দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-২৪+২৫

0
398

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ২৪ ও ২৫
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

সন্ধ্যার পর্ব মুহূর্তে বাড়িতে এসে হাজির হয় নাযীফাহ। তখন সাথে করে মোবাইল নিতে ভুলে গিয়েছিল সে। শত চেষ্টা করেও সালাম সাহেবের সাথে ভয়ে কথা বলতে পারেনি। যদি ধমক দিয়ে বসেন তো?

‘ফাহিম কোথায় মা? এখনো আসেনি?’

মেয়ের দিকে একটা পলক তাকালেন তিনি। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

‘ বিকেলে এসে নিজের রুমে গিয়ে দরজার খিল এঁটে বসে আছে।’

‘ডাকোনি?’

‘ডেকেও লাভ আছে নাকি?’

বিষন্ন মুখে মায়ের দিকে চেয়ে রইলো নাযীফাহ।

___________________

মাগরিবের পরপর ফারিয়া কে পড়াতে বসেছে তূবা। ফারিয়া পড়ছে কম প্রশ্ন করছে বেশি। মাথা গরম হয়ে গেলেও নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করছে। তন্মধ্যে তার মোবাইল বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনে ফয়সালের নাম জ্বলজ্বল করছে। এই সন্ধ্যাবেলা ফয়সালের ফোন পেয়ে কপালে ভাঁজ পড়ে তূবার। রিসিভ করে ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,

‘যা বলার ফটাফট বলে ফেল। তোমার রাজকন্যা কে অক্ষর চিনাতে গিয়ে এমনিতেই মেজাজ গরম।’

ফয়সাল কোনো বাক্য ব্যয় না করে ফুঁস ফুঁস করতে লাগল।

তূবার ভাঁজ হওয়া কপাল আরো ভাঁজ পড়লো।

‘কি হয়েছে? এমন ফুঁস ফুঁস করছো কেন?’

‘আমার জিনিসপত্র কোনটা কোথায় রেখেছো? একটাও খুঁজে পাচ্ছি না। নয়টায় বাস ছাড়বে। এখনো কিছু গুছাতে পারলাম না।’

তূবা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘তোমার সব জিনিসপত্র আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি? প্রায় দুই মাস হতে চলল আমি ওই বাসায় নেই। এতোদিন নিজের জিনিসপত্র নিজেই গুছিয়ে রেখেছো। আমি কিভাবে বলবো কোনটা কোথায় রেখেছো।’

এবারে ফয়সালের গলার স্বর নরম হয়ে এলো।

‘তখন তো আর আমার কোনো অফিশিয়াল ট্যুর ছিলো না। আমার অফিশিয়াল ট্যুর হলে তো তুমি সবকিছু গুছিয়ে দাও। আমি তো একটা নিলে আরেকটা নিতে ভুলে যাই। কয়েক ঘন্টার জন্যে এসো না বাসায়। একটু প্যাকিং করে দিয়ে যাও, প্লিজ!’

কুঁজিত কপাল স্বাভাবিক হলো তূবার। এতক্ষণে ফয়সালের অভিসন্ধি ধরতে পারল তূবা। বাঁকা হেসে বলে,

‘এই ভরসন্ধ্যায় এই শরীর নিয়ে আমি বাসার বাইরে যেতে পারবো না। আমার দুই মায়ের এক মা ও যেতে দিবে না। নিজের কাজ নিজে কর। আমার এতো ঠেকা পড়েনি।’

‘আমি তোমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যেভাবে আছো সেভাবেই চলে আসো।’

‘নিচে কি করো? বাসায় আসো।’

‘হাতে সময় খুব কম। ওখানে গেলে দেরি হয়ে যাবে। আসো না প্লিজ। আমি ওয়েট করছি।’

অগত্যা বাধ্য হয়ে তূবা ফারিয়াকে তার নানু আর দাদুর কাছে নিয়ে গেল।

‘ফারিয়া কে রাখো। আমি একটু বাহিরে যাবো।’

‘পেটের ভিতর যে আরো একজন আছে। সে খেয়াল আছে? এই ভরসন্ধ্যায় কোথাও যাওয়া লাগবে না।’

মনোয়ারা বেগমের কথায় তপ্ত শ্বাস ফেলে তূবা।

‘তোমার আদরের জামাই অফিশিয়াল কাজে চট্টগ্রাম যাবে। এখন গিয়ে তার সবকিছু প্যাকিং করে দিতে হবে।’

‘একা যাবি? একা যাওয়া তো ঠিক হবে না। চল আমিও তোর সাথে যাই। এমনিতেই চারিদিকে বি প দের শেষ নাই।’

রাশেদা খাতুনের কথার পিঠে উত্তর দিলো তূবা।

‘আপনার ছেলে নিচে অপেক্ষা করছে মা। ভয়ের কিছু নেই।’

‘ছেলেটা কে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস? বাসায় আসতে বল।’

‘বলেছি, তার নাকি দেরি হয়ে যাবে। এখন আসছি।’

_____________________

জ্যামে আটকা পড়েছে তাহমিদ। ট্রাফিক লাইটের লাল আলোতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। জলকপাট একেবারে স্থির তার। রিংটোনের আওয়াজে তার ধ্যান ভঙ্গ হয়। তনয়া কল করেছে। মোবাইল স্ক্রিনে তনয়ার নাম দেখে অধর কোণ প্রসারিত হলো তার। মোবাইল রিসিভ করে কানে ধরতেই তাহমিদের মুখের হাসি এক পলকেই মিলিয়ে গেল। নিকষ কালো আঁধারি ঘনীভূত হলো আনন জুড়ে। তনয়ার কথা শুনে কোনো জবাব দিল না। খট করে মোবাইল কে’টে চোখ বন্ধ করে রইল। নিরাবেগ, নির্লিপ্ত স্বরে ড্রাইভারকে বলল,

‘এসি বন্ধ করে জানালার কাঁচ গুলো খুলে দিন। দম বন্ধ লাগছে আমার।’

‘আপনার কি শরীর খারাপ?’

সৌজন্য হাসলো তাহমিদ। না বোধক মাথা নাড়ে। মনে মনে আওড়াল, ‘অসুখ টা শরীরের না মনের।’

জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। মাঝরাস্তায় তাহমিদ ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থামতেই নেমে পড়ে সে। অতঃপর ড্রাইভারকে বলল,

‘আমার বাসা তো সামনেই। বাকি রাস্তাটা আমি হেঁটে হেঁটে যাবো। আপনি চলে যান।’

ফুটপাত ধরে হাঁটছে তাহমিদ। মোবাইল বের করল। নাযীফাহ’র অগোচরে উঠানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ।

‘এভাবে লুকোচুরি না করে আপনাকে সোজাসাপটা বলে দেওয়া উচিৎ ছিলো। তাহলে এমনটা হতো না। যেই দেখতে আসুক না কেন তার সাথে যেন আপনার বিয়েটা না হয়। উপরওয়ালা যেন আপনাকে আমার ভাগ্যেই রাখে। আমার মনের সবটাই যেন এখন আপনার দখলে। আপনি অন্যকারো হয়ে গেলে যে আমি বিলীন হয়ে যাবো।’

_____________________

দূর থেকে তূবাকে দেখে প্রশস্ত হাসলো ফয়সাল। তূবা ফয়সালের কাছাকাছি আসতেই ফয়সাল তার একটা হাত চেপে ধরলো। এদিক ওদিক তাকাল তূবা।

‘ফয়সাল এটা রাস্তা। মানুষ দেখলে খারাপ বলবে।’

‘নিজের বউয়ের হাতই ধরেছি।অন্য কেউর না’

বলে একটা রিক্সা ডেকে সেটাতে দুজন উঠে বসল। সারাটা রাস্তা ফয়সাল তূবার হাতটা ধরে রাখল। তূবা রোজ নতুন এক ফয়সালকে দেখছে। যা তাকে দিনকে দিন অবাক করছে।

বাসায় ঢুকে মাথা খারাপ হয়ে গেল তূবার। সব জিনিসপত্র এলোমেলো। ফয়সালকে চোখ রাঙানি দিতেই। ক্যাবলাকান্তের মতো হাসল,

‘ঘরে রমনী না থাকলে তো এমন হবেই। আমার কি দোষ?’

কিছু না বলে তূবা সব গোছাতে লাগল। হালকা পাতলা সব গুছিয়ে ফয়সালের সবকিছু প্যাক করতে নিলেই ফয়সাল পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে। তূবার কাঁধে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘রাখো এসব আমি নিজেই গুছিয়ে নিতে পারবো।’

‘তোমার প্যাকিং করার জন্যই তো নিয়ে এলে।’

তূবা ঘুরিয়ে নিজের দিকে ফেরাল ফয়সাল। দুহাতে কোমড় টেনে আরো একটু কাছে আনল।

‘ওসব তো বাহানা ছিল। আমার তো তোমার সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছিল। মিস করবো খুব।’

‘অনেকগুলো দিন তো কাছে ছিলাম না তখন করো নাই?’

‘তখন ইচ্ছে করলে পাগল প্রেমিকের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারতাম। চট্টগ্রাম গেলে তো আর এমন করতে পারবো না। তাই তোমাকে মন ভরে দেখবো। চোখের মুগ্ধতা কে স্টক করে নিয়ে যাবো। ক্লান্তি জেঁকে বসলে চোখ বন্ধ করে তোমাকে অনুভব করবো।’

‘প্রেমালাপ বাদ দেন। আগে সব গুছিয়ে নেই তারপর আমাকে মন ভরে দেখে নিয়েন।’

‘কফি খাবে?’

ফয়সালের থেকে ছিটকে দু’কদম দূরে সরে গেল তূবা। গালে হাত রেখে ফয়সালের আপাদমস্তক চোখ বুলাল। তারপর ফয়সালের কপালে হাত রেখে বলল,

‘তোমার জ্বর আসেনি তো? তুমি কি কিছু খেয়েছো?’

‘না রাণী সাহেবা। আপনি প্যাকিং করেন। আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

__________________

কফি নিয়ে বারান্দায় গেল ফয়সাল।তার পিছু পিছু তূবাও গেল।

ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে দুজন।

‘আমাকে ক্ষমা করেছো তো তূবা?’

কফির কাপে চুমুক দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে নিল তূবা৷ যেন সে অমৃত পান করছে।

‘যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো শাস্তি দেওয়া যায় না বা ক্ষমা না করেও থাকা যায় না। বিশেষ করে সে যখন কাছাকাছি থাকে তখন তো নাই। সেজন্য ও বাসায় থেকে তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম আর কই। কয়েকবার সত্যি বিচ্ছেদের কথা ভেবেছিলাম। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করলাম, ‘ আমি ভালো থাকবো তো?’
এই রসকষহীন, কাঠখোট্টা লোকটা কে যে ভালোবাসি। তুমি আমার কাছে পাশে থাকলে আমি অনুভব করি আমার সেই অনুভূতি আমি কখনো ব্যক্ত করতে পারবো না।’

তূবার গা ঘেঁষে বসলো ফয়সাল।

‘পারফিউম বদলেছো?’

‘পারফিউমের জন্য বউ কাছে ঘেঁষতে দেয় না। না বদলে উপায় আছে?’

মুচকি হেসে ফয়সালের কাঁধে মাথা রাখল। চারপাশ একেবারে নিস্তব্ধ। বারান্দায় থাকা দুই নরনারী একে অপর কে অনুভব করতে ব্যস্ত।

‘এই কয়টা দিন নিজের যত্ন নিও। আমি ব্যাক করে তোমাদের এই বাসায় নিয়ে আসবো। যে আসছে তার কথা চিন্তা করে এবার একটু ঝালটা কম খাও।’

‘পারবো না। আমার যত্ন নেওয়ার কথা বললে অথচ নিজের মা আর মেয়ের যত্ন নেওয়ার কথা বললে না?’

তূবার দু গালে হাত রেখে কপালে ওষ্ঠের উষ্ম স্পর্শ দিল ফয়সাল।

‘কারন আমি জানি এদের দু’জনের যত্নের কোনো ত্রুটি থাকবে। আমি সন্তান হয়ে মায়ের যতটা না খেয়াল রাখবো তুমি এর বেশি খেয়াল রাখবে। আমি ওদের যত্ন নেওয়ার কথা বলা মানে তোমার উপর আমার আস্থা নেই। আর তোমার যত্ন নেওয়ার কথা বলেছি এজন্য, কারণ যত অবহেলা নিজের বেলায়। মেয়ের পিছে দৌড়াতে গিয়ে সব ভুলে যাও তুমি। এবার একটু নিজের যত্ন নাও।’

তূবা আবেগঘন স্বরে বলল, ‘ভালোবাসি।’

ফয়সাল পুনশ্চ কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘আমিও।’

___________________

এখনো বাসায় ফিরেনি তাহমিদ যাত্রী ছাউনির নিচে বসে আছে। চারপাশে জন কোলাহল। সে চাইছে একটু শান্ত আর নিরিবিলি পরিবেশ। কিন্তু এখান থেকে উঠে যেতেও ইচ্ছে করছে না।

তার মোবাইল ভাইব্রেট করতে লাগল। নাম না দেখে আনমনে রিসিভ করেই মোবাইল কানে ধরল সে।

‘তাহমিদ কোথায় আছো?’

‘এই তো ফয়সাল ভাই বাইরে। কোনো দরকার?’

‘আমি অফিশিয়াল কাজে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বের হবো একটু পরে। একটু গোছগাছের জন্য তোমার বোন কে একটু বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। আমারও বাসের টাইম হয়ে গেলো এইদিকে রাতও বাড়ছে। তোমার বোনকে একা ছাড়তে সাহস হচ্ছে না। তূবাকে যদি পিক করতে ভালো ছিল।’

‘আচ্ছা আপনি আপনাদের বাসার নিচে থাকেন আমি আসছি।’

___________________

‘শা’লা বাবুর চেহেরা দেখি একবারে দেবদাসের মতো হয়ে গিয়েছে। কাহিনি কি?’৷ তাহমিদের কাঁধে চাপড় মে’রে বলল ফয়সাল।

ফয়সালের কথায় শুকনো হাসে তাহমিদ। তবে কোনো উত্তর দিল না।

‘সেদিন রাতে কথা দিয়েছি না ওই মেয়েটার বাড়িতে আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো। আমার কাজটা শেষ হলেই আমি মাকে নিয়ে যাবো।’

‘তা বোধ হয় আর করতে হবে না। আগামীকাল ওকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আর পছন্দ হলেই বিয়ে।’

একেবারে নিরব হয়ে গেলো ফয়সাল। কিছুক্ষণ বাদে উৎফুল্ল স্বরে বলল,

‘আরে দেখতে আসলেই বিয়ে হয় নাক?’

‘ এমন শুনার পরও হাজার মেয়ে সংসার করছে।’

‘আমার কথা মিলিয়ে নিও।’

‘মিলে গেলেই ভালো।’

ফয়সাল তূবার কাছে এসে এক হাতে জড়িয়ে ধরল।

‘ফোন করলে কিন্তু একেবারে ড্রামা করবে। দূরে যাচ্ছি টেনশন হবে আমার। বুঝেছো?’

মাথা দুলায় তূবা।

‘তুমিও নিজের যত্ন নিবে বলে দিলাম। সেখানে কিন্তু তোমার বউ নেই। তাই যা দিবে তাই খেয়ে ফেলবে। পৌঁছে ফোন দিও।’

______________________

টি টেবিলে বাহারি নাস্তার সমাহার। নাযীফাহ কে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ। পাত্র আর পাত্রের মা। বসার ঘরে উপস্থিত খালেদ মোশাররফ, তুহিন, পাত্র আর পাত্রের মা। সবাই এটাসেটা নিয়ে কথা বলছেন। কথার ফাঁকে নাযীফাহ কে নিয়ে হাজির হয় বকুল। পাত্র পক্ষের সামনে বসে আছে নাযীফাহ। ফাহমিদা বেগম আড়ালে আছেন। বকুল নাযীফাহ’র পাশেই দাঁড়ানো। নাযীফাহকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে পাত্রের মা। টুং করে মেসেজ টিউন বেজে উঠতেই পাত্র মোবাইল হাতে নিল। অতঃপর নাযীফাহ’র দিকে জহুরির চাহনি নিক্ষেপ করে একটা বার পরখ করল।

‘মিসের ঢাকা শহরের ব্যবসা কেমন চলছে?’

নাযীফাহ কথার মানে বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

‘ বড়লোক ছেলেপুলেদের সাথে রাত কাটিয়ে কত টাকা ইনকাম করেন?’

আসমান ভেঙে পড়লো উপস্থিত সবার উপরে। গা হাত পা ছেড়ে দিল নাযীফাহ সহ খালেদ মোশাররফ। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল বেদনার অশ্রু। খালেদ মোশাররফ সহ তুহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। থম মে’রে বসে রইলেন খালেদ মোশাররফ। আড়াল থেকে মুখে আঁচল চেপে ধরে কাঁদছেন ফাহমিদা বেগম। বকুলও যেন কথা খানা হজম করতে পারছে না। চোখের পানি মুছে নিল নাযীফাহ। মুখের বেদনার্ত ছাপ বদলে কঠোর হতে লাগল।

‘শুনেছি আপনি নাকি একজন শিক্ষক। এখন দেখছি আপনারই শিক্ষার অভাব। তা আপনি ছাত্র ছাত্রীদের কি শিক্ষা দেন?’

পাত্র আঙুল উঁচিয়ে বলল,

‘ইউ,,,,

‘আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কোনো কিছু যাচাই না করে কিভাবে আপনি একজনের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে পারেন? নাকি এগুলো আপনি আপনার স্টুডেন্টদের শিক্ষা দেন? আপনার শিক্ষায় ঘাটতি আছে। সেই জায়গাটা আগে ডেভেলপ করুন। তারপর বিয়ের চিন্তাভাবনা করবেন। পরে তো দেখা যাবে বউয়ের সাথে মিসবিহেভ করছন। আর বউ নারী নি’র্যা’ত’নে”র মা ম লা ঠুকে দিবে।’

‘খালেদ সাহেব আপনার মেয়ে তো চরম রকমের বেয়াদব। বেয়াদব বলেই তো বিয়ে দিতে পারছেন না।’

পাত্রে মায়ের কথায় অট্ট হাসল নাযীফাহ।

‘বাবা জানে তার মেয়ে কেমন। আপনাকে না চিনালেও চলবে। আফটার অল জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে বড় তো সেই করছে, তাই না? আর আজকাল একটু আধটু বেয়াদব না হলে হয় না। আসলে মানুষ ভালো টা হজম করতে পারে না। বেয়াদবের কদর বেশী। এই যে অনিচ্ছা সত্বেও আপনার মুখে মুখে তর্ক করতে হচ্ছে।’

‘তার মানের বলতে চাচ্ছেন আপনি সতীসাবিত্রী। তাহলে এসব কি?’

মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে থাকা একটা ছবি জ্বল জ্বল করছে। যেখানে অর্ধ ন’গ্ন নাযীফাহ’র গলায় মুখ ডুবিয়ে কোনো সুঠাম দেহি পুরুষ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। পুরুষের মুখ বুঝা যাচ্ছে না। তার পিছন থেকে তুলা ছবিটি। নাযীফাহ’র চক্ষু জোড়া বুঁজে আছে। হয়তো বা আবেগময়ী প্রতিটা স্পর্শে শিহরিত হয়ে পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে।

অবাঞ্ছিত এই দৃশ্য গোচরীভূত হতেই চোখ বন্ধ করে নিলেন খালেদ মোশাররফ। আর এমন একটা স্থিরচিত্রে নিজেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় নাযীফাহ। এতোটা ঘনিষ্ঠ তো সে কারো সাথে হয়নি। তাহলে এমন ছবি এলো কোথা থেকে? চক্ষু জোড়ায় হাজরো প্রশ্ন নিয়ে সে বকুলের দিকে তাকাল। বকুলও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখ জোড়া বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ছবিটির দিকে।

‘প্রযুক্তির যুগে এসব ধামাচাপা দিয়ে রাখা যায় না, মিস।’

নাযীফাহ ধপ করে আবারও বসে পড়ল। পুরো শরীর কাঁপছে তার। একটা বার সে তার বাবার দিকে তাকাল। খালেদ মোশাররফ নতজানু হয়ে বসে আছেন। এরপর সে তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিনও তার দিকে চেয়ে আছে। তুহিন দু-চোখ যেন তাকে প্রশ্ন করছে, ‘এসব কি নাযীফাহ?’

নাযীফাহ’র অসহায় দু-চোখ যেন উত্তর দিলো, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না।’

চোখ দু’টো বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিল নাযীফাহ।

‘তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করেও আজকাল অনেককিছু করা সম্ভব। সেটা বোধ হয় আপনি ভুলে গিয়েছেন।’

_______________________

জানালার কপাট খুলে দাঁড়িয়ে আছে নাযীফাহ। বাইরের সূর্যের আলোকরশ্মি চোখে এসে বিঁধছে। তারপরও হাত ভাঁজ করে সে এখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

মেহমান বিদায় নিয়েছে বহু আগে। ফাহমিদা বেগম মেয়ের জন্য কাঁদছেন। উনাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বকুল। খালেদ মোশাররফ সেখানেই চুপ করে বসে আছেন। ফাহিম এতক্ষণ এখানে উপস্থিত না থাকলেও এই মাত্র এসে হাজির হয়। বসার ঘরে এমন থমথমে পরিবেশ দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।

‘কি হয়েছে? পাত্রপক্ষ কি চলে গিয়েছে?’

ছেলের গলার স্বর পেয়ে ছেলের দিকে মাথা তুলে তাকালেন ফাহমিদা বেগম। বসা থেকে উঠেই স’জোরে চ’ড় বসিয়ে দিলেন ওর গালে। আকস্মিক ঘটনায় আহাম্মক হয়ে গেল ফাহিম। ঠিক কি কারণে তার মা তাকে চ’ড় দিল বোধগম্য হলো না।

‘খুশি না এবার তুই? সেদিন তোর এসব কথাবার্তার জন্য আমার মেয়েটা বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল। দূরে দূরে থেকেও তোর বি ষা ক্ত কথা থেকে বাঁচতে পারলো না। আজও আবারও আমার মেয়েটাকে অপমানিত হতে হলো।’

বোনের জন্য মা র ল তাকে? গালে হাত দিয়ে ফুঁস ফুঁস করছে সে। সে ছেলে পক্ষকে বলেছে অপমান করার জন্য?

‘তোমার মেয়ে ধোয়া তুলসীপাতা? সে যদি কিছু না করে তাহলে মানুষ এগুলো পায় কোথায়? যা রটে তার একটু হলেও ঘটে। আগে নিজের মেয়ে সামলাও।’

মাথা উঁচিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন খালেদ মোশাররফ। আজ তার ছেলেও এমন কথা বলছে?

__________________

কারো পায়ের শব্দ পেয়ে পিছনে তাকাল নাযীফাহ।

‘এসব কি নাযীফাহ? তোর কি আসলেই কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো বা আছে? আগে তো মানুষের মুখে শুনতাম। কখনো বিশ্বাস করিনি। আসলেই কি এসব সত্যি?’

‘ তোমাকে কি জবাব দিবো আমি নিজেই তো কনফিউজড তুহিন ভাই। আমার তো কারো সাথে রিলেশন ছিল না। এগুলো কোথা থেকে এলো। তুমিই বলো কারো সাথে যদি আমার রিলেশন থাকে তাহলে আমি এখনো অবিবাহিত কেন? আমি তো আরো আগেই বলে দিতাম। সারাজীবন বাবার সম্মানের কথা চিন্তা করে এসব প্রেম ভালোবাসা থেকে দূরে ছিলাম। এমন টা কেন আমার সাথেই ঘটছে?’

‘কখনো কি কারো সাথে তোর ঝামেলা হয়েছিল?’

মাথা নেড়ে না বলল নাযীফাহ। আর কথা বাড়াল না তুহিন তপ্ত শ্বাস ফেলে প্রস্থান করলো। তারও মাথা কাজ করছে না। নাযীফাহ কে বিশ্বাস হচ্ছে আবার হচ্ছে না।

তুহিন চলে যেতেই মোবাইল হাতে নিল নাযীফাহ। আবারও সেই নাম্বারে বার্তা পাঠাল।

‘কোথায় হারিয়ে গেলেন আপনি? আমার মনের আকাশে যে কালো মেঘের ঘনঘটা। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। একটু মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে আকাশ পরিষ্কার হউক খুব করে চাইছি। হুট করে আমার জীবনে এলেন আবার হুট করেই হারিয়ে গেলেন।’

_______________

লাঞ্চ করে মাত্রই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো তাহমিদ। রাস্তায় পা রাখতেই সাত কি আট বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ে হাত পাতল। এলোমেলো চুল, ছেড়া জামা। মেয়েটার বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো সে। চোখ দুটো ডাগর ডাগর আর মায়াবী। ওয়ালেট বের করে। ভাংতি টাকা বের করতে গিয়ে ভুল করে ক্রেডিট কার্ড টান দেয়। ক্রেডিট কার্ডের সাথে আরো একটা ছোট্ট জিনিস রাস্তায় পড়ে যায়। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো তাহমিদের। এইতো সেই সিমকার্ড। এটাকে এখানে রেখে হন্যে হয়ে খুঁজেছে সে। সেই মেয়েটার হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে তাড়াতাড়ি করে আসলো। নিজের কেবিনে প্রবেশ করে তড়িঘড়ি করে সিমকার্ড মোবাইলে ঢুকালো। কিছুক্ষণ বাদে টুংটাং মেসেজ আসতে শুরু করল। কাঁপা কাঁপা হাতে ইনবক্সে গেল সে। এক এক করে সবগুলো মেসেজ পড়ে নিজের উৎকন্ঠা আর দমিয়ে রাখতে পারলো না। কল করে বসল নাযীফাহ কে। মেসেজে এতো কিছু বলা সম্ভব না। যা বলার এবার মুখেই বলবে। যা হওয়ার হবে।

বালিশ জড়িয়ে শুয়ে আছে নাযীফাহ। চোখ জোড়ায় নিদ্রা ভর করেছে। প্রথম বারের রিংটোনের শব্দ তার কর্ণ পর্যন্ত পৌঁছাল না। দ্বিতীয় বার মোবাইল রিং হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সে। মোবাইল স্ক্রিনের নাম্বার টা দেখে চোখ দুটো কচলে নেয়। প্রথমে ভেবেছে ঘুমের ঘুরে ভুল দেখছে। পরে দেখল না ঠিকই আছে। মোবাইল কানে ধরে হ্যালো বলতেই চমকে উঠে সে। অপর পাশ থেকে তাহমিদের উদ্বিগ্ন, অশান্ত গলা শুনে নাযীফাহ বি’স্ফো’রি’ত স্বরে বলল,

‘স্যার আপনি? আপনি আমাকে এতোদিন মেসেজ করেছেন, গিফট পাঠিয়েছেন?’

তাহমিদ কম্পান্বিত কণ্ঠে বলল,

‘হ্যা, আমি পাঠিয়েছি। এখন বলেন আপনার বিয়ে কি ঠিক হয়ে গিয়েছে?’

বিয়ের কথা শুনে আরো আশ্চর্য হয় নাযীফাহ। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘আপনি বিয়ের খবর কই পেলেন?’

‘আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।’

‘বার বার যা হয় তাই হয়েছে। আবারও অপমানের মালা পড়েছি।’

কথাটা শুনে খারাপ লাগলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে। হার্ট বিট নরমাল হচ্ছে।

‘আপনি এই খবর কোথায় পেলেন?’

চুপ করে রইলো তাহমিদ। তার চিন্তা কমেছে এতেই শান্তি তার। তবে সে আর দেরি করবে না।

‘চুপ করে আছেন কেন? আর এতোদিন এভাবে গিফট দেওয়ার মানে কি?’

‘ যদি বলি আপনাতে আসক্ত আমি। আপনি কি বিশ্বাস করবেন? যদি বলি আপনার মায়ায় আটকা পড়েছি। আপনি কি মেনে নিবেন? যদি বলি আপনাকে ভালোবেসে আপনার দায়িত্ব নিতে চাই। আপনার সকল দুঃখ বিলীন করতে চাই। আপনি কি একটু ভরসা করবেন? যদি বলি আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি কি ফিরতি ভালোবাসা দিবেন? আপনি কি শুনবেন আমার মনের আকুলতা? আপনাকে কাছে পাওয়ার তীব্র আর্তনাদ? যদি মনে হয় আমি আপনাকে প্রেম নিবেদন করছি, তবে তাই। শত অপেক্ষার পরেও আমার আপনাকেই চাই।’

প্রতিটা কথার নিস্বন নাযীফাহ’র শ্রবণগোচর হতেই একের স্থির হয়ে গেল সে। শিড়দাঁড়া বেয়ে প্রবাহিত হতে লাগল তরল স্রোত। মোবাইল কানে ধরেই জড়বস্তুর ন্যায় বসে রইলো। এমন একটা দিনের অপেক্ষায় ছিল সে। তবে আজ কেন সে দোটানায় ভুগছে? বুকের ভেতর কেন কাঁপছে তার? এসব কি স্বপ্ন না সত্যি ঠাহর করতে পারছে না।

‘আপনি তো মনে হয় বিবাহিত। বাচ্চাও আছে।’

এবারে শব্দ করে হাসল তাহমিদ।

‘কোথাও নিজেকে বিবাহিত বলে পরিচয় দিয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি আসছি আপনার গ্রামে। আমার পরিবার নিয়ে। আপনার উত্তর টা যেন হ্যা হয়।’

এতোদিনের করা শত দুশ্চিন্তা যেন এক লহমায় বিলীন হয়ে তাহমিদের। বুকের ভেতরটা কেমন হালকা হালকা লাগছে। মোবাইলে নাযীফাহ’র একটা ছবি বের করে ছবিতে ঠোঁট ছুঁয়ালো।

‘আপনি আসলেই আমার আ’স’ক্তি। এভাবে ছেড়ে দেই কিভাবে?’

আলতো হেসে তাহমিদ ফোন লাগায় ফয়সালকে।

ফয়সাল মিটিং শেষ করে হোটেল রুমে এসে গা এলিয়ে দিয়েছে। অফিসের পোশাক এখনো তার গায়ে। মোবাইল ভাইব্রেট করতেই বুঁজে রাখা ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত চোখ জোড়া মেলে তাকায়। রিসিভ করে নিবন্ত স্বরে বলল,

‘দেবদাস কি বলবে বলে ফেল।’

শুনা গেল তাহমিদের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর।

‘আপনার বোধ হয় একমাত্র শা লার বিয়ে খাওয়া হলো না।’

‘ঘটনা কি দেবদাসের গলা দিয়ে আনন্দের বন্যা বইছে? আজ একটু বেশি প্রফুল্ল মনে হচ্ছে?’

এবার দ্বিগুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে তাহমিদ বলল,

‘আপনার কথায় ঠিক হয়েছে। দেখতে আসলেই বিয়ে হয় না।’

‘আচ্ছা! এখন বুঝি আমাকে রেখেই বিয়ে করে ফেলবে? পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে পারবে না?’

‘আমার তো এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না। যদি পারতাম তাহলে উড়াল দিতাম।’

শব্দযোগে হাসতে লাগল ফয়সাল।

‘হাসবেন না ফয়সাল ভাই। নিজের বউ আছে তো আপনি কি বুঝবেন মিসকিনের কষ্ট।’

_____________________

মধ্যাহ্নের সূর্য মাথার উপর সদর্পে আলো ছড়াচ্ছে। চালের গুঁড়ো সংরক্ষণের জন্য বড় একটা থালায় শুকাতে দিয়েছেন ফাহমিদা বেগম। নাযীফাহ সেগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটা ছায়া এসে পায়ের কাছে ঠেকল। সেই ছায়া অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই সামনের মানুষটাকে দেখে চমৎকৃত হয়। চক্ষু জোড়া আপনা আপনি বড় হয়ে গেলো তার।

#চলবে