#ভালবাসা_বাকি_আছে – ১৮
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
(কপি করা নিষেধ)
নাম না জানা পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাংলো বুশরার। জানালার শিফন কাপড়ের পাতলা পর্দা তিরতির করে কাঁপছে মৃদুমন্দ বাতাসে। পর্দার ফাঁক গলে সকালের মিষ্টি রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে বুশরার কপাল, গাল, দুচোখ, শরীরের বাঁক।
দমকা হাওয়ায় পর্দা সরে যেতেই ওর চোখে পড়লো সবুজ পাহাড় আর আদিগন্ত বিস্তৃত পানি আর পানি। কিন্তু পাহাড়গুলো স্থির না বরং, হালকা দুলছে বলে মনে হচ্ছে বুশরার কাছে। একটু কি সরে সরে যাচ্ছে? এমন অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ কি বাস্তব? নাকি স্বপ্ন? বুঝতে পারছে না বুশরা।
কাঠরঙ্গা ঘরটার দেয়াল বেয়ে আঁকড়ে থাকা মানিপ্ল্যান্ট আর জানালার বাহিরে সবুজ পাহাড়ের রাজত্ব বলছে এটা বাস্তব। স্বপ্ন তো এত রঙ্গিন হয়না।
উঠে বসার চেষ্টা করতেই টের পেল পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে থাকা একটা শক্ত পুরুষালি হাত। যে হাত ভালবাসার, ভরসার।
চিন্তা ভাবনা দূরে ঠেলে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই এক হাতে জানালার পর্দা সরিয়ে দিল বুশরা। মুহুর্তটা যদি স্বপ্নও হয় ক্ষতি কি?
এত সুন্দর দৃশ্য একটানা দেখতে চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে বুশরার। তাই অল্প কিছুক্ষণ বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করে পাশ ফিরলো৷ শয্যাসঙ্গীনীর নড়াচড়ায় ঘুম ভাংলো রায়হানের।
“কি জনাব? ঘুমের ওষুধ কি দুজনেই…”, মিটিমিটি হাসলো বুশরা।
“জি না। আমি রাতে ড্রাইভ করেছি।”
“ও তাই? তা হঠাত এই দস্যিপনার কারণ শুনি? আমি তো শুরুতে ভেবেছিলাম স্বপ্ন!”
বুশরার এলোমেলো চুলে আঙুল চালিয়ে রায়হান বললো, “সারপ্রাইজ দফতর কি তোমার একার সম্পত্তি?”
রায়হান উঠে বসলো জানালার পাশে। রায়হানের বুকের বাঁপাশে হালকা হেলান দিয়ে বসলো বুশরা।
“আমরা কোথায় জিজ্ঞাসা করছো না যে?”
বুশরার যেন কোন হেলদোল নেই এমনভাবে, “আছি কোথাও একটা।”
“এত কম সময়ে চিন্তাভাবনা করে সারপ্রাইজ প্ল্যান করলাম, তুমি তো পাত্তাই দিচ্ছো না।”
“প্রিয় মানুষটার সাথে আছি, যেখানেই থাকি। আর আমার ছোট্ট জীবনে দেখা সবচাইতে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যটা উপভোগ করছি তার সাথে। বাকি, এটা স্বপ্ন হোক, বাস্তব হোক, জান্নাত হোক বা অন্যকিছু, আই এম দ্য হ্যাপিয়েস্ট পারসন টু হ্যাভ ইউ উইদ মি।”
জীবনসঙ্গীর কাছে এমন অকপট স্বীকারোক্তি পেতে কার না ভালো লাগে? আনন্দের ভেলায় ভেসে এক হাতে পেছন থেকে স্ত্রীকে জড়িয়ে রাখলো রায়হান। বিশ্বাস, নির্ভরতা, ভালবাসায় কেটে গেল কিছু মুহুর্ত, যার হিসেব বোধহয় পৃথিবীর কোন ঘড়ির কাঁটাতেই করা সম্ভব না।
ঠিক এই সময়টাতে ফোনটা বেজে উঠলো বেরশিকের মত। বিরক্তিতে কুঁচকে গেল রায়হানের জোড়া ভ্রু। তবে ফোনের স্ক্রিণে নাম্বারটা দেখে উপেক্ষা করতে পারলো না।
“স্যার এখন ইঞ্জিন না ছাড়লে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে।”
“হ্যাঁ এখন ছাড়েন। নাস্তা কি রেডি?”
“জি স্যার। সিড়ি দিয়ে দোতালায় চলে আসেন। চিনতে পারবেন? নাকি কাউকে পাঠাবো?”
“সমস্যা নাই চিনতে পারবো। দশ মিনিট পরে আসছি।”
কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বুশরাকে নিয়ে দোতালায় গেল রায়হান। মুলত ওরা এখন অবস্থান করছে খুব সুন্দর একটা হাউজবোটে যা কিনা ভেসে আছে কাপ্তাই লেকে।
বুশরা যাতে কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র মিস না করে তাই ঘাট থেকে অল্প কিছুদুর গিয়েই ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখতে বলেছিল রায়হান। এখন ইঞ্জিন চলতে শুরু করায় ওরা এগিয়ে যাচ্ছে সারি সারি পাহাড়ের দিকে।
নিচতলায় গেস্টদের থাকার ঘর। আর দোতালায় খাওয়াদাওয়ার এরেঞ্জমেন্ট। চারপাশে কোমর পর্যন্ত রেলিং আর রোদ থেকে বাঁচার জন্য মাথার উপর শুধু ছাউনি। বুশরা দোতলায় উঠে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রথম যে শব্দটা উচ্চারণ করলো সেটা হল, “মাশাআল্লাহ”।
সকালের নাস্তা করতে করতেই পাহাড়গুলোর মধ্যে পৌঁছে গেল ওদের প্রমোদতরী। সোফা বাদ দিয়ে দোতলার এক পাশে পা ঝুলিয়ে বসলো দুজনে। লেকের মাঝে সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে যেন বসে আসে সারি সারি পাহাড়।
একেকটা পাহাড় পার হওয়ার সময় আবেগের আতিশয্যে রায়হানের হাত শক্ত করে চেপে ধরছে বুশরা। পাগলীটাকে এত খুশি দেখে এই একটা দিন সময় বের করা স্বার্থক মনে হয় রায়হানের।
” বুশরা.. রোদ লাগছে না? কেবিনে যাবা?”
“উহু আরেকটু থাকি?”
“আচ্ছা। ভালো লাগছে?”
“হুম খুউব। জানো আমি কখনো ঢাকার বাহিরে কোথাও ঘুরতে যাইনি। আসলে ওরকম বন্ধুবান্ধবের সার্কেল ছিলো না, আর পরিবার তো…”
পরিবারহীনা মেয়েটার আগের জীবন কেমন ছিল অজানা নয় রায়হানের। তাইতো সবসময় কামনা করে যেন ওই একাকিত্বের দিনগুলোর কথা কখনো মনে না পড়ে বুশরার।
শুধু রায়হান না, রায়হানের মা শিউলি বেগমও সদা সচেষ্ট যাতে মায়ের অভাব কোনভাবেই বুশরার মনে না আসে আর। কিন্তু তাই বলে অতীত তো আর কেটে বাদ দেওয়া যায়না। তাইতো অতীতের বিদগ্ধ অনুভূতিগুলো হঠাৎ হঠাৎ সামনে চলে আসে না চাইলেও।
মৃদু চোখ রাঙ্গিয়ে রায়হান বললো, “পুরোনো কথা মনে করে আক্ষেপ করো এখনো?”
বুশরা হেসে বললো, “আক্ষেপ করবো কেন? আমার জীবন নিয়ে কতখানি শুকরিয়া আদায় করি ভাবতেও পারবেনা তুমি। আমার তো মনে হয় এক জীবনে এত বেশি ভালবাসা দেবেন বলেই উপরওয়ালা সাময়িকভাবে একাকীত্ব দিয়েছিল।“
প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য রায়হান বললো, ” আচ্ছা শোন, আরেকটু সামনে একটা পাহাড়ি রেস্টুরেন্ট আছে। নাম পেদা টিং টিং।”
অদ্ভুত নাম শুনে হেসে ফেললো বুশরা, “এ আবার কেমন উদ্ভট নাম?”
একটু আগের গুমোট ভাবটা যেন কেটে গেল হাসির ঝলকে।
“পেদা টিং টিং শব্দগুচ্ছের আক্ষরিক মানে হলো, পেট টান টান। আর লাঞ্চ করার পরেই বুঝবা নামকরনের কাহিনী। ”
দুপুরের খাওয়া ওখানেই হবে শুনে ঘড়ি দেখলো বুশরা।
“বারোটাও তো বাজে নি? এখনই লাঞ্চ করতে হবে?”
“আরে বাবা না। এখন আমরা অর্ডার করে যাবো যে কি খাবো। সেই অনুযায়ী ওরা রান্না করবে। একদম ফ্রেশ।“
“বাহ, সুন্দর সিস্টেম তো। আগে এসেছো তুমি?“
“হ্যাঁ, কয়েক বছর আগে এসেছিলাম। ওদের ব্যাম্বো চিকেন এত মজা। কাঁচকি ফ্রাই আর কলার মোচা ভাজিটাও অনেক মজা। হাউজবোটে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু তোমাকে এদের রান্না খাওয়াতে চাই দেখে এখানে থামাতে বলেছি।“
“ব্যাম্বো চিকেন কি? বাঁশ দিয়ে চিকেনের তরকারি? পাহাড়ীরা নাকি বাঁশ খায় শুনেছিলাম।”
“আরে না। খেতে বসেই দেইখো। আচ্ছা শোন তুমি কি শুটকি খাও? দেখেছো এতদিন সংসার করে এটাই জানিনা।”
রায়হানের মুখোভঙ্গি দেখে হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছে বুশরা।
“কি এমন সংসার করেছি আমরা যে শুটকি সমাচার হবে? শুটকি খুব পছন্দ করি এমন না। তবে খাই। কিন্তু কেন?”
“পাহাড়ী সিগনেচার আইটেম বাঁশ কুরুইল, একদম কচি বাঁশের এক ধরনের তরকারি। কিন্তু ওতে শুটকির ফ্লেভার ছিল দেখে আমি খেতে পারিনি। তুমি যদি খাও অর্ডার দিব।“
কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘাটে নোঙ্গর করলো হাউজবোট।
তাই বুশরাকে উত্তরের জন্য তাড়া দিল রায়হান, “এই তাড়াতাড়ি বলো… “
বুশরা সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না দেখে রায়হান বললো, “আচ্ছা বুঝছি…।“
তাড়াহুড়া করে চলে গেল রায়হান। অর্ডার করে পাহাড় থেকে নামার সময় চোখে পড়লো জানালায় থুতনি ঠেকিয়ে রাখা বুশরার স্নিগ্ধ মুখভঙ্গি।
দূর থেকে সহধর্মিনীর প্রতি মুগ্ধ মানুষটা বিড়বিড় করে বলল, “কেন এত দেরিতে এলে এ জীবনে?”
চলবে…
#ভালবাসা_বাকি_আছে – ১৯
পেইজঃ Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা
(কপি করা নিষেধ)
আশেপাশের পাহাড়গুলোতে ঘোরাফেরা করে সময় কেটে গেল ওদের। দুইটা মাঝারি সাইজের পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছিল ওরা। উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে কাপ্তাই লেকের ভাঁজে ভাঁজে ছড়ানো সৌন্দর্য দেখে অভিভূত বুশরা। রায়হান রাঙামাটিতে আগেও এসেছে। আগেরবার প্রকৃতির সৌন্দর্যে উচ্ছ্বসিত হলেও এবার প্রকৃতির চেয়ে বরং স্ত্রীর কিশোরীসুলভ অবাক উচ্ছ্বলতা নজর কাড়ছে বেশি।
এখানে একেকটা পাহাড় একেক রকম বৈচিত্রময়। কোন পাহাড়ে বোদ্ধমন্দির, কোন কোন পাহাড়জুড়ে একান্নবর্তী একটা পরিবারের বাস, কোন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জুম চাষ হচ্ছে, কোথাওবা ছোটখাট পরিসরে ইকো রেস্টুরেন্ট সাথে খোলা যায়গায় বসে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করার ব্যাবস্থা, হ্যামক, দোলনা।
শুভলং ঝরণায় পানি নাই শীতকাল হওয়ায়, তবু ওদিকে একটু ঢু মারলো ওরা। কারন ঘুপপানি ঝরনা, মুপ্পেছড়া ঝরনায় পানি থাকলেও ওগুলো বেশ ভেতরে। রায়হানের মতে সেরকম প্ল্যান প্রোগ্রাম ছাড়া হুট করে স্বামীস্ত্রী চলে যাওয়া ঠিক হবে না। হয়ত পরে কখনো আবার আশা হবে ভবিষ্যতে।
দুপুরে বেশ তৃপ্তি করে খেল ওরা। মানুষ যে আসলেই বাঁশ রান্না করে খেতে পারে সেটা খাওয়ার টেবিলে বসে বিশ্বাস করলো বুশরা। রায়হান অবশ্য বাঁশ কুরুইলে হাত দিল না। ও শুরু করলো কাচকি ফ্রাই আর ডাল দিয়ে। আর ওয়েটার যখন ওদের সামনেই আস্ত বাঁশের ভেতর থেকে চিকেন বের পরিবেশন করল তখন তো বুশরার হা দেখার মত ছিল।
“বাঁশের মধ্যে রান্না? কিভাবে সম্ভব? আসলেই খেতে ভাল হবে? মুরগীর গন্ধ থেকে যাবে না?”, হড়বড় করে প্রশ্ন করতে থাকলো বুশরা।
“বড্ড প্রশ্ন করো তুমি। খেয়েই দেখো না।“
“ওকে…”
উচ্চবাচ্য না করে মুরগীর মাংস আর সামান্য ঝোল দিয়ে এক লোকমা ভাত মাখিয়ে মুখে পুরলো বুশরা। তারপর আরেক লোকমা। তারপর আরেক।
প্লেটের ভাতটুকু চেটেপুটে শেষ করে বললো, “আসলেই মজা তো।“
“বলেছিলাম। ডালটা নাও। আর কাচকি ফ্রাই। একদম তাজা মাছের ফ্রাই, মজা পাবা।“
“পেটে যায়গা নাই তো আর!”
“এইটুকুন পেট তোমার। ব্যাম্বো চিকেন দিয়ে হাউজফুল করতে কে বলছিল?”
“এই আমার পেট নিয়ে খোঁটা দিবা না। চিকেনের লোভ কে দেখাইছিলো ভুলে গেছেন জনাব?”
“টেস্ট করতে বলছি, আমি কি…”
“আচ্ছা খাচ্ছি তো বাপু, খুব পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে শিখেছো আজকাল। রাজনীতিবিদ কোথাকার।“
“বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে গালি দিলা?”, ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো রায়হান।
“আমি কিছু বলিনি।“, বলে চোরের মত কাচকি ফ্রাইয়ের বাটিটা টেনে নিল বুশরা।
আপ্রাণ চেষ্টায় দম ফাটানো হাসি আটকে রেখেছে রায়হান। বরং রাগী রাগী ভং ধরে বউয়ের চোখে চোখ রেখে চামচের উপর চামচ ডাল ঢেলে যাচ্ছে শাস্তিস্বরূপ। একটু আগে ডালের চামচের সাথে কাচকি ফ্রাইয়ের চামচ বদল হইয়ে গেছিল দেখে শুকরিয়া করে বুশরা।
খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষে হাউজবোটে ফিরলো ওরা। পরবর্তী গন্তব্য একটা ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ী রিসোর্ট। ওখানে কায়াকিংয়ের ব্যাবস্থাও আছে। সন্ধ্যার আগে ঘন্টাদুয়েক কায়াকিং করে রাতে রিসোর্টেই থাকবে ওরা। মূলত পুরোটাই একটা প্যাকেজ ট্যুর।
এই শীতকালেও হুট করে আকাশে মেঘেদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। একটু আগের তীব্র রোদ সরে গিয়ে মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাস বইছে। ধীর গতিতে সামনে আগাচ্ছে হাউজবোটটা। কেবিনের সামনের ফাঁকা যায়গাটায় বসে আকাশ দেখছিল বুশরা। পাশে চুপচাপ রায়হান। মাঝে মাঝে প্রকৃতি এত নিস্তব্ধ সুন্দর রূপ ধারন করে যে কথা বললেও যেন এর সৌন্দর্য চুরচুর করে ভেঙ্গে পড়বে এমন মনে হয়।
তবে বেশিক্ষন চুপ করা থাকা সম্ভব হল না। ফোটায় ফোটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হতেই জোর করে বুশরাকে টেনে ঘরে নিয়ে আসলো রায়হান। এই শীতকালেও মিষ্টি মুহুর্তগুলোতে আরেকটু শীতলতা ছড়াতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামলো কাপ্তাইয়ের বুকে।
কিছুক্ষণ আগেই রিসোর্টে পোঁছালো ওদের হাউজবোট। হাউজবোটের মতই রিসোর্টের আনাচে কানাচে রুচিশীলতার ছড়াছড়ি। পাশাপাশি কয়েকটা আলাদা আলাদা কটেজ। প্রত্যেকটাই আগাগোড়া কাঠের তৈরি। আর নির্মানশৈলিও হা করে তাকিয়ে দেখার মত। বারান্দায় শোভা পাচ্ছে নানান জাতের নাম না জানা পাহাড়ি লতানো ফুলগাছ।
হালকাপাতলা বৃষ্টি হচ্ছে এখনো।
কটেজে যেতে যেতে বৃষ্টিতে ভিজে গেল দুজনের জামাকাপড়ই। ঝটপট গোসল সেরে কটেজের বারান্দায় রাখা দোলনাতে বসলো বুশরা। বৃষ্টির হালকা ছাঁট লাগছে ওর গায়ে। তবে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ওর। মাত্র কয়েকদিনের জন্য দেশে এসে এতটা ভাললাগার স্মৃতি নিয়ে ফিরবে তা কি ভেবেছিল ও। চাওয়াপাওয়ার হিসেব করে কোনদিনই চলেনি বুশরা। তবে আজ এই মুহুর্তে হিসেবের খাতা খুলে বসতে খুব ইচ্ছা করছে ওর।
“জ্বর সাথে নিয়ে বৈদেশে ফেরা কি খুব জরুরী ডাক্তার সাহেবা?”
স্বামীর খোঁচা শুনে বা হয়ত ফিরতে হবে ভেবে আহত দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটা, “ফেরার কথা মনে করিয়ে দেওয়া কি খুব জরুরী এমপি সাহেব?”
নিঃশব্দে এসে বুশরার পাশের ফাঁকা স্থান পূরণ করলো রায়হান। কিছু না বলে ওর কাঁধে মাথা রাখলো বুশরা। রায়হানও আকাশসমান ভালবাসা নিয়ে এক হাতে প্রিয় মানুষটাকে আগলে রাখলো নির্ভরতার আবেশে।
পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে খুব দ্রুত। বৃষ্টি থামলো সন্ধ্যার মাত্র আধাঘন্টা আগে। ওইটুকুন সুযোগ পেয়ে অল্প কিছুক্ষণ কায়াকিং করলো দুজনে। শান্ত লেকের পানিতে বেশ অনেকদূর এগিয়ে গিয়ে বৈঠা চালান বন্ধ করলো ওরা।
চুপচাপ উপভোগ করল পাহাড়ের নিস্তব্ধতা, কাপ্তাই লেকের বিশালতা, আর মেঘময় অসীম আকাশ। কায়াকিংয়ের পুরো কন্সেপ্টটা খুব ভালো লেগে যায় বুশরার। একটা নৌকা, দুটো মানুষের হাতে বৈঠা, তৃতীয় কোন ব্যক্তি নাই। তারচেয়েও বড় কথা দুজনের বৈঠা বাওয়ার মাঝে সুন্দর একটা আন্ডার্স্ট্যান্ডিং লাগে ঠিকমত এগিয়ে যাওয়ার জন্য। ঠিক যেমনটা সংসারজীবনে লাগে।
কায়াকিং পয়েন্ট থেকে একটু দূরে চলে গিয়েছিল ওরা, এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। কায়াকিং পয়েন্ট থেকে দুইতিনবার ফোন করেছে ফিরে আসার জন্য। অগত্যা ফিরে আসতে হয় ওদের।
ইলেকট্রিসিটি বলতে আমরা যা বুঝি তা নাই এই রিসোর্টে, বা বলা চলে ছোট্ট এই আইল্যান্ডে। স্বল্প ক্যাপাসিটির একটা সোলার প্যানেলই ভরসা। কিন্তু দুপুর থেকে মেঘলা আকাশ বৃষ্টির কারনে সোলার প্যানেলের ব্যাকআপ খুব বেশি নাই। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া তাই বিদ্যুৎ অপচয় না করার অনুরোধ করেছে রিসোর্ট ম্যানেজার। সাথে নিয়ে এসেছিল দুটো হ্যারিকেন বাতি।
ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বারান্দায় ফিরে আসে রায়হান। বারান্দার দুই কোনায় থাকা আংটার সাথে হ্যারিকেনদুটো ঝুলিয়ে দিল। তারপর লাইট বন্ধ করে এসে বসলো বুশরার পাশে। হ্যারিকেনের হালকা আলোয় দুজনে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের এলোমেলো গল্প করলো অনেকক্ষণ।
রাতের খাওয়ার আয়োজনে বাকি সব খাবারকে উপেক্ষা করে ব্যাম্বো চিকেনের উপর ঝাপিয়ে পড়লো বুশরা। কিন্তু কয়েক লোকমা খেয়ে বলল, “মজা, তবে দুপুরেরটা বেশি মজা ছিল।“
“বুঝেছো কেন হাউজবোটে না খেয়ে ওদের ওখানে খেলাম?”
“হুম্ম।“
“কলার মোচা ভাজি নাও। মজা হয়েছে।“
নাও বললেও বুশরার নেওয়ার অপেক্ষা করলো না রায়হান। নিজেই প্লেটে বেড়ে দিল কলার মোচা ভাজি। তারপর খেল চাপিলা মাছ। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো দুজনেই।
শীত শীত আবহাওয়ায় বেশ সুন্দর ঘুম হলো দুজনের।
ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ বারান্দায় বসতে চাইলো বুশরা। একসাথে সুর্যোদয় উপভোগের তীব্র বাসনা থাকলেও রায়হানের তাড়ায় রেডি হতে হলো বুশরাকেও। তাড়াহুড়া দেখে প্রথমে ভেবেছিল আইল্যান্ডের মধ্যে হাটতে বের হবে হয়তবা। কিন্তু সাথে থাকা একমাত্র ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে চেকআউটের ফর্মালিটি করতে দেখে অকারন মন খারাপ হয়ে যায় বুশরার। তবে বরাবরের মতই কিছু বলে না।
ঘাটে স্পিডবোট রেডি ছিল। বুশরার হাত ধরে উঠতে সাহায্য করলো রায়হান। দুজনে উঠে বসতেই ছেড়ে দিল স্পিডবোট। অল্প সময়ের মধ্যেই স্পিডবোট পৌঁছে গেল রিজার্ভ বাজার ঘাটে, যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল ঠিক করে রাখা সিএনজি।
“গাড়ি কোথায় তোমার?”, অবাক হয়ে বললো বুশরা।
“কাছেই একটা হোটেলের পার্কিংয়ে রাখা আছে।“
“ওহ। আমরা কি ওখানে যাচ্ছি?”
“উহু। একটু চোখ বন্ধ করো। কাঁধে মাথা দাও দেখি…“
শহর থেকে কিছুদুর পেরিয়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় পৌঁছাতেই ভোরের আলো ফুটলো চারিদিকে। সিএনজি থেকে মাথা বাড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে ভুলে গেল বুশরা। পাহাড়ের এক রূপ কাল সারাদিন দেখেছে কাপ্তাই লেকের মাঝে। আর আজকে দেখছে আরেক রূপ। কাল বৃষ্টি হওয়ার বোধহয় আরো বেশি সবুজ দেখাচ্ছে চারপাশ। এখানে ওখানে কুয়াশার মত হালকা মেঘ লেগে আছে পাহাড়ের গায়ে।
সাপছড়ি বাজারে সকালের নাশতা সারলো রায়হান আর বুশরা। নাশতার আয়োজন নিতান্তই সাধারণ। পরোটা আর ডাল। খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষে পাশের দোকান থেকে কিছু শুকনা খাবার কিনলো রায়হান। তারপর আবার সিএনজিতে চেপে বসলো ওরা।
অল্প কিছুদুর যাওয়ার পরেই অবশ্য মাঝ রাস্তায় সিএনজি ছেড়ে দিল রায়হান। বুশরার হাত ধরে পাকা রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়ল মেঠোপথে। অবশ্য মিনিট দুয়েক হাটার পর সেই মেঠোপথ হয়ে গেল পাহাড়ি পথ। একটানা কিছুক্ষন উপরে উঠতে উঠতে আবার নিচে নামা, আবার ওঠা, আবার নামা। এভাবেই চলল ঘন্টা দেড়েক। প্রথম এক ঘন্টা পাহাড়ী সৌন্দর্যে মুগ্ধতায় ভাসলেও ক্লান্তি চেপে ধরছে বুশরাকে। রায়হান সে তুলনায় বেশ চনমনে। ওকে দেখে হাটতে কষ্ট হচ্ছে বলে মনেই হচ্ছেনা বুশরার।
“ইয়া বড় ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়েও হাঁটতে কষ্ট হচ্ছেনা তোমার?”
“কষ্টতো একটু হবে বলেছিলাম।“
“একটু? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“রাঙামাটি জেলার সবচেয়ে সুন্দর আকর্ষণ সাজেকভ্যালি।“
“তা আমরা কি এখন হেঁটে হেঁটে সাজেকভ্যালি যাবো?”, ভেংচি কেটে বললো বুশরা।
“পাগলী, আগে শোন তো।“
“আচ্ছা বলো।“
“সময় কম ছিল, আর তাছাড়া তোমাকে ওভাবে কিডন্যাপ করে সাজেক যাওয়া যেত না। অনেক কাহিনী আছে ওখানে যাওয়ার। কিন্তু রাঙামাটি শহরের পাশেই সাজেকের চাচাতো বোন ফুরোমোন পাহাড়। আমরা এখন ওটার চূড়ায় উঠতেছি। এই এলাকার সবচেয়ে বড় পাহাড় এটা।“
“আম্মাআআআ…… আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও হুহুহু…”
“আম্মা শুনতে পাচ্ছেনা বেবি।“
“এই আমি বেবি না, খবরদার। আমি আম্মাকে ফোন করে নালিশ করবো। আমার ফোন, আমার ফোন দাও।“
বুশরার যাতে হাঁটতে একটু কম কষ্ট হয় তাই বুশরার হ্যান্ডব্যাগটাও নিজের ব্যাকপ্যাকে পুরেছিল রায়হান। এখন এই বিনোদন দেখে নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল বউয়ের দিকে।
“এই নাও ফোন। কিন্তু নেটওয়ার্ক নাই আম্মার বেবি। নাও পানি খাও।“
নিস্ফল আক্রোশে হাত পা ছুড়লো বুশরা। তবে এত পিপাসা লেগেছে যে পানিটা ফিরিয়ে দিল না।
“বেশি খেও না। ওয়াশরুম নাই কিন্তু।“
চোখ বড় বড় করে বুশরা বলল, “সিরিয়াসলি?”
“লোকালয় দেখেছো আশেপাশে?”
আরো কিছুদুর হেঁটে একটা সিড়ির গোড়ায় পৌঁছালো ওরা।
রায়হান বলল, “আর হাঁটতে হবে না পাহাড়ী পথে। যাস্ট সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেই ফুরোমনের চূড়া।“
দাঁতে দাঁত চেপে বুশরা বললো, “তাই? হাঁটতে হবে না? কোলে নিয়ে যাবা?”
নিজের কথায় নিজে ফেঁসে যাচ্ছে দেখে রায়হান অস্ফুটস্বরে বলল, “বড্ড কথা বলো বুশরা। চলো, চলো, রোদ উঠে যাবে তো।“
প্রায় শ পাঁচেক ধাপ পেরোনোর পর বুশরা বললো, “এই তোমার যাস্ট সিড়ি তাইনা?”
“ওই তো আর একটু…”
“জি জনাব, বুঝেছি। চলেন।“
শেষ কয়টা ধাপ উঠতে বুশরার মনে হচ্ছিল আর যেন পা চলছেই না। শক্ত করে স্ত্রীর হাত ধরে রেখেছে রায়হান।
সিড়ি শেষ করে সমতল পেয়ে হাঁপাতে লাগলো দুজনেই। এর মধ্যেই বুশরার চোখ দুটো পেছন থেকে এক হাত দিয়ে ঢেকে দিয়েছে রায়হান।
অন্য হাতে ওকে ধরে বললো, “আমার সাথে সাথে হাটো।“
“পড়ে যাবো তো।“
“বিশ্বাস করোনা আমাকে?”
“করতাম তো। কিন্তু লাস্ট দুইতিন ঘন্টায় বিশ্বাসের ব ও বাকি রাখছো?”
“কি আর করবো বড়জোর পাহাড়ের কিনারায় নিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো।“, হেসে বললো রায়হান।
বুশরাও হেসে ফেললো, “হুম, তাহলে আর হেঁটে নামা লাগবে না। চলো, চলো।“
কথা বলতে বলতেই বুশরাকে পাহাড়চূড়ার কিনারায় নিয়ে আসলো রায়হান। তারপর আলতো করে চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে নিল।
“শেষ? ফেলে দিবা…”, বলতে বলতে চোখ খুললো বুশরা। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল।
মেঘের ফেনিল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো অবাক বিষ্ময়ে।
মিনিটখানেক পরে বললো, “আল্লাহ!!! এত সুন্দর কেন!!! আমি তো মরেই যাবো।“
ঘোর কাটতেই আচমকা পেছন ফিরে রায়হানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুশরা।
“সত্যি সত্যি পা হড়কে পড়ে যাবা কিন্তু…“, বলতে বলতেই তাল সামলালো রায়হান।
চলবে।