#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৭
“এখন কেমন লাগছে সাইকোলজিস্ট সাহেব? ভালোই তো ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন।”
রাশেদ সাহেব হালকা হাসলেন। হাসতেও যেন খানিকটা কষ্ট হচ্ছে। বুকটা জ্ব’লছে এখনো। বুকে হালকা হাত রেখে দুর্বল গলায় জবাব দিলেন,
“এখন তো বেশ ভালোই আছি। মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে যাওয়া ভালো কিন্তু। সব অনুভূতির মাঝে ভয় ধরাও উচিত।”
“আর আপনার মেয়ে? সে তো প্রায় পা’গল হয়ে গিয়েছিল? তার কথাও তো ভাবতে হবে।”
“ওর জন্যই তো ওপারের টিকিট কেটেও যেতে পারিনি।”
রাশেদ সাহেবের কথায় বিস্তর হাসলেন ড. ইরশাদ। অতঃপর বললেন,
“আর এমন টিকিট কাটার দরকার নেই। আমি আসছি তাহলে। আবার আপনাকে জ্বা’লাতে আসব। হসপিটালে রাউন্ড দেওয়ার সময় হয়েছে।”
বলেই চললেন ড. ইরশাদ। তিনিই বর্তমানে রাশেদ সাহেবের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি নিজেও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন রাশেদ সাহেবের কন্ডিশনে। শেষ মূহুর্তে রেসপন্স করেছিলেন বলেই বেঁচে গিয়েছেন এবারের মতো। উনি যাবার পরেই পাশের টুলে বসে থাকা রাগিনী তার বাবার হাত ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে ওঠে,
“বাবা! আমাকে একা করে দিয়ে যাচ্ছিলে কেন?”
মেয়ের এমন প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশেদ সাহেব কষ্ট করে নিজের হাতটা উঠিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখেন।
“এভাবে বললে হবে? সৃষ্টিকর্তার ডাক কখন পড়বে বলা যায়?”
“আমি তোমায় ছাড়া একা একা কী করে থাকব? আমার তো অন্য কেউ নেই। আমি জানি না তুমি আর এমন করবে না আমার সঙ্গে।”
“শুনেছি তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে? এখন ঠিক আছো তো? এত চিন্তা কেউ করে? ডক্টর চেকআপ করেছে? কী বলেছে তোমার প্রেশার লো তাই তো?”
রাগিনী মিনমিন করে বলে,
“উঁহু… তা তো বলেছে আর…”
বলতে বলতে কথার মাঝপথে থেমে যায় রাগিনী। পুরোটা বলা কি ঠিক হবে? তার এমন কথার মাঝে থেমে যাওয়ায় জোর গলায় রাশেদ সাহেব জিজ্ঞেস করেন,
“আর কী? বলো।”
“আসলে বাবা কারা যেন আমাকে ব’ন্দি করে করে ড্রা’গ টাইপের কিছু দিয়েছিল না? সেটার প্রভাবেও জ্ঞান হারাতে পারি বা বেশ কয়েকদিন এর প্রভাব থাকতে পারে। যার কারণে হ্যালুসিনেট করতে পারি।”
রাশেদ সাহেব চুপ রইলেন। তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে রাগিনীর বুঝতে দেরি হলো না উনি ফের চিন্তায় মত্ত হয়েছেন। রাগিনী স্পষ্টভাবে বলল,
“জানি চিন্তা করতে শুরু করেছ। এজন্যই বলতে চাইনি। তোমার আজকের এই অবস্থা শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে চিন্তা করার জন্যই। আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করছ তুমি। কেন এত চিন্তা করছ? দরকার নেই। যা হবার তা হবে।”
বলেই কোহিনূরের কথা স্মরণ করল রাগিনী। যেন এই মানুষটাই সব কিছুর মূলে। এই লোকটাই তো তার পিছু নিয়েছে। সেকারণেই এখন তাকে সব হারানোর ভয় ঝেকে বসেছে। রাগিনীর রাগ হলো। নাকি অভিমান হলো? সে সম্পর্কে সে অবগত নয়। রাশেদ সাহেব স্থির নয়নে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। মেয়েটা শুধু শুধু নিজেকে দোষারোপ করছে। এখন উনি কী করে বোঝাবেন যে চিন্তার কারণ হাজারটা? আর সেই চিন্তার উদ্ভব হয়েছে স্বয়ং নিজের থেকেই। কিন্তু তা তো মুখ ফুটে বলতে পারবেন না মেয়েকে। তার অবস্থা যে এখনো খুব একটা ভালো সেটা উনি বুঝতে পারছেন। ভবিষ্যতে মুষড়ে পড়তে সময় লাগবে না সেটাও বোধগম্য হলো। তবে মেয়েটার কী হবে? আসলেই তো সে একা। এবার কণ্ঠ খাদে নামিয়ে তিনি বললেন,
“একটা কথা নিজের মাথায় ঢুকিয়ে নাও। বাস্তবতা যতই কঠিন হক। তার থেকে কখনো আমরা পালাতে পারব না। যেমন আজ যদি সত্যিই আমার কিছু হয়ে যেত তবে কিন্তু কিছুই করার ছিল না রাগিনী। জীবনের নিশ্চয়তা কেউ কখনো দিতে পারে না। তাই তুমি তোমার মনকে শক্ত রাখবে, তৈরি রাখবে। তবে একটা বিষয় আমায় খুব ভাবাচ্ছে। তোমার ভবিষ্যৎ। মানুষ কখনো একা একা চলতে পারে না। তার জন্য লাগে কোনো সঙ্গী। যার হাত ধরে সবসময় চলতে হয়। এতগুলো বছর আমি তোমায় আগলে, তোমার ছোট আর নমনীয় হাত ধরে তোমায় এগিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার এই হাতটা ভরসা আর নেই।”
এতক্ষণ কোনোমতে দমিয়ে রাখা কান্নাগুলো আর বাঁধ মানতে চাইছে না। ঠেলে ঠেলে বেরিয়ে আসছে। চোখ দুটো দিয়ে সবটা ঝাপ্সা দেখছে। কী বলছে তার বাবা? মানতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে। একদিকে তিল তিল করে যত্নে গড়া অনুভূতি ভেঙেচুরে দেওয়া কোহিনূরের বিশ্বাসঘাতকতা অপরদিকে তার বাবার এমন শক্ত কথা। কতদিক আর সহ্য করা যায়? মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না সংবরণ করার চেষ্টা চালাচ্ছে রাগিনী। তৎক্ষনাৎ রাশেদ সাহেব আবার বললেন,
“তোমার পছন্দের কেউ আছে? কাউকে নিজের সঙ্গী বানাতে চাও?”
বেশ উৎসুক হয়ে প্রশ্নটা করলেন রাশেদ সাহেব। রাগিনী চকিতে তাকাল। ছোট থেকেই তার মা না থাকাই সব খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো বাবার সঙ্গেই শেয়ার করেছে। এখন এটাও তার বাবাকে বলতে হবে? কিন্তু কার কথা বলবে সে? মনটা যেন বার বার জোর করতে থাকল কোহিনূরের নামটা নেওয়ার জন্য। অবুঝ মন! কোনো যুক্তিই তার কাছে বোধগম্য নয়। সে যা বোঝে তাই। আর সে তো বোঝে শুধু মিথ্যেবাদী কোহিনূরকেই। নিশ্বাস প্রগাঢ় হয়ে এলো রাগিনীর। মনে মনে নিজেকে ধমকে বলল, কীসের এত বাসনা? কীসের এত লোভ একটা স্বার্থপরকে পাওয়ার? যে তোকে মিথ্যে বলেছে তাকে পেতে হবে? উঁহু না! রাগিনী চোখমুখ খিঁচে জোরপূর্বক উত্তর দেয়,
“কেউ নেই বাবা। কেউ নেই। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে?”
“কারণ আছে বলে করেছি। আমার কিছু হয়ে যাওয়ার আগে তো তোমার পাশে রাখার মতো কাউকে দরকার।”
“তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারলাম না বাবা।”
ক্ষীণ গলায় বলল রাগিনী। তার হাত-পা কাঁপছে কোনো অজানা আশঙ্কায়। কিছুটা আন্দাজে আসতে পেরেছে সে। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আর প্রতীক্ষা করছে বাবার উত্তরের।
“খুবই সহজ রাগিনী। আমি চাইছি আমি কিছুটা স্টেবল হয়ে উঠলেই তোমার জন্য যোগ্য কোনো সঙ্গীর ব্যবস্থা করতে।”
রাগিনী ওড়না শক্ত করে চেপে ধরল। এটা সে চায়নি। তার মুখের সুর হারাল। বাকহীন হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর নিচু সুরে বলল,
“এটা কথা ছিল না বাবা। তুমিও তো চেয়েছিলে আমি যেন তোমার মতো হই। আমার পড়াশোনা?”
“সব হবে। আমি তোমায় তাড়াহুড়ো করতে বলিনি। তোমার কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ থাকবে না। তবে আমার চোখে একজন রয়েছে যে তোমায় বুঝবে।”
রাগিনী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। হুড়মুড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কে?”
রাশেদ সাহেব এই বিষয়ে আর কিছু বললেন না। মৃদু হেসে বললেন,
“সময় হক। এখন এসব নিয়ে তোমার চিন্তাভাবনা বাড়াব না। তুমি আস্তে আস্তে তৈরি হও।”
রাগিনী কিছু বলার পূর্বেই একজন ওয়ার্ড বয় এলো। বিনয়ের সঙ্গে রাগিনীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“স্যারকে এখন অবজারভেশনে রাখা হয়েছে ম্যাম। এখানে আপনার বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। এখন বাহিরে যেতে হবে। ঘুমানোর সময় হয়েছে উনার।”
রাগিনী প্রতিত্তোরে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়াল। রাশেদ সাহেবের দিকে চেয়ে থমথমে গলায় বলল,
“গুড নাইট বাবা।”
রাশেদ সাহেব মাথা দুলালেন। রাগিনী উঠে বাহিরে এসে সিটে ধপ করে বসল। দুহাত পড়ল মাথায়। বাবার সব কথা মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে যেন। নিতে পারছে না আর! কী করে করবে নিজেকে তৈরি? অসহ্য লাগছে চারিদিক। বি’ষের চেয়েও বি’ষাক্ত হয়ে উঠেছে প্রতিটা মূহুর্ত। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে রাগিনীর। দেয়ালের সাথে মাথা লাগিয়ে দেয় সে। চোখটা বুঁজে আসে। বিড়বিড় করে বলে,
“আজ বাবাকে আপনার নামটাই বলতাম যদি সবটা ঠিক থাকত। যদি সত্যিই আমি আপনার প্রেয়সী হতে পারতাম। যদি সত্যিই আমাদের এতগুলো একসাথে কাটানো মূহুর্তগুলোর মাঝে কোনো একটা অর্থ থাকত। কিছুই নেই। সব অর্থহীন। সব একতরফা।”
সিটি হসপিটালটা সবে একটু একটু করে নীরব হতে শুরু করেছে। সরগম কমছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে চলাচল করতে দেখা যাচ্ছে না। নাইট ডিউটি ব্যতীত সব ডক্টর নিজেদের বাসস্থানে ফিরতে ব্যস্ত। রাগিনী একা একজায়গায় বসে। রাগিনী স্তব্ধ হয়ে মূর্তির ন্যায় চোখ বুঁজে বসে আছে। পেটে কিছুটা খাবার পড়েছে। অভিরূপ ও নোমান রাগিনীকে খাইয়ে তবেই বাড়িতে ফিরেছে। যদিও তারা যেতে চায়নি। রাগিনীর জোরাজুরিতেই তাদের বাড়ি ফেরা। তবে সকাল সকাল তারা উপস্থিত হবে তাতে নিশ্চিত রাগিনী। কখনো কখনো সে বুঝেই উঠতে পারেনা যে সে একজন সেলেব্রিটি মানুষের সাথে রয়েছে। সে দেখেছে অভিরূপের মাঝের উচাটন। রাশেদ সাহেবের জন্য দুশ্চিন্তা। মানুষটা একটু পাগলাটে হলেও বেশ ভালো।
নির্জন হসপিটালের রিসেপশনে আসে। চোখেমুখে চাঞ্চল্যতা। মনটা দুরুদুরু করছে। শান্ত হচ্ছে না কিছুতেই। তবুও শান্ত গলায় রিসেপশনিস্টকে বলে,
“হ্যালো. মিস! শাহ্ রাশেদ স্যারের কেবিনটা কোনদিকে বলতে পারবেন?”
রিসেপশনিস্ট চেক না করেই তড়িঘড়ি করে বলল,
“উনি তো এখনো অবজারভেশনে। সেকেন্ড ফ্লোরের লাস্ট দিকে।”
“থ্যাংক ইউ।”
বড় শ্বাস নিয়ে নির্জন এগোতে থাকে সিঁড়ির দিকে। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে শেষ প্রান্তে বেশ উত্তেজনার সঙ্গে পৌঁছায়। হাঁটার মাঝেই মৃদু আলোতে দৃষ্টি আটকায় এক ছিপছিপে গড়নের দুশ্চিন্তা মাখানো মুখের দিকে। উজ্জ্বলতায় পরিপূর্ণ সেই মুখটা এখন ফ্যাকাশে। যেন নিষ্প্রাণ। নির্জনের বুক ধক করে ওঠে। মেয়েটা ঠিক আছে তো? এসব ভাবার মধ্যেই রাগিনীর নিকটে পৌঁছায় সে। রাগিনী চোখ হ্যান্ডেলে হাত রেখে তার উপর মাথা লাগিয়ে যেন অবচেতন। নির্জন তাড়াহুড়ো করে গিয়ে তার পাশে বসে। তার মাথায় আস্তে করে হাত বুলায়। তৎক্ষনাৎ হুড়মুড়িয়ে রাগিনী উঠে সোজা হয়ে বসতেই নির্জন চমকে ওঠে। চোখ বড় বড় করে তাকায় রাগিনীর দিকে। এখনো মেয়েটা চোখ বন্ধ করেই রয়েছে। ফট করেই চোখ মেলে রোবটের ন্যায় মাথা ঘুরিয়ে নির্জনের দিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকাতেই নির্জন তব্দা খেয়ে যায়। মেয়েটা কি এতই শোকে কাতর যে চিনতে পারছে না তাকে? হতেই পারে! নির্জন কিছু বলাট আগেই রাগিনী খানিকটা চেঁচিয়ে বলে,
“আপনি আবার এখানে এসেছেন?”
থতমত খেয়ে যায় নির্জন। কী বলে এই মেয়ে? সে আবার কখন এসেছিল?
“আমি তো কেবলই এলাম।”
“মিথ্যুক। আস্ত একটা মিথ্যুকের বস্তা। সবসময় মুখে মিথ্যে লেগেই থাকে। এই নিয়ে নয়বার আপনি এসেছেন।”
“নয়বার?”
এবার বিস্ময়ে নিজেই হতবাক হয় নির্জন। মাথাটা ভনভন করে ওঠে। রাগিনী থামে না। আঙ্গুল উঁচিয়ে দুর্বল গলায় বলে,
“হু নয়বার। বার বার আমার সুযোগ নিচ্ছেন আপনি। ডক্টর বলেছে আমি ড্রা’গের প্রভাবে হ্যালুসিনেট করতে পারি। আর আপনি সেটার সুযোগ নিয়ে বার বার আমার হ্যালুসিনেশনে প্রবেশ করছেন। লজ্জা করে না?”
এবার নির্জন খানিকটা হলেও বুঝল। স্বস্তির শ্বাস ফেলল সে। মৃদু হেঁসে রাগিনীর হাতটা আলতো স্পর্শ করে বলল,
“দেখো! আমি এবার সত্যি এসেছি।”
রাগিনী ঝটকা মে’রে হাত সরায়। তড়তড় করে বলে,
“এর আগের বারও আপনি আমার হাত ধরেছিলেন, আমায় স্পর্শ করেছিলেন আর…”
“আর কী?”
“চুমুও খেয়েছিলেন। কিন্তু আবার উধাও হয়ে গিয়েছিলেন।”
বলেই হতাশ হয় রাগিনী। তার চোখের ঘুমটা এখনো লেগে রয়েছে। সেই সঙ্গে এত বড় শক। তার উপর ড্রা’গের প্রভাব। সব মিলিয়ে মেয়েটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। নির্জন এবার রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসে বলল,
“তাই? কিসও করেছি?”
রাগিনী মাথা দুলায়। নির্জন আবারও বলে,
“রাশেদ আঙ্কেল কেমন আছেন?”
“সব হয়েছে আপনার জন্য। বাবার অবস্থার জন্য আপনি দায়ি।”
নির্জন বিস্ময় নিয়ে বলে,
“আমি?”
“হু আপনি। আমার পিছু নিয়েছেন জন্যই তো বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। ছাড়ুন না আমার পিছু।”
কিছুটা অনুরোধ করেই বলল রাগিনী। নির্জন দম নিয়ে রাগিনীকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
“আরে বাবা, এই প্রথম দেখলাম মেয়ের চুরি হয়ে যাওয়ার চিন্তায় তার বাবা হার্ট ফেইল করেছে।”
“আপনি খুব নিষ্ঠুর মানুষ।”
বলেই নির্জনের বুকে থাবা দিয়ে সরে আসে রাগিনী। নির্জন প্রশ্ন করে,
“কেন?”
“”আপনি আমার জীবনের এমন একজন মানব যাকে ঠিক ভালোবাসা আর ঘৃণা এই দুটো অনুভূতির মাঝখানটাতে ঠাঁই দিয়েছি। সেই ভালোবাসা ও ঘৃণার মাঝে যু’দ্ধ আহ্বান করা হয়েছে। তারা নিজেরা যু’দ্ধ করছে আপনাকে নিজের কাতারে ফেলতে। আমার মনে কেন এই যু’দ্ধের সৃষ্টি করলেন কোহিনূর রত্ন?”
চলবে…
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৮
“এই ভালোবাসা আর ঘৃ’ণার যুদ্ধে তুমি কাকে জয়ী হতে দেখতে চাইছ, এ্যাংরি কুইন?”
নির্জন নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করে বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে রইল রাগিনীর শুকনো এবং দুর্বল মুখের দিকে উত্তরের আশায়। মেয়েটা এখনো চোখ দুটো অর্ধেক বুঁজে রয়েছে। পুরোটা খুলতেই পারেনি। সারা মুখে লেগে আছে ক্লান্তি। পোশাক-আশাক দেখে মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠেই সরাসরি ছুটেছে হসপিটালে। শর্ট গেঞ্জির মতো টপসের উপর গলায় রাখা স্কার্ফ কোনোরকমে জড়ানো। রাগিনী দেরি করল না উত্তর দিতে। নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“আই ওয়ান্ট টু সি লাভ উইন।”
“ভালোবাসো আমাকে?”
রাগিনী অস্পষ্ট চোখে রেগেমেগে তাকাল। অকপটে উত্তর দেয়,
“আই হেট ইউ।”
নির্জন হেঁসে ওঠে। তার হাসিতে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে ফেলে রাগিনী। ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল,
“হাসছেন যে?”
“হাসব না? আমি যে তোমার বলা আই হেট ইউ বাক্যের মাঝে ভালোবাসা শব্দটা শুনতে পেলাম। এভাবে কেউ আই হেট ইউ বলে? যেকোনো মানুষ হেট এর পরিবর্তে লাভ শুনে ভুল করবে তো।”
রাগিনী ঠোঁট বাঁকা করে ভেংচি কে’টে অন্যপাশ ফিরে বসল। বিড়বিড়িয়ে বলল,
“ক্রি’মিনাল কোথাকার!”
নির্জন ঠিক করে শুনতে পেল না রাগিনীর কথা। জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বললে?”
“হ্যাঁ বললাম। আপনি এখনি আমার হ্যালুসিনেশন থেকে বিদায় হবেন। সেটাই বললাম। বিদায় হন এখান থেকে। একা থাকতে দিন। বিরক্ত করবেন না।”
“বিদায় না হলে কী করবে?”
রাগিনী চটে গেল। অস্থির হয়ে প্রতিত্তোরে বলল,
“মে’রে দেব আপনাকে।”
“আমি তো অনেক আগেই ম’রে গিয়েছি। বিলীয় হয়েছি তোমার মাঝে।”
রাগিনী এবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। কর্ণকুহরে সুমধুর সুরের ন্যায় বাজতে থাকে সেই বাক্য। হৃদয়ে খেলে গেল দোল। মূহুর্তেই মনে হলো লোকটা এখনো বিদায় হচ্ছে না কেন? আগের মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে না কেন? তবে কি সত্যিই সত্যিই…?
তৎক্ষনাৎ নিজের ডান হাতের পিঠে এক নম্র স্পর্শ অনুভূত হলো তার। নিজের ধূসর গোলাপি বর্ণে মিশ্রিত ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা নির্জন ভালোবাসার স্পর্শ আঁকল রাগিনীর হাতে পিঠে। রাগিনীর শরীর জুড়ে শুরু হলো কম্পন। উঁহু… এটা মিথ্যে নয়। সত্যি! বাস্তব! রাগিনী চোখ বুঁজে ফেলে। আঁখি জুড়ে নামতে থাকে অশ্রু যা সংবরণ করতে থাকে। মানুষটা সত্যিই তবে এসেছে। কেন এসেছে? কী চাই তার? তবে রাগিনীর নির্বোধ মনের বাসনা জাগল বাজে লোকটার কাঁধে মাথা রেখে নিজের সব মনের কথাগুলো উগড়ে দিতে। তা আর হলো কই? চোখ খুলে আর দেখল না লোকটাকে। কই গেলেন উনি? রাগিনী আশেপাশে তাকাল। নির্জন ইতিমধ্যে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে বলতে হাঁটা লাগিয়েছে করিডোর ধরে। দ্রুত হাঁটছে সে। যেন কত তাড়া! রাগিনী উঠতে চাইল। চিৎকার করে লোকটাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। তবে ক্লান্ত পা দুটো সায় দিল না। কণ্ঠে শক্তি এলো না। সে মাথা লাগিয়ে ফেলল দেয়ালে। নিস্তেজ হতে থাকল চোখ দুটো।
নিজের ডেরায় ফিরতে বেশ রাত হয়েছে রূপাঞ্জনার। আজকাল এক জায়গায় বন্দি থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে যাবার পরিক্রম হয় তার। বাহিরে গিয়েও তো শান্তি নেই। চোরের মতো লুকিয়ে থাকতে হয় সার্বক্ষণিক। আজ রাস্তায় কয়েকটা পথশিশুকে চোখে পড়েছিল তার। তাদের কারোর হাত নেই। আবার কারোর দুটো চোখ নেই। আরো বিভিন্ন সমস্যায় জ’র্জরিত। রূপার বুঝতে দেরি হয়নি এসব তার আদেশেই করা হয়েছিল একসময়। ঠিক তার আদেশে নয় ডার্ক ম্যাক্সের আদেশে। রূপা তো শুধুমাত্র সেই আদেশ পালন করার গুটি মাত্র। আগে কবির বাচ্চাগুলোর ছবি দেখিয়েছিল তাকে। তাই কিছুটা চিনতে পেরেছে। আজ বাচ্চাগুলোকে দেখে ভেতরটা হাসফাস করছিল তার। সে সত্যিই এতটা নির্দয়া হয়ে উঠেছে? যেখানে শিশুদেরও রেহাই নেই? তবে কিছু করার নেই।
পুরোনো, পরিত্যক্ত যেই কারখানাটা ভূতুড়ে নামে পরিচিত সেখানেই নিজেদের আস্তানা গেঁড়েছে রূপাঞ্জনা এবং তার দলবল। এখানে গতকালই এসেছে। ঘনঘন জায়গা পাল্টাতে হয় নিজেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। তার জীবনটা তো এমনই। কোথাও সুখ নেই, কোথাও অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব থেকেও অস্তিত্বহীনের মতোই বেড়াতে হয়। গরমের মধ্যে হুডি পড়ে থাকাটা অসহ্য! হুডির টুপি মাথা থেকে নামিয়ে দরজা খুলেই চোখে পড়ল কবিরকে। নিজের রি’ভলবারে খুব যত্ন করে বু’লেট ঢোকাচ্ছে সে। পাশেই দুই-তিনজন নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে আছে। এদের আর কাজ কী? অবশ্য রূপাও তো ব্যতিক্রম ছিল না। সারাদিন একই কাজ ছিল। মাতাল হয়ে পড়ে থাকা। কয়েকদিন ধরে ম’দ বা দামি ব্র্যান্ড কাবু করতে পারে না তাকে। রূপাঞ্জনা ধীর পায়ে কবিরের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে আদেশের সুরে বলল,
“কবির! আমার ঘরে ঠান্ডা পানি আন তো। বাসি হয়ে গিয়েছে ঘরের পানি।”
নিজের ঘরের লোহার দরজার কাছে দাঁড়াল রূপা। নাকে ঠেকল এক বাজে গন্ধ। অনেকদিন পরিত্যক্ত আর অপরিষ্কার হয়ে পড়ে থাকার ফলাফল এটা। রূপার এসব সয়ে গিয়েছে। তবে এখনো কবিরের হেলদোল বা প্রতিত্তোর না পেয়ে বিরক্ত হলো সে। বলল,
“কী হলো? কানে কালা হয়েছিস নাকি?”
কবির তবুও নির্লিপ্ত। রূপাঞ্জনা অবাক। কবির তো তার কথার হেরফের করে না কখনো। কিছু বললে সাথে সাথে হন্তদন্ত হয়ে করে দেয়। রূপাঞ্জনা পিছু ফিরে তাকাল।
“এই শালা কু*! কথা কানে যাচ্ছে না? দেব নাকি কানের নিচে?”
“গা’লিগা’লাজ করছিস কেন ওকে? ভদ্র মেয়ে হয়েছিস না? ভদ্র মেয়েরা বুঝি গা’লি দেয়?”
নিজের শোনা সবচেয়ে ভয়া’নক কণ্ঠস্বর আঁতকে তুলল রূপাকে। কানে কি ভুল শুনল? নাহ! রূপার ঘরের দরজা খুলে দরজায় ঠেস দিয়ে বেশ আয়েশের সঙ্গে সিগারেট ফুঁকছে স্বয়ং ডার্ক ম্যাক্স। ডার্কের শান্তভাব চোখের পেছনে হিং’স্রতা প্রগাঢ় দেখতে পায় সে। রূপা বিস্ময়ে স্থির মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়েছে। যেন কোনো দুঃস্বপ্ন! ডার্ক ম্যাক্স এখানে কী করে? এই পুরো দলের কারোর জানার কথা নয় রূপাকেও কেউ পরিচালনা করে। সুতরাং, ডার্ক ম্যাক্স বলে কোনো অস্তিত্ব বিরাজমান তাও তো কেউ জানার কথা নয়! তবে? রূপা বিস্ময়, অদম্য উচ্ছাস এবং উত্তেজনার সঙ্গে প্রশ্ন করে,
“আ…আপনি আমাদের ডেরায়?”
ডার্ক সিগারেট শেষবারের মতো ঠোঁটে ধরে টেনে তা হাতে নিয়ে তা নিশানা করে রূপার পায়ের কাছাকাছি ফেলতেই চমকে উঠে সরে যায় রূপা। মৃদু হেসে রূপার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতেই কবির উঠে দাঁড়ায়। ডার্ক ম্যাক্সের উদ্দেশ্যে বিনীত সুরে বলে,
“সব রেডি, বস!”
“গুড জব! এখন তোদের লেডি বসের থেকে তোকে বেশি বিশ্বাস করা যায়। তোদের লেডি বস তো মুখ ঘুরিয়ে নিলো।”
রূপা তাদের কথোপকথনে আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তবে বোঝার চেষ্টা করতে থাকল। কিঞ্চিৎ বোধগম্য হলেও পুরোটা হলো না। ভাবনা জগতে মত্ত থাকা রূপাকে চমকে দিয়ে ডার্ক বলল,
“আমার গ্যাং, আমার লোকজনকে একদিন না একদিন তো আমার দর্শন পেতেই হতো রূপা। সেটা আগে হক না পরে। তোর তাগিদে না হয় সেটা আগেই হলো। তোর প্রতি তো বিশ্বাস নেই আর। তাই আমি সবার সামনে এসেছি। সবাই জানে এখন তাদের মাস্টার আমি। স্বয়ং ডার্ক ম্যাক্সের সরাসরি আদেশে এবার কাজ হবে।”
রূপা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। এজন্যই কবির তাকে পাত্তা দেয়নি। এতদিন যার আদেশে মেনে এসেছে সে এখন সকলের কাছে তুচ্ছ! রূপা উদগ্রীব হয়ে কিছু বলতে চাইল,
“আমি…”
“তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তুই আমার দাবা কোর্টের হেরে যাওয়া একটা গুটি যে কোনো কাজে লাগে না।”
রূপা মাথা নুইয়ে ফেলল। তবে রাগ হচ্ছে ভীষণ। রাগের কারণ সে জানে না। ডার্ক তার জায়গা থেকে ঠিক। তার বিশ্বাস না করার কারণটাও ঠিক। এতদিন পর হুট করেই কারোর কথার খেলাপ করাটা রূপার সাজে না সেটা রূপা নিজেও জানে। কিন্তু! মনের মাঝে যে তৈরি হওয়া অদম্য ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটি বেশ উথালপাতাল করছে। এই ভয়’ঙ্কর হিং’স্র জা’নোয়ারের সঙ্গে কাজ করা যেন নিজের গলায় নিজে শি’কল বেঁধে রাখার মতোই। সে স্বাধীনতা একদিন অনুভব করেছিল। অভিরূপের সাথে। ওই নৌকাতে! খোলা আকাশের নিচে, অবাধ্য বাতাসের মাঝে। সেদিন যেন ছিল প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেবার মতো দিন। ঠিক সেদিন থেকে মন টিকতে চায় না এই জীবনে। শুধু পালাই পালাই করে। এজীবন যেন কিছু মূহুর্তের জন্য অসহনীয় মনে হয়! তবে মুক্তি পাওয়ার কি কোনো পথ সে আদেও খোলা রেখেছে?
“ভাবিস না। তোকে ফে’লেও দেব না। তোকে আমার দরকার। যতই ইউজলেস হয়ে যাস না কেন! তোকে খুব দরকার।”
রূপা মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। সে জানত ডার্ক এমন কথাই বলবে। রূপার এত সহজে নিস্তার নেই এটা সম্পর্কে সে অবগত। নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো মৃ’ত্যু। তবে সকলের প্রস্তুতি দেখে কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করল,
“কীসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আপনারা? কোনো প্ল্যানিং আছে আপনাদের?”
কেউ তার কথার কোনো জবাব দিলো না। রূপার ভেতর ভেতর রাগ হলেও প্রকাশ করল না। ডার্ক ম্যাক্স নিচে পড়ে থাকা বড় গা’ন তুলে রূপাঞ্জনার দিকে তাক করে এক চোখ বন্ধ করে বলল,
“তা তো অবশ্যই। তোর প্ল্যানিং এর আশায় বসে থাকলে কি আমাদের দিন চলবে নাকি? ঢাকায় কী কারণে এসেছিলাম সেটা তুই ভুললেও আমি ভুলিনি ইভেন আমার পুরো টিমকেও ভুলতে দিই নি। চট্টগ্রামের সকলের সামনে অজানা হয়েই চ্যালেঞ্জ ছুঁ’ড়ে দিয়ে এসেছিলাম ঢাকাকে পরিণত করব মৃ’ত্যুপুরী।”
রূপাঞ্জনা তপ্ত শ্বাস ফেলল। মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেতে লাগল প্রথমেই অভিরূপ নামক ব্যক্তিটির কথা। তবে কি টার্গেট অভিরূপ চৌধুরী? কিলবিল করে উঠল মনে থাকা প্রশ্নগুলো। তাই আবারও জানতে বলল,
“টার্গেট কী? অন্তত এতটুকু তো জানতে পারি? সেই অধিকার নিশ্চয় হারাই নি?”
ডার্ক বেশ সহজ গলায় বলল,
“শুনলাম রাগিনীর বাপটা হার্ট অ্যা’টাক করে হসপিটালে পড়ে আছে। সেই কারণে তোর পেয়ারের অভিরূপও নিজের সেফটি জোন থেকে বেরিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করছে। কথা সত্য?”
রূপাঞ্জনা আঁতকে তাকাল। ডার্ক বেশ উপভোগ করল রূপার আঁতকে ওঠা। সে হাসি বাড়াল। রূপার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়তে বাড়তে যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কবে হলো এই ঘটনা? তবে কি টার্গেট অভিরূপ? না চাইতেও সে মুখ ফসকে বলে দিলো,
“উনিই আপনার টার্গেট?”
“হ্যাঁ। না হওয়ার কী আছে? আমি যাকে টার্গেট করি সেটা তো কখনো মিস যায়নি। তাছাড়া ও তোকে বাঁচিয়েছে। সেকারণে তুই ওকে বাঁচাচ্ছিস। যাকে ইংরেজিতে বলে, গিভ অ্যান্ড টেক। এতে আমাদের বেনিফিট কী? আমরা কেন টার্গেট থেকে সরে আসব।”
রূপাঞ্জনার মুখ চুপসে গেল। বিমূঢ় হয়ে পড়ল মূহুর্তেই। হাত মুঠো করল। বুকের মাঝে অস্থিরতা তড়তড় করে বেয়ে যেন মাথা থেকে পা অবধি ছড়িয়ে পড়ল। তার কী করা উচিত?
সিটে একভাবে মাথা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে রাগিনী। কোনো হুঁশ নেই তার। লোকজনের সরগম ঘটেছে হসপিটালে। কর্ণকুহর অবধি পৌঁছাচ্ছে না শোরগোল। তার হাতে যখন ঝাঁকুনি অনুভূত হলো নড়েচড়ে উঠল ঘুমের মাঝেই। একহাত দিয়ে ঢাকল নিজের মুখ। ঘুম হালকা হতেই কানে ভেসে এলো চিকন মিষ্টি পুরুষালী কণ্ঠ।
“খোলা চোখখানা করো বন্ধ
বাতাসের ঠান্ডা গন্ধ,
বয়ে বেড়ায় ঘরেরও বাহিরে।
আসো ছোট্ট একটা গান করি
যাতে ঘুম পাড়ানি মাসী এসে পাশে
বসে হাতখানা দিবে কপাল ভরে…!”
কণ্ঠে মেশানো সুরটা বেশ মুগ্ধকর। আপনাআপনি চোখ খুলে গেল রাগিনীর। সোজা হয়ে বসে চোখে আশপাশটাতে পড়তেই চোখমুখ দুহাত দিয়ে মুছে নেয় রাগিনী। পাশ ফিরে তাকাতেই নজরে আসে অভিরূপের হাস্যমুখর চেহারা। রাগিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে আকস্মিক হাসি দিতেই অভিরূপ বলে,
“ঘুম ভেঙেছে তাহলে?”
“এমন করে গান গাইলে সকলেরই ঘুম ভেঙে যাবে।”
“খুব খারাপ গাইছিলাম?”
রাগিনী মাথা নাড়ায়। অতঃপর জোর গলায় উত্তর দেয়,
“উঁহু না। সুন্দর গাইছিলেন জন্যই তো ঘুম ভাঙলো। কয়টা বাজে?”
অভিরূপ আন্দাজ করে বলে,
“এই প্রায় সাড়ে আটটা!”
তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায় রাগিনী। পায়ের জুতোটা সামলে নিয়ে পড়তে পড়তে বলে,
“এত দেরি হয়ে গিয়েছে! বাবাকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে তো।”
“রিল্যাক্স, রিল্যাক্স! উনি খাওয়া শেষ করে মেডিসিনও নিয়ে নিয়েছেন। এখন নিজের দিকে তাকাও।”
শান্ত হলো রাগিনী। অভিরূপের কথা বোধগম্য হলো না। বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তৎক্ষনাৎ অভিরূপ বলল,
“আমি জানতাম মেয়েরা ঘনঘন ড্রেস চেঞ্জ করতে ভালোবাসে। তুমি তো দেখছি পুরোটাই আলাদা। ছেলে হতে গিয়ে মেয়ে হয়ে গিয়েছ নাকি?”
থতমত খেয়ে উদ্ভট নজরে তাকায় রাগিনী। কী বলছে লোকটা? এটা কেমন কথা? তার এমন চাহনিতে অভিরূপের বোঝার বাকি থাকে না সে অযাচিত কিছু বলে বসেছে। আবার তাকে রাগের চোটে পে’টাতে না শুরু করে। নিজের মুখ সামলে বলে ওঠে,
“আই মিন তুমি যেমন সাহসী, তেমনই ফাস্ট গার্ল। তাই বলছিলাম।”
রাগিনী প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। ঘুমটা যেন কমপ্লিট হয়নি। হাই তুলল একবার। তখনি অভিরূপ বলল,
“আমি আর নোমান তো এসে গিয়েছি। তুমি বরং গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো বাড়ি থেকে। আমি আর নোমান আঙ্কেলের কাছেই আছি।”
বেশ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলো রাগিনীর মনে। একে তো এই অতিথি মানুষটি আসার পর থেকে একের পর এক ঝামেলাই পড়ছে। তার ওপর এই বাবার খেয়াল রাখার ঝামেলাটা চাপিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? রাগিনীর মৌনতায় অভিরূপ ভ্রু কুঁচকায়। আর ক্ষীণ সুরে বলে,
“আঙ্কেলের খেয়াল রাখতে পারব না এমন ভাবছ না তো?”
“না, না। আমি তো আপনাকে এসব ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলাম না।”
“কীসের ঝামেলা? এক্সকিউজ মি, ম্যাডাম! হি ইজ মাই আঙ্কেল। আই নো হি ইজ ইউর ফাদার। বাট হি ইজ মাই আঙ্কেল অলসো!”
রাগিনী বুঝে গেল অভিরূপের কথার সাথে পারার ক্ষমতা তার নেই। তাই শুধু শুধু কথা বাড়তি করে লাভ নেই। তারও বাড়ি গেলে ভালোই হয়। নিজেকে ফ্রেশ করা দরকার! সে রাশেদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলেই চলল নিজের বাড়ি। রয়ে গেল নোমান আর অভিরূপ।
সিটি হসপিটালের বাহিরে হুড়মুড়িয়ে অটো থেকে নামল রূপাঞ্জনা। পরনে বাধ্য হয়ে লং গোলাপী কামিজ আর বড়ো কালো ওড়না। নেমেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পা চালাতেই পায়ের নিচে ওড়না পড়তেই মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়তে পড়তে নিজেকে সামাল দিলো সে। বিরক্তির ‘চ’ শব্দের ন্যায় উচ্চারণ করে কোনোরকমে গলায় পেঁচিয়ে নিলো ওড়না। বিলম্ব না করে ঢুকল হসপিটালে। রাশেদ সাহেবকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। কেবিন নম্বর জেনে তাড়াহুড়ো করে ছুটল সেখানে রূপা। আত’ঙ্কের শেষ নেই। কিছুক্ষণ আগেই ডার্কের তৈরি করা মাস্টার প্ল্যান এক্সকিউট করতে নেমে পড়েছে তার টিম। আর রূপার ধারণা মতে তাদের লক্ষ্য অভিরূপ! নিজেকে আটকাতে চেয়েও তা না পেরে মনের কথা অনুযায়ী ছুটে এসেছে হসপিটালে। সে পারছে না নিজেকে শান্ত রাখতে। সে জানে এর পরিণামটা ঠিক সুবিধার নয়। তবুও অবাধ্য, দুর্বার মনটা কী চায় সে নিজেই বোঝে না। বুঝলেও সফল হতে পারে না!
হুড়মুড়িয়ে কেবিনের দরজা খুলতেই কেবিনে থাকা সকলেই চমকে তাকাল রূপাঞ্জনার দিকে। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করল রূপাঞ্জনা। মুখটা স্বাভাবিক করার চেষ্টায় থাকল। কেউ তাকে আবার ধরে ফেলবে না তো? ইনিয়েবিনিয়ে তার চোখ যখন চকলেট কালার শার্টে আবৃত এক পুরুষকে অ’ক্ষত অবস্থায় দেখল তখন মন এবং চক্ষু দুটোই শান্তিতে ছেয়ে গেল। মুখ পুরে বেরিয়ে এলো স্বস্তির শ্বাস। মাথায় প্রশ্ন এলো, এত ব্যাকুলতা, আকুলতার কীসের তরে? ইহা শুধুই কী সামান্য বাঁচানোর বদৌলতে বাঁচানো? নাকি পাথরের ন্যায় মনটার উপরের আবরণ খানি ভেঙে পরিলক্ষিত হচ্ছে নারী মনটা?
“আঙ্কেল! শুনতে পাচ্ছেন? বলছিলাম যে আপনার মেয়েকে আপনি সবদিক থেকেই পারফেক্ট করে তৈরি করেছেন দেখছি!”
পিটপিট করে তাকালেন রাশেদ সাহেব। অতঃপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন অবিকল রাগিনীর ন্যায় দেখতে মেয়েটাকে। যাকে দেখে যে কারোর ভুল হতে পারে। অভিরূপ ফের বলল,
“আগে জানতাম অলওয়েজ লেডিস ফার্স্ট সেটা শুধু ডায়লগেই বলে। আপনার মেয়ে ফার্স্ট হয়ে নারী জাতির এই ডায়লগের মর্মার্থ কিন্তু ধরে রাখতে পারল!”
রূপা থতমত খেয়ে চেয়ে থাকে। কীসব বলছে লোকটা? মাথায় নিশ্চয় কোনো স্ক্রু ঢিলে আছে। সে সবটা জেনেই হসপিটালে পা রাখার সাহস দেখিয়েছে। সে রাগিনীর মুভমেন্টের প্রতিটা খবর জানে। তাই তো সুযোগ খুঁজছিল। আর সেই সুযোগ সে পেয়েও গিয়েছে। হাতছাড়া করেনি। দরজা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে ভেতরে এলো রূপা। এই প্রথম সে রাগিনীর বাবার মুখোমুখি হয়েছে। আচ্ছা নিজের মেয়েকেও কি উনি চিনতে ভুল করবেন? নাকি ধরে ফেলবেন? ধরে ফেললে তো সমস্যা! কথায় বলে, র’ক্তের সম্পর্ক চিনতে ভুল হয় না। তাই রাশেদ সাহেব ধরে ফেললেও খুব একটা অবাক হবে না রূপা। তাই সে রাশেদ সাহেবের কাছাকাছি না গিয়ে দূরেই দাঁড়িয়ে রইল।
রাশেদ সাহেব মেয়েকে দেখে কিছুটা নম্র সুরে বললেন,
“তোমায় যা বলেছিলাম গতকাল! এবার শুধু আমি একা একা তোমার জন্য চিন্তা করব না। আমি চিন্তা করার জন্য আরেকটা সঙ্গী আনছি।”
নোমান উনার কথার মাঝপথে ব্যঙ্গ করে বলল,
“অভিরূপ কিন্তু চিন্তা করার মানুষ একদমই নয় আঙ্কেল। তবে আমি চাইলে আমি ওকে জোর করে চিন্তা করাতে পারি।”
অভিরূপ নোমানের কথায় ফোঁড়ন কেটে বলে,
“শাট আপ! কে বলেছে আমি চিন্তা করতে পারি না? আমি আরেকটু হলে আঙ্কেলের চিন্তায় হার্ট ফেল করে বসতাম। তোর মতো নাকি?”
“সেই! আমার মতো হলে তো চিন্তা ছিল না। আমার মতো নয় বলেই সমস্যা।”
অভিরূপ তড়িঘড়ি করে আরো কিছু বলতে চাইল। তবে তার আগেই রাশেদ সাহেব মেয়ের নীরবতা দেখে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
“কী হয়েছে রাগিনী? কোনো সমস্যা মা?”
রূপার ভেতরটা কেমন যেন করছে এবার। নিজের কানে ‘মা’ শব্দটি ভেসে আসার পর বাড়ল উতলা মনের অস্থিরতা। এই প্রথম কারোর থেকে এভাবে ‘মা’ ডাকটি শুনেছে সে। এই প্রথম কেউ আদর করে ডেকেছে তাকে। উত্তর না দিয়ে কী করে থাকবে? সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
“না, বাবা।”
কথার শেষে বাবা শব্দটি বলে নিজেই থমকালো রূপা। রাজ্যের অস্থিরতা ঘিরে ধরল তাকে। দরদর করে ঘামতে আরম্ভ করল এসি রুমেও। কখনো কারোর মুখ থেকে আদুরে গলায় ডাক না শোনার পর আজ যখন প্রথমবার কেউ তাকে মা বলে নিজের মেয়ের মতো ডাকল তখন নিশ্চল হয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটা অঙ্গ। কোথাও একটা হৃদয়ের সমস্ত ভালো লাগা গিয়ে জমা হলো। এ যেন অত্যন্ত স্নিগ্ধ অনুভূতি। রাগিনী মেয়েটা সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী! যাকে সকলে এত ভালোবাসে। যার বাবা তাকে এত ভালোবাসে। নিশ্চয় তার জীবনটা সুন্দর! রূপার মতো ছন্নছাড়া নয়।
“একটু পানি এগিয়ে দাও। তৃষ্ণা পেয়েছে।”
রাশেদ সাহেবের এমন কথায় রূপা এতটাই উতলা হলো যেন এটা তার নিজেরই বাবা। সে দ্রুত টেবিল থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে পানি ঢেলে দিতে গেল রাশেদ সাহেবকে। তবে অতিরিক্ত অস্থিরতা এবং তাড়াহুড়োতে সফল হলো না সে। ফলস্বরূপ কাঁপা হাত থেকে পড়ে গেল কাঁচের গ্লাস নিচে। বিকট শব্দ হলো। কাঁচ ভেঙে চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ল। পানি গড়িয়ে পড়ল আশেপাশে। সকলের দৃষ্টি তখন ফ্লোরে। রূপাঞ্জনা তখন যেন দিশেহারা। কী করতে গিয়ে কী করে ফেলছে? নিজেরই কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হলো তার। রাশেদ সাহেবও নিচে গ্লাস পড়ে যাওয়ার সেদিকে তাকালেন। হতবাক হলেন অন্যকিছুতে চোখ পড়তেই। স্থির নয়নে কিছু মূহুর্ত চেয়ে থাকতেই দম বন্ধ লাগল উনার। হাসফাস করতে থাকল। বিছানায় টলে পড়লেন। আকস্মিক ঘটনায় উপস্থিত সকলে চরম বিস্মিত। হঠাৎ কী হলো রাশেদ সাহেবের? নোমান দেরি না করেই ছুটল কেবিনের বাহিরে ডক্টরকে ডাকতে। রূপা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। হঠাৎ এমন হবার কারণ উপলব্ধি করতে পারল না। হঠাৎ করেই সে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। তার পায়ে হালকা উঁচু হিল। তবে ডান পায়ে ছয়টা আঙ্গুল স্পষ্ট দৃশ্যমান। রূপা না চাইতেও নিজের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরল। তাহলে এটাই উনার এমন অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণ? উনি ধরতে পেরেছেন রূপা রাগিনী নয়? কেন আগ বাড়িয়ে পানি দিতে গেল সে?
ডক্টর ইরশাদ ছুটে কেবিনে প্রবেশ করলেন। দেরি না করেই বুকে চাপ দিতে আরম্ভ করলেন। নার্সকে বললেন ইনজেকশন রেডি করতে। অভিরূপ সবকিছুর মাঝে কী করবে ভেবে পেল না। স্তব্ধ হয়ে থাকা রূপাঞ্জনার হাতটা ধরে বাহিরে নিয়ে এলো। রূপাঞ্জনার ফোনের মেসেজ টোনটা বেজে উঠতেই চকিতে তাকিয়ে পার্স থেকে ফোন বের করল সে। অভিরূপের অশান্ত মুখে পানে চাইল একবার। একটু সরে এসে মেসেজ ওপেন করতেই একটা মেসেজ ভেসে উঠল ফোনের স্ক্রিনে।
‘মিশন কমপ্লিট! সিলি গার্ল! অভিরূপকে বাঁচাতে দৌড় দিয়েছিস। কিন্তু আমার টার্গেট তো অভিরূপ চৌধুরী নয়।’
হাফ ছাড়ল রূপা। তবে টার্গেট কী ছিল? মাথায় এলো না। সেসব নিয়ে মাথাও ঘামাল না। ফোনটা জোরে চাপ দিয়ে ধরে বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,
“সব ধ্বংস হক তোর হাতে ডার্ক ম্যাক্স! শুধু ওই পাগল মানুষটা অক্ষত থাক।”
চলবে…