#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৮
সারাদিন মেহেরের মনমরা হয়েই কাটে।মাতৃত্বের স্বাদ হলো মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর মেহের সেই স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না।এরচেয়ে বড় দুঃখ আর কিইবা হতে পারে মেহেরের জন্য। এই ভেবেি সারাদিন মেহেরের মন খারাপ থাকে।আর তাছাড়া যে মানুষ টা তাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দেয়নি কিভাবে পারবে মেহের তার সাথে সারাটাজীবন কাটাতে?তার শ্বাশুড়িও তাকে পছন্দ করেন না। হঠাৎ মীরার ডাকে মেহেরের ধ্যান ভাঙলো।মীরা এসে মেহেরের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
-“একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি করছো ভাবী?”
মেহের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মুচকি হেসে বললো,
-“কিছু না মীরা।তুমি কি কিছু বলবে আমায়?”
-“আজ কলেজ নেই আমার।তাই আজ সারাদিন তোমার সাথেই থাকব।”
-“আন্টি একা একা রান্না করছেন,আমি কি যাব?”
-“মা তো তোমায় যাওয়ার পারমিশন দেয়নি ভাবী।যেচে কেন বকা খেতে চাইছ?”
-“পারমিশন দেননি ঠিক আছে। কিন্তু গতকাল থেকে একবারো না ও তো করেননি।”
-“হ্যা।আমার কি মনে হয় জানো?”
-“কি?”
-“মা তোমার রান্না খেয়ে বশ হয়ে গেছে!”
বলেই মীরা হো হো করে হাসতে লাগলো।মেহের চোখ রাঙালো। তারপর বললো,
-“মজা করিও না তো।”
-“আচ্ছা বাবা করলাম না। আচ্ছা ভাবী,ভাইয়ার সাথে কেমন যাচ্ছে?”
বলেই মেহেরকে মজার ছলে কাঁধে নিজের কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলো মেহের।মেহের কোণাচোখে তাকিয়ে বললো,
-“আজ তুমি বেশ মজার মুডে আছো তাই না?”
-“হ্যা তা ঠিক।এখন বলো না!”
-“উফ!কি বলব?”
-“ওইযে ভাইয়ার সাথে কেমন যাচ্ছে!”
-“সবটা জেনেও কেন এমন বলছ মীরা।”
-“মানে?কিছু হয়নি এখনো?”(অবাক হয়ে)
-“কি হবে!”(বিরক্তি নিয়ে)
-“প্রেম -ভালোবাসা কিছু জাগেনি?”
-“ওই ভাল্লুকের ভালোবাসা জাগবে আমার প্রতি?হাহ!”
-“ভাল্লুক?”
মীরা আরেক দফা হেসে দিলো।এদিকে মেহের বেশ সিরিয়াস।তা দেখে মীরা কোনমতে হাসি থামিয়ে বললো,
-“আচ্ছা বুঝলাম।এখনো তাহলে কিছুই হয়নি।”
-“….”
-“আচ্ছা ভাবী, একটা প্রশ্ন করি?”
-“হু।”
-“তুমি চাওনা ভাইয়ার সাথে সংসার করতে?মানে তোমার মন কি চায়?”
মেহের কিছুটা সময় নিলো।বারান্দায় কোনো বসার মত জায়গা নেই।মেহের ঘরে ঢুকলো। বিছানায় বসতে বসতে বললো,
-“ভলোবাসা হলো দুটো মনের মিলন।আর সংসার হয় ভালোবাসার বন্ধনের মাঝে।এখন, দুইটা মনের মধ্যে যদি মিল ই না থাকে তাহলে ভালোবাসা হবে কিভাবে আর সংসারই বা হবে কিভাবে?”
-“তাহলে তুমি থাকতে চাওনা আমার ভাইয়ের সাথে?”
-“সেটা না।আমার বিয়ে একবারই হয়েছে। আমার ভাগ্যে আরবাজের নাম লেখা ছিল বলেই সে আমার স্বামী।এখন বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন।সে তো আমার স্বামী।কিন্তু মীরা,সে যদি আমায় না চায় তাহলে কি আমি জোর করে থাকতে পারব?আর তাছাড়া তুমি তো জানোই আমার সমস্যার বিষয়ে। কেই বা তার জীবন নষ্ট করবে আমার জন্য?”
বলতে বলতে মেহের মাথা নিচু করে ফেললো।মীরা কি বলবে বুঝতে পারছে না।মেহের কাঁপা গলায় বললো,
-“আরবাজের সাথে আমার সম্পর্ক টা হয়ত কখনো ঠিক হবে না।উনি আমায় কোনোদিনও স্ত্রীর স্বীকৃতি দেবেন না। কেননা উনি আমায় ভালোবেসে বিয়ে করেননি,করেছেন আংকেলের কথায়।আমাদের সম্মান বাঁচাতে।আর আমার এত বড় সমস্যার পরেও উনি আমাকে কেনই বা মেনে নিবেন।আমার তো মনে হয় কদিন পরই উনি আমায় ড..ডিভোর্স…”
এতটুকু বলে মেহের ডুকরে কেঁদে উঠলো।আর থামানো গেল না নিজেকে।হঠাৎ করে কেঁদে ফেলায় মীরা হকচকিয়ে গেল।মেহেরকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলতে লাগলো,
-“ভাবী ভাবী,দেখো হাল ছেড়ে দিলে তো চলবে না তাই না।”
-“….”
-“সংসার টা এখন তোমারি।সবার মনে জায়গা করে তোমারি নিতে হবে।বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন।হয়ে তো গেছে। নিয়তির লিখন তে আর পাল্টানো যাবে না তাই না।আল্লাহ হয়ত তোমার ভালোর জন্যই ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে লিখে রেখেছিলেন”
মেহের মীরার কথা শুনে কোনোমতে নিজেকে থামালো।তারপর শান্ত হলো।মীরা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
-“তুমি মনে হয় রাতেও কাঁদো তাই না?ইশশ!কালে হয়ে যাচ্ছে চোখের নিচে!”
-“….”
-“আর কেঁদো না।”
মেহের নিজেকে সামলে নিলো।নিচের দিকে তাকিয়েই
বললো,
-“আচ্ছা মীরা একটা কথা বলি?”
-“হু।”
-“আমি কি তোমার ঘরে ঘুমাতে পারি?”
-“হ্যা অবশ্যই। কিন্তু কেন বলোতো?ভাইয়া কিছু বলেছে?”
মেহের কি বলবে বুঝতে পারছে না।আরবাজ যে তাকে সোফায় ঘুমাতে বলে সেটা কি আর মীরাকে বলতে পারবে!হাজার হোক সেটা তো একটা প্রাইভেট কথা।কিভাবে বলবে সে!মীরা হয়ত বুঝে গেছে। তাই আর মেহেরকে প্রশ্ন করলো না।হালকা হেসে বললো,
-“আচ্ছা আজকে থেকে আমার সাথেই রাতে থেকো।”
মেহের মাথা দুলালো।হঠাৎ মেহেরের শ্বাশুড়ি মীরাকে ডাকতে লাগলেন আরবাজের রুমের দরজা থেকে।কিন্তু ঘরে ঢুকলেন না।মেহের আর মীরা উঠে দাঁড়ালো।মেহের সামনে গিয়ে বলতে লাগলো,
-“আন্টি আপনি বাহিরে দাঁড়িয়ে ডাকছেন কেন?ঘরে আসলেই তো হত।”
-“এখন কি আর ছেলের ঘরে ঢুকতে পারব?এখন ঢুকতেও তো পারমিশন লাগবে।আর কারো পারমিশন নিয়ে কাজ করার মত দিন আমার এখনো আসেনি।”
বলেই মুখ বেঁকিয়ে ফেললো শেহনাজ পারভীন।মেহের হাসার চেষ্টা করে বললো,
-“এটা আপনি কি বলছেন আন্টি!আপনার ছেলের ঘরে ঢুকতে আপনার পারমিশন নিতে হবে?”
শেহনাজ পারভীন মেহেরের কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলেন না।মীরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“মীরা রান্নাঘরে আয়।”
-“মা আমি…”
-“হ্যা তুই।শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে না?ওখানে কি কাজ করবি না?নাকি ম্যামসাহেব সেজে বসে থাকবি আর বুড়ো শ্বাশুড়িকে খাটাবি।”
মেহের আর মীরা ঠিকই বুঝলো যে কথাটা মেহেরকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। তাইতো মীরা মেহেরের দিকে তাকালো।মেহের বলতে লাগলো,
-“আন্টি ওর কষ্ট করা লাগবে না। আমি করে দিই?”
-“কি করবে তুমি?”
-“র..রান্না।মানে আপনি যদি পারমিশন দেন তাহলে আমি রান্না টা করে দিই?”
ভয়ে ভয়ে বললো মেহের।ধরেই নিল তার শ্বাশুড়ি এখন তাকে ধুয়ে দিবে।শেহনাজ পারভীন কড়া গলায় বললেন,
-“সকালে কার পারমিশ নিয়ে গেছিলে যে এখন পারমিশন লাগবে?”
-“না আসলে….”
-“ঢং!যাও যা পারবে করো গিয়ে।আজ শরীর ভালো না আমার।”
মেহেরের খুশি দেখে কে!খুশি হয়ে সে প্রায় শেহনাজ পারভীন কে জড়িয়েই ধরলো।জড়িয়ে ধরেই বললো,
-“থ্যাংক ইউউউ!”
মীরার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।মেহের কি খুশির চোটে পাগল হয়ে গেল নাকি।শেহনাজ পারভীন বেকায়দায় পড়ে গেলেন।আর বলতে লাগলেন,
-“এই!কি হচ্ছে টা কি।”
মেহের ছেড়ে দিলো।জোরপূর্বক হেসে বললো,
-“সরি সরি।সরি আন্টি।আসলে বেশিই এক্সাইটেড হয়ে গেছিলাম।”
-“নাটক যত্তসব!”
মেহের রান্না করতে চলে গেল।পিছন পিছন মীরাও গেল।শেহনাজ পারভীন ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
।
আজ আরবাজ একটু তাড়াতাড়িই বাসায় ফিরলো।রাত তখন নয়টা।মেহের তখন রান্না করতে ব্যস্ত।দরজা খুলে আরবাজকে দেখে তার মা শেহনাজ পারভীন বলতে লাগলেন,
-“আজ তাড়াতাড়ি চলে এলি বাবা।”
-“হ্যা মা,আজ চাপ কম ছিল।”
-“আচ্ছা যা ফ্রেশ হয়ে নে।টেবিলে খাবার বাড়ছি।”
আরবাজ মাথা নাড়িয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।
কিন্তু ঘরে ঢুকে মেহেরকে দেখলো না সে।ড্রয়িংরুমেও নেই।আরবাজের মনে কেন যেন প্রশ্ন জাগলো মেহেরকে নিয়ে।তাহলে কি মেহের মীরার ঘরে?হতেও পারে!সারাদিন তো দুজম চিপকে থাকে।আরবাজ আওড়ালো,
-“বিয়ে আমি করেছি,অথচ সারাদিন থাকে মীরার সাথে।”
এ কথা বলে আরবাজ নিজেও অবাক।
-“থাক না।তাতে আমার কি।কি আশ্চর্য!একে নিয়ে এত ভাববার ই বা কি আছে।”
ভেবেই আরবাজ ফ্রেশ হতে চলে গেল।খানিক্ষন পর বের হয়ে দেখলো তার টি-শার্ট আর ট্রাওজার বিছানায় রাখা রয়েছে। আরবাজ অবাক হলো।তার মা রেখেছে?কিন্তু মা তো কখনো এমন করে না।আর করলেও তো আমায় এসে ডাক দিবে।চুপচাপ তো চলে যাবে না।তাহলে?মেহের?কথাটা ভেবেই আরবাজ অবাক হয়ে গেল।পোশাক পড়ে চুলগুলো মুছে বের হলো ঘরে থেকে।সবাই টেবিলে বসে আছে মেহের বাদে।
আরবাজও গিয়ে মীরার পাশে বসে গেল।শেহনাজ পারভীন তাড়া দিলেন,
-“আমি কি বেড়ে দিব?”
রান্না ঘর থেকে একটা বাটি হাতে মেহের দ্রুত গতিতে আসতে আসতে বললো,
-“এইত আমি এসে গেছি।”
বলতে বলতে মেহের ডালের বাটিটা রাখলো টেবিলে।তারপর বললো,
-“আপনারা বসুন।আমি পরিবেশন করছি।”
মেহের সার্ভ করতে লাগলো।এদিকে মেহেরকে যেন আজ নতুন রূপে দেখছে আরবাজ।পড়ণের শাড়ির শেষ অংশটুকু কোমড়ে গোঁজা। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করায় সামনে কাটা ছোট চুলগুলো গাল বেয়ে থুতনি অবধি চলে এসেছে। কপালে হলুদের দাগ বোঝা যাচ্ছে।সবার থালায় সে খাবার পরিবেশন করছে।আরবাজের সামনে এসে সে খাবার বাড়লো।মেহের তো নিজের মত ভাত বাড়ছে।এদিকে আরবাজ মেহেরের দিকে এখনো তাকিয়ে।মেহের আরবাজের অনেকটাই কাছে।একপাশে দাঁড়িয়ে সে খাবার বাড়ছে।আরবাজের হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। মেহের খাবার বেড়ে দিয়ে বললো,
-“নিন খান।”
বলেই মেহের পাশে দাঁড়িয়েই রইলো।আরবাজ তখনো মেহেরকে অপলক ভাবে দেখছে।সে কি করছে!কেন করছে সেটা জানে না।শুধু দেখেই চলেছে।এ যেন অন্য এক মেহের!এদিকে খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ মীরার চোখ গেল আরবাজের দিকে।মীরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।তারপর বললো,
-“ভাইয়া,খেয়ে নে আগে।পরে দেখিস।”
আরবাজের ধ্যান ভাঙলো। সবাই তাকালো আরবাজের দিকে।শাহীন খান কাশি দিয়ে বললেন,
-“মেহের মা,তুমিও বসে পড়ো।”
শেহনাজ পারভীন খেতে খেতে বললেন,
-“ডালে লবণ কম হয়েছে।”
-“আসলে শেষে করেছি তো তাড়াতাড়ির মধ্যে… ”
-“হয়েছে বুঝেছি। আরবাজ বাবা আরো কিছু লাগবে?”
আরবাজ না বোধক মাথা নাড়ালো।শাহীন খানের জোরাজোরিতে মেহের বসে পড়লো আরবাজের পাশে।মীরা এখনো তাদের দেখছে আর হাসছে।আরবাজ না চাইতেও বারবার মেহেরের দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। কেন হচ্ছে এমন আরবাজ বুঝতে পারছে না।শুধু ভাবছে,যা হচ্ছে হোক।মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে!
মেহেরের উদ্দেশ্য শেষমেশ মীরা বলেই ফেললো,
-“তোমাকে তো পাক্কা রাঁধুনি লাগছে ভাবী।”
চলবে…..