#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১২
বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে হলে ফিরে বিছানায় গড়াচ্ছিলো শোভা। কিছু ভালো লাগছিল না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নিজের অজান্তেই নজর চলে যাচ্ছে ফোনের উপর। অন্য দিন হলে এতোক্ষণে কতবার ফোন চলে আসতো। আর আজ একবারও ফোনটা বাজলো না। শোভা ফোন উল্টো করে বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমানো দরকার অথচ ঘুম আসছে না। আজব তো! মাত্র তিন সপ্তাহে সারাজীবনের অভ্যাস বদলে যাবে? এসব কেমন কথা? নিজেকে খানিকটা ধমকে নিলো মনে মনে। কিছুক্ষণের জন্য মন শান্ত হল। দশমিনিট পরে আবারও একই কথা মনে ঘুরপাক খায়। বিরক্ত হয়ে বিছানায় উঠে বসলো শোভা।
রুমে ফিরে শোভাকে ওভাবে বিছানায় বসে থাকতে দেখে অবাক হলো ওর এক রুমমেট জুথি।
“কিরে শোভা, আজ বাইরে যাসনি? আজ তো বৃহস্পতিবার তোর বাইরে ঘোরার দিন।”
“নারে, আজ শরীরটা ভালো না তাই যাইনি।”
ডাহা মিথ্যে কথা বলে শোভা।
“ওহহহ, কি হয়েছে?”
জুথির উদ্বিগ্ন কন্ঠ শোনা গেলো।
“তেমন কিছু না। পেট ব্যাথা করছে।”
“পেইন কিলার খেয়েছিস?”
“হুম।”
উল্টো ঘুরে ঘুমানোর ভঙ্গি করে শোভা। কথা বলতে একদম ভালো লাগছে না তার৷ মন খারাপ হচ্ছে ভীষণ। ঘড়ি দেখেছে সে। সন্ধ্যা সাতটা বাজছে। এতোটা সময় গেলো একবারও রিফাতের ফোন এলো না। অথচ খুব দাবি করে তার কেয়ার করে। বন্ধুদের পেয়ে তাকে ভুলে গেছে। ঠিক আছে বন্ধুদের নিয়েই থাকো। তোমার সাথে আর কথা বলবে না শোভা। তুমি হাজার বার সরি বললেও না!
“এই শোভা, তোর জন্য একটা পার্সেল আছে।”
শোভার অন্য রুমমেট কনা এসে ঢুকলো ঘরে। হাতে একটা লাল র্যাপিং এ মোড়ানো পার্সেল। শোভা বিস্মিত হয়ে উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে পার্সেল নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলো। কোনায় ছোট করে শোভার নাম লেখা এছাড়া আর কিছু লেখা নেই। কে তাকে পার্সেল পাঠাবে? কানিজ আপু নাতো?
“খোল তো। দেখি কে কি দিলো তোকে?”
কনা বললো। শোভা অনিচ্ছায় পার্সেল খুলতেই টকটকে লাল রঙের জামদানী শাড়ি বেড়িয়ে এলো পার্সেল থেকে। জুথি ছুটে এসে জামদানী শাড়িটি লুফে নিলো-“ওয়াও, কি সুন্দর শাড়ি। কে দিলো রে শোভা?”
“এই শাড়িটার অনেক দাম হবে শোভা। পুরো শাড়ি জুড়ে কি সুন্দর কাজ দেখেছিস?”
জুথির কাছ থেকে কনা নিলো শাড়িটা। নিজে গায়ে মেলে ধরলো। শোভার নজর তখন অন্য কিছুর দিকে। বক্সে একটা চিঠি আছে। সেটাই খুলে দেখছিল সে। গোটা গোটা হাতে লেখা চিঠির ভাষা অনেকটা এমন-
“জানি তোমার অনেক মন খারাপ আজ বেড়াতে যেতে না পেরে। কিন্তু কি করবো বলো, বন্ধুরাও তো জরুরি জীবনে। তবে না যেয়ে একদিকে ভালোই হয়েছে। আসলে মনে মনে এটাই এ সপ্তাহে প্ল্যান করেছিলাম। আজ না যেয়ে কাল সকালে যাব। সারাদিন বাইরে বেড়াবো। কালকের দিনটা একটু অন্যরকম ভালো কাটাবো আমরা। এইজন্যই তোমার জন্য এই শাড়ীটা পাঠালাম। এই শাড়ি পরে শার্প সকাল আটটায় ভার্সিটির গেটে দেখতে চাই তোমাকে। কাল আমরা দূরে কোথাও হারিয়ে যাব। একমিনিটও যেন দেরি না হয়। শাড়ী পরা তোমাকে দেখার জন্য আজ সারারাত ঘুম হবে না আমার।
রিফাত।”
শোভা অতিদ্রুত চিঠিটা লুকিয়ে ফেললো বালিশের তলায়। কনা আর জুথির দিকে তাকিয়ে রাগ লাগছে। ওর শাড়িটা দু’জন মিলে টানাটানি করছে।
“কি করছিস তোরা? শাড়িটা ছিঁড়ে যাবে না? আশ্চর্য! দে আমার কাছে দে।”
শোভার হাতে শাড়ি গছিয়ে দিয়ে কনা জানতে চাইলো-“কে দিয়েছে রে শাড়ীটা?”
“কানিজকে চিনিস তো? কুর্নিশে কানিজের কানিজ আপু? উনি পাঠিয়েছে। আমি ওনার পেজে কাজ করি। কাল অনুষ্ঠান আছে। শাড়ী পরে যেতে হবে তাই শাড়ীটা পাঠিয়েছে।”
“বাব্বাহ, এতো দামী শাড়ী পাঠাবে তাই বলে?”
“হুম। এসব অনুষ্ঠানে দামী ড্রেস পরেই যেতে হয়। সাধে পাঠায়নি।”
শোভা শাড়ি ভাজ করে আবার বক্সে তুলে রাখে। অবাক হয়ে ভাবলো কি অবলীলায় মিথ্যে বলে যাচ্ছে ও। একটুও খারাপ লাগছে না। বরং এই লুকোচুরি খেলাটা ভালো লাগছে। মনে অদ্ভুত আনন্দ। রুমমেট দু’জন না থাকলে হয়তো গুনগুনিয়ে গান গেয়ে উঠতো। শাড়ীটা গায়ে ধরে নাচত। শোভা ভাবছে এ কেমন পরিবর্তন হয়েছে তার?
★★★
সাতসকালে ঘুম ভেঙেছে শোভার। জুথি আর কনা তখন ঘুমে কাঁদা। শোভা যতটা সম্ভব আওয়াজ না করে হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হতে বসলো। শাড়ি পরতে পারে না শোভা। সেদিন ছোট বোন বিভা ওকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল। আজ একা একা কি করবে তাই ভাবছে। কয়েকবার করে ইউটিউবে শাড়ী পরার ভিডিও দেখে নিয়ে অনেকবারের চেষ্টায় শাড়ী পরলো। আয়নায় নিজেকে দেখলো বারবার। সন্তুষ্ট হলো, দেখতে খারাপ লাগছে না তাকে। সাড়ে সাতটার দিকে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়লো। আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই ইউনিভার্সিটির গেটে চলে এলো শোভা। দূর থেকেই রিফাতের গাড়িটা দেখেছে। কাছাকাছি এসে গাড়ির গ্লাসে টোকা দিলো। রিফাত দরজা খুললো না। আবারও টোকা দিল কিন্তু কোন আওয়াজ নেই। শোভা উঁকি দিয়ে দেখলো রিফাত গাড়ির সিটে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। হাসি পেয়ে গেলো শোভার। তাকে ঠিক সময়ে আসতে বলে এখন নিজেই ঘুমাচ্ছে দেখো। শোভা এবার জোরে জোরে শব্দ করে। রিফাত লাফ দিয়ে উঠে বসলো। শোভা হাত নাড়তেই চোখ কচলে গাড়ির দরজা খুলে দিলো-“সরি, তুমি এসেছ টের পাইনি।”
শোভা চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো।
“আসলে ভোরে উঠে রওনা দিয়েছি তো। রাতেও ঘুম হয়নি। তাই সাতটার দিকে এখানে পৌঁছে দেখলাম হাতে সময় আছে একটু ঘুমিয়ে নেই। তুমি কি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলে?”
একবার ভাবলো হ্যা বলবে। পরক্ষণেই মত বদলালো শোভা। বেচারা তার জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠে এতোদূর গাড়ি চালিয়ে এসেছে তাকে পেরেশান করা উচিত হবে না। সে মাথা নেড়ে না বললো-“খুব বেশিক্ষণ না। পাঁচ মিনিট হবে হয়তো।”
“ওহহ। চলো তাহলে আগে কোথাও থেকে নাস্তা করে নেই। খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।”
“ঠিক আছে কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
“আগে চলো তারপর দেখতে পাবে। তার আগ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরো।”
“ওকে।”
পথে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে সকালের নাস্তা করলো ওরা। তারপর রওনা দিলো। গাড়ি চালাতে চালাতে টুকটাক কথা বলছে রিফাত। শোভা ভেতর ভেতর অস্থির হচ্ছে। এতোটা সময় হয়ে গেছে রিফাত একটাবার তার দিকে ঠিকঠাক তাকিয়ে দেখেনি। তাকে কেমন লাগছে সেটাও বলেনি। আজব একটা ছেলে তো! মেয়েটা প্রথমবারের মতো নিজের চেষ্টায় শাড়ী পরেছে তাকে একটু এপ্রিসিয়েট করবে না? কেমন লাগছে জানাবে না? অভিমানে গাল ফুলাতে মন চাইলেও শরমে পারছে না। পাছে রিফাত তার মনোভাব বুঝে হেঁসে না দেয়।
অনেকটা সময় পরে সামনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শোভার চোখ লেগে এসেছিল। তখনই গাড়িটা থেমে গেলো। শোভা চোখ খুলে তাকালেই রিফাতকে দেখলো তার পাশের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। শোভা বললো-“কি?”
“নামো চলে এসেছি।”
গাড়ি থেকে নেমে সামনে তাকিয়ে অবাক হলো। সামনে বিশাল এক দীঘি, তার অপর পাশে রাজবাড়ীর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। শোভা বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলো-“কোথায় এটা?”
“টাঙ্গাইল। মহেরা জমিদার বাড়ি।”
“বেশ সুন্দর তো। আগে কখনো দেখিনি এরকম।”
“ভেতরে চলো, আরো ভালো লাগবে। আরও দু’টো দিঘি আছে ভেতরে। দীঘির পাশে বসার ব্যবস্থা আছে। তোমার লাক যদি ভালো হয় তাহলে বৃষ্টি নামবে। তখন বুঝবে সৌন্দর্য কাকে বলে।”
শোভা বিনা বাক্যে রিফাতের পিছু নিলো। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে চারপাশে মুগ্ধ দৃষ্টি বুলিয়ে নিচ্ছে। ভাবছে, এই পৃথিবীতে দেখার কতকিছু আছে অথচ সে এখনো কিছুই দেখেনি।
কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে জায়গাটা দেখতে পেল শোভা। দীঘির উপর কাঠের পাটাতন দিয়ে বসার জায়গা তৈরি করেছে। উপরে ছাউনি দেওয়া। দেখতে বেশ লাগছে। রিফাত এগিয়ে গিয়ে ডাকলো তাকে-“এসো এখানে বসে চা খাই। আকাশে মেঘ জমছে, বৃষ্টি নামলে এখানটায় বসে দেখতে কি যে ভালো লাগে।”
“আপনি আগে এসেছিলেন?”
“হ্যা, বন্ধুদের সাথে।”
“ওহহহ।”
মন খারাপ হলো শোভার। যে কোন সুন্দর কিছু দেখার পর ওর যেমন আনন্দ হচ্ছে। রিফাত আগে দেখেছে সেটা ভেবে মন খারাপ হচ্ছে। দু’জনার অনুভূতি তো মিলছে না। ও সবকিছুতে মুগ্ধ হচ্ছে যেখানে রিফাতের হয়তো কেবল ভালো লাগছে। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে চায়ে চুমুক দেয় শোভার দৃষ্টি দীঘির অপর পাড়ে। হঠাৎ ক্লিকের শব্দে চমকে ফিরে দেখলো রিফাত তার ছবি তুলছে। ওকে তাকাতে দেখে হাসলো-“শাড়িতে তোমাকে কি চমৎকার লাগছে বলে বোঝাতে পারবোনা। আমি যেমনটা কল্পনা করেছিলাম তার চাইতেও সুন্দর। আর এই যে মন খারাপ করে ওদিকে তাকিয়ে ছিলে একদম অন্যরকম লাগছিল। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। দেখ তো নিজেকে চিনতে পারো কিনা।”
রিফাত মোবাইল এগিয়ে দিলো শোভার দিকে। শোভা দেখলো আসলেই তার চেহারায় অন্যরকম মাদকতা খেলা করছে। নিজেকে চিনতে পারে না সে। রিফাত মোবাইল নিয়ে নেয়-“নিজেকে এভাবে দেখতে হয় নাকি বোকা মেয়ে?”
শোভা লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
“এখন বলো তো মন খারাপ কেন করলে? এসব জায়গা আমি আগে দেখেছি সেজন্য?”
শোভা আবারও লজ্জিত হলো। এই ছেলে তার মন পড়তে পারছে কি করে? রিফাত ওর কাছে এগিয়ে এলো। মিহি স্বরে বললো-“তুমি একটা জায়গায় যতবারই যাও না কেন যদি ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সাথে যাও তাহলে প্রতিবার সব নতুন করে দেখবে। আগেরবার বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম ওদের মতো করে দেখেছি। এবার তোমার সাথে এসেছি তোমার মতো করে দেখছি। আগের বারের তুলনায় এবার সবকিছু দ্বিগুণ ভালো লাগছে। কাজেই মন খারাপ করার কিছু নেই।”
রিফাতের কথা শেষ হতে হতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আশেপাশে যারা ছিলো সবার মধ্যে ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেলো। কেবল শোভা আর রিফাত চুপচাপ বসে রইলো ছাউনির নিচে। দু’জন মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে। হঠাৎ রিফাত ওর কানে কানে ফিসফিস করে-“তোমার চুড়ি পরা হাতে একটু বৃষ্টি ধরবে?”
শোভা চমকে উঠলো। ঠিক এমনটাই ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মনে। কোন কথা না বলে ও এগিয়ে দাঁড়ায়। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানি ধরলো। রিফাত ওর ছবি নিচ্ছে একটার পর একটা।
“এক মিনিট।”
বলে রিফাত পকেট থেকে একটা সাদা গোলাপ বের করে শোভার চুলে গেঁথে দিলো-“এবার ঠিক আছে। একদম রবী ঠাকুরের লাবন্যর মতো লাগছে।”
বিকেলের দিকে আবারও বংশী নদীর পাড়ে এসে বসলো। শোভাকে হতবাক করে দিয়ে গাড়ি থেকে গিটার নিয়ে এলো।
ঠিক সন্ধ্যা লাগার মুহূর্তে সুর তুললো-“আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে। চলো না ঘুরে আসি অজানাতে যেখানে নদী এসে থেমে গেছে। কি যাবে? যাবে আমার সাথে? অজানাতে? বলো বলো?”
রিফাতের প্রশ্নে শোভা হেসে গড়িয়ে পড়ে। রিফাত মুগ্ধ নয়নে ওকে দেখে-“একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?”
শোভা মাথা দুলালো।
“বলো তো তোমাকে এইসব জায়গায় কেন নিয়ে আসছি? এই যে নদীর পাড়, প্রকৃতির মাঝে, দীঘির কাছে কেন বসছি বারবার?”
“আমি জানি না।”
রিফাত গভীর দৃষ্টি মেলে দেয় শোভার চোখের তারায়। সে দৃষ্টির প্রখরতায় শোভার বুক গুড়গুড় করে। সে নতমুখে বসে রয়।
“এসব পরিবেশে থাকলে মানুষের প্রেম প্রেম পায়। ভালোবাসাতে ইচ্ছে করে। কাউকে মায়ায় বেঁধে রাখতে মন চায়। এইজন্য আমি তোমাকে এসব জায়গায় নিয়ে আসছি যাতে তোমার…”
“চলুন উঠি। সন্ধ্যা নেমে গেছে আর থাকা ঠিক হবে না। ক্লান্ত লাগছে আমার। একটু রেস্ট দরকার কারন কাল ক্লাস আছে সকালে।”
রিফাত মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়-“যথা আজ্ঞা মহারানী। চলুন প্রস্থান করি।”
শোভা হাসি লুকাতে অন্য দিকে মুখ ফিরায়। অথচ মনের মধ্যে হাজারো আতশবাজি ফুটছে।
রাতে ইউনিভার্সিটির গেটে শোভাকে নামিয়ে দিতে যেয়ে আরেক চমক।
“ভাইয়া, তুমি? এখানে?”
রিফাত চমকে উঠলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদৃতা। চমকে উঠলো আদৃতাও শোভাকে দেখে। আর শোভা! ওর কি হলো হঠাৎ?
চলবে—
©Farhana_Yesmin
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৩
“তুই এখানে!”
শোভার চোখ মুখ লাল। বিস্ময়, ঘৃনা, রাগের মিশেলে ওর চেহারা অদ্ভুত দর্শন লাগছে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে তাকিয়ে আছে আদৃতার দিকে। আদৃতার চেহারায় ভয়ের ছায়া পড়েছে। সে শোভাতে দেখছে অবিশ্বাস্য নজরে। আদৃতা জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে-“এখানেই পড়ি আমি। কিন্তু তুই?”
শোভা বাঁকা হাসি হাসলো-“এখানে কি করে এলাম এটা ভেবে অবাক হচ্ছিস তাই না? আমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিলো কিংবা কোন আস্তাকুঁড়ে আশ্রয় হওয়া উচিত ছিল। এটাই ভাবছিস তো?”
আদৃতা জবাব দিলো না। শোভা এবার একটু এগিয়ে গেলো ওর দিকে, হিসহিসিয়ে বললো-“আমার জীবন নষ্ট করে দিয়ে তুই পালিয়ে গেলি। ভদ্র মেয়ে সেজে এখন ভালোই আছিস দেখছি?”
আদৃতা আড়চোখে রিফাতকে দেখলো। মিনমিন করলো-“কি যা তা বলছিস আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
“বুঝতে পারছিস না নাকি বুঝতে চাইছিস না? তুই খুব ভালো করে জানিস আমি কি বলছি, তাই না?”
রিফাত বোকার মতো দু’জনকে দেখছে। দু’জনের কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারলোনা। সে এগিয়ে এসে জানতে চাইলো-“তোমরা একে অপরকে চেন?”
“খুব ভালো করে, তাই না রে আদৃতা?”
আদৃতা চুপ করে রইলো। রিফাত হতবাক হয়ে জানতে চাইলো-“কিভাবে চেন? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না?”
“কি রে কিভাবে চিনি তোকে বল? নাকি আমি বলবো?”
আদৃতা এবারও চুপচাপ শোভাকে দেখছে। হঠাৎ রিফাতের দিকে ফিরে বললো-“বাসায় যাবে না ভাইয়া? নাকি আমি চলে যাব একা একা?”
“হ্যা যাবো কিন্তু…”
শোভা আদৃতার হাত ধরলো-“আজও পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস? কিন্তু আমি যে আজ ছাড়বো না তোকে? আচ্ছা, আদৃতা কেমন বোন আপনার?”
“চাচাতো বোন৷ কেন বলতো? কি করেছে ও? আর ওকে তুমি কিভাবে চেন?”
“বাড়াবাড়ি করিস না শোভা। ছেড়ে দে আমার হাত।”
“আপনাদের বাড়ি কি দিনাজপুরের ফুলবাড়ি? কখনো দেখিনি কেন আপনাদের?”
“হ্যা দিনাজপুর। আমাদের দাদার বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিল না তাই।”
“আর এই আদৃতা ঠিক কবে এলো আপনাদের বাসায়? মেট্রিক পরীক্ষার পর নিশ্চয়ই?”
“হ্যা, কিন্তু তুমি এতকিছু কিভাবে জানো?” শোভা তখনো আদৃতার হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে আছে নির্নমেষ। রিফাতের প্রশ্ন শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো-“আপনার বোনটা খুব প্রেমবাজ, এটা জানেন?”
“ভালো হবে না শোভা। হাত ছেড়ে দে বলছি।”
আদৃতা হুঙ্কার দিলো।
“প্রেমবাজ বললাম বলে আঁতে ঘা লাগছে? সত্যি কথা কেউ জানে না বুঝি?”
রিফাত পালা করে দু’জনকে দেখছে। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে তার। আগামাথা বুঝতে পারছে না। সে চেচিয়ে উঠলো-“কি হচ্ছে কেউ বলবে? আদৃতা তুই শোভাকে চিনিস?”
আদৃতা মাথা দুলায়।
“কি করে?”
“একসাথে স্কুলে পড়েছি আমরা।”
“শুধু পড়েছি বল কলিজার বান্ধবী ছিলাম।”
আদৃতা রাগত চোখে শোভাকে দেখলো।
“আর? কি সব বলছে শোভা?”
রিফাতের প্রশ্নে আদৃতা ঘামছে-“বাসায় চলো ভাইয়া, রাত হয়ে গেছে।”
“ও বলবে না কিছু। ওর সেই সৎ সাহস নেই। থাকলে আমাকে বিপদে ফেলে রাতের আঁধারে পালিয়ে ঢাকায় আসতো না।”
“তোমাকে বিপদে ফেলেছে এসেছে? কি করেছিল খুলে বলবে? আমার কোন আইডিয়া নেই।”
“ভাইয়া চলো না।” আদৃতা তাড়া দিতেই রিফাত ধমকে উঠলো-“শোভার কথা আগে শুনে নেই। কি করেছিস তুই সেটা জানি আগে।”
“আমি তাহলে একাই চলে যাই।”
“খবরদার নড়বিনা। আমার সাথে থাক, তুই কি করেছিস সেটা জানতে চাই।”
আদৃতার আর কথা বাড়ানোর সাহস হলো না। চুপ করে বসে থাকলো। শোভার চেহারায় বিষাদের ছাপ। ও বলতে শুরু করলো-“ও আমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী ছিল। আমাদের কয়েকবাড়ি পরে ওদের বাড়ি। ছোট বেলা থেকে একসাথে বেড়ে উঠেছি। দু’জনেই ভালো ছাত্রী। বন্ধুত্বটা তাই দিনদিন গাঢ়ো হয়েছে। আমি জানতাম ও ছেলেদের সাথে কথা বলে, প্রেম করে। আমি এসবে ইন্টারেস্টেড না, বাসা থেকে মানা করা ছিল। বাবার এক কথা কখনো যেন এমন কিছু কানে না আসে। তাছাড়া বাবা টের পেলে ভয়াবহ ব্যাপার হবে। আর সত্যি বলতে ব্যাপারটা আসলে আমার পছন্দ না কিন্তু ওকে মানা করলে শুনবে না তাই আর কিছু বলা হয় না। দু’জনের সব দিকে মিল কেবল এই দিকটি ছাড়া।
এসএসসির পরে ও একদিন আমাকে অনেক রিকোয়েস্ট করলো আদৃতা সেজে একজনার সাথে দেখা করার জন্য। ছেলেটা নাকি ওর পিছনে পড়ে আছে। দেখা না করলে বাসায় চলে আসবে। আমি বললাম, তুই যা দেখা কর। ও বলে ওর যেতে ভয় লাগে। আমি যেন যাই। আমি মানা করে দিলাম কিন্তু ও পিছনে পড়ে রইলো। হাতে পায়ে ধরার মতো অবস্থা। বান্ধবীর এত অনুরোধ কি ফেলা যায়? আমি রাজি হলাম। তখনও ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি দেখা করতে গেলে আমার জীবনটাই বদলে যাবে। যদি জানতাম তাহলে কখনোই যেতাম না।”
এই পর্যন্ত বলে থামে শোভা। রিফাত উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো-“তারপর কি হলো? তুমি দেখা করতে যাওয়ার পর?”
“জীবনে প্রথমবারের মতো মাকে মিথ্যে কথা বলে বেরিয়েছিলাম। আদৃতা ওর ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ছেলে এখানেই ম্যাসেজ বা কল দেবে তুই ফোনটা কাছে রাখ। আমি তোর আসেপাশে থাকবো। তেমন মনেহলে এগিয়ে আসবো। আমি বোকা ওর কথা মেনে নিলাম। নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরই একটা ছেলে কল করলো-‘তুমি কোথায় আছো আদৃতা?’
আমি রেস্টুরেন্টের নাম জানাতেই একসাথে তিনজন ছেলে ঢুকলো। আমার কাছে এসে জানতে চাইলো-‘তুমি কি আদৃতা?’
আমি মাথা নাড়তেই আমার সামনে বসলো ওরা তিনজন। কাকে যেন ফোন করে বললো-‘মেয়েকে পেয়েছি আপনারা চলে আসেন।’
কিছুক্ষণ পর আরও দু’জন এসে ঢুকলো। আমার হাতে থাকা আদৃতার ফোন বারবার আওয়াজ করে যাচ্ছিলো। একজন বললো-‘ফোনটা চেক করো।’
আমি বলি-‘কেন?’
‘করো তাহলেই টের পাবে।’
ফোন চেক করলদম। দেখলাম অনেকগুলো ছেলের ম্যাসেজ। সবার একটাই প্রশ্ন, আদৃতা তুমি এখন কোথায়? আমি এখানে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। আমি না বুঝে ওদের দেখি-‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না? কে আপনারা?’
আমার প্রশ্নে ওরা সবাই একসাথে হেঁসে উঠলো। একজন বললো-‘বাহ দারুণ ব্যাপার তো? আমাদের সবার সাথে প্রেম প্রেম খেলা খেলে গিফট টিফট নিয়ে এখন কিছুই বুঝতে পারছ না? বিশ্বাস হবে কথা?’
‘কি যা তা বলছেন এসব?’
‘ঠিকই বলছি। এই সেদিনও তোমাকে দুই হাজার টাকা দিয়েছি আমি।’
‘আমাকে দিয়েছেন?’
“তবে আর কাকে?’
‘এই এর কথা বিশ্বাস করিস নাতো। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে একদম ইনোসেন্ট কিচ্ছুটি জানে না। অথচ একসাথে পাঁচটা ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। একে আজ একটা কঠিন সাজা দিতে হবে যেন আর কোন দিন কোন ছেলের সাথে এমন কিছু করার সু্যোগ না পায়।’
আমি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াই-‘ভাই আপনারা কি বলছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি আসলে আদৃতা না। আদৃতার বান্ধবী। ও আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিল সুমন নামে একটা ছেলের সাথে দেখা করার জন্য। সুমন নাকি ওকে অনেক জ্বালাচ্ছে তাই।’
একজন তেড়ে এলো-‘চাপা মারার জায়গা নেই? তুমি বললে আর আমরা বিশ্বাস করবো? তুমি যে আমাকে ছবি পাঠিয়েছ সেটা তো এই ফেসেরই। এই যে দেখ ছবি। এখন নিজেকে বাঁচাতে মিছে কথা বলছো? এই সুমন ভিডিও কর তো। ওকে আজ ফেসবুকে ভাইরাল করবো। ওর প্রেম করার শখ জন্মের মতো মিটিয়ে দেব।’
আমি তখন রীতিমতো ঘেমে গোসল করেছি। মাঝে মাঝে পড়তে গেলে আদৃতা আমার ছবি তুলতো। সেই ছবিই দেখতে পেলাম ছেলেটার মোবাইলে। কি ঘটেছে কি ঘটছে আমার ছোট মাথায় কিছু ঢুকছিল না। আমি চিৎকার করি-‘ভাই আমি সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না। আদৃতা ব্লাকমেল করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। এই ফোনটাও আমার না, আদৃতার। ও জোর করে দিয়েছে আমাকে।’
‘ফের মিথ্যে? আর একটা মিথ্যে বললে এখানেই মেরে রেখে যাবো। চুপচাপ বয় এখানে। তোকে ভিডিও করতে দে। আমাদের অনেক টাকা খেয়েছিস, অনেক ক্ষতি করেছিস আর না। অনেক প্রেম করার শখ না তোর। আজকের পর তোর আর প্রেমিকের অভাব হবে না। কত প্রেম করবি করিস। এই মমিন ভিডিও করছিস?’
‘করছি।’
আমি কেঁদে ফেললাম-‘ভাই আপনাদের পায়ে পরি। সত্যি আমি নির্দোষ। আমি কিছু জানি না। ভিডিও কইরেন না ভাই। বাবা এসব দেখলে জানে মেরে ফেলবে?’
‘এই কথা আগে মনে হয় নাই? এখন তো তুই ভাইরাল হবি। কোন কথা শুনবো না।’
‘ভাই আমি সত্যি বলতেছি আমি আদৃতা না। বিশ্বাস করেন।’
আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি। ওরা হাসে। কথা বলতে বলতে ভিডিও করে। আমি সাহায্যের আশায় আশেপাশে তাকাই। আদৃতা বলেছিল ও আমার কাছাকাছি থাকবে বিপদ দেখলে হেল্প করবে। কিন্তু ওকে কোথাও দেখলাম না। আমি অনেক অনুনয় করার পরও ওরা আমার কথা মানেনি। অনেক খারাপ খারাপ কথা বলছিল আমাকে। আর ভিডিও করছিল। আমার মনেহচ্ছিল আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবো সব ঠিক কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। এতো কান্না করছিলাম তবুও ওদের মন একটুও গলেনি। জানেন।”
শোভা হুহু করে কাঁদছে। ওর কান্না দেখে রিফাতের চোখের কোনে জল জমে। অসহায় শোভাকে দেখে ওর হৃদয় চুর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকটা বছর না জানি কত কি সয়েছে মেয়েটা। পাশে বসে শোভার হাতে হাত রেখে ওকে আশ্বস্ত করতে চায়। অনেকটা সময় পার হওয়ার পর কিছুটা ধাতস্থ হলো শোভা। রিফাতের পানে চেয়ে বললো-“ওকে জিজ্ঞেস করুন তো, ও কেন এমন করেছিল আমার সাথে? কি দোষ ছিলো আমার যে আমার এতবড় ক্ষতি করলো? ওকে বিশ্বাস করেছিলাম এটাই কি আমার দোষ?”
রিফাত পাশে ফিরে আদৃতাকে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলো। আদৃতা নেই ওদের পাশে। অন্ধকারে কখন উঠে পালিয়েছে মেয়েটা ওরা টের পায়নি।
চলবে—
©Farhana_Yesmin