তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-৩৯

0
1095

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:৩৯
#জুনাইনাহ_তাসনিম

নানুবাড়ি থেকে ফিরে আজ সারাদিন অনু তার দাদার সাথে গল্প করেছে,কলেজেও যায়নি।রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে আসতেই তার ডায়েরিটার কথা মনে পড়লো।সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে লাস্ট পেইজে বের করলো মানে লেখা শেষ যেখানে।অনুর খুব জানতে ইচ্ছা করছে তার পর কি হয়েছিলো।

[সবাই অবাক হচ্ছেন তো যে গল্পে হটাত এ কি টুইস্ট চলে এলো।কেই বা এই অনু?তাহলে অনুর পরিচয় জেনে নেয়া যাক আগে]

*বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান অনামিকা চৌধুরি ওরফে অনু।অনুর বাবা বিদেশি এক কোম্পানিতে বেশ ভালো পোস্টে চাকরি করে আর মা নামকরা এক কলেজে অর্থনীতির প্রোফেসর।বেশ বড়লোক ফ্যামিলির মেয়ে অনু।তাই শহরের নামকরা ব্যয়বহুল বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়তে কোন অসুবিধাই নেই তার।মা-বাবার সাথে নানুবাড়ি বেড়াতে গেছিলো।আসার পথেই ট্রেনের মধ্যে একটা ডায়েরি খুজে পায় সে।সেই ডায়েরিটাই ছিলো সূচীর ডায়েরি।একটা অসম্পূর্ণ ডায়েরি,যার শেষ জানার জন্যে অনামিকা খুবই আগ্রহী।
রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো সে কারন এমনিই আজ ক্লাস করেনি সে।যে করেই হোক কাল তাকে ক্লাসে এটেন্ড থাকা লাগবেই।

*ছুটি শেষে আবার অনুরা সব ফ্রেন্ড একসাথে হয়েছে।গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে সবাই।কিন্তু আজ সব মেয়েদের মুখে একটাই কথা “স্যারটা খুব হ্যান্ডসাম”।ছেলেরাও দেখি স্যারকে নিয়েই কথা বলছে।কিন্তু কোন স্যারের কথা হচ্ছে অনু তো কিছুই বুঝতে পারছে না।খুব বিতক্ত লাগছে অনুর।না পেরে সে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
–এই তোরা কার কথা বলছিস রে?কোন স্যারের কথা বলছিস হ্যা?কলেজের সবই স্যারই বুইড়া বুইড়া।কোন বুইড়া ব্যাটারে দেখে ক্রাশ খেলি হুম?

–দোস্ত কোন বুইড়া ব্যাটারে দেখে ক্রাশ খাই নাই।হট,ইয়াং,ড্যাশিং এক স্যার আইছে কলেজে।(অনুর বান্ধবী তিথি বলে)

–হট,ইয়াং,ড্যাশিং স্যার?তা কে সেই মহারথি?

–আরে উনি তো….(তিথি থেমে যায়)

–কি রে চুপ করে গেলি কেন?

–গাইজ স্যায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ারর(তিথি গালে হাত দিয়ে দুচোখ ভরে তাকিয়ে রইলো)

তিথির এরকম অবস্থা দেখে অনু ক্লাসরুমের দরজার দিকে তাকায়।অনু গালে হাত দিয়ে বসেছিলো কিন্তু স্যারকে দেখা মাত্রই ওর গাল থেকে হাত সরে যায়।আর অনু বেঞ্চের ওপর দুড়ুম করে পড়ে।পড়ার সাথে সাথেই উঠে যায়।ভাগ্যিস কেউ খেয়াল করেনি তাহলে আর বন্ধুরা ক্ষেপিয়ে আস্ত রাখতো না।কিন্তু তিথি ভুল কিছু বলেনি স্যারটা আসলেই অনেক সুন্দর।স্যার ভিতরে আসলেন সবাই উঠে দাড়িয়ে হ্যালো বললো।
–হ্যালোওওওও স্যার(সবাই একসাথে)
–হ্যালো এভরিওয়ান।প্লিজ সীট ডাউন(মিষ্টি হেসে)

সবাই বসে পড়ে।তারপর কুল,ড্যাশিং স্যার পুরো ক্লাসটা একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
–সো ক্লাস আমি গতকালকেই আমার পরিচয় দিয়েছিলাম কিন্তু আজ আবার আপনাদের সুবিধার্থে আবার বলি।হ্যালো,আই এম আশহাদ।ইউ ক্যান কল মি আশহাদ।সো ক্লাস শুরু করা যাক?
–ইয়েএএএস স্যার।

ক্লাস শুরু হয়।নতুন টিচার অনেক সুন্দর করে পড়াচ্ছে।সব মেয়েরা এমনকি ছেলেরাও তাকিয়ে আছে।যদিও মেয়েরা পড়াই কম স্যারের মুখের দিকেই তাকিয়ে।অনুরও বেশ ভালোই লাগলো নতুন স্যারকে।স্যার ক্লাস শেষ করে চলে গেলো।অনুর ফ্রেন্ডরা সবাই জিজ্ঞেস করলো অনুকে স্যারের ব্যাপারে কিন্তু অনু বলেই দিলো যে তার নাকি একটুও ভালো লাগেনি।বাসায় চলে এলো তারা।

*রাত ১২টা ৪৯।বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অনু এখন নাইট ক্লাবে ড্রাংক অবস্থায় চোখে সব ডাবল ডাবল দেখছে।জীবনে প্রথমবার শখ করে বন্ধুরা মিলে নাইট ক্লাবে এসেছিলো।অরেঞ্জ জুস ভেবে মদ খেয়ে ফেলেছে।এখন যে যার মতো মাতলামো করছে।অনুও মাতাল অবস্থায় ক্লাবের বাইরে চলে গেলো।রাতে রোডে গাড়ি কম ছিলো,সে রাস্তার মাঝ দিয়ে যেতে শুরু করলো।হটাত কিছু ছেলে এসে তাকে নানারকম অসভ্য কথা বলতে শুরু করলো।কিন্তু অনু তো মদ খেয়ে মাতাল তাই সে ৪টা মানুষকে ৮ টা দেখলো।কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভয় পেয়ে অনু দৌড়াতে শুরু করলো।অনু দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ধপ করে এক গাড়ির ওপর পড়লো।অনুর গাড়ির সামনে পড়েই নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলো।ঠিক তখনি গাড়ি থেকে একটা ছেলে নেমে এলো।ছেলেটা এসেই অনুকে ধমক দিলো।
–হে গার্ল আর ইউ ব্লাইন্ড?
অনু তাকাতেই দেখে তাদের নতুন টিচার আশহাদ এহসান দাড়িয়ে।স্যারকে দেখেই অনু চিল্লিয়ে উঠলো,
–স্যায়ায়ায়ার..
আশহাদ একটু অবাক হলো।অনুকে হাত ধরে উঠিয়ে বলে,
–ডু ইউ নো মি?
–ইয়েস ইয়েস।আমি তো আপনার স্টুডেন্ট স্যার।ওই যে কলেজে পড়ি।(অনু মাতলামি করে কথাটা বলছিলো)
–আর ইউ ড্রাংক?
–স্যার আসলে…(অনু আর কোন কথা বলতে পারলো না।তার আগেই অজ্ঞান হয়ে আশহাদের বুকের ওপর পড়লো)

আশহাদ এরকম একটা সিচুয়েশনের জন্যে একদমই রেডি ছিলো না।সে কি করবে বুঝতে পারছিলো না।অনুকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাবার মতো দাড়িয়ে তখনি গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মুখ বের করে এক প্রায় পঞ্চাশ এর কাছাকাছি বয়সের একজন মুখ বের করে বলে,
–এই যে হিরো।হিরোইনকে গাড়িতে নিয়ে এসে বসেন।
আশহাদ আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
–কাকু।ইয়ারকি মেরো না।আমি তো চিনিই না এই মেয়েকে আন্দাজে গাড়িতে নিয়ে যাবো।
–তো কি একা ছেড়ে দিবা?এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে?

আশহাদ আর কোন কথা বললো না।অনুকে নিয়ে গাড়িতে বসালো।তারপর সেও সীটে এসে বসলো।আশহাদের পাশের লোকটি মুচকি মুচকি হেসেই যাচ্ছে।আশহাদ কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,
–কাকু একদম হাসবা না।হিস্ট্রি রিপিট হয় তা আমি মানি না।
–আমি তো কিছুই বলিনি বাবা।
–কাকু তুমি…

আশহাদ আর কিছু বলতো তার আগেই অনুর হুশ ফেরে।আর হুশ ফিরার সাথে সাথেই সে হড়হড় করে বমি দেয়।আশহাদ তো ক্ষেপে আগুন।
–হোয়াট দা হেল?আর ইউ ক্রেজি?কি করলে এটা?
–স সরি স্যার।
অনুর নেশা প্রায় কেটে গেছে তবে মাথা ব্যাথা আছে।আশহাদের চিল্লানিতে মাথা ব্যাথা আরো বেড়ে গেলো।কারন সে আশহাদের গাড়িতে বমি করে দিয়েছে।আশহাদ তো চিল্লাতেই আছে।আশহাদের চিল্লানি থামানোর জন্যে তার কাকু বকা দিয়ে ওঠে।
–কি হচ্ছে বাবা!তুমি এরকম করছো কেন?মেয়েটা তো ইচ্ছা করে কিছু করিনি।
–হ্যা হ্যা।আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি।(অনু বলে)
–চুপ থাকো তুমি(আশহাদ ধমক দিয়ে বলে)
–বাবা!মা তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ!আমাদের হিরোর একটু মাথা গরম তাই হিরোইনের ওপর রাগ দেখিয়ে ফেলেছে।
–কাকু!
–ধমকাচ্ছিস কেন?আমি তো সিনেমাই দেখেছি।
–আবার?(আশহাদ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে)
–বাহ ব্যাটা!তুমি বললে দোষ নেয়।আমি বললেই দোষ?হাহহাহাহহহাহহহহ(লোকটি হাসতে থাকে)

আশহাদ আর কোন কথা না বলেই অনুকে বাসায় পৌছে দেয়।অনু গাড়ি থেকে নেমে আশহাদকে সরি বলে বাসায় ঢুকে যায়।আশহাদের কাকা তার দিকে তাকিয়ে থাকে,সে তার কাকার দিকে তাকিয়ে বলে,
–হিস্ট্রি কান্ট রিপিট।
–হোয়াই?
–আই ডোন্ট বিলিভ ইন লাভ।আর তা ছাড়া হিস্ট্রি রিপিট হলে মেয়েটি ফিরে আসতো না।
–আরে..
–আমি আর কোন কথা চাচ্ছি না।
–বড় হয়ে গেছিস রে বাবা তুই।আগে আমি তোকে বকা দিতাম আর এখন তুই।আগে সারদিন পাকনামি করতিস আর এখন কেমন গম্ভীর টাইপের।

আশহাদ কোন কথা না বলেই গাড়ি চালিয়ে বাসায় চলে গেলো।

*পরের দিন অনু ক্লাসে বসে আছে তখনই আশহাদ এলো।ক্লাসে এসেই খুব গম্ভিরভাবে দাড়িয়ে।সবাই উঠে দাড়ালে সবাইকে বসতে বলে,অনুও বসতে যাচ্ছিলো।কিন্তু আশহাদ অনুর দিকে হাত দিয়ে বলে,
–আপনি দাড়িয়ে থাকুন।
–আমি?(অনু ভয়ে ভয়ে বলে)
–ইয়েস ইউ।

অনু দাড়িয়ে থাকে।ভয়ে তার হাত পা কাঁপছে কাল রাতের কথা মনে করে।আশহাদ অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
–হোয়াটস ইউর নেম?
–জি অ অনু
–আগে পিছে কিছু নাই?
–জি স্যা স্যার আ আছে তো।অ অনামিকা চ চৌধুরি।
–তোতলাচ্ছেন কেন?তোতলা কি আপনি?
–নো স্যার।
–ওকে। এবার বলুন…

আশহাদ একের পর এক পড়া ধরতে থাকে।ক্লাসের সবাই তো কিছুই বুঝতে পারছে না হচ্ছে টা কি।হটাত করে অনুকে এতো পড়া ধরছে কেন।অনু তো ভয়ে জানা উত্তরও দিতে পারলো না।আশহাদ এবার অনুকে যা নয় তা বলে অপমান করতে লাগলো।অনু তো কেঁদেই ফেললো।কাঁদতে কাঁদতে অনু রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।ক্লাসের সবাই তো কিছুই বুঝতে পারছে না কিন্তু অনুর বুঝতে অসুবিধা হলো না আশহাদ কেন এরকম করলো।

*কেটে গেছে ৩ দিন।অনু কলেজ যায়না।সে না হয় একটু ভুল করে ফেলেছিলো তাই বলে আশহাদ এরকম রুড বিহেভ করবে।সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।তার বাবাও কোনদিন তাকে বকা দেয়নি আর সে কিনা এরকম করলো।সে ঠিক করলো আশহাদকে এই অপমানের জবাব দেবে।কিন্তু কিভাবে জবাবটা দেবে ভেবেই পাচ্ছে না।তখনই তিথি এলো অনুর বাসায়।তিথির জোরাজুরিতে দুজন বাইরে বেরলো।টুকটাক শপিং করে একটা কফি শপে বসলো।দুজন মিল্কশেক অর্ডার করেছিলো।কয়েক মিনিট পর মিল্কশেক এলো কিন্তু ওয়েটারকে দেখে তিথি আর অনুর চোখ যেন বেরিয়ে এলো।কারন ওয়েটারটা আশহাদ।অনু বা তিথি কিছু বলবে তার আগেই আশহাদ বলে,
–আমি এখানে আপাতত কোন ডাক্তার বা টিচার না।সো ওইভাবে না তাকালেই ভালো হবে।

অনুরা অবাক হলেও কিছু বলো না।কিন্তু অনুর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এটে গেলো।সে মিল্কশেকটা এক চুমুক খেয়ে ওয়েটার বলে ডাক দেয়।আশহাদ এসে দাড়ায়।
–ইয়েস ম্যাম।
–এইটা কি?
–মিল্কশেক।
–হুম সে তো আমিও জানি।কিন্তু এটা কি সত্যিই মিল্কশেক হয়েছে?
–মানে?
–মানে..মানে খুবই জঘন্য হয়েছে।

অনু কথাটা বলেই মিল্কশেকটা আশহাদের মুখে ছুড়ে মারে।আশহাদ এরকম কিছুর জন্যে রেডি ছিলো না।কিন্তু অনুর এই ব্যবহারে সে খুব রেগে যায়।অনুকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশহাদের কাকা তার হাত ধরে ফেলে।আশহাদ তার কাকার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যায়।
–আয়ান।বাবা দাড়া..(আশহাদের কাকা তাকে ডাক দেয়।কিন্তু সে দাড়ায় না)সরি ম্যাম।সরি….

লোকটা চলে যায়।অনু অবাক হয়ে লোকটার চলে যাওয়া দেখে।কাল রাতে উনিই তো ছিলো আশহাদের সাথে,ওনাকে তো অনু চেনেই।কিন্তু কথা সেটা না।কথা হলো লোকটা আশহাদকে আয়ান বলে ডাক দিলো।নামটা তার খুব চেনা মনে হলো।একটু ভাবতেই খেয়াল হলো আয়ান নামের একটা পাকা পিচ্চির গল্প পড়েছে সে সূচীর ডায়রিতে।অনু পিচ্চি আয়ানের কথা পড়েই হেসে ফেললো।সে আর তিথি ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলো।গাড়ির মধ্যে তার বারবার পিচ্চি আয়ানের পাকনামি গুলো মনে পড়ছে।কিন্তু সেই আয়ান আর এই আয়ান এর কোন মিল নেয়।যদিও আশহাদকে লোকটা কেন আয়ান বলে ডেকেছে তাও জানা নেয় অনুর।হয়তো ডাক নাম হবে।
অনু বাসায় চলে যায়।তার মন কিছুটা খারাপ লাগছে।কারন কাজটা তার বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।লোকটা একটু রাগি,গম্ভীর দেখেই বোঝা যায় কিন্তু সে অন্যায় করেছে যতোই হোক তিনি অনুর টিচার।টিচারের সাথে এরকম বিভেব করা অপরাধ।সে সন্ধ্যা বেলায় আবার সেই ক্যাফেতে চলে গেলো।আগের বার সে ক্যাফের নাম খেয়াল করলেও এবার খেয়াল করলো,বেশ বড়বড় করে লেখা ‘দা এহসান ক্যাফে’।সে ভিতরে ঢুকলো আর ভিতরে ঢুকতেই দেখে আশহাদের কাকা দাড়িয়ে।

চলবে…..