#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৩১
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম
দুপুরে ওয়াহিদ গোসল করতে ঢোকার পর তার ফোনে একের পর এক মেসেজ আসতে শুরু করে। ঝুমুর তখন খাটে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। কিন্তু মেসেজের শব্দে তার মনোযোগ ছিন্ন হলো। এতগুলো নোটিফিকেশন দেখে তার মনে হলো, হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ হবে। ওয়াহিদ তার ফোন লক করে রাখে না, তাই কৌতূহল সামলাতে না পেরে ঝুমুর ফোনটা হাতে তুলে নিল।
স্ক্রিনে ভেসে উঠছিল মিশকাতের নাম। মিশকাত ওয়াহিদের অ্যাসিস্ট্যান্ট, এটা আগেই বলেছিল। কিন্তু এত জরুরী কথা হলে মেসেজের কী প্রয়োজন? সরাসরি ফোন দিলেই তো পারতো। একটু দ্বিধা নিয়ে ঝুমুর মেসেজের তালিকায় ঢুকে প্রথম মেসেজটি খুলল।
“স্যার, আপনি আজকে হসপিটালে আসেননি কেন? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আপনি হয়তো এখন ব্যস্ত। ফ্রি হলে মেসেজ দিন, আমি কল ব্যাক করব।”
ঝুমুরের ভ্রু কুঁচকে গেল।স্ক্রল করতে করতে সে আরও কিছু মেসেজ দেখতে পেল। বেশিরভাগই রাতের সময় পাঠানো—সবই অনেকটা একই রকম। কিন্তু ওয়াহিদ কোনো মেসেজের উত্তর দেয়নি। এটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেও মনের ভেতর প্রশ্নের ঢেউ তুলল—এই মেয়ের ওয়াহিদের সাথে এত কথা কিসের?
হঠাৎ ঝুমুরির চোখ আটকে গেল কয়েকমাস আগের একটা মেসেজে।
“স্যার,গতকাল রাতে পার্টিতে আপনাকে খুব হ্যান্ডসাম লাগছিল।”
ঝুমুরের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। পার্টি? ওয়াহিদ কোন পার্টিতে গিয়েছিল? তার তো এ ব্যাপারে কোনো কিছুই মনে নেই। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে থাকার পর তার মনে পড়ল কয়েক মাস আগের একটি ঘটনা। ওয়াহিদের এক বন্ধুর এনগেজমেন্ট পার্টিতে দু’জনেই একসঙ্গে গিয়েছিল। সেদিনের কিছু মুহূর্ত এখন স্পষ্ট হতে লাগল। কিন্তু সেই পার্টিতে ওয়াহিদের অ্যাসিস্ট্যান্ট কেন যাবে? আর গেলেও বা ঝুমুরের সাথে ওয়াহিদ তার পরিচয় করিয়ে দেয়নি কেন?
ঝুমুরের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল নানান ভাবনায়। ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে সে চুপচাপ খাটে বসে রইল। তার ভেতরটা এক অজানা আশঙ্কায় তোলপাড় করতে লাগল।
আচ্ছা, ওই রাতের সেই মেয়েটাই কি মিশকাত?
মনে প্রশ্নের ঝড় নিয়ে ঝুমুর আনমনে বসে রইল। ঠিক তখনই ওয়াশরুম থেকে ওয়াহিদ বেরিয়ে এল। ভেজা চুল মুছতে মুছতে সে ঝুমুরের দিকে তাকাল। ঝুমুরকে এমন উদাসীন দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ঝুমুর, কী হয়েছে? আমার ফোন এসেছিল মনে হয়? জরুরী কোন ফোন ছিল?”
ঝুমুর কোনো উত্তর দিল না। ওয়াহিদ আবার এগিয়ে এসে বলল,
“কি হলো? কথা বলছো না কেন?”
ঝুমুর সোজা হয়ে বসল। ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ, আপনার ফোনে অনেকগুলো মেসেজ এসেছে। আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট মিশকাতের।”
ওয়াহিদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ওহ, বাদ দাও। ওয়ার্কিং আওয়ার ছাড়া এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না।”
ঝুমুর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এরপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমার মনে হয়, আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট মিশকাত আপনাকে পছন্দ করে।”
আচমকা ঝুমুরের এমন কথায় ওয়াহিদ চমকে উঠল। যেন অপ্রত্যাশিত কিছু শুনেছে। সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে বলল
“কি বলো এসব? এরকম কিছুই না! মিশকাত এমনই একটু খোলামেলা স্বভাবের। আর ও তো জানে আমি ম্যারিড!”
ঝুমুরের ঠোঁটে একধরনের ব্যঙ্গাত্মক হাসি খেলে গেল।
— “খোলামেলা স্বভাব বললেই কি কারও মেসেজের ভাষা এমন হয়? রাতের বেলায়, পার্টি নিয়ে এইসব কথার মানে কী? মিশকাত কি জানে, আপনার স্ত্রী এসব জানতে পারলে কি হবে?”
ওয়াহিদ অপ্রস্তুতভাবে বলল,
“তুমি ভুল বুঝছ, ঝুমুর। আমি কখনো মিশকাতের সঙ্গে এমন কিছু করিনি যাতে ও এমনটা ভাবার সুযোগ পায়। আর আমি তোমাকে ওর কথা জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু যেখানে আমি কোনোভাবেই ওর এইসব টলারেট করি না তাহলে তোমাকে জানিয়ে কি লাভ। বেশ কয়েকবার ওকে বাদ দিয়ে অন্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ঠিক করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর ফিনান্সিয়াল অবস্থা দেখে মায়া হয়েছে। আর আমি ভেবেছিলাম ও শুধরে যাবে।”
ওয়াহিদ এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। ঝুমুরের চোখে ঝাঁপসা কিছু দেখতে পেয়ে সে একটু অস্থির হয়ে উঠল।
“ঝুমুর, আমি তোমার কাছে কখনো কিছু লুকাইনি। আর মিশকাতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধুই পেশাদারি।আর আমি কালই নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করব।”
ঝুমুর ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
দেখুন নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস বলে যদি কিছু হয় সেটা আমি আপনাকে করি। আপনাকে মোটেও আপনাকে নিয়ে ভয় পাই না। আর এটাও ভাবি না যে আপনি আমার থেকে কিছু লুকাবেন। শুধু কেন জানিনা আমার ওই মেয়েটাকে ভালো লাগছেনা।”
ওয়াহিদ সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ঝুমুরের সামনে বসে বলে,
“তুমি যেটা বলবে সেটাই হবে ঝুমুর। আমাদের মাঝে এমন কিছুই থাকবে না যেটা আমাদের মাঝখানে দুরত্ব তৈরি করবে।”
*
ঘামে ভিজে একাকার হয়ে দুপুর ঠিক তিনটায় বাড়ি ফিরলো আদিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার মা যেন এক পাহারাদারের মতো অপেক্ষা করছেন।দরজার কাছাকাছি যেতেই মাকে দেখে তার কপালে ভাঁজ পড়ে। তপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
সাহিদা বেগম তার চোখের দৃষ্টি তার দিকে ছুঁড়ে পাল্টা জবাব দিলেন,
“কী হয়েছে সেটা তো আমিই জিজ্ঞেস করব! এতক্ষণ কোথায় ছিলি? এই সময়ে বাড়ি ফেরার সময়? নাকি ব্যবসার দায়িত্ব দিয়েছি বলে নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে আমাকে শাস্তি দিচ্ছিস?”
আদিল মায়ের কথায় হালকা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ওহ মা, নতুন আরতে বসেছি তো। হিসেব-নিকেশে একটু গরমিল হচ্ছিল, তাই সময় বেশি লেগে গেছে। আর আসছি তো! এখন গোসল করব, খেতে বসব। তুমি ভাত দাও টেবিলে।”
বলে সে ঘরের ভেতর যাওয়ার জন্য ঘুরতে নেয়। কিন্তু মায়ের গলা আবার তাকে থামিয়ে দিল,
“আজ মোবাইলটা ফেলে গিয়েছিলি। কেয়া ফোন দিয়েছিল কয়েকবার। আচ্ছা, কেয়ার সাথে তোর কী চলছে বল তো?”
মায়ের সরাসরি প্রশ্ন শুনে আদিল যেন থমকে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“কেয়ার সাথে আমার কী আবার থাকবে! এমনিই বন্ধু হয়।”
মা এগিয়ে এসে ছেলের সামনে দাঁড়ালেন। আদিলের শার্টের কলার টেনে ধরে যেন আরও শক্তভাবে বললেন,
“কী মানে? তুই কী সত্যিই কিছু জানিস না? খুব ভালো তো! বাইকে করে তো খুব ঘুরাঘুরি হয়। আর আমি জিজ্ঞেস করলেই বলিস ‘এমনি’?”
আদিল তখন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। বলল,
“ওইটা তো এমনি। একটু ঘুরতে চাইছিল, তাই বাইকে উঠিয়েছিলাম।”
মায়ের ঠোঁটের কোণে সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি।
“ওহ আচ্ছা! এমনি না কি! সেইটা আমি পরে বুঝব। এখন যা করছিস, সেটাই কর। পরে সময়মতো একজনকে খুঁজে দেব নাহয়!”
আদিল বিস্মিত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কী ?”
মা দৃঢ় গলায় উত্তর দিলেন,
“হ্যাঁ। সারা জীবন তো আর পরের বাড়ির মেয়েকে তোর বাইকে চড়ার সুযোগ দিয়ে রাখবে না। তার জন্য তো নিজের ঘরে নিয়ে আসতে হবে।”
মায়ের এমন কথায় আদিল একদিকে লজ্জায়, অন্যদিকে বিব্রত হয়ে হাসল।
“ধুর বাদ দাও তো এইসব। আচ্ছা আমি যে কেয়াকে বাইকে উঠেয়েছি তোমাকে এই কথা কে বলল?”
“পলি বললো সেদিন। আচ্ছা তুই পরশুদিন কেয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি না?”
আদিল নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকায়।
“আচ্ছা বুঝেছি এখন গোসল করে খেতে আয়। এসব নিয়ে আমি পরে কথা বলব।”বলেই সাহিদা বেগম চলে যেতে নিলেন
হঠাৎ আদিল মাকে বললো,
“মা তোমার কি কেয়াকে পছন্দ?”
সাহিদা বেগম যেন এই কথাটার অপেক্ষায় ছিলেন। মুখে বললেন,
“না।”
আদিল চমকে উঠলো।
“কেন?”
“কারন কেয়াকে তো আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে সেই কবেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছি। আলাদা করে আর কি পছন্দ করব রে?”
চলবে…..