কন্ট্রাক্ট অফ ম্যারেজ পর্ব-২৮

0
934

#কন্ট্রাক্ট_অফ_ম্যারেজ
Sadia afrin nishi
— পর্বঃ২৮
___________________

গাড়ি এসে থামল বিস্তর নদীর তীরে। এই নদীটি শহর থেকে কিছু টা দুরে অবস্থিত। জায়গা টা ভীষণ সুন্দর। নদীর চারপাশে খোলা আকাশের নিচে রেস্টুরেন্টের মতো আয়োজন করা। এই রেস্টুরেন্টের নাম “মুক্ত বাতাস আহারঘর”। এই রেস্টুরেন্টের একটা অদ্ভুত বিশেষত্ব হলো এখানে প্রতিটি টেবিলের চারপাশ ঘিরে আছে ফুলের সমাহার। এক কথায় ফুলের রাজত্ব এটা।খোলা জায়গা হওয়ার দরুন বাতাসের প্রবাহ সর্বক্ষণ লক্ষণীয়। এমন মনোরম পরিবেশে যে একবার আসবে নির্ঘাত আর বাড়ি ফিরতেই চাইবে না।

গাড়ি থেকে নেমে এমন একটা আশ্চর্য জায়গার সম্মুখীন হবে ভাবতেই পারেনি মৃধা আর আহিবা। দুজনেই ভীষণ অবাক। এমন জায়গাও হয়? তারা দু’জনে এতটাই অবাকতায় মশগুল যে তাদের সঙ্গে যে আদ্র, আয়ান আছে এটা তারা বেমালুম ভুলে বসে আছে। দু’জনে হাত ধরে অগ্রসর হচ্ছে সামনের দিকে। তাদের পেছন পেছন আসছে দুই ভাই। মৃধা সোজা চলে গেল একদম নদীর তীরবর্তী স্থানে। আহিবাও আছে তার সঙ্গেই। ওদের পাশে এসে আদ্র আর আয়ানও দাড়িয়ে পরল। মৃধা নিজের দুহাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। অতঃপর সকলেই মৃধাকে অনুসরণ করে এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যায়। প্রকৃতির অমাইক স্পর্শ নিরবে অনুভব করতে থাকে তারা।

___

ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন অর্ডার দিয়েছে আদ্র। মূলত আহিবার পছন্দে এই অর্ডার। এদিকে শুধু আইসক্রিম নিয়ে বসে আছে মৃধা। তার কাছে আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।
আয়ানও মৃধার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইসক্রিম নিয়ে বসে আছে। সবাই যে যার মতো খাচ্ছে আর পরিবেশ টা উপভোগ করছে। চারিদিকে একেবারে ফুলের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে।

খাওয়া শেষে আরেকটু ঘুরাঘুরির পর ওরা রওনা হয় বাসার উদ্দেশ্যে। সবার মনটা ভীষণ খুশি। কিন্তু কেউ কিছু মুখে প্রকাশ করছে না। একান্তে অনুভূতি সম্পন্ন সময় গুলো আসলেই মধুরতা মিশ্রিত।

___

দেখতে দেখতে কেটে গেছে আরও অনেক গুলো মাস । আজ সেই দিন। মৃধা আয়ানের বিয়ের এক বছর পূর্তি। কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী আজ তাদের একসঙ্গে পথচলার শেষ দিন। এমনটাই লেখা ছিল ওই কন্ট্রাক্টে।

আনমনে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মৃধা। মনটা তার বিষন্ন হয়ে আছে। আজ সারাটা দিন তার ঘরবন্দী হয়েই কেটেছে। অফিসেও যায়নি। ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটা। আয়ান এখনো বাড়ি ফেরে নি। অজানা ভয়ে ধুকপুক করছে মৃধার বক্ষঃস্থল। আয়ান কেন আজ সারাদিন বাড়িতে ফিরল না? আয়ান কী সত্যিই তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে? তাদের পথচলা কী এ পর্যন্তই শেষ?
এমনও হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মৃধার মস্তিষ্কে। মনটা যেন বিষিয়ে উঠছে বারংবার।

“মন খারাপ?”

পেছন থেকে গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠস্বর।মৃধা পেছন ফিরল না। সে চিনতে পেরেছে তার পেছনের মানুষটির কন্ঠ। কেন জানি আজ আয়ানের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না মৃধা। আয়ান যদি তাকে অনাকাঙ্খিত কিছু বলে বসে। এই এক বছরে মৃধা আয়ানের প্রতি পুরোপুরি দুর্বল হয়ে পরেছে। এখন যদি আয়ান কিছু বলে ফেলে তবে মৃধা শেষ। চোখ মুখ শক্ত করে আকাশের দিকে দৃষ্টি তার। আয়ান মৃধার থেকে কোনো প্রতিত্তোর না পেয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। অতঃপর সেও মৃধার পাশে এসে দাড়াল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,

“জানো মৃধা আমাদের জীবনে কখন কী হয় না হয় সেটা আমরা আগে থেকে কেউই বলতে পারি না। কখনো কখনো পরিস্থিতির চাপে পড়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা অনেক রকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই। আবার সময়ের পরিবর্তনে সে সকল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠে। এই মুহুর্তে তুমি ঠিক কী ভাবছ এটা আমি পুরোপুরি না জানলেও কিছু টা আন্দাজ করতে পারছি। তোমার এই ভাবনার যুক্তি আছে। তবে সকল পরিস্থিতিতে তোমার নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখতে হবে। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।”

আয়ান কথা শেষ করে চুপচাপ ঘরে চলে গেল। তারপর আলমারি থেকে কয়েকটি পেপার’স এনে মৃধার সামনে ধরল৷ মৃধা আঁতকে উঠল। তার চোখে জল চিকচিক করছে। তার মানে আয়ান তাকে সত্যিই ডিভোর্স দিতে চায়।ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার। মৃধার এমন অবস্থা দেখে আয়ান পেপার’স টা নিজের কাছে নিয়ে নিল। অতঃপর সবগুলো পেপার’স ছিড়ে আগুন জ্বালিয়ে দিল। হঠাৎ ঘটনায় মৃধা হতভম্ব। তার দৃষ্টি ভীত। পেপার’স গুলো পুড়া শেষ হতেই দুজনেই একটা প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে কোনো ভারী পাথর নেমে গেছে।

আয়ান মৃধার একদম নিকটে। মৃধা কয়েক কদম পিছিয়ে গেল অযথাই। আরও কিছু কদম ফেলার আগেই আয়ান তাকে খপ করে ধরে ফেলল। মিশিয়ে নিল বক্ষস্থলে। দুজনের মধ্যে আর কিঞ্চিৎ ফাঁক অবশিষ্ট নেই। দুজনে চেয়ে আছে দুজনাতে। কথা আছে অনেক কিন্তু কেউ কিছু চেয়েও বলতে পারছে না। সময়টা এখানেই থমকে যাক। থেকে যাক ঘড়ির কাঁটা। এভাবেই মত্ত থাকুক দুজন দুজনের চোখের মায়ায়।

হঠাৎই আয়ান মৃধাকে কোলে তুলে নিল খুব সন্তর্পণে। অতঃপর রুমের মধ্যে চলে গেল। শীতল স্পর্শে শুয়িয়ে দিল বিছানায়। নিজেও চেপে বসল মৃধার ওপর। মৃধার কানে মুখ নিয়ে বলল,

“ভয়ের কোনো কারণ নেই প্রেয়সী। এক বছর আগে ঝোঁকের বসে যে ভুল আমি করেছিলাম আজ নিজের সমস্ত আদর দিয়ে সেই ভুল শুধরে নিব। কখনো দুরে যেতে দিব না তোমায়। আই নিড ইউ মৃধা বিকজ আই লাভ ইউ সো মাচ।আর ইউ রেডি?”

মৃধার কলিজা কম্পমান। শরীর জুড়ে হিম শীতল বাতাস প্রবহমান। হৃদয় অজানা আবেশে ভাসমান। রাত যত নিবিড় হচ্ছে স্পর্শ তত গভীরে পৌঁছচ্ছে। অতঃপর দুজনেই মত্ত এক অজানার অতলে।

___

“দাদুভাই ডেকেছিলে আমায়?”

আদ্রের প্রশ্নে মুখ তুলে চাইলেন আফরোজ চৌধুরী। তিনি এতক্ষণ বসে বসে নামাজ শিক্ষা বই পড়ছিলেন। আদ্রকে তিনিই ডেকে পাঠিয়েছেন কিছু কথা বলবার জন্য। বইটি বন্ধ করে টি-টেবিলের ওপর রেখে দিয়ে আদ্রকে বললেন,

“হুম ডেকেছি। তোমার সাথে ইম্পর্টেন্ট কিছু কথা আছে।”

“বল দাদুভাই কী কথা।”

“বলছি বলছি। আগে বসো তারপর বলছি।”

আদ্র গিয়ে আফরোজ চৌধুরীর পাশের সোফায় বসল। আফরোজ চৌধুরী চশমার গ্লাস টা রুমালে মুছতে মুছতে বললেন,

“দেখ দাদুভাই। তোমাদের বিয়ের আজ এক বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু আমি জানি তোমাদের মধ্যে এখনো সবকিছু ঠিকঠাক নেই। তোমরা এখনো নরমাল হয়ে উঠতে পারো নি। এজন্য আমিও তোমাদের এ্যানুভার্সারি উৎযাপন করার ইচ্ছে থাকলেও করতে পারিনি। যেখানে তোমাদের সম্পর্কই ঠিক নেই সেখানে কোনো সেলিব্রেশন তো একদমই বেমানান। আমি বলি কী দাদুভাই তোমার বাবা-মা কে কেন্দ্র করে বিয়ে, সংসার এসবের ওপর তোমার যে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে সেটা এবার ঘোচানোর সময় হয়েছে। সব মানুষ এক নয়। এটা তোমাকে বুঝতে হবে দাদুভাই। তুমি আহিবা মেয়েটার সব স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছ। তার প্রতি অন্যায় করছ। সেই সঙ্গে আমাকে করছ তার কাছে অপরাধী। কারণ আমিই তো তাকে বড় মুখ করে তোমার বউ করে এনেছিলাম। আয়ান দাদুভাই এর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে বলেছে যত দ্রুত সম্ভব তাদের সম্পর্কও ঠিক করে নেবে। আমি চাইছি তোমাদের সম্পর্ক টাও ঠিক করে নাও। নয়তো আমি তোমাদের ডিভোর্স করিয়ে দিব।”

ডিভোর্সের কথা শুনে আদ্রের বুকটা ধক করে উঠল। কোথায় যেন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে কোনো রকমে উত্তর দিল, “ঠিক আছে দাদুভাই আমি চেষ্টা করব তোমার কথা রাখার।” অতঃপর সে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলেন। আদ্র চলে যেতেই আফরোজ চৌধুরী মৃদু হেসে মনে মনে আওড়ালেন,

“ভাঙবে তবু মচকাবে না।”

___

মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়িতে ফিরেছে মুগ্ধ। ড্রইং রুমে সবাই উপস্থিত তার এই অসভ্যতার কৈফিয়ত নিতে। কিন্তু মুগ্ধর সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। সে তো নিজের মতো বাহানা করছে।

চলবে,