বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব-১৩+১৪

0
236

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৭

সকাল হতেই আবার সকলে দলবল নিয়ে ছুটলো দুলাল ঠাকুরের বাড়ি। মুখে মুখে সবার আহারে, আহারে করা আফসোসের বুলি। ছেলেটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ঠাকুর বাড়িতে কেমন অশান্তি নেমে এলো! ক’দিন আগে অসুস্থ হলো বাড়ির কত্রী আজ নাকি অসুস্থ হয়েছে কর্তা। পত্রও সবার মতন ছুটে গেলো জেঠা মশাই দের বাড়ি। সুঠাম দেহী মানুষটা এক রাতের মাঝেই কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে! দেহে কোনো মতে প্রাণটা টিকে আছে বললেই চলে। মুখটা প্রায় বাঁকা হয়ে গেছে। মানুষটা কথা বলছে অথচ কেবল শোনা যাচ্ছে গোঙানোর আওয়াজ। বিন্নী ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছে। জেঠিমা খাটের এক ধারে বসে আঁচল দিয়ে বার বার নিজের চোখের অশ্রু টুকু মুছে নিচ্ছে। পরিবারটার প্রায় বিধ্বস্ত দশা। পত্র আগলে নিলো বিন্নীকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কাঁদিস না, খই। আমরা আছি তো।”

প্রাণ প্রিয় বান্ধবীকে পেয়ে আরও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বিন্নী। পত্রের কোমড় জড়িয়ে ধরে অস্ফুটস্বরে বললো,
“আমাদের সাথে এমন কেন হচ্ছে রে, পত্র? আমরা কার ক্ষতি করেছিলাম?”

“কারো ক্ষতি করিস নি। ভগবান তোদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। ধৈর্য ধর, খই।”

বিন্নীর কান্না বন্ধ হলো না। সে আগের তুলনায় আরও বেশি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। পত্র স্বান্তনা দিতে থাকলো। ভেতর ভেতর বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। হাসি, খুশি চা বাগানের এমন দশা তার মোটেও ভালো লাগছে না যে। অথচ এমন গোলমেলে সমস্যার সমাধানও তার জানা নেই। সে কেবল চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছে একজনকে, ভালোবাসে কিনা। কিন্তু তার পরও সকল কিছুই তার বড্ড ভেজাল যুক্ত মনে হচ্ছে। কেমন যেন পেঁচিয়ে আছে ব্যাপারটা। ভয়ঙ্কর পেঁচিয়ে আছে।

_

অবশেষে পুরো দু’দিন পর ছায়া দরজা খুললো। তার রাগ, জেদ সে ঠিকই বজায় রেখেছে দুই দিন যাবত। যখন সমির বাবু রাজি হলেন পদ্মের বিয়ে দিতে তখনই ছায়া দরজা খুললেন। তার শরীর অসাড় হয়ে অতঃপর লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। একটা হৈচৈ পড়লো, ডাক্তার ডাকা হলো।

নিত্যনতুন ঘটনায় প্রায় অসহ্য হয়ে গেছে পত্র। একটু শান্তি, একটু মুক্তির জন্য সে আস্তে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। হাঁটা শুরু করলো সরু পথটা দিয়ে। তখন বিকেলের প্রথম ভাগ। শিরশিরে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। উড়িয়ে নিচ্ছে তার সকল ক্লান্তি। হাঁটতে হাঁটতে সে চা বাগানের পূর্ব দিকের খোলা মাঠটার দিকে এসে দাঁড়ালো। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলছে মাঠ জুড়ে। একটা হৈ হৈ, রমরমা ভাব এখানে। নানান রকমের আনন্দ হাসছে যেন এখানে। পত্রের ভালো লাগছে দেখতে। যাক, অন্তত কোথাও তো কেউ খুশি আছে, কেউ হাসছে। নাহয় তো পুরো চা বাগান জুড়েই কেমন দুঃখদের উৎপাত। কেমন দমবন্ধকর চিৎকার চেঁচামেচি।
“কী করো, হে পত্রলেখা?”

পাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠে বেশ ভড়কে গেলো পত্র। খুব দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই একটা হাস্যোজ্জ্বল মুখ চোখে পড়লো। পরিচিত মুখটা দেখতে পেয়ে হাসলো পত্রও। ধীর কণ্ঠে বললো,
“খেলা দেখছি।”

“তুমিও তো ওসব খেলা পারো শুনলাম। খেলবে না?”

আতসের প্রশ্নের বিপরীতে পত্র হতাশার শ্বাস ফেললো। মাথা ডানে-বামে হেলিয়ে বললো,
“নাহ্। এখন ভালো লাগে না এসব।”

“কেন লাগে না? পত্রলেখা, আমি যতটুকু বুজেছি তা হলো তুমি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে। আর তোমার সবকিছু নিয়ে ভাবনা একটু আলাদা রকম। সবার চেয়ে ভিন্ন। তোমার ভিতরে একটা নিদারুণ স্বত্তা আছে, আর আমি জানি, সেটার সৃষ্টিকর্তা তোমার অভ্রদা। যে তোমাকে একদম আলাদা একটা মানুষ তৈরী করে দিয়েছে। এতটুকু মেয়ের মাঝে ঐ অসাধারণত্বটা আমার পছন্দের। আর হ্যাঁ, এটা অবশ্যই তোমার আবেগের বয়স। তাই সব কিছু ছাপিয়ে তোমার আবেগটাই বেশি প্রাধান্য পাবে৷ কিন্তু বেশি আবেগ প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজের ভালো-মন্দটা হারিয়ে যেতে দিও না। দিনশেষে আমরা মানুষ কেবল নিজেদের জন্য ই বেঁচে থাকি। তাই সেই নিজের সবটাকে প্রাধান্য দেওয়া হলো আমাদের আসল কাজ।”

পত্র মনযোগ দিয়ে শুনলো আতসের কথা। বেশ গম্ভীর হয়েই কথা গুলো বলেছে ছেলেটা কিন্তু মুখে সেই সবসময়ের হাসিটা রয়েই গেছে। সেই হাসিটা দেখে নিজের মাঝে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা ছড়িয়ে গেলো পত্রের। ভেতর ভেতর সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হলো। চারপাশের অগোছালো ঘটনা গুলো তাকে বিরক্ত করছে। ভালো খারাপ ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিচ্ছে। কী করা উচিৎ, কী করা উচিৎ না, কী করলে ভালো হয়, এসব নানা চিন্তায় সে বিরক্ত। অথচ সমাধান নেই কিছুর।

বাহিরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি। পত্র বসে আছে নিজের ঘরে। হারিকেনের মিটমিট আলোয় নিজের পড়া গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। এই যে এতকিছু হচ্ছে তার মধ্যে পত্রের পড়া বন্ধ নেই। বড্ড পড়াশোনা পছন্দ করে কিনা। তাছাড়া পিসিও পড়াশোনা করতে বলতো সবসময়। পিসিরও পড়াশোনা পছন্দ ছিলো। বৃষ্টির চঞ্চল শব্দ ছাপিয়ে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো পাশের ঘর থেকে। পত্রের মনযোগে ব্যাঘাত ঘটলো। কপাল কুঁচকে বুঝার চেষ্টা করলো ভুল শুনেছে না ঠিক। অতঃপর আবারও একই ডাক ভেসে আসতেই পত্র উঠে দাঁড়ালো। বই গুলো গুটিয়ে রেখে সাবধানী পায়ে বোনেদের ঘরে গেলো। হালকা বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগলো তার শরীরেও।

ঘরে ঢুকতেই দেখে বড়দি বসে আছে খাটের এক কোণায়। বিকেলে রোদ থেকে আনা জামাকাপড় গুলো গুছোচ্ছে। পত্র স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“ডেকেছিলে বড়দি?”

“হ্যাঁ।”

জামাকাপড় ভাঁজ করতে করতেই পত্র জবাব দিলো। পত্র আরও দু’কদম এগিয়ে কাঠের ভাঙা, নড়বড়ে চেয়ারটাতে বসলো। ঘরের চারপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে বললো,
“পুষ্প কোথায়? ওরে যে দেখছি না?”

“অভ্রদা’র বাড়িতে। জেঠা মশাই অসুস্থ, জেঠিমা এবং বিন্নীরও মন মেজাজ খারাপ, ভেঙে পড়েছে উনারা, কারো তো সেখানে থাকা দরকার। পুষ্প নিজেই বললো ও থাকবে। তাই বাবা ওরে দিয়ে আসছে সেখানে। আমি অবশ্য যেতে চেয়ে ছিলাম।”

“মা রাজি হয়ে গেলো!”

পত্রের চোখ-মুখে বিস্ময়। কারণ সচারাচর তাদের মা মেয়েদের বিকেলের পর বের হওয়া পছন্দ করেন না। সবসময় সে চায় যেন তার মেয়েরা চুপচাপ, গম্ভীর ও পরিপাটি থাকে। পত্র এমনটা ছিলো না বিধায় মা রাগ বেশি করতেন। আর আজ কিনা সে মা পুষ্পকে আরেক জনের বাড়িতে থাকার অনুমতি দিলো!

পত্রের বিস্ময় হওয়ার কারণটা পদ্মও জানে। তাই সে আগের ন্যায় জামাকাপড় গুছাতে গুছাতে বললো,
“বাদ দে ওসব কথা, তোকে আমি অন্য কথা বলতে ডেকেছি।”

“কী কথা, বড়দি?”

পত্র বেশ আগ্রহের সাথে ই জিজ্ঞেস করলো। বড়দি সব জামা কাপড় গুলো আলনাতে রেখে এলেন। এর মাঝে সে একটা কথা ও বলেন নি। জামাকাপড় রেখে খাটের নিচ থেকে স্টিলের একটা বাক্স বের করলেন। সেখান থেকে আলগোছে একটা ছোটোখাটো কিছু বের করে ধরলেন পত্রের সামনে। ছোটো জিনিসটা চোখে পড়তেই পত্র খানিকটা কেঁপে উঠলো। ভয় স্রোতের বেগে তার শরীরে খেলে গেলো। কম্পনরত কণ্ঠে পত্র শুধালো,
“তুমি কোথায় পেয়েছো এটা, বড়দি?”

“যেখানে তুই গোপন করে রেখে ছিলিস, সেখানেই। তা, এটা কোথায় পেয়েছিস বললি না তো!”

পত্র নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। এমন শীতল রাতেও সে ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ওড়নার কোণা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
“এটা তো রথের মেলা থেকে কিনে ছিলাম। মনে নেই তোর?”

“সে তো আরও চার পাঁচ মাসেরও আগের কথা। এখনো এই আংটির রঙ যায় নি কেন? স্বর্ণের মতন চিকচিক করছে তার রঙ! ব্যাপার কী রে?”

পত্র বড়দির হাতে থাকা আংটিটা ছিনিয়ে নিতে চায়। কিন্তু পদ্ম তা করতে দেয় না বরং বেশ শক্ত হাতে আংটিটা চেপে ধরলো। বাঁকা হেসে বললো,
“স্বর্ণের আংটি তাই না? তা তোকে কে দিলো এটা? আমাদের তো নুন আনতে পানাতা ফুড়ানোর জোগাড় অথচ তোর কাছে স্বর্ণের আংটি! দিলো কে শুনি?”

পত্র মাথা নাড়ালো, গলায় আটকে গেলো কথা। শেষমেষ ধরা পড়ে গেলো।

#চলবে,,,,

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৮

স্রোতের বেগে চলে গেলো আষাঢ় মাস। থেকে গেলো কেমন আঁধার করা আকাশ আর মন খারাপ করে রাখা প্রকৃতি। সময়টা ঠিক দুপুরের মাঝামাঝি। পত্র আর বিন্নীর স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হওয়ায় তারা বাড়ি ফিরছে দুজনেই। দু’জনের মাঝে শুনশান নিরবতা। বিন্নীর সুন্দর হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানায় আজকাল তেমন হাসির ছোঁয়া থাকে না। পত্রের চঞ্চলতা ভরা শরীরে চঞ্চলতারও বড্ড অভাববোধ করে সে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই জিপ গাড়ির গম্ভীর শব্দটুকু শুনতে পায় পত্র ও বিন্নী দু’জনই। পত্র অবাক চোখে সামনে তাকাতেই দেখে সুদর্শন পুরুষটি ঠোঁটে মুগ্ধ হাসি ঝুলিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখানে। কি মনে করে পাশে তাকাতেই দেখে বিন্নীর চোখ মুখে চাপা হাসির ছোঁয়া। পত্র ভ্রু কুঁচকালো। আতসকে নামতে দেখে বিন্নীর সেই হাসি যেন বিস্তৃতি লাভ করলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
“আতস!”

পত্রের কুঁচকানো ভ্রু যুগল আরও কুঁচকে গেলো, প্রায় কিছুটা বিস্মিত হয়েই বললো,
“আতস? এত বড়ো ছেলেকে তুই নাম ধরে ডাকিস?”

পত্রের প্রশ্নতেই ঘোর কেটে গেলো বিন্নীর। প্রায় সেকেন্ডের মাঝেই নিজেকে সামলে নিলো। কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে বললো,
“আতস ভাইয়া বলেছি, পাতা। তুই আজকাল কানে কম শুনিস?”

পত্র সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো বিন্নীর পানে। সে তো ভুল শুনে নি অথচ বিন্নী কী সুন্দর কথা ঘুরিয়ে ফেলছে! পত্র আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আতস এসে তাদের সামনা-সামনি দাঁড়ালো। মিষ্টি এক হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“কী ব্যাপার বিন্নী, পত্র? বাড়ি ফিরছো বুঝি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি কোথায় যাচ্ছো?”

বিন্নীর প্রশ্নে আবারও পত্র অবাক হলো। চোখ বড়ো বড়ো করে বিন্নীর দিকে তাকালো। অবিশ্বাস্যকর ভাব তার চোখ-মুখে। কিন্তু এবার সে তার অবিশ্বাস্য হাব ভাবটা অগোচরেই গিলে নিলো এবং স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ বাড়ি যাচ্ছি।”

“তুমি কোথায় যাচ্ছো বললে না তো?”

বিন্নীর প্রশ্নে আতস ছোটো হাসি দিয়ে উত্তর দিলো, “তোমাদের বাড়ির ওখানেই। প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়েছে তো তাই একটু ঘুরতে যাচ্ছি।”

“ওহ্।”

পত্র এর মাঝে একটা কথাও বললো না কেবল দু’জনকে সচেতন দৃষ্টিতে পরখ করে নিলো। আতস এবার পত্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
“চলো তোমাদের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসি।”

“না। আমার বাড়ি তো এখানেই, আপনি বরং বিন্নীকে নিয়ে যান।”

পত্রের কাঠ কাঠ জবাবেও বিন্নী কিছুটা আঁচ করতে পারলো না বরং খুশি মনে সে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাকে নিয়ে যাও। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।”

“ওমা? এই প্রথম বুঝি তুই হেঁটে এসেছিস? এর আগে কী উড়োজাহাজ দিয়ে আসতিস?”

প্রত্রের বাঁকা প্রশ্নে মুখটা মলিন করে ফেললো বিন্নী। কোমল কণ্ঠে বললো,
“এমন করে খোঁচা দিচ্ছিস কেন রে পাতা? তুই না চাইলে আমি হেঁটেই যাবো।”

বিন্নীর কোমল কণ্ঠে মায়া হলো পত্রের। সে বিন্নীর বাহু জড়িয়ে ধরো হাসি মুখে বললো,
“আরে না, মজা করলাম। যা তুই উনার সাথে, আমি হেঁটেই যেতে পারবো।”

বিন্নী ঘাড় কাঁত করেই জিপে গিয়ে উঠলো। আতস সে দিকে একবার তাকিয়ে পত্রের দিকে দৃষ্টি দিলো, ক্ষীণ স্বরে বললো,
“তোমার দিদির বিয়ে নাকি? তা, আমাদের নিমন্ত্রণ দিলে না যে?”

“কাল বিকালে পুকুর পাড়ে আসবেন, কথা আছে।”

“আচ্ছা, যাই তাহলে।”

কথাটা বলেই আতস গাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলো। পত্র আলগোছে একটা শ্বাস ফেললো। ভালোবাসলে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়, পত্র নিজেই সে কথাটার প্রমাণ। পত্রের পাশ কাটিয়ে গাড়িটা চলে গেলো, পত্র নিজেও নিজের বাড়ির পথে পা বাড়ালো। ঐ তো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়ির গেইট। বিয়ে বিয়ে একটা আমেজ চা বাগানে। আর অদ্ভুত ভাবে এ কয়েকদিন চা বাগানে আর তেমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে নি। সব যেন মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেছে। কিন্তু পত্র থেমে নেই, যেভাবেই হোক এই রহস্যের ঘোলাটে ভাব সে সরিয়ে ফেলবেই।

বাহিরে মানুষের একটা গমগমে ভাব, পত্র বসে আছে তার মায়ের ঘরে কারণ তার ঘর অতিথিতে পরিপূর্ণ। কাল বড়দির আশীর্বাদ। দু’দিন পরেই বিয়ের তারিখ রাখা হয়েছে। ছেলে তাদের পাশের গ্রামেরই একটা স্কুল মাস্টার। পরিবারও ভালো, তারা এক দেখাতে দিদিকে পছন্দ করেছে আর মায়ের ইচ্ছেতেই বিয়েটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে যখন সে সকল হিসাব মিলাতে ব্যস্ত তখন পুকুর পাড়ে চোখ যেতেই সে চমকে উঠলো। আতস দাঁড়িয়ে আছে সাদা শার্ট পড়নে। হুট করেই তার মনে পড়লো আজ আতসের সাথে দেখা করার কথা ছিলো তার আর সে বেমালুম ভুলে বসে আছে!

শরীরের ওড়নাটা আরও ভালো ভাবে জড়িয়ে পত্র বাহিরে বেরিয়ে গেলো। উঠোন জুড়ে হাসি-ঠাট্টার ঢেউ। পুষ্প রান্নাঘরের দরজায় বসে রান্নার জন্য মসলা বাটছে। আজকাল মেয়েটা একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। কোনো হৈচৈ নেই তার ভেতর, ঝামেলা ঝঞ্জাটও করে না আগের মতন। একদম ভিন্ন এক পুষ্পের আবির্ভাব।

পত্র উঠোন পেরুনোর আগেই উঠোনে হাজির হলো একদল অপরিচিত লোকজন। চোখে-মুখে কাঠিন্যতা। পত্র সহ বাড়ির সকলে অবাক হলো। ছায়া রান্নাঘর থেকে উঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলেন উঠোনে কারা। লোক গুলোর মাঝে একজন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“সমির বাবু কোথায়? উনাকে ডাক দেন।”

ছায়া রান্নাঘর থেকে উঠে এলেন। মাথায় আঁচল দিয়ে বেশ বড়সড় ঘোমটা টেনে বললেন,
“উনাকে কী দরকার?”

“আপনি কে?”

“আমি উনার স্ত্রী।”

“আপনার স্বামীকে ডাকুন। তাকে বলা হয়েছিল এ বাড়ি ছাড়তে। বারবার চা বাগানের কমিটি থেকে নোটিশও পাঠানো হয়েছে, অথচ সে বাড়ি না ছেড়ে এখানে উৎসব শুরু করে দিয়েছেন! ডাকুন তাকে।”

ছায়া অবাক হলেন, অবাক কণ্ঠে বললেন,
“বাড়ি ছাড়তে হবে মানে? কে ছাড়বে বাড়ি? আমাদের বাড়ি এটা।”

“আপনারা ছাড়বেন বাড়ি।”

ছায়া মুহূর্তেই রেগে গেলেন। আঙ্গুল উঁচিয়ে বললেন,
“আপনারা বেরিয়ে যাবেন। যান বেরিয়ে, যান বলছি। কতো বড়ো সাহস আপনাদের! আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে বলছেন বেরিয়ে যেতে! এত সাহস?”

ছায়ার রণমুর্তি দেখে ক্ষাণিক ভ্যাবাচেকা খেলো ছেলে গুলো। পঁয়ত্রিশের রমণীর এমন তেজ মোটেও কাম্য নয়। যেখানে মেয়েরা পুরুষদের আড়ালেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সেখানে কি-না এমন তেজ?

ছেলেদের মাঝে একজন এগিয়ে এলেন, ছায়ার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
“আপনি সরুন সামনে থেকে, নাহয় আমরা হাত তুলতে বাধ্য হবো৷”

কথাটা শেষ করার সাথে সাথে তৎক্ষনাৎ চ/ড় পড়লো উক্ত কথা বলা লোকটার গালে। লোক গুলোর সাথে সাথে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছায়া তখন রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। রান্নাঘর থেকে চেলাকাঠ তুলে এনে লোক গুলোর সামনে দাঁড়ালো। শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,
“এক্ষুণি উঠোন ছাড়বি তোরা আর নাহয় পৃথিবী। কোনটা চাস বল?”

ছায়ার আকস্মিক আচরণে লোকগুলো প্রায় ভীত হলো। থতমত খেয়ে তারা দ্রুত প্রস্থান নিলো। বাড়ির উপস্থিত মানুষজন বিস্মিত হয়ে সবটা দেখলো। ছায়া রেগে যায়, মাঝে মাঝে চিৎকার চেঁচামেচিও করেন কিন্তু সবটাই বাড়ির মানুষের সাথে। বাহিরের মানুষ তো ছায়ার চেহারাই দেখতে পান না আবার চিৎকার শুনবে তো দূরের কথা।

সবাইকে থম মেরে আগের ন্যায় নিজ জায়গায় অবস্থান করে থাকতে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করলো ছায়া। খানিকটা কেঁশে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“যে যা করছো, করো। ভালোই ভালোই আমার মেয়ের বিয়েটা মিটে যাবে কেউ চিন্তা করো না। যে যার যার কাজ করো।”

ছায়ার একটা কথাতেই সবাই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। নিজেদের হাসি তামাশায় আবার মনযোগ দিলো। পত্র কতক্ষণ নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। সবটা স্বাভাবিক হতেই তার মাথায় খেলে গেলো অন্য এক ভাবনা। লোকগুলো কে কারা পাঠিয়েছে? প্রজেক্টের কাজের জন্য ই তো এই জমিটা প্রয়োজন, তবে আতসেরা পাঠিয়েছে! চমকে গেলো পত্র। তার পিঠ পিছে আতস অন্যকিছু করছে। অন্যরকম কিছু!

#চলবে