আকাশ মোড়ানো চিরকুট পর্ব-৪০+৪১

0
503

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৪০.

ঘুম থেকে উঠে চোখবুঁজেই বসে থাকে কুহেলী। মাথা ঝিমঝিম করছে। চন্দ্রিমা কল করেছিল একটু আগে। ফোন বাজতে বাজতে কখন কেটে গিয়েছে কুহেলী টেরই পায়নি। ঘড়িতে একবার সময়টা পরখ করে নেয় সে। নয়টা বেজে গেছে! হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয় কুহেলী। রেগুলার পড়া থেকে অনেক পিছিয়ে গিয়েছে এ কয়েকদিনের ব্যবধানে। মেডিক্যালের দু-একটা ক্লাস মিস হলেই তাল মিলাতে বিপদে পড়তে হয়, সেখানে ও তিন মাসের বেশি সময় ছিলনা। সবটা রিকোভারি করতে এখন তাকে হিমশিম খেতে হবে। দুইটা আইটেম মিস হয়েছে সেগুলো ক্লিয়ার করতে হবে। সামনের মাসে কার্ড এক্সাম। কুঞ্জার মৃত্যুর পর সবকিছুই ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে কুহেলীর কাছে। পড়ার মানসিকতাই নেই। সবমিলিয়ে চোখে শুধু সরিষা ফুল দেখছে কুহেলী। কুহেলী চোখ বুজে এক মুহুর্ত কুঞ্জার চেহারাটা মনে করে। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা জল বেয়ে পরে তার। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে নিজেকে বুঝায় এভাবে চলবে না। আব্বা তাকে খুব কষ্ট করে এতো দূর পড়তে পাঠিয়েছে। যে আব্বা তাকে ছাড়া এক বেলা খেতেও পাড়তো না সেই আব্বার কষ্টের টাকা সে কিছুতেই জলে যেতে দিতে পারে না। জীবনকে কারো জন্য থেমে থাকতে দেয়া যাবে না। তাকে পাড়তে হবে। সবটা মেনে নিতে হবে। কুহেলী মনে মনে রুটিন গুছিয়ে নেয়। কাল কলেজে গিয়ে এতো দিনের সব নোটস নিয়ে পড়াটা গুছিয়ে ফেলতে হবে। তারপর রোজকার পড়া শেষ করে পুরনো পড়াগুলো সান্দ্র ভাইয়ার কাছ থেকে বুঝে নিয়ে শেষ করতে হবে। একমাস একটানা এভাবে কনটিনিউ করতে পারলে হয়তো কিছুটা শেষ হবে। ফিজিওলজি বইটা নাড়া দিতেই ভেতর থেকে একটা কাগজ নিচে পরে। কুহেলী চমকে ভাঁজ করা কাগজটা হাতে নেয়। কপাল কুঁচকে আসে তার। দ্রুত খুলে দেখে এটা সেই মানুষটার চিঠি যে গ্রামে যাওয়ার আগে রোজ তাকে চিঠি দিতো। হঠাৎই কেনো যেনো চরম বিরক্তিতে কুহেলীর মন ভরে ওঠে। সে এখন বিবাহিত! কুহেলীর চিঠিটা পড়ার ইচ্ছা না থাকা স্বত্তেও পড়ে দেখে।

‘ প্রিয় প্রাণনাশি,
কতদিন, ঠিক কতটা ছটফট করাবেন আপনি আমায় কৃষ্ণপরী! আপনার মোহে আমি প্রতি সেকেন্ডে মারা যাচ্ছি সে খবর যে আপনি রাখেননা। এমন মায়াবী হওয়াটা অন্যায়। ইদানীং আরো বেশি করে প্রেমে পড়ছি আপনার। কারণটা কি বলুন তো? আপনার মায়াজালের একেকটা বুনন ছিড়তে আমার ভেতর জলে পুড় ছাড়খার হচ্ছে। Now you are my universe. I need you forever, in my every breath. Every moment of mine is just stamped in your name. Your name is enough to make my heart rejoice. এতোটা চাওয়ার পরও তুমি তোমার আর আমার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছো। অপেক্ষা করাচ্ছো তো,ভালো। কিন্তু এতো বেশিও করিয়ো যে যখন কাছে পাবো নিজেকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতাই না থাকলো।
আপনার,
সিক্রেট প্রেমিক ‘

একটু আগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা রাগ নিমিষেই মিইয়ে যায় কুহেলীর। এই বেনামি চিঠিগুলো বরাবরই অদ্ভুত। যিনি লিখেছেন যেন তার সবটা অনুভূতি মিশিয়ে দিয়েছেন। কুহেলীর ভেতর কেঁপে উঠে। এই বেনামি চিঠির মালিক কি কোনোভাবে সমারোহ হতে পারতো না? সমারোহর ভেতর জুড়ে তার থাকতে চাওয়াটা খুব অন্যায় হবে? কেনো সবসময় আমরা যা ভাবি তার বিপরীতটাই হতে হয়! আর কতদিনই বা সে অন্যকারো চেতনার অংশ হয়ে কাটাবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিঠিটা ভাঁজ করে কাঠের বক্সে তুলে রাখে কুহেলী। বিগত সবগুলো চিঠিই আছে এখানে। সযত্নে জমিয়েছে সে প্রতিটা।

চন্দ্রিমার সঙে কথা বলে পড়া গুছিয়ে নেয় কুহেলী।সান্দ্র মেডিক্যাল থেকে বাড়ি ফিরার পর তার কাছ থেকে একটা টপিক বুঝে আসে। নিজে পড়াটা কমপ্লিট করে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে তখন রাত আটটা বাজতে চলেছে। সমারোহ কিছু ট্রান্সফার সম্পর্কিত এপ্লিকেশনে সাইন করাতে মেডিক্যালে গিয়েছে বলে তার সাথে দেখা হয়নি আর। হয়তো ভয়ানক রেগে আছেন ভেতর ভেতর। সমারোহর রাগী চেহারাটা চোখের সামনে ভাসতেই কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয় কুহেলীর। সমারোহ এখনো বাড়ি ফিরেনি। ফিরেই যদি বলে কুহেলীকে তার ঘরে থাকতে! তাহলে সে কি করবে? উল্টা পাল্টা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই কুহেলীর মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসে। মুচকি হেসে আনরুবার ঘরের দিকটায় ছুটে কুহেলী।

‘ বাড়ির সামনের পুকুরের কচুরিপানায় ফুল ফুটেছে, আমার বেশি না হাতে গুনা পাঁচটা ফুল লাগবে এনে দিন। ‘

খুব সহজ ভাষায় কথাটা বলে সোফায় শরীর হেলিয়ে বসে পরে চন্দ্রিমা। আবির কেবল হা হয়ে চেয়ে থাকে চন্দ্রিমার পানে। আবিরের চাহনি দেখে চন্দ্রিমা ভ্রুঁ উঁচিয়ে সহজ গলায় বলে,

‘ কি? এমন হাবার মতো চেয়ে আছেন কেন? পারবেন নাকি না? ‘

‘ ওইটা ময়লা ডোবা চন্দ্রি! ‘

‘ তো? কচুরিপানা ময়লাতেই হয় আর তার ফুলই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ‘

‘ চন্দ্রি, তুমি আমার কাছে কিছু চেয়েছো কিন্তু আমি দিইনি এমন কখনো হয়েছে? কচুরিপানা ফুল আনার জন্য এখন আমি এই ময়লায় নামবো! অন্য কিছু চাও আমি সব এনে দেব। এটা কোনো চাওয়ার জিনিস হলো? ‘

‘ হ্যা, আর কাছে এটাই চাওয়ার মতো। আপনার আর আমার পছন্দে কতো তফাৎ দেখলেন! মনেরও মিল নেই। কি করে থাকার আশা করেন আমার সঙ্গে? ‘

‘ কোনো কিছুর মিল না থাকলেও তুমি আমায় ভালোবাসো আর আমি তোমায় এই মিল তো আছে, আর কোনো মিলের দরকার ও নেই। আর এই সামান্য বিষয় দিয়ে তুমি ভালোবাসার পরিমাণ কিভাবে করো? ‘

‘ আমি ভালোবাসি? কে বললো? ‘

‘ তোমার চোখ। ‘

‘ মিথ্যা বলেছে। ‘

‘ আর কতো লুকিয়ে বেড়াবে আমার কাছ থেকে? এটা কি খুব বেশি জরুরি? আমার ভালোবাসা তোমার চোখেই পরে না। ‘

‘ না পরে না। আমার কাউকে ভালোবাসে নষ্ট করার মতো সময় নেই। ‘

‘ আমি তোমার কাছে কখনোই অতিরিক্ত সময় চাইনি। আচ্ছা আমার দোষটা কি বলতে পারো চন্দ্রি?কেনো আমাকে এতোটা অবহেলা পেতে হবে? ‘

‘ আমাকে চন্দ্রি বলে ডাকবেন না। পুরো নাম বলবেন নয়তো বলবেন না বুঝেছেন। ‘

‘ পারবো না। সময় থাকতে নিজের শুভাকাঙ্ক্ষীদের আঁকড়ে ধরো। নয়তো পরে একদম একা হয়ে যাবে। আমি জানি না কেনো তুমি আমায় তোমার আশেপাশে পছন্দ করো না তবে জানো তো চন্দ্রি, আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্য কাউকে তোমার জায়গা দিতে পারবো না আর তোমার পিছুও ছাড়বো না। ইউ জাস্ট ওয়েট, আমি তোমাকে আমার কাছে আনবোই। তুমি চাইলেও আমার হবে, না চাইলেও আমার হবে। শুধু আবিরের। ‘

চন্দ্রিমার ভেতরটা কেনো যেন খুশিতে ভরে যায় আবিরের কথায়। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করে চন্দ্রিমা। সে দেশের বাহিরে যাবে না কিছুতেই। তাকে তার পরিবার সামলাতে হবে, বাবার বিশাল দেনার বোঝা তার উপর। সে ছাড়া তার ছোট ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এতো সব ঝামেলার মাঝে সে আবিরকে ঢুকাতে চায় না। চন্দ্রিমার চোখের কার্ণিশে জল আসতে চায়। মাঝে মাঝে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমরা মানুষেরা এমন কেনো, মনের কথা সহজে মুখে আনতে পারি না আর মুখের কথা মনের হয় না। আমাদের চারপাশের পরিবেশ আমাদের বাধ্য করে ভেতরের চাওয়া-পাওয়াকে চেপে রাখতে। আবিরের সাথে এখন খুব সুন্দর মুহূর্ত সে চাইলেই কাটাতে পারে, চাইলেই ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে বিয়ে করে গুছিয়ে নিতে পারে তার জীবন। তবে তাতে তার পরিবারের ভবিষ্যৎ দিনগুলো অনিশ্চিত হয়ে পরবে। সে তার পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার। ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে নিজের ইচ্ছে সেখানেই কবর দেয় চন্দ্রিমা। ঠোঁটে মৃদুু হাসি মেখে বলে,

‘ চ্যালেঞ্জ করছেন নাকি? ‘

‘ সত্য বলছি। তোমার চ্যালেঞ্জ মনে হলে তাই। ‘

‘ আপনাকে আর কতোবার বললে আপনি বুঝবেন আমি এখন আমার জীবনে কাউকে চাই না। ‘

‘ আর কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে আমার? ‘

‘ দয়া করে অফ যান এবার। আমার গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করতে পাঁচ বছর, আমার ভাইটা একদম ছোট, বোনের ও ভার্সিটিতে ভর্তি হতে সাত-আট বছরের মতো লাগবে। এতোদিন অপেক্ষা করতে পারবেন? আন্টি আপনার বিয়ের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। বয়স হয়েছে উনার আর কতো কষ্ট পাবে আপনাকে দেখে! ‘

‘ তো কি করতে বলছো? ‘

‘ বিয়ে করে ফেলুন। ‘

কথা বলার সময় বুক ধীপ ধীপ করে চন্দ্রিমার। আবিরের এবার সত্যিই খারাপ লাগে চন্দ্রিমার কথাগুলো। চন্দ্রিমার সকল খারাপ আচরণ সবসময় সে সহ্য করে নিয়েছে, কখনো একটা টু শব্দও করেনি। তাই বলে মেয়েটা কখনোই কও বুঝবে না যে আবির তাকে ঠিক কতটা চায়? একটা মানুষের সহ্য ক্ষমতা কতটা হতে পারে! চন্দ্রিমাকে একটু দেখবে বলে সে বিদেশ থেকে ছুটে বাংলাদেশে এসেছে। দিনের পর দিন হাজারটা অপমান অনায়াসে গিলে নিয়েছে। যখন থেকে চন্দ্রিমাকে দেখেছে নিজেকে ভুলে গিয়ে নিজের পছন্দ অপছন্দ ছেড়ে দিয়ে কেবলই তার মনের মতো হতে চেয়েছে। নিজেকে পার্ফেক্ট করতে চেয়েছে। দিন শেষে সে নিজে কি পেয়েছে? কোনো প্রাপ্তিই কি সে ডিজার্ভ করে না? এতোটাই তুচ্ছ সে? চন্দ্রিমার দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবির বলে,

‘ তো এটাই তোমার শেষ কথা? ‘

‘ হুম। ‘

‘ আর কিছু বলার নেই? ‘

‘ না। ‘

আবির শব্দ করে হাসে। চন্দ্রিমা কপাল কুঁচকে বলে ওঠে,

‘ হাসির কিছু বলেছি? আমি কি জোকার? ‘

আবির চন্দ্রিমার কাছ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলে,

‘ চন্দ্রি একদিন তুমি আপসোস করবে আজকের বলা কথাগুলোর জন্য। তুমি চাইলেই সব সুখ পেতে। মানুষ ভালোবাসা হাজার খুঁজেও পায়না আর আজ তুমি নিজ হাতে নিজের জন্য একাকিত্ব বেছে নিলে। এই একাকিত্ব তোমায় সারাজীবন আঘাত করবে। তোমার ফ্যামিলিকে নিশ্চয়ই আমি বিয়ের পর তোমার কাছ থেকে কেঁড়ে নিতাম না বা তোমায় বলতাম না ওদের খেয়াল রেখো না। বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কেতা বহুদূর। যাই হোক, ভালো থেকো আর নিজের যত্ন নিও। আমি আর কখনোই তোমার বিরক্তির কারণ হবো না। একমাস থাকতাম তবে এখন তার কারণ দেখি না। পরশু চলে যাব। ‘

অতিরিক্ত শান্ত আবিরের কন্ঠস্বর। চন্দ্রিমা হা করে চেয়ে থাকে আবিরের দিকে। অনেক বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। আবির যখন তার সাথে এসেছিল তখন খুবই প্রফুল্ল ছিল অথচ এখন তার মুখখানি শ্রাবণের গাঢ় কালো মেঘে ঢাকা। চন্দ্রিমাকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে আবির তার খুব কাছাকাছি গিয়ে বলো,

‘ একবার জড়িয়ে ধরতে দেবে? ‘

চন্দ্রিমা তৎক্ষনাৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালো আবিরের দিকে। আবির কন্ঠে শ’খানেক মোহ মিশিয়ে দিয়ে বলে,

‘ এরপর কক্ষনো এরম অন্যায় আবদার করবো না। দেবে? ‘

আবিরের কথায় চন্দ্রিমার কি হলো সে জানেনা শুধু মুখ ফসকে বের হয়ে এলো, ‘ হু ‘

চন্দ্রিমার কথা শেষ হওয়ার আগে আবির তীরের বেগে জড়িয়ে ধরে তাকে। খুব শক্ত করে মিশিয়ে নেয় বুকের সঙে। আবিরের শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন স্পষ্ট হয়। চন্দ্রিমার আত্মা শুদ্দ কেঁপে ওঠে। লোজটা সত্যিই শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরেছে তাকে! নাহ, তা কি করে হতে পারে। আবির তো তাকে ছাড়া কিছু বুঝেই না। তাকে বলেছে তো কোনোদিন ও ছাড়বে না। চন্দ্রিমা কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই টের পায় আবির কাঁদছে। আবিরের পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলে,

‘ আ… আপনি কাঁদছেন আবির? ‘

আবির চন্দ্রিমাকে হঠাৎই কপালে গভীর চুমু খেয়ে ভেজা সুরে বলে, ‘ ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি তোমায়। শুধু ছ’সাত বছর কেনো আমি সারাটা জীবন খুশি খুশি তোমার জন্য অপেক্ষা করে কাটিয়ে দিতে পারি। আসি। ‘

আবির আর এক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায় না। চন্দ্রিমা স্পষ্ট দেখতে পায় আবির তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবির তাকে ছেড়ে যাচ্ছে! চন্দ্রিমার ব্যাথায় বুকটা চিনচিন করে ওঠে। বুকের বা’পাশে হাত রেখে কেবল অনুভব করে তার সব শেষ। এতো ভালো স্টুডেন্ট, সুনিশ্চিত ক্যারিয়ার, লোকসমাগমে জনপ্রিয় এবং অতীব সুন্দরী হওয়ার পরও তার সবটাই শেষ। ভেতর থেকে চিৎকার করে কেউ বলছে, ‘ তোর সবকিছুই বৃথা, সবটা বৃথা। ‘

চলবে.

আকাশ মোড়ানো চিরকুট
লেখনী – সাইমা ইসলাম প্রীতি

৪১.

ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল কথা বলছে কুহেলী। সমারোহ বেশ উপভোগ করছে বিষয়টা। ঘুমে কথা বলার অভ্যাসও কুহেলীর আছে তা পূর্বে অজানা ছিলনা তার। কুহেলীর ঠিক পাশে মাথার নিচে হাত দিয়ে উঁচু হয়ে শুয়ে রয়েছে সমারোহ। কুহেলীর মুখের উপর উড়ে এসে পরা কয়েকটা ছোট চুল দুই আঙ্গুলে সরিয়ে দিয়ে গভীর ভাবে দেখে কুহেলীকে। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন যে নারীকে ঘুমে সুন্দর দেখায় আর যে নারীর হাসি মায়াময়ী সে নারী সত্যিকারের সুন্দর। কুহেলীর মতো কাউকে দেখেই হয়তে বলেছিলেন তিনি। সমারোহর ও এই মুহূর্তে কবি হতে ইচ্ছা করছে। এই ঘুমপরীর বিবরণ যদি কবিতায় টুকে রাখা না হয় তবে তা হয়তো বড়ই অন্যায় হবে। সমারোহর মৃদু হাসিতে চোখের নিচের ভাজ স্পষ্ট হয়। সমারোহ নেশা মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

‘ তোমার নাম আর তোমার মাঝে একবিন্দু অমিল নেই কুহেলী। কুয়াশার চাদরে ঢাকা তুৃমি মানেই দ্বিধা। তোমার চারপাশ মায়াজালে ঘেরা। আর মায়াজাল টপকে কাছে গেলেই হৃদয়ের মৃত্যু। তুমি ঠিক হাওয়াই মিঠাই এর মতোন। খুবই আকর্ষণী, কোমল অথচ তোমার মিষ্টি ছোঁয়া আমার পাওয়া হয় না। তবে জানোত তোমার এই মিষ্টি ধোঁকা আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি তোমার নামের নদীতে তারা হয়ে ফুটতে চাই। তোমার সঙে আমার শেষ থেকে শুরু করতে চাই। তোমার নামের বৃষ্টি নামাতে চাই আমার আকাশে। ‘

কুহেলীর কানের কাছে খুব সন্তর্পণে কথাটা বলে সমারোহ। কুহেলী তখন ঘুমিয়ে বেহুশ। সমারোহর কথা শোনা আর হয়না তার। অনেকটা সময় পর কুহেলীর ঘুম আলগা হয়ে আসে। একটু নেড়েচেড়ে শোয় সে। সমারোহ কুহেলীর চোখের পাতায় ফুঁ দেয় দুষ্টুমি করে। কুহেলী ভ্রুঁ কুঁচকে ঢিপঢিপ করে তাকায়। ঘুমের ঘোরে পাশে তাকাতেই চোখ আটকে যায় কুহেলীর। প্রথমে একবার দেখে চোখ বুঁজে নিয়ে তার মনে হয়, সমারোহ সত্যিই তার পাশে? নাকি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে সে! আবার দ্রুত চোখ খুলে পাশে ফিরে তাকিয়ে আকস্মাৎ চমকে গিয়ে চিৎকার করতে নেয় কুহেলী। কুহেলী চিৎকার করার আগেই সমারোহ মুখ চেপে ধরে তার। চেপে ধরতে গিয়ে কুহেলীর খুব কাছাকাছি চলে আসে সমারোহ। কুহেলী চোখ বড়সড় করে চেয়ে সমারোহর হাত সরাতে চাইলে সমারোহ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

‘ একদম চিল্লাপাল্লা করার চেষ্টা করবা না বলে দিলাম। ‘

কুহেলীকে ছেড়ে তার পাশ থেকে উঠে বসে সমারোহ। কুহেলী সেকেন্ডের মধ্যে লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে নিজের ওড়না ঠিকঠাক করতে করতে আমতা আমতা করে বলে,

‘ আ…আমি তো মামনির ঘরে ছিলাম, এখানে এলাম কি করে? ‘

‘ পালকি ভাড়া করে নিয়ে এসছি। ‘, নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে সমারোহ।

কুহেলী হা করে চেয়ে থাকে সমারোহর দিকে। সমারোহ একপলক কুহেলীকে দেখে নিয়ে বিরক্তির সুরে আবার বলে,

‘ কোলে তুলে নিয়ে এসছি। ‘

‘ কিহ! আপনি আমাকে? ‘

সমারোহ অবাক হয়ে চোখ ঘুরিয়ে কুহেলীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ তো কি অন্য কেউ দিয়ে যাওয়ার কথা? ‘

কুহেলী চুপসে যায়। একবার ঢোক গিলে নিয়ে মিহিন স্বরে বলে,

‘ না মানে মামনি তে আমার কাছেই ছিল! ‘

‘ সবার সামনেই কোলে তুলে নিয়ে এসছি। ‘

কুহেলীর চোখ ছানাবড়ার মতো হয়ে যায় সমারোহর কথা শুনে। সমারোহ তার সঙ্গে এমন কাজ করতে পারে ভাবতেই পারছে না কুহেলী। লজ্জায় তার মনে হচ্ছে পাতাল ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যেতে। কি বেহায়া লোক হয়েছেন ইনি!
সমারোহ আড়চোখে দেখে কুহেলীর কান আর চিকস লাল হয়ে গিয়েছে। তবুও তেমন পাত্তা না দিয়ে সমারোহ মুখ শক্ত করে বলে,

‘ তো ম্যাডাম, রেডি হয়ে নিন পানিশমেন্টের জন্য। ‘

‘ কে’কেনো? কি করেছি আমি? ‘

‘ কি করোনি? ‘

কুহেলী ঢোক গিলে। বুকে ধীপধীপ শব্দ সময়ের সঙে পাল্লা দিয়ে বেরে চলেছে। এবার যথেষ্ট ভয় করছে তার। তখন চালাকি করে সমারোহ বাড়ি ফিরার আগেই মামনির ঘরে গিয়ে শুয়ে পরেছিল কুহেলী। জহির ঢাকা গেছেন দুই দিন হলো। স্বামীকে ছাড়া আনরুবার বাড়ি যেন একদম শূন্য মনে হয়। তার উপর কুহেলী এসে এতো সুন্দর করে আবদার করলো তার পায়ে মাথা রেখে ঘুমতে চায় যে আনরুবা মোটেই না করতে পারেনি। কুহেলী যে কারো হাত থেকে বাঁচতে এমনটা করেছে তা আনরুবার অজানা। কুহেলীর এবার গলা ফাটিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করে। কেনো করতে গেছিলো সে পাকনামি! কিছু তো হলোই না উল্টো এখন নাকি শাস্তি পেতে হবে। আচ্ছা কাল সকালে সে সবার সামনে মুখ দেখাবে কি করে! কুহেলীর ভাবনায় ছেদ পরে সমারোহর কথা শুনে। সমারোহ কখন কুহেলীর একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। যখন বুঝতে পারে দ্রুত পিছিয়ে যেয়ে দেয়ালে ঠাস করে বারি খেয়ে মাথা হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কুহেলীর কান্ড দেখে ফিক করে হেসে ফেলে সমারোহ। তারপর গলা খ্যাক করে পরিষ্কার করে বলে,

‘ তো বলুন, আমার অবাধ্য হওয়ার কি পানিশমেন্ট দেয়া যায়? কঠিন দিব নাকি একটু সহজ? ‘

কুহেলী অভিমানী চোখে সমারোহর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ঠোঁট উল্টে বলে,

‘ আমি আপনার কোনো পানিশমেন্টই নিব না। ‘

বলেই সমারোহ পাশ কেটে দৌড়ে পালাতে নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজাটা উপর থেকে আটকানো আছে। পারবে না জেনেও কয়েকবার ছিটকিনিটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে কুহেলী। শেষে ব্যার্থ হয়ে হার মেনে নিয়ে সমারোহর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ এটা কেনো আটকালেন? বারবার এতো কষ্ট না করে নিচেরটা আটকালে কি হয় শুনি? ‘

সমারোহ বিছানায় বসতে বসতে ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলে , ‘ বলেছিলাম তো তোমায়। ‘

‘ কি বলেছিলেন? ‘

‘ বউ আটকে রাখতে। ‘

কুহেলী চোখ বড়বড় করে চেয়ে রয় সমারোহর দিকে। সেদিন যখন সেইম কথাটা সমারোহ বলেছিল কুহেলীর খুব হিংসা হয়েছিল তার ভবিষ্যত বউয়ের কথা ভেবে। অথচ আজ সে নিজেই…
সমারোহ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে কুহেলীকে না দেখেই বলে,

‘ এভাবে দেখো না আমায়, প্রেমে পড়ে যাবে। ‘

কুহেলী চোখ সরিয়ে নিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলে, ‘ আমি ঘরে যাবো। ‘

‘ আম্মু কি বললো শুনলে না, এটাই তোমার রুম। ‘

‘ আমার জামাকাপড় আনতে হবে। ‘

‘ আমি সব এনে রেখেছি এই ঘরে। ওই কর্ণারটায় দেখো তোমার সব জামাকাপড় বই খাতা সব আছে। ‘

কুহেলী ভরকে যায় মুহূর্তেই। সব নিয়ে এসছে মানে! ওই চিঠিগুলো আবার দেখে ফেলেননি তো! কুহেলী বলে,

‘ আপনি আমাকে না বলে আমার জিনিস ধরলেন কেনো? ‘

‘ কোনটা তোমার? তুৃমি নিজেই তো আমার। তোমার সবকিছুই আমার। ‘

কুহেলীর মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল কিছু বয়ে যায়। সময়টা থমকে যায়। সমারোহ কি বললো মাত্র! সমারোহ কি সত্যিই কুহেলীকে তার বললো? নাকি কুহেলী ভুল শুনেছে? ইদানীং সমারোহর প্রতিটা কথাই লজ্জাজনক হয় কুহেলীর জন্য। ইচ্ছে করেই করেন এমন নাকি কুহেলীর লজ্জার দমক বেড়ে চলেছে দিন দিন বুঝতে পারছে না সে। কুহেলী মাথা নিচু করে জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলে, ‘ কি বললেন আপনি? ‘

‘ বললাম এই ঘরটা আমার, তো ঘরের সবকিছুই আমার। ‘

‘ না আপনি এটা বলেননি। ‘

সমারোহ এবার ফিরে তাকায় কুহেলীর দিকে। ঠোঁটের কোণে তার বাঁকা হাসি লেপ্টে আছে। কুহেলীর সমারোহকে দেখে আজ ভয় করে। সমারোহ অবলীলায় বলে,

‘ ইদানীং তুমি কথার পাল্টা জবাব বেশি দাও। ছোট মানুষ এতো কথা বলবা কেন, যা বলবো চুপচাপ শুনবে। এখন তোমার পানিশমেন্ট দেয়ার পালা। এদিকে এসো, আমার কাছে। ‘

কুহেলীর মনে হচ্ছে তার দেহ থেকে ভয়ে আত্মা উড়ে গেছে। হাত পা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে অলরেডি। কুহেলী ভয়ে আমতা আমতা করে বলে,

‘ আমাকে কি মাফ করা যায় না? আর এমন করবো না। ‘

‘ কোনো মাফ নেই। শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে। ‘

‘ কি করতে হবে আমাকে? ‘

সমারোহ এক’পা দু’পা করে কুহেলীর কাছে এসে হঠাৎ করে কুহেলীর চুলের মুঠি ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব অশ্লীল এক কবিতার কয়েক লাইন আওরায়। কুহেলীর চোখ বড়বড় হয়ে আসে কবিতা শুনে। লজ্জায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পরে। চোখ পিটপিট করে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকে। বেখেয়ালি ভাবে এক হাত সমারোহর বুকের শার্ট খামছে ধরে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলে সমারোহ আরো কাছে টেনে নেয় কুহেলীকে। কুহেলী সমারোহর দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। চোখাচোখি হয় তাদের। সমারোহ অনবরত দেখে যাচ্ছে কুহেলীকে। মুগ্ধ চোখে লাজুক কুহেলীর অস্বস্তি আর গরম নিশ্বাস অনুভব করছে। কুহেলী ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ এমন অশ্লীল কবিতাও আপনি পড়েন? ‘

সমারোহ বাঁকা হেসে বলে, ‘ সমারোহ এর চেয়েও অশ্লীল হতে জানে। ‘

কুহেলীর কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। আড়ষ্টতায় একদম চুপসে যায়। ভয়ে সমারোহর হাত ধরে বলে,

‘ প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দিন আমি প্রমিজ আর কোনোদিন এমন করবো না। যেতে দিন আমায়। ‘

‘ প্রথম আর শেষ বারের মতো? ‘

‘ হুঁ ‘

‘ কোথায় যাবে? ‘

‘ মামনির কাছে। ‘

‘ ক’টা বাজে হুঁশ আছে ম্যাডাম! ‘

কুহেলী বোকার মতো চেহারা করে বলে, ‘ কয়টা? ‘

‘ আড়াইটা। ‘

‘ আমি খেয়াল করিনি। তাহলে আমার ঘরে যাই? ‘

‘ এটাই তোমার ঘর এখন থেকে বললাম না! ‘

কুহেলী অসহায় হয়ে বলে, ‘ আ’আমি পানি খাব। ‘

‘ এতো বাহানা পালানোর জন্য? ‘

‘ হু। না মানে, না। ‘

সমারোহ ফিক করে হেসে ফেলে এবার। কুহেলীর কাছ থেকে সরে এসে বলে,

‘ রাত হয়েছে, কোত্থাও যেতে হবে না। তুমি খাটেই ঘুমাতে পারো। আমি পড়বো সারারাত। ‘

কুহেলী অবাক হয়। হা করে কিছুক্ষণ সমারোহকে দেখে বলে,
‘ এখন কি পড়বেন আবার? আমেরিকা গিয়ে পড়া শুরু করলে হবে না! ‘

সমারোহ বই নিয়ে টেবিলে বসতে বসতে বলে, ‘ পড়ার অভ্যাস একবার চলে গেলে তা ফিরিয়ে আনা কতটা কঠিন তা আমি জানি। রিপিট করতে চাই না কষ্টটা। ‘

‘ কিন্তু… ‘

‘ এক্ষুনি না ঘুমালে পানিশমেন্ট নিতেই পারো! জেগেই তো আছো। ‘

‘ না না না। আপনি পড়ুন আমার অনেক ঘুম পেয়েছে। ‘

কথা শেষ হওয়ার আগেই দৌড়ে গিয়ে খাটে শুয়ে পরে কুহেলী। সমারোহ মৃদু হেসে পড়া শুরু করে। কুহেলী শুয়ে নিশ্চুপ হয়ে সমারোহকে দেখে কিছুক্ষণ। সমারোহ পড়ায় বিভোর ছিল তাই টের পায়নি। কুহেলীর কাছে খুবই অদ্ভুত ঠেকায় ইদানীং সমারোহর আচরণ। কেমন যেন অস্পষ্ট পুরো বিষয়টা। কুহেলীর খুব করে জানতে ইচ্ছে করে সমারোহ তাকে ভালোবাসে কিনা। নয়না আপু বলেছে বাসেন। কুহেলী আর কিছু ভাবতে পারে না। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরে যায়। মাথা খুব ব্যথা করতে থাকে। চোখ বুঁজে কুহেলী।

বিসিএস ভাইভা পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে আজ। সকাল থেকে বাহিরে তুমুল ঝড় উঠেছে। মুশলধারে বৃষ্টি নয়নার ভেতরখানি উতলা করে তুলেছে। বাড়িতে পত্রিকা পৌঁছাবে না আজ। সমারোহ বা সান্দ্রও নেই বাড়ি। তারা থাকলেও একটা ব্যবস্থা করতে পারতো। সে এখন কিভাবে জানবে তার রেজাল্ট কি? তার অস্থিরতায় বাড়ির প্রতিটা মানুষ অস্থির হয়ে রয়েছে। বৃষ্টি মাথায় জহির চলেছে বাজারের দিকে পত্রিকা জোগাড় করতে। তখনকার সময় এখনের মতো এতো আধুনিক মাধ্যম ছিল না ফলাফল জানার। বিসিএস, মেডিক্যাল,চাকরির এর মতো বড় বড় পরীক্ষার ফলাফল জানার একমাত্র মাধ্যম ছিল পত্রিকা। আনরুবা নয়নার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আহ্লাদী সুরে বলেন,

‘ আহারে মা’রে, এতো চিন্তা করিস না। ভালো ফলাফলই হইবো। আগেরবার থেকে এইবার তুই বেশি কষ্ট করছোস। তোর পরিশ্রম বৃথা যাইবো না। এতো চিন্তা বাচ্চার জন্য ভালো না। ‘

নয়না অস্থিরতা লুকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলার চেষ্টা করে,

‘ আম্মু, আমি অনেক বিসিএস দিসি। পিলি টিকে রিটেন এও গেছি কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নাই। এইবার আমি আমার সর্বোচ্চটা দিসি, ভাইভা পর্যন্ত গেছি। এখন না হলেও আমার আফসোস থাকবে না। তবুও টেনশন হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। ‘

আনরুবা হেসে নয়নার চিবুকে হাত ছুঁইয়ে চুমু খেয়ে বলেন,
‘ এজন্যই আমি আমার মেয়ের উপর প্রাউড ফিল করি। ‘

আনরুবার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ফিরে আসেন জহির। সঙে প্রচুর মিষ্টির প্যাকেট। খুশিতে টইটম্বুর হয়ে আছে তার মুখখানা। নয়না তার বাবার চোখ আর ঠোঁটের বিস্তর হাসির ঝিলিক দেখে হেসে ফেলে। আল্লাহ তাকে প্রথম ধাপ পার করিয়ে দিয়েছেন। এবার তাকে আরো বেশি শ্রম দিতে হবে। সে আর কারো জন্য আটকে থাকবে না। সে সন্তানকে সমাজ তার পায়ের শিকল বানাতে চেয়েছিল সে এখন হবে তার শক্তি। মুক্তির উন্মুক্ত মাধ্যম। তার ভুলে মাশুল তার সন্তানকে দিতে দিবে না। ইসলামের পথে চালনা করবে সে তার সন্তানকে। সে এখন আর কারো জন্য বোঝা নয়। ক্যাডার পদের চাকরি করবে সে। তার এখন অনেক দায়িত্ব। নয়নার মনে পরে সৌরভের সঙে কাটানো সময়গুলো। মনে পরে ভাইভা বোর্ডে তাকে করা প্রশ্নগুলো। ভাইভা বোর্ডে যখন সাতজন স্যারের সামনে চেয়ারম্যান স্যার নয়নাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে অবিবাহিত হওয়ার পরও প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ভাইভা দিতে এসেছে! নয়না তখন একদম ঘাবড়ে যায়নি। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলেছিল,

‘ স্যার আমার সুন্দর জীবনে ছোট্ট একটা ভুল এটা। আমি আমার প্রেমিককে খুব বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি এবং অনুশোচনা করেছি। ‘

স্যার ভ্রুঁ উঁচিয়ে নয়নাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ তুমি অনুতপ্ত এটা ভালো। বাচ্চাটাকে কি তুমি বোঝা মনে করছো? ‘

‘ না স্যার। সে আমার বোঝা নয় শক্তি হওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে বাকিটা জীবনের যুদ্ধ জয় করতে চাই। ‘

‘ সিঙ্গেল মাদার আমাদের সমাজে অবহেলিত জানার পরও? ‘

‘ আমি সমাজের বদ্ধ নিয়মে থাকতে চাই না। সমাজ বদলাতে চাই। আমি আমার মতো হাজারটা মেয়ের আশার আলো হতে চাই। তাদের পাশে দাড়াতে চাই। ‘

নয়না মৃদু হাসে। সে পেরেছে। সে সত্যিই পেরেছে আজ তার লক্ষ্যে পৌঁছেতে। নয়না দ্রুত ঘরে গিয়ে দুই রাকাআত শুকরিয়ার নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে অঝরে কেঁদে ধন্যবাদ জানায়।

চলবে.