প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব-২২

0
377

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২২.

-তুমি মিষ্টিঘরে ফিরে যাও খই।

রাকীনের কথা শুনে কিছুক্ষন নিরবে ওর‌ দিকে‌ তাকিয়ে রইলো খই। রাকীনের শান্ত চাওনি। খই চোখ সরিয়ে দুহাতে দুগাল মুছলো নিজের। কিসব বলে রাকীনকে দুর্বল করে দিতে যাচ্ছিলো‌ ও? রাগ হলো‌ ওর নিজের উপর। নাক টেনে বললো,

-হ! ত্ তুমিও বাড়ি ফিরা যাও নকশাদার। আসতাছি।

একমুহুর্ত দেরি না করে উল্টোপথে হাটা ধরলো খই। যেখানে দায়ভার হয়ে থাকবে না বলে সাদিক সাহেবের বাসা থেকে ও বেরিয়ে এসেছিলো, সেখানে রাকীনের কাছে নিজের বলা কথাতে ওকে দায় করে‌ দিতে যাচ্ছিলো ও। আজ নিজেই নিজেকে অপমান করেছে ও। রাকীন পেছন থেকে ওর এক হাত ধরে‌‌ বললো,

-খই আমি…

খই‌ ছাড়িয়ে নিলো‌ নিজের হাত। একটা জোরপুর্বক হাসি দিয়ে বললো,

-ফিরা‌ যাও নকশাদার। আ্ আমি অনাথআশ্রমে‌ যাইতাছি। চিন্তা করন লাগবো না তোমার। আ্ আমি ঠিক আছি। জানিনা তহন কি হইছিলো, পাগল হইয়া গেছিলাম হয়তো। তয় ওহন ঠিক আছি। তুমি যাও।

রাকীন ওর সামনে এসে দাড়ালো। খইয়ের দুহাত মুঠো করে নিয়ে, মাথা নিচু করে বললো,

-আমাকে ক্ষমা করে‌ দিও খই। জানিনা এটুকো সময়ের ব্যবধানে, ভাঁদুলগাও থেকে শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবে ঢাকা চলে আসার এতো সাহস কি করে আসলো আমার‌ মাঝে। তবে এটা জানি, এই‌মুহুর্তে তোমাকে পরিচয় দেওয়ার‌ সাহস আমার নেই‌। তাই…

খই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো রাকীনের দিকে।‌ রাকীনের চেহারায় তীব্র আত্মগ্লানি। খইয়ের নিজের উপরও রাগ হলো। টের পেলো, অনেকবেশি আবোলতাবোল বকেছে ও। যার‌ জন্য এই‌ লোকটা এতোটা দ্বন্দে পরে গেছে। কিন্তু ও তো সেভাবে বলতেই চায়নি। আপনার ভেবে, দুঃখটাকে উগড়ে দিতে গিয়ে বলে দিয়েছিলো কথাগুলো। ও তো কারো দায়বদ্ধতা হতে চায়ই‌ নি। সেখানে ওর‌ কথাতেই রাকীন দায়বদ্ধতায় পরে যাচ্ছিলো। যেখানে ওর চেয়ে শতসহস্র ভালো কিছুর দাবিদার এই‌ মানুষটা, ও‌ কি করে তার‌ কাছে দাবি রাখতে পারে? মুচকি‌ হেসে রাকীনের হাতে হাত রেখে বললো,

-খই নিজের পরিচয়ে বাচবো নকশাদার। তুমি দেইখো। আমার মায়ে যা চাইছিলো, তাই হইবো। তুমি নিজের উপরে কোনো দায় নিও না। ভালো থাইকো।

রাকীন চোখ তুলে তাকালো। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে খই‌ হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। অন্ধকারে চলে গেলো সে পথে, যে পথ দিয়ে এসেছিলো। মাথার চুলগুলো একহাতে উল্টে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুললো রাকীন। চোখ বন্ধ করে নিতেই জল গরালো ওর চোখের কোনা বেয়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ওর ছায়ার সাথে হৃদয়ের চাপা কষ্টগুলোর প্রতিধ্বনি স্পষ্টতর হতে লাগলো। প্রতিটা প্রশ্বাস যেনো তীব্র যন্ত্রনাসমেত বলছে,
“যে জায়গাটা এতোগুলো বছরে ইচ্ছেকে দিতে পারিনি, সে জায়গাটা কি করে তোমায় দিয়ে দেবো খই? যে সেই ছোটবেলা থেকে রাকীনের সবটা জুড়ে আছে, তোমার সাথের এই দুদিনের সাক্ষাতে কি করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো বলো? খেয়া যেখানেই থাকুক না কেনো, আমি তো জানি, আমার সবটা জুড়ে শুধু ওই আছে। ওর অনুপস্থিতি কেউ পুরন করতে পারবে না। আমি দেবো না কাউকে সে অধিকার। দিতে পারবো না!”

রেকর্ডিংয়ের জন্য বাসা থেকে বেরোলো ইচ্ছে। আজও ব্রেকফাস্ট করেনি বলে নওশাদ সাহেবের অসহায় আর্জি আর নাফিজা বেগমের বিব্রত চাওনি দেখতে হয়েছে ওকে। সেসব মাথা থেকে ঝেরে, গাড়িতে বসে ডিরেক্টরের এসিসটেন্টের লাস্ট কলের সময় দেখবে বলে মোবাইলের কললিস্ট স্ক্রল করছিলো ইচ্ছে। হঠাৎই একটা আননোন নম্বরে চোখ আটকালো ইচ্ছের। সময়, তারিখ আর আননোন নম্বর লিস্টে দেখে একটা ঘটনাই মনে পরলো ওর। পিয়ালীর সে সন্ধ্যার ঘটনাটা। পুরো নম্বরটা কয়েকবার চোখ বুলালো ইচ্ছে। কি ভেবে বাটন ফোনটা বের করলো ও। ঠিকঠাকমতো নম্বরটা তুলে কল করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নিলো পাশের টমিকে। চোখ বুজে শুয়ে আছে টমি। মুচকি হেসে ইচ্ছে একহাতে ওর গায়ে হাত বুলালো। নড়েচড়ে আরো আরাম করে শুয়ে পরলো টমি। ঠোট কামড়ে হেসে নম্বরটা ডায়াল করলো ইচ্ছে। কি হলো ওর, রিং হবার আগেই কেটে দিলো কলটা। কিছুক্ষন ইতস্তত করে, একটা জোরে শ্বাস ফেলে আবারো নম্বরটায় কল লাগালো ও।
ফোনের আওয়াজে চোখ মেলে তাকালো প্রাপ্ত। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে নিলো। নম্বর না দেখে রিসিভ করলো কলটা। ঘুমুঘুমু গলায় বললো,

-হ্যালো?

প্রতিত্তরে কুকুরের আওয়াজ শুনে তখনতখন চোখের ঘুম গায়েব প্রাপ্তর। ইচ্ছে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলো টমিকে আওয়াজ করতে শুনে। কল কেটে দিলো তৎক্ষনাৎ। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো টমির দিকে। টমি লেজ নেড়ে আদর বুঝালো ওকে। ইচ্ছে কড়া গলায় বললো,

-শব্দ করলি কেনো?

টমি সিটের উপর রাখা ইচ্ছের অন্য ফোনের স্ক্রিনে থাকা প্রাপ্তর নম্বরে সামনের পা রাখলো। ইচ্ছের মুখ হা হয়ে গেলো আপনাআপনিই। বললো,

-ওই লোকটা মোবাইলের ওপাশ থেকে হ্যালো বলেছে, সেটাও কানে গেছে তোর?

টমি আবারো শুয়ে পরলো আরাম করে। ইচ্ছে ওর গা ছাড়া ভাব দেখে বললো,

-সরি ডুড, ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের তুলনায় তো তোর শ্রাব্যতার সীমা অনেক বেশি। ঠিক বুঝে গেছিস কার নম্বরে ডায়াল করেছি।

টমি আরো দুবার ডাকলো। যেনো আরো বেশি ভাব বুঝালো ও। ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো এবার। টমিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

-ইউ‌ নো হোয়াট টমি? মিস্টার গ্যাংস্টারের প্রতি তোর এই বিহেভটা আমি এন্জয় করতে শুরু করেছি। পারিসও তুই!

টমি কিছুই বললো না। মনেমনে হয়তো চাপা ঈর্সা পুষতে শুরু করলো প্রাপ্তর প্রতি। এদিকে টমির গলা চিনতে কষ্ট হলেও ভুল হলো না প্রাপ্তর। উঠে বসে হা হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ঠিকই শুনেছে কিনা ঘুমের ঘোরে, সেটাও একটা বিষয়। টমি ওর নম্বর কিভাবে পাবে, ওকেই‌ কেনো কল করবে, সর্বপরি কিভাবে কল করবে ভেবে সকালটাই উল্টেপাল্টে গেলো প্রাপ্তর। নম্বরটা পড়ে নিলো কয়েকবার। মোবাইল বিছানায় রেখে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখে ড্রয়িংরুমে সোফায় পিয়ালী, সাদিক সাহেব আর মিষ্টিঘরের আরেক অভিভাবক বাকের কাকা সবাই বসে। হাতের ঘড়িটা পরতে পরতে পুরো ড্রয়িংরুমের পুরোটা চোখ বুলিয়ে এককোনে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা খইকেও‌ দেখতে পেলো রাকীন। পিয়ালী‌ বললো,

-কোথায় যাচ্ছিস ভাইয়া?

-এমনি, মাহীমদের ওদিকে…

প্রাপ্তকে শেষ করতে না দিয়ে সাদিক সাহেব উঠে দাড়িয়ে বললেন,

-খই মিষ্টিঘরে চলে যেতে চায় প্রাপ্ত।

প্রাপ্ত অবাকচোখে তাকালো খইয়ের দিকে। খই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সেভাবেই নিচদিকে তাকিয়ে আছে ও। পিয়ালী বললো,

-সকালবেলা উঠেই‌ আমাকে বলছে এ বাসায় থাকবে না। আমি অনেক বললাম এখানে…

প্রাপ্ত এগিয়ে গেলো খইয়ের দিকে। খই অনড়। মেয়েটার চেহারা শুকিয়ে গেছে একদম। চোখ কোঠরে বসে গেছে। প্রাপ্ত বললো,

-এ বাসায় থাকতে চাওনা তুমি?

-না।

খইয়ের স্পষ্ট জবাব। সাদিক সাহেব এগিয়ে আসলেন ওর দিকে। বললেন,

-কিন্তু খই…

-এই বাড়িতে আমার দমবন্ধ লাগে কাকা। আমারে আশ্রমে যাইতে দাও। ওইহান থাইকা‌ পড়তে চাই আমি। নিজের পরিচয়ে বাচবার‌ চাই। বাধা দিও না কাকা। পায়ে পরি তোমার। আমারে আশ্রমে যাইতে‌ দাও।

প্রাপ্ত কি‌ বলবে, বুঝে উঠতে পারলো না। বেশ অনেকক্ষন খইয়ের আকুতি শোনার পর সাদিক সাহেব হার মানলেন খইয়ের কাছে। উনি ভালোমতোই জানেন, এই‌মুহুর্তে খইয়ের আত্মসম্মানই ওর কাছে বড়। এদিক দিয়ে ওকে জোর করা হলে, হিতের বিপরীত হবার সম্ভবনাই বেশি। আর তাছাড়া উনি নিজেও‌ চান, খই নিজের দিকগুলো বুঝে বাচতে শিখুক যতো‌ দ্রুত সম্ভব। প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তুমি কি বলো প্রাপ্ত?

-যেটা খই চায়, সেটা করাই উচিত হবে বাবা।

একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে‌ বাকেরের সাথে সবধরনের ফর্মালিটি মিটিয়ে‌ নিলেন সাদিক সাহেব। খই শক্ত করে নিলো নিজেকে। বাকের কাকার সাথে বেরিয়ে এলো প্রাপ্তদের বাসা থেকে। বেরোনোর সময় সাদিক সাহেব ওকে পেছনডাক দিলেন। খই থামলো। সাদিক সাহেব ওর‌ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-অনেকঅনেক দোয়া তোমার জন্য। শুধু বাসাটা বদলেছে। তোমার প্রতি আমাদের ভালোবাসা না। সবসময় আমরা পাশে আছি তোমার। নিজেকে প্রস্তুত করো খই। এই বাসা, বাসার মানুষগুলো এক নতুন তোমার‌ স্থায়ী আগমনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো কিন্তু!

খই প্রাপ্তর দিকে তাকালো একপলক। প্রাপ্তর শান্তস্থির চাওনি। দুজনের মনে আচমকাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের আভাস হানা দিতে লাগলো। এ যেনো নতুনের শুরু নয়, অন্তিমের পুরোনো ট্যালি…

#চলবে…