার করে কাঁদলে তার জন্য মৃত ব্যক্তির কবরে আজাব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তুমি কুঞ্জার জন্য দোয়া করবে, তার গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করবে। মৃত্যুর পর তোমাদের আবার জান্নাতে দেখা হবে, সেখানে বিচ্ছেদ নেই। নেই হারাবার ভয়। তখনকার কথা ভাবো। কতোই না সুন্দর হবে সে মুহূর্ত! ‘

কুহেলী নিজের অজান্তেই মুচকি হাসে সমারোহর কথা শুনে। সমারোহ কুহেলীকে হাসতে দেখে খুশি হয়ে যায়। এই হাসিটাই তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান! হঠাৎই কুহেলী সমারোহর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,‌

‘ সেখানে আপনিও থাকবেন তাই না! আমার কাছে। ‘

সমারোহ চমকে উঠে কুহেলীর কথা শুনে। কুহেলী খুশি হয়ে সমারোহর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মুখ ফসকে বলে ফেলেছে কথাটা। দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয় সে। সমারোহ চুপিসারে হেসে ফেলে। উঠে গিয়ে মোবাইল আনতে আনতে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘ আম্মু ফোন দিয়েছিল তোমার সাথে কথা বলার জন্য। কল দিব একবার? কথা বলবে? ‘

কুহেলীর সামান্য লজ্জা লাগে সমারোহর সাথে কথা বলতে। খুব কষ্ট করে যেন কুহেলী উচ্চারণ করে,

‘ হুঁ দিন। ‘

সমারোহ কথা না বাড়িয়ে আনরুবাকে কল করে। কল রিসিভ করে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আনরুবা বলেন,

‘ কেমন আছোস বাবা? এমন একটা সংবাদ শুনতে হবে কল্পনাও করি নাই কোনোদিন। ভাই, ভাবীর কি অবস্থা? কেমন আছে সবাই। ‘

‘ মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাকিরা ভালো আছেন। তোমার আর আব্বার শরীর কেমন আছে? ‘

‘ আল্লাহর রহমতে ভালো। কুহেলী কি করতেছে? কাঁদতেছে এখনো? ‘

সমারোহ মিনমিনে গলায় বলে, ‘ হুম, কথা বলো ওর সাথে। ‘

সমারোহ কুহেলীর কাছে ফোন দিলে কুহেলী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘ আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি। ভালো আছেন? ‘

‘ হ্যাঁ মা আছি। তুমি কেমন আছো? ‘

‘ ভালো। ‘ সংক্ষিপ্তে বলে কুহেলী।

‘ মা তোমারে সান্তনা দেয়ার ভাষা আমার নাই আর দিতে চাইও না। শুধু বলবো, কার কখন মৃত্যু হয় আমাদের জানা নাই। কুঞ্জার কথা শুনে অনেক কষ্ট পাইছি আমি। দুনিয়াটা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি দেখো যেই নোংরা মনের মানুষগুলো আছে এর পিছনে তারা ঠিকই শাস্তি পাবে। আল্লাহর বিচার খুবই সূক্ষ্ম। বিশ্বাস রাখো, ধৈর্য ধরো। আল্লাহ তোমারে শক্তি দিক। ‘

কুহেলী আবার হুড়মুড় করে কেঁদে উঠে আনরুবার কথা শুনে। নাক টানতে থাকে। সমারোহর কষ্ট হয় কুহেলীকে দেখে তাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে কিছু সময়ের জন্য। কুহেলীর কান্নার আওয়াজ শুনে আনরুবা নরম হয়ে বলেন,

‘ তুমি না খুব স্ট্রং মেয়ে আমার? কাঁদে না মা। তুমি ভেঙ্গে পড়লে খোর্শেদ ভাই আর হাসনা আপারে কে সামলাবে বলো? তোমাকেই হাল ধরতে হবে এবার নাকি? যে অন্যের হাঁসির দায়িত্ব নেয় তাকে নিজের কষ্ট লুকাতে শিখতে হয়, জল আনতে নেই তার। ‘

কুহেলী হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে। ভাঙ্গা গলায় বলে,

‘ হুম কাঁদবো না কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কুঞ্জা! আমি মানতে পারছি না। ‘

‘ সহ্য করতে হবে। বাস্তবতা মানতে হবে। আঘাত না পেলে হৃদয় শক্ত হবে কিভাবে? কুহেলী তোমার মনে আছে তুমি একবার নয়নাকে কি বলেছিলে? আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেন, তাকে পরীক্ষা করেন। তার চোখের জল দ্বারা তার ধৈর্যের পরীক্ষা নেন। মনকে বিশুদ্ধ করেন। এখন তোমার ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহর দেয়া হায়াতের উপর আমাদের কারো হাত নেই। সবকিছু ভালোর জন্য হবে। আমরা কুঞ্জাকে ভালোবাসি, আমরা তার জন্য দোয়া করবো। ‘

‘ জ্বি। ‘

প্রসন্ন হেঁসে উত্তর করে কুহেলী। আনরুবাও চোখ মুছে হালকা হাসেন। ভেজা কোমল কন্ঠে বিড়বিড় করে বলেন,

‘ আমার সন্তানদের হাসিতে যেন কারো নজর না লাগে। শোনো, নিজের খেয়াল রাখবা। সান্দ্রর কাছে আমি শুনেছি, কুঞ্জা তোমাকে খুব বেশি ভালবাসতো। মৃত্যুর পর মানুষ দুনিয়াবি চিন্তা থেকে মুক্ত কিন্তু ও যদি থাকতো হয়তো তোমারে এভাবে দেখে কষ্ট পেতো। নিজেকে খুশি রাখতে হবে সবসময়। সন্তান হয়ে আব্বা আম্মার কষ্ট কমাতে সাহায্য করবা। আমার দোয়া আছে তোমার সাথে। ‘

‘ জি আন্টি। ওখানে সবাই ভালো আছে? ‘

‘ হ্যা আছে আরকি। নয়নার শরীরটা এই খারাপ তো এই ভালো। এইভাবেই চলছে। তোমার কথা মনে করে খুব। আচ্ছা মা, রাত তো হইলো একটু ঘুমাও এবার। ‘

‘ সাবধানে থাকবেন। ‘

‘ আচ্ছা মা। আল্লাহ হাফেজ। ‘

‘ আল্লাহ হাফেজ। ‘

ফোন কেটে চোখ মুছে ঘর থেকে বের হয়ে দেখে উঠানের ঠিক মাঝখানে বসে আছে সমারোহ। চাঁদের আলোয় সে চেহারার ক্লান্তি স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। কুহেলীর মন খারাপ এবার দিগুন হয়ে যায়। সকাল থেকে লোকটা বাড়ির সবাইকে সামলে যাচ্ছে। কখনো কুহেলীর মন শান্ত করছে তো কখনো তার আম্মাকে সান্তনা দিচ্ছেন। সমারোহর সাথে কথা বলার পর থেকে হাসনাহেনার কান্নার শব্দ আর পাওয়া যায়নি তবে দরজায় খিল এঁটে বসে আছেন তিনি। অথচ তাকে গ্রামে পৌঁছে দিতে গিয়েই কতো কিছু গেলো মানুষটার উপর দিয়ে। না চাইতেই হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো কুহেলীর সঙ্গে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটাই হয়তো তিনি নিজে নিতে পারেননি। আলো আপুর সাথে তো বিয়ের কথা চলছিল! তপ্ত শ্বাস ফেলে কুহেলী। আর বিয়ে হওয়ার পর যেখানে তার জামাই আদর খাওয়ার কথা ছিল সেখানে চুপচাপ কেবল শ্বশুর বাড়ির প্রতি দায়িত্ব পালন করছেন! এমন ভাবে পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন যেন পরিবারটা কুহেলীর থেকেও বেশি তাঁর আপন হয়ে গিয়েছে। তারপরও ক্লান্তি নেই মানুষটার।

কুহেলী উরনা দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে সমারোহর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মিনমিনে গলায় বলে উঠে,

‘ আপনি ঘরে আসুন, আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি। ‘

‘ খিদে নেই আমার। ‘

‘ বললেই হলো? কাল রাত থেকে এখন অবধি কিছুই খাননি, চলুন। ‘

‘ তুমিও তো খাওনি। ‘

সমারোহর কথায় চুপসে যায় কুহেলী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলে,

‘ ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নেব। ‘

‘ মা, বাবা, দাদু কেউ খেলো না আর আমি খেয়ে নেব! ‘

‘ আপনি এই বাড়ির জামাই। যা কিছুই হোক না কেনো জামাই না খেয়ে আছে শুনলে আম্মা আব্বা খুব কষ্ট পাবেন। ‘

‘ কেনো? জামাই কি পর নাকি যে কেউ না খেয়ে থাকলেও তাকে ভালো মতো খেয়েদেয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরতে হবে‌! ‘

সমারোহর কথা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকায় কুহেলী। অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে যায় সে। ইতস্তত করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,

‘ আমি কিন্তু এভাবে বলতে চাইনি কথাটা। ভুল বুঝছেন আমাকে। না খেলে দুর্বল হয়ে পড়বেন। ‘

‘ সবাই যখন খাবে তখন ডেকো খাব। ‘

কুহেলী ঠাওর করতে পারে সমারোহকে কিছু বলে আর লাভ হবে না‌। নাছোড়বান্দা সমারোহ। তাই তার মতামতে সম্মতি দিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে,

‘ আপনি ঘরে যেয়ে রেস্ট নিন। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি দাদীমার ঘরে যাচ্ছি। ‘

‘ হুম। ‘

কুহেলী চলে যায়। সমারোহ চুপচাপ তার যাওয়া দেখে। কুহেলী তাকে একা রেখেই চলে গেছে, কুহেলীর সত্যিই তার প্রতি কোন অনুভূতি নেই! ঘরে চলে আসে সমারোহ।

ফজরের নামাজের পর কুঞ্জার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নিয়ম মোতাবেক দাফন কার্য সম্পাদন করার পর খোর্শেদ স্কুলে চলে যান। পারিবারিক সমস্যার কারণে এর আগেও তিনি কখনোই তার কাজ থেকে দূরে থাকেননি। আজও থাকবেন না। স্কুলের বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালে হয়তো কষ্ট আরো কমে আসবে। হাসনাহেনা ও সকাল থেকে একদম কাঁদেননি। মনকে শক্ত রেখেছেন। বাড়ির কাজকর্ম করছেন ধীরে সুস্থে। তাকে দেখে প্রায় সবাই অবাক। ভেতরের কাল বৈশাখী ঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়া হৃদয় নিয়ে দিব্বি কাজ করছেন তিনি। দুনিয়ার সব রং যেন তার কাছে এখন ফ্যাকাসে।

পুকুর ধারে বসে বসে পানিতে ঢিল ছুঁড়ছিল রজব। কুঞ্জার মৃত্যুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী মনে করে নিয়েছে। পুরনো স্মৃতির ক্ষত মৃত্যুলগ্ন পর্যন্ত পীড়া দেয়। উদ্ভ্রান্ত পথিকের ন্যায় মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েও এর থেকে পালানো অসম্ভব। রজবও পালাতে পারছে না। এই দিনগুলো তার সবচেয়ে বিচ্ছিড়ি দিন ছিল। যেন সে সব হারিয়ে নিঃস্ব গেছে! পানি ঢিল ছোঁড়ার ফাঁকেই রজব খেয়াল করে সমারোহকে। সাদা সুতি পাঞ্জাবী পড়া সমারোহকে দারুন লাগছে। গোল টুপিটাও মাথায় চমৎকার মানিয়েছে। শহুরে মানুষ তো একদম ফিটফাট! চমৎকার মানুষ বটে। তবে ইদানিং সমারোহকে কেনো যেন সহ্য হয়না তার। সমারোহর আশেপাশে থাকতে ইচ্ছা করে না একদম। সমারোহর কান্ডে বেজায় বিরক্ত হয় সে। সমারোহ এসে তার থেকে দুই সিঁড়ি উপরে বসেছে। রজব পাত্তা না দিয়ে উল্টো দিক মুখ করেই বসে থাকে। কাঁদছিল সে। কান্নার মাঝে ডিস্টার্ব ছাড়া আর কিছুই না। সমারোহ বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ বসে থাকে। রজব আর চুপ থাকতে না পেরে বলেই ফেলে,

‘ আপনে এনে গরমে বইয়্যা আছেন কেন? বিদ্যুৎ কি আবার গেছেগা? ঘরে বসেন। চাচী অহনি খাইতে ডাকবো আপনেরে। ‘

সমারোহ হালকা হাসে। রজবের ফ্যাসফ্যাসে গলায় জেদ আছে! তবে তার কোনো কারণ ছাড়াই অসহ্য লাগে রজবকে। যদিও রজবকে ঠিক অপছন্দ করে না তবে সমারোহর সাবকনশাস মাইন্ড পছন্দ করে না তাকে। সমারোহ রজবের প্রতিউত্তরে কেবল হাসে। রজবের এবার মেজাজ গরম হয়। চোখ গরম করে বলে,

‘ হাসেন কেরে? আমি কি জোকার নাকি? ‘

‘ মনে হয়। ‘

বিড়বিড় করে সমারোহ। রজব মৃদু আঁচ করতে পেরে তরমুজের মতো ফুলে উঠে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

‘ কিহ? কি কইলেন আপনে হে? আবার কন তো? ‘

‘ কুহেলীর কাছ থেকে দূরে থাকবে। ‘

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রজবের থেকে চোখ সরিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাটা বলে সমারোহ। হঠাৎই সমারোহর এই কথায় চোখ মুখ ছোট হয়ে আসে রজবের। মানে কি? কেন দূরে থাকবো? সমারোহর কথা মাটিতে পড়ার আগেই ক্ষেপে গিয়ে রজব বলে উঠে,

‘ কেন থাকুম? আপনে কয়দিন আইয়্যাই আমার লগে কুহেলী আপার কথা বন্ধ করাইয়্যা দিতে চাইতাছেন? ‘

‘ উঁহু, একদম না। আপা শব্দটা যেন সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে রজব! কুহেলী অবুঝ হতে পারে আমি নই। ‘

সেখান থেকে উঠে পরে সমারোহ। রজব হাঁ হয়ে থাকে সমারোহর কথা শুনে। ভারী ভারী শব্দ গুচ্ছগুলো তার মাথার উপর দিয়ে গেছে। এই লোকটা গ্রামে আসলো কেন? কুহেলী শহরে না গেলে কি হইতো না? রজবের কান্না পায়। খুব কষ্ট হয়। সমারোহ যাওয়ার আগেই রজব উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে,

‘ আপনে গেরামে আইছেন কেন কুহুর লগে? আপনে আইছেন দেইখ্যাই কুহুর বেজ্জতি হইছে গেরামের মাইষের সামনে। জোর কইরা বিয়া করতে হইছে আপনেরে। আপনের লগে বিয়া হইছে দেইখ্যা কতো কানছে ওই জানেন আপনে? আপনে না আইলে গেরামে সালিশ বইতো না আর আমার কুঞ্জা বইনও মরতো না। সব দোষ আপনের। ‘

রজবের কথার কোনো উত্তর করে না সমারোহ। পেছন ফিরে তাকায় না‌। চলে আসে ঘরে। রাগে রজব হঠাৎই উন্মাদের মতো নিজের চুল টানে। সিঁড়িতে যতগুলো পাথর রাখা ছিল সব একসঙ্গে ছুঁড়ে মারে পানিতে। ঘরে আসার পরই হাসনাহেনা সমারোহকে সকালের খাবার খাওয়ানো জন্য নিয়ে যায়। ঘরে উনুন জ্বলেনি। প্রতিবেশীদের ঘর থেকে খাবার এসেছে। রমলা আর সমারোহ একসঙ্গে খেতে বসেছে। রমলা সমারোহর সাথে টুকটাক কথা বললেও সমারোহ শুধু হুঁ হা করে চুপচাপ খেয়ে চলেছে। হাসনাহেনা খেয়াল করেন রজবকে কুহেলী ডাকার পরও আসেনি। হয়তো তার কালকের কথায় আঘাত পেয়েছে ছেলেটা। তাই কুহেলীকে খাবার সার্ভ করতে বলে তিনি যান রজবকে ডাকতে। সমারোহর পরোটা শেষ হয়ে গিয়েছে বলে কুহেলী তার প্ল্যাটে আরো একটা পরোটা দিতেই কিছু না বলে খাবারের প্ল্যাট রেখেই হুট করে সেখান থেকে উঠে চলে যায় সমারোহ। কুহেলী অবাক হয় তাতে। রমলাও চমকে গিয়ে কুহেলীকে বলেন,

‘ জামাইয়ের কি আমাগো এইখানে খাইতে কষ্ট হইতাছেরে কুহু? ঠিক মতো না খাইয়্যাই উইট্টা গেলো? জামাই মানুষ কালকেত্তে না খাইয়্যা আছে। জামাই আদরও করতে পারতাছি না আমরা। নিজের হাতে রাইন্দা খাওয়াতেও পারতাছি না। ‘

কুহেলী কি বলবে ভেবে পায় না। এতোক্ষণ তো দিব্বি খাচ্ছিল। হঠাৎই… কুহেলী খাবার দেয়াতে কি রাগ করলো? কিন্তু কেনো ? তার সাথে রাগ করার তো কোনো কারণ নেই! তাহলে? কুহেলী জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘ তেমন কিছু না দাদীমা। ‘

‘ তাইলে কি হইছে দেখতো। যাহ! ‘

কুহেলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘরে চলে আসে চুপচাপ। সমারোহ বিছানায় বসে বই পড়ছে। কুহেলী অবাক হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

‘ আপনি এভাবে উঠে চলে এলেন কেনো? রান্না কি খুব বাজে হয়েছে? কষ্ট হয়েছে খেতে? ‘

সমারোহ নিশ্চুপ থাকে। কুহেলী চিন্তিত হয়ে পরে। আবার বলে,

‘ শরীর ঠিক আছে আপনার? ‘

সমারোহ কোনো উত্তর দেয় তো দূর কুহেলীর দিকে তাকায় অবধি না। কোনো হেলেদুল নেই তার মাঝে। কুহেলী এবার একটু ভয় পায়। নিশ্চয়ই গুরুতর রাগ! সমারোহর কাছে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,

‘ আপনি কথা বলছেন না কেনো আমার সাথে? রাগ করার মতো কি করলাম আমি? ‘

সমারোহ বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে টেবিল থেকে বই নিয়ে ব্যাগের মধ্য রাখতে শুরু করে। তারপর আলমারি থেকে একেক করে শার্ট প্যান্ট নিয়ে গুছিয়ে ব্যাগে রাখে। কুহেলী হতবিহম্বল হয়ে পড়ে সমারোহর কাজে। সমারোহ যেখানে যায় তাঁর পিছু পিছু ঘুরে বকবক করতে থাকে। সমারোহর রাগ এবার দিগুন বেরে যায়। কন্ঠ দাবিয়ে বলে,

‘ কুহেলী এই ঘর থেকে যাও আমার মাথা গরম আছে। উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলবো সেটা খারাপ দেখাবে। ‘

কুহেলীর কান্না পায়। মানুষটা রাগ করেছে, না কষ্ট পেয়েছে? অস্থির লাগছে তার। পেটের ভেতর সুরসুরি দিচ্ছে কি হয়েছে জানার জন্য। সমারোহ ব্যাগে শার্ট রাখতে নিলে কুহেলী সমারোহর শার্টের হাতা দুহাতে খামচে ধরে বলে,

‘ আপনি ব্যাগ গুছাচ্ছেন কেনো? বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন? এখানে থাকতে কি কষ্ট হচ্ছে? কারো আচরণে কষ্ট পেয়েছেন? আমি কষ্ট দিয়েছি? ‘

‘ না, হাত ছাড়ো আমার। ‘

‘ ছাড়বো না। বলুন প্লিজ! ‘

সমারোহ চোখ বুঁজে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বলে,

‘ কুহেলী যাও, হাত ছাড়ো আমার। ‘ সমারোহ গলার স্বর এবার আগের চেয়ে অনেকটা বেড়ে যায়।

‘ যাচ্ছিনা, আগে বলুন। ‘

নাছোড়বান্দা হয়ে বলে কুহেলী। সমারোহর রাগ এবার মাত্রা ছাড়ায়। হঠাৎই কুহেলীকে নিজের একদম কাছে টেনে এনে হাত পেছনে মোচড়ে ধরে হুংকার ছেড়ে বলে,

‘ সবার কেনো আমার জিনিসটাই লাগবে বলতে পারো? এর আগেও এমনটা হয়েছে আমার সঙ্গে, এখন আবার! সমস্যাটা কোথায়? পৃথিবীতে কি আর কিছু নাই? আমার জিনিসের দিকেই কেনো মানুষের নজর দিতে হয়! আমার জিনিসে অন্য কারো হস্তক্ষেপ একদম সহ্য হয়না আমার। আমারটা শুধুই আমার। খুন করতে ইচ্ছা করে। রক্ত চড়ে যায় মাথায়। সমারোহ অত ভালো মানুষ না। ‘

কুহেলীর মাথার উপর দিয়ে যায় সমারোহর কথা। কি আবল-তাবল বকছেন উনি! সমারোহর চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে। চোখের সাদা রঙের ফাঁকে ফাঁকে লাল ধমনীগুলো স্পষ্ট। গলার রগ খাড়া হয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে হয়তো সমারোহর মস্তিষ্ক রাগে টগবগ করছে। কুহেলী ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘ কি হয়েছে? আপনার কোন জিনিসে কে হস্তক্ষেপ করলো! ‘

সমারোহ কোনো উত্তর না দিয়ে হঠাৎই ধাক্কা দিয়ে কুহেলীকে সরিয়ে দিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের কাজে। সমারোহর অকস্মাৎ ধাক্কা সামলাতে না পেরে টেবিলের সঙ্গে হাতের কব্জিতে বারি খেতেই আহ’ শব্দ করে উঠে কুহেলী। সমারোহ দেখেও পাত্তা না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কুহেলী কেবল হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে দেখে যায় সবটা। সমারোহ যেতেই নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে কেটে না গেলেও লাল হয়ে গেছে অনেকটা অংশ। খুব জোর কান্না পায় এবার কুহেলীর। লোকটা এমন কেনো? বারবার তাকে কেবল আঘাতই করে যায়!

সারা দিনে আর সমারোহর চেহারা দেখার সৌভাগ্য হয়নি কুহেলীর। রেগে কোথায় গেছে কে জানে! কুহেলী ফোন দিলে ফোন ধরছে না অথচ হাসনাহেনা ফোন দেয়ার পর বলেছে রাজশাহী শহরে কিছু পুরনো বন্ধু আছে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে, রাতে বাড়ি আসতে একটু দেরি হবে। একটু না ছাই সেটা কুহেলী জানে। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত তখন বারোটা। গ্রামে বারোটা মানেই চারিদিকে কুয়াশার ছড়াছড়ি আর এক ছটাক স্নিগ্ধতা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। এবার তার নিজেরই রাগ হচ্ছে সমারোহর উপর। সে কোনো ভুল করে থাকলে তাকে ইচ্ছে মতো বকে দিক কিন্তু বাড়ি দেরি করে ফিরার কি মানে? এই সময়টা কি তার রাগ করার মতো? একা একা থেকে কুঞ্জার কথা মনে করে গাল ভাসিয়ে কাঁদে কুহেলী। চোখের জলে আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কুহেলীর চোখ জোড়া একসময় লেগে আসে। খানিকটা সময় পরে টুকটাক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় কুহেলীর। উঠে দেখে ঘর তখন কুপির আলোয় মুখরিত। সমারোহ আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট বলদে নিচ্ছে। সমারোহর উন্মুক্ত বুকের দিকে চোখ পড়তেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় কুহেলী। অন্যদিকে ফিরে আমতা আমতা করে বলে,

‘ চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। ডাক দেননি কেনো? ‘

সমারোহ কেবল এক পলক দেখে কুহেলীকে। কিছু বলে না। কুহেলী আবার বলে,

‘ হাত মুখ ধুয়ে ফেলুন আমি খাবার গরম করে নিয়ে আসছি। ‘

বলেই ঘরে থেকে বের হয়ে খাবার নিয়ে আসে কুহেলী। সমারোহ ততক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে এসে কপালের উপর এক হাত রেখে চোখ বুজে শুয়েছে বিছানায়। কুহেলী বারকয়েক ডাকলেও তাকে পাত্তাই দেয় না সমারোহ। সমারোহর এই সামান্য এড়িয়ে চলাই তার ভেতরটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। কুহেলী এবার চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। টপটপ করে জল ঝরে পড়ে চোখের কার্ণিশ বেয়ে। সমারোহ এক চোখ খুলে দেখে নেয় কুহেলীকে। কুহেলী সেখান থেকে যাওয়ার আগেই খপ করে ধরে নেয় তার হাত। উঠে বসে কুহেলীকেও টান দিয়ে বসিয়ে দেয় নিজের পাশে। আহ্লাদী সুরে বলে উঠে,

‘ হায় হায়, এতোটুকু রাগ করলেই কান্না করে দিতে হয় নাকি মেয়ে? ‘

সমারোহর নরম আদুরে গলা শুনে কুহেলীর কান্নার বেগ হুড়হুড়িয়ে বেড়ে যায়। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কুহেলী বাচ্চাদের মতো করে বলে,

‘ আপনি আমার সাথে কথা বলেন না কেন? রাগ করে কথা না বললে কাঁদবো না? ‘

সমারোহর এবার হাঁসি পায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাঁসি থামিয়ে বলে,

‘ কে বললো আমি তোমার উপর রাগ করে আছি? ‘

‘ আমার উপরেই তো রাগ করে আছেন। আমার ফোন ধরেন নাই। আমি খাবার দিলাম বলে সকালে খেলেন না। আমার সাথে রাগ করেই তো সারাদিন বাড়ি ফিরেন নি। আমি অনেক খারাপ না! যান আমি চলেই যাচ্ছি আর আমার চেহারা দেখতে…।’

কুহেলী কথা শেষ করার আগেই সমারোহ চাটি মারে কুহেলীর কপালে। কুহেলী কপালে হাত চেপে ধরে এবার আরো জোরে কান্না শুরু করে দেয়।

‘ তোমার উপর রাগ না আমি পাগলী মেয়ে। আমার রাগ হচ্ছে প্রিতুসের উপর। আমি ওর আশেপাশে ইন ফ্যাক্ট এখানেই তোমাকে রাখতে অসহ্য লাগছে। আর… ‘

‘ হুম, আর? ‘

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার গ্রিলের ফাঁকে অদূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সমারোহ বলে,

‘ জানি না কেনো কিন্তু রজবকেও অসহ্য লাগছে। ‘

কুহেলী হা করে সমারোহর দিকে চেয়ে থাকে। ভেবে পায়না একটা মানুষ কতোটা পজেসিভ হতে পারে!

চলবে.