#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৮
#লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম
শেখ ভিলার আজকে সকালের নাস্তার টেবিলের মধ্যমনি এ বাড়ির ছোট বউ তথা ঝুমুর।কারন আজ থেকে ঝুমুরের কলেজ শাসন জারি করা হয়েছে। তার শাসক স্বয়ং প্রফেসর শাকিল শেখ। উনিই কলেজে যাবার সময় ঝুমুরকে নিয়ে যাবে।
ঝুমুর নাস্তার প্লেট সামনে নিয়ে মনে মনে ভাবছিলো,”ধুর প্রথমে তো বিয়ে করতে চাইলাম না কারণ বিয়ে করলে বাউন্ডুলে থেকে বউ হতে হবে, এখন দেখি পাত্রী হতে গিয়ে ছাত্রী হয়ে গেছি!”
ঝুমুরকে অন্যমনস্ক দেখে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকাল শায়লা বেগমের।”এই কি হয়েছে রে ঝুমুর? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
ঝুমুর আশ্বাসের সুরে বললো,”না না কিছু হয় নি।”
সফেদ শার্টের লম্বা হাতা দুটো ফোল্ড করতে করতে সিড়ি দিয়ে নামছিল ওয়াহিদ। শায়লা বেগমের কথা শুনে বলতে লাগলো,”কার কি খারাপ হলো আবার? আর হলেই বা কি ঠিক করার মেকানিক স্বয়ং হাজির!”
তার এমন কথায় হেসে উঠলো সবাই। শায়লা বেগম হাসি থামিয়ে মুখটাকে গম্ভীর করে বললেন,”এখনো কিছুই হয় নি, কিন্তু আজ যদি কেউ নাস্তা না করে ঘরের বাহিরে যায় তাহলে অনেক কিছুই হতে পারে!”
ওয়াহিদ আর কথা না বাড়াল না।হালকা হেসে ঝুমুরের পাশে ফাঁকা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। পাউরুটিতে জ্যাম লাগিয়ে নিয়ে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে ঝুমুরের উদ্দেশ্যে বলে,”আজ তোমার কলেজ যাওয়ার কথা। নাস্তা শেষ করে রেডি হয়ে আসো আমি গাড়িতে ওয়েট করছি।”
ঝুমুর কিছু বলতে যাবে তার আগেই শায়লা বেগম তার হাত চেপে ধরে থামিয়ে দিলেন। বলে উঠেন,”হ্যাঁ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।নাহলে দুজনেরই দেরি হয়ে যাবে।”
______
প্রায় পনেরো মিনিট সময় নিলো রেডি হতে ঝুমুর। কলেজে নির্দিষ্ট ড্রেস পরা যেহেতু বাধ্যতামূলক তাই কলেজ ড্রেসটাই গায়ে জড়িয়ে নিল। আজ ড্রেস পরে কলেজে যাবে ভেবে একটু লজ্জা লাগলো তার। কিন্তু কি আর করার পরতে তো হবেই! আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে বিয়ে করতে পারলে ড্রেস পরা কেন পরতে পারবে না? নিজেকে নিজে এমন ডজনখানেক শান্তনা দিয়ে নিচে নেমে গেল ঝুমুর।
ঝুমুরকে কলেজ ড্রেসে দেখে হা হয়ে গেল ওয়াহিদ। নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে লাগছে। এটা নাকি তার বউ! হায়! এখন তো লোকজন এটা শুনলে তাকে বাল্যবিবাহের অপরাধে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।
ওয়াহিদকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তিতে পরে গেল ঝুমুর। মনোযোগ সরাতে বললো,”আমি রেডি।”
ঝুমুরের কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো ওয়াহিদের।’হ্যা চলো।’
গাড়ির ভেতরে কেউ কোনো কথা বললো না। ওয়াহিদের চেম্বার যেহেতু কলেজ পেরিয়েই তাই ভাবলো ক্লাস শেষ হলে ঝুমুরকে তুলে নিবে।
কলেজের গেইটে গাড়ি থামিয়ে বলল,”তুমি কলেজ শেষ হলে অপেক্ষা করো আমি নিয়ে যাব।”
ঝুমুর মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। গেইটে ঢোকার জন্য পা বাড়াতেই ওয়াহিদ বলে উঠলো,’আর শোনো আমাদের বিয়ের কথাটা আপাতত হাইড করলে তোমার জন্য বেটার হবে।’
ঝুমুর ঠিক বুঝতে পারলো না তার কি সুবিধা অসুবিধা হতে পারে। তবুও মুখে বললো আচ্ছা।ওয়াহিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাসে চলে গেল।
ক্লাসের ঢুকতেই দুই তিন জন ছেলেমেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ঝুমুরের গাঁয়ে। তাঁরা আর কেউ না বন্ধু নামক শত্রু গুলো।ক্লাস শুরু হতে এখনো আধ ঘন্টার মতো সময় বাকি তাই সবাই মিলে বসলো চিরপরিচিত ক্যান্টিনের চত্বরে।
“কিরে ঐদিন যে বললি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এরপরে তো একবারে লাপাত্তা। আসলেই বিয়া শাদি কইরা ফেললি নাকি?” চিন্তিত হয়ে বলছে কেয়া।
কেয়ার কথাকে ব্যঙ্গ করে বলে উঠে নিরব,”আরে ধুর ও হচ্ছে এই ঝাড়ু হচ্ছে রাখাল বালক। মনে নাই কিভাবে ছোটবেলায় ব্যথা পাওয়ার নাটক করে আমাদের ঘোল খাওয়াইতো! মহারানী ভাবছে ওর বিরহে আমরা কাঁদতে কাঁদতে বলবো,”ইশ রে ঝুমুর তুই তিনদিন কলেজে আসিস নাই এতে আমাদের দুই নাম্বার বন্ধ হয়ে গেছে।”
ব্যাস! আগুনে পড়লো ঘি! ঝুমুর চিল্লিয়ে উঠে পাশ থেকে খালি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে নিরবের পেছনে ছুটতে লাগলো।
ক্যান্টিনের বাকিরা যে যার মত স্বাভাবিক হয়েই বসে আছে।কারন এগুলো তাদের নিত্যদিনের দেখা জিনিস।
মিনিট পাঁচেক দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত হয়ে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো ঝুমুর। নিরবও চুপচাপ বসে পড়লো। সবাই ঝুমুরকে এটা সেটা বললেও চুপচাপ বসে আছে আদিল।
আদিল কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে নীরব বললো,” শাকচুন্নির দৌড়ানি খাইলাম আমি আর তুই এমনে মরা’র মতো পইড়া আছোস ক্যান?”
হাসতে হাসতে কেয়া বললো,”মনে হয় বিয়ে ঝুমুরের ঠিক হয় নাই ওর গার্লফ্রেন্ড এর হইছে। যেদিন শুনছে এই কথা ওইদিন থেকে এই এই মুখে রোদ উঠে না।”
আদিল কিছু না বলে উঠে ক্লাসে চলে গেল।
______
ঝুমুর পুরোক্লাসে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত ছিল তা বুঝতে পেরে কেয়া বলে উঠে ,’তোর হয়েছে টা কি ঝুমুর?কিছু না না বললে বুঝবো কি করে!’
ঝুমুর কেয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,’তোকে একটা কথা বলবো তুই এখন এটা কাউকে বলিস না।”
‘কি কথা?”
‘আমার বিয়ে হয়ে গেছে। শাকিল স্যারের ছেলের সাথে।’
‘কি সত্যি!’ হা হয়ে গেল কেয়ার মুখ।
‘হ্যাঁ।’
সকাল থেকে ঝুমুরকে চুপচাপ দেখে সবাই ভেবেছিল মন খারাপ।তাই নিরব আর আদনান গিয়েছিল ঝুমুরের পছন্দের চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম আনতে। ঝুমুরের কথা শুনে আদনানের হাত থেকে আইসক্রিম গুলো রাস্তায় পড়ে গেল।
কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে পেছনে তাকিয়ে আদনান আর নিরবকে দেখে অবাক হয়ে গেল ঝুমুর। মনে মনে ভাবল ধুর যেটা করতে চায় না ওইটাই হয়ে যায় বারবার।
ঝুমুর আদনান আর নিরবের কাছে গিয়ে বলল,’দেখ আমি আজ না হয় কাল তোদের এ ব্যাপারটা বলতাম। কিন্তু চাইছিলাম এখন কেউ না জানুক। তাই বলনি।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! আদনান তো রাগে ফেটে পড়ল। বলতে লাগলো, ‘ধুর শালা’র কপাল! কত আশায় ছিলাম তোদের বিয়াতে সুন্দরী বেয়াইন গো লগে প্রেম করমু ।আর শেষ পর্যন্ত তোরা কিনা না বইল্লাই বিয়া করে ফেললি!’
ঝুমুর কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখল ওয়াহিদের গাড়িটা গেটের সামনে দাঁড়ানো। পরে তোদেরকে সবকিছু পরিস্কার করে বলবো বলে গাড়ির দিকে চলে গেল।
আদিলের নাকি কিছু কাজ আছে তাই তার একটু পরে যাবে। কেয়া,নিরব তাতে সায় জানিয়ে চলে গেল।
আদিল চৈতন্যহীনের মতো গিয়ে বসে রইলো কলেজের সামনের ক্যান্টিনে। যেখানে দিনের শুরুতে একটা হাসিমুখ দেখে মন ভালো হয়ে যেতো। এমনটা তো হওয়ারই ছিল! তবুও মনের কোনো এক কোণে হয়তো একটুখানি ভুল ভ্রান্তি জমা ছিল। ছিল ছোট্ট একটুকরো আশা,যা একটুখানি আলোর দেখা পেলেই বেরিয়ে পড়তো। তার অবচেতন মন ভেবে বসেছিল ঝুমুরও হয়তো তাকে ভালোবাসে! নাহ সব ভুল! সব মিথ্যা! ছেলেরা সহজে যেমন কাঁদতে পারেনা, তেমনি চেপে রাখার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।ভেতরের চেপে রাখা কান্না যেন চোখ দিয়ে রক্ত হয়ে ঝরছে। রাগে কষ্টে নিজের চুল খামচে ধরলো। ভাবতে লাগলো, ঠিকই তো করেছে ঝুমুর। তার মত ছেলেকে কি ভালোবাসা যায় নাকি!তাকে তো শুধু বন্ধু বানানো যায়!
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো আদনান। পিছনে তাকিয়ে দেখল কেয়া। তড়িঘড়ি করে মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। বলতে লাগলো, ‘কিরে তুই এখনো যাসনি? এখানে কি করছিস?’
কেয়া বলে উঠলো,’এই কথা তো আমার তোকে জিজ্ঞেস করার কথা! তুই এখানে কি করছিস?’
আরে কিছু না এদিকে একটু কাজ ছিল। এখনই বাসায় চলে যাব। এদিক সেদিক দেখার ভান করে মুখ লুকিয়ে বলল আদনান।
কেয়া একহাতে আদনানের মুখটা নিজের দিকে ধরে বললো,’দেখ আদনান তুই আর যাই করিস না কেন অন্তত আমার কাছে কিছু লুকানোর চেষ্টা ও করিস না! আমি জানি তুই এখানে কেন বসে আছিস আর তোর যে কোন কাজ নেই সেটা আমি ভালোই জানি।’
একটু থেমে কেয়া আবার বলতে শুরু করলো,’তুই এতদিন কেন তোর মনের কথাটা ওকে বলিস নি? আর শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে ঝুমুরের মনে তোর জন্য বন্ধু ছাড়া আর কোন ফিলিংস কখনোই ছিল না। কিছু জিনিস এমনই হয় আদনান, যা আমরা মন প্রান দিয়েছি চাইলেও পাই না।’
আদনান এবার রেগে গেল। কেয়ার হাত সড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,’তুই কি করে জানবি ভালোবাসা হারিয়ে গেলে কতটা খারাপ লাগে! আর কাকেই বা কি বলছি,
তোর কি কাউকে ভালোবাসার মতো মন আছে নাকি!’
কথাগুলো বলেই আদনান চলে গেল।
পিছনে একবার ফিরেও দেখলো না নিজের কষ্টগুলো যে অন্য একজন মানুষকে দ্বিগুণ আকারে ফেরত দিয়ে চলে গেল। কেয়া বলতে লাগলো,
‘তুই তো মাএ ক’দিন ভালোবেসে হারাচ্ছিস আদনান,আর আমি তো ভালোবাসা বলতেই তাকে বুঝেছিলাম। তার মধ্যেই হারানো আমি টাকে খুঁজে পেয়েছিলাম!’
________
গাড়ির মধ্যে নীরবতা কাটিয়ে ওয়াহিদ বলে উঠলো,’ তোমার লক্ষ্য কি?’
ঝুমুর সবসময়ের মতো বলে উঠে,’ছোটবেলায় ছিল ডাক্তার,আর বড়বেলায় বিয়ে করা।’
ওয়াহিদ তাজ্জব হয়ে গেল ঝুমুরের কথায়। সে মোটেও এমন উত্তর আশা করেনি। হাসতে হাসতে বললো,’এখনো যেহেতু ছোটই আছো তাহলে ছোটবেলার স্বপ্নটাই পূরণ করো। বড় হলে পরেরটা আমি দেখব।’
দুপুর যেহেতু পার হয় যাচ্ছে চলো আজকে বাহিরেই লাঞ্চ করে যাই। ঝুমুর কিছু বলতে যাবে তার আগেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা পার্ক করে ফেললো ওয়াহিদ।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বের হতে হতে একঘন্টা লাগলো। বের হয়ে ওয়াহিদ বললো,চলো একটু শপিং মলে যাই,’প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নেয়ার আছে।’
ঝুমুরের বাসায় পরার তেমন ড্রেস নেই এই জিনিসটা খেয়াল করেছে ওয়াহিদ। তাই ওয়াহিদ বেশ কিছু ড্রেস নিয়ে নিল। ঝুমুর কিছু বললো না কারণ এগুলো তার আসলেই দরকার ছিল। ঘরে তো আর সারাদিন শাড়ি পড়ে রাখা যায় না।ওয়াহিদের আম্মু ঝুমুরের জন্য সব শাড়িই কিনে ফেলেছেন। সবশেষে লাইব্রেরী থেকে ঝুমুরের জন্য অ্যানিমেশনের কিছু বই নিয়ে নিল। ওয়াহিদ সব ঠিকঠাক করে প্যাকেট করে নিচ্ছিল আর ঝুমুর লাইব্রেরীর সামনে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাই দেখলো পাশ থেকে দৌড়ে একটা কুকুর চলে গেল। ওয়াহিদ এসে বলতে লাগলো এই মন কোথায় তোমার,’কুকুর এর সাথে বন্ধুত্ব করছিলে নাকি? পাশে ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কিছু করছিলেই না!’
ঝুমুর তা দেখে মনে বলতে লাগলো,’ধুর এই পড়ালেখা আর কু*ত্তা দুইটাই জীবনের কুফা পিছু ছাড়তেই চায় না।’
চলবে…?