#প্রেয়সী ♥(৪০)
#লেখিকা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
৭৮.
মাস দুয়েক পেরিয়ে গেলো রাহিয়ান আগের মতো বাড়িতে সময় দিতে পারেন না। সেদিনের পর থেকে উনি খুবই কম কথা বলেন আমার সাথে। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বলেন। তবে আমার যত্নের কোনো ত্রুটি রাখেননি উনি। অভিযোগ করার মতো কখনই কিছু খুঁজে পাওয়া যাবেনা উনার বি*রু*দ্ধে। তবুও আমি মেনে নিতে পারছি না উনার চুপচাপ ভাব ভঙ্গিমা। কাজের প্রেশারে কখনও কখনও রাতে ফিরেন না উনি। রাত করে অপেক্ষা করি কিন্তু মুখ ফুটে বলিনা, আজ একটু জলদি বাসায় ফিরবেন! ছোট্ট একটা কল করে উনাকে জিঙ্গেস করা হয়না, আজ কখন ফিরছেন? আমাদের ঘরে কোনাকোনি ভাবে দুটো ক্যামেরা লাগানো হয়েছে! যাতে উনি অফিসে থেকেই আমার উপর সুন্দর ভাবে নজর রাখতে পারেন। কোনো রকম কোনো অস্বাভাবিকতা দেখলে যেন তৎক্ষনাৎ ছুটে আসতে পারেন। দুজন নার্সও রাখা হয়েছে সারাক্ষণ আমার শারিরীক কন্ডিশন চেক করার জন্য। কোনো রকম ত্রুটি নেই। সবটাই নিখুঁতভাবে হ্যান্ডেল করছেন উনি। কিন্তু এই সব কিছুর মাঝেও যেন সজীবতা নেই। সবটাই নিষ্প্রাণ লাগছে। সারাক্ষণ অস্থিরতা,বিষন্নতা নিয়েই পার করতে হচ্ছে প্রতিটা দিন,প্রতিটাক্ষন!
চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে আমার! মা হওয়ার সুখ আর য*ন্ত্র*ণা দুটোই বেশ ভালো ভাবে ইনজয় করছি। হাতে পায়েও বেশ পরিবর্তন। সেই রোগা পাতলা মেয়েটা ৫৪ কেজি ওজন ভে*ঙ্গে ৬০ কেজিতে পদার্পণ করেছে। গালে মাংস জমেছে। সেই স্লিম ফিটনেস বডি ভে*ঙে একটু একটু করে একজন পরিপূর্ণ মা হয়ে ওঠার গল্পটা হয়তো একটু ভিন্নই হয়। উনি বুঝি আমার এই পরিবর্তন গুলো লক্ষ করেননি। যদি করতেন তাহলে নিশ্চয়ই কিছুটা মজা আর খুনসুটি করে আমাকে রা*গা*তে*ন! আমিও বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে রা*গ*তা*ম। উনি হেসে কুটিকুটি হতেন। আর আমি? আমিও চোখ মুখ কুঁচকে গাল ফুলিয়ে থাকতাম। সেই খুনসুটি গুলো আজ আর নেই। সবটা চা*পা পড়েছে অভিমানের বড় বড় পা*হাড় গুলোর নীচে।
ঐদিকে শুনেছি কেশব বিয়ে করেছে। মেয়েটা তার অফিসের ছোটখাটো কর্মচারী! বিয়ে করে বেশ সুখেই জীবন পার করছে তারা। আমায় না পাওয়ার আক্ষেপ বুঝি ঘুচল কেশবের! রিম্মি আপু বলল, মেয়েটা অতিশয় নম্র ভদ্র। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা নেই। ছোট একটা বোন আছে। পরিবার বলতে সে আর তার ছোট বোন। ছোট বোনটা এবার মাধ্যমিক দিলো। পড়াশোনার খরচ চালাতে না পারায় অফিসের বসের কাছে এপ্লিকেশন জমা দিয়েছিলো বেতন বাড়াতে। কেশব কি ভেবে মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দু’দিনের মাথায় চুপিসারে বিয়ে করল। যেদিন কেশবের বিয়ে ছিলো সেদিন রাহিয়ানকে কাউকে একটা বলতে শুনেছিলাম, “এটা ওর একটা নতুন চাল!” এমন কিছু যে আমারও মনে হয়নি তা কিন্তু নয়! তবে আজকাল নিজেকে নিয়েই বেশ অসুবিধায় পরে গিয়েছি আমি! অন্যের কথা ভাবার আর সময় কই?
—-” শেষ বেলায় ছাদে থাকতে নেই। জ্বীন-পরির আচর লাগে।”
কথাটা বলেই হেসে পড়ল হিয়া আপু। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই হিয়ার আপুর হাস্যজ্বল মুখটা ভেসে উঠল। ঠোঁটের কোনে ক্লান্তির হাসি দিয়ে বললাম,
—-” হিয়া আপু্? কতদিন বাদে এলে!”
হিয়া আপু হাসি মুখে বলল,
—-” হুম। অনেকদিন পর! কেমন আছো কিউটি?”
—-” এই তো যেমন দেখছো। এতদিন কেন এলেনা?”
—-” আর বলো না। সে অনেক কথা! একটা জবের জন্য অনেক ট্রাই করছি গো কিন্তু কিছুতেই হচ্ছিল না! অবশেষে লাস্ট মান্থে একটা জব হয়ে গেলো। সেখানেই জয়েন করা নিয়ে অনেক ঝা*মে*লা পোহাতে হলো। অবশেষে জয়েন হতে পারলাম। বেশ ভালো জব বুঝলে। আজ ১০দিন হলো জয়েন করেছি। ফাহিমের সাথেও এতোদিন ঠিক করে দু’দন্ড কথা বলতে পারিনি! সে তো ভীষণ ফুলে আছে। তাই আজ সময় নিয়ে ওর সাথে দেখা করতে এলাম। বাইরেই মিট করতাম কিন্তু তোমার কথা মনে হতেই সোজা বাড়িতে চলে এলাম।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,
—-” খুব ভালো করেছো। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি তোমায় দেখে। মাঝেমধ্যে একটু আসলেও তো পারো।”
—-” এখন থেকে রোজ আসবো দেখে নিও।”
হিয়া আপুর তৃপ্তি মুলক বানিতে আমি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—-” রোজ আসতে পারবে? আর অফিসের কি করবে?”
হিয়া আপু লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
—-” বাবা বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গিয়েছে। বলেছেন দু’একদিনের মধ্যেই ফাহিমের পরিবারের সাথে কথা বলবে।”
—-” সত্যিইই!”
—-” হ্যাঁ গো সত্যি। সো, বিয়েটা হয়ে গেলে আমি তো তোমাদের বাড়িতেই বেশি থাকব।”
—-” তা আর বলতে? আমি মেঝ খালামনিকে বলে তোমায় পার্মানেন্টলি এখানেই রেখে দিবো দেখে নিও। আমি বললে মেঝ খালামনিও আর না করতে পারবেনা।”
হিয়া আপুর গাল দুটো আবারও লজ্জায় লাল হলো। ছাদের মৃদু বাতাসে হিয়া আপুর স্ট্রেট চুল গুলো উড়ে এসে ওর মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে। বেচারি বিরক্ত হাতে চুল গুলো গুঁজে নিলো কানের পাশে। আশেপাশে তাকাতে তাকাতে বলল,
—-” তোমার বডিগার্ডরা কই? দেখছি না যে কাউকে?”
—-” ওরা আর কতক্ষণ থাকবে বলো আমার সাথে? শুধু মাত্র উনার কড়া আদেশ বলেই আমিও আর দ্বিতীয় বুলি আওড়াতে পারিনি। কেননা পায়ে পায়ে ঘোরা লোক আমার একদম ভাল্লাগে না। আগে ভালো লাগত। সঙ্গে করে দু-তিনজন মানুষ না থাকলে নিজেকে কেমন এলিয়েন বলে মনে হতো কিন্তু বাবু পেটে আসার পর থেকে আর ভাল্লাগে না। সারাক্ষণ একা একা থাকতেই ভাল্লাগে।”
—-” এটা কি মুড সুয়িংয়ের আংশিক।”
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,
—-” জানি না গো। আচ্ছা আজ কি এখানে বসেই সময় পার করার ইচ্ছে নাকি? যার সঙ্গে দেখা করতে এলে সেই আসল মানুষ টা কই? তাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না।”
হিয়া আপু আমার হাত ধরে বলল,
—-” সে গিয়েছে তোমার বরের অফিসে। তার নাকি কোনো এক জবরদস্ত প্ল্যান আছে। রাতে বোধহয় পিকনিকের আয়োজন হয়েছে। তাই রাহিয়ান ভাইয়াকে আনতে গেলো। আরফান ভাইয়া আর রাইও আসবে। আজ জমিয়ে আড্ডা হবে।”
রাহিয়ানের নামটা শোনার পর বাকি কথা গুলো আর বুঝতে পারলাম না। ফাহিম ভাইয়া উনাকে আনতে গিয়েছেন? উনি কি উনার এতো এতো কাজ ফেলে আসবেন? আসবেন না! আমি জানি! অকারণে আশা নিয়ে বসে কিছুই হবে না! তাতে করে অভিমান গুলো আরেকটু পাহাড় ছুঁবে। চাপা ক*ষ্ট*টা আরেকটু ছিটকে উঠে তার অস্তিত্ব জাগরন করবে। কি দরকার খামখা আশা রাখার? এই দু’মাসে তো কম আশা রাখেনি! আর কম ক*ষ্টও পায়নি। কেবল বাবুটার কথা ভেবে এসব যুক্তিহীন অনুভূতি গুলোকে নিয়ে ভেবে ক*ষ্ট পাওয়াটা বন্ধ করেছি। আশা রাখি, বাকি জীবনটাও পারব।
—–” নীচে যাবে তো? চলো?”
হিয়ার আপুর ছোঁয়ায় ঘোর কাটল আমার। আমি ওর কথা গুলো বোঝার প্রয়াস চালিয়ে বোকা গলায় প্রশ্ন করলাম,
—-” কিছু বললে?”
—-” হ্যাঁ! নীচে যাবে না? চলো যাই।”
আমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললাম,
—-” হ্যাঁ যাবো তো। চলো?”
—-” কিছু ভাবছিলে?”
আমি কিছুক্ষণ বোবা চোখে তাকিয়ে রইলাম হিয়ার আপুর দিকে। কথার পিঠে কথা জোগাড় করতেও ক*ষ্ট হচ্ছে আমার। তাল ঘেঁটে বললাম,
—-” ভাবছি? কই না তো? কিছুই ভাবছি না। চলো নীচে চলো।”
হিয়া আপু মাথা দুলিয়ে বলল,
—-” আচ্ছা চলো।”
৭৯.
ছেলে-মেয়েদের আড্ডা মহলে বেশিক্ষণ নাক না ঘষে গুরুজনরা সবাই নীচে নেমে গেলো। রিম্মি আপুর শশুর-শাশুরি এসেছেন। কেশবরা আসেননি! বউ নিয়ে সে নাকি আলাদা সংসার করছে তাই তাকে আলাদা করে আর ইনভাইট করা হলো না। আরফান ভাই-রাই,রিম্মি আপু-আসিফ ভাইয়া,হিয়া আপু আর ফাহিম ভাইয়া সবাই পাশাপাশি বসেছেন। কেবল আলাদা আমরা দুজন। দু’দিন যাবত আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। তাই আমার জন্য ফ্লোরে বিছানো পাটিতে জায়গা হয়নি, জায়গা হয়ে হয়েছে সবার থেকে আলাদা করে একটা চার পায়াতে। শুরুতে অবশ্য উনার এমন অ*ত্যা*চা*রে রু*ষ্ট হয়েছিলাম বটে, কেন আমাকে সবার থেকে আলাদা করা হলো? পরে অবশ্য বুঝতে পারছিলাম আবহাওয়ার তেজ।
আজ বৃষ্টি হবে। হোক না, আমি না হয় না পারি কিন্তু আকাশের তো মানা নেই কাঁদতে। আজ সে না হয় আমার হয়েই একটু কেঁদে দিলো। খারাপ হবে না। ফাহিম ভাইয়ার যাওয়াতে রাহিয়ান সত্যিই এলো। আজ আশা রাখিনি বলেই হয়তো খানিক অপ্রত্যাশা আমার দুঃখ মুছলো। উনাকে দেখে আজ ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। মুখটা খুব শুঁকনো শুঁকনো লাগছে। হয়তো উনার ভেতরটা জল জল করছেন! মনের ভাবনা থেকেই ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
—-” জল খাবেন?”
উনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন উনার ফোনের স্ক্রিনে ঠেসে ছিলো। আমার কন্ঠ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন। পাশেই একবার ফাহিম ভাইয়াদের দিকে তাকালো। নাহ্, তাদের হৈ হুল্লোড় বহাল আছে। উনি ব্যতীত আমার প্রশ্ন আর কারোর কানেই যায়নি। উনি ছোট্ট করে হাসলেন। সেই পুরনো চমৎকার হাসি। আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো উনার হাসি মুখটা দেখে। মনে হলো, এই তো সেই চেনা হাসিটা! এতোদিন কোথায় যেন একরাশ অভিমান নিয়ে লুকিয়ে ছিলো! আজ আবারও ফিরলো। ফিরল,ফিরল,ফিরল।
—-” কিছু খাবে? ক্ষিদে পেয়েছে তোমার?”
আমার প্রশ্নের জবাব উনি দিলেননা। পাল্টা প্রশ্ন করে আবারও চমৎকার হাসলেন। আমি গাল ফুলিয়ে বললাম,
—-” প্রশ্নটা আগে আমার ছিলো!”
উনি ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন,
—-” কিন্তু দায়িত্বটা তো আমার বেশি।”
—-” দায়িত্ব একা মাথায় নিয়ে তো দুনিয়া এপাশ ওপাশ করে উল্টে ফেলেছেন! এতো দায়িত্ব নিতে কে বলেছে?”
আমার কন্ঠে উনি বুঝি অভিযোগের আচ পেলেন। ছোট্ট করে হেসে জবাব দিলেন,
—-” জলটা নিজের হাতে দিবে তো?”
উনার একটু খানি প্রশ্নে আমার বুকের ভেতরটা আবারও হাহাকার করে উঠল যেন। আবার এই ছোট্ট প্রশ্নটিতেই আনন্দে ছলছল করে উঠল আমার চোখ জোড়া। ছাদ টা অন্ধকার না হলেও আলোর উল্টো দিকে মুখ করে থাকায় উনার মুখটা অন্ধকারেই ঢেকে গিয়েছে বলা যায়। সেই অন্ধকারের মাঝেও বেশ আবিষ্কার করতে পারলাম নোনাজলে চিকচিক করা উনার চোখ জোড়া। আমায় একভাবেই চেয়ে থাকতে দেখে হেসে মাথা নীচু করে নিলেন উনি। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে গেলাম উনার জন্য জল আনতে। না দেখলেও বুঝতে পারলাম উনি আঁড়চোখেই দেখছিলেন আমায়। আমি যতক্ষন না ফিরলাম উনার কাছে ততক্ষণ উনি চেয়েই রইলেন।
—-” জল!”
উনি ফোনটা পাশে রেখে গ্লাসটা হাতে নিলেন। কিছুক্ষণ জলটাকে নিয়ে গবেষণা চালিয়ে বললেন,
—-” আমার মনে হচ্ছে আমার থেকেও তোমার বেশি জল তেষ্টা পেয়েছে। সো আগে তুমি খাও? তারপর আমি খাচ্ছি।”
আমি কপালের মাঝের সুক্ষ ভাজ ফেলে বললাম,
—-” আমি কিন্তু মোটেই বলিনি আমার তেষ্টা পেয়েছে।”
—-” আমিও তো বলিনি। তাহলে কেন দিলে?”
—-” কারন আপনার মুখটা শুঁকিয়ে আছে! আর আপনি মনে মনে বলছিলেন আপনার এই মুহুর্তে একটু জল চাই। আমি সেটাই শুনলাম। তাই তো দিলাম!”
উনি ভাবুক কন্ঠে বললেন,
—-” তাহলে কি তুমি মনে মনে জল তেষ্টার কথা বলোনি?”
আমি না সূচক মাথা নেড়ে বললাম,
—-” না, বলিনি।”
উনি হঠাৎ হেসে পড়লেন। আমার দিকে তাকালেন।অতঃপর আমার পেটের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-” তাহলে নিশ্চয়ই আমার প্রিন্সেসের খুব জল তেষ্টা পেয়েছে! আমি এই মাত্রই শুনলাম কে যেন আধোআধো গলায় বলল, পাপা আমি জল কাবো। তাই বলছিলাম কি, তুমি একটু খেয়ে ওর গলাটা ভেজাও।”
আমি তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললাম,
—-” আপনার প্রিন্সেসেরও জল তেষ্টা পায়নি। বাই দ্যা ওয়ে ও প্রিন্সেস নয়, প্রিন্স হবে। আর,আমার প্রিন্সের জল তেষ্টা পায়নি, পেয়েছে তার বাবার। সেটা আমার প্রিন্স নিজেই বলেছে।”
—-” আহ্ তুমি বুঝছো না!”
উনার বাচ্চাসুলভ কন্ঠ শুনে হেসে ফেললাম আমি। বললাম,
—-” আচ্ছা দিন খাচ্ছি। একটু খানি খাবো কিন্তু।”
উনি আনন্দিত হয়ে বললেন,
—-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ একটু খেলেই হবে।”
আমি জলটা নিয়ে এক ঢোক খেয়ে উনাকে দিয়ে দিলাম। উনি মুচকি হেসে গ্লাসটা নিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চোখ বুলালো গ্লাসটায়। আমি আঁড়চোখে দেখতেই উনি তড়িঘড়ি করে জলটা খেয় নিলেন। তবে এর মাঝেও একটা ব্যাপার ছিলো, উনার জলটা খাওয়ার ধরনে দেখে মনে হচ্ছিলো না যানি আজ কতগুলো দিন বাদে উনি তৃপ্তি করে জল খাচ্ছেন। দেখেও মনটা জুড়িয়ে গেলো।
আড্ডাতেই আরও কিছু সময় ব্যয় হলো। সবাই কিছুনা কিছু করছে! এই যেমন ফাহিম ভাই জোক্স বলছে আর আরফান ভাই গান গাচ্ছে। সেরকম ভাবেই আড্ডা এগিয়ে চলেছে। সবার পাট চুকিয়ে এবার এলো রাহিয়ানের পালা। সবাই উনাকে চেপে ধরল, কবিতা শোনানোর জন্য। আমাদের ছোট্ট লাভস্টোরিটা এখানে কম বেশি সবাই-ই জানে। আর বিশেষ করে উনার সব বিখ্যাত বিখ্যাত কবিতা গুলোর প্রশংসায় সবাই পঞ্চমূখ। অবশ্য এই দুই মাসে সবটাই পেছনে ফেলে এসেছেন উনি! তাই সবার অনুরোধ রাখতে পারবে না বলেই আপত্তি জানালেন! তাই বাকি সবাই উনাকে ছেড়ে আমাকে নিয়ে পড়ল! সবার বক্তব্য হলো, আমি বললেই নাকি উনি কবিতা বলতে রাজি হবেন। আমিও তাই সবার মন রাখতে উনায় ছোট্ট একটা অনুরোধ করেই ফেললাম। আশ্চর্যজনক ভাবে উনি কোনো রকম অমত না করেই ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি এঁটে আবৃত্তি করতে লাগলেন উনার বিখ্যাত স্বরচিত কবিতা,
—-” তুমি তবে রাতের আকাশে এক টুকরো চাঁদ হও
আমি তোমার পাশে জ্বলজ্বলে এক তারা হবো।
কখনো ভেসে বেড়াও বা মেঘের আড়ালে লুকাও
খুব কাছের তারাটি হয়ে আমি সঙ্গি রবো।
নয়তো তুমি ফুটন্ত এক গোলাপ হয়ে ফুটে থাকো~
আমি প্রজাপ্রতি হয়ে তোমার কাছে ছুটে আসব |
যদি তুমি অন্ধকারে বুকের ভেতর ভ*য় রাখো,
আমি জোনাকি হয়ে মিটিমিটি আলো ছড়াবো।
আমি ঝরনা হয়ে ঝাপ দিবো নীচের ঐ ভূমিতে,
যদি তুমি পাহাড় হয়ে আমায় বুকে ধারন করো |
আমি কোনো এক চর হয়ে জেগে উঠব নদীতে
যদি তুমি ঢেউ হয়ে আঁচড়ে আমার বুকে পড়ো |
আমার গভীর রাতের আঁধারে নুর হও তুমি,
শিয়াল ডাকা মধ্যরাতে ভ*য় যেন না পাই!
তোমার দুই চোখে একটিবার ডুবে যাবো আমি,
তোমায় নিয়ে কবিতা লিখে ভাবুক কবি হতে চাই |
তার চেয়ে ভালো তুমি আমার স্বপ্ন হও,
শতবার ভা*ঙ*লেও বারবার দেখতে চাই।
আশাই তো জীবন, তুমি আমার আশা হও
আমি তোমায় নিয়ে এই জীবন পাড়ি দিতে চাই |
সবচেয়ে ভালো তুমি আমার একজনমের প্রেম হও,
আমি রাত দুপুরে জনম ভর তোমার প্রেমে পড়তে চাই।”
আবৃত্তি শেষে উনি ঠোঁটের কোনের হাসিটাকে আরেকটু প্রসারিত করে আমার চোখে চোখ রাখলেন! আমারও আর এবার চোখ ফেরানোর ইচ্ছে জাগল না। মনে হচ্ছিল আম**রন এভাবেই ডুবে থাকি উনার চোখে। বাকিদের হৈ হৈ তে চমকে উঠলাম আমরা দু’জনেই। লজ্জায় পড়ে আমি চোখ নামিয়ে নিলাম উনার থেকে। উনি মুচকি হেসে বাকিদের দিকে তাকালেন। বাকিরা প্রতিটা লাইন ধরে ধরে বর্ননা দিয়ে প্রশংসা করছে। আর উনি বাকিদের কথায় মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বার বার আঁড়চোখে আমায় দেখছেন। এই তো বেশ ভালো আছি। দীর্ঘ অপেক্ষার পথ অতিক্রম করে আজ অভিমানের পাহাড় গুলো উঁচু থেকে ঢালুতে পড়ে তাদের গুমুড় ভা*ঙ*লো বুঝি!
#চলবে____________________