বীরাঙ্গনা হইতে বারাঙ্গনা পর্ব-১৫+১৬

0
218

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ৯

ভর সন্ধ্যা বেলা পত্রদের অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ বাড়িটাই হাজির হলো পত্রদের সবচেয়ে প্রিয় পরেশ মামা। দুই হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি নিয়ে গমগমে আয়োজনে হাজির হয় সে। তার উপস্থিতি অনুষ্ঠান বাড়িটাকে আরও দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসিত করে তুলে। মুহূর্তেই সবাই ভুলে যায় কিছুক্ষণ আগের হৈচৈ এর কথা। পত্র তো মামাকে দেখেই তীব্র বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আনন্দের সাথে বলে,
“কবে আসলা মামা সদর থেকে? তোমারে অনেক মনে পড়েছে।”

ভদ্রলোক মিষ্টির হাঁড়ি গুলো ছায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাসিখুশি কণ্ঠে জবাব দেয়,
“এইতো আজই এলুম। তোদের ছাড়া কী আমার মন টিকে সেখানে বল? তাই চলে এলাম।”

পুষ্পও খুশি হয়ে রান্নাঘরের দরজা থেকে নেমে মামার কাছে আসে, মিষ্টি কণ্ঠে শুধায়,
“কেমন আছো, মামা?”

“ভালো আছি, মা। তুই কেমন আছিস?”

প্রশ্ন করতে করতে পুষ্পের মাথাও আদুরে হাত বুলিয়ে দেয় সে। পুষ্প মাথা দুলিয়ে বলে,
“ভালো আছি, মামা। আসো ভেতরে।”

পুষ্পের কথায় পত্রও মামাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। জায়গা দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ মামা, আসো ভেতরে। কতখানি রাস্তা এসেছো। আসো আসো।”

ভদ্রলোক প্রাণখোলা হাসি দিয়ে উঠোনে রাখা কাঠের চেয়ারটাতে বসলো। তন্মধ্যে পুষ্প জল এনে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলো লোকটার পানে। পরেশ জলটুকু নিয়ে তৃপ্তি মনে খেলো। অতঃপর ছায়ার দিকে তাকিয়ে বেশ প্রশংসার স্বরে বললো,
“কী ব্যাপার ছায়া? পুষ্প মা দেখি বড়ো হয়ে গেছে কয়েক মাসে! আগে তো দৌড়ে গিয়েই সদর থেকে কী উপহার এনেছি তা দেখার জন্য ছটফট করতো কিন্তু আজ! আজ তার রূপ একেবারেই ভিন্ন যে!”

পুষ্প খানিক লজ্জা পেলো বোধহয় মামার ঠাট্টায়। ছায়াও নরম হেসে বললো,
“বড়ো হচ্ছে তো, বুদ্ধি-জ্ঞান বাড়ছে। তা আপনি তো নিশ্চয় ক্লান্ত, ঘরে গিয়ে বসুন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

“হ্যাঁ একটু ক্লান্ত কিন্তু এই হৈচৈ দেখতে খারাপ লাগছে না। যেন আনন্দের হাট বসেছে তোদের উঠোনে। তা সমিরবাবু কই? তার যে কোনো খবর নেই?”

“ঘুমাচ্ছে। আপনি ঘরে যান, আমি ডেকে দিচ্ছি।”

“আরে না না, তার দরকার নেই। পরে উঠলেই দেখা করবো নে। তা পদ্ম মা, তুই অমন চুপচাপ কেন? কী হয়েছে মা তোর? দেখি এদিকে আয় তো।”

উঠোনের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা পদ্মের ধ্যান ভাঙলো পরেশের ডাকে। সে অনেক কষ্টে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মামার কাছে যেতে যেতে বললো,
“কিচ্ছু হয় নি, মামা। তোমাকেই দেখছিলাম ; অনেকদিন পর এলে তো।”

“অনেকদিন পর এলে মানুষ আরও খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় অথচ তুই মন মরা হয়ে বসে আছিস। মন খারাপ, মা?”

মামার প্রশ্নে পুষ্পের ঠেলে কান্না আসে কিন্তু সে কাঁদে না। যেখানে কান্নার বিষয়বস্তু অহেতুক সেখানে কান্নার যে আদৌও মূল্য নেই। নিজেকে অনেক বুঝানোর পরে কান্না গিলতে সক্ষম হলো পদ্ম। মেয়ে জাতি চাইলেই তার সকল অনুভূতি গিলে নিতে পারে। উপচে পড়া কান্না ঠেলে সরিয়ে সে কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে বজায় রেখে আলতো হেসে বললো,
“ঐ তোমাদের ছেড়ে যেতে হবে তো, তাই একটু মন খারাপ। তুমি এসেছো দেখে আমি অনেক খুশি।”

পরেশ মামা তার ব্যাগ থেকে একটা লাল রঙের ছোটো বাক্স এগিয়ে দিলো পদ্মের দিকে, খুশি মনে বললো,
“এই যে ধর, এটা তোর জন্য। দেখতো পছন্দ হয় কিনা।”

পদ্ম বাক্স টা হাতে নিলো। চারপাশে সকলের কৌতূহল মেটানোর জন্য বাক্সটা খুলতেই দেখে স্বর্ণের এক জোড়া ভারী দুল জ্বলজ্বল করছে। তা দেখে ছায়ার হাসি হাসি মুখ মুহূর্তেই চুপসে গেলো, কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
“ওমা, আপনি এত দামী জিনিস আনতে গেলেন কেন? এটার তো অনেক দাম হবে। না না, এত দামী কিছু পদ্ম কীভাবে নিবে। না না, এটা উচিৎ না।”

“কেন উচিৎ না? আমি কী তোদের কেউ না? তোর ছোটোবেলা থেকে তোর মেয়েদের শৈশব কৈশোর আমি ছিলাম, সে নিশ্চয় ভুলে যাস নি? তবে কীভাবে এসব বলছিস?”

ছায়ার তবুও কাঠ কাঠ মুখের প্রতিচ্ছবি বদলালো না। সে ঠাঁই আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
“না তবুও, এতো দামী উপহার দিবেন না পদ্মকে। আমার এটা দৃষ্টিকটু লাগবে। আপনি বরং কমদামী কিছু দিয়েন, আমার পদ্ম হাসি মুখে গ্রহণ করবে। আপনি এটা ফিরিয়ে নিন।”

পরেশ মামাও নিজের কথায় অটল। অতঃপর অনেকটা সময় তর্ক-বিতর্ক করার পর হার মানলেন তিনি। ছোটো শ্বাস ফেলে ছায়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
“ঠিক আছে তবে, তোর কথা ই রইলো। আমি তো তোদের পর, আমার থেকে তোরা নিবি ই বা কেন।”

“পর আপনের কথা না। উপহার দিলেই আপন, নাহয় পর, এসব কেন ভাবছেন? আপনার আন্তরিকতাতেই আমরা সন্তুষ্ট।”

“ঠিক আছে, তবে পদ্মের বিয়ের শাড়িটা আমি-ই দিবো। এটা তো নিবি নাকি?”

অবশেষে ছায়া না পেরে রাজি হলো এই প্রস্তাবে। এর মাঝের পুরোটা সময় পদ্ম পত্রের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রশ্ন মাখা দৃষ্টিতে। কিছু একটা বলতে চেয়েও ভরা সমাগম দেখে সে বললো না। আনন্দ, হৈচৈ-এ আবার মেতে উঠলো পুরো বাড়ি। পত্র মামাকে ঘরে যেতে বললেও সে গেলেন না। আনন্দ পছন্দ করা মানুষ সে। সবসময় আনন্দে মেতে থাকতেই তিনি পছন্দ করেন। বেশিরভাগ সময় সে সদরে থাকলেও হুটহাট গ্রামে এসে পত্রদের বাড়িতে থাকেন। আনন্দে ভরিয়ে রাখেন তখন বাড়িটা।

_

সকল আনন্দ আমেজ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাড়ির উঠোনে অনেক আলো থাকলেও মানুষ মাত্র তিনজন। ছায়া, পত্র ও পুষ্প। তারা রান্না-বান্নার সব গুছিয়ে রাখছে। কেটে-কুটে, ধুয়ে রাখছে। আগামীকাল এত কাজ সামাল দেওয়া সম্ভব না তাই এখনই করে রাখছে। বর্ষার প্রকৃতি তো, তাই শীত শীত ভাবটা একদম জুবুথুবু হয়ে এসেছে। ছায়া মাংসের টুকরো করতে করতে বললো,
“তোমরা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হলো তো।”

পত্র কল পাড়ে গিয়ে মাংসের আলু ধুচ্ছিলো তখন আর পুষ্প মশলা পিষছিলো। মায়ের কথায় দু’জনই মায়ের দিকে তাকায়। পুষ্প নরম কণ্ঠে বললো,
“কাজ গুলো হাতে হাতে শেষ করে দেই, মা। তাহলে তোমার কষ্ট কম হবে।”

ছায়া এক পলক দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছোটো শ্বাস ফেলে বললো,
“পুষ্প, আমার কষ্ট কমাতে চাও? তবে এমন সাদামাটা চালচলন টা বাদ দিয়ে দেও। আগের মতন রঙিন হও, আমার ভালো লাগবে। আর পত্র, তুমি, তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শিখো। সারাজীবন তো ভুল মানুষের সাথে থেকে ভুলই শিখলে।”

পত্র হয়তো বুঝতে পারলো মা কার কথা বলেছে। তাই সাথে সাথে তার মাথায় রাগ উঠে গেলো, বেশ হুঙ্কার দিয়ে তাই মাকে বললো,
“তুমি এবার তো ক্ষান্ত হও মা। মানুষটা তো আর নেই তবে কেন তাকে প্রতি কথায় টানো?”

“টানার কাজ করেছে বলেই টানি।”

পত্র ধোয়ার কাজটা ফেলেই উঠে চলে গেলো গটগট করে। পুষ্প মায়ের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“আমি নিজেকে এখনো ক্ষমা করতে পারি নি, মা। সেদিন যদি আমি এমন চিৎকার চেঁচামেচি না করতাম তবে এতকিছু হতো না। আজ সবটা ভিন্ন থাকতো। এসব বলে আমার খারাপ লাগাটা বাড়িয়ে দিও না, মা।”

“তোমার খারাপ লাগা কমে যাবে, ধৈর্য ধরো।”

পুষ্প আর কিছু বললো না। নিজের মতন সবটা কাজ শেষ করলো। ছায়াও রইলো নিরিবিলি।

আজ সকালটাও আঁধার মেঘের ভেলা নিয়ে এসেছে। চারপাশে অশান্ত বাতাস। উঠোনে রান্নার জন্য তৈরী করা বড়ো চুলাটাও জ্বালাতে পারছে না বাতাসের জন্য। গা শীতল করা বাতাস হিমশীতল করে ফেলছে চারপাশ।

ছায়া ব্যস্ত হাতে কিছু রান্না নিজেদের রান্নাঘরেই বসিয়ে দিলেন। অন্তত পক্ষে নতুন অতিথিদের জন্য তো খাবারের আয়োজন করতে হবে। পদ্ম মাত্র স্নান করে এলো পুকুর থেকে। বাড়িতে তখনও পাড়া-প্রতিবেশির ভিড় পড়ে নি দেখে বার বার চিন্তায় কপাল কুঁচকাচ্ছে ছায়া। পদ্ম উঠোনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছছে। পুষ্প চা বানিয়ে এনেছে পরেশ মামা আর বাবার জন্য। পরেশ মামা চায়ে চুমুক দিয়ে সমিরবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন,
“কী ব্যাপার? কাল শুনলাম আপনাদের বাড়িতে নাকি জায়গা জমি নিয়ে ঝামেলা হলো?”

সমির বাবু চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
“হ্যাঁ, আমাকে তো পদ্মের মা ডাক দেয় নি। আসলে কোয়াটারে আসা মালিকের ছেলে ও ছেলের বন্ধুরা যে প্রজেক্টের জন্য এসেছে সেটার জন্য আমাদের বাড়ির জায়গাটাও প্রয়োজন। ওরা আমাকে বললেও আমি নিষেধ করে দেই। তাই কাল লোক পাঠিযেছে। ছায়া তো নাকি নিজেই ওদের সাথে কথা কাটাকাটি করেছে।”

“ছায়া তো চিরকালেরই সাহসী। ওর বিয়ে তো কম বয়সেই হলো কিন্তু সেই কম বয়সেই কত ছেলেকে শায়েস্তা করেছে ও। একদম বীরকন্যা। ওর যে রূপ, ছেলেদের ভয়ে তো ওর জেঠু জেঠিমা বেরই হতে দিতেন না। কিন্তু ছায়া ছিলো চঞ্চল। ও ঠিক বের হতো আর ছেলেরা কিছু বললে শিক্ষাও দিতো।”

পরেশ হেসে উঠলো ছায়ার শৈশব বর্ণনা করতে করতে। তা শুনে পুষ্প বেশ অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“মা চঞ্চল ছিলো! এ জীবনে তাকে গম্ভীর রূপ ছাড়া দেখিই নি।”

“বয়স হয়েছে, সংসার হয়েছে। আর মেয়েদের বিয়ের পর বদলে ফেলতে হয় তাদের সব। মেয়ে থেকে বউ হয়ে উঠা জীবনের ত্যাগ অনেক।”

পরেশ মামার কথার বিপরীতে ছায়া কিছু বললেন না তবে উঠোনের প্রত্যেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই নারীটির দিকে। কেবল মনে হলো এই নারীটা বোধহয় কোনো রহস্যের গোপন সমুদ্র।

তার মাঝেই উঠোনে ছুটতে ছুটতে হাজির হলো পত্র। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
“মা, বাবা, তাড়াতাড়ি চলো। অভ্রদা’র বাবা আর নেই। মানুষটা আর নেই।”

#চলবে

#বীরাঙ্গনা_হইতে_বারাঙ্গনা (২য় পরিচ্ছেদ)
#মম_সাহা

পর্বঃ ১০

প্রকৃতিতে তখন মানুষ বিদায় নেওয়ার মৌসুম। আকাশে, বাতাসে ছড়িয়ে যাওয়া আগরবাতির ঘ্রাণ জানিয়ে দিচ্ছে কেউ একজন আর নেই। চিতায় তখনও আগুনের ছাঁট রয়েছে। প্রিয় মানুষদের চোখে অশ্রুর স্রোত।

অভ্রদাদের বাড়ির উঠানে বসেছে পাড়া-পড়শীর হাট। দুলাল ঠাকুরের দেহখানা চিতায় তুলে আবার সকলে এসেছে তাদের বাড়ি। এই গ্রামে দুলার ঠাকুরদের আপন বলতে যারা আছে তারা হলো দুলাল ঠাকুরের কয়েকজন কাকাতো ভাই এবং ভাইদের পরিবার। তারাও এসেছে আজ আত্মীয়ের এমন শোকে একটু পাশে থাকার জন্য। সকলের মুখেমুখে রটেছে চা বাগানের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কথা। মুহূর্তেই যেন সে পরিবর্তন হাসিখুশি থাকা ঠাকুর পরিবারটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। প্রথমে এত ভালো ছেলেটা চলে গেলো, তারপর গেলো দুলাল ঠাকুর। পুরো বাড়ি জুড়ে পড়ে রইলো অসহায় মা-মেয়ে। জেঠিমা তো ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে, আবার মিনিট পেরুতেই জ্ঞান হারাচ্ছেন। তাকে ধরেই জটলা বেঁধেছে মহিলাদের। পত্র উঠোনের এক কিনারায় দাঁড়িয়ে পরখ করছে সবটা। হুট করেই সে খেয়াল করলো বিন্নীটা আশেপাশে নেই। পত্র চারপাশে চোখ বুলালো। নাহ্, মেয়েটা উঠোনের কোথাও নেই! তার মা যে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে, সেখানেও মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না। কী অদ্ভুত!

মানুষের সমাগম থেকে সরে পত্র উঠে গেলো অভ্রদা’র বাড়ির দু’তলায়। প্রথমেই সে বিন্নীর ঘরে গেলো। ঘরটা অগোছালো তবে ফাঁকা। বিন্নীটা বরাবরই এমন অগোছালো ছিলো। পত্র চারপাশ খুঁজে বিন্নীকে না পেয়ে চলে গেলো বিন্নীর পাশের ঘরটাতে। অভ্রদা’র ঘর এটা। কাঠের দরজাটা ঠেলতেই কড়মড় শব্দ তুলে খুলে গেলো দরজাটা। রুমটা কী সুন্দর গুছানো! তবে শূণ্যতায় খা খা করেছর চারপাশটা। বারান্দা গলিয়ে একফালি শেষ বিকেলের রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। পত্রের হুট করেই অনুভব হলো অভ্রদা’র শূণ্যতা। অভ্রদা যে চিরতরে বিদায় নিয়েছে এ কথাটা পত্রের এই মুহূর্তে এসে মনে পড়লো। সে ধীর পায়ে অভ্রদা’র ঘরে গিয়ে খাটের পাশে দাঁড়ালো। রুমটার চারপাশ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে পত্রের কানে কেবল একটা কথাই বাজছে “অভ্রদা নেই, নেই এবং নেই”। পত্র বিচলিত হলো। শরীর কাঁপিয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। এতদিন সে বেমালুম এই কথাটা ভুলে ছিলো। ঠিক ভুলে থাকা না, তাকে কেউ একজন এ কথাটা মনেই করতে দেয় নি। ব্যস্ত রেখেছে নানান অহেতুক কাজে। অথচ এতো বড়ো একটা সত্যি পত্র অনুভবই করতে পারলো না! কীভাবে সে ভুলে ছিল?

অনুশোচনায় ঘা হলো পত্রের ভেতর। চোখ টলমল করে অশ্রু ঝড়লো। পত্র বসে পড়লো খাটে। অনুভব করলো পড়ার টেবিলে কেউ একজন বসে আছে। পত্র সেখানে তাকাতেই দেখলো অভ্রদা বসে আছে। খুব মনযোগ সহকারে টেবিলের উপর খাতা রেখে কি যেন লিখছে। পত্র চমকে উঠলো। বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটালো। না, সে তো ভুল দেখছে না। এইতো অভ্রদা সত্যি সত্যি বসে আছে। পত্রের কণ্ঠে তখন শব্দের ভয়াবহ বিপর্যস্ততা। তবুও পত্র ক্ষীণ স্বরে উচ্চারণ করলো,
“অভ্রদা!”

“খবরদার পত্রলেখা, আমায় ডাকিস না ও নামে। তুই যে তোর অভ্রদা’র কেউ না, তুই তা প্রমাণ করে দিলি।”

পত্রের চোখ বেয়ে নোনা অশ্র গড়িয়ে পড়লো। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মিনতি করে বললো,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দেও।”

“ক্ষমা করবো? আমি থাকতে আমায় নিয়ে মেতে ছিলিস, আমি যেতেই বেমালুম ভুলে গেলি আমায়? তোকে তো আমি শিখাতাম কীভাবে ভালো থাকা যায়, ভুলে থাকাটা কোথায় শিখলি পত্রলেখা? তোর অমন দূর্দশা কে করলো রে?”

অভ্রদা’র প্রশ্নে পত্র বাক্যহারা। তার দুর্দশা ঘটিয়েছে তার প্রেম, পত্র তা উচ্চারণ করবে কীভাবে? পত্র চুপ রইলো কিন্তু অপরপাশে বসে থাকা অভ্রদা চুপ রইলেন না। সে আগের ন্যায় ই বলতে লাগলো,
“পত্র, সুন্দর আর চাকচিক্য মানেই সব সঠিক না। চোখ মেলে তাকা, আশপাশ হাতরে দেখ, তোর সর্বনাশ তুই নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিস। আমি তো ভালো নেই, অন্তত তুই ভালো থাক।”

পত্র আরও কিছু বলতো কিন্তু হুট করেই সে টেবিলের উপর তাকাতেই দেখলো সেখানে কেউ নেই। শুধু টেবিল কেন, পুরো ঘরটাতেই কেউ নেই। পত্র থমকালো, সবটাই তার মনের ভ্রম ছিলো! সেটাই হবে হয়তো। হয়তো তার মস্তিষ্কে জাগা প্রশ্ন গুলো তাকে কেবল অভ্রদার প্রতিচ্ছবি দেখালো। পত্র বেরুতে যাবে তার আগেই খেয়াল করলো টেবিলের উপর অভ্রদার লাল রঙের মোটা ডায়েরি খানায় ধুলো জমেছে। পত্র সযত্নে ধৃলো পরিষ্কার করার জন্য ডায়েরি টা তুলতেই কতগুলো সাদা পৃষ্ঠা খুলে খুলে পড়লো ডায়েরি থেকে। পত্র হতভম্ব। ডায়েরিটা খুলতেই তার হতভম্ব রেশটা আরও বাড়লো। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা গুলো ছেঁড়া। কোনো লেখা পৃষ্ঠা নেই। সে পৃষ্ঠা গুলো ছিঁড়ে ফেলার কারণেই সাদা পৃষ্ঠা গুলো খুলে খুলে পড়েছে। পত্র অবাক হলো। অভ্রদা’র এটা বহু যত্নের ডায়েরি। এমন ছেঁড়া থাকার তো কথা না। আর ছিঁড়লেও অভ্রদা ছিঁড়বে না। কাজটা অন্য কেউ করেছে, কিন্তু কেন?

এক ঝাঁক প্রশ্ন নিয়েই পত্র অভ্রদা’র রুম ত্যাগ করলো। মাথায় প্রশ্নদের ছড়াছড়ি। পত্র আরেকটু এগুতেই লাইব্রেরিটা চোখে পড়লো যার দরজা ভেজানো কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে ভেতরে কেউ আছে। পত্র উঁকি দিলো। লাইব্রেরীর বা’দিকের তাক টার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বিন্নী। তার হাত বিভিন্ন বই ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার। পত্র অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো বিন্নীর দিকে। যে মেয়েটা ভাইয়ের মৃত্যু শোক সইতে না পেরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল, নিজের সকল হাসি ভাসিয়ে দিয়েছে মন খারাপের স্রোতে, সে মেয়েটা কিনা বাবার মৃত্যুতে নিরুদ্বেগ! পত্র আর ডাকলো না বিন্নীকে। কেবল চুপচাপ দেখলো মেয়েটার কাণ্ড। নিচ থেকে তখন পরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসতেই পত্র উঁকি মারে উঠোনে। আতসের চিন্তিত চেহারা ভেসে উঠে। লোকটা বিন্নীর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েই বোধহয় ছুটে এসেছে। কিন্তু এতটা উৎকণ্ঠা তো তার চোখেমুখে থাকার কথা না। তবে কেন এত উৎকণ্ঠা? কিসের চিন্তা তার? বিন্নীর জন্য ই কী সে চিন্তা!

পদ্মের আশীর্বাদের তারিখটা সকলে পিছাতে বললেও ছায়া তা করলেন না। নিজের কথায় সে অটুট রইলো। সন্ধ্যার দিকে পদ্মের আশীর্বাদ হয়ে গেলো বেশ সাদামাটা ভাবেই। যদিও পদ্মের মুখে আনন্দের ছিটেফোঁটা ছিলো না কিন্তু ছায়া ছিলো প্রচণ্ড খুশি। তার মুখ থেকে এক সেকেন্ডর জন্যও যেন হাসি সরে নি। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে এমন তা করে দেখিয়েছে। গ্রামবাসী কয়েকজন তা নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছে, কেউবা ধিক্কার দিয়েছে আবার কেউ প্রশংসাও করেছে।

দেখতে দেখতে সকল ব্যস্ততা কাটিয়ে রাত নেমেছে প্রকৃতির বুকে। পরেশ মামা বসে আছেন উঠোনের মধ্যিখানে কাঠের চেয়ারে। ছায়া রান্নাঘরেই টুকটাক কাজ সারছেন। পরেশ মামা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন। তার আবার সময়-অসময়ে চা খাওয়ার অভ্যেস। উঠোনে আপাতত কেউ নেই। সমিরবাবু কেয়ারটেকারের কাজটা ছেড়ে দিয়েছেন কয়েকদিন আগেই। তাই আজকাল নতুন কাজের সন্ধানে থাকেন। পুষ্প আজও অভ্রদা’র বাড়িতে চলে গেছে। গ্রামের আরও কয়েকজন মহিলা অবশ্য সেখানে আছে, সাথে পুষ্পও থাকবে। পত্র বাড়ির কথা ভেবে আর যায় নি। বর্তমানে সে নিজের ঘরে কিছু একটা করছে আর পদ্ম শুয়ে আছে নিজের ঘরের বিছানায়।

পরেশ চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুকটা দিয়ে খানিক গলা পরিষ্কার করে ছায়ার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো এবং সক্ষমও হলো। ছায়া নীরব দৃষ্টিতে তাকালো পরেশের দিকে, ধীর কণ্ঠে বললো,
“কিছু বলবেন?”

“তুই এখনও পত্রের সাথে খারাপ আচরণ করিস কেন?”

ছায়ার ব্যস্ত, কর্মঠ হাতটা থেমে গেলো পরেশের প্রশ্নে। বার দুয়েক পলক ফেলে তাকালো আঁধারে বসে থাকা মানুষটার দিকে। অতঃপর গোপনে একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“তেমন কিছুই না।”

“তুই চোখ ফাঁকি দিতে চাস আমার?”

ছায়া জবাব দিলেন না। নিচের দিকে তাকিয়ে আপন মনে নিজের কাজ করতে থাকলেন। পরেশও আর কিছু বললেন না। অলস হাতে নিজের চা টুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। চায়ের কাপটা রান্নাঘরের দরজার সামনে রেখে ধীর কণ্ঠে বললেন,
“তোর সাথে সরলার সম্পর্কও আমি দেখে ছিলাম। এতটা বদলানোর কোনো কারণ ছিলো না, তবুও তুই বদলেছিলি, কেন?”

“তারও কোনো উত্তর নেই।”

ছায়ার একরোখা উত্তরে তপ্ত শ্বাস ফেললো পরেশ। ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আমি একটু বাহির থেকে ঘুরে আসি।”

“আপনি তো শহরে থাকেন, বিয়ে করেন নি কেন?”

“তারও উত্তর আমার কাছে নেই।”

বাক্য টুকু শেষ করেই পরেশ তৎক্ষণাৎ প্রস্থান নিলো। ছায়া তাকালো না অব্দি সে দিকে। সে যেন জানতো এমন একটা উত্তর দিবে পরেশ। তার ঠিক কিছুক্ষণ বাদেই পদ্ম ঘর থেকে ছুটে এলো হুড়মুড় করে। কল পাড় অব্দি এসেই বমি করে ভাসিয়ে দিলো। পদ্মের বমির শব্দে পত্রও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ছায়া নিজেও রান্নাঘর থেকে উঠে গিয়ে পদ্মের পাশে দাঁড়ালো। পত্রের চোখ-মুখে বিচলিত হাবভাব দেখা গেলেও ছায়ার অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন ছিলো না। সে নিরুত্তর চেয়ে রইলো। পদ্ম বমি করতে করতে ক্লান্ত হতেই তার চোখ-মুখে জলের ঝাপ্টা দিলো ছায়া। মাথায় খানিক জলও ঢাললো। তারপর আবার নিজের আঁচল দিয়ে মুছে দিলো সে জল। পদ্ম ততক্ষণে প্রায় নেতিয়ে গেছে। পত্র চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
“কী হয়েছে বড়দি তোমার? মা, কী হয়েছে গো? হুট করে বমি করলো?”

“অবেলায় খেয়েছে তো, তাই বোধহয় বদহজম হয়ে গেছে। তুই যা নিজের ঘরে, আমি আছি ওর সাথে।”

মায়ের স্বাভাবিক উত্তরটাও অস্বাভাবিক লাগলো পত্রের। সে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“খেয়েছে তো অল্প একটু। তাছাড়া আজকাল তো বড়দি খেতেই চায় না, তুমি বরং একটু ডাক্তার দেখাও বড়দিকে। নিশ্চয় কিছু হয়েছে ওর।”

“তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেছে? যেতে বলেছি না এখান থেকে? যাও বলছি।”

মায়ের ধমকে কিঞ্চিৎ থতমত খেয়ে গেল পত্র। মা যখন অনেক গম্ভীর হয়ে যান তখন কেমন তুমি, তুমি করে কথা বলে। মায়ের আচরণে বোঝা গেলো মা এখনও গম্ভীর হয়ে গেছেন। কিন্তু পত্রের সন্দেহ মিটলো না। সে নিজের ঘরে যেতে যেতে মায়ের চাপা ধমক শুনলো। মা কেমন তাচ্ছিল্য করে বলছে,
“এখন বুজছো তো, ভুল আবেগে গা ভাসালে কী হয়? যে তোমার এসবের জন্য দায়ী সে কোথায় আজ? পিঠ বাঁচিয়ে তো ঠিক চলে গেলো। তুমিই এখন ফেলনা যাবে সমাজের কাছে। তাই যা বলছি তা-ই করো। রাতুল ছেলেটা বেশ ভালো। ও তোমাকে ভালো রাখবে। ওর পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই। তোমাকে নিয়ে সদরে চলে গেলে আর কলঙ্কের ভয় নেই৷ আমি তোমার ভালো চাই।”

মায়ের কথা শেষ হতেই পদ্ম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মাকে জড়িয়ে। পত্রেরও যেন হিসেব মেলাতে সুবিধা হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছে বড়দির কালো অধ্যায়ের কথা। এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করলে সে তার উত্তর পেয়ে যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। মা যখন বড়দিকে নিয়ে ঘরে শুয়ে আসলো পত্র তখন নিজের ঘরে সুযোগের অপেক্ষা করছিল। ছায়া পদ্মের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে যেতেই পত্র হাজির হলো বড়দির ঘরে। পদ্ম তখন কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর তার শরীর কাঁপছে। খুব সম্ভবত কান্নার দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠছে। পত্র সেদিকে তাকিয়ে নিজেকে তৈরী করলো, অতঃপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“বড়দি, আমি যদি খুব ভুল না হই তবে তোমার সর্বনাশের কারণ বিপ্লব ভাই, তাই না?”

পদ্ম চমকে উঠলো। তৎক্ষণাৎ তার চোখের উপর থেকে হাতটা সরে গেলো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো ছোটো বোনের দিকে। পত্র এগিয়ে এলো, বাঁকা হেসে বললো,
“পুকুরপাড়ে তার সাথেই তো গভীর প্রেমে মত্ত হতে। সেই প্রেমেরই ফল এটা? সত্যি বলছি না?”

পদ্মের যেন উত্তর দেওয়ার আর ভাষা নেই। পর পর এভাবে ধরা পড়ে যাবে সে ভাবতেই পারে নি। চোখে-মুখে অবিশ্বাসের উপচে পড়া ঢেউ। পত্র তা দেখে জলচৌকিতে বসলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
“বিপ্লব ভাই কে তো আজকাল আর দেখা যাচ্ছে না। সেদিন মায়ের জ্বরের ওষুধ দিতে এলো এরপর তার আর দেখা নেই। কী ব্যাপার বলো তো?”

পত্রের প্রশ্নের বেড়াজালে হাসফাস করে উঠলো পদ্ম। উপায় না পেয়ে শেষমেশ কেঁদে উঠলো। দু’হাতে মুখ ঢেকে বললো,
“কাপুরুষ ও, কাপুরুষ ছিলো। ভুল প্রেমে মত্ত হওয়া জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাপ ছিলো। ওরে বিশ্বাস করে আমি জীবনের সবটা দান করেছি অথচ ও আমাকে শেষ করে দিলো পত্র। একবারে শেষ করে দিলো। আমাকে ডুবিয়ে ও পালিয়েছে এখন। কথা রাখে নি ও।”

পত্র ক্রন্দনরত বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ভেতরে প্রশ্নরা হামাগুড়ি খাচ্ছে। সেই প্রশ্নদের দমিয়ে রাখতে না পেরে অবশেষে সে প্রশ্ন করেই বসলো,
“আমি তোমাকে দেখেছিলাম সন্ধ্যাবেলা পুকুর পাড়ে। বিন্নী দেখিয়েছিল। এতদিন সঠিক সুযোগের জন্য বলি নি। আবার তুমি অস্বীকার করবে তাই বলি নি। কিন্তু মা জানলো কীভাবে এসব? তবে কী বিন্নী বললো?”

#চলবে