এক ফালি সুখ পর্ব-০৬

0
278

#এক_ফালি_সুখ🌼 |৬|
#তাসনিম_জাহান_মৌরিন
ভাগ্য ভালো ছিলো মৌরিন এর, উপরে উঠে দেখলো ছাদের দড়জা আটকানো তবে তালা দেওয়া নেই। তার মানে ছাদ সবসময় খোলাই থাকে। দরজা খুলে ছাদে চলে আসে মৌরিন। বিল্ডিংটা খুব একটা বড় না হওয়ায় ছাদটাও মাঝারি আকৃতির। বড় ও নয় আবার ছোট ও বলা চলেনা।
পা বারিয়ে কার্নিশ এর কাছে চলে আসে মৌরিন। রেলিং দেওয়া তবে খুবই নিচু, বাচ্চাদের নিয়ে এই ছাদে আসাটা বিপদজনক হবে। আশেপাশে আরো অনেকগুলো বিল্ডিং, বেশিরভাগ পুরনো। তবে কয়েকটা নতুন বিল্ডিং ও রয়েছে। একপাশে অনেক গাছপালা, নিচে কয়েকটা ছোট টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে। বাহিরে রান্নাঘরে আলো জ্বলছে, কোনো মহিলা রান্না করছে বোধ হয়।

তবে ছাদে এসে তিল পরিমান বাতার অনুভব করলোনা মৌরিন, গাছপালার একটা পাতাও যেন নড়ছে না। পাশের বিল্ডিং এর পাঁচতলার রান্নাঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ আসছে। এছাড়া সবটাই নির্জন,শহরে তো মানুষ এত আগে ঘুমিয়ে যায়না। তাহলে আজ এত নিরব কেন সবকিছু? স্ট্রেঞ্জ!

এই ছাদে ভালোলাগার মতো কিছুই খুজে পেলোনা মৌরিন, তবে খারাপ ও লাগছে না। এমন অন্ধকারে নিশ্চুপ হয়ে একা একা দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব একটা মন্দ নয়।
টিনের দরজা টা খোলার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো মৌরিন, আরাফ হাতে সিগারেট নিয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই ছাদে প্রবেশ করছে। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো চলে যেত ছাদ থেকে, তবে মৌরিন ভিন্ন। সে আরাফের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারো আগের ন্যায় দাড়িয়ে রইলো, আরো কিছুক্ষন থাকতে ইচ্ছে করছে ছাদে। অন্য কাউকে দেখে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাজ করার মানসিকতা অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছে সে।

অন্যদিকে ছাদে এসে মৌরিন কে দেখতে পেয়ে মনেমনে বেশ খুশিই হলো আরাফ,মেঘ না চাইতেই জল পাওয়া যাকে বলে। হাতে থাকা অর্ধেক সিগারেট টা নিচে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে ফেললো আগুনটা। ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে মৌরিন এর থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই তার পাশে এসে দাড়ালো আরাফ। মৌরিন তখনো ভাবলেশহীন, নিজের মতো তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কিছু সময় পর আরাফ নিজে থেকেই বললো,
_”হায়, আমি আরাফ।”

একনজর আরাফের দিকে তাকিয়ে ছোট করে “হুম” বলে আবারো সামনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো মৌরিন।

_”ভালোই হলো, এখানেই দেখা হয়ে গেলো তোমার সঙ্গে।”

_”ভালো হওয়ার কি আছে?”

_”কারণ তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিলো।”

আরাফের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় মৌরিন, শান্ত কণ্ঠে বলে,
_”আমাদের বাসায় কোনো মালামাল টানাহেঁচড়া করা হয়না। কোনো বাচ্চাও নেই যে শব্দ করবে। তাই অভিযোগ করার তো কোনো কারণ দেখছিনা।”

আরাফ হেসে বলে,
_”অভিযোগ কেন করতে যাবো? অন্য কথাও তো থাকতে পারে।”

_”বাড়িওয়ালা দের অভিযোগ ব্যাতীত অন্য কিছুতো বলতে দেখিনি কখনো।”

আবারো আগের অবস্থানে চলে গেলো মৌরিন। আরাফ বুকে হাত গুজে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
_”খোঁজ নিয়ে জানলাম, তোমার বাবা নেই। আর্থিক অবস্থাও নাকি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তুমি চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি।”

_”কেমন হেল্প?”

_”এই যেমন ধরো, তোমাদের বাসা ভাড়া কমিয়ে দিতে পারি। এক মাসের অ্যাডভান্স ভাড়াটা বাদ দিয়ে দিতে পারি। আর চাইলে আর্থিকভাবেও সাহায্য করতে পারি। আর তার বদলে..”

_”আর তার বদলে ইউ ওয়ান্ট টু গো টু বেড উইথ মি, রাইট?”

আরাফের কথা সম্পূর্ন না হতেই তার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে মৌরিন। আরাফ সামান্য হেসে বলে,
_”আগেই বুঝে গেলে? বেশ সোজাসুজি কথা বলো দেখছি।”

মৃদু হাসে মৌরিন,আরাফের দিকে ঘুরে মৃদু হেসে বলে,
_”আমার জানা মতে চোড়েরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে। আর আমি কোনো চোড় নই,তাই সোজাসুজিই বললাম।”

_”বুঝেই গেছো যখন,তখন রাজিও হয়ে যাও। লাভ তো তোমারই।”

_”বলা শেষ আপনার?”

আরাফ কপাল কুঁচকে নিলো। মৌরিন বুকে হাত গুঁজে বললো,
_”আপনার মা না আপনাকে নিয়ে অনেক গর্ব করে। এইতো দুদিন আগে এসে আম্মুর সঙ্গে আপনার কত প্রশংসা করছিলো। তার একদম হিরের টুকরো ছেলে। আপনার এই রূপটা জানে তো সে?”

_”কি বলতে চাইছো তুমি?”

_”এই রূপটা আপনার বাবা মা কে জানানো উচিৎ নয় কি?”

আরাফ বাঁকা হেসে বলে,
_”কে তুমি? তোমার কথা বিশ্বাস করতে যাবে কেন তারা?”

_”হুম ঠিকই বলেছেন, মুখের কথা একদমই বিশ্বাস করা উচিৎ নয়।”
কথাটা বলেই নিজের হাতে থাকা ফোনটা সামনে এনে রেকর্ডিং অফ করলো মৌরিন। আরাফ অবাক হয়ে হা করে তাকালো ফোনটার দিকে।
আরাফকে পাশে এসে দাড়াতে দেখেই মৌরিন আন্দাজ করতে পেরেছিল এমন কিছু, তাই আগে থেকেই ফোনের রেকর্ডিং অন করে রেখেছিল।

_”এটা শুনলে তো বিশ্বাস করতে বাধ্য।”

শুকনো ঢোক গিললো আরাফ, মেয়েটাকে যতটা শান্ত শিষ্ট ভেবেছিল তার ঠিক উল্টোটা মনে হচ্ছে এখন।
ফোনটা হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে মুখভঙ্গি গম্ভীর করে নিলো মৌরিন। নিজে থেকে আরাফের দিকে দু কদম এগিয়ে গিয়ে বললো,
_”বাবা মায়ের চোখে সন্তানকে ছোট করতে খুব খারাপ লাগবে আমার। তবে দ্বিতীয়বার এই ধরণের প্রস্তাব আমার কানে এলে ঐ খারাপ লাগাটা ভুলে যাবো আমি।”

আর কিছু বলার সুযোগ পেলোনা আরাফ, তার আগেই মৌরিন নেমে গেলো ছাদ থেকে। আরাফ এখনো আশ্চর্য নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে, মৌরিন এতটা চালাক তাকে দেখে তো বোঝা যায়না।

____
কলিং বেল এর শব্দ পেতেই জলদি এসে দরজা খুললেন মারুফা। মৌরিন ভিতরে এসে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো মারুফার দিকে, এরপর নজর গেলো পাশের ছোট খাটটার দিকে। সেখানে বাবার ছবিটা পরে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মৌরিন। মারুফা মেয়ের থেকে নিজের নজর আড়াল করার চেষ্টা করছেন,তবে তা সম্ভব হচ্ছে না।

এগিয়ে এসে মা’কে নিয়ে খাটে বসালো মৌরিন। বিছানায় থাকা ফটোফ্রেম টা হাতে নিয়ে নিজের ওড়নার সাহায্যে মুছে নিলো সেটা। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো,
_”তুমি আবার কান্নাকাটি করছিলে তো? কেন এত কাঁদো বলতো, বেশি কষ্ট হলে তো আমার সাথে কথা বলতে পারো মা।”

আঁচলে চোখে মুছে মারুফা বললেন,
_”তোর কষ্ট হয়না বুঝি? কি করে এত শান্ত থাকিস বলতো।”

_”আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিতে পেরেছি মা, তাই হয়তো কষ্টগুলো একটু হলেও কমে যায়। কিন্তু তুমি? তুমি তো এখনো মানতে পারছো না।”

মেয়ের মাথার হাত বুলিয়ে দিলেন মারুফা। অসহায় সুরে বললেন,
_”আমার যে তোর জন্য বেশি কষ্ট হয় মৌ। আমার ভাগ্যে যা ছিলো তা নাহয় মেনে নিলাম। কিন্তু তুই কি করে মেনে নিচ্ছিস মা? তোর ভাগ্যটা তো এমন না হলেও পারতো।”

বিপরীতে আর কিছু বললোনা মৌরিন। মারুফা আবারো নিজের চোখ মুছে বললেন,
_”তোর এই মনোবলই একদিন তোকে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যাবে মৌ, মিলিয়ে নিস আমার কথা। তার সঙ্গে জীবনে এমন একজন..”

মারুফাকে তার কথা সম্পূর্ন করার সুযোগ দিলোনা মৌরিন। নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
_”চাইনা তো। বিশ্বাস করো,কাউকে চাইনা আমার। আমি কেবলমাত্র আমাকে চাই, নিজের মাঝে আমি নিজেকেই খুজে পেতে চাই, অন্য কাউকে নয়। নিজের মতো বাঁচতে চাই, সঙ্গে চাই.. এক ফালি সুখ।”

গাম্ভীর্যতা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য কিছুটা থামলো মৌরিন। মারুফার দুগালে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,
_”সঙ্গে তুমিতো আছোই। দেখো, আমরা তো এখনো ভালোই আছি। কত মানুষের তো করুন অবস্থা, আমরা তো দিব্যি আছি সেখানে। একটু অভাব আছে ঠিকই, তবে সেটা কোনো বিষয় নয়।”

মারুফা বুঝতে পারলেন, মৌরিন নিজেকে এবং তাকে উভয়কেই শান্ত করার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টা বিফলে যেতে দিলেন না মারুফা, নিজেও মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন।
মৌরিন এবার মারুফাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
_”টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায়না মা। তোমার মেয়ে তোমায় কখনো আফসোস করতে দেবেনা,কাউকে লাগবেনা আমাদের। আমরা মা মেয়ে মিলেই সুখে থাকবো, ভীষণ সুখে থাকবো।”

#চলবে?