তুমি আমার পর্ব-১২+১৩

0
583

#তুমি_আমার
#পর্ব_১২+১৩
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

মানুষের জীবন বড়ই বিচিএ।কার জীবনে কখন কি ঘটে কেউ জানে না।রাত অব্দি যার জীবনে ছিলো আলোর ঘনঘটা সকাল হতে না হতেই তার জীবনে নেমে এসেছে কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার।সময়গুলো এমন বিশ্বাসঘাতক কেন জানা নেই কারো।সকালে চিল্লাচিল্লিতে ঘুম ভাঙ্গে যায় সিরাতের।ঘুম ভেঙ্গে চোখের সামনে এমন কিছু দেখবে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি সে।পুরো বাড়ি সুব্ধ লোক জড়ো হয়েছে ওর রুমে।কারণ টা নিজেরই অজানা।সকলকে দেখে ভ্রু জোড়া কুচকে এলো তাঁর।মুখে কারোরই হাসি নেই।থমথমে অবস্থা বিরাজমান।ও থপ করে উঠে বসবে তাঁর আগেই টান খেয়ে আবারও বিছানায় পড়ে গেলো সে।কিন্তু বিছানা তো নরম তুলতুলে হওয়ায় কথা এত শক্ত হলো কি করে।মাথা তুলে তাকাতেই চোখ চড়কগাছ তাঁর।তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে শুয়ে আছে আবেশ।বিষয়টা মস্তিষ্কে হানা দিতেই সকলের উপস্থিতির কারণ স্পষ্ট তার কাছে।তড়িঘড়ি করে উঠতে যেয়ে আবেশের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।আবেশ ওকে ছেড়ে এক লাফ দিয়ে উঠে বসলো।সিরাত ধপ করে বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো।আরু ওর পাশে হাত ধরে রইলো।আরু জানে এখন সিরাতের উপর দিয়ে ঠিক কি যাবে হয়তো সিরাত সেসব কিছুর আইডিয়াও করতে পারছে না।সকালে সিরাতকে ঘুম থেকে ডাকার জন্য রুমে আসে সখিনা।সে আবেশ আর সিরাতকে একসাথে দেখে দৌড়ে গিয়ে সবাইকে জানায়।তারপর সকলে এসে উপস্থিত হয় এখানে।।বিছানা হাতরে আবেশের পায়ের নিচ থেকে ওর ওড়না নিয়ে এলো আরু।আবেশ এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারে নি।সিরাত কর্কশ কন্ঠে আবেশকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-‘আপনি এখানে কি করছেন’?

আবেশ উওর দেওয়ার আগেই ওর ফুপি বললেন,

-‘সারারাত আমার ভাইপোর সাথে রঙ তামাশা করে এখন ন্যাকা সাজা হচ্ছে’?এই একটা কথাই সিরাতের মুখের কথা কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো।সিরাত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাবেয়ার দিকে।ছলছল করে উঠলো আঁখিদ্বয়।বিরক্তি নিয়ে আবেশ বললো,

-‘কি যা তা বলছো ফুপি?মুখ সামলে কথা বলো’।

-‘কেন মুখ সামলাবো আমি।সারারাত একটা মেয়ের সাথে কাটিয়ে এখন আবার গলা বড় করে কথা বলছিস।লজ্জা করে না’।

-‘ফুপিইইই!

-‘চিৎকার করে পুরো বাসা মাথায় তুললে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যায় না আবেশ।আমরা সবাই দেখেছি দুজনে কীভাবে ঘুমিয়ে ছিহ মুখে আনতেও কষ্ট হচ্ছে আমার’।

এবার ধপধপ করে শিরা উপশিরায় সমস্ত রাগ ছড়িয়ে পরলো আবেশের।তবে সে রাগ অন্য কারোর উপর নয় সবটা গিয়ে পরছে সিরাতের উপর।কারণ এই মেয়েটা এই রুমে এসে ঘুমোলো কেন?না আসলে তো কিছুই হতো না।দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

-‘তুমি এই রুমে এসেছিলে কেন?কখন এসেছিলো আন্সার মি’?

ওর চিৎকারে কেঁপে উঠলো সবাই।সিরাত চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত।আবেশের মা বললেন,

-‘মেয়েটার উপর চিৎকার করবি না।ওর কোনো দোষ নেই।থাকার জায়গা নেই বলে ওকে আমি এই রুমে পাঠিয়ে ছিলাম।তুই বাসায় বাইরে গিয়েছিলিস তাহলে তুই এখানে কেন?তুই না বলেছিলিস তুই বাসায় ফিরবি না আর তার চেয়ে বড় কথা তোর রুম থাকতে তুই এই রুমে কেন’?মায়ের কথা শোনে অবাক হয়ে যায় আবেশ।অবাক কন্ঠে বলে,

-‘মা ফুপির মতো তুমিও কি আমাকে অবিশ্বাস করছো’?

-‘এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয়।একটা মেয়ের মান সম্মানের কথা’।

ইতিমধ্যে সকলের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে।সবাই ফিসফাস করে কথা বলছে।সেগুলো যে সিরাত আর আবেশকে জড়িয়ে নোংরা নোংরা কথা সেটা বুঝতে বাকী নেই কারো।আবেশ লম্বা একটা দম নিয়ে বললো,

-‘দেখুন আপনারা যা ভাবছেন তেমন কিছুই নয়।আমি জানতাম না সিরাত এখানে ছিল তীব্র মাথা ব্যাথার কারণে আমি ভোর রাতে এসে স্নান করে চুপচাপ শুয়ে পরেছি।সারা রাত জেগে থাকার দরুন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি পাশে কে আছে না আছে টের পাই নি বা খেয়াল করিনি।এই সহজ বিষয়টাকে কমপ্লিকেটেড না করে সহজ ভাবে মেনে নিন’।আবেশের ফুপি চট করে বললেন,

-‘তাই নাকি তাহলে তোর টি শার্টে সিরাতের লিপস্টিক আর গলায় নখের আচড় কেন? সিরাতের মুখের লিপস্টিক লেপ্টানো চুল এলোমেলো কেন বলতে পারিস’? উনার কথায় চমকে উঠলো আবেশ।সাথে সাথে সবাই ওর দিকে নজর দিলো সত্যি উনি মিথ্যা বলেন নি।এবার নিজেই বোকা বনে গেলো আবেশ।সিরাত সেদিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।তাহলে কি সত্যি আর ভাবার সাহস হলো না তাঁর।আরুর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।আরু,রিয়া,আয়েশা এসব বিশ্বাস করেনি বলে আশ্বস্ত করলো তাঁকে।আবেশের মাকে উদ্দেশ্য করে আবার রাবেয়া বেগম বললেন,

-‘ভাবী আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে সুবিধার নয় বিশ্বাস করলে না।সেদিনও দেখলাম দিনে দুপুরে ছেলেটার সাথে ঢলাঢলি করছে কিন্তু তুমি তো বিশ্বাস করার মানুষই নও।এবার হয়েছে মুখে চুন খালি পরেছে।ছেলে মানুষের আর দোষ কি।মেয়েরা সুযোগ দিলে ছেলেরা তো রঙ ঢঙ করবেই’।সিরাত আর চুপ থাকতে পারলো না
কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললো,

-‘স্টপ ফুপি!আর একটাও বাজে কথা বলবেন না।সেদিনে উনাকে জড়িয়ে নানা কথা বলেছেন গুরুজন বলে ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু বারবার ছেড়ে দেবো ভাববেন না।আমরা যখন বলছি আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি তাহলে আপনি কেন জলঘোলা করছেন’?

-‘চুপ কর!বেশরম মেয়ে আর একটাও কথা বলবি না।তুই বললে মজাটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে।নষ্টা মেয়ে।ওকে রূপের জালে ফাসিয়ে কলেজ পাস করতে হবে তো।তোদের ভালোভাবে চেনা আছে আমার’।সিরাত আর কথা বলার সাহস পেলো না।আবেশের প্রতি ভালোবাসার জায়গায় হয়তো ঘৃণা জমা হচ্ছে এখন।তার জন্য অকারণে অপমাণিত হতে হচ্ছে তাকে।আরু এবার বললো,

-‘ফুপি আমি সিরাতকে চিনি আর তোমার থেকে একটু বেশিই চিনি।সো প্লিজ বেশি বাড়াবাড়ি করে নিজের সম্মান খোয়াতে এসো না’।

-‘কি বললি আরু।একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুই তোর ফুপির সাথে এভাবে কথা বললি।তাও ওই নষ্টা কলঙ্কিনী টার জন্য’।বারবার একই শব্দ সহ্য করতে পারছে না সিরাত।হাত পা কাঁপছে।মুখ দিয়ে কোনো শব্দও বের হচ্ছে না।আবেশ একবার সিরাতের মুখের দিকে তাকিয়ে ফুপির উদ্দেশ্যে বললো,

-‘ফুপি সিরাত সম্পর্কে অনেক কিছু বললে তা তোমার ভাইপো সম্পর্কে কিছু বলো।সে তো দুধে ধোয়া তুলশী পাতা নয়।এখানে আমি এসেছি সিরাত নয়।তাই দোষী আমি ও নয়’।

-‘তুই সবসময় ওর দোষ নিজের উপর দিয়ে ওকে বাঁচাতে চাস।কিন্তু এবার আর পারবি না’।

পুরো বাসায় নীরবতা বিরাজমান।ড্রয়িংরুমে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আবেশ।পাশের সোফায় আবেশের বাবা মা সিরাতের বাবা মা বসে আছেন।সিরাতকে এখানে আনা হয়নি কারণ সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই।সিয়াম সব শুনে বাইরে চলে গেছে।কারো সাথে কোনোকথা বলে নি।আবেশের ফুপির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।আবেশের বাবা হঠাৎ ঠাস করে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন আবেশের গালে।আবেশ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এমন কিছু হবে সে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো।আবিদ ভাইকে আগলে দাঁড়িয়ে রইলো।আরু এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে।সিরাতের বাবা উনাকে নিয়ে বসালেন সোফায়।আবেশ নিজেকে সামলে শক্ত হয়ে বললো,

-‘বাবা, আঙ্কেল, আন্টি তোমরা সবাই মনে করো তো আমি দোষী।ঠিক আছে আমি মেনে নিলাম।এবার তোমরা যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেবো’।ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে সিয়াম বললো,

-‘সিরাতকে বিয়ে করতে হবে তোকে।এটাই তোর সব থেকে বড় শাস্তি।আমার কলিজার উপর কলঙ্কের এতটুকু আচঁও লাগতে দেবো না আমি’।

সকলে চমকালো থমকালো।আবেশ সিয়ামকে দেখে ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-‘তুইও’!

-‘নাহ্!আমি জানি তুই বা সিরাত কেউই দোষী নস।কিন্তু কোনো এক কুটনি ডাইনী বুড়ির জন্য প্রত্যক্ষভাবে তুই দোষী।আর সেই দোষের দায়ে আমার বোনটাকে দোষী বলা হচ্ছে।আজ বাড়িতে বলছে কাল বাইরে বলবে।সিরাত রাস্তায় বেরুতে পারবে না লোকে ছি ছি করবে তখন হয়তো মৃত্যু ছাড়া ওর কোনো পথ খোলা থাকবে না।আমি আমার বোনটাকে হারাতে চাইনা রে ভাই।তাই বিয়েটা হয়ে গেলে এসব কথার কোনো ভিওি থাকবে না।একজন ওয়াইফের উপর তার স্বামীর অধিকার সবচেয়ে বেশি।আমি আমার সিরাতের সম্মান রক্ষার্থে বলছি প্লিজ।আমার সিরাতকে তুই মরতে দিস না।আমাদের বুক খালি করিস না’!

আবেশ হাসে প্রাপ্তির হাসি।উৎফুল্লে আনন্দে আবারও জড়িয়ে ধরে সিয়ামকে।কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

-‘আমি খুব লাকি তোর মতো একটা বন্ধু পেয়েছি।যেখানে আপনজনেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সেখানে তুই আমাকে বিশ্বাস করেছিস।তুই যা বলবি আমি তাই করবো।আজ প্রমাণ করে দিলি তুই আমার বন্ধু নস আমার ছায়া’।

সিয়ামের বাবা মা বিয়েতে আপওি করলেও সিয়াম তাদের বুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে।আবেশের বাবা মা রাজি।কিন্তু বাধ সাধে সিরাত।সে এই বিয়ে কিছুতেই করবে না।যদিও লোকটাকে ভালোবাসে নিজের করতে চেয়েছিল কিন্তু এভাবে চায় নি।ভালোবাসায় পরিপূর্ণ বিয়ে চেয়েছিলো সে কোনো কলঙ্ককে ধাপাচাপা দেওয়ার জন্য বিয়ে নামক পবিএ বন্ধন চায় নি।এই বিয়েতে মত দেওয়া মানে অন্যায় টাকে প্রশয় দেওয়া।সকলের মনের সন্দেহ প্রখর হওয়া।তারা যেটা দেখেছে সেটাই সত্যি।কিন্তু সেটা তো সত্যি নয় তাহলে কেন মেনে নেবে সে।মানবে না কিছুতেই মানবে না।

আবেশের ফুপি পায়চারি করছেন পুরো রুম জুড়ে।বিয়ে কিছুতেই মানতে পারছেন না তিনি।তিনি তো এটা চান নি।কোথা থেকে কি হয়ে গেলো।যে করেই হোক বিয়েটা আটকাতে হবে তাঁকে।

#চলবে

#তুমি_আমার
#পর্ব_১৩
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত

সময় প্রবাহমান।কারোর জন্য সময় আটকে থাকে না।বিকালের মধ্যেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো সিরাতের।কারণ সন্ধ্যায় রিসেপশন আছে আবিদের।আবিদ অনেকবার না করেছে কিন্তু আবেশ সেটা মানেনি।তার জন্য খামোখা কেন আনিদের সুন্দর মূহুর্ত গুলো বরবাদ হবে, হবে না,হতে দিবে না সে।অনেক জল্পনা কল্পনা করেও কেউই বিয়ে ভাঙ্গতে সক্ষম হয় নি।অনেক কষ্টে সিরাতকে বিয়েতে রাজি করাতে পেরেছে সিয়াম ।সাদা মাটা ড্রেস পরেই বিয়ে হয়েছে তার।নেই কোনো সাজগোজ,রঙ বেরঙের আলোকসজ্জা, বাসাভর্তি মেহমান।না কোনোকিছুই হয়নি তার বিয়েতে।আরু সাজাতে চেয়েছিলো কিন্তু কড়া ভাষায় না করে দিয়েছে সে।তাই জোর করার সাহস হয়ে উঠে নি কারো।।এদিক থেকে আবেশ একটু এগিয়ে একটা পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে বিয়ে সেরেছে সে।বিয়ের পর ওই বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছে সিরাত কিন্তু আবেশ সেটা মানে নি।তার স্ত্রীকে বাপের বাড়ি ফেলে রাখতে রাজি নয় সে।বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন বিয়ে তো বিয়েই।তার সাথে সিয়ামও একদম।একথা শুনে বিয়ের পর থেকে আরুর ঘরের দরজায় খিল দিয়ে বসে আছে সিরাত।কারো ডাকে সাড়া দিচ্ছে না।নিজের মত কিছুটা সময় আছে।প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষা করার পরও দরজা খুললো না।এবার চিন্তা বাড়ছে সবার।খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলে নি তো।সিরাতের মা কান্না জুড়ে দিয়েছেন অনেক আগে।একে তো একমাএ মেয়ের বিয়েতে তেমন কিছু করতে পারেন নি।আর এখন মেয়ের হদিসই নেই।তবে আবেশের বাবা আশ্বস্ত করেছেন ধুমধাম করে বউ ঘরে তুলবেন তিনি।আবেশের ফুপি বললো,

-‘এই মেয়ে কত ঢং করতে জানে বাবা।না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।আমার ভোলা ভালা ভাইপোটাকে এতদিন ইচ্ছেমত নাচিয়েছে এখন যেই বিয়ে হলো অমনি সব শেষ ফুড়ুৎ।আসলে ছেলেদের সাথে ফ্লাটিং করার মজা নিতে যেয়ে এভাবে ফেঁসে যাবে ভাবতেও পারে নি’।ফুপির কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবেশের।এ পর্যন্ত তাকে জড়িয়ে অনেক খারাপ কথা শুনিছেন
9
সিরাতকে তিনি।যার পরিণতি আজকের এই বিয়ে।তবুও আয়েশ মিটে নি।চিৎকার করে বললো,

-‘স্টপ ফুপি!আর একটা কথাও সিরাত সম্পর্কে বলবে না।আর যদি বলো তাহলে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো তুমি আমার ফুপি’।বলে হনহন করে উপরে চলে গেলো সে।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল আছড়াতে ব্যস্ত রাদিফ।আজ আবারও মায়াবিনীর মুখোমুখি হবে সে।মেয়েটার মুখে অদ্ভুত এক মায়া আছে যা তাঁকে ঘায়েল করার জন্য যথেষ্ট।একবার চোখের সামনে আসলে দৃষ্টি সরানো দ্বায় হয়ে পরে তার।ফোন বের করে একটা মুচকি হাসি দিলো সে।গতকাল তার মায়াবিনীর একটি ছবি সকলের অগোচরে তুলেছে সে।যদিও বিনা অনুমতিতে আনরেডি অবস্থায় তুলেছে তবুও অসাধারণ হয়েছে এটি।ছবিটার কপালে আলতো করে ভালোবাসার স্পর্শ আকলো রাদিফ।এখন সুখের সাগরে ভাসছে সে।সেই সাগরে তার মায়াবিনীকে নিয়ে ডুব দিতে চায় অন্ততকাল।ওর ভাবনায় ছেদ ঘটলো তিথির কথা শোনে।তিথি বললো,

-‘ভাইয়া কাহিনী কি হুম?আপুর বিয়েতে এসে মায়াবিনী কে ভুলে নতুন করে কারে প্রেমে পরলি নাকি’?রাদিফ মুচকি হাসলো।আনমনে বললো,

-‘এই জীবনে মায়াবিনীকে ভুলে থাকা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।যেখানে কোনো খোঁজ খবর ছাড়া একটি বছরের ভুলতে পারিনি সেখানে চোখের সামনে বারবার দেখে তাকে ভুলবো কি করে’।তিথি চোখ বড় বড় করে বললো,

-‘চোখের সামনে মানে?খুঁজে পেয়েছো তাঁকে?কোথায় পেয়েছো’?

-‘খান বাড়ি’।খান বাড়ি শুনে চমকে উঠলো তিথি।’খান বাড়ির কে ভাইয়া’?

-‘সময় হলে ঠিক জানতে পারবি’।

🍁🍁🍁

মেঝেতে বসে দু হাতে ভর দিয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে সিরাত।কান্না করতে করতে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে প্রায়।নিজেকে এখন পৃথিবীর সব থেকে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে তার।যার কোথাও কেউ নেই।বিবাহিত নাম লাগা মাএই নিজের পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ওর থেকে।কি হয় ওকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে গেলে।বিয়ে হয়েছে হ্যাঁ হয়েছে!কিন্তু কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে হয়েছে সেটা কি জানে না তারা।আজকে কার উপর অভিমান করবে সে ভাইয়ের উপর নাকি বাবা মায়ের উপর আর নাকি নিজের উপর।দরজায় করাঘাত হতেই রাগে সারা শরীর কেঁপে উঠলো ওর।এতক্ষণ সকলের ডাক উপেক্ষা করে দরজা এটে বসে থাকলেও এখন দরজার ওপাশের ব্যাক্তিটির মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে তার।দরজাট শব্দ বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে।দরজা খুলেছে দেখে সকলে স্বস্তি পায়।আবেশ রুমে ঢুকে সযত্নে আবার দরজা বন্ধ করে দেয়।সিরাত হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ধুম করে আশেবের কলার চেপে ধরে বলে,

-‘আমার সাথে কেন এমন করলেন আপনি?কি দোষ করেছিলাম যার জন্য পুরো বাসার সকলের সামনে আমাকে অপমান করলেন।বলুন কেন করলেন’?চিৎকার করে শেষের কথাগুলো বলে সিরাত।আবেশ সিরাতের হাত ছাড়িয়ে নরম সুরে বলে,

-‘প্লিজ সিরাত মাথা গরম করো না।একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখ এখানে আমার বা তোমার কারো কোনো দোষ নেই।সবটাই আমাদের নিয়তি’।

-‘এটা আমার নিয়তি ছিলো না।আপনি গতকালকের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এমনটা ইচ্ছে করে করেছেন তাই না।আপনি একজন শিক্ষক নন বরং শিক্ষক নামের কলঙ্ক আপনি’।আবেশ কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে হজম করার চেষ্টা করছে।কিন্তু শেষের কথাটা সহ্য করতে পারলো না সে।তীরের মত বিঁধলো তার বুকে।এভাবে তার পেশাকে অপমান করতে পারে না সিরাত।ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,

-‘এই মেয়ে একদম চুপ অনেক বলে ফেলেছো সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু এটা সহ্য করবো না।ইচ্ছে করে যদি করতাম তাহলে সেদিন জঙ্গলে করতে পারতাম তখন সেটা কেউ জানতো না।শুধু তুমি আর আমি ছাড়া।একবার সেদিনটা ভেবে দেখ।এখানে কেউ ষড়যন্ত্র করে আমাকে তোমাকে ফাঁসিয়েছে।নইলে এতদিন ধরে আমাকে চেনো বল কখনও তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছি কি।আর আজকের বিষয়টা বলো তুমি কিছু ফিল করেছো।এলোমেলো চুল লিপস্টিক লেপ্টানো এসবে কিচ্ছু প্রুফ হয় না ‘।সিরাত অনেকটা ভেবে নেয় আবেশের কথাগুলো।সত্যি ওর কথায় যুক্তি আছে।কিন্তু ওকে অপমান করে কার কি লাভ।কান্না মিশ্রিত কন্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,

-‘যেভাবেই হোক সবাই তো এটা ভেবে নিয়েছে।প্রত্যক্ষভাবে আমাকে আপনাকে দোষী ভাবছে।বাইরের লোকজন যদি জানে তখন আমি করবো ভাবতে পারছেন আপনি’।

-‘আরে তোমার কি তোমাকে তোমার পরিবার অবিশ্বাস করেছে করেনি বরং সাপোর্ট করছে।আর আমার পরিবার দেখেছো আমাকে তারা বিশ্বাসই করে নি।আমার বাবা আজ আমার গায়ে সকলের সামনে হাত তুলেছেন কেন জানো বাবা বুঝে গেছেন এই অপকর্ম আমি করেছি।মা সরাসরি কিছু না বললেও তার অব্যক্ত কথা আমি বুঝে গেছি।কাল যদি এটা জানাজানি হয় তোমার সাথে আমি….তখন সমাজে মুখ দেখাবো কি করে বুঝতে পারছো।সবাই যখন বলবে একজন শিক্ষক তার ছাএীকে বাসায় নিয়ে,

-‘এনাফ!আর শুনতে চাই না আমি।প্লিজ রেহাই দিন আমায়।আমি সব মেনে নিয়েছি এখন প্লিজ আমাকে আমার বাড়ি যেতে দিন।এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো আমি’।কাঁদতে কাঁদতে বললো সিরাত।

-‘সরি সিরাত!এটা আমি করতে পারবো না।তবে এক সপ্তাহ ঘুরে আসতে পারো এর বেশি নয়।তোমার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত তুমি এখানে এই বাড়িতে আমার সাথে থাকবে।তারপর যদি তোমার মনে হয় এই বিয়েতে তুমি হ্যাপি নও বা আমাকে নিয়ে তোমার প্রবলেম তাহলে তুমি যা চাইবে তাই হবে।আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেব আর যদি তুমি সবকিছু ভুলে নিজের বাড়ি মনে করতে পারো তাহলে সবাইকে জানিয়ে তোমাকে ঘরে তুলবো’।
ডিভোর্স শব্দটা শুনে কেঁপে উঠলো সিরাত।সে তো ডিভোর্স মাথায় আনেনি।এই লোকটাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল রঙিন স্বপ্ন বুনে রঙিন আকাশে ভাসিয়ে ছিলো।তাহলে কি এক নিমিষে সেগুলো ভেঙ্গে যাবে।উনি কি ভালোবাসেন কাউকে।কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,

-‘আপনি কাউকে ভালোবাসেন?আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তাঁকে বিয়ে করবেন’?

সিরাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকালো আবেশ।তারপর বললো,

-‘বিয়ে মানুষের একবারই হয় সেটা আমি মনে করি।হোক সেটা পছন্দের মানুষের সাথে বা অপছন্দের।মানিয়ে আর মেনে নিলে অপছন্দ টাও একদিন পারফেক্ট পছন্দের তালিকায় সর্বপ্রথম স্থান পায়।

আজ দুদিন হলো সিরাত বাসায় এসেছে।আবেশের কথানুযায়ী আর মাএ পাঁচ দিন এই বাড়িতে থাকতে পারবে সে।এই দুদিনে ওর সাথে দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি তাঁর।আরু আর তিথি কিছুক্ষণ পর পর কল দিয়ে ওর মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে।বাসার সকলেই স্বাভাবিক।এমন যেন সিরাতের জীবনে কিছুই ঘটে নি। পুরনো কথা নিয়ে কেউ ঘাটাঘাটি করে নি।সেদিন সিরাত আসার সময় ওই কুটনি মহিলাটির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল।রাবেয়া বেগম মুখ ভেংচি দিয়ে বিরবির করে কয়েকটা কথা শুনিয়েছেন তাঁকে।এই ঘটনার পেছনে উনার হাত আছে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সিরাত।কিন্তু এসব করে উনার লাভ কি সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর কাছে।

কলেজে বসে আছে সিরাত।আজকে কিছুতেই এখানে আসতে চায় নি সে।কিন্তু তাঁর পাগল বন্ধু মহল এক প্রকার তুলে নিয়ে এসেছে তাঁকে।মুখ গম্ভীর করে বসে থাকার উপায় পাচ্ছে না।আজকল সকলের মুখে যেন খই ফুটছে।মিনার বললো,

-‘দোস্ত তুই তো ফাস্ট সকলের আগে বিয়ে করে নিলি।আর এই অধম একটা মেয়েকে দেখে প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে কিন্তু মেয়েটার খোঁজ পাচ্ছে না’।ওর কথা শুনে হাসলো সবাই।শুধু সিরাতই আগের মতো প্রাণ খুলে হাসতে পারলো না কোথাও একটা আটকে গেলো।সকলের হাসি দেখে মুখ ভার করে মিনার বললো,

-‘শালা তোদের কাছে ইমোশনের কোনো দাম নাই ধুর’। বলে উঠে চলে গেলো।সকলে অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে।

ক্লাসে বসে আছে সিরাত।আবেশ ক্লাস নিচ্ছে।আজকে অন্য দিনের তুলনায় সুন্দর লাগছে।কিন্তু এই সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে পারছে না সিরাত।বারবার কয়েকবার চোখাচোখি হলেও আজ কোনোকথা হয়নি আর।এলিনা দাঁত কেলিয়ে বারবার এটা ওটা নিয়ে কথা বলছে।।নির্ধারিত সময় শেষে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো আবেশ।

রাস্তায় এলোমেলো পায়ে হাঁটছে সিরাত।দুইটা ক্লাস করে কাউকে কিছু না বলে কলেজ থেকে বেড়িয়ে এসেছে সে।আসার সময় এলিনা আর আবেশকে একসাথে দেখে মাথাটা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে।কিছুতেই কিছু ভালো লাগছে না তাঁর।সময় যত যাচ্ছে জীবনটা ততই জটিল আকার ধারণ করছে।তপ্ত রোদে হাঁটছে ঘেমে নেয়ে একাকার কিন্তু কিছুই যেন ছুঁতে পারছে না তাঁকে।হঠাৎ মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তাঁর।পাওা দিলো না।দু’পা এগুতেই চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে মাথাও চক্কর দিতে থাকে।একসময় শরীরের সাথে না পেরে রাস্তায় পড়ে যায় সে।

#চলবে