#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ২৬ ও ২৭
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)
‘নাযীফাহ কোথায় ফাহিমের মা?’
রাতে খাবার টেবিলে বসে প্রশ্ন করলেন খালেদ মোশাররফ। মাছের মাথাটা উনার প্লেটে তুলে দিয়ে ফাহমিদা বেগম নির্লিপ্ত স্বরে বললেন,
‘বাপ ছেলে খেয়ে উঠো। আমরা মা মেয়ে পরে খাবো।’
‘কেন রান্না কি কম করেছো নাকি যে পরে খাবে?’
‘রান্না কম করবো কেন?’
‘তাহলে কি হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি আবার অনেক কিছুই হয়েছে। তোমরা চুপচাপ খেয়ে উঠো।’
আর কথা বাড়ালেন না খালেদ মোশাররফ। চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেলেন। ফাহিম খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই ফাহমিদা বেগম ভাবলেশহীন ভাবে বললেন,
‘সময় গেলে সাধন হবে না।’
চমকে উঠে ফাহিম। চমকিত চোখে মায়ের দিকে নজর দিল। ভাবান্তর হলো না ফাহমিদা বেগমের। তিনি আপন মনে এঁটো প্লেট সরিয়ে আরো দু’টো প্লেটে ভাত নিচ্ছেন।
ছোট্ট বইয়ের তাক থেকে নাযীফাহ ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের বইটা বের করলো। উপরে ধূলো জমেছে। সেই ধূলো ঝেড়ে পাতা উল্টাতেই ফাহমিদা বেগমের ডাক শুনা গেল।
‘নাযীফাহ অনেক রাত হয়েছে খেয়ে যা।’
নাযীফাহ হাতের বইটা রেখে ধীর পায়ে ডাইনিং স্পেসে গেল। পুরো রুম একবার চোখ বুলিয়ে শ্লথ, মন্থর গলায় বলে,
‘বাবা খেয়েছে তো?’
মাথা দুলান ফাহমিদা বেগম। নাযীফাহ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসে। নাযীফাহ’র সামনে প্লেট দিতেই সে না খেয়ে ভাত গুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল। দৃষ্টি নিবদ্ধ সাদা ভাত গুলোর দিকে। ফাহমিদা বেগম এক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। উদাসীন, অনদ্বিগ্ন নাযীফাহ। আপন ভাবনায় ব্যস্ত সে।
‘খাচ্ছিস না কেন?’
মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো নাযীফাহ। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
‘সকালে যা হলো তোমরা কি এগুলো বিশ্বাস করো মা?
নিরুত্তর রইলেন ফাহমিদা বেগম। চোখের কালো মনি জোড়া নিবদ্ধ নাযীফাহ’র চোখে।
মায়ের কাছ থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে ভারি হয়ে এলো নাযীফাহ’র কন্ঠস্বর। শুকনো ঢুগ গিলে সে।
‘বিশ্বাস করেছো তাই তো? মা, বিশ্বাস করো আমি ওসবের কিছু না। কোথা থেকে এসব এসেছে আমি ভাবতে ভাবতে পা গ ল হয়ে যাচ্ছি।’ কথা গুলো বলতে বলতে বেদনা, মর্মযন্ত্রনার অশ্রু স্পর্শ করেছে তার গাল।
ফাহমিদা বেগম উঠে এলেন। নাযীফাহ’র চোখের পানি মুছে দিল পরম মমতায়।
‘খাবার পাতে চোখের পানি ফেলে না। এতে অকল্যান হয়।’
মায়ের পেট জড়িয়ে ধরে নাযীফাহ। হেঁচকি তুলে কেঁদে চলেছে সে। ফাহমিদা বেগম নাযীফাহ’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কান্নার প্রকোপ একটু কমতেই নাযীফাহ কাঁপা গলায় বলল,
‘সকালের সেই ঘটনার পর থেকে বাবার চোখে চোখ মিলাতে আমার সংকোচ হচ্ছে। বাবা নিশ্চয়ই তার মেয়েকে খা’রাপ মনে করছে? আমি কিভাবে বাবার সামনে যাবো? তুমিও আমাকে খা’রাপ মনে করছো তাই না মা?’
‘প্রতিটা মা তার সন্তান কে রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনে। সবার থেকে সবকিছু লুকিয়ে রাখলেও মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায় না। সন্তানের অপরাধী চোখ জোড়া দেখলে মা বুঝতে পারে। আমি তো চিনি আমার সন্তানকে। দশটা মাস এই পেটে ধরে পৃথিবীর আলো দেখালাম। সবাই যদি ছি ছি করে মুখ সরিয়েও নেয়। কিন্তু মা পারে না। সন্তানের সাথে যে মায়ের নাড়ীর সম্পর্ক। তোর মা এসব বিশ্বাস করে না।’
নাযীফাহ তার মা কে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।
______________________
‘কালকে আমরা সবাই কুমিল্লা যাচ্ছি।’
তাহমিদের কথা শুনে খাওয়া ছেড়ে ওর দিকে মনোনিবেশ করে সবাই।
‘কুমিল্লা তো আমাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়ি নেই। তাহলে কুমিল্লা কোথায় যাবি? অফিসের কাজে যাবি নাকি?
মায়ের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ে তাহমিদ। যার মানে হলো না।
‘তাহলে কেন যাবি তুই?’ তূবার প্রশ্ন শুনে প্রশস্ত হাসে সে।
‘হারিয়ে যাওয়া সিম টা আমি পেয়েছি।’
তূবা প্রফুল্ল স্বরে বলে, ‘সত্যি?’
রাশেদা খাতুন খাচ্ছে কম ওদের দেখছে বেশি। মনোয়ারা বেগম দুই ভাই বোনের কথা কিছুই বুঝতে পারছেন না। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছেন।
‘খাওয়া শেষ করো এরপর বলছি কেন যাবো।’
খাওয়া শেষ করে সবাই বসল। অপেক্ষা তাহমিদের কথা শুনা। তাহমিদ মায়ের পায়ের কাছে এসে মেঝেতে বসল। নিজের মাথাটা মায়ের কোলে রাখল। শান্ত স্বরে বলল,
‘মাথায় হাত বুলিয়ে দাও মা। হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে এই ছোট্ট মাথায়।’
ফারিয়া সোফা ছেড়ে নামল। ছোট ছোট হাতে তাহমিদের মাথায় হাত রাখল। মনোয়ারা বেগম এক গাল হেসে বললেন,
‘আমার ভাত বোধ হয় উঠল। তোর আরেক মা হাজির হাত বুলানোর জন্য।’
মনোয়ারা বেগমের কথায় সবাই উচ্চ শব্দে হাসতে লাগল।
তাহমিদ নিষ্প্রভ, ধীরগতিতে বলল,
‘মা? আমি না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার সিদ্ধান্ত শুনার পর তুমিই কি আমার উপর নারাজ হবে?’
এবারে তিনিও তাহমিদের মাথায় হাত রাখলেন।
‘আমার ছেলে নিশ্চয়ই কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না।’
শুকনো ঢুক গিলে তাহমিদ। তার মা যতই বলুক না কেন তার ভয় হচ্ছে।
‘আমরা কাল সবাই নাযীফাহদের বাড়ি যাচ্ছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।’
হাত থেমে গেল মনোয়ারা বেগমের। রাশেদা খাতুন আর তূবাও তাহমিদের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো।
মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। মনোয়ারা বেগম কি জবাব দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
‘তুমি আমার সিদ্ধান্তে নারাজ তো? আচ্ছা তবে যাবো না। আমি কয়েক বছর আগেও তোমার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছি। আর আজও তোমার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিবো। তবে অন্য কাউকে বিয়ে করতে বলো না। আমার দ্বারা সম্ভব না। আমার মন ওই একজনেই আঁটকে আছে।’
বিষন্ন মুখে উঠে দাঁড়ায়। তূবার মুখটাও কালো। তাহমিদ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রাশেদা খাতুন মনোয়ারা বেগম কে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেন মনোয়ারা বেগম অধর প্রসারিত করেন।
‘কাল কয়টার সময় রওনা দিবি?
মায়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্ত হাসলো তাহমিদ। দ্রুত পায়ে আবারও মায়ের পদতলে বসে পড়ল।
উৎফুল্ল স্বরে বলল,
‘তুমি সত্যি যাবে মা?’
মাথা দুলান তিনি।
‘তাহলে এতক্ষণ চুপ করে ছিলে কেন?’
‘হুট করেই কথাটা হজম করতে পারছিলাম না। তোর এমন একটা সিদ্ধান্তের জন্য আমি কতগুলো দিন অপেক্ষা করে আছি। তোর যাকে পছন্দ তাকেই বিয়ে কর। আমি শুধু চাই তোর একটা সংসার হউক।’
তূবার মুখের অন্ধকার কে’টে গিয়ে যেন সূর্য উদিত হলো। রাশেদা খাতুন ও হাসলেন।
‘মাউই মা সকাল রেডি হয়ে থাকবেন। আটটার বাসে যাবো আমরা।’
‘আমাকে কেন এসবের মাঝে টানছো। আমি থাকি বাসায়।’
‘আপনার আরেকটা ছেলে থাকলে কি না গিয়ে পারতেন?’
____________________
মধ্যাহ্নের সূর্য মাথার উপর সদর্পে আলো ছড়াচ্ছে। উঠানের দড়িতে থাকা শুকনো কাপড়গুলো হাতে তুলে নিলো নাযীফাহ। অন্যথায় রোদের তাপে কাপড়ের রং নষ্ট হয়ে যাবে। চালের গুঁড়ো সংরক্ষণের জন্য বড় একটা থালায় শুকাতে দিয়েছেন ফাহমিদা বেগম। নাযীফাহ সেগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে উঠে দাঁড়াল। একটা ছায়া এসে পায়ের কাছে ঠেকল। সেই ছায়া অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই সামনের মানুষটাকে দেখে চক্ষু ছানাবড়া নাযীফাহ’র। বাচ্চা কোলে তাহমিদ দাঁড়িয়ে আছে তারই অক্ষিপটে। পিছনে আরো তিনজন নারী।
নাযীফাহ চমকিত স্বরে বলল,
‘আপনি?’
‘উত্তর পরে দিচ্ছি। আগে আমার ভাগ্নীকে একটু শোয়ানোর ব্যবস্থা করে দিন। বাচ্চা মেয়েটা গরমে একেবারে নাজেহাল। আর আমাদের একটু ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ। কাঁচপুরের দেড় ঘন্টার জ্যামে সবাই পেরেশান। তার উপর আপনাদের বাড়ি চিনতেও অনেকটা সময় লেগেছে। সেই কবে এসেছি।’
নাযীফাহ কোনো জবাব না দিয়ে ঘুমন্ত ফারিয়াকে কোলে তুলে নিল। সবাইকে কলপাড় দেখিয়ে দিয়ে ফারিয়া কে নিজের রুমে এসে শুইয়ে দিল।
ফাহমিদা বেগম কাউকে চিনতে পারছেন না। মেয়েও কোনো জবাব দিচ্ছে না। কপাল কুঁচকে শুধু সবাইকে দেখছে।
‘মা আমাকে দেওয়ার জন্য যে মাংস গুলো রান্না করে ফ্রিজে রেখেছিলে সেগুলো গরম করো আর ভাত বসাও। উনারা খাবেন।’
এবার ফাহমিদা বেগম নাযীফাহ হাত চেপে ধরলেন এরা কারা জানার জন্য।
নাযীফাহ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ছেলেটাকে ভালো করে দেখ মা। দেখো চিনতে পারো কি না। ওই যে পাঁচ বছর আগে।’
ফাহমিদা বেগম নাযীফাহ’র হাত ছেড়ে তাহমিদের দিকে তাকাল। কিছুক্ষন বাদে চিনতে পেরেই বললেন,
‘এরা এখানে কি করছেন? এদের এখানে কি কাজ?’
‘জানি না আবার জানিও। বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলো আর উনাদের খাবারের ব্যবস্থা করো। উনারা নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত।’
ফাহমিদা আবারও চুলায় ভাত বসালেন। আর যাইহোক মেহমান কে তো আর অভুক্ত রাখা যাবে না। ভাত বসিয়ে তিনি খালেদ মোশাররফ কে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
নাযীফাহ গামছা নিয়ে এলো কলপাড়ে। সবার হাত মুখ ধুয়া শেষ। তিনজকে নিজের রুমে যেতে বলে তাহমিদের হাতে গামছা দিল। তাহমিদ মুচকি হেসে বলল,
‘বলেছিলাম না খুব শীঘ্রই আসছি।’
কপাল কুঁজিত করে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।
_________________________
বেলা নামতে শুরু করেছে। রোদের প্রখরতাও কম। বসার ঘরে সবাই উপস্থিত। ফাহিম এককোনায় দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে।
‘ভাইজান আমি আপনার মেয়েকে নিজের মেয়ে করে নিয়ে যেতে চাই।’
মনোয়ারা বেগম খালেদ মোশাররফ কে কথা বলতেই উনি মনোয়ারা বেগমের দিকে প্রশ্নের বান ছুড়লেন।
‘নিজের মেয়ে তো পাঁচ বছর আগেও করতে চেয়েছিলেন। করলেন না তো কোনো এক কারণে। আজকে হটাৎ আবার কেন?’
‘আল্লাহর সিদ্ধান্তে ভরসা করেন তো? হয়তো তখন বিয়েটা ওদের জন্য কল্যান কর ছিলো না। না হলে কোনো না কোনো ভাবে বিয়েটা তখন সম্পূর্ণ হতো।’
মনোয়ারা বেগম হয়তো জানতেন এমন প্রশ্ন করবেন। তাই আগেই উত্তর রেডি করে রেখেছিলেন।
খালেদ মোশাররফ কি বলবেন ভেবে পেলেন না। নিচের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন।
‘আপনি হয়তো আপনার মেয়েকে আমার থেকে ভালো কিংবা আরো প্রতিষ্ঠিত ছেলের কাছে বিয়ে দিতে পারবেন। কারণ নাযীফাহ সেগুলো ডিজার্ভ করে। তবে আমি তাহমিদ আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে না পারলে আর কাউকে বিয়ে করবো না। যাকে মনে মনে চেয়েছি তাকে না পেলে মনে হয় না আমি অন্য কারো সাথে সুখী হতে পারবো।’
তাহমিদের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন উনি। তাহমিদের কথায় অবাক হয়েছেন ফাহমিদা বেগম সহ ফাহিমও। তারা যেন তাদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
খালেদ মোশাররফ আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘আসলে কি বলবো আমি বুঝতে পারছি না। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আমার কি বলা উচিৎ সেটাও বুঝতে পারছি না। মেয়ের বাবা আমি। মেয়ে তো অবশ্যই বিয়ে দিবো। তবে কেউ হুট করেই এসে আমার মেয়ের হাত চাইলেই তো দিবো না। আমি যাচাই বাছাই করবো। ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর নিবো। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমার মেয়ের মতামত।
‘অবশ্যই আপনি আমাদের ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর নিবেন। আমিও এই পরিবারের মেয়েকে নিজের ছেলের বউ করেছি। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এমন পরিবার আপনি কোথাও পাবেন। আর ছেলে সম্পর্কে না হয় প্রথম ভোট আমিই দিলাম। তাহমিদ সোনার টুকরো ছেলে। হয়তো আপনার কাছে বেশি বেশি মন হতে পারে। তবে ও আমার ছেলে থেকে কোনো অংশে কম না।
‘আপনার মতামতের ভিত্তিতে আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বউকে ঘরে তুলবো।’
মনোয়ারা বেগম কথাটা শেষ করতেই তাহমিদ বলল,
‘আমরা আবার ঢাকা ফিরবো। আপনি অনুমতি দিলে আপনার মেয়ের সাথে আমি আলাদা করে কয়েকটা কথা বলতে চাই।’
‘সেকি আজই ফিরবে? সবাই তো ক্লান্ত আজকের রাতটা থেকে গেলে ভালো হতো। সেভাবে কোনো আপ্যায়ন করতে পারলাম না।’
ফাহমিদা বেগমের কথার প্রেক্ষিতে মনোয়ারা বেগম বলেন,
‘এই স্বল্প সময়ে যেই আপ্যায়ন করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। তবে আল্লাহ চাইলে আবার আসবো বার বার আসবো। তখন হয়তো বিরক্ত হয়ে যেতে পারেন।
_____________________
ওয়ারড্রবের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাযীফাহ। তাহমিদ খাটে বসে নাযীফাহ’র রুম পর্যবেক্ষণ করছে।
‘এতো লুকোচুরির মানে কি?’
নাযীফাহ’র প্রশ্ন শুনে তার দিকে তাকায় তাহমিদ।
‘জানি না, হয়তো ভয় ছিল যদি তুমি আমাকে রিজেক্ট করো। ব্যপারটা কিন্তু সহজ ছিল না।’
‘এতোদিন বিয়ে কেন করেননি?’
‘আপনি কেন করেননি?’
‘আই থিংক উত্তরটা আপনার জানা।’
‘আপনি সেদিন রেস্টুরেন্টে বলেছিলেন না? আমার সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে একটা সুন্দর সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আপনার মতো স্বপ্ন আমিও দেখেছিলাম। হয়তো ততদিনে আপনার জন্য সফট কর্নারও তৈরী হয়েছিল। বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পর আমার বার বার মনে হয়েছিল আমি আপনাকে ঠকিয়েছি। অন্য কারো সাথে নতুন জীবন শুরু করলে হয়তো আমি সুখী হবো না। মায়ের জোরাজোরিতে যতগুলো মেয়ে দেখেছি কেন জানি ওদের দেখলে আপনার আদল আমার চোখে ভাসতো। পুরুষ মানুষ সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরে একটু একটু মানসিক শান্তি চায়। আর সেটা হয়তো আপনাতেই নিহিত। আমি জানি না হয়তো আল্লাহ আপনার ভাগ্যটা আমার সাথে জুড়ে রেখেছেন। না হলে কেন আমি বিয়ে করলাম না বা আপনার বিয়ে হলো না। কেন জোড়া লাগা পথ আলাদা হয়েও আবার দিনশেষে একত্রিত হলো? উত্তরটা না আপনার জানা আর না আমার।’
‘আমি যদি নাকচ করে দেই?’
নাযীফাহ’র দিকে তাকিয়ে বিষন্ন হাসলো তাহমিদ। সেই হাসির অর্থ হলো, হয়তো আপনি আমার ভাগ্যে নেই।
‘আমি আপনার বাবাকেও বলেছি। আপনাকেও বলছি, নাযীফাহ হয়তো আরো ভালো কাউকে পাবে। কিন্তু তাহমিদের নাযীফাহকেই লাগবে। হয় নাযীফাহ আর নয়ত কাউকে না।’
নাযীফাহ চমৎকৃত চোখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাহমিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘আপনার ভাই কি অসুস্থ?’
‘না তো। কেন?
‘না কিছু না এমনি জিজ্ঞেস করলাম।’
বিদায় বেলা তাহমিদ খালেদ মোশাররফ কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আপনার কাছে আমার অনুরোধ আপনি দয়া করে বিয়ের ব্যপারটা কাউকে বলবেন না। বাকিরাও যেন না বলে। আপনারা চারজনের মাঝেই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। খুব কাছের কাউকেও না। আমাদের কথা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কিছু একটা বলে চালিয়ে দিয়েন।’
______________________________
ছুটি শেষে নাযীফাহ’র সাথে ঢাকা এসেছিলেন খালেদ মোশাররফ। তাহমিদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। আসার আগে ফাহমিদা বেগম এবং ফাহিম কে সাবধান করে এসেছেন এসব কথা যেন কাউকে না বলে। তারপর নাযীফাহ’র বাড়িওয়ালার সাহায্যে টানা তিন দিন তাহমিদের বাসার আশপাশ থেকে তাহমিদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়। নাযীফাহ’র এমডির সাথে কথা বলে তাহমিদ সম্পর্কে জেনে নেয়।
তেমন কেউ খা’রাপ বলেনি তাহমিদ সম্পর্কে। মোটামুটি সবাই ভালো তথ্যই দিয়েছে।
রাতের বেলা ছাদে বসে আছে বাপ বেটি। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আগামীকাল খালেদ মোশাররফ গ্রামে ফিরবেন। তিনি পশ্চিমাকাশে তাকালেন। মিটিমিটি করছে তারকা। দু-চোখে উনার অশ্রু টলমল করছে। কিন্তু অন্ধকারে বুঝা গেল। সেদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই সেই অশ্রু গাল স্পর্শ করলো। না এ দুঃখের অশ্রু না। মেয়ের একটা গতি হবে। সেই আনন্দের অশ্রু। অনেক সহ্য করেছে উনার মেয়ে। এবার যদি একটু সুখের মুখ দেখে।
উনি ফোন লাগালেন তাহমিদের নাম্বারে।
_________________________
সন্ধ্যায় ঢাকা এসে পৌঁছেছে ফয়সাল। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোজা তাহমিদদের বাসায় এসেছে। ফ্রেশ হয়ে হালকা খাবার খেয়ে বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। তূবা ফয়সালের জন্য রান্না করছে। ফয়সাল গল্পের ফাঁকে ফাঁকে তূবার দিকে তাকাচ্ছে। বউকে কাছে পাওয়ার জন্য নিশপিশ করছে। কিন্তু বউ তার মহা ব্যস্ত।
বিকট শব্দে তাহমিদের মোবাইল বেজে উঠলো। চমকে উঠে ফয়সাল। সবার আড়ালে বুকে থু থু দেয়।
তাহমিদ সালাম দিয়ে তার মায়ের কাছে দিল।
মনোয়ারা বেগম চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, কে?’
তাহমিদ স্বাভাবিক ভাবে বলল, ‘ নাযীফাহ’র বাবা।’
তাহমিদ রান্নাঘরে গিয়ে তূবাকে কিছু একটা বলতেই। মুচকি হেসে চুলার আঁচ কমিয়ে বসার ঘরে এলো। মনোয়ারা বেগম সাবলীলভাবে কথা বলছেন।
‘না ভাই আমাদের আর কোনো খুঁজ খবর নেওয়ার দরকার নেই। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বউ ঘরে তুলতে চাই। আগামী শুক্রবার হলে আরো ভালো হবে।’
ফোনের ওপাশ থেকে খালেদ মোশাররফ বললেন,
‘আমার একমাত্র মেয়ে। এভাবে সাদামাটা কিভাবে বিদায় দেই বলুন তো? তাছাড়া গ্রামে আমি দশজনের সাথে চলাফেরা করি তাদেরও তো বলতে হবে । আর আয়োজনেরও তো একটা ব্যপার আছে। একা হাতে কিভাবে সামলাবো আমি? পনেরো বিশ দিন সময় পেলে ভালো ছিল।’
ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নাযীফাহ। বাবার বলা প্রতিটা কথাই সে শুনছে। সে মিশ্র অনুভূতি অনুভব করছে। হালকা ভয় আর হালকা সুখ। অবশেষে তারও একটা সংসার হবে। বহু বছর আগে যাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়ে ছিল ঠিক তারই সাথে।
মনোয়ারা বেগম বলেন,
‘আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। আমি দেরি করতে চাইছি না কারণ দেরি করলেই কেউ সেই সুযোগের ফয়দা লুটবে। আমরা বিয়ের পরও অনুষ্ঠান করতে পারবো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি ভেবে দেখছি।’
বলেই কল কে’টে দিলেন খালেদ মোশাররফ।
‘কি শা লা বাবু কয়দিন পর তো ম্যারিড ট্যাগ লাগাবা শরীরে। বুঝবে বউ কি জিনিস। বউ সাথে থাকলে কয়দিনে বছর যায়।’ কথা শেষ করেই তূবার দিকে। তূবা আগুন লাল চোখে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে আছে। তূবার দিকে তাকিয়ে ফয়সাল শুকনো ঢুক গিলে।
‘আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছে ফয়সাল ভাই। আমার রুমে আসবেন?’
_______________________
‘এটা কি করে সম্ভব তাহমিদ? আর তোমার হবু শ্বশুরই বা কি বলবে। কে না কে গিয়ে সব খবরদারি করছে।’
‘উনাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।উনাকে আমি সামলে নিবো। উনি মেয়ের কথা চিন্তা করে হলেও রাজি হবেন। আপনি না করবেন না প্লিজ। আপনাকে তো সবই বললাম। আপনি যদি ওখানে গিয়ে খোঁজ খবর নেন বা আশেপাশে নজর রাখেন কেউ ধারণাও করতে পারবে না। আপনারও কাজটা সহজ হবে। আমি শুধু মানুষটাকে চিনতে চাই।’
‘মেয়েটাকে বুঝি খুব ভালোবাসো?’
‘তা জানি না। কিন্তু পাশে থাকলে কেমন জানি সুখ সুখ অনুভব হয়।’
আবারও তাহমিদের ফোন বেজে উঠলো। এবারেও খালেদ মোশাররফ ফোন করেছেন। তাহমিদ রিসিভ করতেই উনি বললেন,
‘তোমার আশেপাশে কেউ আছে?’
তাহমিদ না বলতেই উনি পুনশ্চ বললেন,
‘তখন নাযীফাহ সামনে থাকায় কিছু বলতে পারেনি। আমার মেয়ের কেন বিয়ে হচ্ছে না বা কেন বিয়ে ভাঙছে সেসব বিষয়ে হয়তো জানো। বিয়ের ব্যপারটা জানাজানি হয়ে গেলে হয়তো তোমার কাছেও কোনো নেতিবাচক খবর যাবে। আগে আগেই জেনে নিচ্ছি তোমার কি মতামত? পরে কিন্তু আমার মেয়েটাকে অপমান করো না।’
তাহমিদ অধর প্রসারিত করে বলল,
‘আমি বেশি কিছু বলবো না শুধু এতটুকুই বলবো আমার নাযীফাহকেই লাগবে।’
মনে মনে খালেদ মোশাররফ ‘আলহামদুলিল্লাহ’
বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।
‘তবে আপনার কাছে আমার একটা আবদার আছে। বিয়েটা আমি এই শুক্রবারের মাঝেই করতে চাই।’
‘কিন্তু আমি একা হাতে সব সামলাবো কি করে? আমার ছেলেটাও তো ছোট।’
‘আপনি যদি অনুমতি দেন তো আমার বোনের স্বামী আপনাদের বাড়ি যাবে। বিয়ের সকল খরচে আপনাকে সাহায্য করবে।’
‘দেখ বাবা, ছেলেপক্ষ থেকে কেউ একজন এসে আমাকে সাহায্য করছে ব্যপারটা দৃষ্টি কটু না?’
‘ছেলে মনে করে আমাকে একটু ভরসা করেন। ইনশাআল্লাহ নিরাশ হবেন না। হয়তো খুব বড় কারন আছে। আপতত বলছি না। আগে চোর ধরি তারপর বলবো। আমি রিস্ক নিতে চাই না।’
______________________
বধূ বেশে তাহমিদের রুমে বসে নাযীফাহ। বসে থাকতে থাকতে তার কোমড় ব্যথা করছে। এতক্ষণ চোখ বুলিয়ে সে তাহমিদ রুম দেখছিল। বেশ পরিপাটি। দরজা খোলার আওয়াজে গুটিয়ে বসে সে। তাহমিদ এসেছে।
নাযীফাহ’র মুখোমুখি বসে সে। মেহেদি রাঙা হাত দুটো ধরল তাহমিদ। শিউরে ওঠে নাযীফাহ। তবে মাথা তুলে তাকাল না। নতজানু হয়ে বসে থাকা নাযীফাহ’র দিকে তাহমিদ অপলক, অনিমেষ তাকিয়ে রইল। বহু দিনের চোখের তৃষ্ণা মিটাতে ব্যস্ত সে। আচমকাই তাহমিদ বলে উঠলো,
‘আই ওয়ান্ট টু কিস ইউর ফরহেড।’
এবারে নাযীফাহ মাথা উঁচিয়ে তাহমিদের চোখের দিকে তাকাল। চোখ জোড়ায় হাজারো আকুলতা। না এই তৃষ্ণার্ত চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবে না। সে তলিয়ে যাবে অতলে। তাহমিদ পুনশ্চ বলল,
‘ক্যান আই?’
#চলবে