. #গল্প — #আড়ালে_কে [ #পর্ব – ১০ ]
#লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক
নাজমুল সাহেব সোহানার কানে কানে বলে, ‘আজকের রাতটার জন্য অন্তত শাড়ি পরে সাজবে ?’
সোহানা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো উত্তর দিতে পারে না সে। নাজমুল সাহেব চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে সোহানার মুখের দিকে। সোহানা চোখ নিচে নামিয়ে নেয়। তিনি আবারও তার থুতনিতে ধরে মুখটা উপরে তোলে। চোখে চোখে তাকিয়ে বলে, ‘একবারের জন্য পরবে!’
সোহানা নিচু স্বরে ‘ স্যরি ‘বলে, নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
নাজমুল সাহেব পিছন থেকে হাত ধরে সোহানার। আবারও অনুনয় করে, ‘প্লিজ একবার, আজকের জন্য শুধু।’
সোহানার যেন সাহস বেড়ে যায়। জোর গলায় বলে, ‘বললাম না পারব না এখন। আমার যখন মন চায় তখন পরব।’
নাজমুল সাহেবের বুকে আঘাত করে কথাটা। এমনটা তিনি মোটেও আশা করেননি। সোহানার হাতটা অনেকক্ষণ ধরেই ধরে রেখেছিলেন। তার এই কথায় রাগে একটা ঝাঁকি দিয়ে ছেড়ে দেয় হাতটা। সোহানা ব্যাথায় উহ্ করে উঠে। নাজমুল সাহেব সেদিকে আর কর্ণপাত করেন না। দ্রুত নিজের পোশাক পাল্টে ফ্রেশ হয়ে ছাঁদে চলে যান। নাজমুল এমন ভাবে রাগের সহিত সব কাজ শেষ করে ছাঁদে গেলেন যে এসব দেখে সোহানা বোবার মতো দাঁড়িয়ে ছিল। সে ঠিক বুঝতে পারছে না যে কি হচ্ছে এসব। নাজমুল কি তবে অভিমান করে এভাবে চলে গেল!
সোহানা গিফটের শাড়িটা প্যাকেট থেকে বের করে কোলে নিয়ে বসে থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সেটা, আর ভাবে, ‘এতো সুন্দর একটা শাড়ি। আমি তো এমনিতেই পরার লোভ সামলাতে পারছি না। উনি অনুরোধ না করলে এমনিই তো পরতে মন চাইতো এটা। কেন শুধু শুধু কষ্ট দিলাম ওনাকে। এতো সুন্দর গিফট এনেছে আমার জন্য কোথায় ওনার খুশি মতো কিছু করব। তা না করে উল্টো কষ্ট দিলাম। ‘
সোহানার একবার মনে চায় শাড়িটা পরে ছাঁদে যাওয়ার জন্য। আবার মনে হয়, কয়দিন পরে আলাদা হয়ে যাব এখন এসব প্রেম দেখিয়ে ঝামেলা করার দরকার নেই। শাড়িটা আবার ভাজ করে ঐ বক্সেই রেখে দেয়। শশুর-শাশুড়ীর ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসে খাবার রেডি করবে কি-না। ওনাদের মতামত জেনে এসে খাবার সব টেবিলে গুছিয়ে রাখে সে।
পোনে দশ-টা বাজলেই সবাই খাবার টেবিলে আসে নাজমুল সাহেব বাদে। তখনও একা একা দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে তিনি। ওনার মা বারবার জিজ্ঞেস করে ছেলের কথা। সোহানা স্বাভাবিক উত্তর দেয়, ” উনি ছাঁদে গেছে আম্মা। এসে পরবে একটু পরই।’
মা নাছোরবান্দা, ‘না না একসাথেই খাব সবাই। যা তো নাদিয়া নাজমুলকে ডেকে নিয়ে আয়।’
নাদিয়া বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে চলে যায়। সিঁড়িতে ছোট বোনের পায়ের পরিচিত শব্দ পেতেই সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেন নাজমুল সাহেব। দ্রুত কয়েকবার ধুঁয়া উড়িয়ে মুখের গন্ধ দূূর করার চেষ্টা করেন। নাদিয়া তবুও দূর থেকেই বুঝে ফেলে যে তার ভাই সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকার আকাশে উড়তে থাকা সাদা ধুঁয়া দূরের লাইটের কারণে স্পষ্ট স্পষ্ট বুঝা যায়। এজন্য সে আর সামনে যায় না ভাইয়ের। দূর থেকেই বলে, ‘আম্মু ডাকতেছে, তাড়তাড়ি খেতে আসো ভাইয়া। ‘
‘ তুই যা আমি আসতেছি। ‘
‘ দেরি করো না, আম্মু প্লেট সামনে নিয়েই বসে আছে। বলছে তুমি গেলে খাবে।’
‘ আচ্ছা তুই নাম নিচে, আমি আসতেছি।’
নিজের মায়ের আদেশ, অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে নিচে নেমে যান উনি। প্রথমেই হাত ধোঁয়ার উসিলা দেখিয়ে গোসল খানায় গিয়ে মুখের গন্ধ দূর করার ব্যবস্থা করেন । তারপর এসে খাবার টেবিলে বসেন সবার সাথে।
খাবার টেবিলে কাউকে কিছুই বুঝতে দেন না নাজমুল সাহেব। মাথা নিচু করে চুপচাপ অল্প একটু খেয়ে হাত ধুয়ে আবারও ছাঁদে চলে যান। কেউ বুঝতে পারে না যে কি হয়েছে। কিন্তু সোহানা তো বুঝে! তাই সবার খাওয়া শেষে বাকি খাবারগুলো তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেন নাদিয়াকে সাথে নিয়েই। তারপর কেকটা নরমালি কেটে ছোট প্লেটে করে সবাইকে দেয়। এখানেও বুড়া-বুড়ি জিজ্ঞেস করে, “নাজমুলে খাইছে?”
সোহানা ওনাদের বুঝ দেয় , ‘আপনারা খেয়ে নেন আমাদের জন্য রাখা আছে। আমরা পরে একসাথে খাব। ‘
নাদিয়া বাঁকা চোখে কটমট করে তাকায় সোহানার দিকে। সোহানার, এই তাকানোর মানেটা অজানা নয়। কিন্তু কোনো চিন্তাই নিজের মাথায় জায়গা দেয় না সে। হাসি মুখে আরেকটু কেক কেটে নাদিয়ার প্লেটে দিয়ে দেয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে। সোহানার হাসি দেখে নাদিয়ার যেন পিত্তি জ্বলে যায়। তবুও চুপচাপ খেয়ে নিজের ঘরে চলে যায় সে। বই খাতা গুছিয়ে রেখে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
সবাই চলে যাওয়ার পর সোহানা মোবাইল নিয়ে বসে। হোয়াটসঅ্যাপের সব মেসেজ ডিলেট করে ফেলেছিল চ্যাটিং শেষ করেই। এজন্য প্রেমিকের দেওয়া জন্মদিন উপলক্ষের মেসেজগুলো দেখা গেল না। তাকে অনলাইনে না পেয়ে শুভ রাত্রি মেসেজ দিয়েই আবারও কনভারসেশন ডিলেট করে দেয় সে। অতঃপর ইয়ারফোন কানে দিয়ে কতক্ষণ গান শুনে।।
রাত ১১ টা বেজে গেছে তবুও নাজমুল সাহেব ঘরে আসেন না। সোহানার এবার একটু বিরক্ত লাগে। মনে মনে চিন্তা করে, ‘প্রেমই নাই যেখানে সেখানে উনি অভিমান করে। এমন গা*ধা তো জীবনে দেখিনি।”
অনেকক্ষণ নানান কথা চিন্তা করে আর গান শুনে শুয়ে শুয়ে। নাজমুল সাহেবের তখনও আসার নাম নেই। সোহানা আবার চিন্তা চিন্তা করে শাড়ি পরলে কোনো সমস্যা আছে কি না। কোনো হ্যাঁ না উত্তর আসে না নিজের ভিতর থেকে। শেষে সব চিন্তা বাদ দিয়ে আলমারি থেকে সাদা একটা ব্লাউজ বের করে। পরনের কাপড় পাল্টে সাদা ব্লাউজের সাথে নীল শাড়ি পরে নেয়। অনেকদিন পর শাড়ি পরেছে সে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বিশেষ কি এমন পরিবর্তন হয়েছে। যার জন্য ছেলেরা তাদের প্রেমিকা বা স্ত্রীদের শাড়িতে দেখতে পছন্দ করে। এটা বুঝতে বেশি সময় লাগে না তার। নীল শাড়ি তার সৌন্দর্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে এই শাড়ি পরার পরে। তাই শাড়ি পরা শেষে হালকা কাজল আর লিপস্টিক দিয়ে নিজের সৌন্দর্য আরেকটু বাড়িয়ে তোলে। এর বেশি আর সাজতে ইচ্ছে করে না তার। সাজ শেষে নাজমুল সাহেবের ফোনে মেসেজ দেয় কয়েকটা। কোনো উত্তর নেই দেখে কল দিতেই ফোনের ভাইব্রেশন হওয়ার শব্দ আসে তার কানে। মোবাইল ঘরে রেখেই ছাঁদে উঠেছেন তিনি।
কি আর করার! কতক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর নিজেই ছাঁদের দিকে পা বাড়ায়। তার আগে চেক করে নেয় ফ্ল্যাটের সদর দরজা তালা দেওয়া হয়েছে কি না। নাদিয়া এই কাজ সেরে তবেই শুয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পর বাইরে থেকে নিজ রুমের দরজা দিয়ে ছাঁদে চলে যায় সোহানা। নাজমুল সাহেব ছাঁদের এক কোনে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। সোহানা ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অন্য দিকে ঘুরে যান নাজমুল সাহেব। সোহানা আবারও সামনের দিকে গেলে ঐ জায়গা ছেড়েছে উঠে যান তিনি। আবার অন্য জায়গায় গিয়ে বসতেই সোহানাও সেখানে গিয়ে ওনার পাশে বসে পরে। নাজমুল সাহেব এবার কেবল অন্য দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
সোহানার এই স্তব্ধতাকেও ভয় লাগে। যেদিন তার গলা টি*পে ধরা হয়েছিল সেদিনের পর থেকে নাজমুল সাহেবের সকল অস্বাভাবিক আচরণকে ভয় পায় সে। আজকেও এতো রাতে শাড়ি পরার পিছনে সেই ভয়ই কাজ করেছে। মোটেও ভালোবাসা থেকে সাজেনি সে। আজ রাতেও যেন রাগ থেকে কোনো আঘাত তার উপরে না আসে, সে জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে সে। আরেকটু কাছে ঘেঁষে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে বলে, এখনও রাগ করে থাকবেন! একবার তাকান আমার দিকে!’
নাজমুল সাহেব কিছুই বলেন না। নির্জীব হয়ে তাকিয়ে থাকেন অন্য দিকে। সোহানা আরেকটু কাছে গিয়ে ওনার হাত ধরে ফেলে । দুই হাতে শক্ত করে হাতটা ধরে নিজের তালুতে নিয়ে বলে, ‘ আপনি না বললেও এমনিতেই আমি শাড়িটা পরতাম। আপনি নিজে থেকে বলছেন দেখে শুধু না করেছি।’
নাজমুল সাহেব তখনও নির্জীব। সোহানার ভয় বেড়ে যায়। কিন্তু এবার একটু ভিন্ন ভাবে চেষ্টা করে। ওনার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, “আচ্ছা তাকাবেন না তো আমার দিকে! ঠিক আছে চলে যাচ্ছি আমি। শাড়িও খুলে ফেলব কাউকে আর দেখতে হবে না।”
কথাটা শেষ করেই অভিমান করার মতো কৃত্রিম ভঙ্গিমা করে উঠে যায় সোহানা। কিন্তু পা সামনে বাড়ানোর আগেই তার হাতটা ধরে ফেলেন নাজমুল সাহেব। একটানে বসিয়ে দেন সোহানাকে। তারপর সোজা গলা টি*পে ধরেন দেয়ালে ধা*ক্কা দিয়ে। সোহানার শ্বাসবন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে যায়। ঠিক তখনই নাজমুল সাহেব তার কানে কানে বলে, ‘কসম করে বলছি। যদি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করিস তবে তোর প্রাণটাও তোকে ছেড়ে যাবে।’
সোহানার জিহ্বা বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়, বারবার নাজমুল সাহেবের হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। কিন্তু কিছুতে ছাড়াতে পারে না নিজেকে। কিছুক্ষণ পর নাজমুল সাহেব নিজে থেকেই ছেড়ে দেয় তাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার অবস্থা হয় তার। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে নিজের বিচার বুদ্ধি ফিরে পেতে। স্বাভাবিক হতেই এক লাফে উঠে দাঁড়ায় সে। অতঃপর নাজমুল সাহেবের মুখের উপরে বলে দেয় ‘আপনি একটা জানাে*য়ার, জঘন্য জানো*য়ার। ”
নাজমুল সাহেব কিছু বলেন না তাকে। শুধু খেঁকখেঁক করে হাসতে থাকে। সোহানাও রাগে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় ওনার গালে। তারপর দ্রুত দৌড়ে নিচে চলে যায়।
নাজমুুল সাহেব তখনও একা একা হাসতে থাকে। সোহানার থাপ্পড়কে কিছুই মনে করেন না। পকেট থেকে মুচড়ে যাওয়া সিগারেটটা বের করে জ্বালায় সেটা। একটার পর একটা টান দেয় আর নিজে নিজেই বলে, “এই জানো*য়ারটা তোকে জানো*য়ারের মতোই ভালোবাসে। জানো*য়ার তার মনিবকে যতটা ভালোবাসে আমি তারচেয়ে বেশি ভালোবাসি তোকে। ‘
সিগারেটের সাদা ধুঁয়ার সাথে সাথে এই অদ্ভুত কথাগুলোও বাতাস মিলিয়ে যেতে থাকে।
আট….
একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে পুলিশের কাছে। বলা হয় এস আই আজিজ স্যারের কাছে দেওয়ার জন্য। কলটা ডাইভার্ট করা হয় আজিজ সাহেবের ফোনে। ওপাশ থেকে একটা যুবক ছেলে বলে, ” আজিজ স্যার বলছেন? ‘
এস আই আজিজ সাহেব বলেন, ‘জি, বলুন কি বলতে চান।’
‘ স্যার আপনারা যে খু*নিকে খুঁজছেন আমি তাকে দেখেছি।”
‘ কোন খুনি! আমরা তো কত খুনিকেই খুঁজছি।’
‘ আরে স্যার কয়দিন আগে যে একটা ছেলে তার বউকে খুন করল, পত্রিকায় খবর আসল ছবিসহ। সিয়াম নাম।’
আজিজ সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, ‘ কি বলছ কখন দেখছ তাকে?’
‘ এইতো স্যার মাত্র ২ মিনিট আগে।’
‘ ঠিকানা বল তাড়াতাড়ি। ‘
ছেলেটি বিস্তারিত ঠিকানা দিল এস আই আজিজ সাহেব কে। আজিজ সাহেব দ্রুত ফোর্স নিয়ে ১ঘণ্টার মধ্যে হাজির হলেন একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে। বাড়ির সীমানায় পা রাখতেই গাঁজার গন্ধ ওনাদের নাকে আসতে লাগল। অল্প চাঁদের আলোতেই ভাঙা বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন উনি ও ওনার ৩ সহযোগী। পা টিপে টিপে একটা ভাঙা রুমের সামনে যেতেই গাঁজার গন্ধটা প্রকোপ হলো। বুঝে গেলেন এখানেই হয়তো কেউ আছে। টর্চ লাইটটা জ্বালিয়ে ভিতরের দিকে আলো ফেলে দেখলেন কেউ নেই। দালান ঘর বলেই হয়তো অনেকক্ষণ আগের গন্ধ এখন অবদি রয়ে গেছে। ঘরের ভিতরে ঢুকে সব দিকে দেখতে লাগলেন তিনি। হঠাৎই একটা মানুষের পিঠের উপরে আলো পরল টর্চ লাইটের। ধারণা করলেন এই হয়তো সেই লোক যে এতোক্ষণ গাঁজার ধুঁয়া উড়িয়েছে। আর এখন নেশাগ্রস্ত হয়ে এখানেই পরে আছে।
আরেকটু কাছে যেতেই বুঝতে পারলেন এটা বয়স্ক লোক নয় বরং যুবক বয়সী একটা ছেলে। আজিজ সাহেব লাইটটা সহকর্মীর হাতে দিয়ে এক টানে উল্টে ফেললেন ছেলেটাকে। সাথে সাথে চমকে উঠল সবাই। আরে! এই তো সিয়াম। কিন্তু এই অবস্থা কি করে হলো! তার কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, পেট থেকেও রক্ত বের হয়ে পুরো টি শার্ট লাল করে দিয়েছে। এস আই সাহেব তার হাতের রগ চেপে ধরে দেখলেন। না না, একবারের জন্যও কাঁপছে না। অনেক আগেই হয়তো উড়ে গেছে তার প্রাণ পাখি।
( চলবে ইন শা আল্লাহ)
. #গল্প- #আড়ালে_কে [ #পর্ব – ১১ ]
#লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক [ জুনিয়র মুগলি ]
যাকে ধরার জন্য পুলিশ খুঁজছে সে’ই যখন খু*ন হয়ে যায় তখন পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় তা সহজেই আন্দাজ করার নয়। এবার, ভিক্টিম নিজেই খু*ন হয়ে গেছে, এই লিখেই কেস ক্লোজ করে দিতে হবে। কিন্তু ভিক্টিমকে কে খু*ন করল সেটা নিয়ে কি আরেকটা কেস হবে না!
পুলিশ সেটা পরে ভাববে, কেউ যদি তার হয়ে মামলা করতে চায় তবেই নতুন করে কাজ শুরু করবে। নয়তো নেশা করতে গিয়ে খুন হয়েছে অন্য কোনো নেশাগ্রস্তের হাতে এটা লিখেই ফাইল ক্লোজ। মাঝে মধ্যে টাকার দরকার পরলে হয়তো একটু খু*নের জায়গাটায় তল্লাশি করবে। যাদের সেখান থেকে ধরতে পারবে তাদের কিছু জেরা করবে আর টাকা নিয়ে ছেড়ে দিবে। সরকার বাদী মামলা করে খু*নী খুঁজে বেড়ানোর কাজ বাংলাদেশ পুলিশের নয়।।
তাই সাধারণ সুরতহাল লেখা শেষ করে লা*শ সেখান থেকে নিয়ে চলে আসেন ওনারা। সিয়ামের বাড়িতে খবর দেওয়া হয় যে তাদের ছেলে খু*ন হয়ে গেছে। কোথায় খু*ন হয়েছে সেই ডিটেইলস তাদের জানায় পুলিশ। এমন নেশাখোরদের আড্ডায় খু*ন হয়েছে তাদের ছেলে এটা নিয়ে শুধু শুধু আর মামলা হা*মলা করল না সিয়ামের পরিবার। ময়না*তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লা*শ হস্তান্তর করা হলে তারা শুধু দাফন কাফন সম্পূর্ণ করে।
বিয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আজকে লা*শ হয়ে ফেরত এসেছে। তার মৃত্যুতে লোকজন কষ্টের চাইতে খুশিই হয়েছে বেশি। এর পিছনে কারণ একটাই, কয়দিন আগেই তার করা কুকর্মের কথা সবারই জানা। নিজের স্ত্রীকে যে এতো অত্যাচার করেছে, নৃ*শংস ভাবে খু*ন করেছে তার এভাবে বেঘোরে ম*রাই ভালো হয়েছে।
সাইফার ভাইয়েরাও এসেছিল লা*শ দেখতে। বোনের স্বামী এবং খু*নীকে শেষ বারের মতো দেখে গেল একবার। সাইফার বড় ভাই তো সবার সামনে একবার বলেই ফেলেছে, ‘জানাযা না দিয়া কু*ত্তা দিয়া খাওয়ানো উচিত এরে। কিসের কবর দিব লা*শ পোড়া দেন নিয়া।
কেউ কিছু বলতে পারে না ওকে। সাইফার ছোট ভাই কেবল টেনে নিয়ে এসে পরে সেখান থেকে। আর দু’জনে জানাযা না পরেই বাড়িতে চলে আসে। তারপর বিকালে থানায় গিয়ে কেস বিষয়ক সকল ঝামেলা শেষ করে সাইফার বড় ভাই।
দুই দুইটা প্রাণ হুট করে ঝরে পড়ল। একজনের খু*নির তো সন্ধান পাওয়া গেল, যদিও সে মৃত। কিন্তু অন্য জনের খু*নি কে! প্রশ্ন থেকেই গেল। কিন্তু এই প্রশ্নের সমাধান করার পিছনে সময় নষ্ট করেনি পুলিশ। কেউ যেখানে মামলা করছে না, সেখানে তাদের আর কি করার!
আট…
রেগে মেগে ঘরে ঢুকেই পরনের নতুন শাড়িটা একদম টেনে হিঁচড়ে খুলতে লাগল সোহানা। এতো সুন্দর শাড়িটা এখন তার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস মনে হচ্ছে। ঠোঁটের লিপস্টিক গুলোও লেপ্টে ফেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে। মনে চায় শাড়িটা পুড়িয়ে ফেলতে। কিন্তু এতো বেশি সাহসও হয় না তার। তাই কেবল একদম ছেঁড়া কাপড়ের মতো পেচিয়ে ফেলে রাখে বক্সটার উপরে। তারপর আগের সেই থ্রি-পিস টা পরা শেষ হতেই দরজায় টোকার শব্দ শুনতে পায় সে। ওর একদমই খুলতে মন চায় না। ইচ্ছে করে সারা রাত নাজমুল সাহেবকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখতে।
কিন্তু অতোটাও সাহস নেই তার। পরপর ৩ বার টোকা পরতেই দরজা খুলে দিল সে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে সোজা বিছানায় তলে গেল। নাজমুল সাহেবের মুখের দিকে একবারও তাকায়নি এর মাঝে। রাগে তার পিত্তি জ্বলে, মনে মনে ভাবে, ‘আমাকে পুুতুল পেয়েছে দুইদিন পরপর গলা টি*পে ধরবে। আর সহ্য করব না আমি, আরেকদিন এমন করলে সোজা মামলা করে দিব। এবার আর শুধু ডায়েরি করব না।”
নাজমুল সাহেব দরজাটা লাগিয়ে সোজা চলে যায় গোসলখানায়। মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ দূর করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় উঠেন। সোহানা বিছানার একদম উত্তর পাশে শুয়েছে। আর মাঝে একটা বালিশ রেখে অপর পাশে ওনার বালিশটা রেখেছে। নাজমুল সাহেব মুচকি মুচকি হাসেন এসব দেখে। মাঝখানের বালিশ টা তুলে নিয়ে নিজের বালিশটা সোহানার কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সোহানা এতোক্ষণ উল্টো পাশ ফিরে শুয়েছিল। কিন্তু নাজমুল সাহেব পাশ ঘেঁষে শোয়া মাত্রই ওনার দিকে ফিরে সে। ডান হাতে ওনার বুুকে ধাক্কা দিয়ে পিছনে নিতে চায়। নাজমুল সাহেব যেতে না চাইলে জোর গলায় বলে, “খবরদার একটুও কাছে আসবেন না। আমি কোনো পুতুল না যে যখন খুশি জড়িয়ে ধরবেন আর গলা টি*পে ধরবেন।”
নাজমুল সাহেব এসব কানেই তুলেন না, সোহানার ঐ হাত ধরেই উল্টো নিজের দিকে টেনে নেয় নিজের দিকে। কানে কানে বলে, ‘তুমি পুতুলের চাইতেও অনেক সুন্দর। সেটার সাথে কেন’ই বা তুলনা করব! আর তুমি যদি নিজ ইচ্ছেতে আমার বুকে মাথা রাখতে তবে কসম আল্লাহর, কোনোদিন একটা ফুলের টোকাও দিতাম না।”
সোহানা কোনো কিছু বলে না। ঝাঁকি মেরে নিজের হাত ছুটিয়ে নেয়। চুপচাপ উল্টো পাশে ফিরে শোও। নাজমুল সাহেব আবারও তাকে জড়িয়ে ধরে পিছন থেকে। একই ভাবে বলে, ‘একবার ভালোবেসে দেখতে কতটা ভালোবাসি তোমাকে। কেবল তো নিজের কষ্টটার দেখলে আমারটা তো একবারও দেখলে না। এতোদিন হলো বিয়ে করেছি একবার কি মন থেকে আমার ভালোবাসা কামনা করছ!”
সোহনা উত্তর দেয় না। চুপটি করে শুয়ে থাকে। অনেকক্ষণ কিসব ভেবে তারপর বলে, “একবার এটা ভাবছেন গলা টি*পে ধরলে আমার কেমন লাগে! আমার চোখ, জিহ্বা ছিঁড়ে যাবে বলে মনে হয়।’
নাজমুল সাহেব হেসে উঠে বলেন, ‘হাহ্ তুমি আমাকে গলা টি*পে ধরার কষ্টের কথা বলছ! অথচ তুমি নিয়মিতই আমার কলিজা টি*পে ধরছ। আমার হৃদপিণ্ডটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছো সেটা কেন বুঝতে চাও না।”
সোহানা এসব কথার কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। কতক্ষণ পর নিজের গলাতে পানির স্পর্শ পায়। পানি গলা বেয়ে সেসব নামতে থাকে বুকের দিকে। নাজমুল সাহেব কাঁদতেছে! নিজের ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় সে। ডিম লাইটের আলোতে চিকচিক করে চোখের জ্বল। এই প্রথম কেমন যেন লাগে সোহানার কাছে। কখনো কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে কাঁদতে দেখেনি সে। আজকেই প্রথম যে মানুষটিকে কাঁদতে দেখছে সে আবার খুব দূরের নয়। খুব কাছের একজন মানুষ, যাকে যে ইচ্ছেকৃত কষ্ট দিচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সে নিচু স্বরে বলে, ‘ আমি কি করব বলেন আপনিই? আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিয়েছে আমার বাড়ি থেকে। বিয়ের আগে আপনার সাথে কথা বলারও সুযোগ দেয়নি। নয়তো আগেই সব বলতাম আপনাকে।’
নাজমুল চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে, ” সত্যি কথা বলবে, কেন পছন্দ হয় না আমাকে? বয়স তোমার চেয়ে অনেক বেশি বলে না-কি অন্য কাউকে পছন্দ কর?’
সোহানা এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না। বোবার মতো চুপ করে থাকে সে। নাজমুল সাহেব হাসতে হাসতে বলেন, ‘বলতে হবে না আর। চুপ থাকা দেখেই বুঝে গেছি। আচ্ছা যাকে পছন্দ কর সে কি আমার চেয়ে অনেক হ্যান্ডসাম আর আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে তোমাকে?’
সোহানা এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। একবার তার ভিতরে খারাপ লাগে আবার পরক্ষনেই ভয় করে, ভাবে আবার গলা টি*পে ধরবে না তো! চোখ বন্ধ করে চিন্তা মগ্ন হয় সে।
হঠাৎই গালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খোলে। নাজমুল সাহেব তার খুব কাছে চলে এসেছেন। তার চোখে চোখ রেখে বলে, ‘একবারের জন্য ভালোবেসে দেখ না আমাকে। কথা দিচ্ছি সারাজীবন আগলে রাখব। ‘
সোহানার কাছে যেন একদমই অর্থহীন লাগে এসব কথা। নাজমুল সাহেবের হাতটা নিজের গাল থেকে সরিয়ে দেয় নিজ হাতে। একবারের জন্যও মনে হয় না যে এই মানুষটা কতটা আবেগ নিয়ে কথাটা বলছে। অতঃপর নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চুপ করে শুয়ে পরে অন্য পাশ ফিরে। নাজমুল সাহেবও আর স্পর্শ করে না তাকে। নিজেও আরেকটু দূরে গিয়ে উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। দুজন বিছানার দুই পাশে শুয়ে নানান ধরনের চিন্তা করতে থাকে।
সোহানার প্রায় চোখ লেগে আসে। ঘুম ঘুম ভাব হয়ে যায়। এমন সময় আবারও ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস পায়। নাজমুল সাহেব তার কানের কাছে বলতে থাকেন, ‘সব নিয়ম মেনে, পুরো দেনমোহর আদায় করে তারপর তোমাকে বিয়ে করে এনেছিলাম। তোমার উপরে আমার সম্পূর্ণ হক ছিল। কিন্তু তোমার অনিচ্ছার পরে কোনোদিন জোর করিনি তোমার উপরে। সব সময় চেয়েছিলাম যে তুমি আমাকে বুঝতে শিখ, আমাকে ভালোবেসে নিজ ইচ্ছেতেই আমার বুকে মাথা রাখো। কিন্তু তুমি তোমার সব কিছু হয়তো অন্য কারো জন্য উৎসর্গ করে বসে আছো। তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই, ঠিক বা ভুল যাই কর আমি সব ক্ষমা করে দিছি। আজকের রাতটা তোমার জন্য শেষ সময় তুমি সিদ্ধান্ত নিবে সব কিছু ছেড়ে আমার হবে! না-কি হবে না। আজকের পর থেকে তোমার আর এই সুযোগ থাকবে না। আর কখনো তোমাকে ভালোবেসে স্পর্শ করব না আমি।”
এক নাগাড়ে সব গুলো কথা শেষ করে আবারও নিজের জায়গায় শুয়ে পরেন তিনি। সোহানার বুক ধুকধুক করতে শুরু করে। অনুভূতি হয় কেউ যেন তার ভিতরের প্রতিটি অঙ্গ চেপে ধরছে। টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে সব। তার চোখের ঘুম উধাও হয়ে যায় মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরতে থাকে, ‘আগামীর দিন গুলোতে কি হবে আমার!’
সারারাত নানান চিন্তা করে শেষ রাতে চোখ লেগে আসে তার। ঘুমের দুনিয়ায় হারিয়ে যায় হুট করেই।
তারপর যখন ঘুম ভাঙে তখন প্রায় ৬:৩০ বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রাস্তার চিন্তা করতে হয় তাকে। জিনিস পত্র গোছানোর মাঝখানে বুঝতে পারে নাজমুল সাহেব কারো ঘরেই নেই। ব্যাপার টা তাকে একটু স্বস্তি দেয়। স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারে সে। রান্না শেষ করে একবার ছাদে যাবে ভাবে সে। কিন্তু তার আগেই নেমে আসেন নাজমুল সাহেব। সোহানা ভয়ে ভয়ে তাকায় ওনার দিকে। কিন্তু নাজমুল সাহেব তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। সোজা হাত মুখ ধুয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেন অফিসে যাওয়ার জন্য। সোহানা ওনাকে বাঁধা দেয়, “না খেয়েই কোথায় যাচ্ছেন?’
নাজমুল সাহেব র*ক্তচক্ষুতে তাকায় ওর দিকে। গমগমে গলায় বলেন, ‘আমি মনে চায় জাহান্নামে যাই তাতে তোর কি?’
সোহানা ভয়ে মাথা নিচু করে নেয়। কিছুই বলার নেই তার। সে বুঝতে পারে সামনে অনেক ভয়াবহ কিছুই অপেক্ষা করছে তার জন্য। সে নিজেকে আরেকটু আন্তরিক প্রমান করার চেষ্ঠা করে। কৃত্রিম আবেগ দেখিয়ে নাজমুল সাহেবের হাত ধরে বলে, ‘প্লিজ না খেয়ে যাবেন না। ‘
নাজমুল সাহেব এক হেঁচকা দিয়ে সোহানার হাত সরিয়ে দেয়। তারপর চোখ বরাবর আঙুল তুলে দাঁত কিরকির করতে করতে বলে, ” তুই আমাকে, একবারও টাচ করবি না। যা তোর কোনো প্রেমিক আছে তার হাত ধর গিয়ে। ”
কথা শেষ করেই সোহানার কাঁধে স্বজোরে ধা*ক্কা মেরে ঘর থেকে বের হয়ে যান তিনি। সোহানা কোনো রকমে নিজের তাল সামলে নিয়ে পরে যাওয়া থেকে রক্ষা পায়। অতঃপর মাথায় হাত দিয়ে বসে বসে চিন্তা করতে থাকে ভবিষ্যতের।
নাজমুল সাহেব কি সত্যি সত্যি অভিমান করে তার থেকে দূরে থাকবে! না-কি আবারও জানো*য়ারের মতো ক্ষিপ্র হয়ে আক্র*মণ করবে তাকে?
( চলবে )