উইন্টার এন্ড মাই সনেট পর্ব-৩৫+৩৬

0
29

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৫ (১ম ভাগ)||

বসার ঘরে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। অরুণিকার চোখ-মুখ শক্ত। আরাফ ও তাহমিদ থমথমে মুখে আহনাফ ও অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ অরুণিকার ঠিক বিপরীতে বসেছে। তার দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। মিসেস চৌধুরী ও মিসেস তাওসিফের মুখ ম্লান হয়ে আছে। চৌধুরী সাহেব ও তার দুই ছেলে সটান হয়ে বসে আছেন। পাশে শিরিন সুলতানার ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা। এবার গমগমে গলায় আরেফিন চৌধুরী বললেন, “অরুণিকা যেহেতু সম্পর্কটা আর রাখতে চায় না, তাহলে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই শ্রেয়।”

আবার সেকেন্ড খানিক নিরবতা বিরাজ করলো। আমির চৌধুরী বললেন, “কাগজপত্র রেডি করে ফেলেছি। আহনাফ ও অরুণিকার সিগনেচার লাগবে এখন।”

আহনাফ চোখ তুলে অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকা এখনো বেশ শক্ত হয়ে বসে আছে। আহনাফ তা দেখে ক্ষীণ হাসল। ভাবলো, “তুই এতো কঠিন হৃদয়ের কখন থেকে হলি, অরু? যার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমানোর স্বপ্ন বেঁধেছিস। তাকে ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা তোর মাথায় কীভাবে এলো?”

শিরিন সুলতানা কাগজটা অরুণিকার হাতে দিয়ে বললেন, “সই করে ফেলো। প্রথম তালাক হয়ে যাবে।”

অরুণিকা কাগজ হাতে নিলো। পাশ থেকে কলম তুলে নিতেই আহনাফ বলল, “আমি চাই না ডিভোর্স।”

সবার দৃষ্টি এবার আহনাফের ক্লান্ত মুখের দিকে৷ আহনাফ অরুণিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর অভিযোগ, আমি তোকে বিরক্ত করি। তোর সাথে বাজে ব্যবহার করেছি। তাহলে তো দোষ আমার। শাস্তি আমার পাওয়া উচিত।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। শিরিন সুলতানা বিরক্তির সুরে বললেন, “সময় নষ্ট করার কি দরকার, আহু। যা হচ্ছে, হয়ে যাক। জয়িতার মা’কে কথা দিয়েছি আমি। তোদের ডিভোর্স হলেই আমি তোর বিয়ের কথা আগাবো।”

আরাফ গম্ভীরমুখে বলল, “ওদের এই মুহূর্তে আলাদা কথা বলতে দেওয়া উচিত। সংসার ভাঙার উস্কানি দেওয়া শয়তানের কাজ।”

আরাফের কথায় বাড়ির সবার মুখ লাল হয়ে গেল। বিশেষ করে শিরিন সুলতানার মুখ। তবে মিসেস তাওসিফ ও মিসেস চৌধুরী আরাফের কথায় সায় দিলেন। মিসেস চৌধুরী বললেন, “আরাফ দাদুভাই ঠিক বলেছে। সংসার ভাঙা পাপ। তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত, উলটো আমরা তাদের সাহায্য করছি।”

আমির চৌধুরী বললেন, “কিন্তু এটা অরুণিকার সিদ্ধান্ত। আমরা তো জোর করছি না কাউকে। ও এসে আমাদের বললো ডিভোর্স নেবে। আমরা তো চেয়েছি পঁচিশ বছর হলে সে আরো ম্যাচিউওর হবে, তারপর সিদ্ধান্ত নেবে সংসার করবে না-কি করবে না। কিন্তু এর আগেই অরুণিকা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

এবার আরেফিন চৌধুরী বললেন, “আর বিয়েটাও গ্রামের মানুষের জোরাজুরিতে হয়েছে। জুবায়ের নিজেও তার মেয়েকে আহনাফের সাথে বিয়ে দিতে চায় নি।”

শিরিন সুলতানা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, “যেমন কি আমরা চেয়েছিলাম? আমরাও চাই নি ওকে ঘরের বউ করে আনতে!”

অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, “যেমন কি আমি চেয়েছি? আপনার ছেলে এমন কোনো সুপুরুষ নয় যে তাকে বিয়ে করে একটা মেয়ে কখনো নিজেকে ভাগ্যবতী বলতে পারবে। তার চেয়ে আমি সিংগেল থাকাটা প্রেফার করি।”

“দেখেছো, কেমন বেয়াদব মেয়ে! কেমন পটর পটর করছে! আমার এক ছেলেকে মেরে, আরেক ছেলের গায়ে জোঁকের মতো বসে আছে।”

অরুণিকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “একটা প্রবাদ আছে। দুধ কলা দিয়ে সাপ পোষা। জোঁক পোষার কোনো প্রবাদ নেই। থ্যাংকস আমাকে জোঁক বলার জন্য। সাপ হওয়ার রুচি আমার নেই।”

শিরিন সুলতানা তেড়ে আসতেই আহনাফ মা’কে ধরে বলল, “প্লিজ, আমার কথা ভাবো। আমি ভালোবাসি অরুকে। আমার জন্য তোমরা পুরোনো সবকিছু ভুলে যাও।”

তাওসিফ শাহরিয়ার বললেন, “কিন্তু পাঁচ বছর আগে তুমিই তো সবাইকে বললে অরুণিকাকে ভালোবাসো না।”

“তখন আর এখনের মধ্যে অনেক পার্থক্য।”

শিরিন সুলতানা ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। অরুণিকা তা দেখে বলল, “এতো হতাশ হতে হবে না। আমি সত্যিই এই সংসার চাই না।”

আহনাফ অরুণিকার হাত থেকে তালাকের কাগজ নিয়ে ছিঁড়ে ফেললো। এমন আচরণে চমকে উঠলো সবাই। আমির চৌধুরী বললেন, “মশকরা করছো তোমরা আমাদের সাথে? ডিভোর্স দিয়ে আলাদা হয়ে যাও। এতো ঝামেলা ভালো লাগছে না আর। এমনিতেই অরুণিকার জন্য আমার ছোট ছেলে মারা গেছে। এই মেয়েকে দেখলেই আমার আবরারের কথা মনে পড়ে।”

শিরিন সুলতানা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠলেন। অরুণিকা বাঁকা চোখে তার দিকে তাকিয়ে মিনমিনিয়ে বলল, “হাউ ড্রামাটিক!”

আবরারের কথা মনে পড়তেই আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকালো। অরুণিকার চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সবাই তাকে আবরারের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে, অথচ সে এখনো সটান হয়ে বসে আছে। আহনাফ বলল, “ঠিক আছে। ডিভোর্স হবে। তবে আমার একটা শর্ত আছে।”

আরেফিন চৌধুরী বললেন, “কি শর্ত?”

“ডিভোর্সের সাথে আমি অরুকে কাবিনের টাকাসহ আমার নামে থাকা চৌধুরী ম্যানশনের ফ্ল্যাট, চৌধুরী বিজনেস গ্রুপে আমার অংশ, আমার নামে কেনা ফার্ম হাউজ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে আমার নামে কেনা যাবতীয় জায়গা, বাড়িতে আমার অংশ, আমার নামে যেই যেই বিজনেস দাঁড় করানো হয়েছে সবই আমি অরুর নামে লিখে দেবো, আর যদি এই শর্ত অরু নিজেও না মানে, তাহলে আমার পক্ষ থেকে কোনো লেটার যাবে না।”

আমির চৌধুরী ও শিরিন সুলতানা রাগে চিৎকার করে উঠলেন। শিরিন সুলতানা বললেন, “তোর মাথা ঠিক আছে?”

“মাথা ঠিকই আছে।”

অরুণিকা অবাক দৃষ্টিতে আহনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। আরাফ ও তাহমিদ এতোক্ষণে আয়েশ করে বসলো সোফায়। চৌধুরী সাহেব বললেন, “অরুণিকা মেয়ে মানুষ। তোমার সব মানে তোমার বাবার যা আছে তাও, আমার থেকে তোমার বাবা যা পাবে তাও। তোমাদের তো তখন কিছুই থাকবে না। কারণ তুমিই এখন তোমার বাবা-মার একমাত্র ছেলে।”

“আমি চাকরি করে যা পাবো, তা দিয়েই আমি চলতে পারবো। আমার বাবা-মাকেও চালাতে পারবো।”

আমির চৌধুরী বললেন, “আমি অনেক শ্রম দিয়ে এই বিজনেস দাঁড় করিয়েছে। কেন করেছি এসব? একমাত্র তোর জন্য। তোর ভবিষ্যতের জন্য। আর তুই বলছিস এসব অরুণিকাকে লিখে দিবি!”

“ভালোবাসা অনেক বড় সম্পদ। এর চেয়ে দামি সম্পদ হয় না। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। আমি সব বিলাসিতা ত্যাগ করতে পারবো। আমার কাছে যদি আমার অরুই না থাকে, আমি এসব দিয়ে কি করবো? অভাবের চাপে যদি কষ্ট ভুলে থাকতে পারি, তাহলে তো আমার জন্যই ভালো।”

অরুণিকা আহনাফের হাত ধরে বলল, “তুমি এমন অভিনয় কেন করছো, আহনাফ? তুমি আমাকে ভালোবাসো না। তুমি আবরার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই বিয়েটা ভাঙতে চাইছো না। বলো এটাই সত্য?”

আহনাফ অরুণিকার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি।”

আমির চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে অরুণিকাকে বললেন, “অরুণিকা, তুমি আরেকটু ভেবে দেখো। আহনাফের শর্ত আমার পক্ষে মানা সম্ভব না। ওর কথায় বোঝা যাচ্ছে, তোমাকে ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা ওর মধ্যে নেই।”

শিরিন সুলতানা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন, “কি যা তা বলছো? ছাড়বে না কেন? অবশ্যই ছাড়বে। ও না ছাড়লে, অরুণিকা ছাড়বে।”

অরুণিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। আহনাফ বলল, “অরুর মামী ওকে ফিন্যান্সিয়ালি কোনো সাপোর্ট করে না। ওর মামা দেশে না আসা অব্ধি ওদিক থেকে কোনো আশাও হয়তো অরুর নেই। ও নিজে টিউশন করে যা টাকা পায়, তাতেই ওর মাস চালানো দায়। ডিভোর্স লয়ার ঠিক করার মতো টাকা ওর কাছে নেই।”

“আমি ধার দেবো অরুণিকাকে।”

শিরিন সুলতানার কথায় আরাফ আর তাহমিদ ভ্রূ কুঁচকালো। আহনাফ হেসে বলল, “যদি কেউ অরুণিকাকে টাকা ধার দিয়ে ডিভোর্স নিতে সাহায্য করে, আই সু’য়ের, সম্পত্তিগুলো সব দানে দিয়ে দেবো। তখন না থাকবে ঘরে, না থাকবে ঘাটে।”

তাহমিদ আরাফের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসি দিলো। আরাফ বলল, “ভালো পয়েন্ট, যদি আমার বাবাও অরুকে সাহায্য করে, তবে আমিও সব দানে দিয়ে দেবো। একটা সংসার ভাঙার মতো পাপ করে, অন্তত সেই বোঝ কমানোর জন্য সাদকা করাই সবচেয়ে উপযুক্ত।”

চৌধুরী সাহেব বললেন, “তোমরা কি আমাদের সাথে মশকরা করছো?

আহনাফ আর কিছু বললো না। সে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আরাফ ও তাহমিদকে বলল, “আমি মুহাম্মদপুর চলে যাচ্ছি। তোরাও চল।”

আরাফ ও তাহমিদও বেরিয়ে পড়লো। চৌধুরী সাহেব নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমির চৌধুরী ও আরেফিন চৌধুরী অরুণিকার দিকে একনজর তাকিয়ে চলে গেলেন। অরুণিকাও চুপচাপ বের হতে যাবে, শিরিন সুলতানা তার হাত মুড়ে ধরে বললেন, “আমার ছেলেকে জাদু করেছিস না?”

অরুণিকা শিরিন সুলতানার গাল টেনে দিয়ে বলল, “আপনার জাদু কাটলেই তো আমার জাদু কাজ করবে।”

তাওসিফ শাহরিয়ার ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। মিসেস তাওসিফ স্বামীর হাত ধরে বললেন, “তুমি চাচীকে নিয়ে ভেতরে যাও।”

তাওসিফ মিসেস চৌধুরীকে নিয়ে চলে গেলেন। মিসেস তাওসিফ অরুণিকার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বড়দের সাথে এভাবে কথা বলে না, অরু।”

শিরিন সুলতানা নিজের পক্ষে কাউকে দেখে সাহস পেয়ে গেল। বিলাপ করে বললেন, “এই মেয়ে জাদু করেছে আমার ছেলের উপর। নয়তো আমার সুস্থ ছেলেটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেল!”

অরুণিকা এক গাল হেসে বলল, “আমি আপনার আহুকে বলে দিয়েছি। পাঁচ বছর আগে ছাদে কি কি হয়েছিল!”

মিসেস তাওসিফের দিকে তাকালেন শিরিন। আমতা আমতা করে বললেন, “কি বলছো তুমি? তুমিই আমার ছেলেকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছো।”

অরুণিকা হালকা হেসে মিসেস তাওসিফের দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখুন না চাচী। আমার শাশুড়ী মা, কেমন বোকা, তাই না? পাঁচ বছর আগে কি শুধু আবরার ছাদ থেকে পড়েছিল? পাঁচ বছর আগে ছাদে পিকনিক করতে গিয়ে আমার শাশুড়ি যে আমাকে চড় লাগিয়েছিল, সেটা তো মনেই ছিল না উনার। আমি তো সেটা বলেছি আহনাফকে। আর উনি কি-না ঘুরেফিরে আবরারেই আঁটকে যান।”

শিরিন সুলতানা রাগী স্বরে বললেন, “আমার তো সেই ঘটনায় মনে থাকবে। কারণ আমার ছেলে মারা গেছে।”

“মনে থাকা ভালো। কিন্তু আমি ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছি এটা বারবার কেন বলছেন? মনে হচ্ছে মুখস্থ করিয়ে দিতে চাচ্ছেন! চিন্তা করবেন না। মনে আছে আমার সব। আর আপনি যা মুখস্থ করিয়েছেন, সেটাও মনে আছে সবার। আমাকে কিছু মনে করাতে হবে। তবে আপনাকে আমৃত্যু সবাইকে মুখস্থ করিয়ে দিতে হবে। এখানে ভুলচুক হলে, আপনি তো শেষ।”

মিসেস তাওসিফ ভ্রূ কুঁচকে অরুণিকার দিকে তাকালেন। অরুণিকা এক গাল হেসে বলল, “মানে পেটের ভাত হজম হবে না আর কি।”

শিরিন সুলতানা রাগী দৃষ্টিতে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছেন। অরুণিকা হাতের ইশারায় বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে।

(***)

ঘড়িতে দুপুর বারোটা। আহনাফ ফাঁকা ক্লাসরুমে মাথা নিচু করে বসে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবুও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। আহনাফ ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত শিরিন সুলতানার নম্বরে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো তার কঠোর স্বর।

“কেন ফোন দিয়েছিস আমাকে? এতো করে বললাম ওই মেয়েকে ছেড়ে দে। কিন্তু দিতে তো পারলি না।”

“মা প্লিজ, এসব কথা পরে হবে৷ আগে ওই ডাক্তারের নম্বর দাও, যে আমাকে ভিটামিনগুলো দিচ্ছে।”

শিরিন সুলতানা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, “কেন? আমাকে কি এখন বিশ্বাসও হচ্ছে না?”

“মা, ওষুধগুলোর সাইড ইফেক্ট অনেক বেশি। আর আমি এখন ইউনিভার্সিটির লেকচারার।”

“কি সমস্যা আমাকে বল।”

“তোমাকে বলতে পারলে কি বলতাম না?”

“আমি বুঝেছি। ডাক্তার আমাকে বলেছিল সব। আর তাই জয়িতার সাথে তোর বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি এমন করছি। একবার বিয়ে করে নে। তোর আর ওষুধগুলো খেতেই হবে না।”

“মা, তুমি জানো এর সাইড ইফেক্ট কি?”

“হ্যাঁ, জানি।”

আহনাফ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। নিরবতা ভেঙে শিরিন সুলতানা বললেন, “দেখ বাবা, আবরারের মৃত্যুর পর তুই যেভাবে ডিপ্রেশড ছিলি, ওষুধগুলোই তোকে শান্তি দিয়েছে। ওই ট্যাবলেটটা দিনে দুই বেলা। আর পাউডারগুলো পানির সাথে গুলিয়ে খাবি।”

“কিন্তু আমার যে সমস্যা হচ্ছে!”

“পাঁচ বছর কি খাস নি? তখন কীভাবে সহ্য করেছিলি?”

“মা, আমি এখন লেকচারার।”

“তাই বলছি, বিয়ে করে ফেল। জয়িতা তোর জন্য পারফেক্ট। এই সমস্যার সমাধান বিয়ে।”

“তুমি আমাকে বুঝতেই চাচ্ছো না, মা।”

“ওষুধ বন্ধ করলে তুই হিংস্র হয়ে যাবি। তখন তোর অরুকে খুন করতে ইচ্ছে করবে। বরং এসব খেয়ে তুই ভালো থাকবি৷”

আহনাফ চেঁচিয়ে বলল, “উফ, তুমি আমাকে ডাক্তারের নম্বর দাও। নয়তো আমাকে চাকরি ছেড়ে বাসায় বসে থাকতে হবে। তুমি কেমন মা? তুমি আমার পেইন কেন বুঝতে পারছো না? আমি তোমাকে সব ক্লিয়ারলি বলতে চাচ্ছি না। একটু তো লজ্জা করো তুমি। আমি তোমার ছেলে। তুমি আমাকে ডাক্তারের নম্বর দাও। নয়তো আমি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেললে তোমাদের রেপুটেশন নষ্ট হবে। আমার ইমেজ খারাপ হবে।”

“যা করার কর। আমি তোকে কারো নম্বর দিচ্ছি না। তোর সমস্যার সমাধান জয়িতা, ব্যস।”

আহনাফ ফোন কেটে চেয়ার ছেড়ে উঠে ফোনটা ছুঁড়ে মারলো ফাঁকা ক্লাসরুমে। ফোনটি তার বিপরীতমুখী দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গেল। আহনাফ আবার চেয়ারে বসে চুল খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। চিৎকার করতে চেয়েও পারছে না সে। হঠাৎ একটা শীতল হাত তার ঘাড় স্পর্শ করতেই চমকে উঠলো আহনাফ। মাথা তুলে পাশে যতিকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। যতির চোখে রহস্য। সে নরম সুরে বলল, “স্যার, আজ আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে! ঠিক আছেন তো?

আহনাফ রুক্ষ কণ্ঠে বলল, “তুমি এখানে কি করছ? যাও এখান থেকে।”

যতি হালকা হেসে বলল, “আপনাকে আজ অন্যরকম লাগছে কেন, স্যার?

যতি তার হাত আহনাফের বুকের উপর রাখলো। আহনাফের বুক ধড়ফড় করছে। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথাটাও ভারী ভারী লাগছে। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো সে। যতি তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “আমি জানি অরুণিকার সাথে আপনার সম্পর্ক ভালো চলছে না। অরুণিকা আপনাকে একটুও রেস্পেক্ট করে না, স্যার। আপনি শুধু শুধু কেন ওর পেছনে সময় নষ্ট করছেন? আপনি যথেষ্ট স্মার্ট। অরুণিকার চেয়ে বেটার মেয়ে আপনি ডিজার্ভ করেন। প্লিজ, লিভ হার। আমি আপনাকে ভালোবাসি, স্যার। আপনাকে চিঠি লিখেছিলা, মনে আছে? আপনি কোনো উত্তর দেননি। আমার সত্যিই আপনাকে ভালো লেগেছে, স্যার। আমি আপনার আর অরুণিকার বিয়ের ব্যাপারে কাউকে বলিনি। ক্লাসের কেউ জানেনা আপনারা ম্যারিড। আমারও কোনো সমস্যা নেই এতে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি আছি, স্যার। আপনি চাইলে আমরা একটা সম্পর্ক শুরু করতে পারি। আপনি আমাকে চিনলেন, জানলেন, এরপর না হয় আমাকে বিয়ে করবেন!”

আহনাফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “তুমি এখান থেকে যাও।”

“আমি আপনার আর আপনার মায়ের কথোপকথন শুনে ফেলেছি, স্যার। হয়তো অরুণিকার কাছ থেকে আপনি সেই ভালোবাসা পাচ্ছেন না। আমি আপনাকে সেই ভালোবাসা দেবো, স্যার।”

এই বলে যতি তার অধর জোড়া আহনাফের দিকে এগিয়ে আনলো। আর তখনই আহনাফ উঠে দাঁড়াতেই চেয়ারটা পেছনে পড়ে গেল। শব্দ শুনে চমকে উঠলো যতি। আহনাফ রাগী স্বরে বলল, “তুমি এতো অসভ্য মেয়ে এটা তো আমি জানতাম না? তোমার মতো মেয়েরা আমাদের ইউনিভার্সিটিতে পড়ে? এরকম মেয়ে থাকলে তো ক্লাসের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তোমাকে এই ভার্সিটি থেকেই বের করে দেবো।”

যতি ঠান্ডা হাসি দিয়ে বলল, “আপনি বলবেন আমি আপনাকে সিডিউস করতে চেয়েছি, আর এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে?”

“এটা আমার ইউনিভার্সিটি। এখানের ট্রাস্টি বোর্ড আমার বাপ-চাচা। আর তুমি আমাকে থ্রেড দিচ্ছো? তোমার মতো মেয়েদের মেরে গুম করে ফেললেও আমার কোনো সমস্যা হবে না।”

আহনাফের হাত মুষ্টিবদ্ধ। চোখ লাল হয়ে আছে। যতি তার হাত ধরে বলল, “আপনি নিজেকে আর কীভাবে কন্ট্রোল করবেন?”

আহনাফ চোখ-মুখ কুঁচকে সশব্দে যতির গালে চড় বসিয়ে দিল। যতি গালে হাত দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ আঙ্গুল তাক করে বলল, “তোমাকে আর এই ইউনিভার্সিটিতে আসতে হবে না। কাল তোমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক দিন হবে। জাস্ট ওয়েট।”

এই বলে আহনাফ বেরিয়ে পড়লো। যতি মুখে হাত দিয়ে বলল, “আমি কি করে ফেললাম! ভেবেছি স্যার কন্ট্রোল হারিয়ে আমার কাছে আসবেন, আর আমি সেই সুযোগে ভিডিও করে উনাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করবো। কিন্তু এখন তো দেখছি উনিই উলটো আমাকে শাসিয়ে গেলেন।”

যতি একপাশে ভিডিও অন করে রাখা ফোনটি হাতে নিয়ে ভিডিওটি ডিলিট করে ভাবতে লাগলো, “বাবা জানলে তো আমাকে খুন করে ফেলবে। কি করবো এখন আমি?”

পরদিন আহনাফ তার প্রতিটা বাক্য সত্য প্রমাণ করেছে। যতির বাবা-মাকে ডাকা হয়েছে। যতি ঘটনা অস্বীকার করলেও ট্রাস্টি বোর্ড আহনাফের কথায় বিশ্বাস করেছে। আর আহনাফের ব্যাপারে রিপোর্ট নিয়ে কেউ অশিষ্ট মন্তব্য করতে পারে নি। তাই যতিকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ গোপনীয়তার সাথে। পুরো ক্যাম্পাসে এই কথা ছড়ায় নি। তবে ইংরেজি বিভাগে পুরোপুরি ছড়িয়ে গেছে। ক্লাসের শিক্ষকরা ছেলে-মেয়েদের এই বিষয়ে কথা ছড়াতে বারণ করলেও ডিপার্টমেন্টে বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এই ঘটনা। আর এসব শুনে অরুণিকা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। যতির জন্য তার বেশ খারাপ লাগছে। তার মনে হচ্ছে দোষটা আহনাফের। কারণ আহনাফ তার সাথে অনেকবার বাজে আচরণ করেছিল। বাজেভাবে স্পর্শ করেছিল তাকে। যতিকেও হয়তো ঠিক সেভাবেই ফাঁসানো হয়েছে, যেভাবে তাকে ফাঁসিয়েছিল। মেয়েটাও তো আহনাফকে ভালোবাসে। ভালোবাসা দেখিয়েই তো আহনাফ মেয়েদের ফাঁদে ফেলে। অরুণিকার মনে আহনাফের প্রতি ঘৃণা আরো বাড়তে লাগলো। কিন্তু চুপ করে থাকা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।

(***)

ভার্সিটির কেন্টিনে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে অরুণিকা ও ইমান। ইমান বলল, “যতির কাহিনি শুনেছো?

অরুণিকা মাথা নাড়লো। ইমান বলল, “মেয়েটা আসলেই একটু ওরকম।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনাকে কে বলেছে?”

“মেয়েদের অঙ্গভঙ্গি দেখলে বোঝা যায়। ভালো ঘরের মেয়েদের চাল-চলনেই বোঝা যায় তার পারিবারিক শিক্ষা।”

“যতি কি তাহলে ভালো ছিল না?”

“না। একটু লুজ ক্যারেক্টরের ছিল। গায়ে পড়া স্বভাব আছে ওর। আহনাফ স্যার তো ভালো মানুষ। রেড মার্ক করে দিলে তো কোথাও ভর্তি হতে পার‍তো না।”

অরুণিকা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল, “আর ছেলেদের কীভাবে চেনা যায়?”

ইমান মুচকি হেসে অরুণিকার দিকে তাকালো। আর বলল,
“তুমি কাকে চিনতে চাও?”

“কাউকে না।”

ইমান হালকা হেসে বলল, “ভালো ছেলেরা অনেক প্রোটেক্টিভ হয়। অনর্থক কোনো মেয়ের সাথে কথা বলে না। যেমন আমি।”

অরুণিকা ইমানের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলো। ইমান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হাসছো কেন?”

“আপনি তো খালি খালিই বসে আছেন। কোনো প্রয়োজনীয় কথা তো বলছি না আমরা। আপসারাপ সময় নষ্ট করছেন। তাহলে আপনি তো ভালো না।”

ইমান হেসে বলল, “তুমি তো আমার বন্ধু।”

“বন্ধুর ব্যাপারে কি ভালো ছেলে চেনার আলাদা উপায় আছে?”

“হুম।”

“যেমন?”

“প্রোটেক্টিভ।”

“মানুষ তো শো অফও করতে পারে।”

ইমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা, বাদ দাও এসব। আগে বলো হিমালয়ের গল্প পড়তে পারছো এখন?”

অরুণিকা উৎসাহ নিয়ে বলল, “হ্যাঁ। আমার তো উনার সাথে চ্যাটও হয়।”

“যাহ! সত্যি?”

“হুম।”

ইমান হাসলো। অরুণিকা বলল, “আমাকে কবিতা লিখে পাঠায়। আমাকে বইও গিফট করেছে।”

ইমান তাকালো অরুণিকার দিকে৷ অরুণিকা ভাবুক কন্ঠে বলল, “মনে হয় সব আমার জন্য লেখা৷ আমার মনে জমানো সব কথা লিখে প্রকাশ করেন উনি। অনেক শান্তি লাগে মানুষটার সাথে কথা বলে। আমার সাথে বন্ধুত্বও করেছে। আমাদের তো প্রায়ই চ্যাট হয়। উনি অনেক ভালো।”

ইমান অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, একজন লেখক তোমার সাথে এতো কথা বলে!”

“হ্যাঁ সত্যি।”

“উনার ছবি পাঠিয়েছে? উনাকে তো কেউ দেখে নি।”

“না, পাঠায় নি। কখনো খুঁজিও নি।”

“ফ্রডও তো হতে পারে।”

“আপনি বলছেন ফ্রড?”

“হ্যাঁ।”

“আপনিই আমাকে সেই আইডি দিয়েছেন।”

“হ্যাঁ, আমার কাজিন ওই একাউন্ট থেকেই তো স্টোরি পড়ে।”

“তাহলে তো ফ্রড হতেই পারে না।”

ইমান রহস্যময় দৃষ্টিতে তাকালো অরুণিকার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, “এই কয়েকদিনে তুমি হয়তো অনেক বেশি হিমালয় ভক্ত হয়ে গেছো?”

অরুণিকা মৃদু হেসে বলল, “আগে তো ভক্ত ছিলাম। এখন তো বন্ধু।”

“বন্ধু হলে তো তোমাকে পরিচয় দেবেই। যদি পরিচয় দেয়, তখন কি করবে? বন্ধুত্ব থেকে কি অন্য কিছু হয়ে যাবে?”

অরুণিকা লাজুক হাসলো। ইমান সেই হাসির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু।

(***)

অরুণিকা বাসায় এসে ফোন নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। হিমালয়ের সাথে চ্যাট করা তার রোজাকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মানুষটা ধীরে ধীরে তার কাছে চমৎকার মানুষে রূপান্তর হচ্ছে, যেই মানুষটাকে নিয়ে কল্পনা করতে ভালো লাগে৷ কল্পনায় ভাবতে থাকে, কেমন হবে তার লেখক মানুষটা?

হিমালয়ের মেসেজ এসেছিল সেই সকালে। ভার্সিটিতে থাকায় মেসেজ দেখে নি সে৷ হিমালয় লিখেছে,
“আজকাল ভোরের সূর্য আমার কাছে ম্লান মনে হয়। পাখির কিচকিচ শব্দটা আমার কান অব্ধি আসে না। মনে হয় আশেপাশে অনেক নীরবতা।”

অরুণিকা লিখলো, “আমি এর কি সমাধান দেবো?”

“ভোর মানেই তো নতুনত্ব। ভোরে কলম নিয়ে লিখতে বসি আমি। অথচ এই কয়েকদিন লিখতে পারি নি। মনের সব দ্বার বন্ধ।”

“কেন?”

“আপনি ছিলেন না। ভোরে উঠতে পারেন নি।”

“রাতে কাজ থেকে ফিরে, টিউশন করে এসে পড়তে বসতে হয়। এরপর টায়ার্ড হয়ে যাই। ভোরে ঘুম ভাঙে না আর।”

“অনেক পরিশ্রম হয় আপনার!”

“হুম। তবুও ঠিক আছে। পরিশ্রম করেই তো স্বপ্ন পূরণ করা যায়।”

“কি স্বপ্ন আপনার?”

“নিজের পায়ে দাঁড়াবো। ভালো বেতনে চাকরি করবো। কারো উপর ডিপেন্ড হতে হবে না।”

“জগতের নিয়ম বিচিত্র। লাখ টাকা আয়ের পরও মানুষকে ডিপেন্ড হতে হয়।”

“যেমন?”

“আকাশের বিশালতা মেঘের চেয়েও বেশি। অথচ আকাশ পরিষ্কার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এসব শব্দই মানু্ষ উচ্চারণ করে। আকাশ কখনো একা হতে পারে না। মেঘের সাথেই আকাশের সম্পর্ক। মেঘহীনা আকাশের কোনো মূল্যই নেই। মেঘ আছে বলেই আকাশকে ব্যাখ্যা করা যায়। তেমনি মানুষকেও অন্য মানুষের উপর নির্ভর হতেই হয়৷ হোক সেই মানুষ কোনো জ্বলন্ত অগ্নি, কোনো হিংস্র সত্তা, হোক সে লাভা, ধরলেই ছাই হয়ে যাবে সব। কিন্তু নির্ভর তো হতেই হয়। যেমন চাঁদ সূর্যহীনা অচল।”

অরুণিকা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর বলল, “মাঝে মাঝে আপনার কথার গভীরতা আমি বুঝতে পারি না। তবুও আপনার কথাগুলো বেশ ভালো লাগে আমার।”

“আজকে গোধূলি আকাশটা দেখেছেন আপনি?”

অরুণিকা জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিচতলা থেকে আকাশ দেখা যায় না।”

“ছাদে উঠে দেখতে পারেন। অনেক সুন্দর আকাশটা।”

“না, আমি আর ছাদে উঠবো না। ছাদে উঠে অনেক খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।”

“কেমন অভিজ্ঞতা?”

“আমরা যেখানে আছি, এখানে একটা অসভ্য লোক থাকে। তার নজর বেশ খারাপ। আমার তো ভীষণ ভয় লাগে লোকটাকে। ইচ্ছে তো করে চোখ দু’টো কানা করে দেই।”

“তো করেন নি কেন?”

“কি যে বলেন আমার নামে কেইস হয়ে যাবে।”

“আপনি সত্য কথা বললে কেন কেইস হবে? আপনি বলবেন লোকটা আপনার দিকে বাজেভাবে তাকিয়েছে, তাই আমি তাকে অন্ধ করে দিয়েছি। যেই চোখে ভালোবাসা নেই, লালসা আছে, সেই চোখ না থাকায় ভালো।”

“এদের তো বেঁচে থাকারও কোনো অধিকার নেই।”

“আপনি চান সে মারা যাক?”

“না, কিন্তু আমার চোখের সামনে না আসুক। ঘেন্না লাগে লোকটাকে।”

“খুব অভিযোগ আপনার! লোকটাকে শায়েস্তা করবো একদিন।”

“আপনি?”

“হুম।”

“কীভাবে?”

“আপনি তার একটা ছবি পাঠিয়ে দিন। তারপর পরদিন আপনার ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাবে।”

অরুণিকা খুব উৎসাহ নিয়ে আহনাফের ছবি পাঠিয়ে দিল। হিমালয় লিখলো, “কি শাস্তি চান?”

“মুভিতে দেখায় না, হিরো এসে ভিলেনকে ইচ্ছেমতো মারে। এই লোকটাকেও কেউ ইচ্ছেমতো মারলে শান্তি পাবো আমি।”

“তবে তাই হোক। আপনাকে যে আঘাত করেছে, আঘাত পাওয়া তার প্রাপ্য।”

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৫ (২য় ভাগ)||

রুম অন্ধকার করে ফোন দেখছে অরুণিকা। মৃদু আলো ঘরে প্রবেশ করতেই সে পাশ ফিরে দেখলো রুহানি রুমে এসেছে। রুহানিকে দেখে সে সোজা হয়ে বসে বলল, “আয় না!”

রুহানি অরুণিকার মুখোমুখি এসে বসলো। অরুণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস?”

“হ্যাঁ, আমার কি হবে?”

“ইদানিং খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিস দেখছি। সকালে ভার্সিটি, এসেই দোকানে, এরপর টিউশনে, রাতে পড়িস, নয়তো ওই ষ্টুপিড হিমালয়ের সাথে চ্যাট করিস।”

অরুণিকা শব্দ করে হেসে উঠলো। রুহানি বলল, “হাসিস না। আমি খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।”

অরুণিকা রুহানির হাত ধরে বলল, “কি স্বপ্ন!”

“তোকে নিয়ে দেখেছি।”

অরুণিকা উৎসাহ নিয়ে বলল, “বল না!”

“খারাপ স্বপ্ন বলা উচিত না।”

“কি হবে বললে?”

“যদি সত্যি হয়ে যায়?”

“স্বপ্নে আমি মরে-টরে গেছি না-কি?”

“না।”

“তো?”

“বলে দেবো?”

“হ্যাঁ, বল।”

“যদি কিছু হয়ে যায়?”

“কিছু হবে না, ইনশাআল্লাহ।”

“দেখেছি, তুই খুব কান্না করছিস। তোর কান্নার শব্দে আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছিল। আকাশও কাঁদছিল।”

অরুণিকা হেসে বলল, “সিনেমা-টিনেমা দেখেছিস?”

“সেটা তো আমি প্রায়ই দেখি।”

“এজন্যই দেখেছিস এমন স্বপ্ন।”

রুহানি হুট করে অরুণিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হিমালয় যদি তোকে ঠকায়?”

অরুণিকা রুহানির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “তুই আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করিস?”

রুহানি সোজা হয়ে বসে বলল, “তুই অলরেডি একটা টক্সিক সম্পর্কে আছিস। সম্পর্কও না, বিয়ে! যেখান থেকে তুই চেয়েও বের হতে পারছিস না। আবার এখন তোর মনে হিমালয়ের প্রতি ভালো লাগা সৃষ্টি হচ্ছে। আমি হ্যাপি তোর জন্য। তুই মুভ অন করছিস, এটা ভালো কথা। কিন্তু টক্সিক সম্পর্কটা শেষ না করে মুভ অন করাটা কি ঠিক হচ্ছে? যদি হিমালয় জানে তুই ম্যারিড, তখন কি আর এভাবে যোগাযোগ করবে? সব জানার পর যদি তোর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, তুই আবার কষ্ট পাবি। আহনাফ স্যারকে ভালোবেসে যেভাবে কষ্ট পেয়েছিস, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবি। কারণ ওটা তোর চাইল্ডহুড ফ্যাসিনেশন ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা ট্রু।”

অরুণিকা অন্যদিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বলল, “জানিস রুহু, চাইল্ডহুড ফ্যাসিনেশন বল, আর যাই বল, হি ইজ মাই হাসবেন্ড। সেই সম্পর্কে আমি আমার বেস্টটা দিয়েছিলাম। আমার কেউ ছিল না ওই মানুষটা ছাড়া। বাবা-মাকে হারানোর পর আমার একমাত্র আশ্রয় ছিল ও। কিন্তু ও আমাকে ভালোই বাসে নি। দিনের পর দিন আঘাত করে গেছে। আমি ওর কাছ থেকে ভালোবাসা চেয়েছি, সুন্দর ব্যবহার চেয়েছি, ওই মানুষটা আমাকে বিনিময়ে আঘাত দিয়েছে, অপমান করেছে। হাজার চড় খেয়েও মেয়েরা সংসার করে, ও তো আমার চরিত্রে আঘাত করেছে। নষ্টা মেয়ের ট্যাগ দিয়েছে আমাকে। আমি জানি না, হিমালয়কে নিয়ে আমার ভালোলাগা কতোটুকু। কিন্তু যতোক্ষণ তার সাথে চ্যাট করি, আমার নিজেকে জীবন্ত মনে হয়। অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি, রুহু। একটুখানি ভালোবাসা কি ডিজার্ভ করি না আমি? আহনাফ বিকৃত চিন্তার মানুষ। বড় হতে হতে বুঝতে শিখেছি ওর কাছে ভালোবাসা মানে হয়তো ফিজিক্যাল এট্রেকশন। ও আমাকে বাজেভাবে টাচ করে। আমার সম্মতিও নেয় না। আমার মনে ওর প্রতি এতো অভিযোগ, ও একবারও সেই অভিযোগ ভাঙাতে আসে নি। উল্টো বাড়িয়ে দিয়েছে।”

রুহানি অরুণিকার গালে হাত রেখে বলল, “আগে নিজেকে শক্ত করে বল তো, হিমালয় সব জেনে যদি তোর সাথে দূরত্ব রাখে, তুই ভালো থাকবি?”

অরুণিকা চুপ করে রইলো। রুহানি বলল, “ভালোবাসা তোর মনের উপর নিয়ন্ত্রণ করার আগেই তাকে জানিয়ে দে তোর অতীত। কে কীভাবে কষ্ট পেলো, আমার কিছু যায় আসে না। তুই না পেলেই হলো।”

“যদি আমাকে সত্যিই ইগ্নোর করে!”

“কখনো না কখনো তো জানবে।”

“ডিভোর্সের পর জানালে ভালো হয় না?”

“আহনাফ স্যার তোকে এতো সহজে ছাড়বেন না। উনি প্রচুর ঘাড়ত্যাড়া।”

“হুম, আমি হিমালয়কে আমার অতীত বলবো। অবশ্যই বলবো। আমি আর কষ্ট পেতে চাই না। আমি তো একটু হলেও সুখ ডিজার্ভ করি, তাই না, বল!”

অরুণিকার চোখ ভিজে উঠলো। রুহানি জড়িয়ে ধরলো তাকে। বলল, “বিলিয়ন বিলিয়ন সুখ ডিজার্ভ করিস।”

(***)

অন্ধকার ফাঁকা রাস্তা। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ। আহনাফকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে চারজন আগন্তুক। আহনাফ তাদের সবাইকে একনজর দেখে নিলো। প্রথমজন এগিয়ে এসে আহনাফের গালে ঘুষি মারলো। আহনাফ কয়েক পা পিছিয়ে গেল। মাথা ঘুরে উঠলো তার। কিন্তু এখনো নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ হালকা ঝুঁকে হাঁটুতে দুই হাত রেখে হাপাচ্ছে। দ্বিতীয় ছেলেটা আহনাফকে পেছন থেকে খুব জোরে লাথি মারলো। আহনাফ মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে। পিঠ ভেঙে গেছে এমন অবস্থা। চোখ-মুখ কুঁচকে দু’হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর আগেই তৃতীয় জন আহনাফের পিঠে চড়ে তার চুল খামচে ধরে মাথাটা উপরে তুললো। আহনাফ চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে। তখনই চতুর্থজন আহনাফের মুখে লাথি মারলো। বুট জুতোর আঘাতে নাক বেয়ে গড়িয়ে পড়লো রক্ত। প্রথমজন এবার তার কোমড়ের বেল্ট খুললো। তৃতীয় জন আহনাফের উপর থেকে সরে যেতেই সেই আগন্তুক আহনাফের পিঠে একনাগাড়ে বেল্ট দিয়ে আঘাত করতে লাগলো। আহনাফ টু-শব্দও করলো না। দ্বিতীয় আগন্তুক আহনাফকে কলার ধরে উঠিয়ে সজোরে পেটে হাঁটু মারলো। আহনাফ পেট ধরে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে রাস্তায় বসে পড়লো। মিনিট খানিক চারজন আগন্তুক আহনাফের দিকে তাকিয়ে ছিল। আহনাফ ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই চারজনই ইচ্ছেমতো লাথি মারতে লাগলো তার পেটে, বুকে, মুখে। প্রায় তিন মিনিট পর তারা থামলো। আহনাফের ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। নাক ছিঁড়ে গেছে। গাল কেটে রক্ত পড়ছে। চোখ টনটন করছে। কপাল ফুলে গেছে। একটা দাঁতের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। বুক আর পেটে অসহ্য ব্যথা, পিঠে আঘাতের চিহ্ন। তবুও আহনাফের কোনো সাড়াশব্দ নেই। সেই চারজন আগন্তুক চলে গেল। আর আহনাফ মাটিতে শুয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঝাপসা দেখছে সব। তার চোখে কষ্টের ছাপ। ঠোঁটে ক্লান্ত হাসি। তার চোখ বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়লো। আহনাফ হাতে ভর দিয়ে উঠতে চেষ্টা করতে গিয়েও পারলো না। কাঁপা হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে আরাফের নম্বরে ডায়াল করলো সে।

এদিকে অরুণিকার নম্বরে মেসেজ এলো। অরুণিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো হিমালয়ের মেসেজ। সেখানে লেখা, “আপনাকে দেওয়া প্রতিটা আঘাতের শোধ উঠে গেছে, হৃদি। আপনি নিশ্চয় এবার খুশি হবেন।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। লিখলো, “আপনার কথা বুঝলাম না।”

হিমালয় মেসেজটা আর দেখলো না। অরুণিকা সারারাত অপেক্ষা করলো। পরদিন সারা সকাল অপেক্ষা করলো। দু’দিন অপেক্ষা করলো। এক সপ্তাহ অপেক্ষা করলো। কিন্তু হিমালয়ের কোনো সাড়া পেলো না। অস্থির অরুণিকা ফোন করলো হিমালয়ের ইন্সটাগ্রাম একাউন্টে। কিন্তু হিমালয় অনলাইনে নেই।

এক সপ্তাহ পর। অরুণিকা সন্ধ্যায় ছাদে উঠলো। ছাদে উঠেই আহনাফকে দেখে অবাক হলো সে। আহনাফের চোখ-মুখ ফোলা। গালে-ঠোঁটে সেলাইয়ের দাগ৷ আহনাফ রেলিঙে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছে। অরুণিকা আহনাফের সামনে এসে দাঁড়ালো। আহনাফ খেয়াল করে নি তাকে। চোখ খুলে অরুণিকাকে দেখে হাত থেকে সিগারেট ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেললো। অরুণিকা আহনাফের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েই থেমে গেল। হাত সরিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “তোমার এই অবস্থা কীভাবে হলো!”

আহনাফ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। অরুণিকা ব্যস্ত কন্ঠে বললো, “কি হলো, বলো?”

“তোর হঠাৎ আমার জন্য এতো চিন্তা!”

“ফালতু কথা না বলে বলো এসব কীভাবে হলো?”

“কিছু হয় নি।”

অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “বলবে?”

আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “কিছু লোক এসে আমাকে আপসারাপ মেরে গেল। আমি বাসায় ফিরছি ওমনি পথ আঁটকে মারা শুরু করলো।”

অরুণিকা এক পা পিছিয়ে গিয়ে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “ক’দিন আগে?”

“এই তো এক সপ্তাহ হচ্ছে।”

অরুণিকা গালে হাত দিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে পড়লো। আহনাফ অরুণিকার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করলো।

অরুণিকা বাসায় এসে তার ফোন হাতে নিলো। হিমালয়ের ইনবক্সে ঢুকলো। এখনো মানুষটা অনলাইনে আসে নি! অরুণিকা কাঁপা হাতে হিমালয়ের শেষ মেসেজটা ড্রাগ করে লিখলো, “আপনি কি আহনাফকে মারার জন্য লোক পাঠিয়ে ছিলেন?”

মেসেজ ডেলিভার হলো না। অরুণিকা ধপ করে বিছানায় বসে ফোনটা একপাশে রেখে মনে মনে বলল, “যদি এই কাজ হিমালয় করে থাকেন, তাহলে এটা উনি একদম ঠিক করেন নি। আমি তো এমনিতেই বলেছি। রাগ দেখিয়ে ওমন কথা বলেছি। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, হিমালয় সত্যিই এই কাজ করবেন। যদি উনি এই কাজ করে থাকেন তাহলে উনি আহনাফকে কীভাবে খুঁজে পেলেন? উনি কি আমার আশেপাশেই থাকেন?”

অরুণিকা মিনিট খানিক স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এরপর মিনমিনিয়ে বলল, “উনি তো আমাকে একবার বই গিফট করেছিলেন। আমার এড্রেস কীভাবে জানলেন সেটাও আমাকে বলেন নি। কে এই হিমালয়? আমি কি তাকে চিনি? কখনো কি দেখেছি?”

(***)

বড় চৌধুরী সাহেবের গ্রামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতি মিয়ার ছেলের বিয়ে৷ চৌধুরী সাহেব সপরিবারে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। মিসেস চৌধুরী কয়েক বার কল দিয়েছেন অরুণিকাকে। শেষমেশ অনিচ্ছাসত্ত্বে বাড়ি যাওয়ায় মন বসালো সে। তবে সে একা যাচ্ছে না। রুহানিও তার সাথে যাবে। আতকিয়া জাহান নিজেই রুহানিকে পাঠাচ্ছেন। মায়ের এমন সম্মতিতে রুহানি আকাশ থেকে পড়েছে। অরুণিকা রুহানি যাচ্ছে শুনে খুব উৎসাহ নিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে। আতকিয়া জাহান মনে মনে বেশ খুশি। আরাফকে তার বেশ ভালো লেগেছে। এই সুযোগে যদি আরাফের পরিবার রুহানিকে দেখে পছন্দ করে ফেলে, তবে তো ভালোই। আরাফ না হলেও তার আপত্তি নেই, কিন্তু চৌধুরী পরিবারের পক্ষ থেকে গেলে অন্তত একটা সম্বন্ধ তো আসবেই। তার মেয়ে কি দেখতে কম সুন্দরী না-কি!

বিকেলেই যাত্রা শুরু হলো তাদের। চৌধুরী পরিবার তাদের নিজস্ব গাড়ি নিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু অরুণিকা রুহানিকে নিয়ে বাসে যাবে। এদিকে অরুণিকা বাসে যাচ্ছে তাই আরাফ, আহনাফ, তাহমিদ ও তূর্য বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ইমন অফিস থেকে ছুটি পায় নি। ইভান একটু অসামাজিক তাই গ্রামের প্রতিবেশি চাচার বিয়ের জন্য ক্যাম্পাস থেকে ছুটি নেওয়া যৌক্তিক মনে করে নি। যদিও তারা গ্রামের প্রতিবেশী হলেও তাদের বাবা-মার সাথে মতি মিয়ার পরিবারের বেশ ভালোই সম্পর্ক। এদিকে তূর্যেরও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কারণটা সবারই জানা। তার অতীত। কিন্তু তাহমিদ আর আরাফ জোর করে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। খুব জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে বলেই বাসে উঠিয়েছে। তবে তূর্য বিয়ে পর্যন্ত থাকবে না। আরাফ ও তাহমিদের জরুরি আলোচনা শেষ হলেই শহরে চলে আসবে।

(***)

মধ্যাহ্নের মিষ্টি বাতাবরণ। বাস এখনো স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। রুহানি ও অরুণিকা ব্যাগ তুলে দিয়ে বাসে উঠে বসলো। অরুণিকা সিটে হেলান দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর এই প্রথম বাড়ি যাচ্ছে। পুরোনো স্মৃতির পুনরাগমন ঘটবে। চাপা কষ্টে বুক ভার হয়ে আছে তার। কিন্তু দম ফেলার সুযোগটাও হলো না। আহনাফ উঠে রুহানিকে বলল, “তুমি অন্য সিটে গিয়ে বসো।”

অরুণিকা আহনাফের কন্ঠ শুনে পাশ ফিরে তাকালো। আহনাফকে দেখে রীতিমতো ধাক্কা খেলো সে। চেঁচিয়ে বলল, “তুমি!”

জোরে শব্দ হওয়ায় আশেপাশের মানুষ তাদের দিকে তাকালো। আহনাফ চোখ ছোট করে বলল, “এটা আমি না, তোমার বর।”

রুহানির দিকে এবার চোখ গরম করে তাকালো আহনাফ। রুহানি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “আমি কি যাবো না!”

আরাফ রুহানির মুখের দিকে তাকিয়ে একটা সিট দেখিয়ে বলল, “তুমি এই পাশে বসো।”

রুহানি সেই সিটে বসতেই, আহনাফ অরুণিকার পাশে বসে পড়লো। আহনাফ জানালা দেখিয়ে বলল, “বউ, আমাকে একটু জানালার পাশে বসতে দেখে?”

আহনাফের কন্ঠে বউ ডাক শুনে অরুণিকার বুকটা ধক করে উঠলো। সে আঁড়চোখে আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। অরুণিকা বিরক্ত হয়ে বলল, “ইচ্ছে হলে অন্য সিটে গিয়ে বসো। আমি তোমার জন্য জানালা ছাড়বো না।”

আহনাফ মাথা নেড়ে বলল, “যা হুকুম আপনার।”

অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো আহনাফের দিকে। মনে মনে বলল, “হঠাৎ এতো মধু ঝরছে? না, না, এই অসভ্যটা বিশ্বাস করা যাবে না। এর মুখে মধু, অন্তরে বিষ।”

আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুণিকার দিকে। অরুণিকা বেশ বিরক্ত হচ্ছে। আহনাফ অরুণিকার দিকে হালকা ঝুঁকে বলল, “হারাতে চাই না, তবুও হারাই তোমার চোখে।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকালো। আহনাফ বুকে হাত দিয়ে ফোঁস করে উঠলো আর বলল, “ইশ! ধারালো চোখ দু’টি আমাকে ঘায়েল করলো।”

অরুণিকা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “মশকরা করছো আমার সাথে?”

“না। তোমাকে ব্যাখ্যা করছি।”

“তোমার উদ্ভট ব্যাখ্যা শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই।”

“আচ্ছা!”

আহনাফ চোখ সরিয়ে মলিন হাসলো। তার কাঁপা হাতটি অরুণিকার হাত স্পর্শ করলো। অরুণিকা ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহনাফ নরম কন্ঠে বলল, “তুই তো আমার বউ, একটু হাতটা ধরি। তোর হাত ধরলে শান্তি লাগে।”

অরুণিকা এই আবদার ফেলতে পারলো। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার। আহনাফের হাত কাঁপছে। অরুণিকা জানালার বাইরে তাকালো। চোখ ভিজে উঠলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আহনাফ অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে সে অরুণিকার কাঁধে মাথা রাখলো। অরুণিকা শক্ত কন্ঠে বলল, “পাব্লিক প্লেসে এমন করো না।”

“কি হবে আর! তুই তো আমার বউ। পাব্লিক বুঝি না আমি। আমার সামনে তুই থাকলে আশপাশ ঝাপসা হয়ে আসে৷ মনে হয় শুধু আমি আর তুই।”

আহনাফের গালে এখনো কাটা দাগ। অরুণিকা সেই দাগের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বলল, “সরি।”

“সরি কেন?”

“আমার কারণে যদি কখনো আঘাত পেয়ে থাকো। আমি কাউকে আঘাত করতে চাই নি। কিন্তু মানুষ আমাকে খুব সহজে আঘাত করে চলে যায়।”

পেছনের সিটে রুহানি আর আরাফ পাশাপাশি বসে আছে। বাস দ্রুত বেগে চলছে। বাসের জানালা খোলা। রুহানির চুলগুলো উন্মাদ হাওয়ায় উড়ছে। আরাফের চোখে-মুখে বেশ কয়েকবার ধাক্কা খেয়েছিল। তবে আরাফ চোখ বন্ধ করে আছে। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। রুহানি চুল সরিয়ে আরাফের দিকে আঁড়চোখে তাকালো। অদ্ভুত ভালো লাগা মনে ভীড় করলো তার। এতোদিন সিনেমায় দেখেছে বাতাসে চুল উড়ে নায়কের মুখের উপর পড়ে। এবার তো বাস্তবে হচ্ছে। রুহানি মনে মনে বলল, “এই নায়কটা কিন্তু অন্যরকম। আমার বেশ ভালো লেগেছে। জেন্টেলম্যান।”

এদিকে তাহমিদ ও তূর্যের মুখে গম্ভীরতা ছেয়ে আছে। অনেক বছর পর তারা রাজা গ্রামে যাচ্ছে। ফেলে আসা হাসি, কান্নার মুখোমুখি হবে তারা। তাহমিদ চোখ বন্ধ করলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি চিরচেনা মুখ। কানে ভেসে এলো একটি মিষ্টি সুধার ডাক।

“ও মিষ্টিমশাই, আমার ইদ সালামি দিবা না? এক কাজ করো, দিঘিতে নৌকা বানায় ভাসাই দাও। আমি তুলে নিবো।”

তূর্য জানালার বাইরে তাকালো। তার চোখের সামনে একটি মেয়ের ছলনার দৃশ্য। হাত মুঠো করলো তূর্য। মনে মনে বলল, “তুমি অন্তত আমার সামনে এসো না। নয়তো আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারবো না, উপমা।”

বাস চলছে। মাতাল হাওয়া দখল করে নিচ্ছে বাসের শূন্যস্থান। প্রতিটি সিটে ভিন্ন ভিন্ন গল্প সাজানো। কোনো গল্পের স্বাদ মিষ্টি, কোনোটা তিক্ত। আবার কোনটা হতাশার, কোনটা ঘৃণার।

চলবে-

#উইন্টার_এন্ড_মাই_সনেট
#লেখা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
|| পর্ব-৩৬||

বাস থেকে নামলো অরুণিকা ও রুহানি। অরুণিকার হাতে ডাফেল ব্যাগ। রুহানির কাঁধে ব্যাকপ্যাক। আহনাফ, আরাফ, তূর্য ও তাহমিদও নেমে পড়ল বাস থেকে। তাদের হাতে ছোট ছোট ডাফেল ব্যাগ। তূর্য ও তাহমিদ বাস থেকে নেমেই আশেপাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এরপর দু’জন দৃষ্টি মিলালো মুহূর্তের জন্য। তূর্য শুকনো হাসল তাহমিদের দিকে তাকিয়ে। তাহমিদের মুখখানা নিষ্প্রভ লাগছে। তূর্য অপরাধীর ন্যায় চোখ সরিয়ে নিল। এদিকে রুহানি নীরব বিষ্ময়ে চারপাশ দেখছে। সামনে বড় ইটের রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে বাঁশঝাড়। কয়েক পা এগুতেই বড় পুকুর। পুকুরের পাশেই মসজিদ। এখন মাগরিবের আযান দিচ্ছে। বড়বুজুর্গ স্থির সলিলে অযু করতে ব্যস্ত। রুহানি তাদের দেখে মাথায় কাপড় টেনে নিল। আরাফ রুহানি ও অরুণিকার পিছু পিছু হাঁটছিল। আকস্মিক রুহানি মাথার কাপড় টানায় চোখ তুলে তাকাল সে। রুহানি পাশ ফিরে দেখল অরুণিকার ওড়না গলায় ঝুলছে। রুহানি কাঁধ দিয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই অরুণিকা রুহানির দিকে তাকাল। রুহানি চোখের ইশারায় বলল, মাথার কাপড় টেনে দিতে। অরুণিকা কিঞ্চিৎ ভ্রূ কুঁচকে কাপড় টেনে চুল ঢেকে নিল। আরাফ এখনো রুহানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ শান্ত। ঠোঁটে হঠাৎ ফুটে উঠল ঈষৎ হাসি। তবে গম্ভীর মুখখানায় এই হাসি দেখলে কেউ বুঝবে না, হাসির উৎস কি। মন ভালো থাকলে সবার মুখে সাধারণত এইটুকু হাসি লেগেই থাকে। যা খালি চোখে বোঝা যায় না৷ কিন্তু আরাফের গম্ভীরমুখে হাসির লেশমাত্র দেখা পাওয়া ভার। তাকে দেখলেই মনে হবে সারাদিনই তার মেজাজ চটে থাকে। তবে এই গোধূলী লগ্নে আরাফের ঠোঁটে ফুটে উঠা মুগ্ধতার হাসি চমৎকার আবেশ সৃষ্টি করেছে।

তারা হেঁটে খানিকটা পথ অতিক্রম করলো। এরপর মোটর রিকশা নিলো তিনটা। অরুণিকা ও রুহানিকে একা পাঠানো যাবে না। তাই আহনাফ অরুণিকার পাশে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অরুণিকা তা বুঝতে পেরে দ্রুত তূর্যের পাশে বসে পড়লো। এদিকে আহনাফ রিকশায় উঠে শুকনো হাসি দিল। আর তূর্য আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইলো। অরুণিকা মাথা নামিয়ে রেখেছে। সে কারো মুখশ্রী দেখে মন ভার করতে চায় না। সে জানে আহনাফের মুখের বারোটা বেজে গেছে। কিন্তু বাজা তো উচিত বারোটা। গত পাঁচ বছরের দেওয়া আঘাত এতো সহজে ক্ষমা করবে কেন সে? এদিকে তাহমিদ উঠে বসলো আহনাফের পাশে। আর আরাফের দিকে তাকিয়ে মোটর রিকশার সিটে দু’বার হাত ছুঁইয়ে রুহানি নীরব আহ্বান জানালো আরাফকে। আরাফ তাকিয়ে আছে তার দিকে। রুহানির ঠোঁটে স্মিত হাসি।

আরাফ উঠে বসলো। রুহানি ঠোঁটের ভেতরের দিকটা আলতো কামড়ে ধরলো, আর তোর চোখে-মুখে মিশে গেল লাজুক হাসি। প্রথম কোনো পুরুষের পাশে বসেছে সে৷ তাও আবার রিকশায়। এর আগে আরাফের মোটর সাইকেলে উঠেছিল সে। তবে সেদিনের চেয়ে আজকের এই অনুভূতিটা সম্পূর্ণ নবীন ও ভিন্ন।

মোটর রিকশা দ্রুত চলছে। সন্ধ্যার গ্রাম অদ্ভুত সুন্দর। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। রুহানির কৌতুহলী দৃষ্টি আশপাশ দেখছে। আর আরাফ রুহানিকে অবলোকনে ব্যস্ত।

তিন তিনটে রিকশা সাঁইসাঁই করে শকুন্তলা দিঘি পার করে চলে গেল। তাহমিদের দৃষ্টি সেই দিঘির স্থির জলের দিকে সেকেন্ড খানিকের জন্য আঁটকালো। তূর্যও সেই মুহূর্তে পাশ ফিরে তাকালো। অরুণিকা তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি সত্যিই উপমা আপুকে ভালোবাসতে?”

তূর্য অরুণিকার প্রশ্নে চমকে উঠলো। অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বলল, “আমার মনে হয় রুদবা তোমাকে পছন্দ করে। কিন্তু আমি চাই না তুমি যেভাবে উপমা আপুকে ঠকিয়েছো, ঠিক সেভাবে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকেও ঠকাও। ও অনেক শক্ত মনের মেয়ে। আমার চেয়ে বেশি ম্যাচিউওর। কিন্তু কখনো কোনো ছেলের প্রতি এতো ওবসেসড দেখি নি। মেয়েরা হয়তো প্রেমে পড়লে জগতের সবচেয়ে দুর্বল প্রাণি হয়ে যায়।”

তূর্য অরুণিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওকে আমার সম্পর্কে বলো নি?”

“সরি টু সে, কিন্তু আমি বলেছি তুমি প্লে বয়।”

তূর্য শব্দ করে হাসলো। অরুণিকা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালো তূর্যের দিকে। তূর্য অরুণিকাকে কাঁধ দিয়ে হালকা ধাক্কা মেরে বলল, “টুইংকেল, আমি কার সাথে প্লে করেছি?”

“করোই তো। সব মেয়েদের সাথেই ফ্লার্ট করো। তুমি রকস্টার, এজন্য মেয়েরা তোমার উপর ক্রাশ খেয়ে বসে থাকে। আর তুমি ওদের সময় দাও। এর কিছুদিন পর ছ্যাকা দিয়ে চলে আসো। এটা কিন্তু ভালো না। ভালো মেয়েরা এমন ছেলে পছন্দ করে না।”

“তোমার বান্ধবী কি তাহলে খারাপ?”

“না, ওতো ভালো। কিন্তু ওতো জানে না তুমি একটা রেড ফ্ল্যাগ।”

তূর্য আবার হাসলো। অরুণিকা হতাশ কন্ঠে বললো, “রুদবাকে কষ্ট দিও না। তুমি যদি ওকে ভালো না বাসো, তাহলে এভয়েড করো। ভালোবাসতে পারলে ওর সাথে মুভ অন করো। ও কিন্তু অনেক ভালো। তবে আমার উপমা আপুকে বেশি ভালো লাগতো। তুমি উনাকে কেন ঠকালে? তুমি আমার জন্য এতোকিছু করেছো। আমার এতো খেয়াল রাখো। আমার কাছে তোমরা সুপার হিরো ছিলে। আমি তোমাদের কাছে নিজেকে কখনো আনসেইফ ভাবি নি। অথচ তুমি এমন একটা কাজ করলে!”

তূর্য অরুণিকার হাত নিজের হাতের তালুতে আবদ্ধ করে বলল, “তুমি আমার আর উপমার বিষয়টা বুঝবে না, টুইংকেল। তাই কিছু জিজ্ঞেস করো না। যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে চেঞ্জ করতে পারবে না। অভ্যাসের কোনো পরিবর্তন সম্ভব না। তবে তোমার জন্য আমি সবসময় গ্রিন ফ্ল্যাগ থাকবো। তোমার আমার বন্ধুত্ব এভারগ্রিন। আচ্ছা, একটা রিকুয়েষ্ট করবো তোমাকে?”

“হুম, করো।”

“তবে এর আগে সরি বলে নিচ্ছি। পাঁচ বছর আগে যা হয়েছিল, তার জন্য তোমার পক্ষ নিতে পারি নি। তোমাকে বিশ্বাস করি নি। জানতাম না, সব আহনাফের প্ল্যান ছিল। কিন্তু ও যেমনই হোক, তোমাকে প্রচুর ভালোবাসে। তুমি সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দাও।”

অরুণিকা চুপ করে রইল। তূর্য বলল, “তুমি যদি আবরারকে ধাক্কা না দিয়ে থাকো, তাহলে সত্যটা বলো। কি হয়েছিল সেদিন!”

“আমি আহনাফকে তখন বলেছি। ও আমাকে বিশ্বাস করে নি। আমাকে উলটো ঠকিয়েছে।”

“আমাকে বলো।”

“তুমি সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করতে পারবে না। আমার কথা বিশ্বাসও বা কেন করবে?”

“একবার বলেই দেখো, তোমার রকস্টার তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। তোমাকে বিশ্বাস করে।”

অরুণিকা তূর্যের দিকে তাকালো। এরপর মোটর রিকশা চালকের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। তূর্য কান এগিয়ে দিয়ে বলল, “কানে কানে বলো!”

অরুণিকা তূর্যের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো তার বুকে জমিয়ে রাখা কথাটা। তূর্যের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো। সে সোজা হয়ে বসে অরুণিকার হাত ছেড়ে দিল। অরুণিকা তা দেখে মলিন হেসে বলল, “জানতাম। তাই তো কাউকে বলতে চাই না। ভিলেন হয়ে আছি। আরো ভিলেন হয়ে যাবো।”

তূর্য বলল, “তোমার হয়তো ভুল হচ্ছে। বিশ্বাস করার মতোও কিছু বলো নি তুমি। তবে আমি মাথায় রাখছি। যার কথা বলছো, আমি তাকে কখনো সন্দেহ করি নি। তবে তোমাকে অবিশ্বাসও করবো না। আমি উনাকে কখনো ওভাবে লক্ষ্য করি নি। এখন থেকে আমি বিষয়টা দেখবো ভালোভাবে। তোমার কথার সাথে আমি যদি উনার আচরণে একটুও সন্দেহ খুঁজে পাই, আই প্রমিজ আমি উনাকে এক্সপোজ করবো। যদি এটা সত্য হয়, তাহলে তোমার আর আহনাফের সম্পর্কের সাথে অনেক অন্যায় হয়েছে। আমি তোমাদের আলাদা দেখতে চাই না৷ আহনাফ কিন্তু তোমাকে অনেক ভালোবাসে।”

অরুণিকার বুকটা ধক করে উঠলো তূর্যের শেষ বাক্যে৷ কেন সে নিজেও জানে না।

(***)

বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই নেমে পড়লো তারা। অরুণিকা ধীর পায়ে হেঁটে যেতে লাগলো বাড়ির দিকে। সরু ইটের পথ। একপাশে পুকুর। পুকুরে জমে আছে কচুরিপানা। কয়েক বাড়ি পেরুতেই তার দাদার বাড়ি। রাজা গ্রামের পুরোনো ধাঁচের সেই চৌধুরী বাড়ি। রুহানি হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সেই বাড়িটির দিকে। পুরোনো জমিদার বাড়ির প্রতিচ্ছবি দেখছে সে। উঠোনের একপাশে ঝুলছে অরুণিকার জন্য বেঁধে দেওয়া দোলনা। অনেক বছর আগে আহনাফ, আরাফ ও তাহমিদ মিলে সেই দোলনা বেঁধেছিল। অরুণিকা সেই দোলনায় হাত রাখলো। ধুলো জমে আছে। কতো বছর এই দোলনায় প্রাণ নেই।

আহনাফ উঠে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লো। বাইরে চৌধুরী সাহেব ও তার বাবার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে বড়রা তাদের আগেই চলে এসেছে। দরজা খুললেন মিসেস তাওসিফ। অরুণিকাকে দেখে মৃদু হাসলেন। কিন্তু পাশে রুহানিকে দেখে মুখ কুঁচকে ফেললেন। বললেন, “ওকেও নিয়ে এসেছো!”

রুহানির অপমানে মুখ লাল হয়ে এলো। সে অরুণিকার হাত ধরলো শক্ত করে। আরাফ তা খেয়াল করলো। কিন্তু কিছু বললো না। রুহানিকে অপছন্দ করার শক্তপোক্ত একটা কারণ আছে, যা হয়তো রুহানি নিজেও জানে না। রুহানির ধারণা সে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, আর চৌধুরীরা বেশ নামি-দামি পরিবার, তাই হয়তো তাকে অপছন্দ করে। কিন্তু এর পেছনে যে অনেক বড় একটা কারণ আছে, তা আদৌ রুহানি জানতে পারবে কি-না সন্দেহ।

আহনাফ ব্যাগপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। শিরিন সুলতানা অরুণিকাকে দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললেন। অরুণিকা নিজেও বেশ বিরক্ত হলো। বাড়ির সবাইকে সালাম করলেও শিরিন সুলতানাকে করলো না৷ আহনাফের ভীষণ খারাপ লাগলো এই ব্যবহার। সে ব্যাগ রেখে এসে অরুণিকার হাত ধরে তাকে রুমে নিয়ে গেল। অরুণিকা অবাক হয়ে আহনাফকে জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে এভাবে টেনে আনলে কেন?”

“এটা আমাদের রুম। ভুলে গেছিস!”

“এটা তোমার রুম।”

“এখন থেকে তোরও।”

“আহনাফ, প্লিজ।”

“রুহানি তোর রুমে থাকবে।”

“আমি রুহানির সাথে থাকতে পারবো।”

“আমি কিন্তু তোর হাসবেন্ড। আর আমি আগেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি বাড়িতে আমরা একসাথে থাকবো।”

অরুণিকা রাগ দেখিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। আহনাফ দরজা আটকে অরুণিকার পাশে বসলো। অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। আহনাফ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল, “তুই থাকবি, তাই রুমটা আরেকটু ভালোভাবে পরিষ্কার করতে বলেছি। ভালো লাগছে না? বিয়ের পর আমরা এক ঘরে আজ প্রথম থাকবো।”

অরুণিকা তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আহনাফ বলল, “কাউকে অভিযোগ করে লাভ নেই। দাদি নিজেই বুয়াকে বলে আমাদের ঘর পরিষ্কার করিয়েছেন। দেখ, বালিশ দুইটা দিয়েছে। তবে আজ তুই আমার বুকের উপর ঘুমাবি।”

অরুণিকা আহনাফের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে বসে বলল, “তুমি আমাকে ক্যারেক্টরলেস বানিয়ে নিজেই আমাকে রুমে নিয়ে এসেছো?”

“সত্যটা আমি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। পাঁচ বছর আগে আমি যা করেছি, সেটা যে তোর উপর রাগ করে করেছি, সেটা সবাই জানে এখন। বাড়িতে আসার আগেই আমি সব সত্য বলে এসেছি। তোকে আর কেউ খারাপ বলবে না, অরু।”

অরুণিকা নির্বাক তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। আহনাফ অরুণিকার কাছে আসতেই অরুণিকা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি সত্যিই বলেছো? তুমি সবাইকে বলেছো সেদিন সব তুমি করেছিলে? সবাই কি জানে আমি নোংরা মানসিকতার মেয়ে না!”

“হ্যাঁ জানে।”

অরুণিকা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠলো। আহনাফ অরুণিকাকে কাছে টেনে নিলো। অরুণিকা আহনাফের বাহু খামচে ধরে বলল, “আহনাফ, তুমি আমাকে মুক্তি দিয়েছো এই বোঝা থেকে। আমি এই অপবাদের ভার নিতেই পারছিলাম না। কাউকে মুখ দেখাতেই লজ্জা করতো আমার। তূর্য আজ রিক্সায় বলেছিল ও সব জানে। আমি ভেবেছি শুধু ওরা জানে। বাড়ির সবাই জানে এটা জানতাম না।”

আহনাফ মৃদু হেসে অরুণিকা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অরুণিকা আহনাফকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। এরপর ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “কিন্তু তুমি আমার সাথে যা করেছো, এরপর তোমাকে আমি কীভাবে ক্ষমা করবো?”

“তুই সময় নে। চিন্তা করিস না। আমি তোর কাছে কোনো বাড়তি আবদার করবো না। শুধু এই কয়েকদিন আমার পাশে থাকিস। আমি তোকে ভালোবাসি, অরু। তুই পাশে থাকলে শান্তি লাগে আমার।”

অরুণিকা আহনাফের দিকে তাকিয়ে রইল স্থির দৃষ্টিতে। আহনাফ বলল, “শুধু একটা রিকুয়েষ্ট, তুই মা’কে কষ্ট দিস না। মায়ের সাথে সুন্দর করে কথা বলিস।”

অরুণিকা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহনাফের অনুরোধ রাখার কোনো ইচ্ছেই তার নেই। মিসেস শিরিন সুলতানাকে সে কখনোই ক্ষমা করবে না।

(***)

ছাদে শীতল পাটি বিছিয়ে সবাই বসে আছে। রুহানি ফিসফিস করে বলল, “তুই আহনাফ স্যারের সাথে এক রুমে থাকছিস!”

অরুণিকা ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম।”

রুহানি এক গাল হেসে বলল, “হাউ রোমান্টিক! তোদের বাসর হবে না-কি?”

অরুণিকা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “কচুর রোমান্টিক। ভয় লাগছে আমার।”

“কেন?”

“এতো সহজে সব ঠিক হয়ে গেল? আহনাফ এখনো মনে করে আমি ওর ভাইকে মেরেছি, তাহলে আমাকে এতো সহজে ক্ষমা করে দিল কেন?”

“হয়তো উনি সব নতুন করে শুরু করতে চান!”

“জানি না।”

অরুণিকা অন্যমনস্ক হয়ে পড়তেই রুহানি বলল, “তুই যদি আহনাফ স্যারের সাথে সব শুরু করিস, তাহলে হিমালয়?”

অরুণিকা চমকে তাকালো রুহানির দিকে। রুহানি বলল, “তুই হিমালয়কে বলতে পারলি না আহনাফ স্যারের কথা, অন্তত আহনাফ স্যারকে হিমালয়ের ব্যাপারে জানা। আর তুই নিজেও খুব কনফিউজড। হিমালয় তোর জন্য আহনাফ স্যারকে মারলো, আর তুই তার সাথেই কথা বলছিস না।”

“হ্যাঁ, কারণ আমি এমন কিছু আশা করি নি। আমি জাস্ট অভিমানটা শেয়ার করলাম তাকে। সে সত্যিই এমন করবে? আহনাফের কিছু হয়ে গেলে!”

“ভাই, আহনাফ স্যার না-কি হিমালয়, তুই আসলে কার, সেটা তুই নিজে শিউর হয়ে আমাকে বলিস।”

রুহানির কথায় মুখ ভার করে ফেললো অরুণিকা। এবার চোখ তুলে আহনাফের দিকে তাকালো সে। আহনাফ তার প্রথম ভালোবাসা। তার বর। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই এই মানুষটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে গেছে সে। কিন্তু তাকে মায়ায় বেঁধেছে হিমালয়। একজন তার অভ্যাস, আরেকজন মায়া। মায়া সৃষ্টি হয় ব্যবহার থেকে, একে অপরের প্রতি সম্মান থেকে। আহনাফ তাকে সম্মান দেয় নি, অথচ হিমালয় নামক মানুষটা তাকে সম্মান দিয়েছে। অন্যদিকে আহনাফকে সে ইদানিং অনুভব করতে পারে না, কিন্তু হিমালয়ের সাথে কথা বলে বেশ শান্তি পায় সে৷ তবে আজ আহনাফের ব্যবহার দেখে সে পুরোপুরি দ্বিধায় পড়ে গেছে। আবার যদি মানুষটা তাকে ঠকায়? তখন তৃতীয় বার ঠকবে সে। এবার ঠকলে হয়তো পুরোপুরি মৃত্যু ঘটবে তার মনের। না, অরুণিকার কোনো ইচ্ছে নেই আবার ঠকে যাওয়ার৷ সে নিজেকে শক্ত রাখবে। কারো মায়া-টায়ায় পড়বে না সে। অরুণিকা হাত মুঠো করে বলল, “ক্যারিয়ারকে বিয়ে করবো। বই খাতার সাথে প্রেম করবো। বেডা মানুষ আউট।”

রুহানি ভ্রূ কুঁচকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকা এক গাল হেসে বলল, “দুইটা বই নিয়ে এসেছি। এখানে বসে সিলেবাস শেষ করবো। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার নিনজা টেকনিক।”

রুহানি বলল, “অল দা বেস্ট, ব্রো।”

(***)

ভোরে হতেই ঘুম ভেঙে গেল অরুণিকার। হাত-মুখ ধুয়ে নামাজ পড়ে পুকুর ঘাটে এসে বসলো সে। এতোদিন হিমালয়কে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়তো সে। এখন ভোরে উঠা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কাল রুহানির সাথেই ঘুমিয়েছিল অরুণিকা। আহনাফ এসে কয়েকবার ডাকার পরও সে যায় নি। এমন ভান ধরেছে যে কয়েক বছরেও ঘুম ভাঙবে না তার। রুহানিও বারবার বলছিল, তার একা ঘুমাতে ভয় লাগবে। তাই অন্তত প্রথমদিন অরুণিকা যাতে তার সাথে থাকে। আহনাফকেও তাই হতাশ হয়ে ফিরতে হলো।

হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো আহনাফ দাঁড়িয়ে আছে। অরুণিকা চোখ কচলে তাকালো। আহনাফ তার পাশে এসে বসলো। তার মাথায় সাদা টুপি। অরুণিকা বলল, “তুমি ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছিলে?”

“হ্যাঁ, আরাফ টেনে উঠিয়েছে। কাল তুমি ছিলে না আমার সাথে। আরাফই তোমার জায়গা নিয়ে ফেলেছিল।”

“বাহ! তুমি তো আগে নামাজ পড়তে না।”

“হ্যাঁ, এই কয়েকদিন তাহমিদ আর আরাফ টেনেটুনে নিয়ে যাচ্ছে।”

“ভালোই তো। এজন্যই হয়তো তোমার ভেতরের শয়তানটা পালাচ্ছে!”

আহনাফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”

“এই যে কাল সুন্দর করে কথা বললে।”

আহনাফ অরুণিকার কথায় স্মিত হাসলো। তারা দু’জন বেশ খানিকক্ষণ নীরবে বসে রইল পুকুর ঘাটে। সূর্য উঠতেই দু’জনে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখল। তবে আহনাফ সূর্যোদয় দেখতে আগ্রহী নয়, সে অরুণিকার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। অরুণিকা পাশ ফিরে তাকাতেই আহনাফ ভুবন ভোলানো হাসি দিল। অরুণিকার কেন যেন মায়া হলো মুখটা দেখে। গালের কাঁটা দাগটাতে আলতো হাত রেখে বলল, “কে মেরেছিল তোমাকে, কিছু জানো?”

আহনাফ চোখ সরিয়ে নিল। হালকা হেসে বলল, “যেই মারুক, তোকে তো আমার করে দিয়ে গেছে।”

“কি!”

“এই যে আমাকে মেরেছে দেখে তোর কপালে চিন্তার রেখা। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম।”

অরুণিকা অপরাধীর ন্যায় চোখ সরিয়ে নিলো। আহনাফ অরুণিকার হাত ধরলো আলতো করে। অরুণিকা চোখ বন্ধ করে বলল, “আমিই তোমাকে মার খাইয়েছি।”

আহনাফ চমকে তাকালো অরুণিকার দিকে। অরুণিকাও আহনাফের দিকে তাকাল। বলল, “আমি একজনকে বলেছি তোমাকে যাতে উচিত শিক্ষা দেয়। সরি, আহনাফ। কথাটা সে সিরিয়াসলি নিয়ে তোমাকে এভাবে মারবে, সেটা আমি আশা করি নি।”

আহনাফ অরুণিকার গালে হাত দিয়ে বলল, “ইটস ওকে।”

এদিকে আরাফ ও তাহমিদ দূর থেকে আহনাফ ও অরুণিকাকে দেখে হাইফাইভ দিয়ে বলল, “মিশন কমপ্লিট।”

আরাফ বলল, “তূর্য ঘুম থেকে উঠলে ওকে আহনাফের ব্যাপারে সব বলবো।”

“হ্যাঁ, আর আহনাফের রুকাইয়া তো চলছে। দেখে মনে হচ্ছে কাজ হচ্ছে।”

“জানি না। ড্রাগসও তো বন্ধ আপতত। কাল সারাদিন ওকে একা ছাড়ি নি। আজও খেতে পারে নি। সিগারেটও কিনতে দেই নি। দেখিস, ওই ভূত তো নামতে বাধ্য হবে৷”

(***)

আহনাফ অরুণিকার হাত ধরে বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকতেই শিরিন সুলতানা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকালেন। অরুণিকা তাকে দেখে সোজা রুমে চলে গেল। শিরিন সুলতানা আহনাফকে বললেন, “রুমে চল, তোর সাথে কিছু কথা আছে।”

আহনাফকে রুমে ঢুকিয়ে দরজা আঁটকে দিলেন শিরিন সুলতানা। আহনাফ অবাক হয়ে বলল, “এভাবে দরজা আঁটকালে কেন? কি হয়েছে?”

শিরিন সুলতানা রাগী স্বরে বললেন, “তোর কি হয়েছে? ওই খুনির সাথে এতো লটরপটর করছিস কেন? তুই ভুলে যাচ্ছিস না তো আমার ছেলেকে ওই মেয়ে মেরেছে? এতো সহজে ভুলে গেলি আবরারকে?”

আহনাফ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “অরু, খুব ছোট ছিল। ও হয়তো বুঝতে পারে নি।”

“আহনাফ! একটা প্রাণ নিয়েছে ওই মেয়ে। আমি ওকে তোর সাথে দেখতে চাই না।”

“আমি ওকে ভালোবাসি, মা। আমি অনেক ভেবেছি এসব নিয়ে। অরুকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু ওকে কষ্ট দিয়ে আমি নিজেই শান্তি পাই না। আবরারের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমারই কষ্ট হচ্ছে। অরুকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

“তার মানে তুই ওষুধগুলো ঠিকমতো খাচ্ছিস না।”

আহনাফ রুমের দরজা খুলে দিতে যাবে তখনই শিরিন সুলতানা আহনাফকে জোরে ধাক্কা দিয়ে বললেন, “তুই সত্যিই ওষুধগুলো বন্ধ করে দিয়েছিস!”

“মা, ওগুলো খেলে সাইড ইফেক্ট হয়। আমি জাস্ট কাল খেতে পারি নি। আর কয়েকদিন হচ্ছে অনিয়মিত খাচ্ছি। কাল ব্যাগপ্যাক করার সময় আরাফ আর তাহমিদ আমার পাশে ছিল। আর আমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর থেকে একটু অনিয়ম হয়েছিল। এরপর কিছুদিন আগে আমার সাথে যা হয়েছে, আরাফ এখন আমার সাথেই থাকছে। একা ছাড়ছেই না আমাকে। এসব ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে দেখলে ও নিজেই চিন্তা করবে। আর তুমিই বলেছো, আমি যাতে এই ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে কাউকে না বলি।”

আহনাফ শিরিন সুলতানার দুই বাহু ধরে বলল, “মা, জাস্ট একদিন ওষুধ বন্ধ রাখায় আমার নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে। সেই মেডিসিনগুলো শুধু সাময়িক শান্তি দিচ্ছিল আমাকে। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর থেকেই আমি নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি। মা, আমি হয়তো এভাবেই ঠিক আছি। গত পাঁচ বছর ধরে সেই মেডিসিনগুলো নিয়ে যাচ্ছি, তুমি জানো না আমার কতো কষ্ট হয়েছিল।”

এই বলে আহনাফ দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। শিরিন সুলতানা পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। তার এত বছরের প্রতীক্ষা, সমাপ্তির কাছাকাছি এসেই শেষ হয়ে গেল? তিনি মনে মনে ভাবলেন, “কিন্তু ড্রাগস নেওয়া শুরু করলে তো মানুষ এতো সহজে ছাড়তে পারে না। এমনকি ছাড়তে চাইও না। উলটো না নিলে এগ্রেসিভ হয়ে যায়। তাহলে আহনাফ কীভাবে একদিন ড্রাগস না নিয়ে স্বাভাবিক আছে?”

(***)

পাঁচ বছর আগে যেদিন আহনাফ শিরিন সুলতানাকে প্রশ্ন করেছিল, কিভাবে সে ছাদ থেকে এতো তাড়াতাড়ি নিচে নেমেছে, সেদিনই তিনি ভেবে নিয়েছেন আহনাফকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে, তার সত্য সবার সামনে ফাঁস হয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আহনাফ যদি অরুণিকার কথা বিশ্বাস করে, তাহলে অরুণিকা যেই সত্যটা জেনেছে, সেটা বাড়ির সবাই জেনে যাবে। আর শিরিন সুলতানা তা হতে দিতে পারেন না। তাই তিনি তার এক বান্ধবীর সাথে পরামর্শ করলেন। তার সেই বান্ধবীই ছিল জয়িতার মা, জাহানারা ইসলাম। জাহানারা ইসলাম এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাকে। তবে সে কোনো ডাক্তার নয়। মাঝপথে ডাক্তারি পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়া এক তরুণ। সে নিজেই ড্রাগস বানাতো। সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করতো। ড্রাগসগুলো কারো শরীরে প্রবেশ করলে সে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। উগ্র আচরণ শুরু করে। শারীরিকভাবে অনেক উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অরুণিকাকে আহনাফের জীবন থেকে বের করে দেওয়ার একমাত্র উপায় ছিল সেই ড্রাগস। শিরিন সুলতানার উদ্দেশ্য ছিল, আহনাফ সেই ড্রাগস নিয়ে তার কথামতো অরুণিকার উপর অত্যাচার চালাবে, আর অরুণিকা বিরক্ত হয়ে আহনাফকে ছেড়ে দেবে। তবে এখানেই তিনি থেমে থাকেন নি। তিনি জাহানারা ইসলামকে সাথে নিয়ে এক বৃদ্ধ লোকের কাছে গিয়েছিলেন। তার হাতে ছিল আহনাফের শার্ট। নিজের গর্ভের সন্তানের উপর কালো জাদু করেছিলেন তিনি, যাতে আহনাফ অরুণিকাকে ভুলে যায়। সেই জাদুর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কি-না তা বোঝা যায় নি। কারণ ড্রাগসের কারণেই আহনাফ অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই পুরোপুরি উগ্র হয়ে উঠে। যার দরুন শিরিন সুলতানার কথায় পাঁচ বছর আগে অরুণিকার চরিত্রে কলঙ্ক লেপ্টে দিতেও দ্বিধা করে নি আহনাফ।

চলবে-