#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২১
মিনারা বেগম তার বড় ভাইয়ের বাসায় বসে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ। জহির উদ্দিন বাসায় না। তার আসতে একটু সময় লাগবে। তাই অপেক্ষা করছে। মিনারা বেগমের ভাবী তার জন্য চা-বিস্কুট নিয়ে আসলেন। বিস্কুট গুলো নেতিয়ে গেছে। তবুও খেল।
জহির উদ্দিন বাসায় ফিরেছেন। হঠাৎ মিনারা বেগমকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-কী ব্যাপার?
যেন কোনো ব্যাপার ছাড়া এ বাসায় তার আসা বারণ।
বোনদের জমির ভাগ দেওয়ার ব্যাপারে ভাইয়েরা ভীষণ নারাজ। এতটাই নারাজ যে তাদের কাছে এ কথা বলতেও ভয় হয়, সংকোচ হয়। কিন্তু আজ মিনারা বেগম কোনো সঙ্কোচ ছাড়াই বলল,
-ভাইজান আমি খুব বিপদে আছি। জায়গা-জমি ভাগ করেন। আমার ভাগেরটুকু আমি বিক্রি করবো। জরুরি প্রয়োজন।
জহির উদ্দিন মহা বিরক্ত হলো। তিনি মেজাজ খারাপ করে বলল,
-বাপের জায়গা-জমি আছেই বা কী, ভাগেই বা পাবে কী! যার জন্য প্রতিদিন আসো।
-প্রতিদিন আসি নাই ভাইজান। এর আগে মনে হয় দুই বার বলেছিলাম।
জহির উদ্দিন কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। দুই কাঠা জমি পাবে কিনা সন্দেহ! তার মায়া ছাড়তে পারছে না।
-ভাইজান কিছু বলছেন না কেন? আমার কিন্তু জরুরি প্রয়োজন। এবার আপনারা আমতা-আমতা করলেও কাজ হবে না।
জহির উদ্দিন ধমকে উঠলেন,
-আসছো এক কাহিনী নিয়া। জায়গা-জমির ব্যাপার বললেই হয়ে যায় না! যাও এখন। দেখি কি করা যায়।
মিনারা বেগম বলে উঠলেন,
-এমন কথা অনেক শুনেছি। এবার যদি আপনারা ভালোয় ভালোয় জমি ভাগ করতে রাজি না হন তাহলে সালিস বসাবো মনে রাখেন। তাতেও যদি না হয় তবে থানায় যাবো।
জহির উদ্দিন পরম আশ্চর্যে তাকিয়ে রইল। মিনারা তাকে থানা পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে!
-এমন ভাব করছেন যেন আপনাদের ভাগের সম্পত্তি চেয়েছি। আমার সম্পত্তি আমাকে দিতে এত তালবাহানা কেন করছেন? দুই বার করে বিধবা হলাম। একটা মেয়েকে নিয়ে কত সংগ্রাম করছি। বছরে তো একবার খোঁজও নেননি। দুইটা দিন এসে বেড়ানোর জন্যও বলেননি। আমার ভাগের সম্পত্তি আমি চেয়েছি। সেটা দিতে এত আপত্তি কিসের আপনাদের?
মিনারা বেগম আবার বললেন,
-খোদার কসম! এবার আমি থানায় যাবো। মামলা করবো।
জহির উদ্দিনের এবার একটু টনক নড়লো। এর আগে কোনোদিন মিনারা বেগম এত শক্ত গলায় কথা বলেনি। তাই তারা সুযোগ পেয়েছে। এবার একটু ঘাবড়ে গেল। তিনি মুখ কালো করে বলল,
-ঠিক আছে। আমি সবার সাথে আলাপ করে কাল জানাবো তোমাকে।
মিনারা বেগম ওখান থেকে চলে আসলেন। দুপুর হয়ে গেছে। বড় ভাইজান তাকে একটু খেয়ে যেতেও বলল না।
__
মিনারা বেগম বাসায় ফিরে দেখে এশা বাসায় নেই। তিনি ব্যস্ত হয়ে হাজেরা খাতুনকে জিজ্ঞেস করলো,
-এশা কোথায়?
-ও একটু বের হয়েছে।
-ওর বাইরে কি কাজ! ওকে আমি বাসায় থাকতে বললাম!
-আরে এত অস্থির হচ্ছো কেন? এসে পড়বে।
হাজেরা খাতুন জিজ্ঞেস করলো,
-তুমি বড় ভাইজানের বাসায় গিয়েছিলে জায়গা-জমি ভাগের ব্যাপারে?
-হুম।
-আচ্ছা এশার বাপের কি কিছুই ছিলো না? সেখানে কিছু পাওনি?
মিনারা বেগম ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-না, তার কিছুই ছিলো না।
-তুমি কি মেয়ের সংসার ভাঙতে চাচ্ছো? তোমার মত মা থাকলে শত্রুর দরকার হয় না বুঝলে!
মিনারা বেগম বিস্মিত মুখে বলল,
-এগুলো কি বলছেন ভাবী?
-ভুল কিছু বলেছি? জামাই নিতে আসলো তার সাথে মেয়েকে দিলে না! এখন আবার জায়গা-জমি বিক্রি করে কি করতে চাচ্ছো? ওই টাকা দিয়ে কয়দিনই বা চলতে পারবা? তোমার কাণ্ডকীর্তি দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কত মেয়েদের দেখছি স্বামীর বাড়ি রোজ মার খায়। তাও সহ্য করে থাকে! অথচ তোমার পায়ের নিচের মাটি না থাকা সত্ত্বেও কত জেদ দেখাচ্ছো! তোমার এই জিদে মেয়েটার জীবন নষ্ট হবে। ওই ছেলে আর যদি তোমার মেয়েকে না নেয় তাহলে বুঝবে!
-ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।
এই বলে মিনারা বেগম ওখান থেকে চলে আসলেন।
মিনারা বেগম ওখান থেকে চলে আসার পর হাজেরা খাতুন ফোন করল জহির উদ্দিনের কাছে। তাকে বলল,
-ভাইজান মিনারাকে বুঝিয়েও লাভ হচ্ছে না। তার মতিগতি বুঝতে পারছি না। হয়ত জায়গা জমি বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসা নিবে।
-মহা মুশকিল তো! আরেকটু বুঝাও ওকে যাতে মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠায়। তাহলে জমি বিক্রির ভূত মাথা থেকে নামবে। জমি যেটুকু আছে তা তো আমাদের চার ভাইয়েরই দরকার। ওদের দিবো কীভাবে! জমি ভাগ হলে শুধু আমরা বিপদে পড়বো না, তোমরাও বিপদে পড়বে।
-বুঝিয়ে বোধ হয় লাভ হবে না। এত বছর তো নরম স্বভাবের মানুষ ভেবেছি। হঠাৎ করে কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে।
-জমি ভাগ কিছুতেই সম্ভব না। তুমি কিছু একটা ব্যবস্থা করে ওর মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাও।
-জি ভাইজান। দেখি কি করা যায়।
-আর শুনো, জমিরকেও একটু বুঝানোর চেষ্টা করো। সে কিন্তু বোনের কথায় একেবারে গলে যাবে।
-তাকে নিয়ে তো আমার বিপদের আর শেষ নেই!
জহির উদ্দিন ফোন রাখে। বললেই একদম জমি দিয়ে দিবে! মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি না পাঠিয়ে সে একটা আদিখ্যেতা শুরু করেছে।
__
এশা বাসায় ফিরে বিকালের দিকে। মিনারা বেগম চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলেন।
-কোথায় গিয়েছিলি তুই এভাবে না বলে?
মিনারা বেগমের গলায় রাগ। এশা বলল,
-তুমিও তো বলে যাওনি আমাকে।
-আমি কাজে গিয়েছিলাম। তোর কি কাজ?
এশা খাটের উপর বসে বলল,
-ঊর্মির বাসায় গিয়েছিলাম। ঊর্মিকে চিনো? আমার সাথে পড়ত হাইস্কুলে! ও একটা চাকরি করে। ওর সাথে একটু চাকরির ব্যাপারে আলাপ করলাম। কিন্তু ওখানে নাকি
এখন লোক নিবে না। এরপর একটা কোচিং সেন্টারেও কথা বললাম। বেতন খুব কম! তা দিয়ে কিছুই হবে না।
-চাকরি তো এখন সোনার হরিণ মা। চাইলেও তো পাওয়া যাবে না!
-হু।
মিনারা বেগম কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
-আচ্ছা তুই কি আজ ফুয়াদের সাথে যেতে চেয়েছিলি?
এশা অসহায় মুখে বলল,
-কি করবো মা বুঝতে পারছি না!
-সত্যি একটা কথা বল তো! ফুয়াদের ব্যাপারে কিছু লুকাচ্ছিস না তো?
এশা চুপ করে থাকলো।
-কি হলো? কথা বলছিস না কেন?
-বিয়ের আগে তার অন্য আরেকজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। সেটা তার পরিবার মানেনি। শেষে মায়ের পছন্দে আমাকে বিয়ে করেছে।
এশা থামলো। মিনারা বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-সেই মেয়ের সাথে এখনো সম্পর্ক আছে?
-না। কিন্তু আমাদের বিয়েরও তেমন গুরুত্ব নেই তার কাছে। সে দেশের বাইরে চলে যাবে। আর সে বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করে না। কখনো বাবা হতে চান না!
-এগুলো কি কথা! তাহলে তোকে নিতে আসলো কেন?
-অনেক প্যাঁচাগোছের ব্যাপার। তুমি বুঝবে না মা।
-বল তুই সব আমাকে।
-সে তার পরিবারকে পছন্দ করে না। তাই আমাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ঝামেলা তৈরি করে। কিন্তু নিজে কোনো প্রতিবাদ করবে না। আর পারিবারিক ব্যবসায় থেকে সে এখন বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়ার জন্য টাকা গোছাচ্ছে। হতে পারে সেজন্য নিজে পরিবারের সঙ্গে কোনো দ্বন্দে জড়াচ্ছে না।
যত যা-ই হোক, মিনারা বেগম এই ভেবে সামান্য স্বস্তিতে ছিলেন যে ফুয়াদ তার পরিবারের মানুষদের মত না! পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে সে প্রতিবাদ না করতে পারলেও সে এশার বিপক্ষে না। কিন্তু এই মুহূর্তে মিনারা বেগমের মাথায় চক্কর দিচ্ছে। তার দুশ্চিন্তা আরো বাড়লো।
__
পরেরদিন অস্থির মেজাজে মিনারা বেগম নাদিমকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-কি করবে? কিছু ভেবেছো?
নাদিম যেন কিছু বুঝতে পারলো না। সে প্রশ্ন করলো,
-কোন ব্যাপারে?
-আমার ভাগের ব্যাপারে।
-মা আপনি এগুলো কি শুরু করেছেন? আপনার এই বাড়িতে ভাগ আছে তো আপনি এখানে এসে থাকেন।
-আমি থাকবো না ওখানে। আমার ভাগ আমি বিক্রি করবো। তুমি রাখবে নাকি আমি অন্য কোথায়ও কথা বলবো?
নাদিমের গলার স্বর এবার নরম হয়ে আসলো। সে বলল,
-বাইরের সম্পত্তি হলে আপনি অন্য কারো কাছে বিক্রি করতেন। আমার কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু বাড়ির ভাগ অন্য কারো কাছে বিক্রি করার কথা কীভাবে ভাবছেন? আমাকেই কিনে রাখতে হবে। এই মুহূর্তে আমার হাতে তো টাকা-পয়সা নেই।
-রাখলে টাকা পয়সা ম্যানেজ করো। আর যদি কোনো তালবাহানা করো তো আমি থানায় যাবো।
মিনারা বেগমের মুখ থেকে এমন কথা শুনে নাদিম যেন বিশাল দুঃখ পেল। সে অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
-মা আপনি আমাকে থানায় যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন!
-তাতে কি দুঃখ পাচ্ছো? তোমাকে যে আমি নিজের সন্তানের মত বড় করলাম। লেখাপড়া শিখালাম। তার কি প্রতিদান দিয়েছো? তুমি আর তোমার বউ আমাকে ঠিকমত খেতেও দাওনি। আমি তোমাদের প্রতি এত দয়া করতে যাবো কেন? অনেক দয়া করেছি।
নাদিম কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। মিনারা বেগম বললেন,
-আমাকে এরচেয়ে কঠোর হতে বাধ্য করো না। তোমার নামে মামলা করতে যেন না হয়। কি করবে শীঘ্রই করো।
__
মিনারা বেগমের চার ভাই মিলে গোপনে বৈঠক করলো। যদিও মেজো ভাইয়ের সম্পত্তি ভাগের ব্যাপারে কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্তু বাকী তিন ভাই আর বউয়ের চাপের মুখে পড়ে তিনিও সবার সাথে যোগ দিলেন।
জহির উদ্দিন সবাইকে বললেন,
-আব্বা খুব বেশি জায়গা সম্পত্তি রেখে যাননি। সামান্য যা আছে তা আমরা চার ভাই মিলে খাচ্ছি। সম্পত্তি বেশি থাকলে না হয় ভাগ করতাম। যেটুকু আছে আমাদের চার ভাইয়ের ই দরকার। ভাগ করা সম্ভব না।
মিনারা বেগমের ছোট ভাই বলল,
-আমরা তাহলে মিনারা আপাকে বলবো যে, সম্পত্তি ভাগের জন্য আমাদের মাস ছয়েক সময় দরকার। আমরা তার থেকে সময় নিবো। এই ছয় মাস তাদেরকে কে থাকতে দিবে! কে খাওয়াবে! পনেরো দিনের মাথায়ই বাধ্য হয়ে মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে হবে।
হাজেরা খাতুন বলল,
-এটাই ভালো বুদ্ধি। মেয়ে তো শ্বশুর বাড়ি বোধ হয় যেতেই চায়। মিনারা ই বাঁধা দিচ্ছে। মেয়েকে একটু ভালো করে বাস্তবতা বুঝিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে হবে। তাহলে আর ফিরে আসবে না যতই কষ্টে থাকুক।
বৈঠক শেষে জহির উদ্দিন মিনারা বেগমকে জানালো,
-আমি সবার সাথে কথা বলেছি। আমাদের মাস ছয়েক সময় দরকার। এরপর আমরা সম্পত্তি ভাগ করবো। এরজন্য তোমাকে থানায় যেতে হবে না। বাপের সম্পত্তি তো আমরা বাইরে বিক্রি করবো না। নিজেরাই রাখবো। টাকাপয়সা জোগাড় করতে তো সময়ের দরকার।
ছয় মাস! তার দুই-এক দিনেই টাকা দরকার। তিনি বললেন,
-আমার দুই-এক দিনেই টাকা দরকার ভাইজান।
-আমাদের দিকটাও একটু বোঝার চেষ্টা করো! এখন টাকা কোথায় পাবো? ছয়মাস সময় চাওয়ার কারণে তুমি যদি ভাইদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাও তাহলে করতে পারো। আমরা তো নিরুপায়।
মিনারা বেগমের সব হিসেব যেন এলোমেলো হয়ে গেল। তিনি এত বেশি হতাশ হলো যে তার চোখে পানি এসে পড়লো! ভাইয়েরা সম্পত্তি ভাগ করতে না চাইলে থানায় যেত দরকার হলে। কিন্তু ছয় মাস সময় চেয়েছে সেজন্য থানায় কীভাবে যাবে!
এর ভিতর নাদিম ফোন করে বলল,
-মা আমি কিছুতেই টাকা জোগাড় করতে পারিনি। আপনি যদি বছর খানেক অপেক্ষা করতেন তাহলে সুবিধা হতো। এর আগে আমার করার কিছু নেই।
-আমার জরুরি দরকার!
নাদিম এবার অন্যরকম স্বরে বলল,
-দরকার হলেই এখন সম্ভব না। তাতে যদি আপনি থানায় যেতে চান, তবে যান।
এই বলে সে ফোন কেটে দিলো। মিনারা বেগম কয়েকবার কল দিলো। কিন্তু সে কল ধরলো না। পরেরদিন মিনারা বেগম বাসায় গিয়ে দেখলো নাদিম বাসায় তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে!
__
মিনারা বেগম বাসায় নেই এই সুযোগে হাজেরা খাতুন এশাকে ডেকে কঠিন গলায় বলল,
-তোমাদের দুইজনকে বাসায় রাখা, খাওয়ানো আমার পক্ষে আর সম্ভব না। ওদিকে জায়গা-জমির ভাগও ছয় মাস পর ছাড়া হবে না। ছয় মাস কি তোমরা এখানে থাকবে? তোমাদের বিবেকে বাঁধছে না একটুও?
এশা মাথা নিচু করে রাখলো। এত অপমান, লজ্জা লাগছে ওর!
-মায়ের কথায় শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসলে। এখন দেখছো বাস্তবতা? বাস্তবতা অত সহজ না।
হাজেরা খাতুন বললেন,
-ভালো বুদ্ধি দেই শুনো। মায়ের কথায় না নেচে শ্বশুর বাড়ি চলে যাও। তা না হলে কয়দিন পর মা-মেয়েকে না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে না। তোমরা যা করার আজকের মধ্যে করো। আজকের পর আমি আর তোমাদের আমার বাসায় একদিনও রাখবো না।
হাজেরা খাতুনের সামনে থেকে চলে এসে এশা অনেকক্ষণ যাবৎ কাঁদলো। এরপর কান্না থামিয়ে গায়ের জামা পরিবর্তন করে। ও তো এক কাপড়েই বেড়িয়ে এসেছে। এতদিন মৌলির জামা পরেছে। সেটা পরিবর্তন করে নিজের জামা গায়ে দিয়ে তৈরি হলো।
দ্রুত তৈরি হয়ে হাজেরা খাতুনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
-মামী মা আসলে বলবেন যে আমি চলে গেছি। আমার জন্য যেন দুশ্চিন্তা না করে।
হাজেরা খাতুন বিস্মিত হলেন। মনে মনে খুশিও হলেন,
-সত্যি তুমি চলে যাচ্ছো!
-হ্যাঁ।
এরপর এশা হাজেরা খাতুনের হাত ধরে অনুরোধ করে বলল,
-মাকে আপনাদের বাসায় রাখেন। আপনার সব ঋন আমি একদিন শোধ করে দিবো।
এই বলে এশা আর সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে পড়লো। ও আবার সেই নরকের দিকে পা বাড়ালো। ওখানে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আপাতত!
তবে এবার আর মুখ বুঁজে কিছু সহ্য করবে না। বাঁচলে বাঁচার মত বাঁচবে, আর মরলেও লড়াই করে মরবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে। ওকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।
(চলবে)
#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২২
এশা মেজো মামার বাসা থেকে বের হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটতে লাগলো। ওর কাছে এই মুহূর্তে এক পয়সাও নেই। পুরো রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। কয় ঘণ্টা লাগবে জানা নেই। এর আগে তো কখনো এভাবে হেঁটে যায়নি। এত দূরের রাস্তা চিনে যেতে পারবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই। তবুও হাঁটতে লাগলো।
এভাবে শত লজ্জা, অপমান মাথায় নিয়ে, আত্মসম্মান খুইয়ে ওই বাসায় যাওয়ার চেয়ে গাড়ির নিচে পড়ে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু ও মরবে না। বেঁচে থাকলে একদিন নিশ্চয়ই সব গ্লানি ধুয়ে মুছে যাবে।
একটা গলি ধরে হাঁটার সময় হঠাৎ সাদা একটা প্রাইভেট কার এশার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ও চমকে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটায় আগে থেকে খেয়াল করেনি।
ফুয়াদ বের হলো গাড়ির ভেতর থেকে। তাকে স্বাভাবিক মনে হলো না। চোখ লাল, চুল গুলো অবিন্যস্ত। চেহারায় কিরকম একটা উন্মাদ ভাব!
ফুয়াদ এখানে! এশা আর কিছু ভাবার সময় পেল না। ফুয়াদ গাড়ি থেকে নেমেই ক্ষিপ্ত হয়ে সজোরে টান দেয় ওর হাত ধরে। ও এক টানে গাড়ির ভিতর ছিটকে পড়লো।
ঘটনার আকস্মিকতায় এশা হতভম্ব হয়ে গেল। ফুয়াদ এরকম আচরণ কেন করছে? তাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?এশা মুখ খুলে কিছু একটা বলতে চাইলে ফুয়াদ হঠাৎ ছুরি বের করলো। ছুরিটা ওর দিকে তাক করলো।
-সিন ক্রিয়েট করতে চাচ্ছো পাবলিক প্লেসে? চিৎকার করবে? চিৎকার করে লোক জড়ো করে বলবে আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছি? এরপর গণপিটুনি খাওয়াবে? এত অপছন্দ করো তুমি আমাকে!
গাড়ি চালাতে চালাতে চেঁচিয়ে বলল ফুয়াদ। এশা বোকার মত তাকিয়ে থাকলো। লোকটার মাথায় কি এ কয় দিনের ব্যবধানে কোনো সমস্যা হয়েছে?
-একদম সিন ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবে না এশা! তুমি তোমার মায়ের কথা মত আমাকে ছেড়ে মামার বাড়ি পড়ে আছো! হোয়াই? এমন কি খারাপ করেছি আমি তোমার সাথে? শুধু একটা চড় দিয়েছি! এছাড়া আর কি অপরাধ আমার? আমার মায়ের কিংবা পরিবারের কারোর কর্মকাণ্ডকে আমি সমর্থন করেছি? বিয়ের পর থেকেই আমি তোমাকে প্রতিবাদ করতে বলেছি। কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ করলে তার সাথে মারামারি করো, চুল ছেঁড়াছেঁড়ি করো। আমার উপর এত রাগ, ক্ষোভ কিসের তোমার?
আগের মতই চেঁচিয়ে বলল ফুয়াদ।
-আমার মনটা কি কোনো যন্ত্র? যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে! তুমি আমাকে চেনার চেষ্টা করেছো কখনো? বোঝার চেষ্টা করেছো? আমার হৃদয়, মন কতটা যন্ত্রণায় জর্জরিত কখনো খেয়াল করেছো? আমি এখনো চোখ বুঁজলেই সুস্মির হাসি মুখটা দেখতে পাই! আমি যন্ত্র হলে তো মন থেকে এসব দৃশ্য মুছে ফেলে তোমাকে মাথায় তুলে আহ্লাদ করতাম! তোমাকে আমি আহ্লাদ না করলেও এমন কি অন্যায়, অত্যাচার করেছি তোমার উপর?
ফুয়াদ বলেই চলল। এশা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
-আমি একজন ট্যালেন্টেড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। স্কলারশিপ পেয়েছি। দেশের বাইরে যাবো। আমার মা টাকা না দিয়ে আমাকে আটকে দিলো। আবার আমি পছন্দ করে একজনকে বিয়ে করতে চাইলাম। সেই বিয়ে ভেঙে গেল আমার পরিবারের কারণে। সুস্মি আমকে ছেড়ে চলে গেল। আমার মনে কোনো রাগ, ক্ষোভ থাকতে পারে না? আমি কি আমার সমস্ত ক্ষোভ তোমার উপর ঝেড়েছি? তোমাকে প্রতিনিয়ত অত্যাচার করেছি?
এশা এবার মুখ খুলে কেবল বলল,
-না।
-তাহলে তোমার মাকে তুমি কি বলেছো? আমি তোমাকে সকাল-বিকাল দুইবার মারধর করি? তিনি তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে দিলো না কেন?
ফুয়াদের কথার বিপরীতে এশার অনেক যুক্তি আছে। বলার অনেক কিছু আছে। কিন্তু ও সেগুলো এই মুহূর্তে বলল না।
এই মুহূর্তে বলে লাভ নেই হয়ত! এশার ধারণা ফুয়াদ কিছুটা মাতাল অবস্থায় আছে। হয়ত কাল রাতে হাবিজাবি কিছু খেয়েছে। সেই রেশ এখনো কাটেনি।
বিয়ের পর থেকে ফুয়াদকে সিগারেট খেতে দেখেছে। একটার পর একটা ধরাতো রুমের দরজা বন্ধ করে। চেইন স্মোকার সে। কিন্তু এর বাইরে অন্য কোনো ধরণের নেশা করতে দেখেনি।
-রুম গোছানো পাই না। আলমারি অগোছালো, বিছানা অগোছালো। অফিসে যাওয়ার সময় জামা-প্যান্ট ইস্ত্রি করা থাকে না। রুমের জগটায় পানি থাকে না। রাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর মত কিছু নেই।
এই বলে ফুয়াদ ব্যস্ত সড়কে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এর সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে থাকলো। এভাবে রাস্তার মধ্যে গাড়ি থামিয়ে রাখায় আশপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো।
এশা দ্রুত গাড়িতে রাখা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ফুয়াদের চোখে-মুখে, মাথায় ছিটিয়ে দিলো। সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে আবার গাড়ি স্টার্ট করলো। এরপর আর কোনো কথা বললো না। এশাও কিছু বলল না।
ও মনে মনে ভাবছে, ফুয়াদ ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বাসায় নাকি নিজের ফ্ল্যাটে? যেখানে নেওয়ার নিক! জাহান্নামের চৌরাস্তায় নিলেও যেতে হবে। নিজ থেকে ওই বাসায় ফিরে যাওয়ার মত ভয়ঙ্কর লজ্জা, অপমান থেকে রেহাই পেয়েছে সেটাই ওর জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার। তবে ফুয়াদ বোধ হয় এই অবস্থায় আজ আবার মেজো মামার বাসায় যাচ্ছিলো ওকে আনতে। তার হাবভাবে সেটাই মনে হলো।
__
ফুয়াদ এশাকে বাসায় নিয়ে এসেছে। বাসার সামনে গাড়ি থামিয়ে এশার হাত ধরে গাড়ি থেকে নামালো। যেন হাত ছাড়লেই ও পালিয়ে যাবে।
বাড়ির আঙিনায় চেয়ার পেতে পলি বেগম আর শফিক আহমেদ বসে আছে। তাদের সাথে অর্পি ও রাঈদ। রাঈদ মালার ছেলে। মালা বাপের বাড়িতে এসে পড়েছে। প্রেগন্যান্সির পুরো সময়টায় সে এখানেই থাকবে আর ভাইয়ের বউদের মাথা খাবে! দুই নাতনিকে নিয়ে বাড়ির আঙিনায় বসে সময় কাটাচ্ছে পলি বেগম আর শফিক আহমেদ।
হঠাৎ পলি বেগম দেখতে পেল ফুয়াদ এশাকে হাত ধরে টেনে বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসছে। তিনি অবিশ্বাস্য, চূড়ান্ত বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো সেদিকে। এই মেয়েকে ফুয়াদ বাসায় আনছে কেন? কোন সাহসে! সে তো বলেছিল ডিভোর্স দিয়ে দিবে। ফুয়াদ কাল রাতে বাসায়ও ফিরেনি। সেলফোনও বন্ধ করে রেখেছিল। সে আসলে কি চাচ্ছে? তার মাথায় চলছেটা কি?
পলি বেগম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ফুয়াদ তাদের সামনে দিয়ে এশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। কোনো সংকোচ করলো না। তাদের কিছু বলারও সুযোগ দিলো না। তারা হতবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। শফিক আহমেদ বিস্মিত গলায় উচ্চারণ করলো,
-এসব কী!
বাসায় ঢুকতেই নিচতলায় যে বসার রুমটা আছে সেখানে মালা আর মারুফা বসে গল্প করছে। এশার সঙ্গে খাতির করার অপরাধে তারা যুক্তি করে সম্পাকে এড়িয়ে চলছে।
মালা দেখলো ফুয়াদ ধপধপ শব্দ করে এশার হাত ধরে দোতলার দিকে উঠছে। মালা ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে ডেকে বলল,
-ফুয়াদ তুই ওকে আবার এ বাড়িতে এনেছিস! এই মেয়েকে তুই এখানে আবার কেন এনেছিস?
ফুয়াদ কোনো উত্তর দিলো না। ও এশাকে রুমে ঢুকিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করলো শব্দ করে। এরপর ওর হাত ছেড়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তীব্র ক্লান্ত স্বরে বলল,
-আমি তিন রাত ধরে নির্ঘুম। এখন ঘুমাবো। কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। দরজা নক করলে খুলবে না।
এশা বলল,
-ঠিক আছে।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল ফুয়াদ। একটু পরই দরজা ধাক্কানো শুরু হলো। এশা প্রথম কয়েকবার খুললো না। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে খুলে দেখলো মারুফা দাঁড়ানো। ও তাকে বলল,
-ফুয়াদ ঘুমাচ্ছে। বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে। কোনো কাজ থাকলে পরে আসুন।
এই মেয়ে এভাবে কথাবার্তা বলছে কেন? মারুফার কতখানি মেজাজ খারাপ হয়েছে সেটা তার মুখ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। এশা আন্দাজ করতে পারলেও পরোয়া করলো না। ও রুমের দরজা আটকিয়ে দিলো।
এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ফুয়াদের এরকম অপ্রত্যাশিত আচরণে এশা কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে বসে রইল। কি হয়েছে, কি হবে, এসব কিছু আর না ভেবে এরপর ও শুয়ে পড়লো ফুয়াদের পাশে। এই কয়টা দিন ওর উপর যেন বিশাল ধকল গেছে। ও চোখ বোঁজার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো।
__
এশার ঘুম ভাঙলো সকাল নয়টার দিকে। ফুয়াদ এখনো ঘুমাচ্ছে। এর ভিতর রাতে বাসায় কি হয়েছে, না হয়েছে কিছুই টের পায়নি। ওসব অত টের পাওয়ার প্রয়োজনও নেই।
ফ্রেশ হয়ে এশা রান্নাঘরের দিকে যায়। মারুফা সেখানে কি যেন করছে। ও সেদিকে ভালো করে তাকালো না। চটপট করে এক প্যাকেট নুডলস রান্না করে রুমে নিয়ে আসলো। এ বাড়িতে কেউ এভাবে আলাদা খাবার-দাবার বানিয়ে খায় না। ও খেল।
খাওয়া শেষ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো তৈরি হতে লাগলো। বাইরে বের হবে। কিছু কাজ আছে। চোখে আইলাইনার টেনে সাজগোজ শেষ করে ফুয়াদকে ডাকলো। সে ঘুম জড়ানো চোখে তাকালো।
এশা বলল,
-কাল থেকে আমি ক্যাম্পাসে যাবো। আপনিই বিয়ের আগে বলেছেন আমাকে পড়াশোনা করাবেন। ইভেন বইও কিনে দিয়েছেন। আমার কিছু কেনাকাটা করা লাগবে। টাকা দেন।
ফুয়াদ পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে এশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-যাও।
-রোদের ভিতর রিক্সায় যেতে পারবো না। ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি বের করতে বলুন।
ফুয়াদ ঘুমে কাতর অবস্থায়ই ড্রাইভারকে ফোন করে বললো এশাকে নিয়ে যেতে।
এশা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পলি বেগমের সামনে পড়লো। ও নিতান্তই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকে বলল,
-মা আমি একটু বের হচ্ছি। আপনার ছেলেকে বলেছি। সে ই অনুমতি দিয়েছে।
এই বলে ও হিল পায়ে ঠকঠক করে হেঁটে তার সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল। ওর শরীর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ পলি বেগমের নাকে লাগলো। সে এই মূহুর্তে বাক্যহারা।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা