পদ্ম ফুলের অভিমান পর্ব-১২

0
269

#পদ্ম_ফুলের_অভিমান(পর্ব:12)
#লেখনীতে_নাফিসা_আনজুম

পদ্মমা আমার ছেলেটা তোকে সত্যি অনেক ভালোবাসে, আমি আগে বুঝতে পারি নি কিন্তু আমার একমাত্র ছেলেটা যখন আমাদেরকে ছেড়ে আমেরিকা চলে যায় তখন থেকে বোঝার চেষ্টা করি। আমরা ওকে বাহিরে কখনোই পাঠাতাম না আর না আমার ছেলেটার বাহিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো কিন্তু হটাৎ একদিন তোদের বাড়ি থেকে এসেই বলে যে,,

-মা আমি দেশে থাকবো না আমেরিকা যাবো,ফুপির ননদরা থাকে ওখানে, আব্বুকে কিছু একটা ব্যাবস্থা করতে বলো তারাতারি,,

-কি হয়েছে নিলয়, তুই কেনো বাহিরে যাবি

-কেনো আবার আমি ওখানে গিয়ে পরাশুনা করে জব করবো

-কিন্তু হটাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেনো, তোর আব্বু কিছুতেই মানবে না, আমাদের একমাত্র ছেলে তুই

-আম্মু আমি যখন বলছি যাবো তখন যাবোই

সেদিন আমি খুব অবাক হয়ে গেছিলাম নিলয়ের কথায়, এমনভাবে ও কখনোই আমার সাথে কথা বলে নি। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো,নিলয়ের বাবাকে ফোন করে বললাম কিন্তু তিনি কোনো রাগ করলেন না বরং শান্তভাবে বললেন ছেলে যদি যেতে চায় আমাদের বাঁধা দেওয়া ঠিক হবে না, পরে অবশ্য জেনেছি আমার আগে নিলয় ওর বাবাকে বলেছে। তার ঠিক দুইমাস পর নিলয় আমেরিকা চলে যায় । ওখানে নিলয়ের বাবার বোনের ননদরা থাকতো প্রথমে নিলয় সেখানেই থাকতো। নিলয় যে তোকে ভালোবাসে সেটা আমি তোর প্রতি ওর কেয়ার দেখেই বুঝেছি, ও সবসময় তোর খোঁজ করতো,এমনকি আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্যও ওই আমাকে বলেছে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারি নি কি এমন হয়েছিলো যে তোদের বাড়ি থেকে আসার সাথে সাথে আমার ছেলেটা এতোদিন আমার থেকে দূরে চলে গিয়েছিলো।

-ফুপির কথায় আমি একটু নড়েচড়ে উঠলাম, অভ্র ভাইয়ার কথাটা যদি কোনো ভাবে জানতে পারে তাহলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

-আচ্ছা সে যাই হোক এখন আমার ছেলেটাকে ভালো রাখিস মা, আমি জানি আমাদের থেকে দূরে গিয়ে ও একদম ভালো ছিলো না। আর বাড়িতে এসেই আগে তোর খোঁজ করেছে যখন পায় নি পরেরদিন এ তোদের বাড়িতে গিয়েছে।

এমন সময় বাহিরে থেকে ডাক আসলো,কই গো ভাবি তোমার ছেলেবউকে নিয়ে ঘরেই বসে থাকবে নাকি আমাদেরকেও দেখাবে।

-চল মা বাহিরে

-আমি ফুপির সাথে বের হয়ে আসলাম, বেশ কিছুক্ষণ সবার সাথে থেকে ঘরে চলে আসলাম।তবে এর মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম,নিলয় ভাইয়া যতোবার আমার পাশ দিয়ে গেছে একবারো আমার দিকে তাকায় নি। মানে একবারো দেখে নি আমার দিকে, কাজে ব্যাস্ত থাকলেও তো উনি এমন করে না। আমার এই জিনিসটা কেমন যেনো লাগছে যে কেনো তাকাচ্ছে না।

ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই নিলয় ভাইয়া আসলো তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেলো, অবাক হলাম যে মানুষ সবসময় তাকিয়ে থাকে আমার দিকে সেই মানুষ একবারো তাকাচ্ছে না আমার দিকে।

সময়টা সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এসেছে, আমাদের বাড়ি থেকে আব্বু, তুর্য, আর মামারা এসেছিলো।মহিলা মানুষ কেউ আসে নি আজ।
সারাদিন বাড়িতে আত্মীয় স্বজন ছিলো তাই খুব বেশি নিলয় ভাইয়ার সাথে দেখা হয় নি
আমি যতক্ষণ রুমে ছিলাম নিলয় ভাইয়া বাহিরে ছিলো, তবে আমি সারাদিনে কিছু একটার অভাব ফিল করতেছি। কেনো জানি কোনো কিছুতেই মন বসতেছে না,অস্থির অস্থির লাগছে সবকিছু। একটু আগে মামারা সবাই চলে গিয়েছে আমি রুমে এসে নিজের ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলাম, কোনো কিছু না করেও ক্লান্ত লাগছে। বিয়ের নিয়ম অনুযায়ী আজকে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও আজ নিলয় ভাইয়া যেতে দেয় নি। একে তো কাছাকাছি না , তার ওপর এখন বাড়িতে অনেক কাজ, আমার ভর্তি পরাশুনা।

শুয়ে থাকতে থাকতে চোখঁটা লেগে এসেছে, জাগনা পেয়ে দেখি রাত হয়েছে, প্রায় দেড় ঘন্টা ঘুমিয়েছি, কেউ ডাকতেও আসে নি, নিলয় ভাইয়াও নেই, আমি উঠে তারাতারি শাড়ি পাল্টিয়ে একটা থ্রিপিস পরে নিচে গেলাম। ফুপি ডাক দিয়ে বললো, আয় মা খেতে আয়, আমি ডাকতে যাচ্ছিলাম এখোনি,,

আমি আশেপাশে নিলয় ভাইয়াকে না দেখে ভাবলাম ফুপিকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু ফুপি আবার কি না কি মনে করে। ধুর কি মনে করে করুক, আমি আসতে করে বললাম, ফুপি নিলয় ভাইয়া কোথায়,,

ও একটু বাহিরে গেছে মা,কি যেনো কাজ আছে নাকি এজন্য,তুই খেয়ে ওর খাবারটা ওপরে নিয়ে যাস কেমন,,

ফুপি তুমি আমাদের দুজনের খাবারি দিয়ে দাও, ভাইয়া আসলে একসাথে ,কথাটা শেষ করার আগেই দেখলাম ফুপি মুচকি মুচকি হাসছে, ইশশ লজ্জা পেয়ে গেলাম।

-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দুজনেরি খাবার দিচ্ছি, নিলয় আসলে একসাথে খেয়ে নিস

খাবারগুলো নিয়ে সেই কখন থেকে অপেক্ষা করতেছি, ওনার আসার কোনো নাম নেই, বিছানায় ও যেতে পারতেছি না।কারন বিছানায় গেলে কখন ঘুমিয়ে পরবো ঠিক নেই, আর আমার ঘুম মানেই তো ম*রা। নিলয় ভাইয়া এসে যদি একা একা খেয়ে ঘুমিয়েও যায় তবুও টের পাবো না আমি। তাই কখনো দাড়িয়ে কখনো হেঁটে কখনো বসে থেকে জেগে থাকার চেষ্টা করছি। কমপক্ষে পঞ্চাশ বার কল করেছি, বিশটা এস এম এস দিয়েছি একবারো রিসিভ করে নি রিপ্লেও দেয় নি। কি এমন হলো হটাৎ করে।

টেবিলে বসে দুই হাত ভাঁজ করে দিয়ে তার ওপর মাথা রেখে আছি খিদাও লাগছে তার ওপর ঘুম পাচ্ছে,
তখনি দরজা খোলার শব্দ পেয়ে উঠে দাড়ালাম। নিলয় ভাইয়া এসেছে, ঘরিতে তাকিয়ে দেখি এগারোটা ছাপ্পান্ন, এতোক্ষন আমার রাগ না হলেও ওনাকে দেখে খুব রাগ হলো, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এতো দেরি হলো কেনো,

উনি স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেন বন্ধুদের সাথে ছিলাম, অনেকদিন পর দেখা তো তাই

আসুন খেয়ে নিন,

আমি খেয়ে এসেছি,

আমার খুব কান্না পাচ্ছে এখন, আমি না খেয়ে আছি ওনার জন্য আর উনি একা একা খেয়ে আসছে,একটাবারের জন্য আমাকে বলে নি,এতোবার ফোন দিলাম একবারো আমাকে ফোন দিয়ে বললো না তুমি খেয়ে নাও। অনেক কষ্টে কান্না আটকিয়ে বললাম, ফোন দিয়েছিলাম,,

উনি ফোন চেক করে বললো, ইশশ সরি বুঝতে পারি নি এতোবার কল দিয়েছো, আর তুমি কেনো জেগে আছো ঘুমিয়ে পরলেই হতো। খেয়েছো তো তাই না,

এবার আর থাকতে পারলাম না, কেঁদেই ফেললাম, এতোক্ষন নিয়ে বলতেছে খেয়েছো তো,

-এই এই কি হলো

আমি ঠোঁট উলটিয়ে বললাম, আমি খাই নি,আমি ভেবেছিলাম আপনি আসলে একসাথে খাবো।এজন্য সেই সন্ধ্যা রাত থেকে অপেক্ষা করতেছি আপনি এই মধ্যেরাতে আসলেন।

-আহারে সরি বউটা আমি বুঝতে পারি নি। আসলে অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা তো তাই ওরা ছাড়তে চায় নি। আসো আমি খাইয়ে দিচ্ছি

-না আমি খাবো না

-আসো না, আমিও খাবো আসো

-এমনিতে খুভ খিদে পেয়েছে তাই চুপচাপ খাওয়া শুরু করলাম। খাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি ওনাকে কি জিজ্ঞেস করবো সকাল থেকে কেনো আমাকে এভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু এখন তো আবার ভালোই আছে মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছিলো, থাক কিছু না বলি। খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পরলাম।

,,
পরেরদিন সকালে উঠে দেখি আজকেও নিলয় ভাইয়া আমার আগে উঠে গেছে, ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম। নাস্তা করে একটু খুশিদের (বান্ধবী) যেতে হবে। তারপর ওকে সাথে নিয়ে লাইব্রেরিতে গিয়ে কিছু বই কিনতে হবে।
নিলয় ভাইয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফুপিকে বললাম
ফুপি আমি একটু খুশিদের বাড়িতে যাবো,

-নিলয়কে বল ও রেখে আসবে এখন

-তোমার ছেলেকে তুমি বলে দাও

-ফুপি হেসেঁ বললো,আচ্ছা ঠিকাছে নিলয় তোর বউকে একটু নামিয়ে দিয়ে আয় তো বাবা

-এই ফুপিটাও না মা ছেলে একদম একরকম এর মধ্যে ফুপা এসে সোফায় বসতে বসতে বলতেছে, কি ব্যাপার আমার ছেলের বউ দেখি আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না শশুর হিসেবে কি আমি পারফেক্ট নই নাকি

-আমি কিছু বলতে যাবো তার আগে ফুপি বললো না পারফেক্ট নও তো, কি দিয়েছো ছেলের বউকে তুমি,

-আহ ফুফি ,,থামো না

ফুপা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললো আমার যা কিছু সবি তো আমার ছেলের আর ওর মেয়ের। তবে এখনো যদি আমার মেয়ে আমাকে বাবা না ডাকে তাহলে আমি কি করবো,

ফুপি শুনে বললো, একদম ঠিক পদ্ম এখনো আমাকে মা বলে ডাকে নি, এই মা বলে ডাক

আমি আমতা আমতা করে বললাম, এভাবে চাপ দিলে হবে নাকি, কই নিলয় ভাইয়াও তো আব্বুকে মামা বলে ডাকে ওনাকে তো কেউ কিছু বলে না শুধু আমাকেই বলে, শেষের কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেললাম,

নিলয় ভাইয়া দেখি আড় চোখেঁ তাকিয়ে আছে, এদিকে ফুপা ফুপিও একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছে,
ফুপা বলছে, যে মেয়ে স্বামিকে এখনো ভাইয়া ডাকে সে আমাদেরকে বাবা মা কবে ডাকবে আল্লাহ জানে।আর নিলয় তুই কেনো তোর শশুরকে মামা ডাকিস। এক্ষুনি ফোন দিয়ে বাবা বলবি ফোন দে

-আব্বু এখন কেনো আমি পরে ফোন দিয়ে বলবো

-এর মধ্যে ফুপি বললো, পরে না এক্ষুনি ফোন দিবি তুই

বাবা মায়ের কথার চাপে পরে বেচারা আব্বুর কাছে ফোন দিচ্ছে,আর বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে, আমি না পারছি কিছু বলতে না পারছি কিছু করতে,

-আব্বু ফোন রিসিভ করেই বললো, নিলয় বাবা কেমন আছো

নিলয় ভাইয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ভালো আছি বাবা আপনি কেমন আছেন, আব্বু একটু চুপ থেকে বললো হ্যাঁ আমিও ভালো আছি, ওদিকে সব ঠিকঠাক তো।তোমার আব্বু আম্মু কেমন আছে বাবা

জ্বি ভালো আছে, এই বলে থেমে গেছে, ফুপা আবার ইশারা দিয়ে বলতেছে তোর শাশুড়ির সাথেও কথা বল

বেচারা নিলয় আর কোনো উপায় না পেয়ে বললো, বাবা মা’র সাথে কথা বলতাম

আব্বু এবার জোড়ে হেসেঁই আম্মুকে বলতেছে, কই গেলে পদ্মর মা দেখো তোমার জামাই ফোন দিয়েছে এদিকে আসো।

আব্বুর কথা শুনে ফুপা ফুপি হেসেঁ গড়াগড়ি। আমারো খুব হাসিঁ পাচ্ছে।

ফুপা-এবার পদ্ম আমাদেরকে বাবা মা বলবে কি বলো নিলয়ের মা

ফুপি-হ্যাঁ হ্যাঁ বলতেই হবে

এই রে এবার আমি শেষ, ফুপা ফুপিকে কি এভাবে আব্বু আম্মু ডাকা যায় নাকি। কিন্তু বলতেই হবে, অনেক কষ্টে আব্বু আম্মু বলে ডাক দিয়ে এক দৌড়ে আমার রুমে এসে গেছি, ইশ কি লজ্জা।

নিলয় ভাইয়া এসে তাড়া দিয়ে গেলো, আমি তারাতারি জামা পাল্টিয়ে রেডি হয়ে নিয়ে গেলাম।তারপর ফুপির থেকে বিদায় নিয়ে বাইকে উঠলাম। কেনো জানি মনে হচ্ছে নিলয় ভাইয়া শুধু দায়িত্ব পালন করতেছে,
আমি আবার বেশিক্ষণ মনের মধ্যে কোনো প্রশ্ন চেপে রাখতে পারি না তাই ওনাকে বললাম, আচ্ছা নিলয় ভাইয়া একটা কথা বলবো,

হুমমম

আমি কি কোনো ভূল করেছি,

এমন কেনো মনে হলো,

না মনে হচ্ছে আপনি কেমন যেনো করতেছেন আমার সাথে,, দেখুন আমি চেষ্টা করছি তো আপনাকে ভালোবাসার। মানুষ চাইলে নিজের ভূল শিকার করে আবারো নিজেকে পাল্টাতে পারে। আমি তো বলেছি আমি আপনাকে যথেষ্ট ভালোবাসবো শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা,

নিলয় ভাইয়া গাড়ি দাড় করিয়ে,আমাকে নামতে বললেন। আমি নামতেই একটা গাছের নিচে বসে বলতে লাগলেন,

পদ্ম ফুল,আমি জানি তুমি আমাকে কেনো এই প্রশ্নটা করলে,

চলবে,,