এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-১৫

0
898

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৫

শেষ বিকেলের রোদ আছড়ে পরেছে জানালার কাঁচ ভেদ করে।একটা সরু তেজস্ব রশ্মি তোহার মুখের উপর ছেঁয়ে আছে।
এখনো চোখ তুলে তাকায়নি তোহা।দৃষ্টি নিচের দিকে দিয়ে থম ধরে বসে আছে।তিহানের হাত এখনো তার গালে,ঠোঁটে।পাক্কা তিনমিনিট যাবত তার সারামুখে চোখ বুলিয়েই যাচ্ছে তিহান।তার মাদকমাখা গভীর দৃষ্টির বিপরীতে মাথা তুলতে পারছেনা তোহা।প্রচন্ড লজ্জায় শ্বাস-প্রশ্বাস যেন গলা অবধি এসে আটকে যাচ্ছে।
তিহানের হাতের বৃদ্ধাআঙ্গুল হাল্কা করে তোহার ঠোঁটে স্লাইড করে শেষমেশ ঠোঁটের কোঁণায় যেতেই তোহা মিনমিনে কন্ঠে বললো,

—“দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

তিহান হাসলো।আচমকা হেসে ফেলা সেই হাসি দেখার ইচ্ছা থাকলেও লজ্জার কারণে তাকাতে পারলোনা তোহা।তিহান গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলে তোহা মুখের উপর আসা চুলগুলো কানের পিছে গোঁজার জন্য হাত উঠাতেই তিহান নিজেই তা গুঁজে দিয়ে সরে গিয়ে সিটে বসলো।তোহার মুখে এখনো লজ্জাভাব স্পষ্ট।
গাড়ি স্টার্ট দিলো তিহান।হাতের মুঠোয় থাকা খোঁপার কাঁটাটা তোহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—“চুল বেঁধে জানালাটা খুলে দে।”

তোহা একবার তাকিয়ে কাঁটাটা দিয়ে পুনরায় খোঁপা করতে করতে বললো,
—“চুলগুলো শুধু শুধু খুললেন কেনো?”

তার কথার প্রেক্ষিতে কোনো কথা বললোনা তিহান।বরং কন্ঠে অস্থির অস্থির ভাব নিয়ে বললো,
—“জানালার কাঁচটা নামা তিহু,প্রচুর গরম লাগছে।”

তোহ্ বিরক্তি নিয়ে খোঁপা আটকে জানালাটা খুলতে খুলতে বললো,
—“এসি ছাড়লেই তো পারেন।”

—“এসির কৃত্রিম ঠান্ডায় কাজ হবেনা।প্রকৃতির অকৃত্রিম তাজা বাতাস লাগবে।”

তোহা পাল্টা জবাব দিলোনা।গাড়ি চলছে তুমুল গতিতে।গাড়ির গতির সাথে পাল্লা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদেরকে।
জানালায় মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো তোহা।যদিও এদিকটায় আকাশ ততটা দেখা যাচ্ছেনা।রাস্তার দু পাশে সাড়ি সাড়ি গাছ।তাদের ছড়ানো ছিটানো ডালপালা দিয়েই আকাশটা আড়াল হয়ে রয়েছে।মাঝে মধ্য একটু আধটু রৌদ্র্যজ্জ্বল মেঘ উঁকি দিচ্ছে গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খানিকটা আচ্ছন্ন হয়ে পরে তোহা।আকাশের দিকে চেয়ে আনমনেই তিহানকে প্রশ্ন করে,
—“আচ্ছা,মেঘময়ূরী মানে কি?”

ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তোহাকে দেখে নিলো তিহান।তারপর শান্ত শীতল স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,
—“মেঘময়ূরী মানে”তুমি”।তুমিই মেঘময়ূরী।”

—“আহা,বলুননা এটার অর্থ কি?”অধৈর্য কৌতুহলী শোনায় তোহার কন্ঠ।

তিহান আবারো হেসে ফেলে।গাড়ির গতি কমিয়ে তোহার দিকে চেয়ে বলতে থাকে,
—“মেঘময়ূরী হচ্ছে মেঘের রাজ্য বিরাজ করা এক অনন্য ময়ূরপরী।যার সর্বাঙ্গে ছেঁয়ে আছে ঘোরলাগা সৌন্দর্য।যার দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।দৃষ্টি ফেরানো দায়।আমি হলাম সেই মেঘ আর তুমি হচ্ছো আমার রাজ্য বিরাজ করা সেই অতিসুন্দরী রমণী।বুঝলে?

প্রত্যত্তুর না করে চোখ বন্ধ করে ফেললো তোহা।হঠাৎ এমন ঘুম ঘুম পাচ্ছে কেনো?অতিশান্তি তে কি সব মানুষের ঘুম আসে?নাকি শুধু তারই?

________________
তাদের গাড়ি থামার পরে বাকিদের দুটো গাড়ি পিছনে থামে।সুতরাং তারাই আগে পৌঁছেছে।
তিহান ব্যস্তহাতে নিজের সিটবেল্ট খুলে তোহার সিটবেল্ট খুলে দিতে দিতে ঝাড়ি দিয়ে বলে,

—“আমরাই সবার আগে পৌঁছেছি।অযথাই দেরি হবে দেরি হবে করে মাথা খাচ্ছিলি আমার।”

তোহা ভ্রু কুচকে তাকায়।প্রতিবাদী স্বরে বলে,
—“আমি একবারই বলেছি।তাতেই আপনার মাথা খাওয়া হয়ে গেলো?”

—“হ্যাঁ,হয়ে গেলো।”বলে তোহার পাশের দরজা খুলে দেয় তিহান।বলে,”নাম,আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।”

তোহা নামতেই পেছন থেকে এগিয়ে আসে সবাই।তার দিকে চোখ বুলিয়ে সর্বপ্রথম অনন্ত জিজ্ঞেস করে,
—“তোহা,আসার সময়তো তোমার কানে দুল দেখলাম না।এখন কোথা থেকে এলো?”

তার সাথে সাথে নিশাও ভ্রু কুচকিয়ে সন্ধিহান কন্ঠে বলে,
—“তাই তো।তোর তো এমন দুলও নেই।”

বিপাকে পড়ে যায় তোহা।তাদেরকে তো আর বলতে পারবেনা এটা যে তিহান দিয়েছে।কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে সে বলে,
—“আসলে..এটা…”

—“মার্কেটের সামনে জ্যামে আটকেছিলো গাড়ি।গাড়ি থেকেই পাশের দোকানে দুলটা চোখে পরতেই কেনার জন্য জেদ করছিলো তাই বাধ্য হয়ে কিনে দিলাম।তোর বোনতো আবার কিছু না দিলে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।জানিসইতো?”পেছন থেকে এসে কথাটা বলে বিদ্রুপাত্মক হাসলো তিহান।

নিশাও তার সাথে হেসে বললো,
—“সে তো ছোটবেলায় কাঁদতো তিহান ভাই।এখন তো বড় হয়েছে।আপনি না কিনে দিলেও পারতেন।শুধু শুধু টাকা নষ্ট।”

—“আমি হলেতো ওকে ওখানের সবকটা কানেরদুল কিনে দিতাম।আপনি তো মাত্র একটা কিনে দিয়েছেন”খানিকটা তাচ্ছিল্য মেশানো স্বরে বললো অনন্ত।

তোহা একরাশ বিরক্তি নিয়ে অনন্তের দিকে চাইলো।এই লোকটা সবসময় বেশি কথা।সেই দুপুর থেকে একটু একটু করে একেবারে অসহ্যকর হয়ে উঠছে লোকটা।কড়া কিছু কথা শোনাতে গিয়েও সৌজন্যতার খাতিরে চুপ করে গেলো সে।

অনন্তের কথায় তিহান চমৎকার করে হেসে স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
—“তিহু আসলে অপচয় একদমই পছন্দ করেনা।আর বাড়াবাড়ি করা তো সহ্যেই করতে পারেনা।”

তিহানের ঠান্ডা মাথার অপমানটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা অনন্তর।তথাপি কোনো জবাব দিলোনা সে।
তবে মুখে অপমানের রাগটা ফুটে উঠলো।মনে মনে হাসলো তোহা।লোকটাকে অপমান হতে দেখে বেশ ভালো লাগছে এখন।
____________
রেস্টুরেন্টটা অনেক খোলামেলা।খোলামেলা বলতে ছাদের উপর চেয়ার টেবিল গাছপালা দিয়ে খুবই সুন্দর মনোরম পরিবেশ।নয়তালার উপর হওয়ায় মৃদু হিমেল হাওয়া বইছে।রেলিংয়ের পাশে বসেনি তোহা।উঁচুতে ভয় লাগে তার।সে বসেছে তিহান আর তূর্যর মাঝে।তার মুখোমুখি বসেছে অনন্ত।তার বাঁকা চাহনীতে রীতিমত গা জ্বলে যাচ্ছে তিহানের।ওয়েটার মেনু দিয়ে যেতেই খাবার পছন্দ করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো সবাই।
ওয়েটারকে দুটো পিজ্জার অর্ডার নিতে বলতেই তিহান বললো,
—“সাথে একটা চিকেন রাইস আর ওয়াইট সস পাস্তা।”

অনন্ত কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বললো,
—“আপনি পিজ্জা খাননা ভাইয়া?”

ফোন থেকে চোখ উঠালো তিহান।হেসে বললো,
—“তিহুর মাশরুমে এ্যালার্জি।পিজ্জায় মাশরুম থাকবে তো।সেজন্যই আরকি।”

অনন্ত এবার তোহাকে বললো,
—“আর ইউ শিওর তোহা?তুমি ওগুলাই খাবে?নাকি অন্যকিছু?”

একপলক তিহানের দিকে তাকালো তোহা।তাকে ফোনে ব্যস্ত দেখে মুচকি হেসে বললো,
—“জি,আমি ওগুলাই খাই।অন্যকিছু না।”

মুখটা চুপসে গেলো অনন্তের।ওয়েটার অর্ডার নিয়ে যেতেই ছবি তোলার জন্য জন্য সবাইকে দাড়া করালো নিশা।
অনন্ত সুযোগ পেয়ে পেছন থেকে তোহাকে স্পর্শ করতেই তোহার বাহু টেনে তাকে তূর্যর সামনে দাড় করিয়ে দিলো তিহান।অত:পর নিজে তূর্যর পাশে দাড়িয়ে খুব সন্তর্পনে জায়গাটা লক করে ফেললো।ছবি তোলা শেষ হতেই চুপচাপ অনন্তের দিকে এগিয়ে শান্ত ধীরস্হির কন্ঠে বললো,
—“স্টে ইন ইউর লিমিটস্।
___________________
সন্ধ্যা শেষে রাত নামতে চলেছে।ফেরার পথেও তিহানের সাথেই আসছে তোহা।গাড়ির ভিতরে হলুদ লাইট জ্বালানো।
এলোমেলো চুলে নিষ্প্রভ নয়নে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে তোহা।তার চুলের খোঁপা একটু আগে আবারো খুলে দিয়েছে তিহান।এবার আর কাঁটাটা ফেরত দেয়নি।বলেছে গাড়ি থেকে নামার আগে দিবে।তার আগে না।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই তিহান বলে,
—“তিহু দেখতো ড্রয়েরে পানি আছে নাকি?”

—“পানি দিয়ে কি করবেন?”

—“নিশ্চয় তোর মাথায় ঢালবোনা।খাবো অবশ্যই।গাধী কোথাকার!”

মুখ লটকিয়ে গাড়ির সামনের ড্রয়ারটা খুলে তোহা।কোঁণায় একটা পানির বোতল দেখতে পেয়ে বলে,”আছে।”

—“মুখটা খুলে দে।”ক্লান্ত কন্ঠ তিহানের।

বোতলের মুখটা খুলে তোহা।অত:পর তিহানের মুখের কাছে বোতলটা ধরে নিরস কন্ঠে বলে,
—“হা করুন।আপনিতো ড্রাইভ করছেন।আমি খাইয়ে দেই।”

তিহানের ঠোঁটের কোঁণে এক চিলতে হাসি দেখা যায়।হাসিটা চোখ এড়ায়না তোহার।বরং চোখে আটকে থাকে।

তিহান মুখ হা করতেই একটু ঝুঁকে গিয়ে খুব যত্ন করে তাকে পানি খাইয়ে দেয় তোহা।তবুও অসাবধানতায় একটু পানি চিবুক গড়িয়ে গলা অবধি পৌছে যায়।সেদিকে চোখ পরতেই পানির বোতলটা রেখে তিহানের আরো একটু কাছে এগিয়ে যায় তোহা।নিজহাতে তিহানের চিবুক আর গলা মুছিয়ে দিতে দিতেই বুঝতে পারে তার চুলের ভাঁজে কারো পাঁচআঙ্গুল ডুবে গিয়েছে।মুখ তুলে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তিহানের দিকে তাকাতেই তিহান তার ধূসর সম্মোহনী দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে প্রগাঢ়,ভরাট কন্ঠে বলে,

—“আমার এতটা কাছে এসোনা মেঘময়ূরী।তোমাকে ছোঁয়া নয় বরং ‘অনুভব’ করাটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”

~চলবে~