১৫শ পর্বের পর থেকেঃ-
”নিরব সে”
#সাদিয়া_সৃষ্টি
১৬শ পর্ব
রাউন্ড থেকে ফিরে এসে ওয়াফিফ নিজের কেবিনে ঢুকল। নিজের সাদা এপ্রোন টা চেয়ারে রেখে গলা থেকে স্টেথোস্কোপ টা নামিয়ে টেবিলের উপর রাখল। তখন চোখ পড়ল টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে। ফোনের উপরে নোটিফিকেশনের আলো জ্বলছে, নিভছে। ফোন অন করলে হয়তো মিসড কলের ম্যাসেজ ও পাবে। ওর মা বার বার বলে দিয়েছিল যাতে পারলে বাড়ি ফিরে আসে আর মামার সাথে দেখা করে যায়। কিন্তু ওয়াফিফ প্রতিবারের মতো এড়িয়ে যেতে চায়। ও জানে, ওর মামা আজ রাতে সেখানে থাকবেন। তাই ও ভেবে রেখেছে সব কাজ শেষ করে একেবারে বাড়ি ফিরবে। কাজ ফেলে রেখে সে বাড়ি ফিরবে না। এতে করে ততক্ষনে মামারা ঘুমিয়ে পড়বে। আর দেখা হলে হবে সোজা সকালে। ওয়াফিফ যে আত্মীয় সামলাতে পারে না, এমনটা না। সবার সাথে ওর ভালোই মেলামেশা আছে। কিন্তু ও মুখোমুখি হতে চায় না। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছা থেকেই। এই ইচ্ছার আলাদা কোন কারণ নেই। শুধু চায় না তাই এসব ফ্যামিলি গ্যাদারিং এড়িয়ে চলে। না চাইতেও ফোন অন করে দেখল। মায়ের মিসড কল। জানা কথা। তাও একটা ম্যাসেজ পাঠাল,
”আমি হাসপাতালে আছি, বাড়ি ফিরে দেখা করব একেবারে।”
লিখেই পাঠিয়ে দিল তার ক্ষুদে বার্তা। তারপর ফোন বন্ধ করে নিজের কেবিনে থাকা বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। এক হাত বুকে আর এক হাত কপালে রেখে নিজের চোখ ঢেকে। আর ভাবতে থাকল তার জীবনটা সত্যিই যদি পরিকল্পনা অনুসারে হত তাহলে কেমন হত? জিনিয়ার জায়গায় হয়তো অন্য কেই থাকত, তার জীবনটাই একেবারে অন্য রকম হত। এতো বছরে হয়তো তারও একটা সন্তান থাকত। এমন হাজার চিন্তা এসে জমা হল তার মস্তিষ্কে। আর সাথে সাথে চোখে জড়ো হল ঘুম। কিন্তু তন্দ্রায় থাকা অবস্থায় ডাক পড়ল এক নার্সের।
–ড. রহমান, রুম নং *** এর পেশেন্ট এর অবস্থা দেখতে বলেছেন ড. রায়।
–ওকে আমি আসছি।
ভেতর থেকেই জবাব দিল ওয়াফিফ। ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে সেটা নিতে গিয়েও নিল না। নিজের এপ্রোন পরতে পরতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
।
জিনিয়া নিজের ঘরে বসেই ভাবছে আজ ভেবেছিল মামা আসায় ওয়াফিফ ও দ্রুত বাড়ি ফিরবে। আর তার সাথে কথা বলাও হয়ে যাবে। জাবিরের কথা জানাতে চায় সে। অন্তত জাবিরের বাহানায় হোক, তাও ওয়াফিফের সাথে ১ বার তো কথা হোক। আজকাল তো কথাই হয় না। ডাক্তার সাহেব ব্যস্ত মানুষ। তার থেকে ব্যস্ত মানুষ যেন পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে। কিন্তু ওয়াফিফের কথা না বলার কারণ কি? কোন কারণে ওয়াফিফ এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? হাসপাতালের কাজে? জিনিয়ার ইচ্ছা করছে ওয়াফিফের হাসপাতালের মালিক নিজে হয়ে ওয়াফিফকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে। কিন্তু না পারছে সে মালিক হতে, আর না পারছে ওয়াফিফ এর চাকরি খেতে।
নিজের মাথায় নিজের হাত দিয়ে হালকা মারল জিনিয়া। আজকাল ও কি সব ভাবতে শুরু করেছে। এই জিনিয়া আগে পেটে বোম ফাটালেও কথা বের করা যেত না। সে আজকাল ওয়াফিফের জন্য নিজের মনে হাজার চিন্তা করে। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে কথা বলে। নিজের পরিবর্তনে নিজের হতবাক। ওয়াফিফের চাকরি খাওয়ার কথা ভাবছে সে। ভাবতেই নিজে নিজেই হাসা শুরু করল। আচ্ছা, এমন হলে কি হত না যে জিনিয়াও ডাক্তার। তাহলে ওয়াফিফের সাথে একই হাসপাতালে কাজ করত আর যখন ইচ্ছা, তখন দেখা করতে পারতো। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। সে তো আর্টস নিয়ে পড়াশোনা করেছে। ডাক্তার হওয়া থেকে হাজার মাইল দূরে সে। হতাশার সুরেই কথাটা মনে মনে আওড়াল সে।
ওয়াফিফের কথা ভাবতে ভাবতে জিনিয়া জাবিরের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছে। এমনটা হয় তার সাথে প্রায়ই। ওয়াফিফের চিন্তায় এতই মগ্ন থাকে যে সব কিছুই ভুলে যায় যেন। তবে ওয়াফিফকে নিয়েই ভাবতে বেশ ভালো লাগে তার। কখন সময় কেটে যায় , বোঝাই যায় না। ওয়াফিফের প্রতিটা কাজ সম্পর্কে বারবার ভাবে। যেন সে ”ওয়াফিফ” নামক বইটা মুখস্ত করছে।
।
ওয়াফিফ বাড়ি ফিরে দেখল আজও লাইট বন্ধ সব ঘরের। সে সাবধানে দরজা বন্ধ করল যাতে শব্দ না হয়। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই দ্রুত নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। গিয়েই আগে নিজের দৃষ্টি জানালাতে আটকাল। জিনিয়াকে না পেয়ে আশেপাশে চোখ বুলাল। লাইট জ্বালাতেই নিজের বিছানায় জিনিয়াকে আবার ঘুমন্ত অবস্থায় পেল। শান্ত হল সে। আগেরবার জিনিয়া জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছিল। সেই চিন্তায় এতো দ্রুত নিজের রুমে আসা ওয়াফিফের। জিনিয়ার দিকে তাকাতেই তার মনে পড়ল আজ জিনিয়া তাকে প্রথমবার ফোন করেছিল। বিয়ের পর ৩ মাসে ১ম। তার এখন অদ্ভুত এক ইচ্ছে হল। জিনিয়ার কল দেওয়ার ছবি প্রিন্ট করে নিজের ঘরে ঝুলিয়ে রাখার। তাছাড়া একটা রেকর্ডিং থাকলে বেশি ভালো হত। কিন্তু রেকর্ড করা হয় নি। ছবি প্রিন্ট করার বিষয়টা সম্পর্কে পরে ভাবা যাবে এই ভেবে সে ফ্রেশ হয়ে নিল। খাওয়া দাওয়া করে একেবারে এদিক ওদিক না তাকিয়ে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিল। সারাদিন সে দাঁড়িয়ে ছিল আর নাহয় বসে ছিল। তাই এতক্ষণ ক্লান্তি টের পায় নি। বিছানায় শুতেই পিঠে ব্যথা চাড়া দিয়ে উঠল। সারাদিনের ব্যথা এক বারে আঘাত করল তাকে যেন। সে ব্যথা কমাতে পাশ ফিরতেই জিনিয়ার মুখ নজরে পড়ল। কিছু চুল তার মুখের উপর এসে পড়েছে। ঘুমের ঘোরেই হয়তো ফুঁ দিয়ে চুল সরানোর চেষ্টা করছে আর ব্যর্থ হয়ে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলছে। ওয়াফিফের খেয়াল হল এই কয়দিন কাজের চাপে জিনিয়া আর বাকি সবার সাথে কথাই বলা হয় নি। বিশেষ করে জিনিয়ার সাথে কথার ‘ক’ বলাও হয় নি। অন্যদের সাথে হলেও। আর তখন সাথে সাথে মাথায় এলো জিনিয়ার ফোন দেওয়ার কথা। তাহলে জিনিয়া কি এজন্যই সাহস করে ওয়াফিফকে কল করেছিল তখন? ভাবতেই মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল। তবে বেশি সময় না যেতেই আবার চিন্তা ভর করল সেখানে। জিনিয়া কি ভাবছে যে ওয়াফিফ অন্য কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে? না কি এমন ও ভাবতে পারে ও জিনিয়াকে ইগনোর করছে? এমন ভাবতে তো তার সংসার ভাঙবে।
ভাবতেই এক লাফে বিছানায় শোয়া থেকে বসে পড়ল। আর এক হাত মাথায়। এখন কি তার সংসার ৩ মাস ও টিকবে না?
”বউয়ের সাথে ৩ মাসের মাথায় কোন কথা না হওয়ায় স্ত্রী ডিভোর্স ফাইল করেছেন”
শিরোনাম টা মাথায় আসতেই নিজেকে গালি দিতে ইচ্ছে করল তার।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার খেয়াল হল যে সে কি পরিমাণে বাচ্চামো করছে এই রাতবিরাতে। মাঝ রাতে সে নিজের ঘুম কে বলি দিয়ে কি না একটা ফালতু কথা ভাবছে? ভাবতেই নিজেকে আরও ২ দফা বকাবকি করল মনে মনে। কয়েক বার মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তা ত্যাগ করল।
নিজের মাথা থেকে সব আজগুবি চিন্তা বের করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল। তখন আবার জিনিয়ার মুখের দিকে চোখ পড়তেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেল জিনিয়ার মখে তখনও বিরক্তির ছোঁয়া লেগে আছে। সে কিছুক্ষণ ভেবে জিনিয়ার কপালের সামনে থাকা ছোট চুলগুলো দেখে মাথা থেকে এর কিছু ছোট চুল সাবধানে টেনে বের করল। তারপর মুখের উপর রেখে দিল। আবার সেই চুল গুলো ধরে জিনিয়ার মুখের সামনে নাড়াল কিছুক্ষণ। এতে জিনিয়ার ঘুম না ভাঙলেও বিরক্তির মাত্রা দ্বিগুণ হল। এবার ওয়াফিফ জিনিয়াকে আর না জ্বালিয়ে সেই চুলগুলো সরিয়ে দিল। জিনিয়া মুখে তখন এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল ঠিকই। কিন্তু ওয়াফিফের বোঝার আগেই জিনিয়া ওয়াফিফের হাত ধরে সেখানে এক কামড় বসিয়ে দিল 🙂 ।
ওয়াফিফ চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। কিছুক্ষণ ভেবেও এই কামড়ের কুল কিনারা না পেয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। আরও কিছুক্ষন গয়েন্দাগিরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু সারাদিনের ক্লান্তি তাকে চোখ খুলে রাখতে দিল না আর।
।
সকালে ঘুম ভাঙতেই জিনিয়ার ঘুমন্ত মুখ দেখল ওয়াফিফ কিন্তু রাতেই কথা মনে পড়তেই আর সেই মুখ দেখতে ইচ্ছে হল না তার। বিনা অপরাধে কামড় খেয়েছে সে। কি করে চুপ থাকতে পারে? এতটাই সহজ?
সে জিনিয়াকে জাগিয়ে দিল। জিনিয়া নিজের হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই নিজের এতো কাছে ওয়াফিফের মুখ দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠল। আর সাথে কেপেও উঠল। জিনিয়া কেঁপে উঠা দেখে ওয়াফিফ নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে সাথে সাথে জিনিয়ার উপর পড়তে নিলে নিজেই সরে গিয়ে খাটের নিচে পড়ে গেল। তখনও তার মাথায় চলছে জিনিয়ার ব্যথা লাগে নি তো? তার পেটে চাপ লাগে নি তো। সে নিজে কোন মতে উঠে জিনিয়াকে দেখতে লাগল সব ঠিক আছে কি না। জিনিয়া ওয়াফিফের এহেন কাজে বোকা বনে গেল। আসলে কি হচ্ছে সকাল সকাল?
জিনিয়া ঠিক আছে দেখে সে আবার জিজ্ঞেস করল,
-তুমি ঠিক আছো তো জিনিয়া, কোথাও লাগে নি তো? ব্যথা করছে না তো? করলে আমাকে বল। কি হল কথা বলছ না কেন?
–লাগে নি আমার। আপনি এখানে কিভাবে? কখন এলেন?
–সেটা বড় কথা না , আগে বল কাল রাতে কি তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে?
–জ্বি , দেখেছি। আপনি জানলেন কি করে?
–কি দেখেছিলে আগে সেটা বল।
–ওহ, কাল রাতে দেখলাম আমি … আমি আমার বাড়ি গিয়েছি, সেখানে আমার এখাতে মেহেদি দেওয়া আর আরেক হাত দিয়ে আমি খাচ্ছি। বারবার চুল উড়ে এসে মুখের উপর পড়ছিল। হঠাৎ করে একটা চিকেন লেগপিস নিয়ে যেই না কামড় দিয়েছি, সাথে সাথে আমার একটা দাঁত ভেঙে গিয়েছে।
–কি?
–হ্যাঁ তো, তারপর আপনিই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন, আর বার বার বলছিলেন যে তোমার মুরগি খাওয়া বন্ধ, একেবারে দাতের ব্যবহার হবে এমন খাবার খাওয়া বন্ধ, তারপর শুধু সুপ খেতে দিবেন আমাকে। কত বকেছিলেন আপনি। স্বপ্নেও বোকা দিয়েছেন আমায়।
বলেই মুখ লটকাল জিনিয়া। জিনিয়া মুখ দেখে ওয়াফিফ সাথে সাথে বলে উঠল,
–আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি কিছু বন্ধ করব না, আর বকাও দিব না। দরকার হলে আজই তোমাকে মুরগি খাওয়াবো, রান্না না করেই। ঠিক আছে?
–আপনি কি আমাকে আদিম কালের মানুষ পেয়েছেন যে রান্না না করেই খাওয়াবেন?
–আচ্ছা, ঠিক আছে রান্না করাই খাওয়াবো।
–ঠিক আছে, আমি এখন যাই।
বলেই জিনিয়া উঠে সেখান থেকে চলে গেল বাথরুমে। ওয়াফিফের মাথায় আসতেই সে আবার নিজেকে কয়েক দফা বকল। জিনিয়ার উপর কোথায় রাগ দেখাবে বলে আসলো। শেষে নিজেই কি না ভুলে গেল রাগ দেখানোর কথা? তখন জিনিয়ার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল একটা বাচ্চা ওর উপর রাগ করেছে। এটা দেখে নিজের রাগের কথাই ভুলে গিয়েছিল সে। বাচ্চা একটা। কিছুদিন পর নিজেই বাচ্চার মা হবে কি না সন্দেহ ।
ওয়াফিফ নিজে ফ্রেশ হয়ে জখন খেতে বের হল তখন নিজের মামা মামীকেও দেখল। তাদের সাথে কথা বলায় লেগে পড়ল সে।
চলবে।
[রিচেক করি নি, ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ]
Sadia Hq Sr.