এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-৩০+৩১

0
848

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩০

কাঁঠালগাছের বড় বড় ডালের ফাঁকফোকর থেকে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক কানে ভাসছে।সেই মধুর সুরেলা কলতানেই ঘোর কাটলো তিহানের।তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি নামিয়ে তোহার থেকে একটু দুরত্ব নিয়ে দাড়ালো সে।
তিহান সরতেই হাতের ফুলগুলো মাটিতে রেখে মাথায় পুনরায় ওড়না টেনে নিলো তোহা।লজ্জায় লালাভ আভা এসে পরেছে দু’গালে।পকেট থেকে ফোন বের করলো তিহান।সময়টা দেখে নিয়ে মাথা বাকিয়ে দু’আঙ্গুলে কপালের কোঁণ ঘষে বললো,
—“আমি বাইরে বেরোবো,তুই যাবি সাথে?”

তোহা তাকালো।তিহান তার উওরের আশায় প্রশ্নাত্মক চাহনী নি:ক্ষেপ করে চেয়ে আছে।তোহার উওর না পেয়ে ভ্রু উচিয়ে আবারো ইশারা করলো তিহান।একটু আগালো তোহা।কিছু না বলে তিহানের হাত আঁকড়ে ধরতেই মুচকি হাসলো তিহান।নিজেও তোহার হাতের মুঠোটা শক্ত করে ধরে গেটের দিকে হাঁটতে লাগলো।
তিহানের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই তোহা বললো,
—“এই ভোরবেলা কোথায় যাবেন?”

—“একটু হাঁটবো।ভোরবেলা গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটার একটা অদ্ভুত শান্তি আছে।বুঝলি?”

—“আপনি কিভাবে জানেন?আপনি তো শহরে থাকেন।”

—“আমি কি তোর মতো বাচ্চা নাকি?আজ পর্যন্ত হুটহাট কত জায়গা ঘুরতে গিয়েছি কোনো হিসাব আছে?এই গ্রাম বাংলার প্রকৃতি আমার ঢের চেনা আছে।তোর মতো ঘরকুনো ব্যাঙ নাকি আমি?গাধা!”বলে একহাতে নি:শব্দে লোহার মেইন গেটের হাঁতল ঘুরালো তিহান।ঠোঁট চেপে ধরলো তোহা।কোনরকম শব্দ ব্যায় না করে গেটটা খোলা হয়ে যেতেই কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

—“গেট খোলাই থাকে সারারাত?”

—“নাহ্,আমি মোসতাক চাচাকে বলে খুলিয়েছি।”

চকিতে আশেপাশে তাকালো তোহা।তার অস্থিরতা ভরা ভীত দৃষ্টি দেখে তিহান স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

—“শান্ত হ,উনি নেই এখানে।গেট খুলে দিয়ে চলে গেছে।এখন হয়তো নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে।”

তিহানের কথায় ছোট্ট করে স্বতিদায়ক একটা শ্বাস ছাড়লো তোহা।তিহান হাসলো।তোহার হাত টেনে তাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে মৃদু কন্ঠে বললো,

—“এত ভয় পাও কেনো?তোমার অসম্মান হবে এমন কিছু আমি কখনোই করবোনা।ভরসা রাখো।”
______________

গ্রামের মাঝারি প্রসস্তের রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তারা।কোন কথা নেই দুজনের ঠোঁটে তবু নিরবতার মধ্যেও যেনো হাজারো ভালোবাসার নিখুঁত নিস্তব্ধ বহি:প্রকাশ।এলোমেলো হাওয়া বইছে।ঠান্ডা শীতল ভোরের মাতাল হাওয়া।তারা হাঁটছে বেশ অনেকক্ষন যাবত।সকাল হয়েই গেছে প্রায়।দু একজন মানুষের আনাগোনাও শুরু হয়েছে।এতক্ষণ বেশ ভালো লাগলেও এখন রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে তোহা।পা ব্যাথা করছে।
উপায়ন্তর তিহানের দিকে তাকালো সে।লোকটা নির্বিকার।কোনরকম অলসতা না নিয়ে অনায়াসে হেঁটে চলেছে।
মুঠো বন্দি থাকা ঘামে ভিজে যাওয়া হাতটা নাড়ালো তোহা।কাতর কন্ঠে ডাকলো,
—“তিহান ভাই..”

তিহান ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো।মূহুর্তেই দৃষ্টি সরিয়ে বাঁকা হেসে ব্যাঙ্গ করে বললো,
—“এটুকুতেই ক্লান্ত!সাধেই কি তোকে ঘরকুনো ব্যাঙ বলি?”

মুহূর্তেই চোখের দৃষ্টি আগুন হয়ে গেলো তোহার।তিহানের হাতটা ঝাঁড়া মেরে সরানোর চেষ্টা করে সে উত্তপ্ত কন্ঠে বললো,
—“আপনি আমাকে বারবার “ব্যাঙ” বলেন কেনো?আমি কি আপনার মতো বুড়ো নাকি যে সবজায়গায় একা একা ঢিংঢিং করে ঘুরে বেড়াবো?খালামনি কে বলে আপনার ঘোরাঘোরি বন্ধ করতে হবে।”

এক ভ্রু উচিয়ে বাঁকা চোখে তাকালো তিহান।তোহার তখনো তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।সরু চোখে সেদিকটা দেখে নিয়ে একটানে তার হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো তিহান।চোখে চোখ রেখে বললো,
—“কি বললি?আবার বলতো?সেইম টোনে বলবি ওকে?”

তোহা থামলো।ছাড়ানোর জন্য নাড়াতে থাকা হাতটা নিস্তেজ হয়ে তিহানের হাতের মাঝে আবদ্ধ হয়ে রইলো।দৃষ্টি ঘুরালো সে।বিরবির করে বললো,
—“আপনি সত্যি সত্যিই একটা অসহ্য।”

তবে এরপর আর বেশিক্ষণ চললোনা তাদের পদচারণ।একটা রিকশা ডেকে সেটায় তোহাকে নিয়ে উঠে বসলো তিহান।শত হলেও,প্রেয়সীর পায়ে ব্যাথা করছে।প্রেমিক কি তা সহ্য করতে পারে?
_______________
শুক্রবারের উৎসবমুখর দুপুর।
খানিক আগেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে তোহা।পরণে কাঁচা হলুদ রংয়ের একটা সুতির জামা।চুলগুলো আধভেজা।স্বর্ণালী দাড়িয়ে আছে জানলার ধার ঘেঁষে।তার হাতে একটা লাল রংয়ের বোতল।ভ্রু কুচকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে সেটাই উল্টে পাল্টে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সে।

—“কি ওটা আপু?এভাবে দেখছো যে?”

—“নানুতো বললো,আলতা।”ছোট্ট করে উওর দিলো স্বর্ণালী।

—“কি বললে?আলতা?”বলেই বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো তোহা।স্বর্নালির কাছে যেয়ে বোতলটা হাতে নিয়ে মুখ খুললেই লাল রংয়ে আঙ্গুল মেখে গেলো।আৎকে উঠলো সে।বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলেও স্বর্ণালির সামনে তা প্রকাশ না করে চুপচাপ বোতলটা আটকে ওয়াশরুমে যেয়ে হাত ধুঁয়ে আসলো।

বাড়ির ছেলেরা এখন বাসায় নেই।সবাই পান্জাবি পরে নানার সাথে মসজিদে গেছে।খালুরাও নেই।
সেজন্য তারা দুজন নেমে রান্নাঘরের দিকে গেলো।স্বর্ণালির হাতে এখনো আলতার বোতলটা বিদ্যমান।রান্নাঘরে আফিয়া আতিয়া নানু সবাই আছে।তারা দুজনও বসলো।তবে খানিকবাদে সেখানটায় আর মন
টিকলোনা তোহার।একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন পাশের তাঁকের উপর রাখা বোতলটার দিকে চেয়ে থাকলো সে।মনের মধ্য তখন আলতা পরার অদম্য ইচ্ছা জেগে উঠছে আস্তে আস্তে।

কাঁঠালগাছের নিচের বসার জায়গাটায় পা তুলে বসেছে তোহা।তার একহাতে আলতার বোতল।আরেকহাত লাল রংয়ে মাখামাখি।হলুদ রংয়ের জামাকপড় পর্যন্ত মেখে যাচ্ছে তবুও আলতা পরার তীব্র জেদ পেয়ে বসেছে তাকে।মূলত এটা কোন কঠিন কাজ না তবুও প্রথমবার করার কারণে তা ঠাওর করতে একবারেই অপারগ তোহা।কালো ভ্রু জোড়া কুচকে আছে।বাচ্চাদের মতো চেপে রাখা ঠোঁটে বিরক্তির আভাস।
একপর্যায়ে বেশ অনেক গুলো আলতা ঢেলে দেয়ায় তা পায়ের কোণা গড়িয়ে টুপটুপ করে ঘাসের উপর পরতেই একটা শক্তপোক্ত হাত তার পা টা টেনে নিলো।চমকিয়ে তাকালো তোহা।তিহানের পরণে সাদা পান্জাবি।মাত্রই বোধহয় ফিরেছে সবাই।
তিহানের একহাতে পানির বোতল।আশেপাশে তাকিয়ে পা সরিয়ে নিতে চাইলো তোহা।তিহান দিলোনা।
পানির বোতল থেকে পানি ঢালতে ঢালতে আর অপরহাতে আলতাগুলো ডলে ডলে উঠাতে উঠাতে বললো,

—“যেটা পারিসনা সেটা করিস কেনো?ভরদুপুরে আলতা পরার শখ হয়েছে?ইডিয়ট।”

তোহার খারাপ মেজাজ আরো বিগরে গেলো।দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো,
—“আপনার কি সমস্যা?আমার পা,আমি আমার হাত দিয়ে পরছি আপনার কি হয়েছে?”

তোহার রাগত কন্ঠের বিপরীতে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো তিহান।ভেজা পা টা রুমাল দিয়ে মুছিয়ে দিতে দিতে তোহার দিকে তাকিয়ে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে কন্ঠে হাসির রেশ টেনেই বললো,
—“পরতে আর পারছো কই “হলদেপাখী”?”বলে তোহার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে নিলো সে।নিজের হাঁটুর উপর তোহার পা রেখে নিজের একআঙ্গুলে আলতা ভরিয়ে সুন্দর করে নিখুঁত ভাবে পরিয়ে দিতে লাগলো।
কয়েকফোঁটা গড়িয়ে পরলো তার ধবধবে সাদা পান্জাবিতে।সেদিকে ভ্রক্ষেপ করলোনা তিহান।একমনে আলতা পরানোর ধ্যানে নিমজ্জিত সে।

হঠাৎই সামনে নিজাম রহমান কে দেখে পিলে চমকে উঠলো তোহার।সে এদিকেই এগিয়ে আসছে।তৎক্ষণাৎ তোহা এক ঝটকায় পা সরিয়ে নিতে গেলেও তিহান বাঁধা দিয়ে বললো,
—“সমস্যা কি?”

উওরে তোহা ভীত ভীত কন্ঠে চাপা গলায় বললো,
—“পা ছাড়ুন।নানা আসছে এদিকেই।ও আল্লাহ!”

নানার কথা শুনেও বিন্দুমাত্র বিচলিত দেখালোনা তিহানকে।তোহা তখন মাথা নিচু করে রেখেছে প্রচন্ড ভয়ে।লোকটা নির্ঘাত তাকে তুমুল লজ্জায় ফেলবে আজ।এরই মাঝে তাদের একদম কাছাকাছি এসে উপস্থিত হলো নিজাম রহমান।

~চলবে~

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩১

গাম্ভীর্যতার ছিঁটেফোটাও নেই নিজাম রহমানের সারামুখে।বরং ঠোঁটের কোঁণে ঝুলছে মুচকি হাসি।তোহা তখনো ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে।নিজাম রহমান নাতনির নতমুখের দিকে চেয়ে স্বশব্দে হেসে পাশে বসলেন।তোহার ডানপায়ে আলতা পরানো ইতিমধ্যেই শেষ করেছে তিহান।পা টা নামিয়ে রেখে নিজাম রহমান হাস্সোজ্জ্বল মুখের দিকে চাইলো সে।তারপর একেবারেই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—“বাচ্চা মানুষতো ‘নানা’,পড়তে জানেনা।তাই আরকি।”বলে অবিলম্বে তোহার বামপাটা নিজ হাঁটুর উপর তুলে নিলো।

নিজাম রহমান আবারো হাসলেন।খানিকটা দুষ্টুমি করে ফিচলে গলায় বললেন,
—“মনোয়ারা কেও আমি এভাবে আলতা পরিয়ে দিতাম।”

কথাটা শোনামাত্রই হেসে ফেললো তিহান।চমৎকার সুন্দর নজরকাড়া হাসি।সুপুরুষ চেহারার মাঝেও কোথায় যেনো একটু লজ্জাভাব লুকিয়ে আছে।অপরদিকে তোহার তখন ঘোরতর লজ্জায় আর ঘটনার আকস্মিকতায় অজ্ঞান হবার অবস্থা।মনোয়ারা তাদের নানুর নাম।তথাপি নানার কথার মানে,ইঙ্গিত,ইশারা বুঝতে কোনোরকম কষ্ট হয়নি তার।

—“তোমার না নানুর সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিলো?তবে?”নিছক কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করলো তিহান।

—“বিয়ের পর প্রেম করা যায়না বুঝি?তোমাদের নানু খুব লাজুক ছিলো বুঝলে।বিয়ের দু”তিনমাস অবধি প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনি আমার সাথে।আমি তখন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক।বুকে একসমুদ্র প্রণয়ের ঢেউ। রাতের বেলা বাড়ি ফেরার সময় আলতা,শাড়ি,চুড়ি নিয়ে আসতাম।পাগলামি করতাম।তোমাদের নানু মুখ বুজে সহ্য করতো।আরক্তিম লাল আভায় ছেঁয়ে যেতো তার গাল।তারপর ধীরে ধীরে তার লজ্জা কাটলো।বউ হলেও কয়েকমাস পর্যন্ত ব্যাক্তিগত প্রেমিকাই ছিলো সে আমার।”

—“আরে বাহ্ নানা।তুমি দেখি…”বলেই দুই ভ্রু দুবার উঁচিয়ে দুষ্টুমি করলো তিহান।নিজাম রহমান হেসে আস্তে করে তিহানের কাঁধে চাপড় মারলো।এদের দুজনকে একসাথে দেখে ভালোলাগায় ভরে উঠছে মন।
মনে চাচ্ছে এখনই বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে।তবে তিহানের সাথে আগেই কথা হয়েছে তার।তাই এ বিষয়ে এখন আর কিছু বললেন না।তাছাড়া তার নাতনি টাও বেশ লাজুক।মৃদু হেসে তিনি তোহার মাথায় হাত রেখে স্নেহের সহিত বললেন,
—“তুমি অনেক ভাগ্যবতী মা।এমন যত্ন সবার ভাগ্যে থাকে না,বুঝলে?”

উওরে মৃদুভাবে মাথা নাড়ালো তোহা।নানা-নাতির লাগামহীন কথাবার্তায় রীতিমত লজ্জায় মাথা কাঁটা যাবার মতো অবস্থা তার।এমন একটা লজ্জাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে জানলে কস্মিককালেও এখানে বসে আলতা পরতোনা সে।
এরই মাঝে তিহান যেন তাকে আরো একটু লজ্জার হাবুডুবু খাওয়াতে নিজের হাত বাড়িয়ে বললো,
—“হাতটা..”

মুখটা একটু তুলে চোখ রাঙিয়ে তিহানের দিকে তাকালো তোহা।সেই চাহনী যেনো আগুন ঝলসানো কন্ঠে বারবার বলছে,”আপনার কি একটুও লজ্জা নেই?”
তিহান নির্লজ্জের মতোই হাসলো।নিজেই তোহার হাতটা টেনে আঙ্গুলের উপর অংশগুলায় আলতা ভরাতে শুরু করতেই লজ্জায় ঠোঁট চেপে ধরলো তোহা।মনে হচ্ছে এখন ছুটে চলে যেতে পারলে ভালো হতো।তবে এমনটা করলে খুবই বিশ্রি বেয়াদবি হবে।
তোহার অসস্তি বুঝতে পেরেই উঠে দাড়ালেন নিজাম রহমান।যাওয়ার আগে তিহানের এককাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে বললেন,
—“প্রণয়ের পথটুকুতো অনেক চলেছো,এবার একটা স্হায়ী গন্তব্য পৌঁছানো উচিত কিন্তু।অন্তত আংটি টা পরিয়ে রাখলে..”

—“আচ্ছা,আমি ভেবে দেখবো নানা”।মাঝপথেই ধীরকন্ঠে উওর দিলো তিহান।

নিজাম সাহেব চলে যেতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তোহা।ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
—“আপনার কি মাথা গিয়েছে পুরো?নানার সামনে এমন করে কেও?না জানি উনি কি ভাবলো!আল্লাহ্”

—“তোমার কি মাথা গেছে?উনার কথা শুনে বুঝোনি কিছু?অদ্ভুত!”

—“এটাও তো আপনার কাজ।নির্লজ্জের মতো নানাকে বলেছেন..ছিহ্!”

—“আমি কিছু বলিনি।উনি এমনেই বুঝেছে।তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করেছে।…তোমার মতো ওতো লজ্জা নিয়ে থাকলে আমার আর তোমাকে পাওয়া লাগবেনা।”নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাটা বললো তিহান।তার এতটুকু কথাতেই কন্ঠনালি আটকে গেলো তোহার।পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিলো সে।তারপর আগেই মতোই অগ্নিকন্ঠে বললো,
—“আপনার কি দরকার ছিলো আমাকে সবার সামনে ওভাবে খাইয়ে দেয়ার?আবার আম্মু জিজ্ঞেস করলে উওর কি দিলেন?”আমিই খাইয়ে দিই খালামনি।ওর হাত মাখবে শুধু শুধু।”তিহানের মতো করে কথাটা বলে থামলো তোহা।পরমূহুর্তেই দ্বিগুন মেজাজ দেখিয়ে বললো,”আপনার কি আম্মুকে এতোটাই বোকা মনে হয়?”

তোহার কথাটায় প্রতিক্রিয়া দেখালোনা তিহান।ততক্ষনে তোহার চার হাতপায়েই তার আলতা পরানো শেষ।
আলতার বোতলটা বন্ধ করে বসার জায়গাটার উপর রাখলো তিহান।তোহার হাত পা লাল রঙে রাঙানো।
পরণে হলুদ কামিজ।মাথায় ঘোমটা।মনে হচ্ছে হলুদের আসরের কোন বউ পালিয়ে এসে হবু বরের সাথে প্রেমে মেতেছে।

তিহান একদৃষ্টিতে কিছুক্ষন কাঙালের ন্যায় চেয়ে থাকলো।অত:পর তোহার হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে মাথা অল্প ঝুঁকিয়ে হাতের উল্টোপিঠ নিজের কপালে ছুঁইয়ে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,

—“”দীর্ঘ প্রেমকাহন পূর্ণতা পাক।এই মূমূর্ষ প্রেমিকের অপেক্ষার অবসান হোক।তুমি শুধু আমার হও।”

______________
বারান্দার গোলাকার জায়গাটা ছেলে মেয়েদের খোশগল্পে মেতে উঠেছে।তোহা বসেছে রেলিংয়ের পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
তার পাশে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আছে তূর্য।অপরপাশে স্বর্ণালী।তিহান বসেছে সাইফ আর নুহাশের মাঝে।অনেকটা বৃত্তাকারেই আছে তারা।তোহা উদাসমুখে সাদা সচ্ছ আকাশের দিকে চেয়ে আছে।সাদা আকাশের প্রতিচ্ছবি পরেছে তার ঘনকালো হরিণী চোখদুটিতে।মনে হচ্ছে কোন গভীর কালো জলদিঘিতে সাদা শুভ্রপরী ডানা মেলে স্নান করছে।ঠোঁটের কোনটা একটু প্রসারিত হলো তিহানের।নুহাশের দৃষ্টি তখন আগাগোড়াই তোহার দিকে।ভ্রু কুঁচকে মজার ছলে সে বললো,
—“আলতা টালতা পরেতো একেবারে বৌ সেজে বসে আছিস তোহা?ব্যাপার কি?তূর্য ভাইয়া তোমার বোনের মতলব তো ভালো ঠেকতেছেনা আমার!”
নুহাশের কথায় হাসলো তূর্য।
—“কিরে?আলতা পরেছিস কেনো?”বলেই তোহার মাথায় হাল্কা চাঁটি মারলো তূর্য।এতক্ষণে ধ্যান ভাঙলো তোহার।কথাগুলো কানে ঢুকেনি তারউপর তূর্য আর নুহাশকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে আরো হতবিহ্বল হয়ে পরলো সে।নড়েচড়ে বসে বিচলিত কন্ঠে বলল,
—“কিছু বললে তোমরা?”

এবার যেনো আকাশের “চাঁদ” হাতে পেয়ে গেলো নুহাশ। কয়েকগুন উৎসাহ নিয়ে জোর গলায় সে বললো,
—“এবারতো একশো পার্সেন্ট শিওর ভাইয়া।তোমার বোন নির্ঘাত প্রেম করে।বেখেয়ালি হওয়াই এর প্রথম লক্ষণ।”

এবারো নুহাশের কথা হেসে উড়িয়ে দিলো তূর্য।তোহার মন তখন আবারো অন্যমনষ্ক হয়ে পরেছে।অকারণেই মন খারাপ লাগছে।মন ভালো থাকার হাজারটা কারণ থাকা সত্তেও এই “অকারণটা” সব দখল করে বসে আছে।

এরইমধ্য সবার জন্য চা দিয়ে গিয়েছে মনোয়ারা।বড় ট্রে তে চায়ের সাথে টোস্ট বিস্কিট।বিস্কিটের উপর চিনি দেয়া।খেতে বেশ স্বুস্বাদু।
গরম চায়ের কাপ হাতের তুলে নিলো তোহা।কাঁচের কাপের হাতলে না ধরে সরাসরি কাপের গাঁয়ে ধরার কারণে হাল্কা একটু ছেঁকাও খেলো আঙ্গুলে।তার সেদিকে মন নেই।সে ব্যস্ত শরতের আকাশের সাদা মেঘের ভেলা গুলো চোখের দৃষ্টিতে দেখেই একান্ত আপন করে নিতে।
ধ্যানহীন মস্তিষ্কে গরম কাপে চুমুক দিতে যেতেই কেউ হাতের কব্জি ধরে ফেললো তার।চকিতে তাকালো তোহা।
তিহান সাথেসাথেই তার হাত ছেড়ে গলার স্বর নামিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“গরম এখনো”।

দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তোহা।ভাবলো,আচ্ছা তার মন খারাপের সাথে কি কোথাও তিহানও জড়িয়ে আছে?পরমূহুর্তেই ভাবনাটা হেসে উড়িয়ে দিকে মনে মনে বললো,ধুর!এই লোকটাকে তার মন ভালো করার এক অবিচ্ছেদ্য কারণ।
______________
সন্ধ্যাবেলার আবছা অন্ধকার পুকুরপাড়।ভুতুরে নির্জন পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানটায় অনেক শান্তি আছে।পুরো বাড়ির একেবারেই কোঁণার দিকে বড় পুকুরটা।বারান্দার কোঁণার সাইড ঘেঁষে না দাড়ালে পুরোপুরি দেখা যায়না।স্হির স্বচ্ছ পানিতে এক দুইটা সবুজ পাতা ভাসছে।সবাই বাড়ির ভিতরে।ভরা আড্ডার আসর থেকে সে-ই নেমে এসেছে চুপিসারে।কারণ,মন ভালোনা।সব কেমন পানসে লাগছে।
পাড়ের দিকে এককদম এগোলো তোহা।পুকুরে মাছ থাকলে বেশ হতো।তবে এটায় মাছ টাছ নেই।শুধুমাত্র বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য খনন করেছে নানা।
যদিও অন্ধকার তবুও স্বচ্ছ পানিতে গভীর ভাবে তাকালে নিজেকে দেখা যায় নাকি তা দেখার জন্য কয়েক পা এগিয়ে যেতেই অসাবধানতায় হুট করে পিঁছলে গেলো তোহা।অত:পর পানিতে বিকট শব্দ তুলে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ…”

~চলবে~