প্রিয়মুখ পর্ব-৮+৯

0
453

#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব০৮

হাসিব নিজের রুমে এসে মন খারাপ করে বসে বসে শুধু ঝুমুরের কথা ভাবছে।ঝুমুর তুমি কি আমাকে সত্যি ভুল বুঝে আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাচ্ছো? আমি কি করে বুঝাই আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি,আমার জীবনে শুধু তুমিই ছিলে,আছো আর সারাজীবন থাকবে।

ঝুমুর ছাদের এক কোণায় হাঁটু গেড়ে বসে আনমনা হয়ে বলেই যাচ্ছে …

আমি তো তোমাকে ছাড়া ভালো থাকার চেষ্টা করছিলাম।নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেয়েছিলাম।সব ভুলে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতে চেয়েছিলাম।তবে কেন তুমি আমার সামনে এসে আমার সব কিছু এলোমেলো করে দিয়ে চলে যাও হাসিব।তুমি যখন সামনে আসো তখন নিজের মধ্যে আমি আমাকে খু্ঁজে পাই না, মনে হয় তোমার মাঝে নিজেকে খুঁজে পাই।

সন্ধ্যা প্রায়ই ঘনিয়ে এলো ঝুমুর নিজেকে কিছুটা শান্তনা করে নিজের রুমে চলে আসতেই ঝুমুরের ছোট চাচীর সাথে দেখা হয়..

…ঝুমুর রেডি হয়ে নেয় একটুপর ঝুমকার বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য মার্কেটে যেতে হবে।

….চাচী তোমরা যাও না বিয়ের কেনাকাটা করতে চৌদ্দ গোষ্ঠী না গেলে হয় না?

…চৌদ্দ গোষ্ঠী না গেলে হয় কিন্তু তুই না গেলে হয় না। তোর বড় চাচীর অর্ডার ঝুমকার বিয়ের কেনাকাটা করতে তোকেই যেতেই হবে।

ঝুমুর মনে এমনিতেই খারাপ যত চাচ্ছে না হাসিবের সাথে দেখা হোক তত বেশি হাসিবের সামনে পড়তে হচ্ছে।
কিন্তু কি করবে কেউ তো আর কারও মন বুঝতে চায় না তাই বাধ্য হয়ে রাজি হতো হলো মার্কেট যাওয়ার জন্য।

সন্ধ্যার পর সবাই রেডি হয়ে গাড়িতে বসে।ড্রাইভ করছে হাসিব আর পাশের সিটে বসছে ঝুমকা।হাসিবের পিছনের সিটে বসছে ঝুমুর,ফাইজা আর ঈশিকা।
একেবারে পিছনের সিটে ছোট চাচী, ফাহিম আর হাসিবের মা।হাসিবের মা গাড়িতে ওঠার সময় প্রথম ঝুমুরের সাথে দেখা হলো।

গাড়ি চলাকালীন সময় সবাই অনেক কথা বলছে, অনেক হৈচৈ করছে।আর কে কি নিবে শুধু সেটা নিয়ে গবেষণা তো আছেই। শুধু ঝুমুর কিছু না বলে চুপচাপ হয়ে বসে আছে জানালা খুলে বাহিরের দিকে তাকিয়ে। হাসিব লুকিং গ্লাস দিয়ে শুধু বার বার ঝুমুরকে দেখছে।কিন্তু ঝুমুর একবারের জন্য সেটা লক্ষ্য করেনি।

ঝুমুরের ছোট চাচী ঠিকই লক্ষ্য করেছে তাই একটু মজা নেয়ার জন্য বললো…

হাসিব, বাবা সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাও এত তাড়াতাড়ি আমরা কেউ মরতে চাই না।

কথাটা শুনার পর হাসিব লজ্জায় সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ঝুমুর কিছুই বুঝতে পারে নি।

এদিকে ঝুমকা বেশ বিরুক্তবোধ করছে।গাল ফুলিয়ে মনে মনে ভাবছে কি বোরিং একটা ছেলে হাসিব একেবারে আনরোমান্টিক।বাবা, মা কেন যে আমার জন্য হাসিবকে ঠিক করেছে আল্লাহ জানে।সারাজীবন কিভাবে কাটাবো এই ছেলেটার সাথে ভাবতেই আমার কেমন জানি অসহ্য লাগছে।

অবশেষে তাদের গাড়ি একটা শপিংমলের সামনে এসে দাঁড়ালো। সবাই গাড়ি থেকে নেমে মার্কেটের ভিতর চলে গেলো।ঝুমকার বিয়ের শাড়ি দেখা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লো সবাই।
আর ঝুমুর পাশের দোকানে গিয়ে চুড়ি দেখছে।পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো হাসিব, ঝুমুর খেয়াল করে নি।

….ঝুমুর চুড়ি পছন্দ হয়েছে?

হঠাৎ হাসিবের কণ্ঠ শুনে ঝুমুর চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখে হাসিব।ঝুমুর কিছু না বলে চুড়িগুলো রেখে পাশের দোকানে চলে গেলো যেখানে সবাই ঝুমকার জন্য বিয়ের শাড়ি দেখছে।

ঝুমুরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো হাসিব।হাসিবের মায়ের হঠাৎ চোখ গেলো ঝুমুর আর হাসিবের দিকে। মনে মনে ভাবছে…

….দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। ঝুমুর যদি আমার ছেলের বউ হতো আমি অনেক বেশি খুশি হতাম।কিন্তু হাসিবের বাবার লোভের কারণে ঝুমুরকে হারাতে হচ্ছে।

চলবে….

#প্রিয়মুখ
#ফারিহা_জান্নাত
#পর্ব০৯

কেনাকাটার এক পর্যায়ে ছোট চাচী একটা মেরুন কালার শাড়ি পছন্দ করে ঝুমুরকে কাছে ডেকে বললো…

ঝুমুর শাড়িটা তোকে কেমন মানায় দেখি তো বলেই শাড়িটা ঝুমুরের গায়ের সাথে জড়িয়ে দেয়। বাহ তোকে তো দারুণ মানিয়েছে।

….ঝুমুর আপুকে একদম পরীর মতো লাগছে বলেই মুচকি হাসে ঈশিকা।

হাসিব একটু আড়ালে গিয়ে ঝুমুরকে এক মনে দেখেই যাচ্ছে,চোখের পলক যেন পড়তেই চাচ্ছে না। আমার পাখিটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

…চাচী আমার শাড়ি লাগবে না।(ঝুমুর চাচ্ছে না বিয়ে উপলক্ষে কিছু কিনতে)

….কেন রে ঝুমুর?বিয়েতে সবাই নতুন পোশাক পরবে আমি চাই তুইও নতুন পোশাক পরবি,আমাদের মতো তুইও আনন্দ করবি(হাসিবের মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো শেষ করলো)

প্রায়ই কেনাকাটা শেষ করে ওরা বাড়িতে আসার পথে রওনা হলো।গাড়িতে সবার উঠা শেষ হলে ঝুমুর উঠবে এমন সময় ঝুমকা বলে….

…ঝুমুর আপু তুমি হাসিবের সাথে সামনের সিটে বসো আমি পিছনে বসবো।

কথাটা শুনার পর ঝুমুর হঠাৎ অবাক হয়ে গেলো।

….ঝুমকা আমি কেন?

….কারণ এই বোরিং লোকটার সাথে আমি কিছুতেই বসতে পারবো না

….কিন্তু ঝুমকা(কথা শেষ করার আগেই ঝুমকা ঝুমুরের সিটে গিয়ে বসে পড়লো)

ঝুমুর দাঁড়িয়ে আছে। হাসিবের মুখে তো বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছে, এটাই তো চেয়েছিলো।ঝুমুরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে….

….কি এভাবে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি গাড়িতে উঠে বসবে।

বাধ্য হয়ে ঝুমুর হাসিবের পাশের সিটে বসলো।

হাসিব গাড়ি চালানো শুরু করলো।কিছু দূর যাবার পর হাসিব পিছনে তাকিয়ে দেখলো সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।
হাসিব মনে মনে খুশিই হলো….

ভালোই হলো সবাই ঘুমিয়ে গেলো। দেখি আমার পাখিটার রাগ ভাঙ্গাতে পারি কিনা।

ঝুমুরকে দেখলো জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে..

হাসিব এক হাত দিয়ে গাড়ি কন্ট্রোল করছে আর এক হাত রাখলো ঝুমুরের হাতের উপর। ঝুমুর কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে হঠাৎ চমকে ওঠে। ঝুমুর বিরুক্ত হয়ে হাত সরানোর জন্য যত চেষ্টা করছে হাসিব তত শক্ত করে হাতটা চেপে ধরলো।ঝুমুর হাসিবের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে…

…হাতটা ছাড়ুন প্লিজ(বিরুক্ত ভাব নিয়ে)

হাসিব মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো ছাড়বে না।

কি একটা মহা ঝামেলায় পড়লাম।কেউ যদি এখন দেখে একটা কেলেংকারী হয়ে যাবে সব দোষ আমাকেই তো দিবে।কথাগুলো মনে মনে বলে যাচ্ছে…

হাত ছাড়ার জন্য আবারও জোরাজোরি করতে লাগলো।

হাসিব ঝুমুরকে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো…

তোমার স্পর্শ আমাকে ভালো রাখে বুঝো না কেন?আর একবার হাত ছাড়ার কথা বলবে না।

…কি পাগলের পাল্লায় পড়লাম, নাচতে নাচতে বিয়ে করছে একজনকে আর ভালোবাসা দেখাতে আসছে আরেকজনকে।(বিড়বিড় করে বলছে)

….কার সাথে কথা বলছো?

….আমার কপালের সাথে (রাগ করে)

….পাশেই তো একজন জলজ্যান্ত মানুষ তোমার কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করছে ইচ্ছে করলে তার সাথে কথা বলতে পারো।

ঝুমুর আর কিছু না বলে মন খারাপ করে জানালার দিকে বাহিরে তাকিয়ে আছে।মনে মনে বলতে লাগলো….

হাসিব তোমার স্পর্শ আমাকে যে কতটা ভালো লাগার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে সেটা তুমি কখনো জানতে পারবে না। তোমাকে ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে হারাতে পারবো না। তাই তো নিজেকে আড়ালে রাখতে চাই।

ঘণ্টা খানিক পর বাড়ি পৌঁছে যায়, গেইটের ভিতর গাড়ি ডুকানোর পরই ঝুমুরের হাত ছেড়ে দেয় হাসিব।হর্ন বাজানোর সাথে সাথে সবাই জেগে উঠে।

ঘুম ঘুম চোখে সবাই শপিং ব্যাগ নিয়ে যে যার মতো করে ঘরের দিকে যেতে লাগলো। ছোট চাচীর হঠাৎ মনে পড়লো হ্যান্ড ব্যাগ গাড়ির মধ্যে রেখে আসছে…

….ঝুমুর আমার ব্যাগ গাড়ির মধ্যে রেখে আসছি,তুই গিয়ে একটু নিয়ে আয় না।

…যাচ্ছি চাচী তুমি আমার ব্যাগ ধরো আর রুমে চলে যাও।আমি নিয়ে আসছি।

ঝুমুর গাড়ির ভিতর থেকে ব্যাগ নিয়ে সামনের দিকে ঘুরতেই হাসিব ঝুমুরকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ হাসিবকে দেখেই ভয়ে চিৎকার করতে যাবে এমন সময় হাসিব ঝুমুরের মুখ চেপে ধরে। ঝুমুর তো ভয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে হাসিবের দিকে।

….চোখ বড় বড় করে এভাবে তাকালে তোমাকে বটগাছের পেত্নীর মতো লাগে (কথাটা বলে হাসিব হেসে দেয়)
ঝুমুর কথাটা শুনে চোখ ছোট করে তাকায়।

….আমাকে দেখলে এমন করো কেন বলো।ভালোবাসার মানুষকে দেখলে কেউ বুঝি এমন করে। কি করতে হয় জানো কথাটা বলে ঝুমুরের মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে ঝুমুরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁটের ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো। ঝুমুরের পুরো শরীর কেঁপে ওঠে হাসিবের স্পর্শ পেয়ে। হাসিব ঝুমুরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঝুমুর নিজের অজান্তেই হাসিবকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার স্পর্শে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে ফেললো।একটু পরই ঝুমুর বাস্তবে ফিরেই নিজেকে হাসিবের মাঝে দেখতে পায় আর সাথে সাথে হাসিবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। ঝুমুর ভাবতে থাকে আমি এটা কি করেছি? আমি হাসিবের এত কাছে আসলাম কেন? কেন হাসিবের ভালোবাসায় সাড়া দিলাম? দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো ঝুমুর দৌড়ে ঘরের ভিতর চলে গেলো।
আর হাসিব অসহায়ের মতো ঝুমুরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলছে…

….আমি জানি ঝুমুর তুমিও আমাকে ভালোবাসো তাহলে বলছো না কেন তুমি আমাকে ভালোবাসো?কেন এত কষ্ট দিচ্ছো,কেন আমাকে দূরে সরিয়ে রাখছো?আমি সত্যি পারবো না তোমাকে হারাতে।তোমার অবহেলা, তোমার দূরে সরে থাকা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তোমার মুখ থেকে আমাকে শুনতেই হবে শুধু একবার বলিও ভালোবাসো না আমি পুরো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।

চলবে……