না_চাইলেও_তুমি_আমার পর্ব-০২

0
3176

#না_চাইলেও_তুমি_আমার
পর্বঃ ০২
জাহান আরা

রুমের দরজা বন্ধ করে বসে আছে রাত্রি,মনে মনে চন্দ্রকে ১০১ টা গালাগাল দিচ্ছে।সকালে বের হয়েছে এখনো ফিরে নি,ওদিকে মিথ্যে বলতে বলতে রাত্রির চাপা ব্যথা হয়ে গেছে।

বাহিরে তোড়জোড় চলছে, আজ রাত্রি কে দেখতে আসবে।রাত্রির ভীষণ মন খারাপ।
বাহির থেকে রাত্রির ভাবী সুরমা এসে দরজায় নক করছে কিছুক্ষণ পর পর।

কলিংবেলের শব্দ শুনে রাবু এসে দরজা খুলে দিলো,বাসায় এসে চন্দ্র নিজেও খানিকটা অবাক।
এই সাজসাজ রব কেনো বাসায়,উত্তরার খালা ও চলে এসেছে,রান্না ঘরে রান্না হচ্ছে।
বাবা ভাইয়া কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।
এটাই সুযোগ চন্দ্র বুঝতে পারে।

রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চন্দ্র গলা নিঁচু করে ডাকে,”আপা-আপা রে”

রাত্রি এসে দরজা খুলে দেয়। রাত্রির চোখ লাল হয়ে গেছে।
চন্দ্র বুঝতে পারছে না কি হয়েছে রত্রির,এমন দেখাচ্ছে কেনো রাত্রিকে।চন্দ্রর হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে আবার।
হঠাৎ করেই চন্দ্রর মনে হলো,রাত্রি বুঝি জেনে গেছে চন্দ্রর বিয়ে হয়ে গেছে, তার জন্য কাঁদছে।

নিজের অস্থিরতা চেপে রেখে শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”আপা,কি হয়েছে?”

“ভাইয়া আমাকে এবার সত্যি বিয়ে দিয়ে তাড়িয়ে দিবে রে চন্দ্র,আজকে আমাকে দেখতে আসছে ছেলেপক্ষ”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচে চন্দ্র যেনো।

“তো দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায় না-কি?
এতো কান্নার কি মানে?”

“তুই জানিস কে আসবে দেখতে আমাকে?”

“কে?”

“নিশান ভাই,ভাইয়ার সেই বন্ধু”
নিশান ভাইয়ের নাম শুনে চন্দ্র নিজেও থমকে যায়,তাহলে এবার আপার বিয়ে নিশ্চিত।

ভাইয়া সবসময়ই বলতো নিশান ভাইয়ের মতো একটা ছেলের সাথে যদি আপার বিয়ে দিতে পারতো।নিশান ভাইয়ের মতো না-কি ছেলেই হয় না।

আইসক্রিমের বক্স নিয়ে চন্দ্র রাত্রির সামনে রাখে,রাত্রি ফিরেও তাকায় না সেদিকে।

দরজা খোলা দেখে সুরমা এসে রুমে ঢুকে,সাইড টেবিলে আইসক্রিমের বক্স অথচ ২বোন উদাসীন হয়ে বসে আছে,বিষয় টা নিতে পারছে না সুরমা।
নিজের ২ ননদকে ভালো করেই চেনা আছে সুরমার,আইসক্রিমের উপর এরা যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর দিন,আর আজ কেউই তাকাচ্ছে না।

হয়েছে কি এদের!

“রাত্রি,চন্দ্র”

২বোন সুরমার দিকে তাকায়। ২বোনের চোখে টলমল করছে অশ্রু।সুরমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। ওরা কাঁদছে কেনো?
বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরমা,মা না থাকলে বুঝি এরকমই হয় ঘরে।

রাত্রি কে ঠেলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলো সুরমা।পাত্রপক্ষ আসার সময় হয়ে এসেছে,অথচ রাত্রি এখনো গোসল করছে না।ভালো করে গায়ে বাথসল্ট লাগাতে বলে,তারপর সাবান।

রাত্রি নীল তাঁতের শাড়ি পরেছে,চুলগুলো খোঁপা করা,খোঁপায় কাঠগোলাপের গাঁজরা,ঠোঁটে ন্যুড কালার লিপস্টিক,হাতে ২গাছি সোনার চুড়ি,কানে ঝুমকা,গলায় চিকন একটা চেইন।
রাত্রিকে অপ্সরার মতো লাগছে।

চন্দ্র অবাক হয়ে দেখছে রাত্রি কে।
চন্দ্রকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাত্রি যেনো লজ্জা পেলো।

“ভাবী তুমি এতো সুন্দর করে সাজাতে পারো?
আপাকে তো তুমি পুরো পরী বানিয়ে দিলে”

“ভেবো না চন্দ্র,তোমার বিয়ের দিন তোমাকেও আমি নিজের হাতে সাজিয়ে দিবো,দেবীর মতো লাগবে তোমাকে সেদিন। ”

চন্দ্রর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ভাবীর কথা শুনে।
তার বিয়ে!!
সে তো আজই হয়ে গেলো।
উফফ!
কি যন্ত্রণাদায়ক সেই স্মৃতি!
চন্দ্রর আবারও হার্টবিট বেড়ে যায় ভাবতেই।নিষাদের সেই রক্তলাল চোখের দৃষ্টি!
নিজের অজান্তেই চোখের কোন ভিজে উঠে।

রাত্রি লক্ষ্য করে তা।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”কাঁদছিস কেনো চন্দ্র,কি হয়েছে তোর?”

“কিছু না আপা”

“বল আমাকে,কি হয়েছে?”

“তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না আপা,আমার খুব কষ্ট হবে”

চন্দ্রর মিথ্যে কথা রাত্রি ধরতে পারলো না,রাত্রির ও চোখ ভিজে এলো।

সুরমার ধমক শুনে ২বোন চোখ মুছে নিলো টিস্যু দিয়ে,আবার কাঁদলে খুব খারাপ হবে বলে ধমক দিয়ে সুরমা বের হয়ে যায়,কিচেনে কতোদূর কাজ হলো তার তদারক করতে বের হয়ে যায় সুরমা।

ডিভানে শুয়ে আছে নিষাদ,হাত থেকে রক্ত পড়তে পড়তে জমাট বেঁধে শুকিয়ে যায় রক্ত।সেদিকে কোনো খেয়াল নেই নিষাদের।
সাদেক আলী কয়েকবার গজ,তুলো,ডেটল নিয়ে দরজার বাহিরে ঘুরঘুর করে গেছে,কিন্তু ভয়ে ভিতরে ঢুকতে পারে নি।

টেবিলের উপর ফোন বেজে চলেছে ক্রমাগত,নিষাদ ফোন ধরছে না।
বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ পর উঠে ফোন অফ করে রাখে।

“মারিয়া তখন বললো যে নিষাদ ভাই তাকে ভালোবাসা দিবসের উইশ করেছে কিন্তু সুন্দরবন দিবসের উইশ করে নি,কাঁদতে কাঁদতে আমার ২বক্স টিস্যু শেষ করলো মারিয়া, ৩য় বক্সের দিকে হাত বাড়ানোর আগেই আমি নিষাদ ভাইকে ভিডিও করে পাঠালাম মারিয়ার কান্নাকাটি।

২ ঘন্টার মধ্যে নিষাদ ভাই হোস্টেলের সামনে আসে নানারকম ফুল,ফল,ভেষজ,কাঠ গাছ নিয়ে।সম্ভব যদি হতো তবে উনি বাঘ,সিংহ,হাতি,ঘোড়া,সুন্দরী,গরান,গেওয়া গাছ নিয়ে আসতো।”

চন্দ্রর কথা শুনে রাত্রি বিছানা থেকে উঠে খিলখিল করে হেসে উঠে।

“মানে আপা,বিশ্বাস করবি না,মা দিবস,বাবা দিবস,রোজ ডে,কিস ডে,হাগ ডে,প্রাক্তন দিবস থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস দিবস,রক্তচাপ দিবস,শিশু দিবসে ও নিষাদ ভাই উইশ করতো মারিয়া কে,নয়তো মারিয়ার সে কি রাগ হতো আপা।”

“এসব কেমন ন্যাকামি?
তোর নিষাদ ভাই ও কি এরকম ন্যাকা না-কি?
পুরুষ মানুষের থাকবে স্ট্রং পার্সোনালিটি ”

“মারিয়া একটু ন্যাকা টাইপের,তবে নিষাদ ভাই তেমন ন্যাকা না,কিন্তু মারিয়া কে উনি হার্ট করতেন না,নিজের অপছন্দের কাজ করলেও ধীরেসুস্থে বুঝাতেন মারিয়া কে,বুঝলে খুশি হতেন,না বুঝলে কষ্ট পেতেন কিন্তু নিজের কষ্ট মারিয়ার কাছে প্রকাশ করতে দেখি নি কখনো।
নিষাদ ভাই মানিয়ে নিয়েছিলো ওর সাথে নিজেকে, বলে না,যারে ভাল্লাগে সে গলায় পাড়া দিয়ে ধরলেও ভালো লাগে”

ভোর হতেই চন্দ্র রেডি হয়ে কাজী অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়,মারিয়া কল দিয়ে জানায় মারিয়া ও বের হবে এখন।

কাজী অফিসে পোঁছে দেখে নিষাদ ও তার বন্ধুরা চলে এসেছে। চন্দ্রকে আইসক্রিম এনে দেয় নিষাদ,অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ও যখন মারিয়া আসে না নিষাদ অস্থির হয়ে উঠে।

বারবার কল দেয় কিন্তু নাম্বার ব্যস্ত।পলাশ বলে মারিয়া নিষাদের নাম্বার ব্লাকলিস্টে দিয়েছে তাই নাম্বার ব্যস্ত বলছে।
পলাশের কথা বিশ্বাস করে না নিষাদ।

চন্দ্রর কাছে গিয়ে বলে কল দিতে মারিয়া কে।চন্দ্র মারিয়া কে কল দেয়,রিং হয় কিন্তু মারিয়া রিসিভ করে না কল।

নিষাদের ফর্সা মুখে কালো মেঘ জমে মুহূর্তে। টুং করে চন্দ্রর ফোনে মেসেজ আসে,জীবনের অন্যতম বড় ভুল চন্দ্র তখনই করে নিষাদকে মেসেজ দেখিয়ে।

“চন্দ্র,আমি আসতে পারবো না রে,তুই চলে যা বাসায়। তুই ঠিকই বলেছিস,বাবা মা’র মনে কষ্ট দেওয়া ঠিক না এভাবে,এতোদিন বুঝি নি,কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমি ভুল করতে যাচ্ছি, তাই আমি যাবো না।
আর শুন,আজ আমার বিয়ে,ছেলে আমেরিকা থাকে, আমাকেও আমেরিকা নিয়ে যাবে,ওর গ্রীন কার্ড আছে।
নিষাদের কি আছে?
ও তো একটা চাকরি করে মাত্র,ও কি কখনো আমাকে আমেরিকা নিয়ে রাখতে পারবে না-কি। ওর চাইতে ভালো পাত্র পেয়েছি আমি,তাই বিয়ে করে নিচ্ছি,তুই নিষাদকে কিছু না বলে চলে যা বাসায়,সন্ধ্যায় আমার বিয়ে”

মেসেজ পড়ে নিষাদের ২চোখ রক্তলাল হয়ে যায়,চন্দ্রর সামনে বসে চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে।

চন্দ্রর গা কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর নিষাদ চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে,”মারিয়ার বিয়ে কবে?”

“আজকে”

“ফাইন,আমি ও আজকেই বিয়ে করবো,ওর আগে আমি বিয়ে করবো”

“আ-আ-আজকেই বিয়ে করবেন?
পা-পা-পাত্রী পাবেন কই?”

“কেনো,পাত্রী তুমি হবে,তোমাকেই বিয়ে করবো”

মুহূর্তের জন্য চন্দ্র স্তব্ধ হয়ে যায়,তারপর চিৎকার করে উঠে।

“চন্দ্র,চিৎকার করো না,আমি তোমাকেই বিয়ে করবো”

দৌড়ে বের হয়ে যেতে নেয় চন্দ্র,তার আগেই পলাশ,লিমন এসে সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। চোখে অন্ধকার দেখে চন্দ্র।

বুঝতে পারে উপায় নাই তার।

বিয়ে হয়ে যায় যেনো কখন চন্দ্র জানেও না।কি এক ঘোরে ছিলো চন্দ্র তখন যেনো।শুধু জানে সে হেরে গেছে,ভীষনভাবে হেরে গেছে সে।
আবার মনে হচ্ছে আসলেই কি হেরে গেছে?

বাহিরে থেকে সুরমার গলা ভেসে আসে,পাত্রপক্ষ এসেছে,রাত্রিকে নিয়ে যেতে হবে চন্দ্রর।
ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে চন্দ্র।

চলবে???