#পান_পাতার_বৌ
বিংশ_পর্ব
~মিহি
-“শানজু বাবা, তুই দেশে আয়। তোর ভাগের আর যা আছে ওগুলো নিয়ে চলে যা। আমি আর তোর বাবা শর্বরীর সাথে থাকবো। তোর যখন টাকাই দরকার, সবই নিয়ে যা।”
-“কিসের টাকা? আর কত টাকাই বা আছে তোমাদের? এক-দেড় লাখ টাকার জন্য যাবো আমি? ফকির পাইছো আমাকে?”
-“দেখ বাবা, আমরা চাই তুই যেখানেই থাক ভালো থাক। তোর বাবা বিশ লাখ টাকার জমি বিক্রি করেছে। শর্বরী সেসব চায় না। তুই না নিলে আমরা সেসব দান করে দিব। তুই ভেবে পরে জানাস আমাকে। রাখি।”
আরজু বেগম খট করে কলটা কেটে দিলেন। শানজু আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। আরজু বেগম কল কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কোন পাপটা বেশি বড়। এমন ছেলেকে জন্ম দেওয়া নাকি এমন ছেলের জন্য সোনার টুকরো মেয়েটাকে পায়ে পিষে ফেলা?
শর্বরী ঘরে বসলো না আর। তার মা এখন কিছুক্ষণ কাঁদবে। সে কান্না বসে বসে দেখতে মোটেও ভালো লাগবে না তার। শর্বরী বাইরে আসতেই রঙ্গনের মুখোমুখি হলো। রঙ্গন বাড়ির উঠোনে বসে। শর্বরী পাশে গিয়ে বসলো।
-“প্ল্যান কাজ করলো?”
-“মনে হয় করবে। যে কিছু টাকার জন্য বাবা মাকে ধোকা দিতে পারে সে লাখখানেক টাকার জন্য দেশে আসতেই পারে!”
-“ধরা পড়ার ভয় আছে একটা। আমার মন বলছে এসব শুধু শানজুর একার কাজ নয়। অন্য কেউ আছে তার সাথে।”
-“মায়ের থেকে শুরু থেকে সবটা শুনতে হবে। আমারো মনে হচ্ছে ভাই একা করেনি এসব। অন্তত টকার মারপ্যাঁচের খেলাটা তার একার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়।”
সীমান্ত চুপ করে বসে আছে। দূরে পূর্ণিমার চাঁদ রূপের বাহার ছড়াচ্ছে। উজ্জ্বল জোৎস্নার আলোয় উঠানখানায় যে সাদার আভা পড়েছে, তাতে শর্বরীর মলিন মুখখানাও কোনো রূপকথার রাজকুমারীর মতো মোহনীয় ঠেকছে।
-“চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
-“এখানে সব ঠিক হলেও হবে হয়তো কিন্তু ও বাড়িতে যে ঝড়টা তুলে রেখে এসেছি তার বিহিত তো দিতেই হবে। আম্মা নিশ্চিত খুব রেগে আছেন। ওনার সাথে কথা হয়েছে আপনার?”
-“না। মা নিজে থেকে কল করেনি, আমিও করিনি। দেখি কতদিন চলে এই রাগপালা! মায়েরও একটু বোঝা উচিত। আমি তো কখনো তাকে অমান্য করিনি তাই বলে সব ভুলে সায় দিব?”
-“আপনি আম্মার সব কথা মেনে এসেছেন অথচ আমি আসার পরপরই যে হঠাৎ বিদ্রোহ তা আম্মার মনে দাগ কেটেছে। সেজন্যই তিনি আপনাকে ভুল বুঝে রাগ করছেন।”
-“ভুল হোক বা ঠিক, মা যতদিন না সবটা ঠিকঠাক করে নিবে ততদিন আমি ও বাড়িমুখো হচ্ছি না। কোয়ার্টারে উঠবো কাল। তুমিও চলো বাবা আর মাকে নিয়ে।”
-“এখন বাড়ি ফেলে যাওয়া উচিত হবে না। আমি আপাতত এখানেই থাকবো, কোনো দরকার লাগলে আপনাকে ডেকে নিবনি।”
সীমান্তর খানিকটা মন খারাপ হলো। সে মেয়েটাকে সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায় অথচ মেয়েটা দূরে দূরে পালিয়ে বেড়ায়। এ তো না-ইনসাফি! স্বামীর হক বোঝেনা, বোকা মেয়ে! সীমান্ত আনমনেই এসব ভাবতে ভাবতে হেসে উঠলো। সে হাসি নজর এড়ালো না শর্বরীর।
-“হাসছেন কেন?”
-“এমনি।”
-“পাগলরা এমনি এমনি হাসে।”
-“হ্যাঁ তো কবে নিজের সাথে পাবনা নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? তোমার তো বোধহয় পরিচিত, তাই না? ওখানেই হানিমুন সেরে ফেলবো।”
-“আমার পরিচিত মানে? এই আপনি আমাকে পাগল বললেন?”
-“না। তুমি নিজে বললে।”
শর্বরী রাগ করে উঠে চলে যেতে নিলে সীমান্ত হাতটা ধরে আটকালো। নিজের আঙুলের ভাঁজে শর্বরীর আঙুলগুলোকে স্থান দিয়ে পরম যত্নের সহিত তাকালো স্বীয় পত্নীর দিকে। মায়াবিনী শব্দটা কি তার স্ত্রীর জন্যই আবিষ্কৃত হয়েছিল কোনোকালে?
_____________________
-“আলেয়াকে টাকা দিব মানে? বুবুকে টাকা দিলে তুই টাকা পাবি কী করে?”
-“আরে মা, আমার পাসপোর্ট ইস্যু আছে কিছু আর ফুপ্পির খুব কাছের এক বন্ধু আমার এখানে আসছে। ওনার হাতে হাতেই টাকাটা পাঠাও, আমি এখান থেকে রিসিভ করবোনি।”
-“দেখ, অনেক টাকার ব্যাপার। আমি রিস্ক নিতে পারবো না।”
-“মা দেখো, আমার টাকা সত্যিই প্রয়োজন। এখানে একেকটা দিন কাটানোও আমার কাছে যুদ্ধ। আমি চাইলেও ফিরতে পারছি না। তুমি শুধু ফুপ্পিকে টাকার ব্যাগটা দিবে। কিছু বলতেও হবে না। বাকিটা আমি দেখবোনি।”
আরজু বেগমের মনে সন্দেহ জন্মালো। হুট করে তার ছেলে এত ফুপ্পিভক্ত কী করে হলো? সন্দেহের তীরটা আলেয়ার নিকট যাওয়ার অবশ্য বেশি বয় কম না। শর্বরীর বিয়ের দায়ভারটাও আলেয়ারাই নিয়েছিল। এমনকি শর্বরীকে বিয়ে দিলে সীমান্তর ভাগের জমি বেচতে সুবিধা হবে এইসব কিছুই আলেয়ার মুখ নিঃসৃত কথা। আরজু বেগম তাতেই মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মানুষের রাগের ক্ষতে পুনরায় ক্ষত করার যে যন্ত্রণা তা মুখে প্রকাশ পায় না অথচ অন্তর্পুর পুড়ে ছারখার করে ফেলে। আরজু বেগম আলেয়াকে কল করতে গিয়েও করলেন না। এই মহিলা চাচ্ছেটা কী? হুট করে শানজু কেনই বা ফুপ্পির উপর বাবা-মায়ের চেয়েও বেশি ভরসা করছে? অবশ্যই কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র তো এর মধ্যে লুকায়িত আছেই।
আরজু বেগম শুরু থেকে সবকিছু বললেন। শর্বরীর বিয়ের তোড়জোড় প্রথমে যে আলেয়াই সংঘটিত করে এসবও বললো সে। শর্বরীও তখন খানিকটা বুঝতে শুরু করলো তবে মূল উদ্দেশ্য এখনো আড়ালে। শুধুমাত্র টাকার জন্যই এ নোংরা খেলা? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে আসছে শর্বরীর। এ মুহূর্তে সীমান্ত আশেপাশে থাকলে একটু স্বস্তি পাওয়া যেত কিন্তু সে তো কোয়ার্টারে। সীমান্তকে সবকিছু বলার জন্য কল করলো শর্বরী। কল রিসিভ হলো না। বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর কল নিজে নিজেই কেটে গেল। শর্বরীর মন খারাপ হয়ে গেল। কোয়ার্টারে উঠলে বুঝি বউকে ভুলে যেতে হয়? না কল না টেক্সট, বউ কল করলেও রিসিভ না করা- সবকিছু মিলিয়ে সীমান্তর কোয়ার্টার লাইফ হলো শর্বরীর সতীন। ব্যস্ত সীমান্তর বোধহয় তার বউয়ের জন্য এক ফোঁটাও সময় হয় না আর। এসব ভেবে নারাজ হয় শর্বরী। পরক্ষণেই আবার নিজের স্বামীর ব্যস্ততা উপলব্ধি করে মন কোমল হয় তার। মিনিট দশেক বাদে শর্বরী আবারো সীমান্তর নম্বরে কল করলো। কল রিসিভ হলো না। আর কল করবে না ভাবতে ভাবতেও আরেকবার নম্বর ডায়াল করলো শর্বরী। ফোন রিসিভ হলো। শর্বরী ঠিক ঈরে রেখেছিল সীমান্তকে আচ্ছা মতো বকবে আজ কিন্তু অপরপ্রান্তের আওয়াজ শুনে শর্বরীর পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে গেল অচিরেই। অপরপ্রান্তে তখনো কোনো এক ভদ্রমহিলা হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছেন। তিনি তো আর জানেন না তার কণ্ঠ ইতোমধ্যে একজনের হৃদয় খুব ভয়ানকভাবে ছারখার করে ফেলেছে। শর্বরীর মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন, কে এই মেয়ে আর কেনই বা সে সীমান্তর কল রিসিভ করলো। প্রশ্নগুলো প্যাঁচালোভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে শর্বরীর মাথায়।
চলবে…
#পান_পাতার_বৌ
একবিংশ_পর্ব
~মিহি
শর্বরী ঘরেই পায়চারি করছে। ইদানিং সে বড্ড সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছে বোধহয়। নয়তো একটা মেয়ে কণ্ঠ শুনেই কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করলো মনটা! আস্ত গাধা সে। সীমান্ত তো পুলিশ, স্বভাবতই লেডি কনস্টেবল থাকবেই থানায়। ফোন রিং হওয়ায় বিনয়বোধ থেকে ভদ্রমহিলা কল রিসিভ করেছিল অথচ শর্বরী মনে মনে কী না কী ভেবে ফেলেছে। অবশ্য ভালোবাসায় পজেসিভনেস বলে একটা কথা আছে না? চাইলেও কাছের মানুষের আশেপাশে অন্য কারো অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। শর্বরী অনুভব করছে সে সীমান্তর ভালোবাসার অতল সাগরে ডুব সাঁতার দিতে গিয়ে সত্যি সত্যি ডুবে গিয়েছে। ঠোঁটের অমলিন হাসিখানার ঔজ্জ্বল্যে তার চেহারাও খিলখিল করে উঠে। পরক্ষণেই মনে পড়ে শানজুর কথা। ঐ ঘটনা নিয়েও তো ভাবতে হবে। সীমান্ত এখন ব্যস্ত, যা করার আপাতত শর্বরীকে একাই করতে হবে। প্রশ্নের জঁটটা আলেয়া ফুপুর বাড়িতেই লেগেছে। সেখান থেকেই জঁট ছাড়াতে হবে। শর্বরী ঠিক করলো ফুপুর বাসায় যাবে। সামনাসামনি কথা বলে জানতে চাইবে এতগুলো টাকা শানজু তার বন্ধুর হাতে পাঠাতে কেন বলছে। সে তো এতটা বোকা না। টাকার ব্যাপারে যে পরিবারের পরোয়া করে না সে তো ফুপুর বন্ধুকে বিশ্বাস করার মতো ছেলে না। যা ভাবা তাই কাজ। আরজু বেগমকে ‘বেরোচ্ছি’ বলে শর্বরী এলো বাসস্ট্যান্ডে। ফুপুর সাথে হিসেব চুকিয়ে সীমান্তর কাছে যেতে হবে। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির অবস্থাটাও দেখতে হবে। যত যাই হোক সালমা খানম তাকে বাইরে থেকে হলেও মেয়ের মতো স্নেহ তো করেছেন। মাথায় ভাবনাচিন্তাগুলো চালু রেখে শর্বরী পৌঁছালো ফুপুর বাড়িতে। আলেয়া তখন ছাদে ছিলেন। আচমকা শর্বরীকে একা আসতে দেখে তার মুখ শক্ত হয়ে আসলো। চটজলদি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো সে।
_____________
-“ফুপু, হাত খোলো আমার। আমি কথা বলতে এসেছি শুধু।”
-“তোর হাত খুলবো? তোকে মেরে ফেলবো আমি। আমার সব পরিকল্পনা বরবাদ করতে চাস তুই? তোর বাবা-মাকে পথে না বসানো অবধি আমি থামবো না।”
-“ফুপু, এসব কী বলছো? ওনারা তোমার ভাই-ভাবী।”
-“কিসের ভাই ভাবী? তোর মায়ের জন্য আমি বিশ বছরের সংসারে শুধু মার খেয়ে পড়ে থাকছি। আমাকে তাড়ানোর তাড়া তোর মায়ের। না দেখে বিয়ে দিল খুব ধনীর ঘরে। টাকা-পয়সা হাতানোর কী দারুণ মতলব! আমার কথা ভাবলো একবার? স্বামীর অত্যাচার মানলাম, দেবর এমনকি চাচা শ্বশুর অবধি আমায় ধর্ষণ করেছে। সেসব তোর মাকে বলেছিলাম। সে কী বলেছিল জানিস? মানিয়ে নাও! মানিয়ে নিব? আমি কী মানিয়ে নিতাম? যে যখন যার ঘরে ডাকবে, ফুলবউ সেজে তার বিছানায় গিয়ে পড়তে?”
আলেয়ার সারা শরীর কাঁপছে। কত বছরের জমানো ক্রোধ আজ উগড়ে বের হচ্ছে তা সে মনেও করতে চায় না। ঐ দুর্বিষহ জীবনটা তাকে মনে মনে দানবীতে পরিণত করেছে। এই পরিবারের সবাইকে সে ঘৃণা করে এসেছে এতকাল। স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়িটা ফাঁকা হয়েছে। এই ফাঁকা বাড়িতেও নিজের আত্মচিৎকার শুনতে পায় আলেয়া। তার উপর হওয়া প্রতিটা অত্যাচার তার স্বামীও দেখেছে। কাপুরুষ মেরুদণ্ডহীন লোকটা কেবল দেখে গেছে। আলেয়ার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো লোকটার গলা টিপে মেরে ফেলতে। শেষমেশ লোকটা একসময় অনুতাপেই মরলো। সমস্ত রাগটা এখন তার পড়েছে ভাই-ভাবীর উপর। শানজুকে হাতে আনা কঠিন ছিল না। টাকার গন্ধ সে এমনিতেই পছন্দ করে। শর্বরীর জমির লোভ দেখিয়ে প্রথমে শানজুকে হাত করেছে সে। এরপর আরজুকে বুঝিয়ে শর্বরীর বিয়ের ব্যবস্থা করেছে যেন শর্বরী ওদের বাঁচানোর জন্য না থাকতে পারে। বাড়ি বন্ধকের খবর পাওয়ার পর থেকে সে অপেক্ষা করছিল কবে ওর ভাই ভাবী রাস্তায় নামবে অথচ এই শর্বরী কিনা ওদের নিজের শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইছে! আবার কিনা বিশ লাখ টাকার জমিও বিক্রি হয়েছে! কই, এসব জমির কথা তো তাকে কখনো জানানো হয়নি। এখানেও ধোঁকা খেয়েছে সে! সবকিছুর শাস্তি এখন শর্বরী পাবে। আলেয়া পাগলের ন্যায় প্রলাপ বকছে। শর্বরীর হাত পেছনে বাঁধা। নিজের ফুপুর এ রূপ সে আগে দেখেনি। তবে ফুপুর জমে থাকা আর্তনাদ যে কী রূপ নিয়েছে তা ঠিকই টের পাচ্ছে সে। নিজের মায়ের প্রতি আজ প্রচণ্ড ঘৃণা অনুভব হচ্ছে তার। কিভাবে পারলো সে? ননদ তো বোনের মতো! সেই বোনের সাথে হওয়া নিকৃষ্ট অত্যাচারের বিবরণ জেনেও সে কী করে বলতে পারলো সব মেনে নিতে? আলেয়া যদি আজ রাগের মাথায় শর্বরীকে খুনটাও করে ফেলে শর্বরী দ্বিরুক্তি করতে পারবে না। এটা কর্মফল, তার মায়ের করা পাপের কর্মফল! শর্বরী মনে করার চেষ্টা করলো তার হাত কখন বাঁধা হয়েছে। সে যখন দরজার কাছে আসে তখন সীমান্তর কল এসেছিল। ফোনের সাথে ইয়ারফোন কানেক্ট করা ছিল বলে রিং হয়নি, কেবল ভাইব্রেট হয়েছে। ফোন রিসিভ করার আগেই দরজা খুলে যায়। সামনে কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু এগোতেই শর্বরীর মাথার পেছনের দিকে ভারী কিছুর আঘাত লাগে। সাথে সাথে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে সে। ঘটনাটা মনে পড়েছে। আঘাতটা খুব বেশি জোরে না হলেও শর্বরী মাথার পেছনে রক্তের উপস্থিতি টের পাচ্ছে। আলেয়া বেগম সত্যিই কি তাকে মেরে ফেলবে এখন? শেষবারের মতো সীমান্তর সাথে কথাটুকুও বলতে পারবে না সে? একটা শেষ চেষ্টা করা প্রয়োজন!
-“আমার মায়ের দোষ ছিল ফুপু কিন্তু তোমার দোষটা সবচেয়ে বেশি! তুমি প্রতিবাদ করোনি। মা তোমাকে চুপ থাকতে বললেই তুমি চুপ থাকবে? কেন? তুমি চাইলেই এই পরিবারের সবাইকে কোর্টে নিয়ে গিয়ে শাস্তি পাওয়াতে পারতে!”
-“ক্ষমতা শব্দটার সাথে পরিচয় আছে তোমার? যেখানে নিজের পরিবার, একমাত্র ভাইটাও সাহায্য করেনি সেখানে একা কোর্টে কোন সাহসে যেতাম আমি?”
-“বাবা আদৌ এসব জানতো?”
-“ভাবী বলেছিল ভাইকে কিন্তু ভাই কর্ণপাত করেনি।”
-“এ কথা বাবা নিজে বলেছে?”
-“না ভাবী বলেছে।”
-“আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে ফুপু? এত বোকা তুমি? বাবা জানলে কখনো তোমাকে এ নরকে রাখতো না। তুমি মনে করে বলো তো বাবা এখানে দেখা করতে আসলে তুমি কখনো নিজে থেকে বাবাকে বলেছো এসব অত্যাচারের কথা?”
-“না আমি ভেবেছি ভাই এসব নিয়ে কথা বাড়াতে চায় না।”
শর্বরী চুপ হয়ে গেল। আলেয়া বেগমকে একটু ভাবার সময় দেওয়া উচিত। সময়টা মূলত শর্বরী নিয়েছে নিজের জন্য। যতক্ষণ সে আলেয়াকে প্যাঁচে ফেলে ঘোরাতে থাকবে ততক্ষণ সে বেঁচে থাকার সময় পাবে। শর্বরী আচমকা অনুভব করলো আলেয়া বেগম কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে যেন অগ্নিগোলক নির্গত হবে এখনি। শর্বরী সেদিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না বেশিক্ষণ।
-“তোর মায়ের জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে এ নরকে এসে পড়েছিলাম। এখন তোকে মারলে তার যায় আসবে? সে তো তোকে ভালোই বাসে না। তোকে আমি মারবো কিনা এটা নিয়ে আমি ভাববো কিছুক্ষণ। তোকে বাঁচিয়ে রাখা রিস্ক আমার জন্য। তার চেয়ে ভালো মরেই যা। তোর মা তো কাঁদবে না, ওর জন্য আরো কান্নার বস্তু অপেক্ষা করছে। কাঁদবে হয়তো সীমান্ত, আহারে ছেলেটা!”
শর্বরীর মনে ভয় ঢুকলো এবার, সীমান্তর থেকে একেবারে দূরে সরে যাওয়ার ভয়। জীবনে সামান্যটুকু ভালোবাসাটাও সে পায়নি। যখন আকাশসম ভালোবাসার একটা মানুষ হলো, তখন ভাগ্য তাকেই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। এত নিষ্ঠুর-নির্দয় কেন নিয়তি? শর্বরী কোন পাপ করেছে যার এমন ভয়াবহ মাশুল তাকে দিতে হচ্ছে?
চলবে…