উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩১
,
,
,
,
,
,
হসপিটাল থেকে বের হওয়ার আগে নাসিম তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,” ভাবী আপনি আসাতে অনেক খুশি হলাম। আজ যদি না আসতেন জানতেই পারতাম না হা*রামীটা বিয়েও করেছে। যাই হোক দেখা হয়ে ভালো লাগলো। এমন এক পরিস্থিতি আপনাদের আতিথেয়তাও করতে পারলাম না। একদিন বাড়িতে আসবেন কিন্তু। চারুলতা আপনাকে দেখলে ভীষণ খুশি হবে। নুসাইব তুই কিন্তু ভাবীকে নিয়ে অবশ্যই আসবি। প্রয়োজনে আমাকে বলবি আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো।
তুধা বেআক্কেলের মত তাকিয়ে আছে। এতো এতোবার ভাবী ডেকে বিয়ে দিচ্ছে , রিয়েক্ট করা পর্যন্ত ভুলে গেছে।
নুসাইব আরেক কান্ড ঘটিয়ে বসলো। ভুল বোঝাবুঝি শেষ না করেই বাঁকা হেসে বলে উঠলো,,” ঠিক আছে তোর ভাবীকে নিয়ে একদিন অবশ্যই যাবো।তোর আসা লাগবে না। তুই বউয়ের খেয়াল রাখ। আপাতত আমি আমার বউ নিয়ে যাচ্ছি।”
তৃধা এই লোকটার কথায় ক্ষনে ক্ষনে অবাক হচ্ছে। চেহারার আদল দেখে বুঝার উপায় নেই ইনিই বাড়ির সেই লোকটা, যে ভীষণ গম্ভীর, দরকার ছাড়া কথা বলেনা, ইভেন হাসেও না। এখন দেখলে বাড়ির কেউ চিনবেই না। চোখে মুখে যে শ*য়*তানি খেলা করছে। ধুরন্ধর লোক।
নাসিম চোখ টিপে ফিসফিস করে বলে,, খুশির খবর টবর কবে শুনবো?
নুসাইব নাসিমের কানের কাছে মুখ নিয়ে দ্বিগুণ ফিসফিসিয়ে বললো,, অতিশীঘ্রই বন্ধু। তুই বরং তোর ছেলেকে এখন থেকে পড়ালেখা শিখিয়ে রাখ। আমি মেয়ে বিয়ে দিবো।
দুজন এমন ভাবে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলো পর্যন্ত তাকিয়ে দেখছে।
তৃধা এতক্ষণ নুসাইবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও লজ্জায় চোখ মুখ লাল করে সরে পড়লো। নাসিম মিটমিটিয়ে বললো,, যা ভাগ। তা না হলে আজ ভাবী হেঁটেই বাড়ী চলে যাবে।
নুসাইব মুচকি হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে তৃধার পিছনে ছুটলো।
এতো এতো গাড়ির মধ্যে নুসাইবের গাড়িটা খুঁজে বের করলো তৃধা। পেছনে হেলেদুলে পকেটে হাত গলিয়ে হাঁটছে নুসাইব। রাত একটার শহর দারুন সুন্দর। ফাঁকা রাস্তায় দুয়েকটা গাড়ি ছুটে চলছে। জনমানব নেই বললেই চলে। দোকান গুলো বন্ধ হয়েছে ঘন্টা দুই হবে। অদ্ভুত সুন্দর নিঃপ্রাণ শহরে প্রেয়সীর পিছে পিছে হেঁটে চলা প্রেমিকের বুক উত্তাল। না পেয়েও সব পেয়ে যাওয়ার মত সুখের জোয়ার ভাটা চলছে তখন। নুসাইব বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। মন মস্তিষ্ক জুড়ে চলছে মিছিল। তৃধা পেছনে ফিরে তাকায়। লোকটার অলস হয়ে হাঁটার ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়। চেহারার আদল ভীষণ উজ্জল। সময় ভালো যাচ্ছে চেহারা দেখলেই বুঝা যায়। তৃধা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষা করছে নুসাইব কখন আসবে। কিন্তু না আসার নামনেই। পকেটে হাত গুঁজে দুর থেকে তাকিয়ে আছে। তৃধা ডাকলো না বরং ইশারায় গাড়ির দরজা দেখালো। নুসাইব হেঁসে আনলক করে দিলো। তৃধা গাড়িতে বসে বসে পুরো সময়টা নিয়ে আবারো ভাবছে। পুরো সময়টাতে নুসাইবকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলো। এমন নুসাইবকে আদৌ কেউ চেনে? নাকি এই নুসাইব শুধু তৃধার সামনেই প্রতীয়মান হয়? উঁহু! এই নুসাইব কোথাও কেউ দেখেনি। এমন নিরেট, গম্ভীর চেহারার দুষ্টু, ধুরন্ধর লোক কেউ দেখেনি। তার এই স্বত্ত্বা তৃধা ছাড়া কেউ দেখেনি।
তৃধা ভাবনায় এতোটাই মশগুল , নুসাইবের আগমন টের পায়নি। গাড়ির দরজা খুলে পাশে বসে তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা পর্যন্ত খেয়াল করেনি। তৃধা শূন্যে দৃষ্টি রেখে লাজুক হাসছে।
নুসাইব চোখ ছোট ছোট করে মুচকি হেসে আদুরে গলায় বলল,, আগে আমাকে বিয়ে করো তৃধা, এরচেয়ে বেশি ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখবো। এর চেয়ে বেশি খেয়াল আমি রাখবো।
বেখেয়ালি তৃধা মুচকি হেসে বলল,, ‘হুম।’
তৃধার এমন বেখেয়ালি উত্তরে নুসাইবের ঠোঁটে বিশ্বজয় করা হাসি। ভাবনার জগৎ থেকে ছিটকে পড়লো তৃধা। লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়ার অবস্থা। তাও আমতা আমতা করে বলল,, “কি বলেছেন খেয়াল করিনি।”
নুসাইব মাথা কাত করে তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,,” যা তোমার খেয়ালে ছিলো তাই বলেছি। উত্তরটাও একদম ঠিকঠাক হয়েছে তৃধা। এখন বলো খেয়ালেকি কি আমি ছিলাম?”
এইবার তৃধার কপট রাগ হলেও,নুসাইবের তাকানোর ধরন ভিন্ন। এইভাবে তাকালে মেয়েরা রাগতে পারে না। বরং মুখখানা দুহাতের আঁজলে রেখে নাকে নাক ঘষে দেওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়। তৃধাও ব্যতিক্রম নয়। কেন জানি নুসাইবের তাকানোর ধরন দেখে ইচ্ছেটা প্রবল হলো। মাথা নিচু করে হাতের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসে আছে তৃধা। নিজের ইচ্ছে গুলোই নিজেকে লজ্জায় ফেলছে। অবাধ্য মন ভীষণ জ্বালাচ্ছে তাকে।
তৃধার লজ্জায় লাল হওয়া চেহারা দেখে মনে মনে হাসলো নুসাইব।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে এলো পার্কিং এরিয়া থেকে। ধীরে ধীরে চলছে গাড়ি, যেন বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। গাড়ির গতি দেখে জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকালো তৃধা। কোলাহল পূর্ণ শহরটা ভীষণ নিরব ঠেকছে। নুসাইব গলা ঝেড়ে সুধোয়,, ঘুম পাচ্ছে?
তৃধা বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল,, না।
গাড়ির গতি আরো কিছুটা কমালো নুসাইব। তৃধা তাকিয়ে বলল,, বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই আজ?
নুসাইব লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” আজ যদি আমি একা হতাম তাহলে যেতাম না। তুমি আছো দেখেই যাচ্ছি।
তৃধা বুঝলো নুসাইব কিছু নিয়ে চিন্তিত। ঘুরে বসে বললো,, হঠাৎ বাড়ি না যাওয়ার ইচ্ছে কেন হলো?
,,”তোমার তাড়া না হলে বলবো।”
তৃধা ভেবে বললো,,” আপনি আছেন,আন্টি চিন্তা মুক্ত থাকবে। এখন যেহেতু আন্টি আমার অভিভাবক তাহলে সমস্যা নেই। বলুন আপনার কি সমস্যা?”
নুসাইব মুচকি হেসে সাথে সাথে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো। গতি বাড়িয়ে ছুটে চললো অজানা গন্তব্যে। তৃধা ঠায় তাকিয়ে রয়। আবহাওয়ার মত বদলাচ্ছে লোকটা।
প্রায় বিশ মিনিট পর গাড়ি থামলো। তৃধা তাকিয়ে দেখে একটা ব্রিজ। খুব বেশি বড় না হলেও ছোটও বলা চলে না। আশপাশ জনমানবহীন যার ফলে থমথমে পরিবেশ। নুসাইব তৃধার ভীতু চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,, ভয় করছে?
তৃধা ঢোঁক গিলে বলে,, “ভয় কেন করবে? ভুতে নিলে শুধু আমাকে নিবে না, সাথে আপনাকেও নিবে। আমাকে নিলে এক ফ্যামলী খেতে পারবে। আপনাকে সহ নিলে পুরো এক গ্ৰামের ভুতেরা খেতে পারবে।”
তৃধার কথা শুনে গা কাঁপিয়ে হাসলো নুসাইব। তৃধা মুখ ফুলিয়ে তাকালো,,হাসার কি আছে? অদ্ভুত, ভুতে ভয় করবে না , নাকি?
হাঁসি থামলে নুসাইব বলে,,”আমি আমাকে ভয় পাওয়ার কথা বলছি পাগলী।”
,”অদ্ভুত! আপনাকে কেন ভয় পাবো? এইখানে আসাতে আপনার আলাদা দাঁত তো বের হয়নি। এইখানেও আন্টির সেই বড় বাচ্চাটাই আছেন।”
নুসাইব মৃধু হেসে বলল,” তোমার কাছে আমি বিশ্বাস যোগ্য বলেই তোমার মাথায় প্রথমে ভুতের ভয় এসেছে।তা না হলে অন্য কোনো পুরুষ হলে সেই পুরুষের ভয়েই ম*রে যেতে তৃধা।”
তৃধা মিনমিন করে বললো,, অন্য কেউ হলে আমিকি এইভাবে নাচতে নাচতে চলে আসতাম ?
নুসাইব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,” তাও ঠিক। আমি ছাড়া কারো সাথে বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
নুসাইবের কথা শুনে মাথা নোয়ালো তৃধা। হুট হাট করে ভালো লাগা ঘিরে ধরছে তাকে। তাও কথা পাল্টাতে বললো,, এইবার বলুন বাড়ি যেতে চাইছেন না কেন?
তৃধার প্রশ্নে নুসাইব বলে উঠলো,, দাদু আমার আম্মুকে পছন্দ করে না জানো?
তৃধা জানে তাও মাথা নেড়ে বললো,”না।”
,” অবশ্যই না জানার কথা। এইবার আসার পর থেকে তোমাকে দেখছে তাই তেমন কিছু বলছে না। তা না হলে আমাদের অনুপস্থিতিতে আম্মুকে হেনস্তা করতো। তৃধা, এইটা নতুন নয়। ছোট থেকেই দেখে আসছি। প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরে ঠিকই জানতে পারি।”
নুসাইবের কথা শুনে চমকে তাকালো তৃধা। আন্টি বলেছে তার বিয়ে সম্পর্কে কেউ জানে না,তাহলে? তাহলে কি নুসাইব সত্যি সব জানে? তৃধার মাথায় প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
,”প্রথম প্রথম দাদু আমার সামনে কিছু না বললেও পর পর আমাকে বসিয়ে বসিয়ে আমার মায়ের কাহিনী শোনাতো। আমার মায়ের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করতো।”
তৃধা দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কিসের কাহিনী?”
নুসাইব সময় নিয়ে বললো,, “প্রথম বিয়ের কাহিনী। আমার বাবার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমার মায়ের আরেকজনের সাথে বিয়ে হয়।”
নুসাইবের কথা শুনে হতভম্ব তৃধা। তাও তৃধা অবাকতার সুরে বলে উঠলো,, প্রথম বিয়ে?
নুসাইব মলিন হেসে বললো,, দেখে মনে হয় না তাইনা?
তৃধা মাথা নাড়ল। নুসাইব পুনরায় বলে উঠলো,, মনে হওয়ার কথাও না। আমার বাবা আমার মাকে কখনো মনে হতেই দেয়নি। তাছাড়া আমাদেরকেও কখনো জানায়নি। ইভেন জেনেও আমরা চুপ করে আছি। বলার মত কিছুই ঘটেনি, বলবো কি? একটা মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে মানুষ ভালো নয়। দীর্ঘ দিন অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করার পর মেয়েটাকে মেয়ের বাবা মা নিয়ে আসে। এরপর তার সাথে এমন একজনের বিয়ে হয় ,যে তাকে আ*ঘা*ত করা তো দুরের কথা, আ*ঘা*ত করার চিন্তা ওবদি করে না। এতোটা ভালোবাসে। তৃধা,, খেয়াল করে দেখো এইখানে দোষের কিছু নেই। এইটা আর যাইহোক অপরাধ নয়। অন্তত আমি মনে করি না। এই সব কিছুর মধ্যেও সমাজ মেয়েটার দোষ ধরে বসে থাকে। যেখানে সহ্যও করলো মেয়েটা কথাও শুনছে মেয়েটা। সেই বিয়ে থেকে এখন পর্যন্ত অপরাধ না করেও অপরাধীদের মত জিবন কাটাচ্ছে আম্মু। সেখানে আমরা সন্তানরা কি-বা বলবো। দাদু আমার মাকে শুরু থেকেই পছন্দ করে না, ইভেন এখনো করে না। আমি জানি সামনেও করবে না। আমি যতদিন গ্ৰামে ছিলাম এই বিয়ে নিয়ে রোজ ঝগড়া হতো। আম্মু কিছু না বললেও দাদু পায়ে পা লাগিয়ে কথা শোনাতো। এরপর আমাকে বসিয়ে বসিয়ে মায়ের বিরুদ্ধে উস্কে দিতো। একদিন বাবা এসে শুনে ফেলে দাদু আমাকে মায়ের আগের বিয়ে নিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। যেখানে আমার মাকেই বেশি দোষী করছে। এরপর বাবা আর এক মিনিট আমাদের গ্রামে থাকতে দেয়নি। নিজেই সব জামাকাপড় গুছিয়ে আম্মুকে নিয়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়ে। সেই থেকে এই পর্যন্ত গ্ৰামে শুধু একবার যাওয়া হয়েছে। দাদা দাদু আসে তবে আমরা যাই না। বাবা যেতে দেয় না। কেন দেয়না সেটা আমাদের বলেনি, তবে যেতে দেয় না। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো আমরা জানি না। কিন্তু তার ধারণা ভুল। আমাদের মধ্যে তিন্নি ছাড়া সবাই মায়ের প্রথম বিয়ের কথা জানে। তিন্নি জানে না, কারন ও একটু রগচটা স্বভাবের। অল্পতেই রেগে যায় এইজন্য দাদু সুযোগ পেলেও তিন্নির কান ভারী করতে পারেনি। এখন তোমার মনে প্রশ্ন হতে পারে আমি এতো গুলো কথা তোমাকে কেন জানালাম?
টু বি অনেস্ট তৃধা এইসব তোমার জানা উচিৎ। কেন জানা উচিৎ কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছো।
আর আজ বাড়ি যেতে না চাওয়ার কারনটাই এই প্রাসঙ্গিক। কিছু কথা দাদু শুনেছে ,এ জন্য মাকে এখন কথা শোনাবে। এই মূহুর্তে মা চাইছে না, তুমি সেই কথা গুলো শোনো। যার কারণে মা তোমাকে বারবার ঘুমানোর কথা জিজ্ঞেস করছে।
তৃধা মাথা নেড়ে বললো, আমার কথা শুনেছে তাইনা?
নুসাইব থেমে বললো,, ঠিক তা নয়।
তৃধা মুচকি হেসে বলল,, আমার কথাই শুনেছে। এইজন্য দাদি এখন বাড়িতে ভেজাল করবে। আমাকে তুলে আন্টিকে কথা শোনাবে। আন্টি উত্তর করবে কারন আন্টি তার সন্তানদের সময় কারো তোয়াক্কা করে না। আর এই মুহূর্তে আমি কথা গুলো শুনলে সমস্যা হবে। যদিও আপনাকে বিয়ে করার চান্স এক পারসেন্টো থাকে, সেটাও আর থাকবে না। এই ভয়ে আন্টি চাইছে আমি যেন ওইসব ঝগড়া না দেখি না শুনি। তার সাথে আপনিও চাইছেন না ওইসব তিক্ত কথা আমি শুনি। শুনলে হয়তো আমি কষ্ট পাবো। রাজি হওয়ার থাকলেও আবার বেঁকে বসবো। তাইতো?
নুসাইব নিঃপলক তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে।
তৃধা নুসাইবের চোখে চোখ রেখে বলল,, আপনার মায়ের বিয়ে সম্পর্কে আমি আরো আগ থেকেই জানি। আন্টি নিজে বলেছে। তিনি চান না তার সন্তানরা এই ব্যাপারে জানুক। আসলে আমি আপনার দাদির কথার ধার ধারি না। যে আন্টির মত মানুষকে পছন্দ করে না। সে আমাকে পছন্দ করবে এইটা স্বপ্ন ব-ই কিছুই না। রইলো কথা বিয়ে নিয়ে, চলুন কাজি অফিস!আজ বিয়ে করে আপনার দাদিকে সারপ্রাইজ দেই।
তৃধার কথায় নুসাইবের কায়া থমকায়। তৃধার বলা শ্রুতিমধুর বাক্য ভীষণ অবিশ্বাস্য ঠেকলো। দৃষ্টি জোড়া স্থির করে কম্পিত হাতখানা বাড়িয়ে তৃধার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ছুঁয়ে বুঝার চেষ্টা চালালো। তৃধার অনড় দৃষ্টিতে নুসাইবের মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। কল্পনা আর বাস্তবের মাঝে ফেঁসে আছে নুসাইব। ভ্রম থেকে বেরিয়ে আসতে টেনে ধরলো তৃধার কপোল। ব্যা*থায় চোখ মুখখিচে কেকিয়ে উঠলো তৃধা,” আরে আরে ব্যা*থ্যা লাগছে তো!
তৃধার কথায় ছিটকে সরে বসলো নুসাইব। গাড়ির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে বলে উঠলো,” ও মাই গড় এতো সত্যিই তৃধা। তৃধা তুমি ঠিক আছো? হাসপাতালে ভুলভাল কিছু খাওনি তো?
নুসাইবের রিয়েকশন দেখে হাসলো তৃধা। গলা ঝেড়ে শক্ত গলায় বলে উঠলো,” কি মুশকিল?বিয়ে করবো না বললেও দোষ, করবো বললেও দোষ।
নুসাইব তখনো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে। যে মেয়ে বিয়ের জন্য রাজি হয় না,সে হঠাৎ রাত দুটোর সময় বিয়ের প্রস্তাব রাখছে। ব্যাপারটা অবশ্যই সন্দেহ জনক।
নুসাইবের চোখ বলছে সে বিশ্বাস করেনি। না করারই কথা। দশ মিনিট আগেও তৃধা জানতো না সে বিয়ের জন্য রাজি হবে। কিন্তু হঠাৎ করে মনে হলো জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। এই দ্বিতীয় সুযোগটা নিজের জন্য কিনা জানে না। তবে নুসাইব নামক লোকটা কে দেখলে মনে হয় দ্বিতীয়বার ভাবা উচিৎ। তার আদুরে পরিবারটাকে দেখলে মনে হয় দ্বিতীয়বার জীবনটাকে সুযোগ দেওয়া উচিৎ। এই মানুষ গুলোকে ভালো রাখার জন্য হলেও আরেকবার ভাবা উচিৎ। কেন জানি নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারছে না। আমি সুখ চাই, আমি ভালো থাকতে চাই,আমি আবারো ভালোবাসা চাই। এই ‘চাই’ শব্দটা কোথাও নেই। লোকে বলে ,’ যে মন ভেঙ্গে আবার জোড়া লাগে,তার আর ভেঙে পড়ার ভয় হয় না। তৃধা একবার সম্পূর্ণ ভেঙ্গে,আবার নিজেকে নিজে গুছিয়ে জোড়া লাগিয়েছে। এখন আর ভেঙ্গে পড়ার ভয় নেই। সেই ভয় কেটে গেছে আরো আগেই।
হড়বড়িয়ে মোবাইল বের করলো নুসাইব। মোবাইলখানা তৃধার সামনে ধরে বললো,, রেকর্ডিং অন কিন্তু । আবার বলো আমি রেকর্ড করে রাখবো। পরে যদি কথার খেলাপ করো? তখন প্রমাণ পাবো কই?
ভীষণ রকমের গম্ভীর লোকটার এহেন আচরণে হাসলো তৃধা। অতঃপর মোবাইল ফোনের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলে উঠল,, চলুন নুসাইব বিয়ে করি।
চলবে,,,?
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩২
,
,
,
,
,
,
গাড়ির স্টেয়ারিংএ হাত রেখে নিশ্চুপ নুসাইব। পাশে বসা তৃধা নিরবতা দেখছে শুধু। দশ মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর নুসাইব পুনরায় বলে উঠলো,, দেখো তৃধা আমি জানি তুমি এখনো তোমার অতীত ভুলতে পারোনি। এখনো সংসার করার মত অবস্থা নেই। পুনরায় ভরসা করা তোমার জন্য সহজ নয়। আমি সব জানি। আমি জানি, বিয়ের পর দিন,মাস কিংবা বছর লাগবে তোমাকে স্বাভাবিক হতে। আমি বুঝতে পারি। আমার পরিবার কিংবা আমার উপর কৃতজ্ঞতা দেখাতে নিজেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করো না প্লিজ। বিয়ে নিয়ে কোনো প্রেশার নিও না। তোমার মন যদি বলে, তাহলে এই মুহূর্তে বিয়ে হবে। তুমি যদি জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাও তাহলে বলো, এখনই বিয়ে হবে। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নয়।
নুসাইবকে চিন্তিত দেখে তৃধা সোজা হয়ে বসলো। সরু চোখে শূন্য তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বললো,, দেখুন নুসাইব , অতীতটা ভুলার মত নয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলবো কিনা সন্দেহ। তবে হ্যাঁ এই অতীতের কষ্টটা সময়ের সাথে কিছুটা তো লাগব হবেই । যেমন এখন আর কষ্টটা কষ্ট মনে হয় না। এখন আগের মত মনে হয় না আমি ভালোবাসা হারিয়েছি। এখন মনে হয় ভ্রম কেটে বাস্তবে ফিরে এসেছি, ছলনা থেকে মুক্তি পেয়েছি। আসলে কি বলুন তো! কষ্ট সয়ে গেছে বলেই এমনটা মনে হয়। আর হ্যাঁ,আপনি বললেন না ,ভরসা করা সহজ নয়? আমি ভরসা করি। আপনাকে আপনার পরিবারকে ভরসা করি। তাছাড়া আপনার পরিবার কিংবা আপনি কারো প্রেশারে রাজি হইনি। নিজের ইচ্ছাতেই রাজি হলাম। ভাবলাম জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। এইবার যদি জীবনটা আবার এলোমেলো হয় তাহলে তেমন কিছু আসবে যাবে না।আবার ভরসা ভাংলে তেমন একটা ক্ষতি হবে না। ভাঙ্গন এখন স্বভাবিক লাগে। প্রয়োজনে নিজেকে আবার গড়ে নিবো।
নুসাইব ঠায় তাকিয়ে রয়। তৃধা চোখ সরিয়ে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,,এইবার ভাগ্যের উপর নয় বরং পুরুষ কুলের দোষ দিয়ে কিছুটা কষ্ট কমাবো।
নুসাইব গাড়ি সার্ট দিয়ে বললো,, তা আর হচ্ছে না। দ্বিতীয় সুযোগটাই শেষ সুযোগ।এর পর তোমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। মরলে আমার আঙ্গিনায় দাফন হবে তাও বাইরে যাওয়া চলবে না।”
________
রাত তিনটা শেখ ভিলার একটা কোন এখনো নির্ঘুম। ফরিদা হক আর নুসাইব বসে আছে। ফরিদা হক ভীষণ চিন্তিত।
প্রায় মিনিট দশেক আগে তৃধা নুসাইব ফিরেছে।
নুসাইব তৃধাকে রুমে পাঠিয়ে বাবা মায়ের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে। ফরিদা হক ঘুমায়নি। তিনি জেগে আছেন। দরজার খটখট শব্দে উঠে বসলেন। এইভাবে তার বড় ছেলে কড়া নাড়ে। তমাল হলে দরজায় এমন ভাবে কড়া নাড়তো যেন দরজা খুলে এক্ষুনি পড়ে যাবে। ফরিদা হক দরজা খুলে অবাক হলেন না, বরং ছেলেকে দেখে ভীষণ শান্ত গলায় বলে উঠলো,, আয় ভেতরে আয়।
নুসাইব ঘরে ঢুকলো না বরং চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,, আম্মু তৃধা বিয়ের জন্য রাজি।
নুসাইবের কথায় চমকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পুনরায় ছেলের দিকে তাকালো ফরিদা হক। এতো রাতে ছেলের বিয়ে ভিমরতি হলো নাকি? নাকি জীন ভুতে ধরেছে?মায়ের অবিশ্বাস্য নজর দৃষ্টি গোচর হতেই নুসাইব বলে উঠলো,, ট্রাস্ট মি আম্মু সত্যি বলছি।
ফরিদা হক জানেন তার এই ছেলে মিথ্যা কথা বলে না। তিনি সন্দিহান চোখে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,,, ভয় দেখাসনিতো?
মায়ের কথায় অবাক হলো না বরং মোবাইল বের করে তৃধার ভয়েস রেকর্ড শুনিয়ে বললো,, খামোখা ভয় দেখাতে যাবো কেন?ভালো করে শোনো।তোমার মত আমারো প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। তাই রেকর্ড করে নিয়েছি।
তৃধার মিষ্টি প্রস্তাবে মৃধু হাসলো ফরিদা।কন্ঠ স্বরে ভয় ভয় ভাব নেই। তার মানে সত্যি। তিনি খুশি হলেও চিন্তিত গলায় বলে উঠলো,, দেখ বাপ তোর দাদির ঠিক ঠিকানা নেই। চল হুজুর নিয়ে আসি! এক্ষুনি বিয়ে পড়িয়ে দিবো। পরে না হয় রেজিস্ট্রি করা যাবে।
মায়ের এহেন কথায় চোখ জোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম।,” রাত তিনটা! আম্মু। এখন কিসের বিয়ে?
নিজের কথায় নিজেই বিরক্ত ফরিদা হক। তিনি বললেন,, তুই যা ঘুমো গিয়ে। আমি দেখছি।
মায়ের হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না। হঠাৎ করে কেমন এলোমেলো লাগছে। খুশিতে এলোমেলো নাকি দাদির সাথে হওয়া ভেজালে এলোমেলো সেটা বুঝা দায়।
নুসাইব রুমে গেলেও ঘুমটা আর হলো না। বাকি রাতটা তৃধার বলা সেই মধুময় বাক্য শুনেই কাটিয়ে দিলো। নুসাইবের মত তৃধার চোখেও ঘুম নেই। পেছনের সময় গুলো ভেবে পার করছে রাত্রি। অতীত বর্তমান মিলিয়ে ভাবছে সব।
রুমে পেতে রাখা সোফায় পা গুটিয়ে বসলো ফরিদা হক। একে একে ফোন করছে সবাইকে। বাপের বাড়ি থেকে শুরু করে নিজের কাছের বান্ধবী কেউ বাদ নেই। তিন্নি বাদ পড়লেও ,বাদ যায়নি তমাল, নবনীও। তিন্নির উপর কিঞ্চিৎ অভিমান করে আছেন ফরিদা হক।
তমাল নবনী খবর পেয়ে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। তমাল কাঁধে ঝুলানো ব্যাগে দুটো বই আর তৃধার দেওয়া শার্ট ভরে নিলো। নবনী ব্যাগ পত্র গুছিয়ে তাড়াহুড়ো করে সমুদ্রকে ফোন করলো। ঘুমে বিভোর সমুদ্র হাতিয়ে চশমাখানা খুঁজে নিলো। বার বার কল করা ব্যাক্তিকে মনে মনে যাচ্ছে তাই গালি দিলেও মোবাইল স্ক্রিনে “নবনীতা” নামটা দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। মনের মধ্যে একরাশ দুঃশ্চিন্তায় ঘুম উড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করতেই ,অপর প্রান্তে থাকা চঞ্চল রমনী হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,,” সমুদ্রঅঅ,,! ভাইয়া বিয়ে করছে।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও ,এক্ষুনি বাড়ি যাবো।
___________
সোফায় পাশাপাশি বসে আছে তৃধা নুসাইব। একটু আগেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। এই মুহূর্তে দুজন ধর্ম মতে বিবাহিত নব-দম্পতি। মিনিট দশেক আগেই ঘটনাটা নাটকিয় ভাবে ঘটে গেছে।
দু’জনেই ঘুমে ঢুলছে। বাকি রাত তৃধা নুসাইব কেউ না ঘুমালেও ভোর পাঁচটার দিকে চোখ জোড়া লেগে আসে দুজনের। ভোর ছয়টায় ফরিদা হকের আগমন।বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট করে টেনে তুলে আনলো দুজনকে । ড্রয়িং রুমের পাতানো সোফায় বসিয়ে তৃধার মাথায় ঘোমটা টেনে পাশে বসে বললে,, হুজুর , বিয়ে পড়ানো শুরু করুন ।
বিয়ে পড়ানো শুরু করুন শুনতেই পিলে চমকে উঠলো তৃধার। চোখ জোড়া কচলাতে কচলাতে ঝাপসা দৃষ্টি পরিষ্কার করে সামনে তাকায়। তার ঠিক সামনে মাঝ বয়সী একজন হুজুর মত লোক বসা। এই দিকে নুসাইব হতবিহব্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। হুজুর থেকে চোখ সরিয়ে তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখে তারও একই অবস্থা। দুইজনের চেহারা দেখার মত হলেও ফরিদা হক আর নাবীব শেখ ভীষণ স্বাভাবিক। এর মধ্যে ব্যাগ পত্র কাঁধে ঝুলিয়ে হড়বড়িয়ে ঢুকলো তমাল। বিয়ে মিস হয়ে যাচ্ছে দেখেই ব্যাগ রেখে ছুটে ভাইয়ের পাশ ঘেঁষে বসে হাঁপাচ্ছে। নাবীব শেখ বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,, আমজাদ কি হলো?”
হুজুর নিজেও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এইখানে। তিনি অবস্থার গতিবেগ দেখে ধারনা করতে পারছে না এইটা কোনো জাতীয় বিয়ে? চুরির বিয়ে ? নাকি পারিবারিক সম্মতির বিয়ে? প্রশ্ন থাকলেও চেপে গেলেন। নাবীব শেখের প্রশ্নে বলে উঠলেন,
,” ভাই সাহেব,মেয়ে সহ মেয়ের মা-বাবার নামতো লাগবে। তা না হলেতো বিয়ে পড়ানো যাবে না। তাছাড়া অভিভাবক?”
তমাল আগ বাড়িয়ে বলল,, ভাবী তাড়াতাড়ি বলো। তোমার দুশমন দাদি শ্বশুড়ি উঠে গেলে সর্বনাশ।
ফরিদা হক বলে উঠলেন,,আমি মেয়ের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবো। আর নাবীব তার ছেলের অভিভাবক। তৃধা মা হুজুর যা জিজ্ঞেস করছে বল।
হঠাৎ এমন হওয়াতে খেই হারালো তৃধা। সব ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছে। মনে হচ্ছে রাতে কথা গুলো স্বপ্ন হয়ে হানা দিচ্ছে।ফরিদা হক তৃধার কাঁধে হাত রেখে বলল,” বলনা মা!
তৃধা ঢোঁক গিলে ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো,, তৃধা বিনতে মাহাবুব ,বাবা :মাহাবুব ইসলাম, মা: মায়া জাহান।
নুসাইব ঘুম জড়ানো রক্তিম শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। তৃধার পুরো নাম এই প্রথম শুনলেও বাকি দুটো নাম ভীষণ পরিচিত লাগছে। এই দুটো নাম কোথাও শুনেছে মনে হয়।
তমাল হা করে তাকিয়ে বললো,, ওয়াও তৃধা আপু তোমার তো আরো নাম আছে।
ফরিদা হক চোখ রাঙ্গায়। এই মুহূর্তে নাম নিয়ে এতো কথা কিসের।
মোহরানার কথা জিজ্ঞেস করার পর তৃধা থেকে উত্তর মেলেনি। তা দেখে ফরিদা হক নিজে মোহরানা ধার্য করে দিলে। মোহরানা ধার্য হতেই ,হুজুর বসে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।
নুসাইব তৃধা থেকে চোখ ফেরায়নি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তৃধাকে। মেয়েটা এতো চুপচাপ কেন? পরক্ষনে ভাবলো হয়তো এমন আচমকা উঠিয়ে এনেছে তাই। নুসাইব ভেবে পায় না এমন সাত সকালে কে বিয়ে করে? নিশ্চয়ই এই আইডিয়া মায়ের। হাত মুখ না ধুয়ে, বিয়ের সাজসজ্জা বাদ দিয়ে পারিবারিক ভাবে বিয়ে এই প্রথয় দেখছে তাও আবার নিজের। কিছুটা হতাশ হলেও কথা বাড়ালো না।
তৃধা চুপ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বলার কিছু নেই। অতীত বর্তমান মিলে জিবনটা ভীষণ রকম এলোমেলো হয়ে আছে। আপাতত অতীতকে পেছনে ফেলতে চায়। অতীতে থাকা ব্যাক্তি তাকে ছাড়াই সুখে আছে। তাহলে সে কেন দুঃখে কাটাবে? নুসাইব ঠিকই বলেছে। ভালো থাকা প্রয়োজন। খুব করে ভালো থাকা প্রয়োজন।
তৃধাকে কবুল বলতে বলার পর থেকে তৃধা চুপ করে আছে। এইদিকে সবার চোখ তৃধার দিকে তাক করা। ফরিদা হক টেনশনে ঘামছে। তমাল পারলে তৃধার হয়ে তিনবার কেন,প্রয়োজনে আট দশবার কবুল বলে দিতো। নুসাইব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার চেহারার আদলে তাকালো। তৃধা তৃধার মধ্যে নেই। তার চোখ মুখে অদ্ভুত দ্বিধা দেখে নুসাইব নরম গলায় বলে উঠলো,, “ইটস্ ওকে।তুমি না চাইলে বাদ।”
নুসাইবের কথা কর্নকুহরে পৌঁছাতেই তৃধা কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট কামড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বহু প্রতীক্ষিত একটি শব্দ তিনবার উচ্চারণ করেই দিলো। ফরিদা হক বড় নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে কতোবার যে আলহামদুলিল্লাহ বলেছে তার ইয়াত্তা নেই। নাবীব শেখ মুচকি হেসে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে পড়লো। তিনি আর দাঁড়াবে না।এই মুহূর্তে মিষ্টি আনতে হবে। তমাল গলা ঝেড়ে বললো,, বাবা কোথায় যাচ্ছো? ভাইয়া বাকি আছে এখনো।
নাবীব শেখ পেছনে তাকিয়ে বললো,,” ও আমার ছেলে। কবুল বলা ছাড়া উঠবে না। আমি যাচ্ছি মিষ্টি আনতে।”
মাঝ বিয়েতে তমাল মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,, আম্মু! বাবা শুধু ভাইয়াকে “আমার ছেলে” বললো কেনো? তাহলে আমি কে?
আমজাদ দারুন বিরক্ত। এই ছেলেটা ছোট থেকেই উল্টো পাল্টা প্রশ্ন করে। বড় হলেও স্বভাব বদলেনি। তিনি মনে মনে বলে মনেই মনেই হতাশ হলেন।
ফরিদা হক ইশারায় তমালকে চুপ করিয়ে ।বিয়ের কাজ শেষ করতে বললেন। কবুল বলতে বলায় সময় নিলো না নুসাইব। বরং হুজুর কবুল বলতে বলার সাথে সাথে কবুল বলে বিয়ের কাজ শেষ করলো।
নাবীব শেখ ছেলের মুখে কবুল শুনে তবেই চৌকাঠ মাড়িয়ে বাইরে বেরুলেন।
সেই থেকে সোফায় বসে আছে তৃধা নুসাইব। দুজনকে রেখে মা ছেলে উঠে পড়লো। ফরিদা হক সমুদ্রের মায়ের সাথে লম্বা আলাপচারিতায় বসেছে। বিয়ের ব্যাপারটা নতুন বেয়াই বেয়ানকে জানানোর ভীষণ তাড়া। তমাল লাগাতার নবনীকে কল করে যাচ্ছে। ফরিদা হকের উচ্ছাস দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো তৃধা। লজ্জায় গাল দুটোতে রক্তিম আভা ছেয়ে গেছে। হঠাৎ করে এতো লজ্জা কোথা থেকে ঘিরে ধরলো বুঝতে পারছে না। নুসাইব নিজেই বুঝতে পারছে না কি রিয়েক্ট করবে। ভাবতেই অবাক লাগছে পাশে বসা মেয়েটা এখন থেকে তার ব্যাক্তিগত রমনী। সবটাই যেন অতিব সুন্দর স্বপ্ন। যে স্বপ্ন ভাঙ্গার ভয়ে কথা বলতেও ভয় করছে তার।
তমাল দুজনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ভাই তার বিয়ে করেই শহীদ হয়ে যাচ্ছে দেখে আফসোসে জর্জরিত। এমন হলে চাচা হওয়া দায়। তমাল ক্যামেরা অন করে গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,, ভাইয়া ভাবী তাকাও।
ভাইয়া বলাতে নুসাইব তাকালেও তৃধা এই ভাবী ডাকে অভ্যস্ত নয়।
নুসাইব পাশ থেকে তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,, নতুন বউ! তোমাকেই বলছে,তাকাও।
চলবে,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৩
,
,
,
,
,
,
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বসলো তৃধা। তার সামনে ঘুর ঘুর করছে নবনী। আলমিরা খুলে একে একে জামা কাপড় সব গুছিয়ে নিচ্ছে ট্রলিতে। এর মধ্যে একটা ট্রলি ব্যাগ তমাল এসে দোতলায় নিয়ে গেছে। এখন আরেকটা গোছানো চলছে। আধ ঘন্টা হলো নবনী বাড়িতে পা রেখেছে। সমুদ্র বাড়ির গেইটে নামিয়ে দিয়ে গেছে। নবনী বারবার বলেও বাড়িতে আনতে পারেনি। তার মতে এই সময় বাড়িতে যাওয়া অশোভনীয়। এরপর নবনীও আর জোর করেনি। বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকেই সে ভীষণ ব্যস্ত। বিয়েতে উপস্থিত থাকতে না পারার দুঃখের চাইতে তৃধাকে এলোমেলো দেখে বেশি দুঃখে জর্জরিত। নিদারুণ একটা ঘটনা এমন সাধারণ সাবলীল ভাবে ঘটে গেলো নবনী মানতে নারাজ। তৃধাকে সোফা থেকে উঠিয়ে ঘরে এনে ফ্রেশ হতে পাঠালেও নিজে তৃধাকে ভাইয়ের ঘরে শিফ্ট করার কাজে লেগে পড়লো। তৃধা নিরবে সবটা দেখে চলেছে। একরাতে জিবনটা আবারো বদলে গেলো। সম্পর্ক গুলো নতুন মলাটে আবৃত হলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। নবনী বারবার তৃধাকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা খুশি।
ফরিদা হক এতক্ষণ টেনশন ফ্রী থাকলেও এইবার কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। ছেলে মেয়ে দুটোর হই হুল্লোড় শুনে শ্বশুর শাশুড়ি দুজন উঠে পড়েছেন। সেতারা বেগম মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। সোয়েব শেখের তেমন ভাবাবেগ নেই। তিনি ফ্রেশ হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। ফরিদা হক যেই কাজ বুক ফুলিয়ে করেছেন সেই কাজ বলতে তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। যদিও ব্যাপারটা জেনে ফেলেছেন কিছু সময় আগে। তাও তিনি ভয় পাচ্ছেন।
পুত্রবধূর ভয় সংসয় বুঝলেন সোয়েব শেখ। তিনি চায়ের কাপ রেখে বলল,, বিয়ে দিয়ে দিয়েছো আপত্তি নেই মা। আমি মনে করি এইটা ভালোই করেছো। তা না হলে লোকে নানান কথা তুলতো। তা এখন কি করবে? শুধু ধর্মমতে বিয়ে হলেতো হবে না।আইনি একটা ব্যাপার আছে।এটাতো আগের যুগ না। এখন কাগজে কলমে লেখা থাকা লাগে।
শ্বশুরের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলেন ফরিদা। নয়তো কথা সব গ*লায় দলা পাকিয়ে ছিল। ফরিদা হক বলেন,’ কোট রেজিস্ট্রি বাকি আছে। সমস্যা নেই সেটাও হয়ে যাবে। এখন ভাবছি অনুষ্ঠান নিয়ে। সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলতে হবে।আমি ভাবছি পরশুদিন সব সেরে ফেলতে।
সোয়েব শেখ চিন্তিত গলায় বলেন,’ পরশু বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? আমাদের দিকের লোকজন থেকে শুরু করে নাতনিদের শ্বশুর বাড়ি সবতো আছে। তাছাড়া নাবীবের বন্ধুবান্ধব,এতো অল্প সময়ে দাওয়াত, আয়োজন চারটে খানে কথা নয়।
শ্বশুরের কথায় ফরিদা হক নিজেই চিন্তায় পড়ে গেছেন।
অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নামছিলো নুসাইব। এর মধ্যে দাদার বিবরণ শুনে বললো,’এতোবড় আয়োজনের দরকার নেই।ওইসব আমার পছন্দ না। খুব কাছের মানুষ আর শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়া বাদবাকি সব বাদ। গ্ৰামের বাড়ি থেকে বড় চাচ্চু , ছোট চাচ্চুর পরিবার আর ফুফু ফুফাকে বললে হবে। নানু বাড়িতে তো কেউই নেই। খালামনি ,মামা সবাই বাইরে। হুট করে তো আর আসা সম্ভব নয়। আমার দিক থেকে বড় জোর দুই একজন হবে। তমাল নবনীর ফ্রেন্ড কেউ থাকলে বলবে। আর আম্মু তুমি সমুদ্রের পরিবারকে জানিও। তিন্নির শ্বশুরের পরিবারও বাইরে। তাও দাওয়াত দিও। আমাদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে আয়োজন করো। খামোখা ঢাকঢোল পিটিয়ে অহেতুক আয়োজনের দরকার নেই। খুব বেশি হলে পঞ্চাশ জন নিয়ে আয়োজন করো। পারলে কমিও তবে এর বেশি যেন না হয়। দুঃখে যখন কেউ থাকেনি, এখন দুধে মাছি হওয়ার দরকার নেই। বেশি মানুষ মানেই বেশি কথা।
ফরিদা হক ছেলের কথায় যুক্তি খুঁজে পেলেন। তিনিও একমত। তাছাড়া কাল রাতের চিৎকার চেঁচামেচি কতটুকু গেছে কে জানে। কেউ যদি তিল শুনে থাকে তাহলে এতক্ষনে তাল বানিয়ে দিয়েছে।
নুসাইবের কথা সোয়েব শেখের ভীষণ মনে ধরলো। তিনি মাথা নেড়ে বললো,, হুম বড় নাতি ঠিক কথাই বলেছে। বউমা তাহলে আয়োজন পরশুই হোক।
ফরিদা হক টেবিলে প্লেট সাজাতে সাজাতে বললো,, ঠিক আছে বাবা।
নুসাইব খেয়াল করে দেখলো ,এতো বেলা হলেও কেউ এখনো ব্রেকফাস্টের জন্য আসেনি। তমাল ছুটে ছুটে তৃধার ঘরে যাচ্ছে আর ব্যাগপত্র নিয়ে বের হচ্ছে। নুসাইব দেখেছে ,তার সাথে তৃধার বিয়ে নিয়ে যদি কেউ বেশি খুশি থাকে তবে সেটা তমাল নবনী। দু’জনের আগ্ৰহ , উচ্ছাস আকাশচুম্বী । নুসাইব চোখ ফিরিয়ে বললো,,, আম্মু বাবাকে দেখছিনা? এখনো ফেরেনি?
ফরিদা হক বিরক্ত হয়ে বলল,, মিষ্টির দোকান তুলে আনতে গেছে। আমি শিওর বসে বসে আগে নিজে খাচ্ছে। মায়ের কথায় হাসলো নুসাইব।
একে একে টেবিলে আসছে সবাই। সেতারা বেগম রাগে ধুপধাপ শব্দ করে চেয়ারে বসছে। তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আগে তমাল নুসাইবের পাশে বসলেও আজ চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে অন্য চেয়ারে বসলো।
নবনী একপ্রকার জোর করে তৃধাকে নতুন জামা পরিয়েছে। তৃধা বারবার মানা করার সত্বেও শুনলো না। নবনী নিজ হাতে চুল বেঁধে ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো,, ভাবতেই অবাক লাগছে তুমি আমার ভাবী হয়ে গেছো। জেগে জেগে দেখা স্বপ্নটা সত্যি হয়ে গেলো। আপু থেকে প্রমোট হয়ে সোজা ভাবী। আহ্ শান্তি। তাড়াতাড়ি চলো তোমার বর সহ শ্বশুরের পরিবার অপেক্ষা করছে।
তৃধা অনড়।নবনীর কথায় পা জোড়া জমে গেছে। এই মুহূর্তে সবার সামনে উপস্থিত হওয়ার মত অবস্থায় সে নেই। যেন কাল রাতের তৃধার সাথে এখনকার তৃধার আকাশপাতাল ফারাক।কেমন এক অনূভুতি বলে বুঝানো দায়। লজ্জা সংকোচ মিলে অদ্ভুত অনুভূতি ঘিরে ধরছে তৃধাকে। হুট করে বিয়ে হওয়া এক কথা। সেখানে অচেনা মানুষগুলোর সাথে শূন্য থেকে শুরু করা যায়। কিন্তু এমন পরিচিতদের মাঝে বিয়ে হওয়া অন্য রকম। চেনা সম্পর্কের নাম সম্বোধন সব বদলে যায়। তার সাথে বদলাতে হয় চালচলন। তৃধা বুঝে পায় না এই মুহূর্তে কিভাবে সবার সামনে যাবে।
তৃধার চিন্তা ভাবনাকে মাড়িয়ে টেনে তুললো নবনী। এক প্রকার ঠেলে রুম থেকে বের করে হাত চেপে ধরে বলল,, খবরদার ভাবী এই মুহূর্তে আবার পিছু হাঁটলে দাদিকে পাঠাবো। দাদি ফু দিয়ে টেবিলে বসাবে। বাড়িতে থাকার সত্ত্বেও দাওয়াত দাওনি তাকে। এর প্রতিশোধ তুলবে। চলো তাড়াতাড়ি।
নবনীর কথা মিথ্যা নয়। সত্যিই সেতারা বেগম নামক দাদি তাকে ছাড়বে না। দুই বছরে গ্ৰামে এইসব কম দেখেনি তৃধা। নিশ্চয়ই বলবে আমি তার বড় লোক নাতিকে তাবিজ করে পটিয়ে বিয়ে করেছি। তা না হলে বলবে রূপ দেখিয়ে পাগল করেছি। এমন হাজার চিন্তা মাথায় নিয়ে ডাইনিং টেবিলে সামনে গেলো। সেতারা বেগম আগুন চোখে তাকায়। তমাল নবনীকে ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে দেয়। ফরিদা হক আদুরে চোখে তাকিয়ে হাসলেন। তার সংসার পূর্ণ মনে হচ্ছে। নবনী নুসাইবের পাশের চেয়ারটা টানার আগেই নুসাইব চেয়ার টেনে দিয়ে বললো,’ বসো।’
নবনী মুখ টিপে হাসছে। তমালের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিয়ে হতে না হতেই ভাইয়ের এমন বদল। ‘বসো’? দারুন উন্নতি। যতটা আনরোমান্টিক ভেবেছি ভাই ততটা আনরোমান্টিক নয়। ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেলো তমাল।
তৃধা চার পাশে তাকিয়ে দেখে কয়েক জোড়া চোখ তাকেই দেখছে। বেচারি লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। পারলে এক্ষুনি মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতো।
তৃধাকে বসিয়ে নবনী অন্য পাশে বসে পড়লো। সবাইকে নাস্তা বেড়ে দিচ্ছেন ফরিদা হক। সেতারা বেগমকে ভাজি দেওয়ার সময় হাত দিয়ে বাধ সাধলেন । তা দেখে সোয়েব শেখ বলে উঠলো,, আহ্! সেতারা এতো রাগ ভালো না। প্রয়োজনে তুমি তোমার পছন্দমত ছোট নাতিকে বিয়ে করিও। এতে আমরা কেউ আপত্তি করবো না।
দাদার কথা শুনে তমালের গলায় রুটি বেজে গেছে। কাঁশতে কাঁশতে বেহাল দশা। তৃধা তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। ফরিদা হক ছেলের পিঠে ,মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,, বাবু আস্তে খা,এতো তাড়াহুড়োর কি আছে।
তমালের অবস্থা দেখে হাসলো নুসাইব। তৃধা হতবিহব্বল হয়ে ফিসফিস করে বললো,, আপনার হাঁসি পাচ্ছে? তমাল ভাই ম*রে যাচ্ছে।
তৃধার কথা শুনেও না শোনার মত করে বললো ,, প্লেট খালি কেন? তৃধা ভীষণ বিরক্ত হয়ে তমালের দিকে তাকায়। নুসাইব তৃধার প্লেটে রুটি আর সবজি বেড়ে দিয়ে বললো,,’আগে খেয়ে নাও।এই বাঁদর দেখার জন্য পুরো জিবন পড়ে আছে।’
সেতারা বেগম বিরক্তে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললেন। এমন ভিমরতি তার সহ্যসীমার বাইরে। ডিভোর্সি মেয়েকে বউ বানিয়ে এতো আদিখ্যেতা করার কি আছে বুঝে পায় না তিনি। সোয়েব শেখ নিজ স্ত্রীর মুখাভঙ্গি দেখে বুঝলেন তার মনে কি চলছে।
তমাল কাঁশি থামলে বলে,, দাদু পছন্দ করবে মানে মেয়েটা দাদুর মতই হবে। দাদা! প্রয়োজনে আমি মুসাফির হয়ে ঘুরে বেড়াবো তাও বিয়ে করবো না। তোমার মত ধৈর্য আমার নেই। আমি আরেক সেতারা সহ্য করতে পারবো না।
তমালের কথায় সবাই মুখ টিপে হাসছে। শুধু সেতারা বেগমের মুখে হাসি নেই। তিনি রেগে সোয়েব শেখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তৃধা রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে হাঁসি থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। নবনী ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে আছে। তা না হলে কখন যে কোন বিপদ ঘটে ইয়াত্তা নেই।
তৃধার অবস্থা দেখে নুসাইব পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,, ‘তোমার শপিং তুমি পছন্দ করে করবে নাকি আমি করে ফেলতাম?’
তৃধা সবার দিকে তাকিয়ে পুনরায় নুসাইবের দিকে তাকালো। সবাই যেন তৃধার উত্তরের অপেক্ষা। তৃধা বুঝে পায় না কিসের শপিং। তৃধার বিভ্রান্ত চেহারা দেখে ফরিদা হক বলে উঠলো,, ‘বিয়ের শপিং তৃধা। পরশুদিন তোদের বিয়ের অনুষ্ঠান। এইজন্য কেনাকাটা করা লাগবে।’
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,, ‘আপনাদের যা পছন্দ।’
তৃধার উত্তরে সেতারা বেগম ফোঁড়নকেটে বললো,,’ ভাবখানা এমন যেন কোনো কিছুই তার দরকার নেই। ভেতরে ভেতরে সবই চাই । আমার নাতির মাথা তো এই ভাবেই নষ্ট করেছে।’
সবার সামনে এইভাবে বলাতে তৃধা মাথা নিচু করে ফেললো। তৃধা জানে তার জন্য অনেক তিক্ত কথা অপেক্ষা করে আছে। তবে সেই তিক্ত কথা এতো তাড়াতাড়ি শুনতে হবে সেটা কল্পনাতেও ছিল না।’ চোখ ভিজলো তৃধার। এতো তিক্ত অভিজ্ঞতা তার নেই। বিয়ে যে ভাবেই হোক এইভাবে কেউ কখনো বলেনি তাকে।
নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে সেতারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,,’ তোমার কি মনে হয় দাদু? আমি অতো কাঁচা মাথা নিয়ে ঘুরি? চাইলেই কেউ নষ্ট করতে পারবে? উল্টো আমিই তৃধার পেছন পেছন ঘুরে ওর মাথা নষ্ট করেছি। বিয়ের জন্য রাজি হচ্ছিল না। একপ্রকার জোর করেই রাজি করাই। সাত সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়ে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লাগি। আমাকে বলো আমি ওর মাথা নষ্ট করেছি। ওকে কেন বলছো? তাছাড়া তৃধার এতোটা চাহিদা নেই যতটা তুমি মনে করছো। ওর চাহিদা অতি সাধারণ। অবশ্য ওসব তোমার বুঝার বাইরে। পরবর্তী সময় বুঝে শুনে কথা বলবে। সে এখন আমার স্ত্রী, ওকে তুলে কথা বলা আর আমাকে তুলে কথা বলা একই।
নুসাইবের কথা শুনে অবাক চোখে তাকালো তৃধা। ফরিদা হক পারলে এক্ষুনি মসজিদে জিলাপি দিতো। নবনী আয়েশ করে দাদি আর ভাইয়ের বাকবিতন্ডা দেখছে। এই দিকে তমাল মনে মনে ভেবেই রেখেছে বিয়ে করলেও চুরি করে করবে। দাদি পাত্রী খুঁজলে তার মত জালিম জাহিল একটাই খুঁজবে। তার মত ভবিষ্যৎ ডাক্তারের প্রয়োজন শান্তশিষ্ট বউ। যাকে দেখলে কথা শুনলে মস্তিষ্ক ঠান্ডা হবে। একদম তৃধা আপু টাইপ। দাদির পছন্দ মানেই তো তাওয়ার উপর বসে পশ্চাৎ জ্বালিয়ে সংসার করা। এমন হলে ভবিষ্যৎ ডাক্তারের ভবিষ্যৎ রোগীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে যাবে।
সেতারা বেগম সোয়েব শেখকে ঝাঁকিয়ে বললো,, দেখেছো !দেখেছো! বিয়ে হয়েছে ঘন্টা দুই হয়নি এর মধ্যেই আমার বিপক্ষে করে নিয়েছে। নিশ্চয়ই এই মেয়ে কিছু করেছে।
তৃধা চমকে তাকালো। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো এতক্ষণ।
নুসাইব মুচকি হেসে বলল,, আমার বউয়ের তোমার মত অতো গুন নেই যে তাবিজ কবজ করে সংসার করবে। তা ছাড়া আমিও সোয়েব শেখ নই। দাদু আমি আবারও বলছি আমার সিদ্ধান্তের উপর প্রশ্ন তুলো না। আমি মোটেও বাবার মত নই। তাই শেষ বারের মত বলছি কিছু বলার থাকলে আমাকে বলবে। তৃধাকে তুলে কোনো কথা যেন না শুনি। তার ভালো-খারাপ,দোষ-গুন সব কিছুর দায় ভার এখন আমার।
সেতারা বেগম উত্তর করার আগে নুসাইব তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,, আম্মু আর নবনীর সাথে সাথে থাকবে। শপিংএর ব্যাপারটা আমি সামলে নিবো। আর হ্যাঁ, অজাচিত কথা শুনে মন খারাপ করার দরকার নেই। আল্লাহ মুখ তোমাকেও দিয়েছে। দরকার হলে বলবে । এই নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি আছি। আমি সবটা দেখে নিবো। কথা গুলো বলে আর দাঁড়ালো না ফরিদা হক থেমে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। নুসাইব গেলেও কথার রেশ রয়ে গেছে। নবনী-তমাল গালে হাত দিয়ে তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদা হক ছেলের কথায় বেশ মুগ্ধ। তিনি জানতেন না ছেলে তৃধার ব্যাপারে এতোটা ডেস্পারেট। এই দিকে সেতারা বেগম রাগে গজগজ করতে করতে রুমে চলে গেলেন। সোয়েব শেখ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার দিকে তাকিয়ে বললো,,, সুখে থাকো তোমরা। আমি সব সময় তোমাদের জন্য দোয়া করবো।তোমার দাদী শ্বাশুড়ির কথায় কিছু মনে করো না। ওর মাথা গরম হলেও মনটা ভীষণ নরম।
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,’ সমস্যা নেই আমি কিছু মনে করিনি।’
সোয়েব শেখ যেতেই নবনী তমাল ঘিরে ধরলো তৃধাকে।
,’দেখেছিস ভাই? বড় ভাইয়া আজ নায়কের মত তার নায়িকাকে কি ভাবে রক্ষা করলো। ওয়াহ্ সুপার হিট। আজকেই সমুদ্রকে বলবো। ভবিষ্যতে তাদের গুষ্টির কুটনি থেকে যেন এই ভাবেই রক্ষা করে।
,’ আরে ওদের গুষ্টি শান্ত গুষ্টি খবর নিয়েছি। ওই পুরো গুষ্টির মধ্যে তুই এক মাত্র কুটনি যাচ্ছিস। ওরা একজনকে আরেকজন রক্ষা করবে। তুই চিন্তা মুক্ত থাক।’
তমালের কথায় রাগলেও কিছু বললো না নবনী। তৃধা না থাকলে চুলোচুলি হতো নিশ্চিত।
ফরিদা হক তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,’ আজ থেকে মা বলবি।’
সবার দুষ্ট মিষ্টি কথা শুনে তৃধা মাথা নিচু করে আছে। ভাবছে নুসাইবকে নিয়ে । তার অধিকার বোধের পরিসর নিয়ে তৃধার সাম্যক ধারনাও ছিলো না। লোকটা হুট করে কেমন জানি বদলে গেলো। দুজনার মধ্যকার দেয়ালটা সরিয়ে দিয়ে আপনের তালিকায় পড়লো। কেউ নেই থেকে আমারো একজন আছে মনে হলো। ধীরে ধীরে তৃধার মন মস্তিষ্কে জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ছে’আমারো কেউ আছে’। বার কয়েক মনে মনে কথাটা আওড়াতে লাগলো তৃধা। সেই কথাটাই ভালোলাগার বীজ বুনে চলেছে। মনে হচ্ছে কেউ বলছে’ তুমি একা নও ,আমিও আছি’।
__________________
ফরিদা হক ভীষণ ব্যস্ত। সবাইকে কল করে করে দাওয়াত দিচ্ছেন। শুধু তিন্নির বেলায় এসে তিনি আটকে যাচ্ছেন। মেয়ের উপর ভীষণ রেগে আছে। কতবড় কান্ড ঘটিয়ে দিলো।
নাবীব শেখও বসে নেই তিনি ডায়রি থেকে নাম্বার গুলো মোবাইলে তুলছেন। সবার সব রকম ব্যাস্ততার মাঝে তমাল ব্যাস্ত ওয়েডিং প্লেনার নিয়ে। মানুষ কম হলেও আয়োজন পরিপূর্ণ হবে। কোনো কিছুতে খামতি থাকা চলবে না।
নুসাইব শপিং করার জন্য বেরিয়েছে। খুঁজে খুঁজে পছন্দ সই কিনছে সব। হুট করে এতো ধৈর্য কই থেকে এলো কেজানে? এতোটা খুতিয়ে কখনোই শপিং করেনি। কিন্তু আজ সময় নিয়ে চিন্তা না করে দেখে দেখে কিনছে সব।
তৃধা হাত দুহাত মেলে বসে আছে। এক হাতে মেহেদি দেওয়া শেষ হলেও অন্য হাতের কাজ এখনো চলছে। নবনী সন্ধ্যায় একজন মেহেদী আর্টিস্টকে আনিয়েছে। কাল সময় করতে পারবেনা দেখে এখনই লাগিয়ে দিচ্ছে। তৃধার কাছে এই আয়োজন নতুন। রজবের সাথে বিয়েটা পালিয়ে হয়েছিলো। এমন তোড়জোড় করে কিছুই হয়নি। বিয়ে হতেই সংসার শুরু করেছে। তৃধা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। হাতের মাঝে ছোট করে নুসাইব নামটা লেখা। এই নামটা তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। তৃধা না চাইতেও আদুরে চোখে তাকায় সে দিকে।
নবনী মৃধু হেসে মেসেজ আদান-প্রদান করছে। নবনীকে শুভ্র লাগছে। তৃধা মুগ্ধ হয়ে দেখছে নবনীকে। হাসি হাসি মুখটা চুপসে যায় যখন দেখে ওইদিক থেকে উত্তর দিতে দেরি হচ্ছে। তৃধা মৃদু হেসে নবনীকে দেখছে। নুসাইবের সাথে তার সম্পর্কটা কি কখনো এমন হবে? অপেক্ষা করে বসে থাকবে ,তার দেরি হলে রাগবে সে। উত্তর নেই তৃধার কাছে। অপেক্ষার জন্য ব্যাক্তিটা ভালোবাসার হতে হয়। নুসাইব কি কখনো ভালোবাসা হবে?
_____________
আজ রজবের ঘর অন্ধকার। ঘরে বাতি দেওয়ার লোক নেই। সে পুকুর ঘাটে বসে আছে। সুমনার সাথে ঝগড়াটা বড় আকার ধারন করেছে। রাগে বশীভুত হয়ে সুমনার গায়ে আবারও হাত তুলেছে। আজকাল সুমনাকে দেখলেই তার ভীষণ রাগ হয়। এর থেকে কথা কাটাকাটি এক পর্যায়ে হাত উঠে যায়। মনে হচ্ছে রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই তার। সুমনা আজ আর বসে থাকেনি। ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। এতে রজবের তেমন একটা ভাবাবেগ হলো না। সুমনা থাকতেও তার ঘরটা শূন্য লাগতো। আজ নেই তাতেও শূন্য লাগছে। সুমনা তৃধার শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। তৃধার শূন্যতা তিলে তিলে শেষ করছে তাকে। রজবের সাথে অন্ধকার ঘরটাও তৃধাকে চাইছে।
চলবে,,,,,