গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব-৪৯

0
400

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৪৯

হসপিটালের ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে রূপাঞ্জনা। তার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে রেলিং চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে অভিরূপ। দুজনেই চুপচাপ। মুখে নেই কথা। অভিরূপের হাতে কীসের যেন চা! ওয়ান টাইম গ্লাসে মাঝে মাঝে লাগাচ্ছে নিজের সুন্দর ওষ্ঠদ্বয়ের চুমুক। আজ সূর্যের তেজটা কম। রোদ কম ছড়াচ্ছে। মেঘের উড়ে বেড়ানোর সংখ্যা বেশি। বাতাসের বেগটাও বেশি। এত বড়ো ভবনের ছাঁদে হাওয়ার পরিমাণ যেন স্বাভাবিকের চেয়ে আরো অনেকটাই বেশি। মাঝে মাঝে সূর্যের কিরণে চোখমুখ কুঁচকে আসছে রূপাঞ্জনার। বায়ুর মাত্রা বাড়তেই ক্লিপ থেকে খুলে খুলে আসছে রূপার ছোটো চুলগুলো। তড়িঘড়ি করে সেসব ক্লিপে আটকাতে চাইল রূপা। অভিরূপের কণ্ঠসুরে এবার ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় সে।
“আঙ্কেল এখন ভালো আছে টেনশন নিও না। উনি এত দ্রুত তার আদরের মেয়েকে রেখে কোথাও যাবেন না।”

রূপাঞ্জনা চুলগুলো ক্লিপে আঁটকে ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘হুমম।’
সে নিজেও চিন্তিত ছিল। মূহুর্তে মূহুর্তে ভেবে যাচ্ছিল এই মানুষটার আবার কিছু হবে না তো? যদিও কিছু একটা হয়েই যেত তাহলে একটা মেয়ে তার বাবাকে হারাত। বিষয়টা রূপার ভালো লাগত না। রূপার কাছে সবচেয়ে দুর্বল দুটো শব্দ হচ্ছে মা আর বাবা। এই দুটো মানুষের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন সে ভেতরে ভেতরে তড়পে ওঠে। কারণটা হয়ত ছোটোবেলা থেকে নিজের এই আপন মানুষগুলোকে কাছে না পাওয়া। অভিরূপ আবারও বলল,
“একটা কথা এখনো বুঝিনি আঙ্কেল ভালোই তো কথাবার্তা বলছিলেন তাহলে হঠাৎ এমন হাইপার হলেন কেন?”

থতমত খেয়ে রূপার পা গেল নিজের পায়ের দিকেই। তার পায়ের ছয়টা আঙ্গুল! পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে ভবনের নিচে মেইন রাস্তার দিকে তাকাল সে। আনমনে দেখতে লাগল ব্যস্ত যানবাহনের ছোটাছুটি। অভিরূপও চুপ হলো এবার। মনে মনে একটা কথা বলার জন্য উসখুস করছে। শত সংকোচ কাটাতে সাহায্য করে তার গান, তার গলার সুর। ফট করে বলল,
“গান শুনবে?”

চকিতে তাকাল রূপা। কী বলবে বুুঝতে না পেরে শুধু মাথা ঝাঁকাল। রূপাকে এমন মনমরা দেখে অভিরূপ একটু ব্যতিব্যস্ত হলো। মেয়েটাকে একটু চঞ্চল করতেই তো তার যত কারসাজি! অভিরূপ এবার উপায়ে উপায়ন্তর না পেয়ে খপ করেই রূপার ডান হাতটা ধরে নিয়ে হেঁচকা টানে। তার এমন আচরণে লোচন দুটো বড়ো বড়ো হলো রূপার। কী করতে চাইছে এই ছেলে? আঁতকে উঠল রূপা। অভিরূপ অন্যহাতটা নিজের বুকের বাম পাশে রেখে গানের সুর তুলে বলল,
“তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।
ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবে না
ক্ষ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড় আর পাবে না, না, না,না,
ছেড়ে দেব না।”

রূপাঞ্জনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতটা উঁচু করে ধরে তাকে গোল করে ঘোরাতে শুরু করল অভিরূপ। মেয়েটার বিস্মিয়ে ভরা ফ্যাকাশে চেহারা দেখতে বেশ মজা পেল সে। এই দৃশ্য সারাজীবন দেখতে পেলে মন্দ হয় না! মুগ্ধ হয়ে সে গেয়ে উঠল,
“তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।
তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না!”

থামল অভিরূপ। ছাড়ল রূপার হাত। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রূপা। এবার তার দিকে ঝুঁকে অভিরূপ বলল,
“কোনো তো রিয়েকশন দাও!”

“মানে?”

“হাসো, রাগো, বিরক্ত হও। কিন্তু মনমরা হয়ে থেকো না। তোমায় বিশেষত রাগানোর জন্যই এভাবে উইদাউট পারমিশন হাত ধরে রাউন্ড করে ঘুরিয়েছি। রেগে রেগে তাকাও। আমি ম্যানেজ করে নেব তোমার চোখের আগুন। কিন্তু চোখের পানি আমার সহ্য হবে না।”

রূপাঞ্জনা অভিরূপের এমন অদ্ভুত কর্মের কারণটা জেনে আরো বেশি হতবাক হলো। নিজেকে ধাতস্থ করে তৎক্ষনাৎ জবাব দিল,
“আমি মনমরা হয়ে নেই। একদম ঠিকঠাক আছি।”

“তুমি কি বহুরূপী?”

আচমকা অভিরূপের অযাচিত সত্য কথায় হকচকিয়ে উঠল রূপাঞ্জনা। তবে কি মানুষটা চিনে ফেলল তাকে? মুখে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্কের রেশ। দেখতে পেল সন্দিহান হয়ে চেয়ে আছে অভিরূপ। আমতা আমতা করে রূপা জিজ্ঞেস করল,
“মা…মানে? কেন?”

“কেন আবার! কখনো তোমায় সাহসী দেখি! কখনো বা ভয়ংকরী! আবার কখনো নমনীয় তুলোর মতো। কখনো একেবারেই ভীতুর ডিম। তুমি যেন একটা মানুষ নও, একের ভেতর সব একটা গাইড।”

রূপাঞ্জনা এবার স্বস্তি পায়। প্রতিত্তোরে বলে,
“এই আপনার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে কীসে মানায়?”

“প্রথম যেই রূপে তোমায় দর্শন করেছিলাম। সাহসিনী! ভয়ংকরী চাহনি! সেই চোখে আস্ত একটা দাবা’নল দেখে ফেলেছিলাম। সেটাই আমার খুব প্রিয়।”

অভিরূপ নিঃসঙ্কোচে বলে দিল। রূপাও সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“তবে ধরে নেবেন সেটাই আমার আসল রূপ, আমার আসল ব্যক্তিত্ব।”

“তোমার সেই ব্যক্তিত্বকেই আমি ভালোবাসি।”

রূপাঞ্জনার মনে খেলে গেল উত্তাল হাওয়া। দম বন্ধ হওয়া এক অনুভূতি আঁকড়ে ধরল তাকে। এ যেন ডার্কের অত্যা’চারের থেকেও বেশি পীড়া দেয়। নিজের ওড়না মুঠো করে ধরে বলল,
“কী?”

অভিরূপ নিজেই চমকালো এবার। সে পাগল হয়ে গিয়েছে। কোনো প্রস্তুতি বা কোনো ইঙ্গিত না দিয়েই সরাসরি ভালোবাসি? উঁহু, প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার! সে ঢক গিলে বলল,
“আঙ্কেল আমার ব্যাপারে তোমায় কিছু বলেছে?”

বোধগম্য হলো না রূপার। বোকা বোকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। বলল,
“কীসের ব্যাপারে?”

অভিরূপ সাহস করে বলে দিল,
“সহজ ভাষায় উনি এবার চিন্তামুক্ত হতে চান। মানে তোমার দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। সোজা কথা, আমাকে উনি আমাদের বিয়ের কথা বলেছেন। তোমার আপত্তি না থাকলে বিষয়টা এগোবে।”

বাকরুদ্ধ হলো রূপাঞ্জনা। তার মানে রাগিনী আর অভিরূপের বিয়ে! রূপার ভালো লাগার কথা। সে মনটাকে ভালো লাগানোর চেষ্টা করল। তবে হয়ে উঠল না। নিজের হাতটা বাড়িয়ে অভিরূপের হাত ধরে বোকামি করে বলল,
“ওহ বিয়ে! কংগ্রাচুলেশনস!”

অভিরূপ হাত মেলাতে মেলাতে অন্যহাত দিয়ে মাথা চুলকে বলল,
“এই প্রথম দেখলাম কোনো বিয়ে তার নিজের বিয়েতেই তার উডবিকে কংগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছে।”

সঙ্গে সঙ্গে হাত ছাড়িয়ে নিলো রূপা। এক মূহুর্তের জন্য যেন ভুলতে বসেছিল সে এখন অন্য এক ব্যক্তিত্বের অভিনয়ে রয়েছে। এখানে থাকলে বার বার এমন ভুল হবে। দ্রুত কোনোভাবে চলে যাওয়া দরকার! রাগিনীও যেকোনো মূহুর্তে চলে আসতে পারে! ঠিক নেই। হন্তদন্ত হয়ে একটা পরিকল্পনা বের করে বলল,
“আপনি যেই চা পান করছিলেন আমার জন্য একটু হবে? গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আরকি!”

“হুয়াই নট। ক্যান্টিনে যাচ্ছি আর আসছি। কোথাও যেও না।”

অভিরূপ চলল রূপাঞ্জনার পাশ কাটিয়ে চা নিতে। হাঁটার মাঝে থেমে ঘাড় বাঁকিয়ে বলল,
“বললে না তো কোনো আপত্তি আছে কিনা এই সম্পর্কে! তুমি বললে বিয়েটা নিয়ে আর একটা কথাও উঠবে না।”

রূপাঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাগিনী এই প্রশ্নে কী জবাব দিত? নিজের বাবার এই প্রস্তাবে না করত না নিশ্চয়ই! তবে ওই পুলিশের লোক কোহিনূরের সঙ্গে তার যে সম্পর্কের গভীরতা? তার কী হবে? ফের ভাবল, এত জেনে তার কী? থমথমে গলায় বলল,
“হয়ত নেই।”

“চা আনতে আনতে সিউর হয়ে নাও আপত্তি আছে কিনা! আই ওয়ান্ট গ্যারান্ট অ্যান্ড ওয়ারেন্টি।”

অভিরূপ আর উত্তরের জন্য দাঁড়াল না। চলে গেল। সে যাওয়ার কিছুটা পরেই হনহনিয়ে নিচে নেমে চলে গেল রূপা।

‘ব্রেকিং নিউজ! শহরে লেগে তো রয়েছেই একের পর এক আত’ঙ্ক। নিরাপদে নেই কেউই। এইসব কিছুর মাঝে আবারও নতুন এক বিপদের সূচনা। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, বর্ণনীল ব্যাংকে ভয়া’নক ডা’কাতি হয়েছে। ডা’কাতের দল ছি’নিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। সেই সঙ্গে প্রাণ গি’য়েছে দুজনের। আ’হত তিনজন। তাছাড়া সেখানে উপস্থিত থাকা সব মানুষের শ্বাসকষ্ট উঠে গিয়েছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেট করে এতটুকু জানতে পেরেছে যে কোনো কেমিক্যালের ব্যবহার হয়েছিল সেখানে। ফলে হয় কেউ কেউ জ্ঞান হারায় আর নয়তবা শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। টেরো’রিস্ট অ্যা’টাকের পর এই ডা’কাতি যেন আমাদের পাঁচ বছর আগের সেই ভয়া’নক আত’ঙ্কবাদীর কথা মনে করিয়ে দেয় যারা পুরো শহরটাকে নিঃ’স্ব করার মি’শনে উঠেপড়ে লেগেছিল। কে আছে এসবের পেছনে? পুলিশ টিম, গোয়েন্দা বিভাগ কারোরই সাধ্য হয়ে উঠছে না আত’ঙ্কবাদীদের ধরার। তার উপর এই হা’মলা কি তারা সামলাতে পারবে?’

ফোনের স্ক্রিনে এই সংবাদ শুনতে বি’ষের ন্যায় লাগল নির্জনের কাছে। নিজের ক্রো’ধ আর নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে উঠল না তার। ফোনটাকে বেশ রূঢ়ভাবে ছিটকে ফে’লে দিলো ফ্লোরে। ফোনের বিভিন্ন পার্টস খুলে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সেটাতেও ক্ষ্যান্ত হলো না নির্জন। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে থাকা সমস্তকিছু একহাতেই ঝটকা দিয়ে ফে’লে দিতেই মেহরাজ এলো। বিকট শব্দে সে নিজেও চমকে উঠে নিজের মুখ ঢাকল। বলা তো যায় না তার মুখচোখেও কোনদিক থেকে আ’ক্রমণ হয়! উঁকি দিয়ে দেখল নির্জন টেবিলে দুটো হাত রেখে নিচু হয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। রাগে মৃদু কাঁপছে। মেহরাজ ঢক গিলে মিনমিন করে বলল,
“স…স্যার…”

নির্জন মাথা উঠিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই আঁতকে উঠল মেহরাজ। এই মূহুর্তে এখান থেকে কেটে পড়ায় শ্রেয় মনে হলো তার কাছে। যেন সে ভুল সময় এসে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে পেছন ফিরে বলল,
“সরি স্যার। আমি অন্যসময় আসছি।”

নির্জনের বিরক্তি আকাশ ছোঁয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“যেতে বলেছি তোমায়? কী বলবে বলো!”

নির্জনের কথায় আর বাহিরে বের হওয়ার সাহসটা পায় না মেহরাজ। ফিরে এসে টেবিলে একটা ফাইল রেখে বলে,
“এখানে একটা ডক্টরের ডিটেইলস আছে স্যার।”

“কোন ডক্টর? কীসের ডক্টর?”

“ওইযে, আপনাকে বলেছিলাম না? আমরা খোঁজ পেয়েছি সেই ডক্টরের যে নকল রাগিনীর সার্জারি করে আসল রাগিনী ম্যাডামের মতো হয়েছেন।”

এবার টনক নড়ে নির্জনের। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হু। তার খোঁজ পেয়েছো?”

“ইয়েস স্যার। কিন্তু আপনার কথা অনুযায়ী আমরা ইন্ডিয়ার পুলিশ টিমের সাহায্য নিই। কারণ এটা জানা যে বাংলাদেশ এখনো প্লাস্টিক সার্জারি বিষয়ে এতটাও উন্নত নয় যে একজনের চেহারা হুবহু বসিয়ে দিতে পারবে। আর কাজটা ইন্ডিয়াতেই হয়েছে। ইন্ডিয়ার পুলিশ টিম ধারণা করেছে বাংলাদেশ থেকে চো’রা ভাবে তারা ইন্ডিয়ায় গিয়েছিল। কারণ এই নিয়ে অনেক কথা উঠেছিল তখন। কিন্তু প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এইটা হচ্ছে ডক্টরের ডিটেইলস।”

নির্জন ফাইলটা ধরে ঘাঁটল। ফের ডা’কাতির কথা স্মরণে আসতেই ফাইল হাতে ধরেই প্রশ্ন করল,
“সাংবাদিকদের কথা অনুযায়ী এই ডা’কাতি, আত’ঙ্ক বর্তমানে রিপিট চলছে। মানে এর আগেও এমন কিছু ঘটেছিল। আচ্ছা, এসপি স্যার বলছিলেন না? পাঁচ বছর আগেও একটা ডেঞ্জারাস স’ন্ত্রাসের দল পুরো শহরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল! সেই টিম সম্পর্কে কিছু জানো তুমি?”

“না স্যার। তবে এটা জানি যে ওই টিমের ধ্বং’স তো অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল। ওই মাস্টারমাইন্ড তো ম’রে গিয়েছিল। তাই না?”

“কী নাম ছিল সেই মাস্টারমাইন্ডের?”

মেহরাজ মাথা চুলকায়। এত কিছু তো তার মনে নেই। নির্জনের কৌতূহল বাড়তে থাকে। মেহরাজের মুখভঙ্গিতে বুঝতে পারে সে এতকিছু জানে না। তাই বলল,
“আগেকার ইনফরমেশন, ফাইলস্ যেই রুমে জমা থাকে সেখান থেকে পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা সম্পর্কে যত ইনফরমেশন কালেক্ট হয়েছে সেটার ফাইল নিয়ে এসো। ফাস্ট!”

মেহরাজ মাথা ঝাঁকিয়েই ছুটল। নির্জন ঠোঁট কামড়ে লক্ষ্য করল ডক্টরের ইনফরমেশনগুলো। এখানে থাকলে আহামরি কিছু করে উঠতে পারবে না সে। কারণ ঘটনা ঘটেছে ইন্ডিয়ায়। হয়ত সেখানে পাড়ি জমাতে হবে কিছুদিনের জন্য।

মেহরাজ ফিরে এলো নির্জনের কাছে মিনিট বিশেক পর। হাতে ধুলোমাখা, ময়লা নীল রঙের ফাইল। বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে দিলো নির্জনের কাছে। সেটা হাতে নিয়েই প্রথমে ফুঁ দিয়ে উপর থেকে ময়লা ঝেড়ে নিতেই দৃশ্যমান হলো ফাইলের ওপর কালো মোটা কালি দিয়ে লেখা ‘ডার্ক ম্যাক্স মিশন’ শব্দটি। চোখজোড়া সরু হয়ে এলো নির্জনের। ফাইলটা খুলল আগ্রহের সাথে। দেখা গেল একজন অর্ধবয়স্ক লোকের ছবি। মৃ’ত অবস্থায়। চুলে হালকা পাক ধরেছিল সবে। চোখেমুখে ভদ্রসভ্য একটা ভাব থাকলেও এই মানুষটির মুখোশের পেছনে ছিল এত ভয়াবহতা? তা মেনে নিতে একটু কষ্ট হলো নির্জনের। নিজে একের পর এক ডিটেইলস পড়তে থাকল। সেখানে লেখা ছিল, ‘ছবিতে যেই ব্যক্তিটি তার নাম ডার্ক ম্যাক্স। সেটা ছিল তার ছদ্মনাম। আসল পরিচয় এখনো সকলের কাছে অজানা। যুবক থাকতেই তার টান ছিল বিভিন্ন কেমিক্যালের প্রতি। কেমিক্যাল নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসত। তার গুপ্ত ল্যাবও ছিল। সেখানেই তার মৃ’ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। নিজের বুদ্ধি আর কেমিক্যাল দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার দিয়ে আধিপত্য করতে চেয়েছিল শহর জুড়ে। প্রথমে ছোটোখাটো চু’রি। আস্তে আস্তে একটু করে নিজের গ্যাং তৈরি তারপর থেকে শহরে আত’ঙ্ক ছড়িয়ে ফেলে একের পর এক হা’মলা এবং ডাকা’তির মাধ্যমে। তাকে আটক করা হলেও বেশিদিনের জন্য রাখা যায়নি। ফাঁ’সি হবার আগেই পলা’তক হয় সে। তার খোঁজ করা হয়। সে ছিল পুরো শহরের আত’ঙ্ক। তবে সকলকে অবাক হয়ে দিয়ে সে নিজেই নিজের গুপ্ত ল্যাবে আত্ম’হ’ত্যা করে। এতেই তার ইতি ঘটে।’

বড় একটা শ্বাস ফেলে নির্জন। আসলেই এবার মনে হচ্ছে পাঁচ বছর আগের এই ডার্ক ম্যাক্সের কেসটার সঙ্গে কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে এই রিসেন্ট টেরো’রিস্ট এবং ডা’কাত দলের। তবে কি ডার্ক ম’রেনি? না ম’রলে ফাইলে কার ছবি? মাথাটা ধরে যায় নির্জনের। আপাতত ডা’কাতির বিষয়টা রায়ান দেখছে। সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চায় না। যেকোনো একটাতে ফোকাস রাখতে হবে। নির্জন ধপ করে বসে পড়ে নিজের চেয়ারে। শান্ত গলায় বলে,
“ইন্ডিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করছি মেহরাজ। গেট রেডি!”

নিজের চশমাটা ঠিকঠাক করে কেবিন নম্বর দেখে চলেছে উর্মিলা। কাঙ্ক্ষিত কেবিন খুঁজেই পাচ্ছে না। জাস্ট রিসেপশনিস্ট বলেছিল সেকেন্ড ফ্লোরের কথা। কোনদিকে সেটা বললে কী এমন ক্ষতি হয়? বেখেয়ালি হয়ে হাঁটতে গিয়ে হুট করেই কোনো লম্বাচওড়া ব্যক্তির সঙ্গে হোঁচট খেয়ে গেল সে। মেজাজটা গেল বিগড়ে। পড়তে নিয়েছিল তার সাধের চশমা সেই সঙ্গে হাতে টিফিনবক্সটাও। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই সামনে থাকা মানবটিকে দেখে চোখমুখটাও কুঁচকে এলো এবার। নোমানও উর্মিলার দেখা পাওয়ায় অন্যদিকে ঘুরে গেল! এই মেয়ে নির্ঘাত আবার ঝগড়া বাঁধাবে! আস্তে করে বলে ফেলে,
“চোখ তুলে দেখো না কে এসেছে,
নতুন করে আবার ঝগড়ার সানাই বেজেছে!”

আস্তে করে বললেও শুনতে ভুল হলো না উর্মিলার। গজগজ করে নোমানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল,
“এই, এই আপনি কী বললেন?”

“যেটা তুমি শুনলে। চোখটা খারাপ হলে কী হবে? কানের শ্রবণশক্তি দেখি একদম একশো তে একশো। হয়ত মানুষ ঠিকই বলে মানুষের একটা ইন্দ্রিয় অচল হলে আরেকটা বেশিই সবল থাকে।”

রাগে কটমট করে উর্মিলা বলল,
“খবরদার! আমার চোখ অচল নয়। জাস্ট একটু সমস্যা! আমাকে ইনসাল্ট করবেন না। আপনার তো সব সবল থাকতেও চোখ পকেটে করে তুলে হাঁটেন। নাহলে এতবার ধাক্কা লাগে?”

“তা এই দুপুরে হঠাৎ করে ঝগড়ার ঝুড়ি নিয়ে কোত্থেকে উদয় হলে?”

“বাড়ি থেকে। আঙ্কেলকে দেখতে এসেছি। আপনার সঙ্গে কথা বলে টাইম ওয়েস্ট করার সময় আমার মোটেও নেই। রাগিনী কোথায়? তাকে ডাকুন।”

“সি ইজ বিজি।”

দায়সারা ভাবে উত্তর দিলো নোমান। একটু থেমে আবারও বলল,
“সে তো তোমার মতো যখন-তখন ঝগড়া করার জন্য রেডি থাকে না। ওর অনেক কাজ থাকে। ও হয়ত এখন অভিরূপের সাথে ছাঁদে আছে।’

গাল ফুলিয়ে ফেলল উর্মিলা। মনে মনে বাসনা জাগল যদি সামনের এই অসহ্যকর, খুঁচিয়ে কথা বলা লোকটাকে উদুম কে’লানি দেওয়া যেত! নোমান অন্যপাশ ফিরে কোনোমতে নিজের হাসি আটকালো। এই উর্মিলা মেয়েটাকে রাগাতে বেশ লাগে তার। শ্যামলা উজ্জ্বল চেহারায় যখন রাগ ফুটে ওঠে, ছিপছিপে আর চাপা গাল তখন ফুলে যায় আপনাআপনি। নাক ফুলিয়ে ঝগড়া করার ভঙ্গি দেখলে নোমানের মন চায় সেখানেই সে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবে!

নিজেকে সামলে উর্মিলা ছাঁদে যাবার পথ ধরে বলল,
” ছাঁদে কী করছে দুপুর সময় ও? দেখে আসি।”

নোমান তৎক্ষনাৎ তার হাত আঁটকে ধরল। ধমকে বলল,
“এই মেয়ে, বুদ্ধিসুদ্ধি নেই? তারা ছাঁদে কথা বলছে।”

“কী কথা?”

“সব খুলে বলতে হবে?”

চোখ ছোটো করে তাকাল উর্মিলা। না বললে কী করে বুঝবে? তার এমন চাহনিতে নোমান ফিসফিস করে বলল,
“রোমান্টিক কথাবার্তা বলছে। বুঝেছো এবার? বিয়ের আগে যেসব কথাবার্তা একটা ছেলে আর মেয়ের মাঝে হয় সেসব বলছে।”

উর্মিলা এবার বিস্ফো’রিত চোখে তাকায়। বিস্ময়ে টলমল করতে থাকে। আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। কী প্রতিক্রিয়া করবে বুঝে উঠতে পারে না। হাত থেকে টিফিনবক্সটা পড়ে যেতে নিয়েও নেয় না। ধরে ফেলে নোমান। নিজের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে জোরেশোরে চিৎকার দিয়ে বলে,
“কিহ্?”

এমন উচ্চরবে ভ্যাবাচেকা খেয়ে মাথায় বুদ্ধি না পেয়ে উর্মিলার মুখ হালকা করে চেপে ধরে বলে,
“চুপ, চুপ! হসপিটাল এটা! মানুষ তোমাকেও পাগল ভাববে সঙ্গে আমাকেও।”

বলেই আশেপাশে তাকায় সে। দেখল চারপাশে থাকা লোকজন উদ্ভট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে সকলকে ইশারায় সরি বলল নোমান। সকলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল উর্মিলার দিকে। উর্মিলা মিনমিন করে বলল,
“সরি! এক্সাইটমেন্ট সামালতে পারিনি।”

নোমান কিছু বলার আগেই হাতে করে চা নিয়ে ঘটল অভিরূপের আগমন। অভিরূপ আশেপাশে তাকিয়ে রাগিনীকে খুঁজল। তাকে পেল না। উর্মিলার দিকে চোখ পড়তেই অভিরূপ স্বভাবসুলভ হেঁসে বলল,
“হ্যালো, উর্মিলা!”

উর্মিলার যেন হার্ট অ্যা’টাক হবার উপক্রম। তার পছন্দের স্টার তাকে নিজ থেকে হ্যালো বলছে। কম ব্যাপার নাকি? আবার নাকি এই মানুষটা তার বান্ধবীর হাজবেন্ড হতে চলেছে। এটা তো বড়োসড়ো ব্যাপার! অভিরূপ জিজ্ঞেস করল,
“রাগিনী এদিকে এসেছে?”

নোমান ভ্রু কুঁচকায়।
“রাগিনী তো তোর সাথে ছিল!”

“তা তো ছিল। কিন্তু ওর জন্য চা আনতে ক্যান্টিনে গেলাম। ওখানে তো সব ছেলেমেয়েদের মাঝে ফেঁসে গিয়েছিলাম। সকলে সেল্ফি অটোগ্রাফ দিতে দিতে আধম’রা হয়ে ফিরে এলাম। এসে দেখি সে নেই। কোথায় গেল বুঝতে পারছি না।”

নোমান ছো মে’রে অভিরূপের হাত থেকে চা নিয়ে সেখানে চুমুক বসিয়ে বলল,
“জীবনে জুতা নিচে পড়িস কিনা সন্দেহ আছে। আর তুই কিনা অন্যজনের জন্য চা আনতে যাচ্ছিস! ইন্টারেস্টিং!”

আরো বেশ কিছু কথা চলে তাদের মাঝে। অভিরূপ ফোন করলেও রাগিনী ফোনটা ধরে না। সে বেশ চিন্তিত হয় মনে মনে তার জন্য।

আধঘণ্টা পর তড়িঘড়ি করে হসপিটালে আসে রাগিনী। ব্যাগ খুলতে খুলতে ফোনে দেখে অভিরূপের নয়বার কল। কিছুটা চমকে ওঠে সে। পায়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত পৌঁছে সকলের কাছে। সকলে রাশেদ সাহেবের কেবিনেই দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত অভিরূপের চোখের সামনে রাগিনী দৃশ্যমান হতেই চকিতে তাকাল সে। রাগিনীর পরনে অন্য পোশাক, খোলা চুল হাতে অন্য ব্যাগ। এ যেন অন্য রূপের রাগিনী! ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে,
“তুমি বাড়ি গিয়েছিলে আবার?”

অভিরূপের প্রশ্নের মানে খুঁজে পায় না রাগিনী। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“মানে? আমি তো সবেই বাড়ি থেকে এলাম। আপনি আমায় অনেকবার কল করেছেন! কোনো সমস্যা? বাবা ঠিক আছে তো?”

অভিরূপ ভ্যাবাচেকা খায়। ক্ষীণ সুরে বলে,
“তখনই তো একটু প্রবলেম হয়েছিল! কিন্তু একটু পরই তো ডক্টর বললেন উনি ঠিক আছেন।”

বাবার সমস্যার কথা শুনেই মনটা ছ্যাঁত করে উঠল রাগিনীর। আর কারো কথা কানে না তুলেই দ্রুত রাশেদ সাহেবের কেবিনে প্রবেশ করল। অভিরূপ হাঁ হয়ে চেয়েই রইল। তারপর নোমানকে বলল,
“বুঝলাম না! ও একটু আগে তো অন্য ড্রেসে ছিল। আবার এখন অন্যভাবে! আবার বলছে ও কেবল এলো। ওর কথা তো কিছুই বুঝলাম না।”

নোমান একটু ভেবে বলল,
“তুই ওকে তোদের বিয়ের কথা বলেছিস?”

অভিরূপ মাথা নাড়ায়। তৎক্ষনাৎ তার ঘাড়ে চাপড় মে’রে নোমান বলে,
“সেকারণেই লজ্জা পেয়েছে। তোর মতো তো সবাই নির্লজ্জ নয় ইউ নো! লজ্জা নারীর ভূষণ! আর হয়ত কোনো প্রবলেম হয়েছে আই মিন গার্লস প্রবলেম। তাই হয়ত বাড়িতে গিয়েছিল আবার। ঘাঁটাস না ওকে।”

অভিরূপের সবটা অবিশ্বাস্য মনে হয় না। নোমানের কথায় যুক্তি আছে বটে। তাই সেসব নিয়ে আর কথা বাড়ায় না সে।

কেটে গিয়েছে প্রায় এক সপ্তাহ। বিলীন হয়েছে আগের স্নিগ্ধ সময়গুলো। সুস্থ হয়ে উঠেছেন রাশেদ সাহেব। এখন বাড়িতেই রয়েছেন তিনি। মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে শ্বাস ফেলতে সময় পান না যেন। রাগিনীর আপত্তি নেই জন্য আরো বেশি খুশি তিনি। রাগিনী নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে তার বাবাকে চিন্তামুক্ত রাখার। এভাবেই কাটছে দিন। আজকে অভিরূপের মা-বাবা আর নোমানের বাবাও দেশে আসছেন। নোমানের মা নেই। ওদেরকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়েছে নোমান আর অভিরূপ। আজ সন্ধ্যায় আংটি পড়ানো হবে রাগিনীকে। যাকে বলে এঙ্গেজমেন্ট। রাগিনীর এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা বা তোড়জোড় নেই। সে এসেছে লাইব্রেরিতে। বিগত কদিন ধরে সময় কাটছে না তার। অন্যদিকে রাশেদ সাহেব মানা করে দিয়েছে বর্তমানে ইন্টারনেট, ভার্চুয়াল লাইফ থেকে দূরে থাকতে। কারণ রাগিনীর মেডিটেশন চলছে। ডিপ্রেশন কাটানো প্রয়োজন তার। আর ইন্টারনেটের বিভিন্ন জিনিস চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়। তাই রাশেদ সাহেবের এই কথা!

চারিদিকে যেন বইয়ের পাহাড়। এত এত বইয়ের মাঝে কোন বইটা তার পড়া উচিত সেটা ভেবেই দিশেহারা হয়ে উঠছে রাগিনী। গোল গোল চোখে দেখছে বইয়ের সব নাম। বেশ ভেবে একটা বই হাতে নিলো রাগিনী। এটা প্রেমের উপন্যাস। ঢক গিলে সাথে সাথে বইয়ের তাকে রেখে দিলো সে। এটা পড়লে পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে ফের কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির গুনগান গাইবে। কী দরকার যেই মানুষটা তার নয় সেই মানুষটাকে মনে করার? প্রয়োজন নেই তো! তবে বিগত কয়েকদিন ধরে কোথায় হারিয়েছে মানুষটি? রাগিনীর মনে প্রশ্ন এলো। লোকটার দেখা পায়নি সে বেশ কয়েকদিন হলো। অদ্ভুত বিষয় হলো রাগিনীর বিষয়টাকে খুশি হওয়ার কথা! তবে তার মনটা উল্টো কাজ করছে। বিষণ্ণ, বিমূঢ়, ব্যাকুল হয়ে উঠছে বারংবার।

আকাশপাতাল ভাবনা চিন্তার মাঝে অসাবধানতাবশত আচমকা মৃদু ধা’ক্কা লাগে কারোর সঙ্গে। হকচকিয়ে সরি বলতে নিলেই বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফাহমিদকে চোখে পড়ে তার। অনেকদিন পর ফাহমিদকে দেখে অসাময়িক হেসে রাগিনী বলে,
“ফাহমিদ, অনেকদিন পর দেখা হলো! কেমন আছো?”

“এইতো চলছে! তা ম্যাডাম হঠাৎ লাইব্রেরিতে! ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই পড়াশোনা স্টার্ট হয়ে দিয়েছো?”

“তেমন কিছু না। এমনি পড়ার জন্য বই খুঁজছিলাম। তুমি কী বই পড়ছো?”

ফাহমিদ স্মিত হেসে তার হাতের বইটা দেখায়। সেটা দেখেই রাগিনী বলে ফেলে,
“তোমার এখনো কেমিস্ট্রির প্রতি আগ্রহ গেল না। সেই কলেজ থেকে দেখছি তুমি কেমিস্ট্রি খুব পছন্দ করো। এখনো একই রয়ে গেলে। কী পাও এটা পড়ে?”

“তুমি যেমন সাইকোলজি নিয়ে পড়ে শান্তি পাও, আমিও তেমনই কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ে মজা পাই।”

রাগিনী আর ফাহমিদ দুজনেই নিজের পছন্দ মতো বই নিতে নিতে বেশ কথাবার্তা বলল। এর মাঝে রাগিনী খেয়াল করল তার দিকে বেশ কয়েকজন উদ্ভট চোখে তাকাচ্ছে। বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। বিষয়টা কেমন যেন লাগল রাগিনীর। তবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ফাহমিদকে বিদায় জানিয়ে বাহিরে এসে উর্মিলাকে কল লাগালো সে। বেশ দ্রুতই ফোন রিসিভ হলো। রাগিনী সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“কোথায় তুই? আমি অপেক্ষা করছি তো!”

“তোর পেছনে তাকা। দেখতে পাবি।”

কানে ফোন নিয়েই পেছন ফিরল রাগিনী। চোখে পড়ল চশমা পড়া ছিমছাম সুন্দর গড়নের মেয়েটাকে। রাগিনী কল কেটে এগিয়ে আসতেই উর্মিলা তড়িঘড়ি করে বলল,
“চল, চল! অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আমার এখনো অনেক শপিং বাকি।”

উর্মিলার তাড়াহুড়ো দেখে রাগিনী হাসে। মেয়েটা এত এক্সাইটেড যে মনে হচ্ছে তারই বিয়ে। অন্যদিকে রাগিনীর কোনো হেলদোল নেই। রাগিনী কথা বাড়ায় না। গিয়ে বসে গাড়িতে। গাড়ি চলতে শুরু করে। রাস্তায় বেশ ট্রাফিক! প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে হাতে ফোন নিয়ে ফেসবুক ঘাঁটতে লাগল উর্মিলা। রাগিনীর বেশ ঘুম পাচ্ছে। আজকাল রাতে ঘুম পায় না তার। এপাশ-ওপাশ করে শেষমেশ জীবনের সবচাইতে বিরক্তিকর মানুষটির স্কেচ দেখে কেটে যায়। মিনিট পাঁচেক পর হুট করেই নিজের কাঁধে হালকা ব্যথা অনুভব করে রাগিনী। শুনতে পায় উর্মিলার উচ্চ কণ্ঠসুর।
“এই এই রাগিনী! দেখ দেখ। কী দেখাচ্ছে ফেসবুকে!”

রাগিনীর চোখ মেলতে মন চাইল না। চোখ বুঁজেই হালকা অপ্রসন্ন হয়ে বলল,
“কী দেখাচ্ছে?”

“তোর আর অভিরূপ জিজুর ছবি! ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।”

চোখ খুলতে সময় লাগল না এবার রাগিনীর। বিদ্যুতের গতিতে উঠে বসে ছোঁ মে’রে ফোনটা নিয়ে দৃষ্টি আটকালো ফোনে থাকা ছবির দিকে। উপরে স্পষ্ট ক্যাপশন লেখা, ‘তবে কি বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশি নারীর প্রেমের আটকালো অভিরূপ চৌধুরী? প্রেমে পড়ে রিকশায় ভ্রমণে দুজন।’

ভ্রু কুঞ্চিত হলো রাগিনীর। মাথায় একটাই প্রশ্ন এলো এই ছবিটা কখনকার তোলা? সে কবে অভিরূপের সাথে রিকশায় উঠেছিল? মনে পড়ছে না তো! উর্মিলা প্রফুল্ল হয়ে বলল,
“বিয়ে না হতেই সেলেব্রিটি হয়ে গেলি! বিয়ে হলে কী হবে ভেবেছিস?”

রাগিনী পাল্টা প্রশ্ন করে বলল,
“কিন্তু এটা কবেকার ছবি?”

“ভুলে গেলি? আমরা ওইদিন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম রিকশায়!”

“কবে?”

“এত দ্রুত কীভাবে ভুলতে পারিস? আমরা ঘুরতে বেরিয়েছিলাম!”

রাগিনীর মনে পড়ে না তারা কবে একসাথে বেরিয়েছিল? যেদিন বের হওয়ার কথা ছিল সেদিন তো উর্মিলা ছিল না। আর সেই বাজে ঘ’টনাও ঘটে গিয়েছিল তার সঙ্গে। তবে তারা ঘুরতে গেল কখন? মাথায় চাপ পড়ে রাগিনীর। তবুও স্মরণে আসে না। ভালো করে ছবির দিকে খেয়াল করে দেখে ছবিতে যেমন ড্রেস তার পরনে তেমন ড্রেসও তার নেই। এমন ভাবনায় সারা রাস্তা কাটে তার। আর পাশে উর্মিলার বকবক!

বেখেয়ালি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাগিনী। মন থেকে চিন্তা সরছে না সেই ছবিটা দেখার পর থেকে। তবে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পেরেছে তখন লাইব্রেরীতে এভাবে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকে পর্যবেক্ষণ করার কারণ। ছবিটা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। ছবি দেখে মনে হলো যেন একদম জীবন্ত! কোনো ইডিটের প্রভাব নেই। তবে?
“এই ঘড়িটা ভালো লাগছে?”

ভাবনার অন্ত ঘটে রাগিনীর। উর্মিলার হাতে ঘড়ি দেখে ভালোমতো খেয়াল না করেই বলে,
“হু ভালোই তো।”

“তাহলে কিনে নিই?”
রাগিনী মাথা দুলায়। ঘড়ি কিনে দুজন বেরিয়ে আসে।

লিফট থেকে নেমে নয়নতাঁরা এত এত ড্রেসের শোরুম দেখে দিশেহারা হয়। দৌড়ে যেতে গিয়েও যায় না। নির্জনের হাত ধরে হাঁটতে থাকে। নির্জনের আরেকহাতে ব্যাগে ভর্তি। নয়নতাঁরা আজ তাকে জোর করে শপিং করাতে নিয়ে এসেছে। আজই ইন্ডিয়া থেকে দেশে ফিরেছে নির্জন। প্রথমেই ভেবেছিল রাগিনীর খোঁজ নেওয়ার কথা! তবে নয়নের জোরাজুরিতে আসলে হলো শপিংমলে। হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে নির্জন বিরক্ত হয়ে বলে,
“আমার ব্যাংক ব্যালেন্স কি আজকেই শেষ করার প্ল্যানিং করে এসেছো নয়ন?”

“আরে না না! আমি তোমার ব্যাংক ব্যালেন্স শেষ করলে রাগিনী ভাবির কী হবে? আমি এতটাও খারাপ ননদিনী হব না যে ভাবির কথা ভাববে না।”

নির্জন দম ফেলে বলে,
“তাহলে অনেক তো শপিং করেছো! এখন তো যাওয়া যায়!”

“আর একটা বিগ ব্রাদার প্লিজ! রিমেম্বার, তোমার জন্য আমাকে লন্ডনেই সব জামাকাপড় ফেলে আসতে হয়েছে। আর এটা তোমার পানিশমেন্ট।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্জন। মেয়েদের এই একটা সমস্যা! শপিংমলে এলে তাদের কেনাকাটা শেষ হতে চায় না।

উর্মিলা আর রাগিনী ঢুকেছে ড্রেসের সাইডটাতে। শোরুমে ঢুকে একের পর এক ড্রেস দেখে যেতে ব্যস্ত উর্মিলা। রাগিনী আনমনে বাহিরের দিকে চেয়ে। মনে পড়ছে তার বিগত কিছু স্নিগ্ধ মূহুর্ত। কোহিনূরকে তার সঙ্গে এখানে এনেছিল সে। কতই পাগলামি না করেছিল! সেইসব স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে একটু একটু করে। আকস্মিকভাবে সেই স্মৃতি যেন সত্যিতে পরিণত হয়। তার সামনে সত্যিই কোহিনূরকে আবিষ্কার করে বসে রাগিনী। মাথাটা ভনভন করে ঘুরে ওঠে। সে কি ভুল দেখছে? নাহ, সব ঠিক দেখছে। সব স্পষ্ট। ওইতো মানুষটা শোরুমের বাহিরেই দাঁড়িয়ে! পাশে একটা চেনা নারীও চোখে পড়ে তার। কোহিনূর তার সঙ্গেই কথা বলতে মশগুল। রাগিনীর আশেপাশে অন্ধকার হয়ে আসে। এতদিন কোথায় ছিল মানুষটা? জানতে মনটা আকুলতায় ছেয়ে যায়। আর ওই মেয়েটাকে চিনেও চিনতে পারে না। নিজের মনের বিরুদ্ধে যাবার সাধ্য তার নেই। কোহিনূর তার চোখের আড়াল হতেই দ্রুত সে উর্মিলাকে বলল,
“আমি একটু আসছি।”

বিলম্ব না করে শোরুমের বাহিরে চলে এলো সে। দেখা পেলো কোহিনূরের। সে অনেকটা দূরে মেয়েটির সাথে হাঁটছে। রাগিনী যেতে গিয়েও থমকালো! কেন সে বার বার ছুটতে চাইছে মানুষটার নিকট? আচমকা মনে পড়ল কোহিনূরের পাশে থাকা মেয়েটির কথা! এটাই তো সেই মেয়ে যাকে সে আর কোহিনূর একদিন হসপিটালে দেখেছিল। কোহিনূরকে দেখে সে বিগ ব্রাদার বলে ডেকে উঠেছিল। কিন্তু কোহিনূর তাকে না চেনার ভান করেছিল বেশ ভালো করেই। আর আজকে ওই মেয়েটির সাথে কোহিনূর? সব গুলিয়ে এলো রাগিনীর। মাথায় একটাই কথা এলো, ‘মানুষটাকে একদমই বিশ্বাস করা যায় না। পৃথিবীর সবচেয়ে অবিশ্বাসযোগ্য মানুষটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।’

চলবে…