আমার হিয়ার মাঝে পর্ব-১০+১১

0
380

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১০

আশ্বিন চলে গিয়েছে অনেক্ষণ আগেই। সত্যি বলতে, বেচারা এক প্রকার অধরা থেকে পালিয়ে গিয়েছে। অধরা মনে মনে বেজায় খুশি। খুশি মনেই সে নিজের ব্যাগ নিয়ে রুমে এসেছে জিনিস পত্র গোছগাছের জন্য। কিন্তু তাদের রুম দেখে সে রীতিমত নিস্তব্ধ, পুরো রুম জুড়ে অধরার মনের মতো সব সামগ্রী। দেয়ালের উত্তর পাশটায় বড় ফ্রেমে লাগানো হয়েছে তাদের বিয়ের ছবি, সাথে ছোট খাটো করে আছে দুজনের আলাদা কিছু ছবি। কিন্তু তার এই সব ছবি কীভাবে আশ্বিনের কাছে..!
‘অবাক হইছেন মামি?’
ধ্যান ভাঙে অধরার। ফিরে তাকায় সে পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট টুসির দিকে। গোলাপী রঙের একটা সুতির গাউন পরে আছে সে, ভেতরে তাহার নানান ফুলের কারুকাজ। ফোকলা দাঁতে কি দারুন তাহার হাসি হাসি মুখ!
‘অবাক কিছুটা হয়েছি। রুমটা একদম আমার মনের মতো করে সাজানো গোছানো।’
‘আলমারিতে কাপড় রাখার জন্য জায়গা করা আছে। মামা কালকে নিজে এই রুম গুছাইছে। আপনার নাকি লাল রঙ পছন্দ? তাই এই লাল পর্দাগুলো কালকে কিনা আনছে মামা।’
অবাক হচ্ছে অধরা, তবে সেটা অপ্রকাশিত। ঘুরে ঘুরে দেখছে সে পুরো রুমটা। সত্যি বলতে আশ্বিন যে তাকে এতটা গভীর ভাবে লক্ষ্য করতো, এ নিয়ে ধারণা ছিল না অধরার। কেননা, আশ্বিনকে দেখে তার কখনও তার মনে হয়নি যে আশ্বিনের মনে তার প্রতি কোন আবেগ অনুভূতির বসবাস ছিল। অথচ আজ এসব উদাহরণ তাকে ভুল প্রমাণ করছে চাইছে।

‘মামি, তোমার নাকি দোলনার বহুত শখ? বারান্দায় দেখ দোলনা লাগানো আছে। ওইটাও কালকে আনছে মামা।’
হেসে উঠে অধরা। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় সে। মুহূর্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। আশ্বিনের এখনও মনে আছে সেদিনের কথা!
ঠিক এমন এক দোলনায় বসে রাতের আকাশ দেখার ইচ্ছে ছিলো অধরার। একবার কথায় কথায় আশ্বিনকে বলেছিলো সে, কি নিদারুন ভাবে কথাগুলো মনে রেখেছে মহাশয়। মনে মনে আশ্বিনকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে অজান্তেই দোলনায় বসে পড়ে অধরা।
দরজার কাছে এসে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে টুসি, নীরবে দেখে যাচ্ছে অধরার প্রতিক্রিয়া।
‘টুসি এসো, আমার পাশে এসে বসো।’
সে যেন এই কথা শোনার অপেক্ষায় ছিলো। এক ছুটে এসে বসে পড়ে অধরার পাশে।
‘আমার ইস্কুলেও এইরম দোলনা আছে। ছুটির পরে আমি আর আমার বান্ধবীরা সবাই দোলনা চড়ি।’
‘কোন স্কুলে পড়ো তুমি?’
‘এই সামনের প্রাইমারি ইস্কুলে। মামা ভর্তি করায় দিছে। নানি বলছে ভালো মতো পড়ালেখা করলে আমিও মামার মতো ডাক্তার হইতে পারবো। মামার কাছে শুনছি তুমিও ডাক্তারি পড়তাছো।’
অধরা আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় টুসির মাথায়। খিলখিল করে হেসে উঠে সে।
‘তোমার মনের আশা পূরণ হোক টুসি বুড়ি। এভাবেই সবসময় হাসি খুশি ভাবে থাকো। তবে, একটা কথা বলি টুসি?’
‘বলো মামি।’
‘বাচ্চারা এমনিতেই অনেক কিউট হয়, আর আমাদের টুসি তো আরো বেশি কিউট। তবে আজকে খাওয়ার টেবিলে তুমি মামাকে যে কথাগুলো বলেছো, তখন সেই কথাগুলো বলা কিন্তু ঠিক হয়নি। কারণ, আমার সামনে কথাগুলো বলায় মামা বিব্রত বোধ করেছিলো। কাউকে এভাবে বিব্রত বোধ করানো কিন্তু মোটেও ঠিক কাজ না। এতে করে সে টুসির প্রতি অসন্তুষ্ট হতে পারে। তাই আজ থেকে আমাদের টুসি সবসময় সুন্দর ভাষায়, গুছিয়ে, কাউকে বিব্রত না করে কথা বলবে, একদম কিউট একটা বাচ্চার মতো। যার কথা শুনে সবাই মুগ্ধ হবে। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে মামি।’
‘আর রইলো আশ্বিনের কথা? এটা তো সবাই জানে তোমার মামা একটু লাজুক প্রকৃতির, আর তোমার ভাষায় হাবা। কিন্তু যেমনি হোক, আমাদেরই তো! নাকি? তাই আজ থেকে টুসি আর মামি এক টিম হয়ে গোয়েন্দার মতো মামাকে পরিবর্তন করতে কাজ করবো। তবে সেটা সবার অগোচরে, সিক্রেট ভাবে। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে। তাহলে আজ থেকে শুরু মিশন মামা।’
হেসে ফেলে অধরা। কি নিষ্পাপ মেয়েটির মুখ খানি। অধরা তার হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে,
‘চলো তোমাকে নুডলস রান্না করে দেই। আমি কিন্তু ভালো নুডলস রান্না পারি।’
—————-

এই কদিন বিয়ের জন্য তার রুটিন মাফিক পড়ালেখার অনেক বরখেলাপ হয়েছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে অধরা বিকেল থেকেই বসে গিয়েছে পড়ার টেবিলে।
এখন রাত নয়টা। সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশ পরিষ্কার, বৃষ্টির ভাব লক্ষণ নেই। ভালো লাগছে না অধরার,এই মুহূর্তে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলে তার ভালো লাগতো। নিজের এরূপ ভাবনায় নিজেই অবাক অধরা, কেননা একটা সময় ছিল যখন বৃষ্টি ছিলো তার কাছে দারুণ অপছন্দের। স্কুল কলেজ ছুটির সময় হুটহাট বৃষ্টি তাকে চরম বিরক্ত করতো।
অথচ এখন বৃষ্টি ভালো লাগে তার, কিভাবে তারই অজান্তেই সৃষ্টি হয়েছে এই ভালোলাগা?

ঘড়ির দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে তার। রাত তো কম হলো না, মহাশয় কি আজ নাইট ডিউটি করছেন নাকি? হলেও তো অধরাকে একবার জানানো উচিত। রাগ হলো অধরার। টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে রাশেদা খালার রুমের দিকে উকি দেয়, খালা বিশ্রাম করছেন আর টুসি উনার পাশে বসে বই খাতা নিয়ে পড়ছে। মুচকি হেসে রুমে ফিরে আসে সে।
বারান্দার দোলনায় বসে রাতের অন্ধকারে ব্যস্ত শহর দেখছে অধরা। ইশা নেই, কথা বলার মানুষও নেই। খুব একা একা লাগছে তার। দীর্ঘদিন ফেলে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। তন্দ্রা ভরা চোখে বসে থেকে মুহূর্তেই চোখ লেগে আসে অধরার।

হঠাত কাঁচের টুংটাং শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরে তাকিয়ে আশ্বিনকে চায়ের কাপ হাতে দেখতে পায়।
‘আপনি কখন এসেছেন?’
‘যখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।’
‘তাহলে ডেকে দিলেন না কেনো?’
উত্তর দেইনি আশ্বিন। ট্রে থেকে একটি চায়ের কাপ নিয়ে এগিয়ে দেয় অধরার দিকে। কথা না বাড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয় অধরা।
‘ধন্যবাদ।’
‘খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে? আমি বানিয়েছি, যদিও আমি আগে কখনও চা বানিয়ে দেখিনি।’
মুচকি হাসে অধরা। বাহিরের আকাশের দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে।
‘খুব ভালো হয়েছে। আজ হঠাত চা বানানোর কারণ?’
‘এমনি। ইচ্ছে হলো তোমার পাশে বসে চা খেতে। যাই হোক, রুম সাজানো পছন্দ হয়েছে তোমার?’
‘হুম, সুন্দর। টুসি তাহলে মিথ্যা বলেনি। আপনি সত্যিই কাল…।’
থেমে যায় অধরা। অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে সে। আশ্বিন একটা লাজুক হাসি দেয়। ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকে অধরার দিকে ফিরে তাকায়।
‘তুমি আসবে ভেবে অনেক আগে থেকেই আমি ঘর সাজিয়েছি অধরা। তুমি সেসব দেখোনি। অথচ শুধুমাত্র একটি ঝলক তোমাকে এতটা অবাক করলো? তাহলে পরবর্তীতে বাস্তবতার মুখোমুখি হবে কিভাবে?’
হাসি উড়ে যায় অধরার। প্রশ্নসিক্ত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় সে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিনের দৃষ্টি নতজানু। অনেক কথার ইশারা করে যাচ্ছে সে। অথচ কোন উত্তর না দিয়ে উঠে রুমে চলে যায় আশ্বিন, নীরবে বসে থাকে অধরা। কথাগুলো বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায় নিয়োজিত সে।
—————

সকাল সকাল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেই একটি দারুণ খবর শোনা যাচ্ছে। ইশা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছে মারিয়া গতকাল আশ্বিনের হাসপাতালে গিয়েছিলো তার সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। আশ্বিন তখন ওটিতে ব্যাস্ত থাকায় সে ফিরে এসেছে দেখা না করেই। কিন্তু আজ হয়তো হাল ছাড়বে না সে।
‘কি মনে হয়? সে কি আবারও হাসপাতালে দেখা করতে যাবে? নাকি অন্য কোথাও দেখা করবে?’
‘আমি বুঝি না, আশ্বিন ভাইয়ের সাথে দেখা করেই তার কি লাভ?’
‘জারিফ, এতো সহজে মারিয়া সব ছেড়ে দিবে কথাটা ভাবিস না। এটা মারিয়া!’
‘অনিক ঠিক বলছে।’
এতোক্ষণ ধরে নীরবে বসে সবার কথাগুলো শুনছিলো অধরা। তার মাথায় চলছে অন্য কথা। আশ্বিনের সাথে মারিয়া দেখা করতে গিয়েছে এই কথা তো কাল আশ্বিন একবারও বলেনি তাকে। আর তাছাড়া, আশ্বিন কেনো মারিয়াকে দেখা না করেই যেতে দিলো?
‘কি ভাবছিস তুই?’
‘কিছু না। জারিফ তোকে যেই খোঁজ নিতে পাঠিয়ে ছিলাম, তার কোন খবর আছে?’
‘নাহ! শুনেছি উনি দেশের বাইরে আছেন। আমাদের উনার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে হবে।’
‘তাহলে প্রাথমিক ভাবে রোদ্দুর ভাইয়ার সাথে কথা বলাই ভালো হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না।’
‘হুম।’
উঠে দাঁড়ায় অধরা। বন্ধুদের সাথে নিজের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা করতে করতে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যায় সে।

ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েই অধরা রওনা দিয়েছিলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রোদ্দুরের সাথে দেখা করা যে তার খুব প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, রোদ্দুর কাল নাইট ডিউটি করায় আজ সকালে ডিউটিতে আসেনি। তাই আফসোসের একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে নিতেই তার দেখা হয় আশ্বিনের সাথে।
‘তুমি এখানে কি করছো?’
অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অধরা। কোনভাবেই যে আশ্বিনকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না তার এখানে আসার আসল কারণ। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে সে।
‘আসলে, ক্লাস শেষ। তাই ভাবলাম আপনাকে নিয়ে লেকের ধারে পার্কে একবার ঘুরে আসি। ঠিক আগের মতোই, মনে আছে আপনার..?’
থমকে থাকে আশ্বিন। ডগর ডগর চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে থাকে অধরার দিকে। অধরার হুশ ফিরে যে কি বলে ফেলেছে সে। কথার প্রসঙ্গে কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টো ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। সেই লেকের ধারে যাওয়া যে তার অতীতের স্মৃতি মনে করিয়ে দিতে তাকে বাধ্য করবে!
‘আমার মনে হচ্ছে আপনি এখন ব্যস্ত। আমরা না হয় পরে কখনও যাবো, সমস্যা নেই।’
কোনরকম কথাগুলো বলেই অধরা চলে আসতে নিতেই আশ্বিনের কথায় সে থেমে যায়।
‘একটু অপেক্ষা করো অধরা। আমি দুই মিনিটের মঝে আসছি।’
আর কথা বাড়ায় না অধরা। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে সে। নিজের জালে নিজেই এসে ধরা খেয়েছে। তাই এই মুহূর্তে চুপ থাকাই হবে তার জন্য শ্রেয়।

পড়ন্ত বিকেল!
রাস্তার পাশ ধরে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে অধরা আর আশ্বিন। পার্ক ঠিক আগের মতোই আছে, শুধু বেড়েছে মানুষের আনাগোনা। বহুদিন পর পুরনো এই জায়গায় এসে মুগ্ধ হয়েছে দুজন। ধীর পায়ে হেঁটে দুজন গিয়ে বসলো ঠিক সেই বেঞ্চটায়। যেখানে, অতীতে দুজন পাশাপাশি বসে গল্প গুজব করতো। আশ্বিন মুগ্ধ নয়নে দেখে যেতো অধরার ছেলেমানুষি।
দিন কীভাবে চলে যায়! সেদিনের পর দুজনেরই আর আসা হয়নি এখানে।

লেকের পাড়ে বসে নীরবতা পালন করতে ব্যস্ত দুজন। অতীতের স্মৃতি এসে হানা দিয়ে যাচ্ছে দুজনের মাঝে।

অতীতে….

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১১

অতীতে,

লাইব্রেরি রুমে বসে নিজের বইয়ে মুখ গুঁজে আছে আশ্বিন। পাশে বসে রোদ্দুর বই সামনে নিয়ে ফোনের মাঝে ব্যাস্ত। আড়চোখে দুবার রোদ্দুরের গতিবিধি লক্ষ্য করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ইদানিং কোন কাজেই কিছু ভালো লাগছে না আশ্বিনের। জ্বরের জন্য অধরা ময়মনসিংহ গিয়েছে আজ পাঁচদিন। এই কদিনের মাঝেই নিজেকে একা মনে হচ্ছে তার, যেন চারদিক বিরাজ করছে অদৃশ্য শূন্যতা।

লাইব্রেরিতে আশ্বিনের পিছনের সারিতে বসে আছে মারিয়া। আশ্বিনকে শুনিয়ে তার বান্ধবীর সাথে গল্প করতে ব্যস্ত সে। রোদ্দুর এতে চরম বিরক্ত, তবে আশ্বিনের কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
‘এই মারিয়া মেয়েটা তোর কপালেই কেনো এসে জুটলো বল তো? আর কি ছেলে ছিলো না ক্যাম্পাসে?’
‘তাকেই জিজ্ঞেস করে আয়। আমি কি করে উত্তর দিবো?’
রাগ হলো রোদ্দুরের। আশ্বিন একে সহ্য করে কীভাবে? কেনোই বা করে? সরাসরি নিষেধ করে দিলেই তো পারে, তবে কেনো করছে না সে?
‘তুই মারিয়াকে কেনো নিষেধ করছিস না যেনো তোকে বিরক্ত না করে?’
‘তোর মনে হয়, বললেও কোন লাভ হবে? তাছাড়া, তার সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে আমার নেই।’
হতাশা আর বিরক্তি এসে গ্রাস করছে রোদ্দুরের। মারিয়া করার ফাঁকে বারবার এদিকে ফিরে তাকানো, মুচকি হাসি কোনটাই সহ্য হচ্ছে না তার। এ যে কোন বিপদ এসে পড়লো তার বন্ধুর!

বইয়ের মাঝে মনোযোগ দিয়ে আছে আশ্বিন। হঠাত এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার। বুকের ভেতর অকারণেই ধুক করে উঠলো। চমকে উঠে আশ্বিন, হঠাত কি হলো তার!
কেমন এক পরিচিত অনুভূতি মনের কোণে এসে হানি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি?
‘অধরা এসেছে রোদ।’
‘কি বললি? অধরা..? গতকাল না সে নিজেই তোকে ফোনে বললো সুস্থ হলে রবিবার আসবে। তাহলে এখন কি বলছিস এসব?’
থেমে যায় আশ্বিন। ঠিকই বলেছে রোদ্দুর, অধরা নিজেই তাকে বলেছে তার দেরিতে ফিরে আসার খবর। তবে হঠাত এমন কেনো মনে হচ্ছে তার? নিজের অনুভূতিতে আজ নিজেই হতবাক আশ্বিন।
‘জানি না। কেনো জানি মনে হচ্ছে অধরা এসেছে ক্যাম্পাসে।’
‘আরে অধরা কীভাবে আসবে? সে তো ময়মন..।’
আর বলা হয়নি রোদ্দুরের। লাইব্রেরির দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে যায় সে। অবাকতার শীর্ষে পৌঁছে মুখ নিজের অজান্তেই হা হয়ে গিয়েছে তার। আর আশ্বিন নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে রোদ্দুরের মুখ পানে। অথচ একবারও ফিরে তাকায়ই সে।

‘আশ্বিন ভাইয়া..!’

বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে আশ্বিনের, মুহুর্তেই বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দন। অধরা এসেছে! সে সত্যিই এসেছে, ঠিক যেমনটা তার মনে হয়েছিলো! কিন্তু এ কি করে সম্ভব?
কোন প্রতিক্রিয়া না করে মাথা নিচু করে বইয়ের দিকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। এতক্ষণে অধরা দৌড়ে এসে বসেছে আশ্বিনের পাশ বরাবর।
‘সারপ্রাইজ..! আমি চলে এসেছি।’
খুশিতে হাসি হাসি মুখে কথাগুলো বলে সামনে ফিরে তাকায় অধরা। হতভম্ব রোদ্দুর এখনও হা করেই তাকিয়ে আছে তার পানে। আশ্বিনও বসে আছে কোন প্রতিউত্তর না করে। মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে যায় তার।
‘কি হয়েছে? ক্যাম্পাসে কিছু হয়েছে?’
জবাবের উদ্দেশ্যে ফিরে তাকায় সে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে অধরার গালে আলতো করে হাত রেখে,
‘ক্যাম্পাসে কিছু হয়নি, সব ঠিকঠাক আছে। তোমার জ্বর এখনও আছে, তাহলে ফিরে এসেছো কেনো?’
‘আম্মু বলেছিলো সুস্থ হয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাসায় একা একা বিরক্তি এসে ভর করছিলো আমায়। তাই আজই সকালের বাসেই চলে এসেছি। খুশি হননি?’
আর কথা বাড়ায় না আশ্বিন। কি বলবে সে, উত্তর দেয়ার জন্য ভাষা তার জানা নেই। কিন্তু তাই বলে চুপ নেই অধরা। সে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে তাকায় রোদ্দুরের দিকে।
‘রোদ ভাইয়া, মুখ বন্ধ করুন। কখন জানি মশা মাছি ঢুকে যায়। আর, কি দেখে এতো অবাক হয়েছেন?’
নিজেকে সামলে নেয় রোদ। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ফিরে তাকায় সে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন নতজানু হয়ে আছে, রোদ্দুরের প্রশ্নের জবাব তার নেই। সে তো নিজেই হতভম্ব!
————–

ক্লাস শেষে অধরা তার বন্ধুমহলকে বিদায় জানিয়ে চলে এসেছে আশ্বিনের সাথে দেখা করতে। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে থেমে থেমে। এমন একটি দিনেই ঘুরতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে অধরার।
‘আশ্বিন ভাইয়া, ঘুরতে যাবেন?’
‘কিহ? মাথা ঠিক আছে তোমার? আকাশের অবস্থা দেখেছো? যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে।’
‘তো কি হয়েছে? চলুন লেকের ধারে ওই পার্কে যাই, বেশি দূর না যেতে।’
‘অধরা..বৃষ্টি শুরু হবে। হোস্টেল ফিরে যাও।’
ভেংচি কাটে অধরা। এতো সুন্দর একটা আবহাওয়া, আর সে কিনা হোস্টেলে ফিরে যাবে? অসম্ভব। রাগে অভিমানে কোন কথা না বাড়িয়ে সে একাই যেতে শুরু করে। আশ্বিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
‘কোথায় যাচ্ছো?’
অধরা নির্লিপ্ত ভাবে পিছনে ফিরে তাকিয়ে,
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’
আবারো যেতে শুরু করে অধরা। হতভম্ব আশ্বিন! সে কি তবে একাই যাচ্ছে নাকি? এতো জেদী কেনো মেয়েটা? বাধ্য হয়ে পিছু নেয় সেও।

লেকের ধারে পার্কের একটি ছোট্ট বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। চারদিকে বাতাস খেলে যাচ্ছে, এলোমেলো করে দিচ্ছে অধরার খোলা চুল। গুণ গুণ করে গান গেয়ে যাচ্ছে সে। আশ্বিন পর্যবেক্ষণ করছে আশেপাশের পরিবেশটা। খোলামেলা, গাছপালা ঘেরা সুন্দর একটি জায়গা, আগে কখনো আসা হয়নি তার। অথচ অধরা নাকি প্রায়ই চলে আসে এখানে। থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে মেঘেদের মৃদু গর্জন।
‘হয়েছে অনেক ঘুরাঘুরি। এখন চলো ফিরে যাই।’
বিরক্ত হয় অধরা। একটা মানুষ এতটা পানসে কীভাবে হতে পারে? এত সুন্দর একটা মুহূর্ত ফেলে উনি কি না বাড়ি ফিরে পড়তে বসবেন?
‘আপনার সমস্যা কোথায় আশ্বিন ভাইয়া?’
‘কি বললা? আমার আবার কিসের সমস্যা হবে?’
‘সমস্যা না হলে এভাবে চিংড়ি মাছের মতো লাফালাফি করছেন কেনো? শান্ত হয়ে বসে থাকুন।’
অধরার ধমক খেয়ে আশ্বিন স্তব্ধ। এই মেয়ে তাকে বকলো? পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয় আশ্বিন। এ যে বাকি সব মেয়ে নয়, অধরা।
‘বেশি কথা না বলে ভালো করে গলায় ওরনা পেঁচিয়ে নাও। নয়তো এই বাতাস আবারো গলা বসিয়ে দিবে তোমার।’
বাধ্য মেয়ের মতো অধরা গলায় ওরনা জড়িয়ে নেয়।
‘আশ্বিন ভাইয়া, একটা ছোট শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে এই বাতাস উপভোগ করুন। ফিল করুন এই আবহাওয়াকে।’
আশ্বিন কিছুক্ষণ অধরার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তার কথা মতো চোখ বন্ধ করে। হিম শীতল এক ঠান্ডা বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে তার শরীরে, প্রশান্তি এসে ভর করেছে তার মন। হেসে উঠে অধরা। চোখ বন্ধ করে আশ্বিন অনুভব করে অধরার খিলখিল হাসির শব্দ।

হঠাত শুরু হয় বর্ষণ। টিপ টিপ বৃষ্টি থেকে মুহূর্তেই এর বেগ বেড়ে যায়। চমকে উঠে চোখ মেলে তাকিয়ে পাশে অধরাকে দেখতে পায় সে। অধরা হাত মেলে যেন বৃষ্টিকে উপভোগ করতে ব্যস্ত।
‘আবারও জ্বর আসবে তোমার। চলো এখনই।’
গা থেকে একটানে সাদা এপ্রোন খুলে অধরার মাথার উপর ধরে তাকে নিয়ে ছুটে চলে রাস্তার ধারে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, এর আগেই আকাশ ভেঙে শুরু হয় বৃষ্টি। শেষে বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় চায়ের টং দোকানটায়।

‘আরো জেদ করো, এখন তো খুব ভালো হয়েছে। আমার কথা কোনদিন শুনবে না তুমি।’
অপরাধীর মতো অধরা চোখ মুখ কালো করে দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ে। তাকে সামলাতে গিয়ে যে নিজে ভিজে একাকার হয়েছে আশ্বিন মহাশয়। খারাপ লাগছে অধরার। আশেপাশে কোন রিকশা বা গাড়ি নেই। কীভাবে যাবে তারা? এদিকে বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে।
‘চা খাবে?’
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় অধরা। আশ্বিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় তার থেকে। হালকা ভেজা চুলে মায়াবী লাগছে মেয়েটিকে।
‘মামা, দুটো লেবু চা..।’

নির্দেশ পেয়েই চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে চা দোকানের মামা। আজ দোকানে ভিড় নেই। মেঘলা দিন বলে হাতে গোনা দুচার জন যারা এসেছিলো, তারাও বৃষ্টি শুরুর আগে ফিরে গিয়েছে।
‘আপনেরা কি দুইজনেই ডাক্তার?’
‘জি, আমরা দুজন এখনও ডাক্তারি পড়ছি।’
‘ভালাই তো। ডাক্তার ডাক্তারে প্রেম!’
চমকে উঠে দুজন। উনি কি তাদের বাকিদের মতো কাপল মনে করছেন নাকি? অধরা তাকিয়ে আছে ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে। আশ্বিনের দৃষ্টি স্বাভাবিক।
আশ্চর্য ব্যাপার! মামার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করলো না দুজন, নীরবেই মেনে নিলো সবটা।
এর মাঝে তাদের হাতে চলে আসে গরম চায়ের কাপ। আশ্বিন মামার সাথে কথায় ব্যস্ত থেকে আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর অধরা আপনমনে তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে। আচ্ছে সে এখানে আশ্বিনকে কোন নিয়ে আসলো? সে তো চাইলে ইশাকে নিয়েও আসতে পারতো। প্রশ্নটা নিদারুণ রহস্য জনক!

তখনই হঠাত বিকট শব্দে শুরু হয় বজ্রপাত। চমকে উঠে অধরা। এক লাফে গিয়ে বসে পড়ে আশ্বিনের পাশ বরাবর। হুট করে এমন কাজে ভড়কে যায় আশ্বিন। কিছু বলতে যাবে তার আগেই এক জোরে বজ্রপাতের শব্দে অধরা ভয়ে নিজের অজান্তেই আশ্বিনের হাত টেনে নিয়ে কামড়ে ধরে।
হতবাক হয়ে যায় আশ্বিন, মুহুর্তেই হাতে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয়।
‘আহ! অধরা হাত ছাড়ো আমার।’
কে শোনে কার কথা? অধরার থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত আশ্বিন। এ কোন রাক্ষস মেয়ে রে বাবা!
এদিকে, তাদের কাজে হেসে যাচ্ছে চা দোকানের মামা।

–চলবে(ইনশাআল্লাহ)