প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-৯+১০

0
4

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৯
#লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

বাইরে থেকে এসেই দরজা-জানলা সব বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল কেয়া। মা ঘরের সামনে এসে বেশ কয়েকবার ডাকলেও কোনো সাড়া দিল না। কেয়ার মা জানে তার মেয়ের প্রায় সময়ই এমন করে তাই আর তিনি আর তেমন পাত্তা দিলেন না। ভাবলো হয়তো মাথা ব্যথা করছে।
দরজার সামনে থেকে চলে যাওয়ার আগে কেয়াকে আর একবার ডেকে বললেন,’শরীর ভালো লাগছে না নাকি? গোসল করে খেতে আয়।’
কেয়া আগের মতই নিঃশব্দে শুয়ে রইল। দরজার সামনে থেকে মায়ের ছায়াটা সরে যেতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আর কত সহ্য করবে সে! তার ভালোবাসার মানুষটা অন্য আরেকজনের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য জ্বলে পুড়ে মরছে। ওকে ভালবাসলে কি এমন ক্ষতি হতো? মানুষ যা চায় তা তার সাধ্যের বাইরে কেন থাকে? চাওয়া পাওয়ার জিনিসগুলো পেয়ে গেলে জীবনটা কতই না সহজ হতো!
আজ থেকে আট বছর আগের কথা। তখনো ওদের বন্ধুত্ব ছিল ঠিক এখনকার মতোই। সেসময় ওরা ফাইভে পড়ে হয়তো। আদিল আর তার বাসা কাছাকাছি হওয়ায় সব সময় একসাথেই স্কুলে যাওয়া হতো তাদের। আদিল বিশ-পঁচিশ মিনিট আগেই তাদের বাড়িতে এসে হইহুল্লোর লাগিয়ে দিত। কেয়ার মা রেহনুমা খানম নিজেও তাকে ভীষণ ভালোবাসতো।বাবা হারা ছোট্ট ছেলেটাকে দেখলে তার ভীষণ মায়া হতো। একটু দুষ্টু হলেও আদিল পড়ালেখায় ছিল সবসময় ফার্স্ট। মাঝেমধ্যেই নিজের সাথে বসিয়ে নাস্তা খাওয়াতেন। ভালোমন্দ কিছু রান্না হলেই ডেকে নিয়ে আসতেন। সে সময়কার একটা ঘটনা, কেয়াদের বাড়িতে তার বড়খালা বেড়াতে এসেছিল। সাথে ছিল তার বারো বছরের এক ছেলে রাফি। যার সাথে কেয়ার ছিল একদম গলায় গলায় ভাব। বাসায় মেহমান আসাতে যেহেতু অনেক ভালো-মন্দ রান্না হয়েছে। তাই কেয়ার মা ও খেলার ছলে আদিলকে বাড়িতে ডেকে নিল। আদিল বাড়িতে এসে কেয়ার ঘর সহ সারা বাড়ি খুঁজেও কেয়াকে কোথাও না পেয়ে ছাদে ছুটে গেল। ছাদে গিয়ে দেখলো,কেয়া তার মায়ের একটা লাল বেনারসি ওড়না শাড়ির মতো গায়ে জড়িয়ে পরেছে। আর কেয়ার সেই খালাতো ভাই রাফির পরনের একটা হলুদ পাঞ্জাবি। মূলত তারা দুজনে মিলে বর বউ খেলছে। কেয়া ওড়নার শেষ মাথাটা কোমরে পেঁচিয়ে রেখে ঢং করে রাফির সামনে গিয়ে বললো,
‘এই নেও তোমার চা।’
কাঁঠাল পাতা দিয়ে বানানো চায়ের কাপটা আর রাফির হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই একটা হাত তার চুল টেনে ধরে পেছনে নিয়ে গেল। কেয়া পেছনে তাকিয়ে আদিলকে দেখে কিছু বলবে তার আগেই চুলে আরো জোরে টান লাগায় কেঁদে উঠলো।
আদিল বলতে থাকে,’ বর বউ খেলছিলি কেন ওর সাথে? আমি না বলেছিলাম আমার সাথে ছাড়া আর কারো সাথে তুই বর বউ খেলবি না।’
কেয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে,’আদিল ছাড় আমি ব্যাথা পাচ্ছি।’
আদিল কেয়ার চুল থেকে হাত সরিয়ে নিল। হাত উঠিয়ে রাফি কি কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই কেয়া ওর হাতে জোরে একটা কামড় বসিয়ে দিল। কেয়াকে আবার ধরতে যাবে তার আগেই দৌড়ে পালিয়ে গেল।
সেদিন রাফির সাথে আদিলের তুমুল মারামারি হয়েছিল। কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল রাফির হাত। বারবার শুধু একটাই কথা বলছিল, ‘তুই কেন ওর সাথে বর বউ খেলছিলি? তুই জানিস না কেয়া আর শুধু আমার সাথে বর বউ খেলে!’
ওই ঘটনার পর থেকে রাফি বেচারা ভয়ে আর কেয়াদের বাড়িতেই আসে না।
শুধু ওইটাই না আরো এমন বহু ঘটনা আছে যা দেখে কেয়ার মনে হয়েছিল আদিলের মনে হয়তো ওর জন্য কিছু আছে যা আর কারো জন্য নেই। তাই সে নিজেও ধীরে ধীরে প্রেমের বীজ বুনেছিল মন জমিনে। কিন্তু নাহ সে ভুল! তবে তার ভালোবাসা নিশ্চয়ই ভুল নয়, সে আগে যেমন আদিলকে চাইতো, এখনো চায়, পরেও চাইবে।এসব ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেয়া।

______

ঝুমুর আর ওয়াহিদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল হলো। সারা বাড়ি জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। ওয়াহিদ ঝুমুরকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করতে গেল। ঝুমুর নিঃশব্দের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ওয়াহিদ গাড়ি পার্ক করে বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে রুমে গেল। ঝুমুর ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আজকের কেনা ড্রেস গুলোর মধ্য থেকে একটা ড্রেস বের করে পড়ে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করতে করতে চুল মুছছিল।
‘চুল শুকানো শেষ হলে বই নিয়ে বসো।’
পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে আসতেই পেছনে তাকিয়ে দেখলো দুই কাপ কফি হাতে নিয়ে ওয়াহিদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
এই অবেলায় পড়ার কথা শুনে ঝুমুর যেন আকাশ থেকে পড়লো। ‘পড়ার সময় পড়িনি আর এখন পড়বো! হুহ!’তবে মনের কথা কথা মনেই রইলো। মিনমিন করে বলে,
‘এখন পড়তে বসবো?’
ওয়াহিদ ঝুমুরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা কফির মগ হাতে দিয়ে বলল ‘ হ্যাঁ এখনই! কারণ দুই মাস পরেই তোমার টেস্ট পরীক্ষা।কোন কোন সাবজেক্ট সমস্যা আছে সেগুলো বের করো। আজকে সাবজেক্ট অনুযায়ী একটা রুটিন বানিয়ে দিব তাহলে করতে অসুবিধা হবে না। আর আমি একটা কোচিং সেন্টারে কথা বলেছি। আব্বুর পরিচিত একজন পড়ায় সেখানে। ভাবছি তোমাকে সেখানেই ভর্তি করে দিব।’
গরগর করে একগাদা আদেশ শুনিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল ওয়াহিদ। প্রায় আধঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে এক অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে চোখ কপালে উঠে গেল তার। সারা বিছানা জুড়ে বইপত্র ছড়ানো ছিটানো আর তার মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে ঝুমুর। ওয়াহিদ কয়েকবার ডেকেও কোন সাড়া পেল না। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সদ্য ভেজা চুলগুলোকে ঝুমুরের মুখের সামনে নিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে দিল। এবার ঝুমুর একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের ঘোরে বলতে লাগলো,’আম্মু পানি দিও না প্লিজ।আর একটু ঘুমাবো।’
ওয়াহিদ এবার হা হা করে হাসতে লাগলো। তবে আর ডাকলো না ঝুমুরকে। ভাবলো কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিলে ভালো লাগবে।
চুল মোছার ভেজা টাওয়াল টা বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে এসে বেড সাইড টেবিল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো কিছু পেন্ডিং কাজ শেষ করতে।

মাগরিবের আজানের আগমুহূর্তেই ঘুম ভাঙলো ঝুমুরের। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে ওয়াহিদকে ঘরের কোথাও দেখতে পেল না। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো ওয়াহিদ তাকে বই নিয়ে বসতে বলেছিল, আর সে কিনা ঘুমিয়ে পড়েছে! বেশ কিছুক্ষণ সময় ঘরেই বসে ছিল। ভাবলো একটু নিচে গিয়ে দেখবে নাকি কি করছে সবাই। যে ভাবা সেই কাজ কিন্তু নিচে গিয়ে দেখলো সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। শুধু বাড়ির সদস্যরাই না সাথে দু’জন নতুন মানুষকে দেখতে পেল।
পরে শায়লা বেগম ঝুমুরের সাথে বড় ছেলে ও তার স্ত্রী সামিয়ার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আজ যে ওরা আসবে এই কথা ঝুমুরের মাথাতেই ছিল না। মনে মনে ভাবলো,
‘ইশ কি ভাবলো সবাই! বাড়িতে মেহমান এসেছে আর সে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল!’
ঝুমুরের অস্বস্তি বুঝতে পেরে সামিয়া বলে উঠে,’তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই আমরাই ডাকতে মানা করেছিলাম। এখন তো আমি এখানেই থাকবো সারা দিন রাত পড়ে আছে কথা বলার জন্য।’

______

এই নিয়ে চব্বিশ বারের মতো রিং বাজতেই কলটা রিসিভ করলো কেয়া। অপর পাশের ব্যাক্তি টি চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘কিরে কল ধরিস না কেন? বাসায় গিয়া পৌছাইছোস?’
‘নাহ রাস্তায় বইসা হাডুডু খেলতেছি! তুই ও আয়!’রেগেমেগে বললো কেয়া।
‘ওই সয়তান আমি ক্যান তোর লগে হাডুডু খেলমু! তোর জামাইরে নিয়া খেল।’বলতে বলতে কল কেটে দেয় আদিল।
কেয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলটা কেটে গেল। তবে এতক্ষনের মনখারাপের রেশটুকু কেটে গেল কেয়ার।

চলবে…?

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_১০
লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

রাতে হসপিটাল থেকে জরুরি কল আসায় সেখানে চলে গেল ওয়াহিদ। যাওয়ার আগে বাসায় বলে গেল আজ রাতে সেখানেই থাকবো। ওয়াহিদ চলে যাওয়ার পর রাত এগারোটা পর্যন্ত বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলো ঝুমুর। তারপর সবার সাথে একসাথে বসে ডিনার করলো। রুমে এসে দেখলো তার ফোনটা অনবরত বেজেই চলছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো বাবার ফোন। প্রায় আধঘন্টা কথা বললো বাবা মায়ের সাথে।ফোন কেটে দেয়ার দুই মিনিটের মাথায় একই নাম্বার থেকে আবার কল এলো। ফোন কানে লাগাতেই অপরদিক থেকে জাবির বলে উঠলো,
‘ ওই আপি শোন আজকে তোর একটা পার্সেল এসেছে। আমি কি এটা আম্মুকে দিয়ে দিব?’
জাবিরের কথা বুঝতে মিনিট দুই এক সময় লাগলো ঝুমুরের। বুঝতে পারল জাবির কিসের কথা বলছে। সে বলতে লাগলো,
‘এই না না আম্মুকে দিস না। আমি কালকে কলেজে যাওয়ার আগে নিয়ে যাব।’
জাবির বলে উঠলো,
কিন্তু তোকে দিয়ে আমার কি লাভ? তারচেয়ে বরং আম্মুকে দিয়ে দেই আম্মু যেহেতু বলেছে আমাকে নতুন রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা কিনে দিবে।’পুরোটাই মিথ্যে বললো।
‘ওহ আচ্ছা এই কথা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির লাগবে! থাক তুই বরং আম্মুকেই দিয়ে দে। আমিও দেখি আম্মুকে টিনার কথা বলি।’
‘আরে ধুর তুই আসলেই একটা গাধা,তোর জিনিস আমি অন্যদের কেন দিবো? মজা করছিলাম হে হে!’
‘আচ্ছা রাখছি এখন ঘুমা।’
ঝুমুর একমাস পর আবার সেই পার্সেল! এতদিন কোথায় ছিল মানুষটা? নাকি তার বিয়ে হয়ে গেছে বলে আর দেয় নি!

_______

সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা খালি দেখে ঝুমুরের মনে পড়লো পাশের মানুষটা কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে দেখলো ড্রয়িং রুমে বসে শাকিল সাহেব, ওয়াহিদ, ওয়ালিদ একসাথে বসে চা খাচ্ছে আর কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। ওয়াহিদের দিকে তাকাতেই দেখলো চোখমুখ লাল হয়ে আছে। সারারাত না ঘুমানোর ফলে নিশ্চয়ই। ঝুমুর মনে মনে ভাবলো ওয়াহিদ নিশ্চয়ই এখন ঘুমাবে। তাহলে এই সুযোগে সে কলেজে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে পার্সেলটা নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ওয়াহিদ তার ভাবনায় পানি ঢেলে দিয়ে বলে উঠলো,
‘তুমি নাস্তা করে রেডি হয়ে এসো আমি তোমাকে কলেজে দিয়ে আসবো।’
‘আমিই একাই চলে যেতে পারবো। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনি রেস্ট নিন।’
‘সমস্যা নেই। তুমি রেডি হয়ে আসো।আমি তোমাকে দিয়ে এসে ঘুমাবো’
ঝুমুর আর কিছু বললো না চুপচাপ রুমে চলে আসলো। রুমে এসে রেডি হবে এমন সময় সামিয়া রুমে আসলো।
গুড মর্নিং কিউটি! কোথাও যাওয়ার প্রিপারেশন চলছে নাকি?’
‘গুড মর্নিং ভাবি। এই তো কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি।’
সামিয়া ঝুমুরের গাল টেনে দিয়ে বলে,
‘হায়! শেষমেষ পিচ্চি একটা মেয়েকে বিয়ে করলো ওয়াহিদ! আচ্ছা যাই হোক শোনো আজ কলেজে যাওয়া লাগবে না। চলো কোথাও ঘুরে আসি। এতদিন পর বিডিতে আসলাম কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও ঘুরতে যেতে পারলাম না। তোমার ভাইয়াকে বললাম কিন্তু সে তো ব্যস্ত তার কাজ নিয়ে।’
‘ওহ। কিন্তু আপু উনি তো মনে হয় মানবেন না।’
সামিয়া হাসতে লাগলো ঝুমুরের কথায়।
‘উনি? বাহ! আচ্ছা শোনো তোমার উনি কি রাজি করানোর দায়িত্ব আমার।’
‘কাকে রাজি করানোর কথা চলছে শুনি?’
পেছন থেকে ওয়াহিদ এর কন্ঠ শুনে সামিয়া তার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘টু দ্যা ইয়াঙ্গার প্রিন্স অফ শেখ ভিলা।’
‘ওহ কিপ ট্রাইং।’
সামিয়া এবার বেশ সিরিয়াস ভাবে বলে উঠলো,
‘এই আমি মজা করছি না। আমরা কিন্তু সত্যিই যাচ্ছি। বাসায় বসে বসে বোরিং লাগছে।’
‘ভাইয়া যাবে সাথে?’
‘নাহ তোমার ভাইয়ার নাকি কাজ আছে।’
‘আমরা তো একাই যেতে পারবো আর সাথে তো ড্রাইভার আছেই।’
ওয়াহিদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,’আচ্ছা বিকালে নিয়ে যাবো। দুপুরে হসপিটালে যাবো একবার তারপর এসে নিয়ে যাবো আমি। রেডি থেকো তোমরা।’

______

ওয়াহিদ ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে ঝুমুরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
‘কালকে রাতে হসপিটাল থেকে কল এলো না? গিয়ে দেখি আঠারো উনিশ বছরের একটা ছেলে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে অবস্থাও খুব ক্রিটিক্যাল। কিন্তু আশ্চর্যজনক কাহিনী রোগীকে হাসপাতালে আনার দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও বাড়ি থেকে কেউ আসেনি।পরে শুনলাম মোবাইল নাকি চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মোবাইল অন করে কল লিস্টের প্রথমেই একটা নাম্বার পেয়ে কল করে বললাম, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলেনি।কি জানি একটা মেয়ের নাম্বার ছিল উমম… কেয়া মনে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে মেয়েটা চলেও এলো সাথে একজন মহিলাও ছিল হয়তো ছেলেটার মা। দুপুরে একবার দেখে আসবো।’

‘ঝুমুর যেন প্রাণহীন কোনো মুর্তি। আঠারো উনিশ বছরের একটা ছেলের বাইক এক্সিডেন্ট আর কেয়া নামটা ব্যতীত কানে আর কোনো কথা ঢুকছে না। মাঝে মাঝে মানুষের এমন কিছু অনুভূতি হয় যা বুকের ভেতরে সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেও বাইরে থেকে দেখতে একদম চকচকে।’
ঝুমুরকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে ওয়াহিদ কাঁধে হাত রেখে বলে উঠে,
‘কি হয়েছে ঝুমুর?’
‘ফাটা একটা গ্লাস জোড়া লাগানোর পর একটু ছোঁয়া লাগলেই যেমন ভেঙ্গে যায়, ঝুমুর ও ঠিক তেমন ভাবেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। হঠাৎ মেঝেতে বসে শব্দ করে কেঁদে উঠলো ঝুমুর।
হঠাৎ কান্না দেখে বিস্ময় এর চরম সীমায় পৌঁছে গেল ওয়াহিদ। হন্তদন্ত হয়ে ঝুমুরকে ধরে বিছানায় বসালো।
‘কি হয়েছে না বললে বুঝবো কি করে? কান্না থামাও প্লিজ।’
কান্নার তোপে গলা ধরে আসছে ঝুমুরের।
‘ওই ছেলেটার নাম কি আদিল?’
ওয়াহিদ মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করলো উওর বের করার আশায়। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো, হ্যাঁ ওই কেয়া নামের মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো আদিলের কি হয়েছে? ও ঠিক হয়ে যাবে তো?
ঝুমুরের কান্না দেখে এখন তার নিজেরই অস্থির লাগছে। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বললো, ‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে নিয়ে চলুন হসপিটালে। এক্ষুনি যেতে চাই আমি।’
ওয়াহিদ আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।সে বুঝে নিল ছেলেটা ঝুমুরের কাছের কেউ হবে নিশ্চয়ই।
মুখে শুধু বললো,’ আচ্ছা তুমি আসো। আমি গাড়ি বের করছি।’

_______

হসপিটালের করিডোরে বসে আছে ঝুমুর। ওয়াহিদ সিনিয়র একজন ডাক্তারের সাথে আদিলের রিপোর্টগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেছে। সারা হসপিটাল জুরে তীব্র ফিনাইল এর গন্ধ ভাসছে। কয়েকবার গা গুলিয়ে আসতে চাইলো ঝুমুরের। তবুও মনের সঙ্গে একপ্রকার যুদ্ধ করে বসে রইলো। এখন ডাক্তারদের ভিজিটিং আওয়ার তাই বাহিরের কেউ কেবিনে ঢুকতে পারবে না। আর আধঘন্টা পর ভেতরে যেতে পারবে। হাসপাতালের সামনের ফার্মেসি থেকে ডাক্তারের লিখে দেওয়া ঔষুধ গুলো নিয়ে মাএই ফিরলো কেয়া।
ঝুমুরকে দেখে প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে না দেখার অভিনয় করে অন্যদিকে গিয়ে বসে পড়লো। ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে কেয়ার পাশে গিয়ে বলতে লাগলো,
‘এই তুই আমাকে কিছু বলিস নি কেন?’
কেয়া মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।
ঝুমুর কেয়ার হাত ধরে বলতে লাগলো,
‘তুই এমন করছিস কেন আমার সাথে?আমি কি কিছু ভুল করেছি?’
কেয়া টান দিয়ে ঝুমুরের কাছ থেকে হাত সড়িয়ে নিল। রাগে হালকা করে বলতে লাগলো,
‘কি করিস নি তুই? খুব ভালো লাগছে না এখন? তুই তো বিয়ে করে খুব সুখে আছিস,তোর জন্য কেউ মরে গেলে তাতে তোর কি আসে যায়! তোর জন্যই তো আদিলের আজ এই অবস্থা!’
‘কি আবোল তাবোল বকছিস কেয়া! আমার জন্য?’
হ্যাঁ তোর জন্য! কারন ও তোকে ভালোবাসে আর কাল তোর বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই ও এমন করছে। কেন রে তুই কি কচি খুকি নাকি? একটা মানুষ তোকে এতদিন ধরে ভালোবাসে আর তুই ধরতেই পারলি না! বাহ! ভালোই যখন বাসিস না তাহলে এতো প্রশ্রয় দিয়েছিস কেন?’
ঝুমুর কিছু বলল না। কথা বলার জন্য কোনো শব্দই খুঁজে পেল না সে। আদিল তাকে ভালোবাসে! কই সে তো বন্ধু ছাড়া আর কোনো সম্পর্কের কথা কোনোদিন মাথায় আনতেই পারে নি। আর রইলো প্রশ্রয়ের কথা ভালোবাসার সম্পর্ক ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কোনো সম্পর্ক নেই! কেয়া কেমন করে এই কথা বলতে পারলো! তার তো ছিল কোনোরকম রক্তের সম্পর্ক ছাড়া একটা সম্পর্ক। যেখানে শুধু একে অন্যের দুঃখ ভাগ করে নেয়া হয়, হাঁসি তো কেড়ে নেয়া হয় না।

চলবে….?