ইচ্ছের উল্টোপিঠ পর্ব-২২+২৩

0
1058

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_২২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

তন্ময় চমকে উঠলো। ভ্রু উচু করে বললো,

” তুমি ঐ..ঐশী ? ”

ঐশী মুচকি হেসে চেয়ারে হেলান দিলো। জোরে এক হাফ ছেড়ে বললো,

” আরে। একবারের কথা একশোবার কেনো বলা লাগে আপনাকে । কালা, নাকি ? ”

তন্ময় শুধু অবাক হচ্ছে ঐশীকে দেখে। চিরচেনা লাজুক , নীরব মেয়ে আজ ওর সামনে রণমূর্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তন্ময়ের ব্যাপারটা একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। ঐশী তন্ময়কে চুপ থাকতে দেখে চেয়ার টেনে তন্ময়ের দিকে আরও একটু এগিয়ে বসলো। তন্ময়ের গালদুটো হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। তন্ময় ব্যাথা পেলো। তবুও চোখ রাঙিয়ে তাকালো ঐশীর দিকে। ঐশী দাত চেপে বললো,

” কি? অবাক হচ্ছিস? আমাকে এই রূপে দেখে সহ্য হচ্ছে না? তাইনা? ”

তন্ময় চোখ কুচকে বললো,

” মাইয়া মানুষের এত তেজ ভালো না। ”

ঐশী রাগে গড়গড় করে উঠলো। তন্ময়ের গাল আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

“আমি মেয়ে। কিন্তু তার আগে আমি একজন সন্তান। আজ আমি এতিম হয়ে গেছি শুধুমাত্র তোদের জন্যে। তোরা সবকটা মরবি। (তন্ময়ের গাল আরো জোড়ে চেপে ধরে) আমি মারবো তোদের। বুঝলি। ”

ঐশী তন্ময়কে ছেড়ে দিয়ে আবারও চেয়ারে বসলো। তন্ময় তেজি গলায় বললো,

” ভূমি,, অপস সরি, ঐশী। দেখ, আমাকে এখানে আটকে রাখতে পারবি না। নাহলে তোর বাবার মতো তোকেও চাঁন্দে পাঠিয়ে দিবো। তাই বলছি ছেড়ে দে। ভালো হবে তোর জন্যে। ”

ঐশী মুখ কুচকে ফিচেল হাসলো। খুব আরামসে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তারগুলোর কাছে গেলো। হাতে গ্লাভস পরে দুটো তার নিজের হাতে নিলো। তন্ময় এসব দেখে ঘামতে লাগলো। কন্ঠনালী শুকিয়ে এলো। কাপা কণ্ঠে বললো,

” ক.কি করতে চাইছো তুমি, ভূমি। দেখো , তুমি… ”

তার আগেই ঐশী তার দিয়ে তন্ময়ের ডান হাতে এলিকট্রিক শক দিলো। তন্ময় কেপে উঠলো। হাতে জ্বালা ধরে সেই জ্বালায় মস্তিষ্ক পর্যন্ত কিলবিল করে উঠলো। চোখ বুঝে ছটফট করতে লাগলো গলা কাটা মুরগীর মতন। ঐশীর এসব দেখে কিছুটা ভয় লাগলো। তন্ময়কে এভাবে ছটফট করতে দেখে শিউরে উঠলো ও। চোখ বন্ধ করে ফেললো ও। কিন্তু বন্ধ সেই চোখে ভাসলো বাবার করুন চেহারা। সঙ্গেসঙ্গে ঐশী চোখ খুলে ফেললো। রক্ত লাল হয়ে উঠলো সেই নিষ্পাপ নয়নজোড়া। তন্ময় যখন একহাতের জ্বালা সামলাতে কাহিল হয়ে যাচ্ছে তখনই ঐশী দ্বিগুণ তেজ নিয়ে তন্ময়ের বাম হাতে তার দিয়ে শক দিলো। সঙ্গেসঙ্গে তন্ময় জোরে ” আহহহ” বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো। তন্ময়ের চিৎকার যাতে বাইরে বের না হয় সেজন্যে ঐশী ওর মুখে কাপড় দিয়ে আটকে দিল। তন্ময় এবার চোখ দিয়েই ঐশীর কাছে কাকুতিমিনতি করতে লাগলো। ঐশী সেই আকুতি দেখে আবারও তন্ময়ের হাতে শক দিলো। তন্ময় চোখ বুজে গুঙিয়ে উঠলো। ঐশী তন্ময়ের গাল হাত দিয়ে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,

” ব্যাথা পাচ্ছিস ? পা। আরো ব্যাথা পা। ছটফট কর। কাতরাতে থাক। নিজের জীবন ভিক্ষা চা আমার কাছে। যেরকম চেয়েছিলেন আমার বাবা, আমার মা। তোর চোখে আমি সেই আকুতি দেখতে চাই। দেখতে চাই সেই আকুতি। ”

ঐশী চিৎকার করে সেই কথা বলে এবার তার দিয়ে তন্ময়ের শরীরে আবারো শক দিলো। তন্ময় গুঙিয়ে উঠলো। চোখ বেয়ে গড়াতে লাগলো অজস্র জলধারা। ঐশী এবার কিছুটা শান্ত হলো। তন্ময়ের কাছে হাঁটু গেরে বসে বললো,

” বাঁচতে চাস ? ”

ব্যাথায় কাহিল হয়ে নেতিয়ে পড়া তন্ময় সঙ্গেসঙ্গে চমকে উঠলো। মাথা পাগলের মতন নেড়ে সম্মতি দিলো অর্থাৎ সে বাঁচতে চায়। ঐশী ক্লান্ত হাসলো। একটু উঠে বসে তন্ময়ের মুখ থেকে কাপড় খুলে দিলো। তন্ময় এতক্ষণে মুখ খোলা পাওয়ায় মাথা নিচু করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো। ঐশী পাশ থেকে পানির বোতল হাতে নিয়ে সিপ খুললো। দুহাতে পানি নিয়ে তন্ময়ের মুখে ছিটিয়ে দিলো। একটু পর নিচু সুরে তন্ময় বিড়বিড় করলো ,” পা.পা.পানি। ”

ঐশী তন্ময়ের থুতনি হাত দিয়ে উপরে তুললো। তারপর পানির বোতল দিয়ে পানি তন্ময়ের খোলা মুখে ঢাললো। তন্ময় কিছুটা পানি গিলে ফেললো বাকিটা ওর মুখ উপচে শরীরে পড়লো। ঐশী পানির বোতল নামিয়ে সিপ দিয়ে আটকে দিলো। ঐশী বললো,

” জিহ্বা বের কর। ”

তন্ময় মাথা তুলে তাকালো। চোখে মুখে প্রশ্নের পসরা। ঐশী আবারও বললো,

” পানি খাবি না ? পানি চাইলে, জিহ্বা বের করতে হবে তো। ”

তন্ময় কি বুঝলো কে জানে।সে জলদি নিজের জিহ্বা বের করে পানির জন্যে আর্তনাদ করতে লাগলো। ঐশী এবার আকস্মিক একটা ধারালো ছুড়ি দিয়ে তন্ময়ের জিহ্বার আগা কেটে নিল। তন্ময় অত্যধিক ব্যাথায় খুব জোড়ে আর্তনাদ করলে উঠলো। ঐশীর সেই চিৎকার শুনে কেনো যেনো খুব দয়া হলো। মেয়েলি মন। হয়তো তাই। ঐশী তন্ময়কে ছেড়ে দিলো। তন্ময় চেয়ারে বসে ছটফট করছে। ঠিক যেমন একটা কৈ মাছ মরার আগে ছটফট করে তেমনভাবে। ঐশী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না। ঐশী এবার ধীরেসুস্থে চেয়ারে বসলো। কয়েকটা কাগজ নিজের হাতে নিয়ে তন্ময়ের দিকে তাকালো। বললো,

” যদি বাঁচার ইচ্ছে থাকে , তাহলে এই পেপারগুলো সাইন করে দে। ”

বলে ঐশী তন্ময়ের দিকে কাগজগুলো এগিয়ে দিলো। বাঁচার জন্যে আগ্রাসী তন্ময় কাগজ হাতে পেয়ে বাধা হাতেই কোনমতে সাইন করে দিলো। সাইন করার সাথেসাথে ঐশী কাগজগুলো ছিনিয়ে আনলো তন্ময়ের কাছ থেকে। তন্ময় ধিমে গলায় বললো,

” এ.এবার ছ.ছ.ছেড়ে দেও আ.আ.আমায়। ”

ঐশী কাগজ চেক করতে করতে বললো,

” হুম। অবশ্যই, অবশ্যই। ”

কাগজগুলো ভালো করে পরখ করে ঐশী তন্ময়ের দিকে এগিয়ে গেলো। তন্ময়ের হাতের দড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে আরো কাছে এলো। তন্ময় চোখে মুখে প্রশান্তি নিয়ে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। ঐশী দড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
কিন্তু হুট করে একটা ইনজেকশন তন্ময়ের বা হাতে পুষ করলে দিলো। তন্ময় জোরে চিৎকার করে উঠলো। ঐশী পুরো ইনজেকশন পুষ করা শেষে সরে এলো। তন্ময়ের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। তন্ময় ব্যাথায় কাতরাতে লাগলো। একটু পর মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো সাদা ফ্যানা। কিছুক্ষণ পর তন্ময়ের ছটফটানি কমে গেলো। শরীর নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে পড়লো চেয়ারেই। তন্ময়ের এই অবস্থা দেখে ঐশীর গা গুলিয়ে এলো। মুখ ভর্তি করে বমি পেলো। ঐশী নিজেকে সামলে তন্ময়ের বাঁধন খুলে তন্ময়ের মৃত দেহ টানতে টানতে নিয়ে ফ্যানের সাথে বেধে দিলো। ঐশী নিচে নেমে এলো। মাথা উঠিয়ে উপরে তাকালো। ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে তন্ময়ের নিথর দেহ। তন্ময়ের মৃত দেহ দেখে শিউরে উঠলো ও। ভয়ে কপালে ঘাম জমলো। ঐশী হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘামের ফোঁটা মুছলো। তবুও আবারও ঘেমে নেয়ে একাকার হলো তার কপাল , মুখশ্রী।

ঐশী তন্ময়ের শরীরে কেরোসিন ঢেলে দিলো। তারপর একটা ম্যাচ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে ছুড়ে ফেললো সেই ম্যাচের কাঠি তন্ময়ের দিকে। সঙ্গেসঙ্গে দাওদাও করে জ্বলে উঠলো আগুন। তন্ময়ের শরীর একটু একটু করে পুড়ে ছাই হচ্ছে। চারপাশে গন্ধ ছড়াচ্ছে। মরণ গন্ধ। ঐশী সবকিছু সামলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গ্যারেজ থেকে।

গ্যারেজের সামনে একটা গলিতে এসে থেমে গেলো। গা গুলিয়ে আসতেই মুখ ভরে বমি করলো রাস্তায়। এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকার ভান করলেও এখন ভয় লাগছে। মন, আত্তা শুকিয়ে খা খা হয়ে যাচ্ছে। তার জীবনের প্রথম খুন ছিল এটা। এতটা নির্মম ভাবে কাউকে মরতে দেখে ঐশীর ভাবনার জগৎ থমকে থমকে যেতে লাগলো। বারবার মাথায় সেই খুনের দৃশ্য ভাসছে। ঐশী নিজেকে সামলাতে পারছে না। মাথা ঘুরাচ্ছে। চারপাশ ঘুরছে। মাথার চক্কর দেওয়ার কারণে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো সে ,বলতে পারে না।

_______________________

দিনের শেষ ভাগ। সময়ের প্রহরগুলো গড়িয়ে যাচ্ছে আপনমনে। ঐশীর প্রায় দুঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো। চোখের উপর পানির উপস্থিতি লক্ষ্য করতেই ঐশী চোখ খুলে নিলো আস্তে আস্তে। প্রথমেই চোখ গেলো দেয়ালে লাগানো এয়ারকন্ডিশনারের দিকে। তারপর চোখ নেমে এলো সোফায় বসে থাকা জুভানের দিকে। জুভান সোফায় বসে বসে ল্যাপটপে কি একটা করছে।

” আপনার রোগী মেন্টালি অনেক ডিপ্রেশনে আছেন, মিস্টার জুভান। ”

পাশ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠস্বর কানে আসতেই ঐশী ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাকালো। একজন মধ্যবয়স্ক ডাক্তার তার ব্যাগ গুছাচ্ছেন। ঐশী উঠতে চাইলে জুভান সোফা থেকেই হুকুম দেয়,

” খবরদার। শরীর নাড়ানোর চেষ্টা করবে তো এক থাপ্পর। সেকেন্ডে ,সেকেন্ডে থাপ্পড়। সো কিপ কোয়াইট। ”

ঐশী ক্লান্ত ছিলো। জুভানের সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই নেই তার। তাই ও বেডে গা এলিয়ে দিলো। ডাক্তার জুভানের দিকে তাকালে জুভান ল্যাপটপ এক পাশে রেখে সোফা থেকে উঠে ডাক্তারের কাছে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তার ব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন,

” দেখুন মিস্টার জুভান , আপনার ভাষ্যমতে রোগী আগে থেকেই মানষিক চাপ পেয়েছেন। একটা পরিবার হারানো কম কথা নয়। তাই উনি এখনো এই মানুষিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। উনাকে সময় দিতে হবে। কোনোরূপ মেন্টাল প্রেসার যাতে উনার উপর না পরে সেই খেয়াল রাখবেন। ”

জুভান এসব শুনে তীক্ষ্ম চোখে ঐশীর দিকে তাকালো। ঐশী চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছে। জুভান ডাক্তারের দিকে তাকালো। দুনো হাত বুকে ভাজ করে নিয়ে বললো,

” তিনি তার নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারেন ,ডক্টর। কোনো ডাক্তার-ফাক্তারের দরকার নেই উনার। ”

ডাক্তার মৃদু হাসলেন। বললেন,

” জোকসটা ফানি ছিল। আমি আসছি এবার। রোগীর কিন্তু প্রপার খেয়াল রাখবেন। ”

জুভান ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে ঐশীর পাশে এসে বসলো। ঐশীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ঐশীর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডাক দিলো,

” ঐশী , এই ঐশী। ”

ঐশীর ঘুম কিছুটা ভাঙলো। চোখ একটু খুলে আবারও বুজে নিলো। জুভান ঐশীর এসব বাচ্চামো দেখে হাসলো। কন্ঠে আদর ঢেলে বললো,

” কে বলবে এই রণচন্ডি মেয়েটা আস্ত এক বাচ্চা। আচার আচরণে এমন বাচ্চামি করে যে নিজেই ফেঁসে যায়। পাগল একটা। ”

#চলবে…

#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_২৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

আসরের আযান ভেসে আসছে অদূর এক মসজিদ থেকে। সেই সুর ছন্দময় ভাবে এসে কানে লাগলো ঐশীর। জানালার পাশের হিজল ফুলের গাছটায় একজোড়া শালিক নিজ বাসায় ফিরে এসেছে। সঙ্গে এনেছে মুখভর্তি সারাদিনের খাবার। বাচ্চাদের খাওয়াতে হবে যে! জুভান কাউকে ফোন করলো, রুমে একটা ডিম আর একগ্লাস দুধ আমার জন্যে।

একটু পর দরজার বেল বাজলো। জুভান ল্যাপটপটা কোল থেকে নামিয়ে পাশে রাখলো। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। খাবার গ্রহন করে ট্রে টা নিয়ে বিছানায় রাখলো। ঐশীর ঘুমন্ত চোখের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসলো। ঐশীর পাশে বসে আলতো গলায় ডাক দিলো,

” ঐশী,ঐশী। উঠো। খাবারটা খেয়ে নাও। ঐশী? ”

ঐশী চোখ কুচকে নিলো। আদো আদো চোখ মেলে তাকালো। পাশে সুঠাম দেহী পুরুষকে দেখে সে চমকে উঠলো। হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো। ব্যাকুল কণ্ঠে বললো,

“আপনি? আপনি আমার রুমে কি করছেন ? এটাতো আমার রুম, তাইনা ? ”

জুভান ঐশীকে বুঝানোর মত করে বললো,

” রিলাক্স ঐশী। রিলাক্স। ওকে। আমি বুঝিয়ে বলছি। শান্ত হও। ”

ঐশী মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিলো। চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে বললো,

” বলুন। ”

” তুমি রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলে। আমি তোমায় হোটেলে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার দেখছিলেন তোমায়। তাই আমি পাশে ছিলাম। আর এখন জাস্ট তোমাকে খাইয়েই চলে যেতাম। দেটস ইট। ”

ঐশী হাফ ছাড়লো। বেডে হেলান দিয়ে ক্লান্ত চোখে তাকালো জুভানের দিকে। বললো,

” খাবার ? ”

জুভান খাবারের ট্রে-টা ঐশীর দিকে এগিয়ে দিলো। ট্রে তে ডিম আর দুধ দেখেই ঐশী নাক ছিটকালো। বিরক্ত হয়ে বললো,

” এসব আমি খাই না। প্লিজ সরান এগুলো। আমার দেখতেই বমি আসছে। ”

জুভান উত্তর করলো না। বরং প্লেট থেকে ডিম হাতে নিয়ে ঐশীর গাল চেপে ধরলো। ঐশী তাজ্জব বনে গেলো এমন ব্যাবহারে। গাল ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। জুভান ছাড়লো নাম বরং জোরপূর্বক ডিমটা ঐশীর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে গাল ছেড়ে দিলো। ঐশী না চাইতেই গিলে ফেললো ডিমটা। তারপর অগ্নি চুক্ষ নিয়ে তাকালো জুভানের দিকে। বললো,

” আপনি এভাবে জোর করে খাওয়ালেন কেনো ? আমি মানা করেছিলাম, না ? ”

জুভান মুচকি হেসে দুধের গ্লাস হাতে নিলো। বললো,

” আমার সাথে ঝগড়া করার জন্যে হলেও তো তোমার শক্তি দরকার। আর এসব না খেলে তো আর শক্তি আসমান থেকে আসবে না। তাইনা? ”

ঐশী রাগে আগুনের শিখায় পরিণত হতে লাগলো। জুভান এসব পাত্তা না দিয়ে দুধের গ্লাস ঐশীর দিকে এগিয়ে বললো,

” এখন এটা। খেয়ে ফেলো ঝটপট। ”

ঐশী ত্যারাভাবে বললো,

” না। খাবো না। আমার এসব পছন্দ নয়। ”

” পছন্দ না হলেও খেতে হবে। কারণ এসব তোমার পছন্দ না হলেও স্বাস্থ্যের পছন্দ। সো ড্রিংক ইট। ”

ঐশী নাক মুখ খিচে দুধটা খেয়ে ফেলার চেষ্টা করলো। অর্ধেক খেয়ে আর পারলো না। গ্লাসটা আবারও ট্রে তে রেখে বললো,

” আই অ্যাম ডান। আর খাওয়া সম্ভব না। ”

জুভাম ট্রে সাইড টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,

” যেটুকু খেয়েছো , সেটুকুই এনাফ। নাও ঘুমাও। আমি লাইট নিভিয়ে চলে যাচ্ছি। ”

জুভান সোফায় থাকা ল্যাপটপের দিকে এগিয়ে গেলে ঐশী হুট করলে চিৎকার করে উঠে। আতঙ্কিত গলায় বলে,

” আমার ড্রেস ! আমার ড্রেস কে চেঞ্জ করেছে ? আম..”

জুভান ল্যাপটপের দিকে ঝুঁকে ভ্রু কুচকে নিলো। আসলেই! এই মেয়েটা ব্যাপক সন্দেহবাজ। জুভান ঐশীর চিৎকার কানে না নিয়ে ল্যাপটপ হাতে নিলো। কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যেতে নিলে ঐশী আবারও চিৎকার করে উঠে,

” আসলেই আপনার চরিত্রের কোনো ঠিক নেই।আপনি কি করে পারলেন এভাবে ….”

আর বলতে পারলো না ঐশী। মাঝপথেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। জুভান তো হতভম্ব হয়ে পিছন ফিরলো। ঐশীর পাশে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললো,

” স্টপ ক্রাইং। ”

ঐশী কান্না থামলো না। বরং আরো জোড়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। জুভান এবার ঐশীর পাশে বসে ঐশীর বাহু ধরে ওকে নিজের দিকে ফিরালো। দাত চেপে বললো,

” ওয়ে। হ্যালো। নিজেকে কি মনে করো ? কোনো রাজ্যের কুইন। এত লেম চিন্তা ভাবনা তোমার। ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন , আপনার ড্রেস আমি চেঞ্জ করেনি। বমি করে ড্রেস নষ্ট করে ফেলেছিলেন। তাই হোটেলের একজন ফিমেল সার্ভেন্ট এসে চেঞ্জ করিয়ে দিয়েছে। ”

ঐশী কান্না থামিয়ে ভিজে চোখে জুভানের দিকে তাকালো। জুভান রাগে ঐশীর বাহু ঝটকা দিয়ে ছেড়ে দিলো। তারপর ল্যাপটপ হাতে নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
ঐশী চেয়ে রইলো অবাক পানে। নিদারুণ বিস্ময় ওই কালো মনির চোখ জোড়ায়। এই মানুষটাকে এখনো চিনে উঠতে পারেনি সে। একেবারেই না।

আচমকা ঐশীর মুঠোফোনে ” রিং রিং ” বেজে উঠলো। ঐশী চোখ মুখ মুছে ফোন হাতে নিলো। হোয়াটসআপ মেসেজ। ঐশী মেসেজটা ওপেন করলে দেখে কয়েকটা ছবি। তন্ময়ের খুনের দৃশ্য। ঐশী এসব দেখে থমকে গেলো। দরদর করে ঘেমে উঠলো তার কপাল। ঐশী ফিরতি মেসেজ করলো,

” কি চাই তোমার ? ”

” টুং” করে মেসেজ আসলো। ঐশী ধুকধুক মন নিয়ে মেসেজ পড়লো। লেখা,

” তোমার সাথে দেখা করতে চাই। ”

ঐশী একটু ভাবলো। তারপর লিখলো,

” ওকে। কোথায় দেখা করতে হবে অ্যাড্রেস পাঠিয়ে দিও। ”

ঐশী ফোন বেডের উপর রেখে “দ” আকৃতিতে বসলো। দুহাত দিয়ে হাঁটু চেপে ধরে দুলতে দুলতে ভাবলো,

” কে এই মানুষ ? ছেলে নাকি মেয়ে? আর কিভাবে এসব ছবি পেলো ও। ”

ঐশী এসব ভেবেই ভয়ে একদম সেটিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতর হৃদপিণ্ড টা জোরে চলছে। এবার কি হবে!

_______________________

জুভান রুমে এসে ঠাস করে দরজা বন্ধ করলো। ল্যাপটপ বেডে জোরালো ভাবে রেখে দিয়ে সোফায় বসলো। রাগে গড়গড় করতে করতে বললো,

” কি পেয়েছে কি এই মেয়ে। যখন যা মুখে আসে তাই বলে। আমাকে এতদিনে এমন মনে হয়েছে ওর। মানছি একসময় আমি মেয়েবাজ ছিলাম। কিন্তু কখনোই কোনো মেয়ের সম্মতি ছাড়া ওকে ছুঁইনি। আর এই মেয়ে কত সহজেই আমাকে চরিত্রহীন বলে দিলো। রাবিশ! ”

জুভান যখন রাগ সামলাতে ব্যস্থ তখন ওর ফোনে কল আসে। জুভান পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে একজন বললো,

” স্যার , কাজটা শেষ। ”

জুভান বাঁকা হাসলো। বললো,

” গুম করে দিয়েছো তো, ঠিকভাবে ? ”

” জ্বি স্যার। ”

” ভেরি গুড। এখন নিউজ সেন্টার গুলোকে সামলে নিও। রাখছি।”

জুভান সোফা থেকে উঠে ফোন কেটে দিলো। একটু নিরব থাকার পর শব্দ করে হাসলো। পরক্ষণে হাসি থামিয়ে বললো,

” নিষিদ্ধ কাজ করার পর সেটা অতি শীগ্রই গোপন করে ফেলতে হয়। নাহলে সেই অসাবধানতা, নিষিদ্ধ কাজ আর নিষিদ্ধ লোক দুজনের জন্যেই বিপদ ডেকে আনে। ”

____________________

“হক মহল ” বাড়ির বাগানে আরাম কেদারায় বসে আছেন সাহেদুল হক। হাতে চায়ের কাপ। পরনে একটা সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি। খুব আরামসে বসে গল্প করছেন একজন আত্মীয়ের সাথে। হঠাৎ উনার কাছে ছুটে এলো এক ছেলে। সাহেদুল হক তার দিকে তাকাতেই ছেলেটা হাপাতে হাপাতে বললো,

” সাহেব , তন্ময় ভাইরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না আজ সকাল থেকে। ”

সাহেদুল হক এই খবর শুনে খুব একটা আশ্চর্য হলেন না। ব্যাপারটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বললেন,

” আরে। দেখো কোথায় মদ খেয়ে পড়ে আছে। ”

” সত্যি বলছি সাহেব। আমি সব জায়গায় , সব বারে খুঁজেছি। উনি কোথাও নেই। ”

সাহেদুল হক এবার রাগী চোখে তাকালেন। বললেন,

” তো তাকে খুঁজে না পাওয়া গেলে কি করবো আমি। নাচবো। ধিং তা নানা ধিং। যত্তসব। যাও এখন। আমার এখন বিশ্রামের সময়। ”

ছেলেটা এসব শুনে আহত ভঙ্গিতে তাকালো মন্ত্রী পদে বসে থাকা এই মানুষরূপী জানোয়ারের দিকে। একটা মানুষ এতোটা নির্দয় কি করে হয়! ভেবে পায়না সে।

#চলবে