#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৬.
-মিস ইনায়াতের এক্সিডেন্টের প্রায় ছ ঘন্টা পার হয়ে গেছে মিস্টার রাকীন। আর তার মাথায় আঘাতটাও ঠিক তখনই লেগেছে। ব্রেইনে ব্লিডিং শুরু হয়েছে তখন থেকেই। শুরুর দিকে বলে তিনি হয়তো তৎক্ষনাৎ টের পাননি। কান দিয়ে আসা অল্পবিস্তর র’ক্তকে ইগ্নোর করেছেন। এখন এতোটা সময় পর ব্লিডিং বেড়েছে। পুরো দিন না খাওয়া উনি। ফিজিক্যালি উইক হয়ে ব্লাডও ডোনেট করেছেন দু ব্যাগ।
এটুকো বলে ডক্টর থামলেন। সামনের মানুষগুলোর বিদ্ধস্ত রুপ দেখে আরও বলার পুর্বে তার সাহস সঞ্চার করা প্রয়োজন। জ্ঞান হারানোর পর ইচ্ছেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রক্তক্ষরন থেমেছে। তবে জ্ঞান ফেরেনি ইচ্ছের। ডক্টরের সামনের চেয়ারে রাকীন, নওশাদ সাহেব অসহায়ের চাওনি নিয়ে বসে। আর এককোনে দুহাত মুঠো করে, মেঝেতে দৃষ্টিস্থির করে প্রাপ্ত দাড়িয়ে। হাতের তালুর উপরপিঠ থেকে র’ক্ত ঝরছে ওর। ইচ্ছেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর করা পাগলামিতে, করিডরের দেয়ালেও লেগেছে সে র’ক্ত। কথাগুলো শোনার পর আরো প্রাপ্ত আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে পরবে, তা বেশ বুঝছেন উনি। ডক্টর উঠে দাড়ালেন। উঠে দাড়ালো রাকীন আর নওশাদ সাহেবও। নওশাদ সাহেবের সামনে গিয়ে ডক্টর বললেন,
-ব্লিডিং আপাতত না থাকলেও, মিস ইনায়াতের এখনো সেন্স ফেরেনি। রেসপন্স করছেন না উনি। আমাদের আর কিছুই করার নেই মিষ্টার নওশাদ।
-আমার মেয়েটা আর বাচবে না। তাইনা ডক্টর?
নওশাদ সাহেবের ফাকা দৃষ্টি। খেয়াকে তো আগেই হারিয়েছিলেন। ওর অভাবে ভালোবাসা নামক অনুভূতিও যেনো হারিয়ে ফেলেছিলো ইচ্ছে। কোনোদিনও ভালোবাসা বোঝে নি তার। আজ যখন খেয়া ফিরেছে, দুই মেয়েকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেওয়ার সুযোগ এসেছে, তখন দুজনকেই এই হসপিটালে দেখে কোন বাবা ঠিক থাকবে? নাফিজা বেগমকে ইচ্ছের ইমারজেন্সির দরজা থেকে সরানোই যায় নি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় পিতা বলে মনে হচ্ছিলো নওশাদ সাহেবের। রাকীন বললো,
-শান্ত হও আঙ্কেল। ইচ্ছের কিছু হবে না। ডক্টরের সাথে আমি কথা বলছি।
রাকীন সরিয়ে নিয়ে আসলো ডক্টরকে। যন্ত্রের মতো বসে রইলেন নওশাদ সাহেব। রাকীন বললো,
-ইচ্ছে কেমন আছে ডক্টর?
-উনি ভালো নেই মিস্টার রাকীন। মিস্টার নওশাদ ভুল আন্দাজ করেন নি। এভাবে সেন্সলেস থাকলে হয়তো ইনায়াতকে আমরা ব্…
কথা শেষ করার আগেই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে ডক্টরের এপ্রোন দুহাতে চেপে ধরলো প্রাপ্ত। তবে ওর রক্তবর্ন চোখ আর শক্ত চোয়াল দেখে নমনীয়তা হারালেন না ডক্টর। ইচ্ছেকে ওর বাহুডোর থেকে সরানোর পর থেকেই এএন পাগলামো করে চলেছে এই ছেলেটা। প্রাপ্ত ডক্টরের এপ্রোন ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বললো,
-এই ডক্টর! আমার ইচ্ছের কিছু হবে না! ওর কিছু হলে আমি কিন্তু কাউকে বাচতে দেবো না! শেষ করে দেবো সব! প্রাপ্ত ওয়াদা করছে এটা! আমি…
রাকীন ঝারা মেরে ডক্টরকে ছাড়িয়ে নিলো প্রাপ্তর হাত থেকে। অবাকচোখে তাকালো প্রাপ্ত। রাকীন শক্ত গলায় বললো,
-এটা তোমার গুন্ডামো দেখানোর জায়গা না প্রাপ্ত! এট হসপিটাল। আর উনি একজন ডক্টর!
-ওকে বলো আমার ইচ্ছেকে সুস্থ্য…
-কিসের তোমার ইচ্ছে? তোমার না ইচ্ছে! বরং এসবের জন্য তুমিই দায়ী! এতোই যদি ভালোবাসো, কেনো বলোনি ভালোবাসো? যে মেয়ে এতোবড় সেলিব্রিটি হয়েও তোমাকে সময় দিতো, তোমার কাজগুলোতে তোমাকে বাধা দিতো না, তোমার একটাবারের জন্যও মনে হয়নি, সে মেয়ে তোমাকে নিয়ে কিছু তো ফিল অবশ্যই করে? একবারো ভাবনায় আসেনি সে কথা? হোক তা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, তবুও বারবার কাছে এসেছিলো ও তোমার। কেনো বলোনি ভালোবাসো ওকে? তাহলে আজ আমাদের কাউকেই এইদিন দেখতে হতো না। না ইচ্ছে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হতো, না তুমি জেদ ধরে খেয়াকে আংটিবদল করতে রাজি হতে। কোনোটাই ঘটতো না!
চোখ নামিয়ে নিলো প্রাপ্ত। একবর্নও ভুল বলেনি রাকীন। তবে রাকীন নিজেও এভাবে বলতে চায়নি। যেটুকো ভাগ্যে লেখা, তা তো হওয়ারই ছিলো। এভাবেই ওদের চারজনের জীবন বহমান হওয়ার ছিলো। একা প্রাপ্তর তো দোষ না এতে। তবে প্রাপ্তকে থামাতে এসব বলতেই হতো ওকে। সত্যিই থেমে গেছে প্রাপ্ত। রাকীন এগোচ্ছিলো ওকে সামলাবে বলে। ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো প্রাপ্ত। দুহাত জোর করে জলভরা চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ইচ্ছেকে প্লিজ সুস্থ্য করে দিন ডক্টর। ওকে প্লিজ ঠিক করে দিন। বাচবো না ওকে ছাড়া আমি। বাচতে পারবো না। প্লিজ ওকে বাচান ডক্টর। প্লিজ!
চোখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়লো রাকীন। ইচ্ছে যখন বলেছিলো, গ্যাংস্টারকে ভালোবাসি, কৌতুহল থেকে রাকার কাছে শুনেছে ও প্রাপ্তর বিষয়ে সবটা। রাকার ভাষ্যমতে যে ছেলে মারপিটের ভাষা ছাড়া অন্যকোনো ভাষায় বুঝাতে জানে না, আজ সে হাতজোর করে কাদতে কাদতে কথা বলছে। নত হচ্ছে। হবেই বা না কেনো? ভালোবাসার কেউ যখন মৃত্যুমুখে, তখন নিজেকে সামলানো কতোটা কষ্টের, ও নিজেও সে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ইচ্ছের অসুস্থ্যতার কথা খেয়া জানার পর ওর অবস্থায় গুরুতর হয়ে গিয়েছিলো। দুজনকে নিয়ে সমান ভয়ে ছিলো সবাই। আপাতত ঘুমের ঔষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে খেয়াকে। ডক্টর প্রাপ্তকে তুলে দাড় করালেন। ওর কাধে হাত রেখে বললেন,
-আমি বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা মিস্টার প্রাপ্ত। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করছি মিস ইনায়াতকে ঠিক করার। বর্তমানে মেডিকেল সাইন্স অনেক উন্নত। এক্সিডেন্টাল স্ট্রোকের ক্ষেত্রে উন্নতদেশে ব্রেইন অপারেশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখানে আমাদের নিউরো হসপিটালেও কিছু স্পেশালিস্ট এমন অপারেশন করেছেন। আপনারা চাইলে আমরা মিস ইনায়াতের অপারেশনের ব্যবস্থা করবো।
একটুখানি স্বস্তির শ্বাস ফেলে, ঠোট কামড়ে নিশব্দে কাদছিলো প্রাপ্ত। ডক্টর একপলক রাকীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-বাট ব্রেইন অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পসিবিলিটি খুব কম মিস্টার প্রাপ্ত। এ পর্যন্ত হওয়া সবগুলো অপারেশনে, প্রতি দশজনে একজনকে বাচাতে পেরেছে ডক্টরেরা। বাকি নয়জন ওটিতেই…
-কি বলছেন আপনি ডক্টর? সবেই তো আশার আলো দেখালেন। এখন বলছেন অপারেশন সাকসেসফুল না হলে ওটিতেই…
বিস্ময়ে বললো রাকীন। ডক্টর মাথা নিচু করে নিলো। রাকীন চুলগুলো উল্টে ধরলো নিজের। এবার ওরও ভয় করছে। ডক্টর বললেন,
-জ্বী। বিষয়টা এমনই। অপারেশন না হলে মিস ইনায়াত অসুস্থ্যতা নিয়ে হাতেগোনা কিছুদিন সার্ভাইভ করবেন। অপারেশন সাকসেসফুল হলে সুস্থ্য হয়ে যাবেন। আর না হলে ওটিতেই… এবার আপনাদের সিদ্ধান্ত নেবার পালা মিস্টার রাকীন। তবে যদি আপনারা অপারেশন করাতে চান, যা করার দ্রুত করতে হবে। নইলে মিস ইনায়াত আরো বেশি অসুস্থ্য হয়ে পরবেন। তখন আমাদেরও করার কিছু থাকবে না।
রাকীন বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। এই অপারেশনের কথা কিভাবে বলবে নওশাদ সাহেবকে? উনি কোনোদিনও রাজী হবেন না এতো ঝুকিপুর্ন অপারেশনের জন্য। বরং অপারেশন ব্যতিরেকেই ইচ্ছেকে আরো কিছুদিন ভালোবাসার সুযোগ নেবেন সে। অপারেশন করাবে না এটা বলবে বলে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে নিলো রাকীন। প্রাপ্ত হঠাৎই শান্তস্বরে বললো,
-আপনি অপারেশনের ব্যবস্থা করুন ডক্টর। ইচ্ছের কিছুই হবে না।
অবাকচোখে ওর দিকে তাকালো রাকীন। প্রাপ্তর দৃষ্টি মেঝের দিকে স্থির। প্রাপ্ত চোখ তুলে বললো,
-দেরি করবেন না প্লিজ ডক্টর। যা ব্যবস্থা করার, করুন। ইচ্ছের অপারেশন হবে।
ডক্টর বললেন,
-আপনার অনুমতিতে অপারেশন হবে না মিস্টার প্রাপ্ত। পেশেন্টের বাবা অথবা পরিবারের কারো অফিসিয়াল অনুমতি চাইবে হসপিটাল অথোরিটি। বোনসাইন ছাড়া এতো ঝুকিপুর্ন অপারেশন কোথাও কেউই করাবে না।
-নওশাদ আঙ্কেল কখনোই এই অপারেশনে অনুমতি দেবে না প্রাপ্ত। তাকে চিনি আমি। খেয়াকে সবে খুজে পেয়ে ইচ্ছেকে হারানোর এতোটুকো ঝুকি নেবেন না তিনি এই মুহুর্তে।
রাকীনের কথায় দু দন্ড চুপ করে রইলো প্রাপ্ত। অপারেশন হবে না এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চিত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো রাকীন। আচমকাই প্রাপ্ত বলে উঠলো,
-বাবার পরিবর্তে পেশেন্টের বর অনুমতি দিলে হবে?
বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালো রাকীন। ডক্টরের চাওনিতেও আকাশসম বিস্ময়। প্রাপ্ত একদম স্বাভাবিক গলায় বললো,
-বলুন না ডক্টর? বিয়ের পর মেয়েদের বড় অভিভাবক তো স্বামীই হয়। নওশাদ স্যারের পরিবর্তে ইচ্ছের বর যদি বোনসাইন করে, অপারেশন করাবেন না আপনারা?
রাকীন খানিকটা জড়ানো গলায় বললো,
-কি করতে চাইছো তুমি প্রাপ্ত?
-আজ তো ইচ্ছের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ইচ্ছের বিয়ে হবে আজ। তারপর ওর বর ওর অপারেশনের জন্য বোনসাইন দেবে। অপারেশন হবে ইচ্ছের। কেউ আটকাতে পারবে না।
স্পষ্টভাষায় জবাব দিলো প্রাপ্ত। রাকীন কপাল চেপে ধরলো নিজের। একবার ভাবলো, প্রাপ্তকে থামাবে। বলবে এমন পাগলামি না করতে। পরপরই নিজেকে এর জায়গায় বসিয়ে ভাবলো, আজ ইচ্ছের জায়গায় খেয়া থাকলে, এমনটা করতে দুবার ভাবতো না ও। এমনকি বন্ধু হিসেবে এখনো ও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু সে সম্পর্কটা না ও চায়, নাইবা ইচ্ছে, খেয়া, প্রাপ্ত বা ওদের পরিবারের কেউ। রাকীন এগিয়ে প্রাপ্তর কাধে হাত রেখে করুনভাবে বললো,
-জেনেশুনে এতোবড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, পরে যদি ইচ্ছের কিছু…
-ইচ্ছের কিছুই হবে না মিস্টার রাকীন। ও তো প্রাপ্তর প্রাপ্য! কেড়ে নেওয়ার অধিকারবোধ খাটাবে না সৃষ্টিকর্তা।
এটুকো বলেই প্রাপ্ত নওশাদ সাহেবের দিকে এগোলো। সে পাথর হয়ে চেয়ারে বসে। প্রাপ্ত তার সামনে গিয়ে হাটু গেরে মেঝেতে বসে বললো,
-আমি,ইচ্ছে, দুজন দুজনকে ভালোবাসি স্যার। আপনি অনুমতি দিলে, আমি ইচ্ছেকে এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই।
নওশাদ সাহেব অবুঝের মতো তাকালেন প্রাপ্তর দিকে। নিজের সুদীর্ঘ জীবনে অনেক প্রেমের কাহিনী দেখেছেন। নিজেও প্রেমে পরেছেন। একবার নয়, দু দুবার। প্রথমজনকে হারানোর পর আবারো ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু জীবনমরনের সন্ধিক্ষনে কেউ কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়, আজ প্রথমবার দেখছেন। প্রাপ্তর দিকে মুগ্ধচোখে চেয়ে রইলো রাকীন। ডক্টরের চাওনিতেও রাজ্যের বিস্ময়। মৃত্যুমুখী জেনেও যে প্রিয় মানুষটাকে বিয়ের কথা বলতে পারে, তারচেয়ে বড় ভালোবাসার প্রমান আর কি হতে পারে? যেখানে কোনো কামনা-বাসনার সুযোগ নেই, কোনো নতুন শুরুর নিশ্চয়তা নেই, সেখানেই কি করে বিয়ে নামক বাধনে বদ্ধ হবার উন্মাদনা? সেখানেই কি করে শুভ প্রেমপরিনয়ের অস্থিরতা? হয়তো ভালোবাসা আছে বলেই! হয়তো প্রেম আছে বলেই! আর এজন্যই, ভালোবাসা পবিত্র, ভালোবাসা সুন্দর…
#চলবে…