তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন পর্ব-০১

0
1537

#তাজ-ইলোর প্রণয়ালাপন
লেখনীতে—ইলোরা জাহান ঊর্মি
পর্ব:০১

অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মধ্যরাতে রাস্তার একপাশে বাধ্য মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার ক্রদ্ধ দৃষ্টি রাস্তার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা তাজ ভাইয়ার উপর। যে এখন একজন নিরীহ লোকের উপর অনবরত চেঁচামেচি করে চলেছেন। যদিও চেঁচিয়ে কী বলছেন তা আমি শুনতে পাচ্ছি না। কিন্তু লোকটার ভীতু চেহারা আর তাজ ভাইয়ার কঠিন চেহারা দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এইখানটায় কোনো স্ট্রিট লাইট নেই। অদূরের একটা স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় ওপাশের হিংস্র রূপী তাজ ভাইয়াকে জ্যান্ত একটা পিশাচ বলে মনে হচ্ছে আমার। মনে হবেই না কেন? এই লোকটা তো আমার জীবনে এন্ট্রিই নিয়েছিল ঘোর অমাবস্যার রাতে। সেদিনও অমাবস্যা ছিল, আজও আছে। লোকটা আমার জন্য আসলেই অশুভ। নইলে একটা ঘুমন্ত মেয়েকে এভাবে ঘুম থেকে টেনে তুলে এনে এমন রাস্তার কিনারায় দাঁড় করিয়ে রাখে? আসলে আমি নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে তাজ ভাইয়া আমার রুমে গিয়ে আমাকে কয়েকবার ডাকাডাকি করে জাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমি শুনছিলাম ঠিকই কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তারপর হঠাৎ রাক্ষসটা আমাকে টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে গাড়িতে করে এখানে নিয়ে এল। পথে আমি প্রশ্ন করতে করতে হয়রান হয়ে গেছি তবু কোনো উত্তর দেয়নি। এতে তার উপর আমার চরম মাত্রায় রাগ উঠেছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম লোকটা এত ঝাড়ি শুনেও মাথা নিচু করে তাজ ভাইয়াকে কিছু বলছে। তাজ ভাইয়া মনোযোগ দিয়ে শুনে রাগ কিছুটা দমিয়ে নিজেও লোকটাকে কী যেন বললেন। কয়েক মিনিট পর লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে হাঁটা দিলো। তাজ ভাইয়া রাস্তার ওপার থেকেই আমার দিকে তাকালেন। আমি তখনও রাগে ফুঁসছি। একে তো মধ্যরাত, তার ওপর আবার অমাবস্যা। আর সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হচ্ছে তাজ ভাইয়ার মতো একটা আস্ত শয়তান আমাকে এই মধ্যরাতে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে এসে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। চোখে এখনও রাজ্যের ঘুম। তাজ ভাইয়া ধীর পায়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তারপর তার ডান হাতের মুঠোয় আমার বাঁ হাতটা ধরতেই আমি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলাম। তাজ ভাইয়া আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,“কী সমস্যা?”

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলাম। তাজ ভাইয়া আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি তার উপর প্রচন্ড রেগে আছি। মিনিট খানেক আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে আমাকে পাঁজাকোলা করে গাড়ির দিকে চললেন। নিমিষেই আমার সব রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে তার জায়গায় বিস্ময় এসে ভর করল। আমি চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে তার দিকে তাকিয়ে হাত পা ছুঁড়ে বললাম,“আরে এসব কী? সমস্যা কী আপনার? কোলে নিলেন কেন? আমি কি ছোটো বাচ্চা? নামান বলছি, পড়ে যাব।”

কে শোনে কার কথা! সে তার মতো সামনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। অনেক ছোটাছুটি করেও আমি তার শক্তির কাছে পরাজিত হলাম। রাক্ষসটা কী খেয়ে শরীরে এত শক্তি জোগায় কে জানে? ঠাকুমার ঝুলিতে দেখেছিলাম রাক্ষসরা আস্ত মানুষ চিবিয়ে খায়। আর এই রাক্ষস বোধ হয় আস্ত গোরু চিবিয়ে খায়। তাজ ভাইয়া আমাকে গাড়ির পাশে গিয়ে কোল থেকে নামিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ঠেলে ভেতরে বসিয়ে দিলেন। আমি হা করে তাকিয়ে আছি ওনার কান্ড দেখে। উনি এসে ড্রাইভিং সিটে বসতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,“এসবের মানে কী? মাঝরাতে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে এই রাস্তার কিনারায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন কেন? আপনার কি কমনসেন্স নেই?”

তাজ ভাইয়া গাড়ি স্টার্ট করে বললেন,“আমার বাইরে আসা প্রয়োজন ছিল। মামু তো বাড়িতে নেই। তো তোকে কি একা বাসায় রেখে আসতাম? বিপদ তো আর বলে-কয়ে আসে না।”

আমি চড়া গলায় বললাম,“দেখলাম তো এই মাঝরাতে আপনি ওই লোকটার উপর চেঁচামেচি করতে এসেছেন। এজন্য আপনার বাইরে আসা প্রয়োজন ছিল? আর আমাকে একা বাসায় রেখে এলে কি আমাকে কিছুতে খেয়ে ফেলত? আমি এত ভীতু না।”

তাজ ভাইয়া তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“নাহ্, আপনি তো একটুও ভীতু না। শুধু অন্ধকার ভয় পান আর ভূতে ভয় পান। তাতে কী? আপনি তো খুব সাহসী!”

এবার কিছুটা দমে গেলাম। ভুল তো কিছু বলেনি। আমি ভূত আর অন্ধকারের ভয়ে রাতে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাই। কথা ঘুরিয়ে রাগত কন্ঠে বললাম,“আপনি আমাকে এভাবে টেনেহিঁচড়ে আনলেন কেন সেটা শুনতে চাই। ঘুমন্ত একটা মেয়ের উপর এমন অবিচার করতে বিবেকে বাঁধল না আপনার? শয়তান একটা, দয়া-মায়া তো নেই-ই।”

তাজ ভাইয়া এবার চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“এখনই এই বকবক বন্ধ না করলে ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দিবো।”

আমার মুখটা চুপসে গেল। এই লোককে দিয়ে বিশ্বাস নেই। যা বিপদজনক লোক, সত্যি সত্যিই যদি ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়? আমার ঘুমের সাথে এই লোকের কী শত্রুতা আল্লাহ্ জানে। প্রথম যেদিন সুইডেন থেকে ফিরল সেদিনও আমার ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়েছিল। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও লোকটার মাথায় ভারী পাথর মারতে ইচ্ছে করে আমার। সেদিনের কথা স্মৃতিচারণা করা যাক।
_____________________________________________
রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। রুমের লাইট বন্ধ না করেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছি একটা জব্বর ঘুম দেয়ার আশায়। সবেমাত্র চোখটা লেগে এসেছে তখনই কানে এল কলিংবেলের শব্দ। দুবার শুনেও অলসতা ডিঙিয়ে উঠতে পারলাম না। কিন্তু কলিংবেল বাজছে তো বাজছেই। বিরক্ত হয়ে চোখ টেনে খুললাম। পরক্ষণেই মনে পড়ল বাবা এখনো বাড়ি ফেরেনি। তার মানে এতক্ষণ ধরে বাবা কলিংবেল বাজাচ্ছিল। ধুর, আমিও না! হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে নেমে দিলাম এক দৌড়। এক দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে থামলাম। তখনও কলিংবেল বাজছে। ঘুম ঘুম চোখে অলসভাবে কোনোরকমে দরজাটা খুলে দিলাম। বাবা কিছু বলার আগেই আবার উল্টোদিক ফিরে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। বাবা পেছন থেকে বলল,“আম্মা, শোনো।”

“যা শোনার সব সকালে শুনব বাবা। এখন আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।” কোনোমতে কথাটা বলেই রুমে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বিছানায় উঠে গেলাম। আমি কখনো রাতে দরজা আটকে ঘুমাই না। তার অবশ্য যথেষ্ট কারণও আছে। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি বাবা আমার পাশে বসে আমার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে। মায়ের কথা মনে পড়লেই বাবা এই কাজটা করে। আমিও তাই দরজা আটকাই না। বাবা হয়তো মুখে কিছু বলবে না, কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়লে তখন আমার মুখটাও দেখতে না পারলে তার কষ্টটা আরো বাড়বে। ঘুমানোর সাথে সাথে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। গত কয়েকদিনের ডিপ্রেশনে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি। তাই আজ ভাবলাম দারুণ একটা ঘুম হবে। অথচ এবারও আমার সাধের ঘুমটা বেশিক্ষণ টিকলো না। মুখে ঠান্ডা পানির ছোঁয়া পেতেই আবার লাফিয়ে উঠলাম। ভাবলাম বাইরে যা বৃষ্টি হচ্ছে, মনে হয় আমার রুমের ছাদ ফুটো হয়ে গেছে। কী সর্বনাশ! ঘুম ঘুম চোখে মাথা উঠিয়ে ছাদের দিকে তাকালাম। নাহ্,ছাদ তো ঠিকই আছে। তাহলে বৃষ্টির পানি এল কোত্থেকে? ভূত-টুত এল না-কি আমার রুমে? কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ পাশে তাকাতেই আমার চোখ থেকে ঘুম গায়েব হয়ে গেল। চোখ দুটো ছানাবড়া করে তাকিয়ে দেখলাম আমার বিছানার পাশে এক সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। ফর্সা গায়ের রং, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সরু চোখ, চুলগুলো সুন্দরভাবে গোছানো, পরনে হোয়াইট শার্ট। এ তো পুরো স্বপ্নের রাজকুমার স্বয়ং আমার সামনে দণ্ডায়মান! আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নের মধ্যে আছি। হা করে তাকিয়ে আছি তো আছি। আমার ধ্যান ভাঙল সুদর্শন পুরুষটির তুড়ির শব্দে। ধ্যান ভাঙতেই আমি চমকে উঠলাম। আমি তো স্বপ্ন দেখছিলাম না। এ তো সত্যি সত্যিই ঐ রাজকুমার আমার সামনে। বাপরে! কেমনে কী? আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠলাম,“কে আপনি?”

লোকটা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,“ভূত।”

আমি চোখ ইয়া বড়ো বড়ো করে তাকালাম। তাই তো। এটা তো ভেবে দেখিনি। এতরাতে আমার রুমে রাজকুমার আসবে কোত্থেকে? এ নিশ্চয়ই কোনো অশরীরী আত্মা। মনে হয় আমাকে মারতে এসেছে। ও আল্লাহ্! এখন আমার কী হবে? চোখ মুখ খিঁচে বাবা বলে দিলাম এক চিৎকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চিৎকারটা রুমের বাহির অব্দি পৌঁছানোর আগেই ভূতটা আমার মুখ চেপে ধরল। আমার অবস্থা এখন বেগতিক। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আর শরীরেও কাঁপুনি ধরে গেছে। শুকনো একটা ঢোক গিলে ভয়ার্ত করুণ দৃষ্টিতে ভূতটার দিকে তাকালাম। দেখলাম সে আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভূত মহাশয় আমার জান না নিয়ে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভূতটা একহাত দিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে আরেক হাতে মুখ চেপে ধরেছে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার মুখ থেকে ভূতটার হাত সরানোর চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভূতটা আরেকটু জোরে আমার মুখ চেপে ধরে রাগত কন্ঠে বলল,“সাট আপ স্টুপিড। আর একবার চিৎকার করার চেষ্টা করলে লাগাব এক চড়। ভূত আসবে কোত্থেকে গাধি মেয়ে? ভূত বলে কিছু আছে না-কি?”

এবার মনে হলো এটা ভূত না। মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াল। ছাড় পেয়ে আমি জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম লোকটা দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে এক দফা ক্রাশ খেলাম। চেহারা বটে! কিন্তু লোকটার এমন অদ্ভুত আচরণে আমার রাগ উঠে গেল। রাগত স্বরে বললাম,“আশ্চর্য! কে আপনি? বাসার মধ্যে ঢুকলেন কীভাবে? বাবা জানে? আমার রুমে কী করছেন? আর এভাবে আমার মুখ চেপে ধরলেন কেন?”

লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল,“একসঙ্গে একগাদা প্রশ্ন করলে কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো?”

বুঝলাম রাগের বশে বোকামি করে ফেলেছি। তাই কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম,“আগে আপনার পরিচয় বলুন।”

লোকটা আফসোসের সুরে বলল,“এই দিনই দেখার বাকি ছিল। মনে হচ্ছে এখন থেকে আত্মীয়-স্বজনের সামনে এনআইডি কার্ড নিয়ে যেতে হবে।”

লোকটার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আত্মীয়-স্বজন মানে? লোকটা আমাদের আত্মীয় হয়? কই? জীবনেও তো দেখলাম না। লোকটা আবার বলল,“কী? চিনতে পারছিস না? মাথামোটা, ভালো করে খেয়াল কর।”

আমি কিছুটা অবাক হলাম। অপরিচিত মানুষ আমাকে মাথামোটা বলবে কোন সাহসে? ছোটো বেলায় একজন আমাকে মাথামোটা বলতো। কথাটা মাথায় আসতেই আমার চোখ চড়কগাছ। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল আজ আমার ফুপাতো ভাই আহনাফ তাজওয়ার এর সুইডেন থেকে ফেরার কথা। বাবা তাকে রিসিভ করতেই এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। কিন্তু আমি কনফিশনে পড়ে গেলাম। কারণ আট বছর আগের তাজ ভাইয়ার সাথে এই তাজ ভাইয়ার কোনো মিলই খুঁজে পাচ্ছি না। এ তো সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ! এ কী করে তাজ ভাইয়া হবে? আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,“আপনি তাজ ভাইয়া?”

তাজ ভাইয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,“যাক অবশেষে চিনতে পেরেছিস তাহলে। তো এতক্ষণ ঢং করছিলি কেন?”

আমি ভদ্রভাবে বললাম,“সরি ভাইয়া। আসলে আমি আপনাকে সত্যিই চিনতে পারিনি। আপনার যে আজ ফেরার কথা তা জানতাম। কিন্তু একদম ভুলে বসেছিলাম। তাছাড়া চোখে প্রচুর ঘুম ছিল তাই ভুলভাল বকে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”

তাজ ভাইয়া অবাক হওয়ার ভান করে বললেন,“ওহ্ মাই গড! আমি কি ঠিক শুনলাম? তুই আমাকে সরি বললি! ছোটো বেলায় তো নিজে কোনো দোষ করলেও বলতি ‘আমি কেন সরি বলব? আমি কী ইচ্ছে করে করেছি?’ আর সেই তুই কি না আজ স্ব-ইচ্ছায় আমাকে সরি বলছিস!”

আমি মুখটা ছোটো করে বললাম,“তখন তো আমি ছোটো ছিলাম ভাইয়া। এখন তো বড়ো হয়েছি।”

তাজ ভাইয়া তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“বড়ো হয়েছিস কোন দিক দিয়ে? আমার তো তোকে দেখে সেই পিচ্চি ইলো-ই মনে হচ্ছে। শুধু একটা চেঞ্জ এসেছে। তা হচ্ছে তোর মোটা মাথায় এক ছিটে বুদ্ধি এসেছে।”

কথাটা শুনে আমার রাগ উঠল। আট বছর পর এসেই আমার সাথে এভাবে কথা বলছে। এখন থেকে তো এই বাসাতেই থাকবে। তাহলে তো এখন থেকে প্রতিদিন এভাবেই কথা বলবে আমার সাথে। আমি এসব কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। বাবাকে বলে যেভাবে হোক ব্যাটাকে বিদায় করতে হবে। আমার রাগত চেহারা দেখে তাজ ভাইয়া বললেন,“রাগও দেখছি আগের মতোই আছে। এজন্যই তো বলি তোর মাঝে কোনো চেঞ্জ নেই। বাই দ্যা ওয়ে, আমি এটা ভেবে আবাক হচ্ছি যে মাত্র আট বছরে একটা মানুষকে সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছিস কীভাবে?”

আমি প্রচন্ড বিরক্ত হলেও স্বাভাবিকভাবেই বললাম,“তখন তো আমি ক্লাস ফোরের স্টুডেন্ট ছিলাম। আপনি যখন সুইডেন চলে গিয়েছিলেন তখনকার চেহারার সাথে এখনকার চেহারার কোনো মিল নেই। সম্পূর্ণ চেঞ্জ হয়ে গেছেন। আপনার আগের চেহারার সাথে মিল নেই বলেই আমি চিনতে পারিনি। তাছাড়া এই আট বছরে তো আমি কখনও আপনার সাথে অডিও বা ভিডিও কলে কথাও বলিনি।”

তাজ ভাইয়া প্রশ্ন করলেন,“ও হ্যাঁ, আচ্ছা তুই আমার সাথে কখনও কথা বলতে চাইতি না কেন?”

আমি ইতস্তত করে উত্তর দিলাম,“আমার লজ্জা লাগতো। এমনিতেও আমি ফোনে কথা কম বলি।”

তাজ ভাইয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,“বুঝলাম। তো, আমার কোনো ছবিও দেখিসনি কখনও মামুর ফোনে?”

আমি উত্তর দিলাম,“না, ইচ্ছে জাগেনি কখনও।”

“তার মানে আট বছর পর তুই আমাকে আজই প্রথম দেখলি!”

তাজ ভাইয়ার কথায় আমি মাথা দোলালাম। তাজ ভাইয়া আবার বললেন,“আমি তোর ছবি দেখেছিলাম। মামু পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেটা আরো দুই বছর আগে। তারপর আর দেখিনি।”

আমি অপেক্ষায় আছি কখন আবার বিছানায় সটান শুয়ে পড়ব। কিন্তু এই তাজ ভাইয়া তো যাচ্ছেই না। আমি ইচ্ছে করেই বড়ো একটা হাই তুললাম। তাজ ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,“মাত্র নয়টা একান্ন বাজে। এত তাড়াতাড়ি এমন ঘুম আসে কোত্থেকে তোর?”

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে অলসভাবে তার দিকে তাকালাম। উনি আবার প্রশ্ন করলেন,“খেয়েছিস?”

আমি উপর নিচে মাথা ঝাঁকালাম। তাজ ভাইয়া প্রশ্ন করলেন,“কখন? তুই সন্ধ্যা বেলায়ই ডিনার করিস না-কি?”

আমি ছোটো একটা শব্দ করলাম,“হুঁ।”

তাজ ভাইয়া আর কোনো কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন,“আচ্ছা তাহলে ঘুমা। গুড নাইট।”

আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এবার অন্তত শান্তিতে ঘুমাতে পারব। তখনই কাঁথার নিচ থেকে জেমি ডেকে উঠল,“মিয়াও।”

শব্দটা শুনেই তাজ ভাইয়া দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে পড়লেন। পেছন ফিরে বিছানার দিকে তাকালেন। তারপর এগিয়ে এসে কাঁথাটা সরিয়ে জেমিকে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,“তোর বিড়াল?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে তাজ ভাইয়া জেমির একটা কান ধরে জোরে টেনে দিলেন। জেমি মিয়াও মিয়াও করে জোরে ডেকে উঠে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওনার এমন কান্ডে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। ওনার দিকে তাকিয়ে মুখ খোলার আগেই উনি হনহন করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি জেমির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও অসহায় মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রাগ উঠে গেল। ধুপধাপ পা ফেলে দ্রুত গিয়ে ঠাস করে দরজাটা আটকে দিলাম। তারপর আবার সেভাবেই বিছানায় উঠে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনে হলো আজ ফুপি বেঁচে থাকলে তার কাছে যাওয়া-আসা চলতে থাকত। তাহলে হয়তো আজ আমি তাজ ভাইয়াকে চিনতেও পারতাম। গত আট বছর আগে এক শীতের রাতে আম্মু আর ফুপি শপিং করে মার্কেট থেকে ফিরছিল। কিন্তু সেই রাতে কে বা কারা তাদের দুজনকে একসাথে গলা কেটে হত্যা করেছিল। শত চেষ্টা করেও পুলিশ সেই হত্যাকারীদের কোনো খোঁজ পায়নি। মাত্র দশ বছর বয়সে আম্মুকে হারিয়ে আমি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম। বাবাও খুব ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু সে আমার কথা ভেবেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল। আত্মীয়-স্বজনরা বাবাকে অনেক বুঝিয়েছে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। তার ধারণা দ্বিতীয় বিয়ে করলে আমার প্রতি অন্যায় করা হবে। কারণ সৎ মা আমাকে আমার আপন মায়ের মতো ভালো নাও বাসতে পারে। তাই এতটা বছর বাবা আমাকে বুকে আগলে রেখেছে। একহাতে নিজের বিজনেস সামলেছে আরেক হাতে আমাকে। আমার মায়ের অভাব ভোলানোর যতরকম চেষ্টা আছে সব তিনি করেছে। ফুপারও একই দশা হয়েছিল। তাজ ভাইয়ার বয়স ছিল তখন আঠারো বছর আর রাজ ভাইয়ার ছিল বিশ বছর। ফুপুর মৃত্যুর পর ফুপা তাজ আর রাজ ভাইয়াকে নিয়ে সুইডেন পাড়ি জমিয়েছিলেন। শুনেছি তার সাড়ে চার বছর পরেই ফুপা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তারপর থেকে রাজ ভাইয়া আর তাজ ভাইয়া মিলে ফুপার বিজনেসের দায়িত্ব নেন। গত দেড় বছর আগে রাজ ভাইয়া সুইডেনের বাঙালি বংশোদ্ভূত এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন। আমার ধারণা ছিল এরা দুই ভাই আর কোনোদিনই দেশে ফিরবে না। কিন্তু হঠাৎ করে তাজ ভাইয়ার আগমনের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছে না। গত পাঁচদিন আগে হঠাৎ উনি বাবাকে জানালেন উনি দেশে ফিরবে। তারপর সত্যি সত্যিই চলে এলেন। আর এসেই আমার সাথে সেই ছোটো বেলার মতো আচরণ করা শুরু করেছেন। আট বছরে একটুও শুধরালো না লোকটা!

তারপর পনেরো দিন কেটে গেল। এই পনেরো দিনে তাজ ভাইয়া সেই ছোটো বেলার মতোই আমাকে জ্বালিয়ে খেয়েছেন। এত বড়ো হয়েও তার সেই আগের আচরণ দেখে আমি যতটা অবাক হয়েছি তার থেকে বেশি বিরক্ত হয়েছি। প্রথম প্রথম ভদ্রভাবে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারপর আর জোর করেও ভদ্রতা বজায় রাখতে পারলাম না। রাগ আর বিরক্তি চলে এসেছে তার প্রতি। কিন্তু বাবার ভয়ে মুখ খুলতেও পারি না। তাজ ভাইয়া সেটা বুঝতে পেরে শুধু মজা নেন। পনেরো দিন পর হঠাৎ করেই তাজ ভাইয়া বাবার থেকে দোআ নিয়ে কোথাও একটা চলে গেলেন। বাবাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি সে খুব জরুরি একটা কাজে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন, কেন গিয়েছেন, আর কখনও ফিরবেন কি না সেসব জানার ইচ্ছে জাগেনি আমার। আমি তো প্রচন্ড খুশি হয়েছি এটা ভেবে যে তার জ্বালাতন থেকে মুক্তি পেয়েছি। মুক্তি পেয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেটা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র সাত মাসের মাথায় আজই তাজ ভাইয়া আবার আমাদের বাসায় ফিরে এলেন। তখনই বুঝলাম আমার কপালে সুখ বেচারা বেশিদিন টেকার ক্ষমতা রাখে না।

চলবে…………………..