#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২৮
____________
একটিমাত্র পুত্র সন্তান হুমায়ুন তালুকদারের। একটিমাত্র পুত্রবধূও। সুখের সংসার, ভরা সংসারের পরিবর্তে সংসারে নেমে এলো দুঃখ,অশান্তির সাথে শোচনীয় অবস্থা। ছেলের চেকআপ চলছে। জ্ঞান ফেরার পর কোন প্রকার অশান্তির সম্মুখীন যেনো হতে না হয় তাই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়নি। অপরিচিত কোন ডক্টরের শরণাপন্নও হয়নি। হ্যাভেনের বন্ধুমহলেরই একজন ডক্টরকে নিয়ে আসা হয়েছে। মাথায় পানি দিয়ে শরীর মুছে দেওয়ার ফলেই জ্ঞান ফিরে হ্যাভেনের। জ্ঞান ফিরতেই কেমন আকুল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চারদিকে। শেষে নিরাশ হয়ে চোখ বুজেও ফেলে। বুকচিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস। মস্তিষ্কে অনবরত বাজতে থাকে আহির বলা প্রতিটি তিক্ত সত্য বানী। মেয়েটি শুধু তিক্ত বানী শুনিয়ে যায়নি। বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে তাঁর অপারগতাকে। হ্যাঁ নিজ স্ত্রী কে যোগ্য সম্মান, যোগ্য ভালোবাসা দিতে ব্যার্থ হয়েছে সে। ব্যার্থ হয়েছে স্বামী হিসেবে ব্যার্থ হয়েছে বাবা হিসেবে। সে আহির দিকে মাত্র একটি আঙুল ওঠিয়েছিলো। কিন্তু বাকি চারটা আঙুল যে নিজের দিকে নিজেই নিজের অজান্তে তাক করেছিলো টেরই পায়নি। আহি সেই বাকি চারটা আঙুল ঠিক স্বচক্ষে দেখিয়ে দিয়েছে শুধু তাঁকে নয় তাঁর পরিবারের প্রত্যেকটি ব্যাক্তিকে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। আসল অপরাধী খুব নিখুঁত ভাবে চিহ্নিত করেও গেছে। একটুও খুঁত রাখেনি। অনুতপ্ততায় বুকের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে হ্যাভেনের। সত্যি যদি একটু স্বাভাবিক সে থাকতো, তিক্ত অতিতকে বর্তমানে টেনে না আনতো। জোর পূর্বক মেয়েটাকে নিজের জীবনে যখন নিয়েই এসেছিলো সম্পর্ক টাকে সম্মানের সঙ্গে যদি গ্রহণ করতো। নিজের বউয়ের প্রতি একটু যত্নশীল যদি হতো আজ এই দিন দেখতে হতোনা। নারীর সব সার্থকতা যেমন মা হওয়াকে কেন্দ্র করে পুরুষের সার্থকতাও তো বাবা হওয়াকে কেন্দ্র করে। তাহলে সে কেনো রূপসার আঘাতকে বয়ে বেড়াচ্ছিলো? হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে কেনো ওঠার চেষ্টা করেনি সে? আহির গর্ভে তাঁর অংশ স্বল্প দিন ঠাঁই পেয়েছিলো। এই স্বল্পতা দীর্ঘও তো হতে পারতো। কেনো সে মেয়েটিকে ভালোবাসলো না? ভালোবাসা বিহীন তাঁর সন্তান ও যে অভিমান করে তাঁর কাছে এলো না। ভালোবাসা বিহীন কোন কিছুই যে চিরস্থায়ী হয়না। কেনো সে একটি বারের জন্যও নিজের করা অন্যায়, নিজের করা ভুলগুলো টের পেলোনা? কেনো সে ভালোবাসলোনা তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী কে? বুকের ভিতর টা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে হ্যাভেনের।
এমন জ্বলন্ত মূহুর্তে চেকআপ করার পর যখন হ্যাভেনের চোখ দেখার জন্য এগিয়ে যায় ডক্টর মারুফ হ্যাভেন তখন ক্ষিপ্ত হয়ে তাকিয়ে মারুফের কলার চেপে ধরে। চিৎকার করে বলে ওঠে,
-‘ এই ডাক্তার! এমন কোন ওষুধের নাম লিখে দে যে ওষুধ সেবন করলে বউয়ের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় ‘।
হ্যাভেনের এমন আজগুবি কথাবার্তা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মারুফ। যদিও সে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তবুও হ্যাভেনের এহেন আচরণে না হেসে পারলো না। হ্যাভেনের হাত সড়ানোর চেষ্টা করতে করতে জোর পূর্বক হাসিটা চেপে রেখে বললো,
-‘ ভাই কলার ছাড়। আগে তোর পুরো সমস্যার কথা তোর মুখেই শুনি তারপর সমাধান দিচ্ছি ‘।
-‘ এই শালা! কি বললাম শুনিস নাই? বউয়ের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় কোন ওষুধ সেবন করলে নাম বল ‘?
হ্যারি,হিরা হ্যাভেনকে শান্ত করার জন্য ছুটে বিছানার পাশে এলো। হ্যারি হ্যাভেনের কাঁধ স্পর্শ করতেই হ্যাভেন মারুফের কলার চেপে ধরা অবস্থায়ই হ্যারির দিকে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। হ্যারির মুখটা ভীষণ ছোট হয়ে গেলো তখন হ্যাভেনকে ছেড়ে দিয়ে সে মাথা নিচু করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো পাশে। হিরাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ভাইদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবারো মারুফের দিকে দৃষ্টি ফেললো হ্যাভেন। এবার সকল অস্থিরতা কে বর্জন করে কেমন আকুতিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হ্যাভেন। মারুফ এক ঢোক গিলে ঠোঁটের কোনে জোর পূর্বক হাসিটি বজায় রেখে কিছু বলতে নিবে তাঁর আগেই হ্যাভেন আবারো বললো,
-‘ এই ডাক্তার এমন কোন ওষুধের নাম লিখে দে যা সেবন করলে বউয়ের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা উৎপন্ন হবে ‘।
এ কি পাগলামি কথাবার্তা বউয়ের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ওষুধ সেবন করবে হ্যাভেন তালুকদার? বউয়ের প্রতি প্রেম,ভালোবাসা উৎপন্ন করার জন্য কোন সাইনটিস্ট ওষুধ তৈরী করেছে বলেতো জানা নেই ডক্টর মারুফের। তাহলে তাঁর এমপি বন্ধু এসব কি ভুলভাল বকছে? সে যাইহোক না কেনো কোন সাইনটিস্ট যদি এমন কোন ওষুধ উৎপন্ন করতে নাও পারে হ্যাভেন তালুকদারের বংশধরকে দিয়ে হলেও এই অসাধ্য কে সাধন করা চাই। কেশে ওঠলো মারুফ। বললো,
-‘ আমার মনে হয় বিষয়টা যখন তোর মাথা থেকেই বেরিয়েছে তখন তুই না পারলেও এই অসাধ্য সাধন তোর ছানাপোনা দ্বারাই সম্ভব হবে ‘।
রুবিনা তালুকদার চোখের সামনে আবারো ছেলের এমন উদ্ভট আচরণ দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন। হুমায়ুন তালুকদার বিরক্তি তে চোখ,মুখ কুঁচকে ধমকে ওঠলেন। বললেন,
-‘ আহ রুবিনা কান্নাকাটি থামাও নয়তো এ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাও’।
স্বামীর ধমকে এবার ডুঁকরে কেঁদে ওঠলেন রুবিনা তালুকদার। হ্যারি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে স্বান্তনা দিতে নিলেই হ্যারির বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। হ্যারি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকলো,
-‘ কিছু হবেনা বড় মা সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক করে নেবো আমরা ‘।
রুবিনার ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পেয়ে মারুফের আর মজার মুড রইলো না। তাই বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে বললো,
-‘ তুই শান্ত হয়ে আমার কথা শোন পাগলামি করিস না। আমাকে তোর ট্রিটমেন্ট করার সুযোগ দে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবির সাথে তোর সম্পর্কও স্বাভাবিক হয়ে যাবে ছাড় আমায়। আমাকে আমার কাজ করতে দে ‘।
-‘ না ছাড়বোনা তুই তো ডাক্তার, বাবার টাকা খরচ করে ডাক্তারি বিদ্যা শিখেছিস আজ আমি দেখতে চাই তুই কেমন বিদ্যা শিখেছিস। আমি আমার রোগ বলবো আর তুই লিখবি প্রেসক্রিপশন। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ভাবে আমার বউকে ফিরিয়ে আনতে চাই আমি। বউ যদি আমার না ফেরে রে মেরে দিব তোকে আমি ‘। চোয়াল শক্ত করে ঘাড় ঘুরিয়ে রক্তিম চোখে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললো হ্যাভেন।
মারুফ দাঁত কেলিয়ে হেসে দিলো। বললো,
-‘ দোস্ত সত্যি বলছি তুই আমাকে ছাড় ওষুধ না দিতে পারলেও আমি যেহেতু বিবাহিত সেহেতু অনেক ধরনের প্রাকৃতিক টিপস দিতে পারবো ‘।
এটুকু বলেই থেমে গেলো মারুফ রুবিনা আর হুমায়ুন তালুকদারের জন্য বেশী মুখ খুললো না। হাজার হলেও বাবা,মা সমতুল্য তাঁরা। এটুকুই মুখ ফঁসকে বলে বেশ লজ্জা লাগছে তাঁর। তাঁর কথা শুনে হ্যাভেন তাঁকে ছেড়ে দিলো। কেমন যেনো চোখ, মুখ মিলিয়ে গেলো তাঁর। তবে বুঝলো ভিতরে ভীষণ ঝড় ওঠেছে। সে ঝড় কালবৈশাখী ঝরের থেকে কম নয়। আর এই ঝড় ততোক্ষণ থামবে না যতোক্ষণ না তাঁর অর্ধাঙ্গিনীকে কাছে না পাবে সে। হ্যারিকে চোখের ইশারায় কিছু বোঝালো মারুফ৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সকলে রুম ত্যাগ করলো। রুমে রয়ে গেলো শুধু হ্যাভেন,হ্যারি আর মারুফ। প্রায় একঘন্টা নাগাদ আলোচনা চললো তাঁদের ভিতর।
.
মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপ পড়ায় সেন্সলেস হয় হ্যাভেন। যেদিন রূপসার সঙ্গে জিসানকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছিলো সেদিনই প্রথম চাপটা পড়েছিলো মস্তিষ্কে। বিশ্বাসঘাতকতার কাছে পরাজিত হয়েছিলো তাঁর মন, মস্তিষ্ক দুটোই। কিন্তু ভালোবাসার কাছে কি করে পরাজিত হবে সে? রূপসা তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। একি সঙ্গে ভালোবাসার মানুষ এবং প্রিয় বন্ধুর করা বেঈমানীর শিকার হয়েছিলো সে। সে ধাক্কা টা তাঁর কাছে ভীষণ যন্ত্রণার হলেও। আহির দেওয়া ধাক্কা টা ছিলো ভীষণ অসহনীয়। অতিতে বিনাদোষে শাস্তি ভোগ করেছিলো সে। বর্তমানে দোষের অন্ত নেই তাঁর। এই দোষ,এই পাপ প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাবে তাঁকে। যে নারী বিশ্বাসঘাতকা করেছে,যে নারী বেঈমানী করেছে তাঁকে ছেড়ে থাকা তাঁকে ভুলে থাকা সম্ভব কিন্তু যে নারী ভালোবাসা,যত্ন দিয়ে আগলে রেখেছিলো তাঁকে ছেড়ে থাকা, তাঁকে ভুলে থাকা কি আদেও সম্ভব? রূপসা তাঁর সাথে বেঈমানী করেছিলো সেই বেঈমানীর জন্য তাঁকে ভয়ংকর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। আহিতো বেঈমানী করেনি। বরং তাঁর সকল হিংস্রতা কে দিনের পর দিন সহ্য করেছে। তাঁকে দিনের পর দিন আগলে রাখার চেষ্টা করেছে। ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে চেয়েছে তবে সেই ভালোবাসার বিনিময়ে তাঁকেও তো শাস্তি দেওয়া উচিত। বেঈমানীর শাস্তি যেমন ভয়ংকর হয় ভালোবাসার শাস্তিও ভয়ংকর হওয়া উচিত। বেঈমানীর শাস্তি যেমন ভয়ংকর বেঈমানী দিয়ে পুষিয়েছিলো ভালোবাসার শাস্তিও তো ভয়ংকর ভালোবাসা দিয়ে পোষানো উচিত। কিন্তু তাঁর যে ধৈর্য্য ভীষণ কম। ধৈর্য্য ধারণ করে ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভালোবাসা দিয়ে ঐ মেয়েটাকে কি করে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনবে?
ক্রমশ অস্থিরতারা আক্রমণ করতে থাকলো তাঁকে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে অস্থিরতায় ডুবে আছে হ্যাভেন। তাঁর বাম পাশে হ্যারি অত্যন্ত চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে। ডানপাশে মারুফ মোড়ায় বসে বিছানায় কনুই ভর করে দুহাতের ওপর মাথা ঠেকিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছে সমস্যা সমাধান করার। একদিকে সে একজন চিকিৎসক অন্যদিকে হ্যাভেনের বন্ধু দুইয়ে মিলিয়ে দায়িত্ব টা ভীষণ সিরিয়াস। এর মধ্যে মারুফ হ্যাভেনকে বশে এনেছে। হ্যাভেন মারুফকে কথাও দিয়েছে সে তাঁর এই বাজে অসুখের চিকিৎসা করবে। যে অসুখের জন্য তাঁর বউ তাঁকে ঘৃণা করে। যে অসুখকে কেন্দ্র করে তাঁর বউ তাঁকে নিজ সন্তানের হত্যাকারী অভিযোগ করে গেছে সেই বিশ্রি অসুখের চিকিৎসা সে অবশ্যই করবে। অবশ্যই সে তাঁর বউকে দেখিয়ে দেবে তাঁর মন,মস্তিষ্ক কোনটাই আর অসুস্থ নেই। সবশেষে অঢেল ভালোবাসা দিয়ে সম্মানের সাথে বউকে ঘরে তুলে প্রমাণ করে দেবে সে কাপুরষও নয়। সকলের ভাবনাচিন্তার অবসান ঘটলো মারুফের বিচলিত কন্ঠস্বরে,
-‘ হ্যারি এখুনি ভাবি কে কল কর এবং বল হ্যাভেন তাঁর চলে যাওয়া মেনে নিতে না পেরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে হসপিটাল ভর্তি রয়েছে। এও বল তুই নিজে তাঁকে নিতে যাবি ‘।
____________
সিএনজি থেকে নামতেই আজম খান দ্রুত এগিয়ে এসে ভাড়া মিটিয়ে মেয়ের কাঁধ চেপে ধরলেন। সিএনজিতে থাকা অবস্থাতেই সিএনজি ড্রাইভারের ফোন থেকে বাবাকে ফোন দেয় আহি। বাবা, মা ব্যাকুল হয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাঁদের আদরের প্রথম সন্তান আহি। হয়তো কোটি পটি নয় তাঁরা তবুও জন্মের পর থেকে মেয়ের কোন চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি। সবচেয়ে বড় কথা ভালোবাসা,আদর,যত্নে ত্রুটি রাখেনি। আদরের সেই সন্তান টা কে যখন জোর পূর্বক শহড়ের এক নেতার ছেলে বউ করে ঘরে তুললো ইচ্ছে থাকা সত্যেও প্রতিবাদ করতে পারেনি। বড় ঘরে তাঁদের মেয়ে সুখী হবে এই ভেবে খুশি হলেও বড় ঘরে যাওয়ার পদ্ধতি তে খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন তাঁরা। উপায় না থাকায় কিছু করতে পারেনি কখনো। কিন্তু মেয়ে ফিরে আসার খবর পেয়ে তাঁদের বুক থেকে পাথর নেমে গেছে। বাবা,মা হয়ে সন্তান কে রক্ষা করতে না পারার অপরাধবোধ যে তীলে তীলে শেষ করে দিচ্ছিলো তাঁদের। বাবাকে পেয়ে বুক ভেঙে চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইলো আহির। কিন্তু তাঁকে যে কাঁদলে চলবেনা। নিজেকে শক্ত রাখতে হবে। অনেক কঠিন সময় পাড়ি দিতে হবে এখন তাঁকে। লড়াই করতে হবে নিজের আত্মসম্মান কে গড়ে তোলার লড়াই। নিজের মর্যাদা রক্ষা করার লড়াই সর্বোপরি নিজের প্রতি হওয়া সকল অন্যায়ের জন্য অন্যাকারীর বিরুদ্ধে লড়াই। একদিকে প্রিয় অপর দিকে অপ্রিয় একদিকে ভালোবাসা অন্যদিকে ঘৃণা এই লড়াই যে ভীষণ কঠিন! নিজেকে তৈরী করতে হবে তাঁকে প্রস্তুত করতে হবে নিজেকে। প্রিয়র চেয়েও অপ্রিয় ঐ মানুষটার অপরাধের সঠিক শাস্তি প্রদানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। অনুভূতি কে আঘাত করার মতো বড় শাস্তি পৃথিবীতে আর দুটি হতে পারেনা। তাঁর হিসেবে যদি খুব একটা ভুল না হয় তবে সে সময় এসে গেছে খুব শিঘ্রই তাঁর প্রতি হওয়া সকল অন্যায়ের জবাব পাবে ঐ ভালোবাসায় ঘেরা ঘৃণ্য মানুষ টা।
.
বাড়িতে ঢুকতেই ছোট বোন দৌড়ে এসে জাবটে ধরলো।
শরীর দূর্বল থাকায় টাল সামলাতে না পেরে দু’কদম পিছিয়ে গেলো আহি তবুও বোনকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লূত হয়ে কেঁদেই ফেললো। বোনের গালে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। শক্ত করে জরিয়ে ধরে ভাঙা আওয়াজে বললো,
-‘ আমার অনা, আমার অনা কতো বড় হয়ে গেছে আমার অনা! ও আব্বু দু’বছর কি অনেক বেশী সময় আমার অনা বড় হয়ে গেলো আর আমি দেখতেও পারলাম না ‘।
-‘ আপু ‘ বলেই ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো অনা।
আহির মা সাজি এসে দু’মেয়েকে একসঙ্গে জরিয়ে ধরে স্বামীর দিকে তাঁকিয়ে ভেজা গলায় বললো,
-‘ দেখেছো আমার পাগলী মেয়েদের কান্ড! এইভাবে কেউ কাঁদে? দেখি অনা সড় তো দেখি আমার কলিজাটার মুখটা দেখি ভালো করে ‘।
অনা চোখের পানি মুছে সড়তেই আহি ঠোঁট ফুলিয়ে আম্মু বলে ডুঁকরে কেঁদে ওঠলো। সাজিও মেয়েকে বুকে জরিয়ে অনেকসময় কাঁদলো। বললো,
-‘ মারে আমার প্রতিটা রাত নির্ঘুম ছিলো। তোর আব্বু গত দুবছর ধরে খাওয়া-দাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিছে। মানুষ টা ভিতরে ভিতরে খুব অপরাধবোধে ভোগে আমরা কেউ ভালো ছিলামনারে মা’।
-‘সাজি মেয়েটারে ঘরে নিয়ে বসতে দাও খেতে দাও। কথা বলার অনেক সুযোগ পাবে যাও ঘরে যাও ‘।
আহি মা’কে শক্ত করে জরিয়ে বুকে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো ফোঁপাচ্ছে। সাজি মেয়ের এমন ফোপাঁনোতে চমকে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলো,
-‘ সোনা মা ও মা কি হয়েছে এমন করে কান্না করো কেনো, মায়ের কোলে ফিরে কাঁদতে হয় না তো মা হাসতে হয় ‘?
মা মেয়ের আবেগি মূহুর্তেই আজম খেয়াল করলো আহির পড়নে শুধু শাড়ি একটা গয়না গায়ে নেই এমনকি নাকের ফুলটা অবদি না। সাজিও মেয়ের মুখ তুলে আদর করতে গিয়ে নাক খেয়াল করলো সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে ওঠে বললো,
-‘ আহি রে এটা কি ‘?
আহি মায়ের আঁতকে ওঠার কারণ বুঝতে পেরে থেমে গেলো। আচমকাই কান্না থামিয়ে মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে ঘরের দিকে চলে গেলো।
.
সাজি দুই মেয়ের জন্য খাবার বেড়ে টেবিলে রাখছে। অনেকদিন পর ঘরটাকে ভরপুর লাগছে। দু’সন্তান তাঁর অথচ দুটো বছর এক সন্তান কাছ ছাড়া ছিলো। মায়ের মন যে কতোখানি উতলা হয়ে ছিলো তা বোধ হয় ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেনা সাজি। আগে মেয়েকে প্রাণ ভরে খাওয়াবে। দু’চোখ ভরে চেয়ে দেখবে তারপর মেয়ের যদি ইচ্ছে হয় কি হয়েছে বলতে তবে সে শুনবে। নিজে থেকে মেয়েকে কোন প্রশ্ন করে কষ্ট সে আর দেবেনা। আহি গোসল করে বের হতেই দেখতে পেলো অনা বাথরুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বোনটা কেমন বড় হয়ে গেছে। সিক্সে পড়ে এখন পড়নে মেরুন রঙের ভাটিকা থ্রি পিস। চুলগুলো ঘাড় ছেড়ে পিঠে পড়েছে। আহির মনে হচ্ছে তাঁর অগোচরেই বোনটা কতো বড় হয়ে গেলো। মুচকি হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বললো,
-‘ চল খুব খিদে পেয়েছে ‘।
অনাও খুব খুশি হয়ে বোনের হাত চেপে ধরে খাবার রুমে চলে গেলো। খেতে বসেছে কেবলই তখনি আজমের ফোনে অচেনা এক নাম্বার থেকে কল এলো। রিসিভ করতেই হ্যারি পরিচয় পর্ব সেরে আহির কথা জিগ্যেস করলো। আজম মেয়ের দিকে তাকাতেই দেখলো আহি চিন্তিত ভঙ্গিতে তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। অপেক্ষা না করে ফোনটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলো আজম। আহিও কোন বাক্যবিনিময় না করেই ফোনটা নিয়ে কানে দিলো।
-‘ হ্যালো কে ‘।
-‘ ভাবি মা আমি হ্যারি তুমি তো চলে গেলে এদিকে ভাইয়া খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে হসপিটালে ভর্তি। বার বার তোমার নাম নিচ্ছে আমি এখুনি তোমাকে নিতে আসছি তুমি তৈরী থেকো ‘।
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আহি। নিজের ভিতর পুষে রাখা দীর্ঘ নিঃশ্বাসটুকু ছেড়ে বললো,
-‘ অসুস্থ হয়েছে মরে তো যায়নি এতো উত্তেজিত না হয়ে ট্রিটমেন্টের ব্যাবস্থা করো। আর হ্যাঁ এমপি সাহেবকে বলে দিও গায়ের জোরে আমাকে নিতে পারলেও বুদ্ধির জোরে কখনোই পারবেনা। এটাও বলে দিও আমাকে গায়ের জোর ছাড়া আর কোন জোরেই তাঁর কাছে নিতে পারবেনা। সেটার জন্য মাথায় যে ঘিলুর প্রয়োজন সেটা অন্তত তোমার বড় ভাইয়ের নেই। আশা করি নেক্সট কেউ আমাকে বিরক্ত করবেনা। আমি অপেক্ষায় রইলাম তোমার ভাইয়ের নয় ডিভোর্স পেপারের’ বলেই দুম করে ফোন কেটে সুইচ অফ করে দিলো আহি।
চলবে..