#প্রণয়ের_আসক্তি
২৭.
#WriterঃMousumi_Akter
নিরবের অপেক্ষায় বসে আছে মৃথিলা ফুলে সাজানো বাসর ঘরে।এক বুক আনন্দ আর ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষা করছে নিরবের জন্য।প্রতিটা মেয়ের কাছেই ফুলের বাসরে বসে অপেক্ষা একটা স্বপ্ন।
–নিরব যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কেউ কলিং বেল বাজাচ্ছে।মৃথিলা উঁকি মেরে দেখে বাইরে মেধা কলিং বেল বাজাচ্ছে।মেধা কে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুলে দিলো মৃথিলা।পরনে ব্লু জিন্স, গায়ে জিন্স এর শার্ট, পায়ে কালো বুট, ছেলেদের লুকে আজ মেধা।আগে এমন পোশাকে দেখে নি মেধাকে।মৃথিলা মিষ্টি হেসে বললো আরে আপু তুমি।
‘মেধার মুখে আজ হাসি নেই রহস্যময় ভাবে বললো,নিরব কোথায় মিথু?’
‘ও তো বাইরে গিয়েছে আপু?’
‘বেশ সেজেছিস তো।একদম নয়া বউ নয়া বউ লাগছে।’
‘হ্যাঁ আপু সুপ্তি আর মুনতাহা ভাবি সাজিয়েছে।’
‘খাটে সাজানো ফুল হাত দিয়ে ছিড়ে বললো,এই ফুল গুলো বেশ সুন্দর তাইনা?নাকে ফুলের সুবাস নিয়ে বললো,সুঘ্রান এ ভরপুর এই ঘর।বলেই খাটের এক সাইডের ফুল ছিড়ে ফেললো মেধা।’
‘মৃথিলার কেমন যেনো লাগছে মেধার ফুল ছেড়া দেখে।হ্যাঁ আপু সুন্দর এই ফুল।’
‘যে ফুল যত সুন্দর সে ফুলে তত বেশী কাঁটা থাকে জানিস তো।’
‘না না আপু উনি কোনো কাঁটা যুক্ত ফুল আনেন নি।’
মেধা একেক করে সব ফুল ছিড়তে শুরু করলো।
‘মৃথিলার কাছে বেশ সন্দেহজনক লাগছে মেধাকে।খানিক টা অস্বাভাবিক লাগছে।পোশাক, কথা বার্তা,চাহনি সব কিছুই ভয়ংকর লাগছে।মৃথিলা নিরবকে একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে।মেধা হাত থেকে ফোন টা কেড়ে নিয়ে বললো,কি বলবি নিরবকে?কষ্ট করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই আমি সব ভিডিও করছি ওকে।’
‘কি হয়েছে আপু তোমার?এমন করছো কেনো?এভাবে কথা বলছো কেনো?’
‘কেনো ভয় পাচ্ছিস মিথু?’
‘না আপু,, মানে তোমাকে যেনো কেমন লাগছে।’
‘ভয় পাওয়ার আগে তোর মনে রাখা উচিত ছিলো নিরব শুধু আমার। মেধা মৃথিলা মুখ হাত দিয়ে খুব জোরে চেপে ধরে বললো,দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পুষেছিলাম আমরা।তুই নিরব কে কেড়ে নিয়েছিস আমার থেকে।আমি কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছিলাম জানিস।নিরব ছাড়া একটা রাত ও ঘুম হয় নি আমার।তুই বোন হয়ে কিভাবে আরেক বোনের ভালবাসা কেড়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করছিস।আজ এই বাসর ঘরে আমার বসে থাকার কথা ছিলো সেখানে আজ তুই বসে আছিস বলেই মৃথিলার মুখ ছেড়ে দিলো।’
মৃথিলার গাল দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।মৃথিলার নিঃশ্বাস এত সময় আটকে ছিলো।হাঁপাতে হাপাতে বললো আপু তুমি এসব কি বলছো,তুমি না তখন বলেছিলে এটুকু বলেই আটকে গেলো মৃথিলা।
মেধা মৃথিলার গালে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরে বললো,তো আমি কি করতাম তখন।তোর চোখে মুখে স্পষ্ট নিরবের জন্য ভালবাসা দেখেছিলাম।মৃথিলার আরেক গালে আরো জোরে একটা থাপ্পড় মেরে বললো বেঈমানির শাস্তি তোকে পেতেই হবে।নিরবের প্রতি তোর ভালবাসা আর নিরবের তোর প্রতি ভালবাসা মানে দুজনে মিলে আমাকে ঠকিয়েছিস।আমাকে ঠকিয়ে সুখে থাকবি দুজনে।মেধার মুখে পৈচাশিক আনন্দ।মৃথিলাকে আরো কয়েক টা থাপ্পর মেরে খুব জোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো।মৃথিলার মাথা ওয়ালের সাথে খুব জোরে গিয়ে লাগলো।ভয়ে মৃথিলার হৃদপিন্ড কাঁপছে।গাল মুখ কেটে গিয়েছে রক্ত এক ভাবে গড়িয়ে পড়ছে।মাথার ভিতর আচমকা ঘুরে উঠলো,চোখে ঝাপসা দেখছে।কপাল কেটে গিয়েছে খানিক টা।
‘মৃথিলা বললো,তাহলে কেনো তখন বললে না আপু।বললে তো আমি সরে যেতাম।আমি কখনো তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি আপু।’
‘এখন সরে যা মিথু, পারবি না সরে যেতে।’
মৃথিলার কন্ঠে কাঁন্না,’না আপু আমি পারবো না।আমি উনাকে ভালবাসি আপু,ভীষণ ভালবাসি।এই মুহুর্তে উনি ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা আমি।’
‘মেধা ব্যাগ থেকে একটা চেইন বের করতে করতে বললো,এতই ভালবাসিস যখন তাহলে মরে যা মিথু।যারা জীবনে ভীষণ ভালবেসেছে তারাই জীবন দিয়েছে।মরতেই পারবি মিথু?’
‘মৃথিলার বুঝতে বাকি রইলো না মেধা তার সাথে কি করতে চলেছে।মৃথিলা বললো,আপু তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো এসব কি বলছো তুমি।’
‘আমাকে তুই আর আপু ডাকবি না মিথু।আমার সাথে তোর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।’
–মেধা ব্যাগ থেকে একটা মোটা চেইন বের করে মৃথিলাকে আঘাত করেই যাচ্ছে।প্রতিটা আঘাতে কেটে যাচ্ছে মৃথিলার শরীর।কাটা জায়গা থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।মৃথিলা ব্যাথায় লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।সমস্ত শরীর রক্তাক্ত মৃথিলার।মেধা তার অত্যাচার বন্ধ করলো না।একভাবে কত সময় আঘাত করে মেধা নিজেই ক্লান্ত হয়ে মৃথিলার কাছে গিয়ে বসে বললো এবার বল নিরব কে ছেড়ে চলে যাবি।
–মৃথিলা কষ্টে কথা বলতে পারছে না,ব্যাথার যন্ত্রণায় কোকাচ্ছে,চোখ ভরা পানি,কথা বলার শক্তি পাচ্ছে না,শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, বলতে পারছে না।মেধার পায়ে ধরে বললো,প্লিজ আপু আমাকে আর মেরো না,আমি তাহলে মরে যাবো।আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
–মেধা খুব জোরে হাসলো ঘরের দেয়ালে প্রতিদ্ধনি হচ্ছে মেধার হাসিতে।পৈচাশিক হাসিতে চারপাশ স্তব্ধ, এই জড় বস্তগুলোর ক্ষমতা থাকলে নিশ্চয় প্রতিবাদ করতো এই মর্মান্তিক অত্যাচারের।
–মেধা বললো,বল তুই নিরব কে ছেড়ে যাবি।
–আমি উনাকে ছেড়ে যেতে পারবো না আপু, তোমার পায়ে ধরছি আমাকে মেরো না তুমি,আমি উনার সাথে বাঁচতে চাই।আমি আমার জন্য না হলেও উনার জন্য বাঁচতে চাই।প্লিজ আমাকে আমার জীবন ভিক্ষা দাও।আমাকে অনেক অত্যাচার করেছো তুমি এইবার আমাকে ছেড়ে দাও আপু।আমি কাউকে বলবো না আজকের কথা।আমি তোমার উপর ও অভিমান করে থাকবো না।
–মেধা মৃথিলার গলা চেপে ধরে নিজের রাগ আরো খানিক টা বাড়িয়ে বললো,,তুই এমনিতেই খুব বেশীদিন বেঁচে থাকার জন্য আসিস নি।তোর মৃত্যু এমনিতেও নিশ্চিত ছিলো।ঠিক এই মুহুর্তে কেমন লাগছে মিথু তোর।নিরব ছাড়া ওপারে পাড়ি জমানোর জন্য রেডি হয়ে নে।তোকে হারানোর পরে নিরব বুঝবে ভালবাসা হারানোর যন্ত্রণা।মৃথিলার পরনের বেনারসি খুলে নিয়ে বললো,তোর পরনের এইসব বেনারসি আমার গায়ে আরো জ্বালা করছে।
–নিষ্পাপ, বাচ্চাসুলভ সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা আধমরা হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে।চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।সমস্ত শরীর রক্তাক্ত।নিরবের কাছে যাওয়ার জন্য কাকুতি, মিনতি করছে।ক্লান্ত, রক্তাক্ত শরীরে মেধাকে বলছে, আমাকে একটা বার উনাকে দেখতে দাও আপু,উনার দেখার জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার,আমাকে তো মেরেই ফেলবে তুমি আমার শেষ কথাগুলো হয়তো কোনদিন উনার কাছে পৌছাবে না বাট আমি উনাকে আমার প্রাণের থেকেও ভীষণ বেশী ভালবাসি।উনাকে দেখার জন্য ভীষণ ভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে আমার ভেতর টা।আমি জানি তুমি আমাকে মেরে ফেলবে। আমি মরে যাবো সেজন্য কষ্ট হচ্ছে না,নিরবের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।আমার নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমার এই শেষযাত্রায় বয়ে চলা প্রতিটি নিঃশ্বাস, আমার শরীর থেকে পড়া প্রতিটি রক্ত বিন্দু চিৎকার করে নিরব নিরব করছে।আমি উনার বুকে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারলাম না।উনার সাথে আরো কয়েক টা দিন বাঁচার বড় শখ ছিলো আমার।দৃশ্য টা হৃদয় কাঁপানো ছিলো,অত্যান্ত মর্মান্তিক ছিলো,চোখে দেখে সহ্য ক্ষমতার বাইরে ছিলো,যে কারো চোখে পানি আসার মতো ছিলো মৃথিলার কাকুতি গুলো আর নিরবের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ।
–নিরবের প্রানের থেকে প্রিয় মানুষ টার না থাকা কি নিরব কিভাবে সহ্য করবে।
–মেধা মৃথিলাকে বললো,এই ভালবাসার পরিণতি তোর জীবন কেড়ে নিচ্ছে তবুও তুই এই ভালবাসার প্রলাপ করেই যাচ্ছিস।
–তুমি ভালবাসার কি বুঝবে,তোমার মাঝে শুধু একজন মানুষকে পাবার আসক্তি,প্রতিহিংসা।প্রণয় কি তুমি সেটা জানো না,ভালবাসা কি তুমি সেটা জানো না,ভালবাসার আসক্তি বুঝলে এইভাবে আমাদের আলাদা করতে পারতে না।
–মেধা দুজন কে ডেকে বললো, ওকে সমুদ্রে ডুবিয়ে ভাষিয়ে দে কেটে কয়েক টুকরো করে।তাহলে সমুদ্রের অভুক্তমাছেরা আমার জন্য দোয়া করবে।
–মৃথিলার সমস্ত শরীর শিউরে উঠলো।এমন ভয়ানক মৃত্যুর কথা শুনে।এটাই কি ছিলো তবে ভবিতব্য।
মৃথিলাকে বস্তায় ভরে সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যাওয়া হলো।বস্তা থেকে বের করার পর ও বেঁচে আছে মৃথিলা।কোনো রকম নিঃশ্বাস বইছে মৃথিলার।প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মেধা পানিতে ডুবিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রাখলো,পানির উপরে বুডবুড শব্দ হচ্ছে।মৃথিলা নিজের শক্তি দিয়ে উঠে আসলো মেধা কে ধাক্কা দিয়ে।পানিতে ভেজা মৃথিলা সমস্ত শরীরে কাটা কাটা দাগ।ক্লান্ত ভাবে ডাকছে নিরব, চোখ বুজে যাচ্ছে।মেধা বার বার পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে মৃথিলাকে, মৃথিলাকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পেরে উঠছে না শক্তির সাথে।যখন সমস্ত শক্তি হারিয়েছে তখন আকাশ পানে তাকিয়ে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলে বললো,জন্ম,মৃত্যু তো তোমার ই হাতে।তুমি যদি এমন মৃত্যু ই লিখে রাখবে তাহলে এমন ভালবাসা কেনো দিয়েছিলে আমাকে।আমাকে ফিরিয়ে দাও উনার কাছে।
-মেধা বললো এখনো নিরব নিরব করছিস।কন্ঠে গর্জন মেধার।
ও ছাড়া আমার কেউ নেই।আমার জীবনের শুধু পারফেক্ট নয় পারমানেন্ট মানুষ উনি।ভীষণ কাঁদছে মৃথিলা।মেধা কে বলছে ও তোকে ছাড়বে না, এর থেকেও ভয়ঙ্কর মৃত্যু হবে তোর। নিরব কাউকে ছাড়বে না।আমি চলে যাচ্ছি,জানিনা কিভাবে আমাকে ছাড়া আপনি থাকবেন,আমার না থাকায় কে আপনাকে সামলাবে জানিনা ভীষণ ইচ্ছা ছিলো আপনার সাথে আরো কয়েক টা যুগ কাটানোর।কেনো আমাকে একা রেখে গেলেন,এই একাকিত্ব আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে আপনাকে।আমাকে ছাড়া আপনার এই ভীষণ কষ্ট আমি শুধু দেখতে পারবো, আপনার চোখের পানি মুছে দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে না আমার।পানিতে অচেতন হয়ে পড়ে গেলো মৃথিলা।পানিতে পড়ার সময় অচেতন হতে হতে বললো,”তোমার সাথে শেষ দেখা হলোনা আমার,ভালবাসার শেষটা এতটা করূণ, মর্মান্তিক,কষ্টের,বেদনাসিক্ত না হলেও পারতো।”
পানি ঝাপতানোর বিশাল শব্দে এক ঝাক পাখি উড়ে গেলো,সমুদ্রে উঠেছে বিশাল তুফান।পানি রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।সমুদ্রে শুরু হয়েছে বিশাল গর্জন।
নিরবের ফোনে মৃথিলার ফোন থেকে এমন ই একটি ভিডিও পাঠানো হয়।যে ভিডিও তে মৃথিলা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। নিরব গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ফ্লোরে ঘুষি মারলো।পৃথিবী থমকে গেলো নিরবের।মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো।পৃথিবীর সব কিছু চক্রাকারে ঘুরছে নিরবের।চোখ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে পানি।মৃথিলার সাথে এমন ভয়ানক কিছু হওয়ার জন্য নিজেকেই দায়ী ভাবছে নিরব।সমস্ত শরীর কাঁপছে নিরবের।হিংস্র নজরে তাকালো মঈন সিদ্দিকীর দিকে।ছুরি দিয়ে গলা কাটতে যেতেই রিফাত ধরে বললো আগে ভাবিকে বাঁচাতে হবে।
মঈন সিদ্দিকী বললো,তোমার উচিত হয় নি মৃথিলাকে এভাবে ছেড়ে আসার
আমাকে মেরে শান্তি পেলে মেরে যাও।কিন্তু মৃথিলার সাথে এমন কিছু হবে জানতাম আমি।তুমি আমাকে বেশী গুরুত্ব দিতে গিয়ে যেটা বেশী গুরুত্ব দেওয়ার সেটা দিতে পারো নি।নিরব মঈন সিদ্দিকীর গলা চেপে ধরে বললো আমি তোকে ছাড়বো না।
মঈন সিদ্দিকী বললো,আমি জানতাম মেধার রাগ আছে মৃথিলার উপর। আমি শুধু সে রাগের আগুন আরো বাড়িয়ে দিয়েছি।
চলবে,,