নেশাক্ত ভালোবাসা ২ পর্ব-৩৮+৩৯

0
1438

#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#Season_2
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৮

প্রায় দেড় ঘন্টা পর কনফারেন্স শেষ হয়। এর মাঝেই আব্রাহাম কোহিনূরের যাবতীয় সব বিষয়-বস্তু ক্লিয়ার করে বলে দিয়েছে। সবাই কেমন এক দোটানার মাঝে ছিলো যে কোহিনূর যদি এখানে থেকে থাকে তাহলে চুরি হওয়ার ব্যাপার টা কি তবে মিথ্যে! কিন্তু এতো বড়ো একটা মিথ্যে কেনোই বা এভাবে কেউ ছড়াবে। আব্রাহাম প্রেজেন্টেশন টাই করেছে এমন যে সেটা আসল মানতে বাধ্য সবাই। অবশেষে আব্রাহাম মুখ ফুটে এও বলে দেয় যে কোহিনূর কখনো চুরিই হয় নি। মিটিং শেষে আব্রাহাম রুম থেকে বের হয়ে পরে। বাইরে আসতেই একঝাক মিডিয়ার লোক তাকে ঘিরে ফেলে। তবে গার্ডরা বাকিসব সামলায়। আব্রাহামের চোখে তায়াফ কে পরলেও সে যেনো তাকে এড়িয়ে চোখে গ্লাস পরে গাড়িতে উঠে পরে। এদিকে তায়াফের দৃঢ় বিশ্বাস যে কিছু তো একটা গন্ডগোল আছেই। কেননা সে এতো চালাকি করে এতো ছলচাতুরি করে কোহিনূর চুরি করেছে। আর এখন কিনা এটাই নকল। প্রশ্নই আসে না। কোহিনূর মূলত যেখানে থাকে অর্থাৎ এটাকে যে জায়গায় হাজারো গার্ড+সেইফটি দিয়ে যেই প্যালেসে রেখে দেওয়া হয়েছে সেখানে থাকবে নকল কোহিনূর। এটা অসম্ভব। আর তায়াফের কাছে যদি আসল কোহিনূর টাই থাকে তাহলে আব্রাহামের কাছে এলো কি করে! আর আব্রাহাম এতো বড়ো একজন ব্যাক্তি হয়ে ভুয়া খবর এভাবে পাবলিক করবে প্রশ্নই আসে না। তায়াফ সেখান থেকে এক প্রকার গা ঢাকা দিয়েই এসে পরে। বাইরে রিসোর্টের দিক টায় এসে পরলে ফোন বের করে দ্রুত আতিকের নাম্বারে ডায়াল করে। ফোন বাজছে তবে ধরে না। ফোন দিতে দিতে এক সময় ফোন বন্ধই দেখানো শুরু করলো। রাগের মাত্রা বাইরে চলে গেলে তায়াফ ফোন টা তুলে দেয় এক আছাড় মেরে ভেঙে। তায়াফের নিজের রুমে চলে যায়। সে যেনো আর এক মূহুর্তের জন্যও শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারছে না। এটা তো আমেরিকা, রাশিয়ান কিছু নামিদামি লোকের কাছে তায়াফের এই হীরে দিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো। অর্থাৎ তাদের হাতে চালান করে দিয়ে এক মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে চাইছিলো সে। সে চাইছিলো যত দ্রুত সম্ভব এই হীরে তাদের হাতে তুলে দিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে খুব শীঘ্রই এখান থেকে দূর কোথাও পালিয়ে যাবে। ধরা একবার খেলে মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত। কিন্তু এখন সেটাও করতে পারছে না স্পেশালি আজ আব্রাহামের এই মিটিং এর পর থেকে। রাশিয়া থেকে তায়াফের কাছে অনেক কলও এসেছে কিন্তু একটাও সে আর রিসিভ করে নি। রুমে গিয়ে ল্যান্ডলাইন থেকে তায়াফের আরো বাকি কিছু চেনা-পরিচিত মানুষের কাছে ফোন দেয়।

তায়াফ;; হ্যালো।

— আপনি?

তায়াফ;; আব্রাহাম চৌধুরীর লাইভ দেখেছেন আজকে?

— দেখলাম।

তায়াফ;; কি হচ্ছে কি এইসব? কোহিনূর আব্রাহাম চৌধুরীর কাছে কীভাবে এলো?

— ওয়াহহহ, চোরের মায়ের দেখি আসলেই বড়ো গলা।

তায়াফ;; মুখ সামলে।

— দেখুন মিস্টার খান, কোহিনূর চুরি করলেন আপনি তাহলে খুব স্বাভাবিক সেটা আপনার কাছেই থাকবে। আব্রাহাম আহমেদ চৌধুরীর হাতে কি করে গেলো কীভাবে গেলো তা আমরা কি করে জানবো? আর আদৌ কি আপনি কাজটা ঠিক করে করতে পেরেছিলেন বলুন তো! কোহিনূর কি আসলেই আপনি ওই প্যালেস থেকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন নাকি সব সেইফটি আর গার্ড দেখে দৌড়ে পালিয়ে ভেগেছিলেন কোনটা!?

তায়াফ;; মোটেও না কিন্তু কোহিনূর আমার কাছেই আছে।

— কে জানে সেটা আসল নাকি নকল। আমার জানা মতে আব্রাহাম চৌধুরী মাত্রাতিরিক্ত বিচক্ষণ একজন ব্যাক্তি। উনি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা টপিক নিয়ে আজ লাইফে এসে এভাবে মিথ্যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মিটিং করবে বলে মনে হয় না।

তায়াফ;; তার মানে?

— মানে হয়তো আপনার কাছেই যে হীরে আছে তাই নকল আর আব্রাহাম চৌধুরীর কাছে যা আছে তাই আসল।

তায়াফ;; কিন্তু প্যালেসে কেনো কেউ নকল হীরে রাখবে?

— আমরা তা জানি না।

তায়াফ;; আচ্ছা এই আতিক কেনো ফোন ধরছে না?

— সে বেঁচে থাকলে তো ফোন ধরবে।

তায়াফ;; মানে?

— মানে আতিক আর বেঁচে নেই। মারা গেছে সে।

তায়াফ;; কিহহ? কিসব যা তা বলছেন? কীভাবে মারা গেলো? কবে?

— উনার লাশ ভয়াবহ রকমের খারাপ অবস্থায় পাওয়া গেছে।

তায়াফ;; কিন্তু…

— আর হ্যাঁ জেনে অবাক হবেন যে আতিকের সাথে যে কাজ করতো বিজয় আরকি সেও কিন্তু মারা গিয়েছে।

তায়াফ ফোন কেটে দেয়। এতো কিছু হয়ে গেলো আর সেখানে সে এইসবের কিছুই জানে না। তায়াফ তার অন্য এক রুমে চলে যায়। ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে একটা লকারের লক খুলে ফেলে। তার ভেতরে আবার এক পাসওয়ার্ড দিয়ে লক খুলে ফেলে। অতঃপর বের হয়ে আসে মহা মূল্যবান এক পাথর যার নাম কোহিনূর। তায়াফ তা হাতে তুলে নেয়। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে লাগে। এই হীরে টার জন্যই আজ এতোকিছু। হীরে টা খুব সাবধানে হাতে নিয়ে তায়াফ বসে পরে৷
হীরে টা যে প্যালেসে ছিলো সেই প্যালেসেরই একজন গার্ড ছিলো তায়াফ। হীরে যে কক্ষে সুরক্ষিত ছিলো সেই কক্ষেরই তায়াফ গার্ড ছিলো। খুব সুক্ষ্ম ভাবেই তায়াফ হীরের যাবতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলো রপ্ত করে নেয়। সে মূলত সেখানে গিয়েই ছিলো হীরে চুরির উদ্দেশ্যে। সেখানে যখন তায়াফ গার্ডের চাকরিরত অবস্থায় ছিলো তখন তার সব বায়ো ডাটা সবই ফেইক ছিলো। এমনকি তায়াফের নাম অব্দি মিথ্যে ছিলো। সেখানের একজন উচ্চ পদস্থ মেনেজার ছিলো। প্যালেসের ভেতরে অর্থাৎ কোহিনূর হীরে যে রুমে আছে সেই রুমে যাওয়ার জন্য যে পাসওয়ার্ড দরকার পরতো তা একমাত্র তিনিই জানতেন। উনি মিস্টার. ডজান আলবাট্রা। ডজান আলবাট্রা যখন সবকিছু পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে প্যালেসের ভেতরে যান। তখন তায়াফের নজরে তা পরে। হীরের কক্ষের সামনের পাসওয়ার্ড প্ল্যাটে সঠিক পাসওয়ার্ড দিয়ে ডজান হীরের মূল কক্ষে প্রবেশ করেন। আর রুমে সেইফটির জন্য যে রেড ল্যাজার লাইট দেওয়া থাকে তখন তা বন্ধ ছিলো। আর রইলো সিসিটিভি ক্যামেরার কথা তো তখন তার কানেকশন অর্থাৎ মনিটর রুমের সব ফুটেজ ডিসেবল করে দেওয়া হয়। তায়াফ নিজেই করেছে সব। ডজান আলবাট্রার পিছে কয়েকজন গার্ড ছিলো। তাদের সাথে নিজের গা মিশিয়ে হীরের রুমে তায়াফও প্রবেশ করে। তবে রুমে প্রবেশ করার আগে তায়াফ তার নিজের সাথে “Cyanide” নামক এক মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত মেডিসিন নিয়ে যায়। এই বিষাক্ত মেডিসিন টা আসলে অনেক দুষ্প্রাপ্য। তবে একবার যদি এটা কারো বডিতে যায় তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু। এটা গ্যাস হিসেবেও পাওয়া যায়। আর তা একবার নাক-মুখ দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করলে মৃত্যু অনিবার্য। প্ল্যান মুতাবিক তায়াফ তার সাথে করেই সেই বিষাক্ত মেডিসিন নিয়ে আসে। তবে তায়াফের শুধু দুচোখ বাদ দিয়ে সারা মুখ মোটা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিলো। নিজের আশেপাশে সবকিছু ভালো করে খেয়াল করে নেয়। দেখে বাকি গার্ড গুলো কঠিন মুখ করে একদম সোজা হয়ে হাতে বিশাল বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ডজান একটা কাচের বক্স থেকে খুব সাবধানে হীরে টা নিয়ে নেয়। কীভাবে খুলতে হয় তায়াফ সেটাও দেখে নেয়৷ ডজানের হীরে টা হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই তায়াফ তার পেছন থেকে গ্যাসীয় বিষাক্ত কেমিক্যাল টুকু বের করে তার মুখ খুলে দেয়৷ ২-৩ সেকেন্ডের মাঝেই পুরো রুমে ব্যাপকভাবে ধোঁয়া ছড়িয়ে পরে। এতোই বেশি ধোঁয়া যুক্ত হয়ে যায় যে একহাত দূরত্বের জিনিস অব্দিও দেখা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। গার্ডরা সব বাজেভাবে কাশতে কাশতে ফ্লোরে লুটিয়ে পরে। তাদের নাক-মুখ দিয়ে সাদা ঝাঝ বের হয়ে পরে। তাদের মাঝে ডজান আলবাট্রাও ছিলেন। সেই কক্ষে ডেঞ্জার এলার্ট বাটন ছিলো। আগুন লাগলে বা অন্য কোন গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে সেই এলার্ট বাটন একা একাই সিগনাল দেওয়া শুরু করে। তার তীব্র শব্দ চারিদিকে বাজতে লাগে। আর কেমিক্যাল আস্তে আস্তে যত ছড়াচ্ছিলো ততই তায়াফ হীরের দিকে কয়েক পা কয়েক পা করে এগোচ্ছিলো। সব যখন একদমই হাতের বাইরে চলে যায় তখন এর মাঝেই তায়াফ কাচের ভেতরে থাকা হীরে নিয়ে দ্রুত গতিতে বাইরে এসে পরে। যতক্ষণে পুলিশ এবং বাকি সবাই হীরের ওই রুমে যেতো ততক্ষণে তায়াফ সেখান থেকে বাইরে বের হয়ে আসে। কয়েকজন গার্ড মারা যান এবং ডজন আলবাট্রা গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন। তারপর থেকেই তায়াফ এই হোটেলে আছে কিছুটা গা ঢাকা দিয়েই। আর তখন থেকেই নিউজে ধুম ছড়ায় কোহিনূর চুরি হয়ে যাওয়ার৷
তায়াফ এগুলোই ভাবছিলো তখনই তার কাছে ফোন আসে। ফোনের আওয়াজে ধ্যান ভেঙে যায় তার। ফোনের স্ক্রীনে আননোন বাম্বার দেখে কি
পাল কুচকায়৷

তায়াফ;; হ্যালো।

— স্যার৷

তায়াফ;; আরে তুই! কি খবর তোর?

যে তায়াফ কে ফোন করেছে সে তার সাথেই কাজ করে। আসলে যাবতীয় সব ইনফরমেশন সেই কালেক্ট করে দেয় তায়াফ কে।

তায়াফ;; কিরে বল।

— স্যার, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি আপনার কাছে যে কোহিনূর আছে সেটা আসল নয় নকল। আর, আর আব্রাহাম স্যারের কাছে যে কোহিনূর টা আছে সেটাই আসল।

তায়াফ;; কিহ?

— জ্বি স্যার। আমি সিওর।

তায়াফ রাগে ফোন কেটে দেয়। তাহলে এতো কষ্ট করে যে হীরে চুরি করলো এতো প্রি প্ল্যান করা সব কিছু এভাবে ভেস্তে গেলো। এটা যেনো মেনেই নিতে পারছে না তায়াফ। আর অন্যদিকে যে লোকটা তায়াফ কে ফোন করেছিলো সে আসলে মিথ্যে কথা বলেছে৷ আব্রাহামের কাছে নকল হীরে তায়াফের কাছেই আসল। তবে তায়াফ কে ভুল বুঝানোর জন্য মিথ্যে তাকে বলতেই হয়েছে এছাড়া যে কোন উপায় ছিলো না তার কাছে। কেননা আব্রাহাম তার মাথার পাশে রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছে। তায়াফের সব লোক এখন বর্তমানে আব্রাহামের আন্ডারেই। আব্রাহাম তায়াফের ওই লোককে আগে তুলে নিয়েছে তারপর অনেক শাসিয়েছে৷ অতঃপর জীবনের মায়ায় পরে গুলির ভয়ের ওপর তায়াফ কে তাকে মিথ্যে কথা বলতেই হয়েছে৷ তায়াফ ফোন কেটে দিতেই আব্রাহাম রিভলভার টা নামিয়ে নেয়৷

— স্যার, স্যার আপনি যেভাবে বলতে বলেছেন ঠিক সেভাবেই বলেছি স্যার। প্লিজ এবার আমাদের ছেড়ে দিন স্যার প্লিজ।

আব্রাহাম;; আমি কাঁচা কাজ করি না।

এই বলেই আব্রাহাম তাকে গার্ড দের দিকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে দেয়। আর গার্ড গুলো তাদের সবাই কে এখান থেকে নিয়ে চলে যায়৷ যাক অর্ধেক কাজ তো হলো। এবার আব্রাহামের ফাদে তায়াফের পা দিতে বেশি একটা দেরি নেই। সেইদিন টা এভাবেই যায়।


দেখতে দেখতেই মাঝখানে কেটে যায় আরো দুদিন। আব্রাহাম প্রচুর ব্যাস্ত থাকে, আইরাতও তা বুঝে। আর আইরাত সবকিছুই জানে৷ আইরাত চোখে মোটা ফ্রেমের এক চশমা পরে বসে বসে ল্যাপটপ ঘেটে যাচ্ছে আর আব্রাহাম করিডরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে৷ হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওপর পাশ থেকে বলে ওঠে…

তায়াফ;; একটা বাজি লাগানো যাক!!

আব্রাহামের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা তায়াফ ছাড়া আর কেউ না।

আব্রাহাম;; চোরে রা আর পারেই বা কি!

তায়াফ;; Big shift road no. 11, আগে আসুন তো।

আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়। রুমে এসে আব্রাহাম কে রিভলবারে বুলেট লোড করতে দেখে আইরাত ড্যাবড্যাব করে তাকায়।

আইরাত;; আব্রাহাম!

আব্রাহাম;; বলো জান।

আইরাত;; কোথায় যাচ্ছেন?

আব্রাহাম;; একটু কাজে। ফিরে আসবো জলদিই।

আইরাত;; আচ্ছা।

আব্রাহাম রিভলবার প্যান্টের পিছনে নিচ্ছিলো তখন আবার আইরাত ডাক দেয়।

আইরাত;; আব্রাহাম!

আব্রাহাম;; হুমম।

আইরাত;; আমি কি বাইরে যেতে পারি!

আব্রাহাম;; কোথায়?

আইরাত;; না মানে রুমে বসে বসে না আর ভালো লাগে না তাই বলছিলাম যে আমি কি একটু ঘুড়তে যাওয়ার জন্য বাইরে যেতে পারি!

আব্রাহাম আইরাতের দিকে এগিয়ে যায়। তার হাত আইরাতের কানের পিছে রেখে কপালে চুমু একে দেয়।

আব্রাহাম;; হ্যাঁ বেবিগার্ল যেতে পারো তবে সাবধানে যেয়ো।

আইরাত;; আচ্ছা।

আব্রাহাম আইরাত কে বলে বের হয়ে পরে৷ আর এদিকে আইরাত তো হেব্বি খুশি। সে ভেবেছিলো যে আব্রাহাম তাকে মানা করবে বাট সে এমন কিছুই বলে নি। আইরাত বিছানার ওপর দাঁড়িয়েই মাথা থেকে কাটা টা খুলে দেয়। ফলে পিঠের পেছনে চুলগুলো সব ঝরঝর করে ছড়িয়ে পরে। সেও রেডি হয়ে নেয় বাইরে ঘুড়তে যাবে বলে। একটা সুব্দর দেখে গোলগাল জামা বের করে পরে, চুলগুলো সুন্দর করে ছেড়ে দেয়। কানে ছোট ছোট ঝুমকা পরে নেয়। হাতে একটা ব্রেস্ল্যাট পরে, তারপর একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পরে। পার্কিং প্লেসে এসে আব্রাহামের একটা গাড়ি নিয়ে নেয়। সে আজ সাথে করে কোন গার্ড বা ড্রাইভার কে নিবে না মানে নিবে না বলে ঠিক করে। গাড়ি স্টার্ট করে চলে যায়। ইচ্ছে মতো ঘুড়বে আজ। তবে আইরাতের চলে যাওয়ার আরো ঘন্টা খানিক পর আব্রাহাম হোটেল থেকে বের হয়। মানে সেখানের কিছু কাজ শেষ করে তারপর আব্রাহাম বাইরে এর হয়ে আসে৷ বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসে পরে। সেও নিজের সাথে আজ আর কোন গার্ড কে নেয় না। প্রায় ঘন্টা খানিক পর তায়াফের বলা জায়গা তে এসে থামে। এখানে একটা বেশ বড়ো আকারের বাড়ি রয়েছে। সবদিক টা ভালো করে লক্ষ্য করে ভেতরে চলে যায়৷ বাড়ির ভেতরে গিয়ে হলরুমে আব্রাহামের পা রাখতেই তার চোখে পরে কোহিনূর হীরে কে৷ হলরুমের ঠিক মাঝ বরাবর হীরে টা কেমন জলজল করে ঘুরছে। আব্রাহাম কয়েক কদম এগিয়ে যায়।

তখনই তায়াফের কর্কশ কন্ঠস্বর।

তায়াফ;; আরে আব্রাহাম আহমেদ চৌধুরী যে।

আব্রাহাম;;

তায়াফ;; আসুন আসুন।

আব্রাহাম;; কেনো ডেকেছিস?

তায়াফ;; আরে কেনো আবার কোহিনূর এর জন্য। যার জন্য এতো কিছু করতে হচ্ছে আপনাকে।

আব্রাহাম;; নকল কোহিনূর নিয়ে কি করবো কি আমি?

তায়াফ;; আসলে যতটা গাধা আমাকে মনে করেন আমি আসলে ততটা গাধা নই। এই কোহিনূর আসল আর আপনার টা নকল৷

আব্রাহাম;; কোন প্রমাণ আছে কি তার?

তায়াফ;; বুঝি আমি। প্যালেসে এতো পাহারা দিয়ে, এতো প্রোটেকশন দিয়ে তো আর নকল হীরে কে রাখবে না তাই না।

আব্রাহাম;; হয় কি জানিস! ডেট ওভার জিনিস কেও খাঁটি জিনিস বলে যেখানে চালিয়ে দেওয়া হয় সেখানে এ আর এমন কি।

তায়াফ;; এই এত্তো মূল্যবান জিনিস আপনার কাছে “এমন কি” হয়ে গেলো!

আব্রাহাম;; হাহ, মানুষের জীবনের থেকে মূল্যবান আর কিছুই না।

তায়াফ;; আর যদি এই জীবন টাই নিয়ে নেই তো!

আব্রাহাম;; মানে?

তায়াফ;; আচ্ছা ধরেই নিলাম যে আপনার কাছের হীরে আসল আর আমার টা নকল। এখন কথা হচ্ছে যে হীরে টা আমার চাই।

আব্রাহাম;; বদলে আমি কি পাবো?

তায়াফ;; যা চাবেন।

আব্রাহাম;; তোর মরণ চাই।

তায়াফ এবার এক অট্টহাসি দেয়।

তায়াফ;; আমি আমার কাছের এই হীরে আপনাকে দিতে পারি তবে এক শর্তে।

আব্রাহাম;; কি?

তায়াফ;; একটা মেয়ে কে দেখেছি আমি সেই হোটেলেই। অনেকবার তো আপনার সাথেই দেখেছি।

আব্রাহাম কপাল কুচকায়।

তায়াফ;; প্রথম দেখি রিসোর্টে। জীবনে কতো মেয়ে কে দেখেছি তবে তার মতো ভালো আমার একটা কেও লাগে নি।

আব্রাহাম;; কে?

তায়াফ;; নাম আইরাত। আমার চাওয়া খুব সাধারণ। আমি হীরে চাই। আর তা যদি না পাই তাহলে আমি ওই মেয়ে টাকে চাই। আর হীরে আপনি নিয়ে যেতে পারেন।

আব্রাহাম ঝড়ের গতিতে গিয়ে তায়াফের কলার খামছে ধরে৷ চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না আব্রাহামের। রাগ হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।

আব্রাহাম;; অবশ্যই কোন এক ফুটপাতের জারজ সন্তান তুই তাই কোন মেয়ের দিকে এভাবে নজর তুলে তাকাস।

তায়াফ;; তা নাহলে হীরেও যাবে আর এই মেয়ে টাকেও যেতে হবে।

আব্রাহাম;; কি বলতে কি চাচ্ছিস তুই!

তায়াফ;; মেয়ে টাকে মেরে ফেলবো আমি।

আব্রাহাম;; তা তো তুই ভুলেই যা। না হীরে তোর হবে আর না ই তুই বেঁচে থাকবি। আর রইলো ওই মেয়ের কথা তা তো তুই ভুল করে স্বপ্নেও ভাবিস না।

তায়াফ;; এক্সিডেন্ট!

আব্রাহাম এবার তায়াফের কলার হালকা করে ছেড়ে দিয়ে কপালের ভাজ দ্বিগুণ করে তাকায়।

তায়াফ;; খোঁজ নিয়ে দেখুন এখনো ওই মেয়ে বেঁচে আছে কিনা!

আব্রাহামের বুকটা কেমন ধক করে ওঠে। তখনই তার মনে পরে যে আজ আইরাত তার কাছে বাইরে যাওয়ার কথা বলেছিলো। আব্রাহামের টেনশন আরো বেড়ে যায়। তখনই তায়াফের ফোনে ফোন আসে। এক শয়তানি হাসি দিয়ে তায়াফ ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেয়। ওপর পাশ থেকে কন্ঠ ভেসে আসে।

— স্যার, কাজ হয়ে গেছে। যেই মেয়েকে ফলো করে এক্সিডেন্ট করাতে বলেছিলেন তার এক্সিডেন্ট করে দিয়েছি। অনেক বাজে ভাবেই।

তায়াফ;; নাম কি মেয়ের?

— আইরাত।

আব্রাহামের পায়ের নিচ থেকে মাটি যেনো সরে যায়৷ নিজের কান কেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে যেনো বর্তমানে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যাচ্ছে৷ তার রাগের মাত্রা এখন পরিমাপ করা যাবে না। তবে এখন রাগের থেকে বুঝে শুনে কাজ করা টাই বেশি শ্রেয়। আব্রাহাম বেশি কিছু না বিকট এক গর্জন দিয়ে তায়াফের কলার ধরে শুধু তার মুখ বরাবর এক ঘুষি দিয়ে দেয়। ছিটকে যায় রক্ত। ব্যাস আর কিছুই বলে না সোজা ছুটে বের হয়ে যায় সেই বাড়ি থেকে৷ আর তায়াফ নিচে বসে আছে মুখ দিয়ে অনরগল রক্ত ঝড়ছে তার। আব্রাহাম বাইরে এসে গাড়িতে উঠে বসে হাওয়ার বেগে ছুটে যাচ্ছে৷ রাস্তা তেই আব্রাহামের একজন গার্ড ফোন করে। রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে হাপাতে হাপাতে বলে ওঠে “আইরাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে”। আব্রাহাম দিন-দুনিয়ার কথা ভুলে গিয়ে ছুটে যাচ্ছে৷ গার্ড তাকে একটা রোডের নাম বলে সেখানেই আব্রাহাম আসে৷ গার্ড রা চারিপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানে অনেক মানুষের ভীড়ও জমে গেছে৷ আব্রাহাম গিয়ে শুধু দেখে যে রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটা আধো ভাঙা গাড়ি উল্টে আছে। আর তার মাঝখানে অর্থাৎ উইন্ড এর দিক টায় একটা রক্তমাখা হাত বের হয়ে আছে। এটা দেখেই আব্রাহামের কলিজায় এক মোচড় দিয়ে ওঠে।





চলবে~~

#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#Season_2
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৯

এই মূহুর্তে থমকে গেছে সবকিছুই। কেমন যেনো নিস্তেজ সব। কেমন নিষ্প্রাণ, রাস্তার আনাচে কানাচে সবদিকেই প্রচুর মানুষ। সবার মাঝে কেমন এক গম্ভীরতার ছাপ। তখনই কয়েকটা ফরেইন পুলিশের গাড়ি রেড এলার্ট বাজিয়ে আসে। সব জায়গায় কেমন এক হৈচৈ পরে গেছে। পুলিশ অফিসার মুখের কাছে মুঠোফোন এনে দ্রুত এম্বুলেন্স কে ফোন করে। আর এইদিকের রাস্তা পুরো বন্ধ করে দিতে বলে। চারিপাশে শুধু পুলিশের এলার্ট বাজানোর শব্দ। আব্রাহামের গার্ড”রা সব মানুষ কে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। যে জায়গায় এক্সিডেন্ট হয়েছে অর্থাৎ এক্সিডেন্ট স্পোট সেখানে বাউন্ডারি দিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে কেউ এর ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। আর এই সবকিছুর ঠিক মাঝে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে আব্রাহাম। তার কান দিয়ে যেনো কোন কথাই যাচ্ছে না, কারো কোন কথাই শুনছে না সে। নিজের আশেপাশের সবকিছুই কেমন সাদা-কালো দেখাচ্ছে তার কাছে। সবকিছুই তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে শুধু আইরাতের গাড়ির এক্সিডেন্ট আর বাইরে বের হয়ে থাকা তার রক্তমাখা হাত টা বাদে। অগোচরেই আব্রাহামের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে এক ফোটা নোনাজল। বুকটা যেনো ভেঙে মূহুর্তেই চুরমার হয়ে গেলো। আব্রাহাম কাপা কাপা পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে যায় কিন্ত পারে না। পা যেনো আর চলে না। তখনই একটা বিশাল আকারের গাড়ি এসে এক্সিডেন্ট করা গাড়ির পেছনে দাঁড়ায়। উল্টে যাওয়া গাড়ি উঠিয়ে আস্তে করে ঘুড়িয়ে দেয়। এতে গাড়ি সোজা হয়ে যায় এবং উইন্ড দিয়ে আইরাতের মুখ টা স্পষ্ট দেখা যায়। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে তার, কপালের বেশ অংশ কেটে গেছে, গলার পাশে ফর্সা দিকটায় খানিক কাচ ঢুকে আছে, সেখান থেকে বেয়ে বেয়ে রক্ত ঝড়ছে। নাক-ঠোঁটের কাছে রক্ত। হাতের অনেক জায়গায় ক্ষত। রক্তে দুহাত লাল আর তাতে আইরাত চোখ বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে ড্রাইভিং সীটে বসে আছে। এতোই জোরে ধাল্লা লেগেছে যে সীট বেল্ট টা ছিড়েই গিয়েছে। আইরাত ড্রাইভিং করছিলো। কিন্তু সাইড মিররে সে দেখে যে একটা কালো গাড়ি তাকে ফলো করছে অনেকক্ষন যাবত। আইরাত যেদিকে গাড়ি মুভ করছে সেই গাড়ি টাও ঠিক সেইদিকেই যাচ্ছে। আইরাত তা দেখে খানিক কপাল কুচকায়। অতঃপর গাড়ি ইউ টার্ন নিয়ে অন্য এক খোলা রোডে নিয়ে চলে যায়। তখনই সেই গাড়িটা তাদের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে আইরাতের গাড়ি কে পেছন থেকে দেয় এক ধক্কা মেরে। ব্রেকের ওপর থেকে নিজের কন্ট্রোল সরে গেলে পরমূহুর্তেই সামনে দানব আকৃতির একটা ট্রাক আসে। ভর পেয়ে আইরাত স্টেয়ারিং এর ওপর থেকে দুহাত উঠিয়ে দিয়ে নিজের সামনে ধরে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় না। খারপ ভাবে তার এক্সিডেন্ট হয়। আর দরুন গাড়ি আধো ভাঙা হয়ে যায় আর উল্টে পরে যায়। অনেক ক্র‍্যাশ খেয়েছে। দূর থেকেই আইরাত কে গাড়ির ভেতরে দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত অবস্থায়। আর আইরাত কে এমন অবস্থায় দেখে আব্রাহাম এক পাগল উন্মাদ হয়ে গেলো। নিজেকে আর নিজের মাঝে খুঁজে পাচ্ছে না সে। আইরাতের এত্তো বড়ো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে তা যেনো মেনেই নিতে পারছে না আব্রাহাম। বলতে ইচ্ছে করছে যে সে যা এই মূহুর্তে দেখছে তা সম্পূর্ণই মিথ্যে। এভাবে আর থাকতে না পেরে আব্রাহাম চিল্লিয়ে ওঠে…

আব্রাহাম;; আইরায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াত!!

বিকট এক চিৎকার দিয়ে আব্রাহাম দৌড়ে আইরাতের গাড়ির দিকে যেতে লাগে। তবে একজন গার্ড এসে আব্রাহাম কে আটকে দেয়।

গার্ড;; স্যার স্যার প্লিজ স্যার নিজেকে সামলান স্যার প্লিজ। সেখানে যাওয়া টা ঠিক হবে বলে মনে হয় না স্যার প্লিজ স্যার।

আব্রাহাম গার্ড কে দেয় এক ধাক্কা। তাকে সরিয়ে দিয়ে আব্রাহাম আবার ছুটে চলে যায়। আব্রাহামের যাওয়ার আগে একজন পুলিশ অফিসার এসে আইরাতের গাড়ির দরজা খুলে দেয়। সীট থেকে বাইরে পাশে পরে যেতে ধরলে আব্রাহাম ছুটে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে আইরাত কে খপ করে ধরে ফেলে। আইরাত পরে যায় আব্রাহামের বুকের ওপর। আব্রাহাম পুরো আষ্ঠেপৃষ্ঠে আইরাত কে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে। মূহুর্তেই আইরাতের রক্তে আব্রাহামের পরনে থাকা সাদা শার্ট টা ভিজে গাঢ় লাল হয়ে যায়। আব্রাহামের হিতাহিত জ্ঞান নেই আজ-এখন। নিজের বাহুতে আইরাতের মাথা টা নিয়ে নেয়। হাত দিয়ে তার মুখে আছড়ে পরা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। আইরাতের গালে ধরে ধরে চিল্লিয়ে যাচ্ছে।

আব্রাহাম;; আইরাত, আইরাত বেবিগার্ল। আইরাত জান আমার চোখ খুলো প্লিজ। আইরাত আমাকে শুনতে পারো কি তুমি আইরাত। আইরাত চোখ খুলো, আইরাত। আমার দোষ সব আমার দোষ। আমি কেনো, কেনো আমি তোমাকে বাইরে বের হতে দিলাম। আমি তো ভেবেছিলাম যে তুমি হোটেলের কোথাও-ই ঘুরবে আমি তো, আমি, আমি তো জানি না যে তুমি বাইরে আসবে। গার্ড নিয়ে সাথে কেনো এলে না। আইরাত আমি মরে যাবো আইরাত আমি সোজা মরে যাবো। আমি এক জীবন্ত লাশ হয়ে যাবো আইরাত। আইরাত আমাকে এভাবে প্লিজ মেরে ফেলো না তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, যেতে পারো না। তুমি চলে গেলে আমার মরণ ছাড়া কোন উপায়ই থাকবে না আর আইরাত। আইরাত বেবিগার্ল চোখ খুলো প্লিজ। আইরাত জান আমার কথা বলো। আইরায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়াত।

আব্রাহামের আশেপাশে কোন খেয়ালই নেই আজ। পাগল হয়ে আইরাতের ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিজের বাহুতে নিয়ে পাগলের মতো চিল্লিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ অফিসার রা চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না। কারণ অবস্থা টাই হাতের বাইরে। আব্রাহাম কে কেউ আজ পর্যন্ত এমন করতে দেখে নি কখনোই না। তাতে যত বড়োই কান্ড হয়ে যাক না কেনো। কেউ আজ পর্যন্ত আব্রাহাম কে এমন করতে দেখে নি। এতো স্ট্রোং একজন মানুষ কে এভাবে ভেঙে পরতে দেখে কারই না খারাপ লাগবে। কেউ কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। গার্ড রা সবাই আফসোস নিয়ে তাকিয়ে আছে। তখনই এম্বুলেন্স আসে। দ্রুত আইরাত কে হস্পিটালাইসড করতে হবে। ওয়ার্ড বয় রা এসে যেই না আইরাত কে ধরে এম্বুলেন্সের ভেতরে নিয়ে যেতে ধরবে তখন আব্রাহাম রেগে আগুন হয়ে যায়। সে উঠে আইরাত কে পাজাকোলে তুলে নেয়। তারপর দ্রুত গিয়ে নিজের গাড়িতে তুলে নেয়। এম্বুলেন্সে আইরাত কে সে উঠতে দিবে না। আইরাত কে দ্রুত বসিয়ে সেও শার্টের হাতা গুলো আরো গুটিয়ে নিতে নিতে গাড়িতে এসে ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে পরে। রক্তে আব্রাহামের সাদা শার্ট শেষ। আইরাত অজ্ঞান হয়ে তার পাশেই বসে আছে। ঝড়ের গতিতে আব্রাহাম গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। এম্বুলেন্সের ওপরে আব্রাহামের বিশ্বাস নেই যদি একবার ট্রাফিং জ্যামে পরে যায় তাহলে শেষ। আর জ্যামে আটকে বসে থাকবে সেই সময় টুকু এখন আইরাতের কাছে নেই। আব্রাহাম ড্রাইভ করছে আর আইরাতের দিকে তাকাচ্ছে। আইরাত কে তার এক হাত দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। এই মূহুর্তে আব্রাহামের প্রচুর কান্না পাচ্ছে কিন্তু কান্না করছে না। একহাত দিয়ে আইরাত কে বুকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। এক ঘন্টার রাস্তা মাত্র বিশ মিনিটে পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। হস্পিটালের সামনে গাড়ি থামতেই আব্রাহাম আইরাত কে সীটে আস্তে করে বসিয়ে নিজে চট জলদি গাড়ি থেকে নেমে পরে। আইরাতের পাশে দরজা খুলে আবার তাকে পাজাকোলে তুলে নেয়। আব্রাহাম কে এই অবস্থায় দেখেই আশেপাশের মানুষ পুরো ‘থ’। গলা ফাটিয়ে “ডক্টর” কে ডেকে ডেকে হস্পিটালের ভেতরে যাচ্ছে আব্রাহাম। ভাগ্য ভালো হস্পিটালে তখন সিনিয়র ডক্টর ছিলো৷ এভাবে কারো গলা শুনেই পুরো হস্পিটালের মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। আর আব্রাহামের কোলে এভাবে একটা মেয়েকে রক্তমাখা অবস্থায় দেখে ডক্টর তড়িঘড়ি করে তার কাছে পৌঁছে যায়।

ডক্টর;; Abraham sir, what happened to her?

আব্রাহাম;; She had a bad accident, check her out…

ডক্টর দ্রুত একটা বেড নিয়ে এসে তাতে আইরাত কে শুইয়ে দিয়ে নিয়ে যায়। একজন নার্স এসে আব্রাহাম কে কিছু শান্তনা পূর্ন কথা বলে যায়। আইরাতের অবস্থা প্রচুর ক্রিটিকাল। রক্তক্ষরণ হয়েছে অনেক। তাকে আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হয় (ইমারজেন্সি)। আব্রাহাম আইরাত কে নিয়ে ভয়ে ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে। এক হাত কোমড়ে রেখে আরেক হাতের উল্টো পাশ দিয়ে কপালের পাশে জমে থাকা ঘাম বিন্দু টুকু মুছে নেয়। আইরাত কে যে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার দরজাতে বড়ো আকারের একটা কাচের গ্লাস দেওয়া ছিলো। যা দ্বারা ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়। আব্রাহাম কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাচের গ্লাস দিয়ে ভেতরে দেখতে লাগে। আইরাতের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। নার্স আর ডক্টর রা ছুটে ছুটে কাজ করছে। তুলি দিয়ে ব্লাড গুলো পরিষ্কার করছে। আর আব্রাহাম এগুলো উইন্ড গ্লাস দিয়ে দেখছে। নিজের ভেতরে যেনো ঝড় বয়ে যাচ্ছে আব্রাহামের। আইরাত কে আব্রাহাম কি পরিমান ভালোবাসে তা ভাষায় প্রকাশ করা বড্ড বেশিই দায়। অনেক কষ্টে পাওয়া আইরাত কে তার, হারাতে চায় না। হারিয়ে গেলে হয়তো সেইদিনই নিজের মৃত্যু কে স্বজ্ঞানে বরণ করে নিতে হবে আব্রাহামের। আব্রাহাম কল্পনাতেও ভাবে নি যে একদিন আইরাত কে সে এই হালে খুঁজে পাবে। নিজেকে বড়ো একা লাগছে আজ। খুব বেশিই খারাপ লাগছে। সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। এভাবে আর থাকতে না পেরে আব্রাহাম তার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুখে চেপে ধরে কেদে দেয়। কথায় বলে যত কঠিন অবস্থাই হোক না কেনো ছেলে দের নাকি কাদতে নেই। কিন্তু এটা ভুলে যায় যে ছেলেরাও মানুষ, ফিলিংস তাদেরও আছে। আব্রাহামের চোখ দিয়ে অঝোড় ধারায় পানি গড়িয়ে পরছে৷ খুব করে কাদছে সে। ভয় সবদিক থেকে বাজেভাবে গ্রাস করে নিয়েছে তাকে, আইরাত কে হারানোর ভয়। আব্রাহাম বসে পরে ধপ করে। দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে নিচু হয়ে যায়। আব্রাহাম কাদছে ভাবতেই কেমন একটা মায়া কাজ করে। কাকতালীয় ভাবে তখন আব্রাহামের দাদি ইলা ফোন করে বসে তার কাছে। ফোন কয়েক বার বেজে কেটে যায় আপনা আপনিই । কেননা এখন কোন রকম কোন কথা বলার অবস্থায় আব্রাহাম নেই, তার তেমন মন-মানসিকতা বিদ্যমান নেই এখন। ৩য় বারের সময় ফোন বের করে সামনে আনতেই দেখে তার দাদি ইলা। আব্রাহাম যথা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। বাসায় কাউকে ভুল করেও এইসবের বিষয়ে জানতে দেওয়া যাবে না তাহলে ওদিকে সবার নাজেহাল দশা হয়ে যাবে। ডান হাতে ফোন নিয়ে বাম হাত দিয়ে দুচোখ মুছে নেয়। স্বাভাবিক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে।

আব্রাহাম;; হ হ হ্য হ্যালো…

ইলা;; হ্যালো আব্রাহাম সোনা কেমন আছিস? আসলে কি আমি জানি যে তোরা দুই ল্যায়লা-মাজনু একই সাথে আছিস কিন্তু কি করবো বল কথা বলতে ইচ্ছে করে তো তাই ফোন দিয়ে বসলাম। আচ্ছা কেমন আছিস তোরা? কি করিস? খাওয়া-দাওয়া ঠিক ভাবে করছিস তো? শোন আইরাতের মা অনামিকা কে না আমি এনে পরেছি আমাদের বাসায়। কারণ সেও তার বাড়িতে একা আর আমিও একা। একা একা আর কি করবো তাই নিয়ে এসে পরেছি। ভালো করেছি না বল! যাই হোক আইরাত কোথায় রে? কেমন আছে ও? আচ্ছা তোর সাথেই পরে কথা বলবো আগে আইরাত কে দে তো দেখি। আমি ওকে মিস করি খুব। কথা বলবো দে দে আগে ওকে দে।

আব্রাহাম;; দ দ দাদি, দাদি আস আসলে আমি তো একটু বাইরে এসেছি তো। আমি বাসায় নেই। আমি য য যক যখন বাসায় যাবো তখন আ আই আ আইরাতের সাথে কথা বলিয়ে দিবো তোমার।

ইলা;; আব্রাহাম! সোনা কি হয়েছে তোর! গলা এমন শোনাচ্ছে কেনো? ঠিক আছিস তো তুই?

আব্রাহামের চোখ আর বাধ মানছে না এখন।

আব্রাহাম;; হ্যাঁ হ্যাঁ আমার বুড়ি আমি, আমি ঠিক আছি একদম। আর ওইতো আইরাত, আইরাত আর আমি মিলে না অ অ অনেক আইসক্রিম একসাথে খেয়ে নিয়েছিলাম তো তাই, তাই আর কি গলা এমন শোনাচ্ছে ভেঙে গিয়েছে। ঠিক আছি আমি।

ইলা;; ধুর তোরা দুটো কি যে করিস না। বড়ো হবি কবে তোরা। আইরাতের সাথে সাথে তুইও ছেলেমানুষী আর ছাড়লি না। আচ্ছা শোন ভালো থাকিস। আর আমার আইরাত কে জ্বালাতন করবি না। ওকে দেখে রাখবি। একটা আচড়ও যেনো ওর ওপরে না আসে বুঝেছিস!

আব্রাহাম;; আমার ক্ষমা করো দাদি, আমি ব্যার্থ। তোমার কথার মূল্য আমি রাখতে পারি নি।

ইলা;; আব্রাহাম!

আব্রাহাম;; ভালো থেকো আমার বুড়ি।

এই বলেই আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়, কেদে দেয়।
ফোনের ওয়ালপেপারে আইরাতের ছবি ভাসছে। বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে তাতে ছুইয়ে দিচ্ছে। আব্রাহাম নিজের দিকে তাকায়। নিজের গায়ে আইরাতের রক্ত। চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো বেশকিছু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। তখনই আব্রাহামের মাথায় তায়াফের খেয়াল আসে আর যে লোকগুলো আইরাতের এক্সিডেন্ট করিয়েছে তাদের কথা আসে। আব্রাহামের মাঝে এখন কোন ভাব নেই। রাগ এতো টাই বেড়ে গিয়েছে যে সে রিয়েক্ট করতেই ভুলে গেছে। কিছু সময় পর আইরাতের কেবিন থেকে একজন নার্স বের হয়ে আসে আব্রাহামের কাছে চলে যায়।

নার্স;; স্যার, স্যার।

আব্রাহাম চোখ তুলে নার্সের দিকে তাকায়। তবে আব্রাহাম যে দেখে নার্সের নিজেরই ভয়ে গা হীম হয়ে আসে, শুকনো ঢোক গিলে। আব্রাহামের চোখ গাঢ় লাল। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে রাগে থরথর করে কাপছে সে। কপালের, হাতের রগগুলো কেমন ফুলে গেছে। নার্স কিছু না বলেই আবার সোজা কেবিনের ভেতরে চলে যায়। তার পরেই ডক্টর বাইরে আসে।

ডক্টর;; আব্রাহাম স্যার!

আব্রাহাম;; জ্বি।

ডক্টর;; ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমি কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি!

আব্রাহাম;; হুয়াট?

ডক্টর;; মেয়েটা আপনার কে হয়?

আব্রাহাম;; আমার বউ, আমার পুরো দুনিয়া ওই মেয়ে।

আব্রাহামের কথা শুনে ডক্টর বেশ অবাকই হয়।

ডক্টর;; জ্বি ধন্যবাদ। আসলে ম্যামের অনেক রক্ত গিয়েছে। রক্ত লাগবে।

আব্রাহাম;; আমার আর আইরাতের ব্লাড গ্রুপ সেইম।

আব্রাহাম মাথা তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে ডক্টরের দিকে তাকায়।

আব্রাহাম;; দরকার পরলে আমার বডির পুরো ব্লাড আপনি নিয়ে নিন কিন্তু যে করেই হোক যেভাবেই হোক আমার আইরাত সেইফ থাকা চাই। তাকে একদম সুস্থ চাই আমার, ডু ইউ গেট দ্যাট!

ডক্টর;; জ জ্ব জ্বি স্যার।

আব্রাহাম কে নিয়ে একটা কেবিনে চলে যায় ডক্টর। প্রায় তিন ব্যাগ রক্ত নেওয়া হয়েছে আব্রাহামের বডি থেকে। বর্তমানে আইরাত কে হস্পিটালের ড্রেস পরিয়ে দিয়ে রেখেছে। হাতে ব্লাডের কানেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। কপালে-গালে ব্যান্ডেজ করা। গলার দিক টায় যেখানে কাচ বিধে ছিলো সেখানে বড়ো ব্যান্ডেজ রয়েছে। ঠোঁটের পাশে বেশ টুকু কেটে গিয়েছে। আব্রাহাম এক নজর আইরাত কে দেখে দ্রুত পা ফেলে হস্পিটাল থেকে বের হয়ে পরে। সবাই কে, সবাই কে এত্তো পরিমাণে জঘন্য-বিচ্ছিরি মৃত্যু আব্রাহাম দিবে যে তাদের মরণ দেখে রাস্তার কুকুর অব্দি কাদবে। সব ধ্বংস করে দিবে। পুরো হস্পিটালের বাইরে কমপক্ষে শত গার্ড দিয়ে রেখেছে। সিনিয়র থেকে সিনিয়র ডক্টর দের ডেকেছে আব্রাহাম আইরাতের ট্রিটমেন্টের জন্য। হস্পিটালের বাইরে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পরে। আইরাতের রক্ত মাখা শার্ট টা আর খুলে না আব্রাহাম তার গা থেকে। তার ওপরেই হুডি টা পরে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। মুখে কোন হাবভাব নেই তার। প্রচন্ডরকম ভাবে রেগে আছে। এমনকি তার রাগের ভয়ে কেউ তার সাথে ঠিক ভাবে কথাও বলে নি। আব্রাহাম চলে যায়, আজ পুরো কিয়ামত হয়ে যাবে।





চলবে~~