#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা
পর্বঃ ঊনত্রিশ
রক্তাক্ত নীলাম্বরীকে দেখে একটুর জন্য থমকে যায় বর্ণ।সবাই যখন নীলাম্বরীর পিছে ব্যস্ত তখন কাজের মেয়েটা এসে আরেক খবর দিলো।মানুষ দিশেহারা হয়ে গেলো। আকষ্মিক ঘটনায় নিরব হয়ে যায় সব।
আজিজুর রহমান তার কলিজার টুকরা মেয়েকে রেখে ছুটে যায় ভাবির কাছে সাথে তার পিছে রাহাতের বাবা, দাদী,ফুপি সাথে আরও আত্মীয় স্বজন ছুট লাগায়।
নীলাম্বরীর নিথর দেহটা পরে থাকে মাটিতে।শারমিন চৌধুরী নীলার পিঠ উল্টে দেখে কোনো ধারালো কিছু দিয়ে বেশ জোড়ে আঘাত করেছে কেউ।হয়তো পিঠের মাংস ভেদ করে ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।নিরুপমা তার আদরের বোনের এ দশা দেখে পাগল প্রায়। আফসানা রহমান জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়।
অনেক মহিলারা মিলে আফসানা রহমানকে রুমের ভিতর নিয়ে যায়। বর্নের ধ্যান ভাঙে তার মায়ের চিৎকারে।সে তার প্রেয়সীর নিথর দেহটার পাশে বসে পরে।গালে কয়েকবার চড় মারার পর জোড়ে নিশ্বাস নেয় নীলা।বর্ণ টলমলে চোখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘ও নীলাম্বরী আপনি এমন করবেন না প্লিজ।আপনাকে আমাদের বড্ড প্রয়োজন। ও নীলাম্বরী তাকান।আমাদের তো এখনো কত গুলো বসন্ত একসাথে কাটানো বাকি তাই না! প্লিজ তাকান নীলাম্বরী।’
নীলাম্বরী ফেলতে পারে নি হতভাগা বর্ণের কথা।হয়তো যমের সাথে তমুল লড়ে পিটপিট করে চোখ তুলে তাকাল।
নীলাম্বরীকে তাকাতে দেখে উপস্থিত সবার শ্বাস জেনো আটকে গেলো।বর্ণ চোখের জল টা আর আটকে রাখতে পারলো না।চোখের জল ছেড়ে দিয়ে বলল
-‘ ও নীলাম্বরী চোখটা খুলে রাখুন প্লিজ।আপনার কিছু হবে না।সবার আপনাকে যে প্রয়োজন নীলাম্বরী।প্লিজ আমাদের মাঝে থাকুন।’
নীলাম্বরী তার রক্তলাল চোখটা দিয়ে সবার দিকে তাকালো। হয়তো খুঁজছে কাউকে।তার বাবাকে হয়তো।তার কন্ঠ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তবুও অনেক কষ্টে উচ্চারণ করে বলল
-‘আ আমাকে কারো প্র প্রয়োজন নেই।পুরো দু দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর বর্ণ।বাবাকে ব বলবেন পুরো দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর।বর্ণ চারদিকে সব,মিথ্যে কলরব।আমার বাবাকে দেখে রাখবেন ডাক্তার সাহেব।’
কথা সমাপ্ত হওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেলে নীলা।বর্ণ পাগলের মতন নীলাকে ডাকতে থাকে
-‘নীলা ও নীলা উঠেন না। কেউ স্বার্থপর না। এই যে আমাদের আপনাকে প্রয়োজন।উঠেন না।’
তারপর বর্ণ তার মায়ের হাতটা ধরে নীলাকে দেখিয়ে বলছে
-‘মা ওরে বলো না উঠতে।মা আমি কি করবো ওনাকে ছাড়া।প্লিজ মা ওরে বাঁচাও।মা কিছু করো প্লিজ।’
নীড় তার ভাইয়ের কাছে এসে পাঁজাকোলে তুলে নিলো নীলাকে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘ছোট আপুর এমনেতেই অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে।যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।আর করা যাবে না।ভাইয়া তুই তো ডাক্তার। তুই এমন করছিস কেন? ওরে হসপিটালে নিতে হবে।তুই তো জানিস এত রক্ত বের হওয়ার ফল কি হবে?’
বর্ণের এতক্ষণে হুঁশ হলো।নীড়ের পিছে ছুট লাগালো সবাই।বড় মাকেও বের করে আনা হয়েছে বাড়ি থেকে।তাকেও হসপিটালে নেওয়া হবে।
_______
কেউ প্রিয় মানুষ হারানোর আত্মচিৎকারে ভেঙে পড়ছে কেউবা নতুন একটা প্রাণ জন্ম নেওয়ার খুশিতে উদ্দাম আনন্দে মেতে উঠছে।একই সাথে হাসি কান্নার বিচিত্র দৃশ্য যেখানে দেখা যায় সেটা হলো হসপিটাল।তীব্র ফিনাইলের গন্ধ বারবার প্রিয় মানুষকে হারানোর কথা মনে করিয়ে দেয়।ফিনাইলের গন্ধে সবসময় ততটা আমাদের সমস্যা না হলেও হসপিটালেন এই ফিনাইলের গন্ধটা আমাদের মৃত্যু নামক শব্দটা স্মরণ করিয়ে দেয়।এটার কোনো সঠিক লজিক বা ব্যাখ্যা নেই তবে ফিনাইলের গন্ধ টা প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় ঢুকিয়ে দেয়।
তেমনই দু দুজন প্রিয় মানুষকে হারানোর আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে কত গুলো মানুষ।তাদের প্রিয় মানুষ গুলো লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে। তারা আবার ফিরে আসতে পারবে কি না জানা নেই কারো।তবে সবাই আলাদা আলাদাভাবে একজনকেই স্মরণ করছে সে হলো ঐ সৃষ্টিকর্তা।
প্রতিটা মানুষের বিধ্বস্ত অবস্থা। রাহাতের মা আর নীলাকে আলাদা আলাদা রুমে চিকিৎসাধীন রাখা হয়েছে।আজিজুর রহমান মূর্তির ন্যায় বসে আছে সাথে তার বড় ভাই মানে রাহাতের বাবা।
শারমিন চৌধুরী আর তিমা বসে আছে অপর পাশে।নিরুপমা মায়ের কাছে থেকে গেছে।বর্ণ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। বর্ণের পাশে নীড় এসে দাঁড়ালো।তিমার স্বামী মাসুদও এসে দাঁড়ায়।
নীড় বর্ণের বাহুতে হাত রেখে বলল
-‘ভাইয়া তুই একটু বস।ছোট আপুর কিছু হবে না।তুই ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে?’
মাসুদ বর্ণের বাহু আকড়ে ধরে আজিজুর রহমানের আঙুল তাক করে বর্ণের উদ্দেশ্যে বলল
-‘আমার ছোট গিন্নি তোমাকে কি বলেছিলো বর্ণ? ঐ মানুষটাকে সামলানোর দ্বায়িত্ব তোমার উপর দিয়ে গিয়ে ছিলো তাই না? তুমি ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে।স্ট্রং থাকতে হবে এখন সবকিছুর জন্য।’
বর্ণ মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলে দেয়। আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটা কথা প্রচলিত আছে।ছেলেদের কাঁদতে নেই।আজ সেই ধরা বান্দা নিয়ম ভেঙে বর্ণ কেঁদে দিয়েছে।আচ্ছা ছেলেদের কান্না নিষেধ কেনো?তাদের কি কষ্ট নেই? সৃষ্টিকর্তা তো সব মানুষকে একই নিয়মে তৈরী করেছে তাহলে মেয়েদের ক্ষেত্রে কোমল আর ছেলেদের ক্ষেত্রে কঠিন বৈশিষ্ট্য টা তৈরী করেছে কেনো? সৃষ্টিকর্তা তো এমন কোনো নিয়ম সৃষ্টি করে নি সব ধরাবান্দা নিয়ম সৃষ্টি করেছে তো মানুষ।ছেলেদেরও মন আছে, তাদেরও কষ্ট হয় মানুষ ভুলে যায় কেনো?কান্নার চেয়ে বড় ওষুধ আর কিছু নেই।কষ্ট পেলে কান্না করলে কষ্ট কমে,সৃষ্টিকর্তার সামনে কান্না করে মন থেকে কিছু চাইলে সেটা পূরণ হয়,ডিপ্রেশন কমায় আর সেখানে ছেলেদের কান্না করা মানায় না বলে তাদের কষ্ট কমানোর ব্যবস্থাকেও শেষ করে দেওয়া হয়।
এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিকে শান্ত করতে ওটি থেকে ডাক্তার বের হয়ে আসলো।নীড় দ্রুত ছুটে গেলো ডাক্তারের কাছে।ডাক্তার জানালেন
-‘সরি।আপনাদের রোগী বেশ উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে আতঙ্ক আর অতিরিক্ত ব্যাথায় স্ট্রোক করেছে।আর তাই তার দেহের এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। এবং মুখ বাকা হয়ে যাওয়ার কারণে বাক্ শক্তি হারিয়েছে।’
নিজের স্ত্রীর এমন দশা শুনে আমজাদ আলী মানে রাহাতের বাবা ধপ করে বসে পড়ে। মাসুদ গিয়ে ধরে তাকে।আজিজুর রহমান নির্বাক হয়ে যায়। কি হয়ে গেলো তার পরিবারের সাথে এটা? তার মেয়েকে ক্ষতবিক্ষত করেছে কেউ তার বড় ভাবিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।মেয়েটা বাঁচবে কিনা সে জানেনা।ধ্বস নেমে গেছে পরিবারে।এই পরিবারকে সামলে উঠবে কীভাবে। সে নিজেকে সামলাবে কীভাবে? তার মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে যে শেষ হয়ে যাবে।
বর্ণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছুই বুজছে না।রাহাত সবটা করেছে ঠিক আছে।কিন্তু যখন নীলাকে আহত করা হয় তখন রাহাত ছিলো বিয়ের আসরে।আর নীলাকে যে আঘাত করেছে সে-ই বড় মাকে ধাক্কা দিয়েছে।নিজের মাকে নিশ্চয় রাহাত ধাক্কা দেওয়ার কথা ভাববে না কোনো মতেই।তার মানে রাহাতের পিছেও কেউ আছে।আবার এমন হতে পারে রাহাত ছাড়াও নীলার আরেকজন শত্রু আছে যে নীলাকে মারতে চায়।কিন্তু কে সে?
বর্ণের ভাবনার মাঝেই কেউ একজন ছুটে আসলো।বর্ণ তাকিয়ে দেখে আফসানা রহমান আর নিরুপমা।আফসানা রহমান এসে তার বড় জা এর কন্ডিশন শুনে থমকে যায়। সে সবাইকে একবার ঘুরে দেখে।এখানে উপস্থিত সবাই ভেঙে পড়েছে।আফসানা রহমান দেয়ালেে সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বর্ণের দিকে তাকায়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তার কাছে।শান্ত স্বরে বলল
-‘বর্ণ?’
বর্ণ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘জ্বি আন্টি?’
আফসানা রহমান শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠে বলল
-‘এখানে সবার দিকে তাকিয়েছো? সবাই ভেঙে পড়েছে। আচ্ছা তুমি বলো এখন ভেঙে পড়ার সময়?একদমই না।সবাই ভেঙে পড়লে হবে কীভাবে? আর এখন নীলার জন্য তোমার নিজেকে শক্ত রাখা জরুরী। নীলা তার পরিবারকে তোমার দ্বায়িত্বে দিয়ে গেছে না? তাহলে তোমার এমন ভেঙে যাওয়া মানায়।’
বর্ণ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে টলমলে চোখে ডানেবামে মাথা নাড়ায় যার অর্থ “মানায় না।” আফসানা রহমান চোখ দিয়ে ভরসা দেয়।কিন্তু তার নিজের ভিতরে কি যাচ্ছে শুধু সে জানে।
এর মাঝেই নীলার ডাক্তার বের হয়।বর্ণ এগিয়ে গিয়ে কিছু বলার আগেই ডাক্তার চাকচক্যময় একটা খবর দিলেন।সবাই বেশ অবাক হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন
-‘আপনাদের পেশেন্টকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।আর মনে হয় আঘাত করার পর তাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়।যেটা এক ধরনে বিষ ধরতে পারেন।আর এই ওষুধটা আপনাদের পেশেন্টকে বেশ আগে কয়েকবার দেওয়া হয়েছিলো মনে হয়। যার জন্য আপনাদের পেশেন্টের ব্রেণের সমস্যা ধরা দিয়েছিলো।আর যতটুকু মনে হয় সে ওষুধও নিতো। কিন্তু সে চিকিৎসা শুরু করে নি।আর আজ ডোজ টা হাই পাওয়ারের হওয়াতে তার ব্রেণ একবারে কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে বললেই চলে।অতিরিক্ত রক্তও বের হয়ে গেছে।আমরা কোনো রূপ আশা দিতে পারছি না।’
ডাক্তার কথা শেষ করে চলে যায় আর উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে যায়। আজিজুর রহমান, আফসানা রহমান বোকার ন্যায় তাকিয়ে থাকে।বর্ণ মেডিসিনের ব্যাপারটা জানতো তাই সে সবটা সবাইকে খুলে বলে।সবটা শুনে সবাই আরেক দফা অবাক হয়।তাদেরই অগোচরে তাদের মেয়েকে কেউ মারার জন্য এই জাল ফেলে রেখেছিলো।তাদের মেয়ে সবাইকে কিছু জানায় নি ভেঙে যাবে বলে!কিন্তু বর্ণ এটা ভেবে অবাক হয় আজও নীলাকে সেইম ওষুধ দেওয়া হয়েছে।তার মানে কাজটা খুব পরিচিত কেউ করেছে। যে আগেও নীলার ক্ষতি করার জন্য এই ওষুধ গুলো দিয়েছে।কিন্তু সে কে?
#চলবে