মন বাড়িয়ে ছুঁই ২ চূড়ান্ত অংশ এবং শেষ পর্ব

0
892

#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
#চূড়ান্ত_অংশ .

ভ:য়ার্ত চেহারায় বসে আছে। মাথাটা মেঝের দিকে ঝুঁকানো। চুল থেকে টুপ-টুপ করে ঘাম ঝরছে।গায়ে নেভি রঙের পান্ঞ্জাবী। ঘামে ভিজে সেটা দেহের ভাঁজে-ভাঁজে লেগে আছে। বেশ লম্বা-লম্বা নিশ্বাস নিচ্ছে, নিশ্বাসের দমকে পিঠটা আস্তে-আস্তে ফুলে আবার ধীরগতিতে আগের মতো হচ্ছে। বাইরে থেকে যতটা শান্ত দেখাচ্ছে, ভেতরের অবস্থা তিনগুণ খারাপ! উত্তপ্ত ক্রোধের বেসামাল ক্ষোভকে কন্ট্রোল করছে সে। বন্য জন্তুর মতো বেকাবু কায়দায় ফুঁসছে। কতক্ষণে শিকারের উপর হাত চালাবে সে, কখন নির্মমতার পরিচয় দিয়ে খুন করবে? টুকরো-টুকরো করে নিশ্চিহ্ন করার সুখ অন্তরে মিলবে কখন? নত দৃষ্টি তুলে সামনের দিকে তাকালো। সেখানে মেঝের উপর শুয়ে আছে রোকনুজ্জামান। জাlনোlয়ারটা একটুখানি পানির জন্য হাহাকার করছে। চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে, মুখটা হা করে আছে। মুখটার উপর জোরে লাlত্থি মাlরlলে কেমন হয়? একই সাথে যদি চোখ ও ঠোঁট থ্যাঁlতlলে দেওয়া হয়, ব্যাপারটা কেমন হবে? এই কুলাঙ্গার কতগুলো মেয়ের সম্ভ্রম নlষ্ট করেছে, তা হিসাব ছাড়া। টাকার বিনিময়ে কত নারীর ইlজ্জlত নিlলাlম করেছে তা বেহিসেব। পlশুlর মতো ভক্ষণশীল স্বভাবের জন্য কত অবলার প্রাlণ কেlড়েlছে, তা অগণিত। এই নlরপlশুটার জন্য নরম মৃlত্যু ঠিক? কখনোই না! নেতার জোর, টাকার জোর, ক্ষমতার জোর খাটিয়ে সবকিছু উদ্ধার করেছে। যখন যেটা দরকার ছিল, টাকার গরজে শিlকাlর করেছে। এমন মানুষরূপী শlয়lতান শুধু নারীদের মাঝে সীমাবদ্ধ না, দেশের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। চোখের সামনে বহু মেয়ের ছবি ভাসলো। কান্নাজড়িত চোখ, নিষ্প্রাণ দেlহ, পাlশlবিক অত্যাlচাlরে দম ছেড়ে দিয়েছে। তাদের শূন্য দেlহ তুলে মাটির গর্তে চাlপা দিচ্ছে। কেউ জানলও না মেয়েটি আর নেই। কলেজ-ভার্সিটি থেকে ফিরতি পথে মেয়েটা রুমাল শুঁকলো। তার জন্য বাবা-মা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকলো। মেয়েটা কোনোদিন ফিরল না। এমন বহু কেস কানে শুনেছে মাহতিম, কিন্তু ন্যায় বিচারের সুযোগ নেই। প্রশাসন যেন টাকার উপরে চলে; বিচার‍ের উপর চলে না। ব্যাপারটা মনে পরতেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারের পাশ থেকে রডটা তুলে প্রচণ্ড জোরে বারি লাগাল! মনের ক্ষোভ মিটিয়ে শরীরে আঘাত করলো সে, পুরো ঘরটা জাlনোয়াlরটার চিৎকারে ছেপে যাচ্ছে। আর্তনাদে দেয়ালে-দেয়াল প্রতিধ্বনি হচ্ছে,

– আর করব না, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আনসারী। আর করব না। বাবা রহম করো। ওয়াদা করছি, কানে ধরছি। আনসারী ছেড়ে দাও, খুব লাগছে।

রডটা দু’হাতে ধরে পিটিয়ে চলল মাহতিম। ইচ্ছামতো পিটিয়েই চলল! চিৎকারের ধ্বনি শুনে একবিন্দু থামল না। জানোয়ারের মুখে ‘ ছেড়ে দাও ‘ শব্দ মানায় না। ওই মেয়েগুলো আর্তনাদ করেনি? ওরা বলেনি ‘ ছেড়ে দাও ‘? টাকার জোরে সবই সম্ভব তাই না? আরো আগ্রাসী হয়ে পেটাতে থাকলো মাহতিম। ততক্ষণ পযর্ন্ত পিটিয়ে চলল, যতক্ষণ পযর্ন্ত নোমান এসে জোরপূর্বক টেনে না-সরালো। বসকে পেছন থেকে জাপটে ধরে অনেক কষ্টে থামাল। অনুরোধ করতে-করতে অস্থিরচিত্তে বলল,

– স্যার থামেন। স্যার, কন্ট্রোল। রডটা আমার হাতে দেন। না, না একে মারবেন না। হাত নোংরা করবেন না। আপনি আমার কথা শোনেন। স্যার শোনেন? এদিকে…এদিকে বসুন, আগে এদিকে বসুন। মাথা ঠান্ডা করুন। রডটা আমার হাতে দেন। বসুন স্যার, ঠান্ডা।

মাহতিম ফোঁস-ফোঁস সুরে নিশ্বাস নিচ্ছে। নোমানের তাগাদায় চেয়ারে বসে। হাত থেকে রডটা ছেড়ে দিতে নিবে, ঠিক তখনই চোয়াল শক্ত করে নির্দিষ্ট দিকে ছুঁড়ে মারলো। সাথে-সাথে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করলো রোকনুজ্জামান। নোমান এহেন কাণ্ডে কিছুই করতে পারল না। একবার বসের দিকে চাইল, আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে মেঝের দিকে চাইল, রোকনুজ্জামান দু’হাতে ঠোঁট চেপে লুটোপুটি খাচ্ছে। নোমান আরেকটু খেয়াল করতেই অস্ফুট স্বরে ‘ আল্লাহ্ ‘ বলে শিউরে উঠলো। রোকনুজ্জামানের ঠোঁট ঝুলে আছে! বীভৎস দৃশ্য দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচাল নোমান, সমস্ত শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা কি করলো? আবার চোখ খুলে বসের দিকে মুখ ফেরালো। বস নির্বিকার। কাজটা করে কোনোপ্রকার ভয় বা অনুশোচনা নেই। বস রোকনুজ্জামানের দিকে শাণিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। নোমান আলতো করে নিচের ঠোঁটটায় জিভ ছোঁয়ালো, মৃদু স্বরে ইতস্তত করে বলল,

– স্যার, ওই রুমে যাওয়া যাচ্ছে না। গন্ধ ছড়াচ্ছে। ডেডবডি বেশিক্ষণ রাখা যাবে না। রজনী ম্যাম আপনাকে শেষবারের জন্য ডেকেছে। যদি আপনি একটু কনসিডার —

মাহতিম পাত্তা দিল না। সে আপন মনে কাজ করে গেল। নিজের মাথাটা একবার ডানে ও একবার বামে কাত করে ব্যায়ামের মতো করলো। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে এমন ভঙ্গীতে চেয়ার ছেড়ে উঠলো, যেন কিছুই করেনি সে। বাঁ-হাতের স্লিভ একটু নেমে গেছে, সেটাই ডানহাতে গুটাতে-গুটাতে রুম ছেড়ে বেরুলো। রোকনুজ্জামানের চিৎকার এখনো কমেনি, লোকটা অসহনীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করে যাচ্ছে।

ভয়াল রাত। চারিদিকে অন্ধকার করা পরিবেশ। ছাদ ধুয়ে পানি পরার শব্দটা ভয় জাগিয়ে দিচ্ছে। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে। মাটির স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ বাতাসে-বাতাসে ছড়াচ্ছে। রুমটা আলোহীন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। গা ছমছম অবস্থা। রজনী ইবনাত রুমের এককোণে গুটি পাকিয়ে বসে আছে। ভয়কাতুরে দৃষ্টি দিয়ে চমকে যাওয়ার মতো কেঁপে-কেঁপে উঠছে। এক্ষুনি পেছন থেকে ভয়ানক কিছু ঘটবে! এই বুঝি মেরে ফেলল কেউ! হঠাৎ গাছের মর্মর শব্দটা এমন সোচ্চার হলো, যেন ডাকিনী আত্মা মুক্তির উল্লাসে চিৎকার করে যাচ্ছে। দ্বিগিদিক অদ্ভুত সুরে সন্ঞ্চার করছে ভয়। রজনী এদিক-ওদিক ভীতু চোখে তাকিয়ে মনের ভ্রমে প্রশ্ন করল, ‘ কে? তু-তুমি কে? হাসছ কেন? জবাব দাও? হা-হাসছ কেন? ‘। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। কোনো জবাব এলো না। গাছটা এখনো মর্মর করে শব্দ করছে। নিশুতি রাতের জন্য এমন অবস্থা হয়েছে, এখানে সুস্থ মানুষের আনাগোনা চলে না। ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে যাবে। জায়গাটা জনমানবশূন্য। বসতি এলাকা থেকে বহু মাইল দূরে। এখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। জোৎস্নার আলো ঢুকে না। কেউ আন্দাজ করতে পারবে না এখানে তিন-তিনটে মানুষ পরে আছে। তার মধ্যে একটা মৃত। লাশটা পঁচে গন্ধ ছড়াচ্ছে। নাকে একটু-একটু পাচ্ছে। হঠাৎ খুটখাট শব্দ হলো। তৎক্ষণাৎ রজনী কান খাড়া করলো। কেউ তো আসছে, ঠিক এদিকটায় আসছে। ধুপ-ধুপ করে শক্ত জুতার শব্দ হচ্ছে। এই স্বর পরিচিত! এটা আর কেউ না, এটা একজনই। দরজা থেকে তালা খুলার শব্দ হল, জড়সড় হল রজনী। এরপরই জং ধরানো দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল। ডান পা বাড়িয়ে প্রবেশ করলো সে, চট করে হলুদ বাতি জ্বালিয়ে দিল। রজনী সবটাই শুনতে পাচ্ছে, এইতো চেয়ার টেনে বসল। রজনী দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে বসে আছে। মৃত্যু চিন্তায় চোখ দিয়ে দরদর করে পানি বেয়ে পরছে। ভাইজানের চিৎকারটা শুনতে পেয়েছে সে। এবার তাকেও মেরে ফেলবে। অনেকক্ষণ যাবৎ সাড়াশব্দ না পেয়ে মুখ তুলল রজনী। চোখের সামনে ভয়ানক মূর্তি দেখে চিৎকার দিয়ে উঠল। থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। আহাজারি করতে-করতে দুই হাত একত্র করে বলল,

– ভু-ভু-ভুল হয়ে গেছে…

মাহতিমকে এই অবস্থায় দেখেনি কেউ। আজ পযর্ন্ত নিজেকে এমন অবস্থায় প্রর্বতন করেনি। কোনো সুস্থ মানুষ যদি এই চেহারায় তাকে দেখত, সে বোধহয় কল্পনাই করতে পারত না এটা মাহতিম। যদি মেহনূরের সামনে এই চেহারায় আসত? মেহনূর তখন কি করত? সে সামনের দিকে মেঝেটার পানে তাকাল। রজনী ইবনাত হুঁ হুঁ করে কাঁদছে। কম্পিত হাত জোড়া খুব কাঁপছে। ক্ষমা প্রার্থনার মতো কপালে ঠেকিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলল,

– ক্ষমা করো আনসারী। ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও…

রজনী শেষ আর্জিটুকু জানিয়ে দিল। সে স্বস্তি চায়। সে মুক্তি চায়। এভাবে অভুক্ত থেকে বাঁচতে চায় না। কপাল থেকে হাতজোড়া নামিয়ে ফেলল সে। কান্নায় ঠোঁট কাঁপাতে-কাঁপাতে বহুকষ্টে বলল,

– ক্ষুক্ষুধায় মরে যাচ্ছি, মৃত্যু দাও।

মাহতিম অনড় ভঙ্গীতে তাকিয়ে রইলো। কিছু সেকেন্ড পর ম্লান ঠোঁটে শ্বাস ছাড়ল। নিরুদ্যম কণ্ঠে বিষণ্ণ চোখে বলল,

– আমার ভাইটাকে কেন মারলেন মামী?

এবার আছড়ে পরা কান্নায় ভেঙে পরলেন রজনী। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আকুতি-মিনতি জানাতে-জানাতে ক্ষমা চাইলেন, বারবার জোড়হস্তে ভুল স্বীকার করলেন। কিন্তু লাভ নেই। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল, একটাই ত্রুটি। কেন তিনি মাহতিমের কলিজায় হাত দিলেন? ওর কাছে যে বউয়ের চেয়ে ভাইটা বেশি আদরের ছিল, সেটা আদৌ জানতেন না তিনি। ভেবেছিলেন মেহনূরকে সরিয়ে আত্মতুষ্টি করবে, কিন্তু যখন ব্যর্থতার ফাঁদে আঁটকা পরলেন, তখন মাহদিকে সরানো ছাড়া উপায় পেলেন না। চেয়ারে বসা মাহতিম আবারও বিষাদের সুরে বলল,

– ওর দোষটা কি ছিল? ওইটুকু ছেলে কি বুঝতো মামী? আপনার শlত্রুlতা আমার সাথে ছিল। আপনি আমাকে আlঘাlত করতেন? আমার ভাইটাকে কেন? যদি আল্লাহর ওয়াস্তে ছেড়ে দিতেন মামী? যদি ছেড়ে দিতেন। আপনি দিলেন না তো। মেlরেই ফেললেন। আজ তিনটা বছর ধরে ওর কlবlরের সামনে আমি যাই না। যেই পযর্ন্ত আপনাকে আমি নিজের হাতে শাlস্তি না দেব, সেই পযর্ন্ত ওর কাছে যাব না। আজও আমি যাইনি। আপনি আমাকে যেই কlষ্ট দিয়েছেন, সেটার কাছে আপনার ক্ষমা কিছুই না।

মাহতিম মাথা নিচু করল। পান্ঞ্জাবীর হাতায় চোখ ডলে আবার তাকাল সে। নিজের ডান কাধে তর্জনী দিয়ে নিশানা করে বলল,

– ওর লাlশ এই কাধে তুলেছি। এত সহজে দিনগুলো ভুলব না। আপনার জন্য ভাইয়ের লাlশ দাlফন করে ডিউটিতে গিয়েছি। আমার অসুস্থ বউকে বিছানায় ফেলে ফিল্ডে যেতে হয়েছে। এতো সহজে তো আনসারী ওগুলো ভুলবে না। আপনার ক্ষমাতে সব ফিরে পাব? এতোই সহজ? আপনার ভাই আর আপনি দুটোই জাlনোlয়ার! আমি জাlনোlয়ারদের সাথে আমি জানোয়ারের মতোই ট্রিট করব।

বলেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। বুক ফুলিয়ে দম ছেড়ে নিlষ্ঠুlর একটা হাসি দিল। রজনী স্তম্ভিতের মতো স্থির হয়ে গেছে। আসন্ন ঘটনা নিয়ে যে সকল ছক পাকিয়েছে, তা যেন হাসির আদলে ফুটে উঠছে। মাহতিম রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো মাথা ঘুরিয়ে হিংlস্র চাহনিতে বলল,

– আপনি আমার মেহনূরকেও শান্তি দেননি। ও আপনার কোনো ক্ষতি করেনি। ওরও দোষ শুধু একটাই, ও মাহতিম আনসারীর বউ। আপনি আমাকে ক্ষlতি করতে যেয়ে কতগুলো পাlপ করেছেন হিসাব আছে? নেই! আপনার জন্য এই মেয়েটাকেও কষ্ট দিয়েছি। মেয়েটা এতিম। ওর বুকে কষ্ট দেওয়ার কাহিনি বুঝেন? বুঝবেন। আমি বুঝিয়ে দিব।

দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে মাহতিম চলে গেল। একবারও পিছু ফিরে তাকাল না। তালাটা যখন নোমানের হাতে দিল, নোমান তখন বসের দিকে চেয়ে গভীর নিশ্বাস ছাড়ল। আজই কাজ শেষ। এই এলাকায় আর ফেরা হবে না। বসকে আশ্বস্ত করে নোমান শান্ত সুরে বলল,

– কাজ হয়ে যাবে স্যার। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি সবকিছু ক্লোজ করে দিচ্ছি। আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন।

.

বেলা বারোটা। সূর্যের তাপ নেই। ধীরে-ধীরে শীতের মৌসুম চলে এসেছে। রাত এখন গভীর হলে ধোঁয়া-ধোঁয়া অবস্থা হয়, ফাঁকা স্থানে কুয়াশা জমে। গাড়িটা মেটো রাস্তা ছেড়ে হাইওয়েতে উঠল। বাতাসটা গরম নয়, বেশ আরামদায়ক। জানালাটা খুলে দিয়েছে মাহতিম, আজ ড্রাইভিং সীটে ড্রাইভ আসন গেড়েছে। পাশেই নোমান চুপচাপ ভঙ্গীতে সামনে তাকিয়ে আছে। গতকাল সন্ধ্যার দিকে এদিকে এসেছে তারা। গোটা রাত পেরিয়ে এখন দুপুর। আজ স্যারের চাচাতো বোনের বৌভাত। তিনি কি ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবেন? প্রশ্নটা করতে গিয়ে কাঁচুমাচু করছে সে, ঠিক ওই সময় পাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত বাক্য চলে আসে,

– ফারিনের বৌভাত নিয়ে টেনশন করছ?

নোমান বড়-বড় চোখ নিয়ে ডান পাশে তাকাল। বসের দিকে আহাম্মকের মতো চেয়ে বলল,

– জ্বী স্যার। আপনি কিভাবে বুঝলেন?

মাহতিম মৃদু ঠোঁটে হাসল। অর্থাৎ, এসব বোঝা কোনো ব্যাপার না। তার চিন্তা হচ্ছে মেহনূরকে নিয়ে। মেয়েটা অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে। রাতে ঘুমায় না, খাওয়াতে মন নেই, সারাদিন খালি পালিয়ে-পালিয়ে বেড়ায়। ইদানিং আরেকটা ব্যাপার আশ্চর্যজনক লাগল! ও রাতে এক রুমে থাকতে চায় না। রাতে অনীহা দেখিয়ে মায়ের রুমে ঘুমাতে যায়। যেই মেহনূর বুকের মধ্যে মাথা রেখে ঘুমোয়, গায়ে স্পর্শ না-পেলে একদণ্ড ঘুমাতে পারে না, সে কিভাবে আলাদা থাকতে চাইছে? মেহনূর কি তবে কোনোকিছুতে ক্ষিপ্ত? নাকি মাহতিম অজান্তেই কোনো ভুল করে বসেছে? এগুলো নিয়ে অন্যমনষ্কে হারিয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ নোমানে চ্যাঁচিয়ে উঠল,

– স্যার সামনে দেখুন!

মাথাটা মৃদু কাঁপিয়ে স্বাভাবিক হল মাহতিম। তাড়াতাড়ি গাড়িটা ব্রেক কষে থামিয়ে ফেলল। রাস্তার মাঝখানে ছোট্ট একটা কুকুর ছোট-ছোট পায়ে পার হচ্ছে। বোবা প্রাণীটা আরেকটু হলে পিষে যেত। নোমান ভ্রুঁ কুঁচকে বিস্ময় চাহনিতে বলল,

– স্যার কি হয়েছে? আপনি কোনোকিছু টেন্সড্? আপনাকে তো কখনো এরকম অবস্থায় ড্রাইভ করতে দেখিনি।

মাহতিম একটু ভাবনায় পরে গেল। সহকারীকে সত্যটা বলে দিবে? যদিও নোমান বিবাহিত, হয়ত বিষয়টা বুঝতে পারবে, কিন্তু একটা প্রেস্টিজের ব্যাপার-স্যাপার আছে। মাহতিম স্টিয়ারিং থেকে হাত না-সরিয়ে রাখ-ঢাক ভঙ্গীতে বলল,

– কেসটা পার্সনাল। আই মিন তোমার হেল্প লাগতে পারে।

নোমান আরো উদগ্রীব হয়ে বসের দিকে ফিরল। বসকে এক কাঠি বেশি নিশ্চয়তা দিয়ে বলল,

– আপনি শুধু মুখ দিয়ে বলুন স্যার। মনে করবেন কাজ শেষ। আপনি কি নিয়ে হেল্প চান খুলে বলুন। এই নোমান আপনার এক হুকুমে রাজি।

নোমানের বাড়াবাড়ি রকমের আদিখ্যেতা দেখে নিশ্চিত হল মাহতিম। ব্যাপারটা পুরোপুরি না ভেঙে হালকা একটু জানাল,

– তোমার ম্যাম নরমাল বিহেভ করছে না। কিছু বললে একটা অলস-অলস ভাব দেখায়। আগে যেমন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চাপ দিলে কথা শুনত, এখন জাস্ট স্কিপ! মানে কথাই শোনে না। আমার কাছে জিনিসটা এ্যাব-নরlমাlল লাগছে। তুমি কি কিছু আইডিয়া করতে পারো? তোমারও তো ওয়াইফ আছে। সে কি এমন কিছু করে?

নোমান কিছুক্ষণ ভাবল। কথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে আবার বসের দিকে চাইল। ভাবনা শেষে আক্ষেপের সুরে বলল,

– সুমাইয়া তো আজীবনই অলস। কিছু বললে এক কান দিয়ে ঢুকায়, আরেক কান দিয়ে বের করে। ম্যামের সাথে তুলনা দিলে সুমাইয়া তো খাঁটি এ্যাবlনরlমাlল। আমার একটা কথাও শুনে না।

গাঁlজাখুlরি মার্কা উত্তর শুনে হাসতেও পারছে না মাহতিম। ওকে সিরিয়াস কেস নিয়ে প্রশ্ন করা হল, ও কি না বউকে এ্যাবনরমাল বানিয়ে ছাড়ল। মাহতিম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসি আঁটকাচ্ছে। যদি এই কথাটা সুমাইয়া শোনে? আজ নোমানের রক্ষে নেই। বসকে নির‍্যুত্তর দেখে ভড়কে খেল নোমান। সে কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল,

– স্যার? আপনি কিছু বললেন না যে?

মাহতিম নিজেকে কন্ট্রোল করে স্বাভাবিক ফর্মে ফিরল। নোমানের দিকে বাঁ ভ্রুঁ উঁচিয়ে মশকারির স্টাইলে বলল,

– তোমার বউ রেগে গেলে কি করে নোমান? রাগটা কিভাবে ঝাlড়ে?

নোমান দুঃখের সাথে চোখ নিচু করল। ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছেড়ে আবারও বসের পানে চোখ তুলল,

– স্যার, বিষয়টা খুবই সেন্সেটিভ। তবুও বলছি। আজ ছোট মুখে পরামর্শ দিব। ভুল কিছু বললে মাফ করবেন। মহিলা মানুষের ভুল ধরতে নেই। তরকারিতে নুন বেশি হলেও গিলবেন। ডালে চুল দেখলেও ‘ মজা, মজা ‘ বলে খাবেন। কিন্তু খবরদার! মনের ভুলেও ওদের দোষ ধরতে যাবেন না। যদি ধরেন, তাহলে ওইদিন আপনার সর্বনাlশ! আপনার উপর দিয়ে কালবৈশাখি ঝড় বইবে। বিছানায় শোবেন, হাউকাউ করে আপনার কান ধুlয়ে দিবে। বাথরুমে যাবেন, আপনার জন্য বালতি ভর্তি কাপড় ভিজাবে। শার্ট পরতে যাবেন, একটাও ইস্ত্রি করা পাবেন না। আর রান্নাবান্না তো বাদই দিলাম। খেতে বসবেন, প্লেট-গ্লাস আছাড় মে:রে-মে:রে টেবিলে রাখবে। খুবই ভয়াবহ দৃশ্য স্যার। আমার ম্যাম খুবই ভালো মানুষ। উনার মতো সোনার মেয়ে হয় না। আপনি ম্যামের সাথে এক প্লেট ফুচকা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন, দেখবেন ম্যাম সব ফড়ফড় করে বলে দিচ্ছে। উনি মাটির মানুষ। মাটির মানুষের সাথে সিমেন্টের তুলনা হয় না।

স্টিয়ারিংয়ে থাকা হাতটা হাসির দমকে কাঁপছে। মাহতিম নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। ফুচকার কথাগুলো অবশ্য মানা যায়, কিন্তু বেচারার কষ্ট বলার নমুনা শুনে হাসি থামানো দুষ্কর। হঠাৎ হাসতে গিয়ে কিছু একটা খেয়াল হল তার। আচানক হাসি থামিয়ে স্থির হলো সে। মেহনূর তার কাছে আদর চায় না। ও আগের মতো…. বুকটা ধড়াস করে উঠলো! ধ্বক-ধ্বক করে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে যাচ্ছে। সে যেটা ভাবছে সেটা কি সত্যি? তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিল মাহতিম। নোমান এরই মধ্যে ‘ কি হয়েছে স্যার? কিছু খুঁজছেন? ‘ বলে প্রশ্ন করলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মাহতিম হুলস্থুল ভঙ্গীতে কল দিয়ে বসেছে। খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করছে। বেচইন অবস্থায় তৃষ্ণা পেয়ে যাচ্ছে। ফোনটা রিং হচ্ছে, কল যাচ্ছে, কিন্তু ধরছে না। কোথায় গেছে? মাহতিম তীব্র মনে আকুলিবিকুল করছে, ‘ মেহনূর ফোনটা ধরো।ফোনটা ধরো! ‘ প্রচণ্ড অস্থিরতায় ডান পা-টা ‘ঠকঠক’ করে কাঁপাচ্ছে। একেকটি টিউন যাচ্ছে, ততটাই উতলা হচ্ছে সে। সীটে গা হেলিয়ে চোখ বুজে ফেলেছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো। পরিচিত কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলল,

– হ্যালো, আসসালামুয়ালাইকুম।

মাহতিম ঝট করে সীট থেকে সোজা হয়ে বসলো। সালামটা ফিরিয়ে তড়িঘড়ি কণ্ঠে বলল,

– মেহনূর শুনছ?

মেহনূর প্রত্যুত্তরে বলল,

– জ্বী, শুনছি। কোথায় আছেন? আপনি বাসায় আসবেন না? ফারিনের বৌভাত। ও আপনাকে খুঁজছে। যেখানেই থাকুন, একটু জলদি আসুন না।

মাহতিম কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।আঁটকে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুকনি এখনো কমেনি। প্রচণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। যদি ঘটনা সত্যি হয়? যদি মেহনূর সত্যি-সত্যিই — . মাহতিম চোখ বন্ধ করলো, বুকে শ্বাস টেনে নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করে মোলায়েম সুরে বলল,

– মেহনূর, তুমি কি প্রেগন্যান্ট?

নোমান চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলেছে। দারুণ বিস্ময়ে অবাক হতে গিয়ে শেষমেশ খুশি হলো সে। এটাই যেন সত্যি হোক, এটাই রটে যাক! নোমান ভেতরে-ভেতরে খুশিতে ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মারজা ম্যামকে ফোন দিয়ে জানাতে! মাহতিম উৎকণ্ঠার সাথে ঢোক গিলে যাচ্ছে। তার কানদুটো সুখকর সত্যগুলো শুনতে চাচ্ছে। মেহনূর বলুক না! আর কতো অপেক্ষা? ডান কানে ফোনটা ধরা। মেহনূর চুপ করে আছে। কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে। নিশ্চয়ই ছোট্ট মুখটা টুকটুকে হয়ে গেছে। মাহতিম ধৈর্য্য রাখতে পারল না, চোখ বন্ধ অবস্থায় ব্যগ্র সুরে বলল,

– ও মেহনূর? শুনছ? তুমি কি প্রেগন্যান্ট?

মেহনূর চুপ করে আছে। মানুষটা যদি সামনে থাকত, তার মুখটা ধরে চোখে চোখ রেখে মিষ্টি করে হাসত। তার বুকটার মধ্যে মাথা রেখে শরীরটা জড়িয়ে ধরত। হৃদস্পন্দনের মাঝে ডুবে গিয়ে আস্তে করে জানাতো, ‘ হ্যাঁ, সত্যি। ‘ ওইসময় মাহতিমের মুখটা কেমন হত? খুশিতে কেমন করতেন? তার উজ্জ্বল মুখখানা কেমন হাসিতে ঝলমল করত? মেহনূর মনের কোণে একমাত্র মুখটা কল্পনা করে যাচ্ছে। কি দারুণ একটা হাসি দিয়েছে, এই হাসি যেন অমায়িক সুন্দর। তার ঠোঁটে লেগে থাকা আনন্দটুকু মেহনূর গভীরভাবে টের পাচ্ছে। তার বুকের ভেতরটা শান্তির প্রদীপে আলোকিত হচ্ছে। খুব অস্থির অনুভব করছে মেহনূর। মানুষটার মুখোমুখি কি করে হবে? আজকের পর থেকে আলাদা ভাবে দেখবে? যেই অপেক্ষার জন্য মাঝে-মাঝে পেটে হাত রাখত, সে কি আজও বুলিয়ে দিবে?

ওপাশ থেকে ‘ টুট টুট টুট ‘ শব্দ শোনা যাচ্ছে। মেহনূর কলটা কেটে দিয়েছে। কান থেকে ফোন নামাতেই সেকেন্ডের ভেতর টুংটাং করে ম্যাসেজ চলে আসলো। মাহতিম হাসি দিয়ে দিতে গিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে বসলো। তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।

‘ 3rd month cholche. ‘

মোবাইলটা ঠোঁটে রেখে চুমু খেল সে। লেখাটার উপর পরপর দুটো চুমু বসালো। মাহতিম চোখজোড়া আর খুললোই না। মোবাইলটা ঠোঁট থেকে নামালো না। সবার প্রথম যেই মাসুম চেহারাটা চোখে ভাসলো, যাকে নবজাতক হিসেবে প্রথম কোলে তুলেছিল, তাকে প্রতিটি কথা প্রতিটি অক্ষর উদ্দেশ্য করে মনে-মনে বলল,

ভেবেছি আমার ছেলে হলে তোর নামটাই দিব। কিন্তু দিলেও আমি দুঃখ পাব। আমার ছেলের নাম ধরে যতবার ডাকব, আমার চোখে শুধু তোর ছবিটাই ভাসবে। মানুষ আমার কথা শুনলে খুব হাসবে। আমার উপর ‘ ব্যাটা মানুষের ‘ ট্যাগ লাগানো বলে কথা। মানুষের ধারণা, ব্যাটা মানুষ পাথরের মতো। পাথর সহজে ভাঙে না। তোর বউটা আমাকে সব দিলো মাহদি। দ্যাখ, আমার জীবনে কি ফিরিয়ে দিল। তুই ভালো থাকিস ভাই। তোকে কোনোদিন ভুলব না।

মাহতিম পান্ঞ্জাবীর পকেটে দিল। অক্ষত চিরকুটটা আস্তে করে খুলতেই নীরব হয়ে গেল। লেখাটা অজস্রবার পড়লো, বারংবার পড়লো। টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু চিরকুটে পরেও গেল।

‘ আমার মধ্যে ছোট্ট একজন বেড়ে উঠছে। ধীরে-ধীরে ছোট-ছোট হাত-পা নিয়ে বড় হবে। ক’দিন পর আপনি তাকে ছুঁতে পারবেন আনসারী সাহেব। আপনি কি খুশি? ‘

.

বৌভাত উপলক্ষে ফারিন ও তৌফ বাড়ি এসেছে। সঙ্গে এসেছে অতিথি। সন্ধ্যা এখন সাতটা। আনসারী নিবাসের লন সাইডে ছোট্ট করে লাইটিং করে সাজানো। খোশগল্পের জন্য মানুষ সেখানে ব্যস্ত। মেহনূর শরীরের কথা চিন্তা না করে এটা-ওটা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দূর থেকে সেটাই শানাজ কটমট চোখে দেখছে। যদি আল্লাহ্ না করুক! ভুলে যদি পা পিছলে যায়? এই সময়টা একটু দেখে-শুনে চলতে হয়, কিন্তু মেহনূরটা আমলে নিচ্ছে না। আজ ভাইয়া ফিরুক খালি, শানাজ সব বলে দিবে। কোনো ওয়াদা-টোওয়া শুনবে না। যেখানে স্বাস্থ্যের কথা চলে আসবে, সেখানে এক চুল দেরি না। শানাজ প্রথমেই ভাবলো মারজার কাছে যাবে, চিন্তাটা আঁটসাঁট করে ভাবতেই বিকট শব্দে গাড়ি ঢোকার শব্দ হলো। শানাজ মুখ ফিরিয়ে গেটটার দিকে চাইতেই মুখে প্রসন্ন সূচকে হাসি ফুটে উঠলো। ফারিন শব্দ শুনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো। মুচকি হাসি দিয়ে তৌফের উদ্দেশ্যে বলল,

– ওইতো ভাইয়া এসে গেছে। তৌফ ভাই নিচে চলো। এ্যাই উঠো! তুমি না ভাইকে বাংlলা ওয়াlশ দিবে? চলো, চলো। এক্ষুণি চলো। আরে উঠো না বাবা! ঘোlড়াlর মতো শুয়ে আছ কেন?

ফোনে কথা বলছিল তৌফ। ফারিনের মুখে ‘ ভাই ‘ ডাক শুনে ভ্রুঁ দুটো এক করলো। কলটা কেটে দিয়ে খিঁচড়ানো মেজাজে বলল,

– কি বললি আবার বলতো?

ফারিন তৎক্ষণাৎ জিভে কামড় বসালো। অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বলল,

– ভাই বলেছি? ভু-ভুলে বলেছি ভুলে, সরি। আর বলব না তৌফ মিয়া। সত্যি কথা, আর বলব না। আসো এখন। ভাইয়ার সাথে দেখা করে আসি।
.

গাড়িটা ঢুকতে দেখে মেহনূর তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেছে। অন্য কাজের বাহানা দিয়ে রান্নাঘরে এসেছে। মাহতিমের সামনেই যাবে না সে। একদিকে লজ্জা, অন্যদিকে জেদ। কথাটা সে কালই জানত, শুধু-শুধু একটা দিন অপেক্ষা করলো। কাল কেন উধাও হল? এগুলো কেমন স্বভাব? এখনো যদি উধাও-উধাও খেলে তাহলে কি সহ্য হবে? মেহনূর কি আর একা আছে? পেটের জনকে নিয়ে সংখ্যা দুই জন হয়েছে। এখনো যদি তার সাথে অমানবিক আচরণ করে, মেহনূর চরম ভাবে কথা শোনাবে। এসব আবোলতাবোল চিন্তা নিয়ে মেহনূর যখন ভাবছিল, তখন রান্নাঘরে মারজার আগমন হলো। তিনি সুন্দর করে জানালেন, দুই কাপ চা বানিয়ে অতিথিকে দেওয়ার জন্য। মেহনূর সেই মতো আপ্যয়ন করতে গেলে হঠাৎ নীতি এসে হাজির। চিন্তিত মুখে কাঁদো-কাঁদো চেহারায় বলল,

– আমার রিং খুঁজে পাচ্ছি না ভাবী। পিউর গোল্ডের রিংটা হারিয়ে গেল। প্লিজ ভাবী একটু খুঁজে দাও না? খোঁজাখুঁজির ম্যাটারে তোমার লাক ভালো। যা-ই খুঁজো পেয়ে যাও। প্লিজ আমাকে রক্ষা করো। ওটা না-পেলে আম্মু খুব ঝাড়বে!

মেহনূর একটুক্ষণ ভেবে আংটি খুঁজতে রাজী হলো। চায়ের ট্রে-টা ওকে ধরিয়ে সে খুঁজতে-খুঁজতে বেরিয়ে গেল। নীতির ভাষ্যমতে, আংটিটা গ্যারেজের কাছাকাছি পরেছে। মেহনূর ভেবেই পাচ্ছে না নীতি গ্যারেজে কেন গেছে। তবুও বেচারীর জিনিস খুঁজতে গিয়ে গ্যারাজের কাছে চলে গেল। গ্যারাজটা নিরিবিলি, এদিকটায় কেউ নেই। গ্যারেজের আলোতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, ততটুকুই করছে মেহনূর। এখানে চমৎকার ঘাস হয়েছে। সবুজে-সবুজে মাটি ঢেকে সুন্দর দেখাচ্ছে। মেহনূর ঘাসের ফাঁকে-ফাঁকে দৃষ্টি ঘুরাতেই হঠাৎ পেছন থেকে খসখস শব্দ হলো। মেহনূর কানের পিছনে চুল গুঁজতে গিয়ে যেই মুখ ঘুরাতে নিবে, ওমনেই পেছন থেকে একজোড়া হাত শূন্যে তোলে ফেলল। মেহনূরকে একটুও নড়াচড়ার সুযোগ না-দিয়ে সবার আড়ালে বাড়িতে প্রবেশ করল। সিঁড়ি ভেঙে নিজের রুমটায় ফিরে দরজাটা চাপিয়ে দিল সে। এটুকু সময় তার একান্ত, এখানে অন্যের হস্তক্ষেপ চাইবে না সে। দুহাতের মধ্যে কুড়িয়ে নেওয়া মেহনূরকে বিছানায় শুইয়ে দিল। বিছানার ধার ঘেঁষে ফ্লোরে বসলো মাহতিম। মেহনূরের দিকে নির্মল দৃষ্টি মেলে বলল,

– আমায় কেন বললে না?

মেহনূর উত্তর দিলো না। তাঁর ডান হাতটা টেনে নিজের গালে চেপে রাখল। কিছু সময় অপেক্ষা করে বলল,

– আপনার জন্মদিনে জানাতাম, তাই গোপন রেখেছি।

মাহতিম হাসতে গিয়ে উদাসী চোখে চাইলো। ওর নরম তুলতুলে গালটা ছুঁয়ে মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে বলল,

– আমার কোনো জন্মদিন নেই। আমি এগুলো মানিনা।

মেহনূর ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। কাজটা কি খারাপ করেছে? মাহতিম ওকে চমকে গিয়ে অদ্ভুত কান্ড করলো। শাড়ির নিচে হাত গলিয়ে পেটটার উপর হাত রাখলো। আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে নম্র সুরে বলল,

– আমাদের প্রথম সন্তান তাই না?

সহজ স্বীকারোক্তি দেখে মেহনূর অশ্রুসিক্ত হল। তাদের প্রথম সন্তান। তাদের নিখাদ ভালোবাসার চিহ্ন। দুজনের কাছ থেকে একটু-একটু করে তাদের ছোট্ট সোনাটা আসবে। মেহনূর পরম আবেশে পেটের উপর শক্ত হাতটা চেপে ধরে। অপরিমেয় সুখের কাছে নতজানু হয়ে শুধায়,

– আপনি খুশি?

মাহতিম প্রচণ্ড বিহ্বল হয়ে মেহনূরকে জাপটে ধরলো। সে বলতেও পারছে না কতটা খুশি সে! কতটা আনন্দে প্রাণ চন্ঞ্চল হচ্ছে! তার প্রথম সন্তান। তার শরীরের অংশ, তার রক্ত, তার চিহ্ন। ভাবতেই-ভাবতে প্রচণ্ড শিহরণ অনুভব করল। দাঁতজোড়া শক্ত করে কঠোর হল সে। মেহনূরকে আরো কঠোরভাবে আবদ্ধ করলো। মাহদির পর এটাই হবে তার সবচাইতে কাছের ব্যক্তি। তাকে ‘ বাবা ‘ ডাকা মানুষ। গভীর থেকে গভীর অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছিল মাহতিম। তাকে কেউ আদুরে কণ্ঠে ‘ বাবা ‘ ডাকবে, ছোট-ছোট হাতে তর্জনী ধরবে। টলমল করে দু’চোখের কার্নিশ ভিজে যাচ্ছে। বিহ্বল সুখে গা ভিজিয়ে মাহতিম শান্ত হলো। খুব কষ্টে ঢোক গিলে প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে বলল,

– আমার আত্মাটা ঠান্ডা হয়ে গেছে মেহনূর। আমি বোঝাতে পারব না বাবা হওয়ার অনুভূতিটা কত সুখের! আমার শরীরে ঠান্ডা কিছু বয়ে যাচ্ছে। আমি বোঝাতে পারব না কতটা খুশি। আমি কিছুতেই পারব না মেহনূর…

জীবনের অক্লান্ত ধারায় সময়গুলো পেরিয়ে যায়। কখনো সুখ এসে পুলকিত করে, কখনো দুঃখ এসে ভেঙে যায়। কিছু মানুষ এসে যুক্ত হয়, কিছু মানুষ এসে হারিয়ে যায়। বদ্ধ নিরালায় থাকতে-থাকতে কেউ মlরে যায়, কেউ খোলামেলা আকাশ পেয়ে বেঁচে যায়। জীবনের নিয়ম বোধহয় এমনই। কখনো সুখ, কখনো দুঃখ। কখনো হাসি, কখনো কান্না। তবুও আমরা শেষটার জন্য মরিয়া। যেন শেষের ছন্দটুকু পূর্ণ হোক। গর্ভকালীন পুরোটা সময় কাটিয়ে আজ মেহনূর হাসপাতালে। ডেলিভারি রুমটায় শুয়ে আছে। পাশেই ছোট্ট একটা টুলে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে লোকটা। একদিন এই লোকটাকে ‘ অস:ভ্য ‘ বলে ডেকেছিল। মানুষটা কোনোদিনই অস:ভ্য ছিল না। বরং, পরিস্থিতি তাকে অস:ভ্য চেহারায় দেখিয়েছে। মেহনূরকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে দেখে কোমল সুরে বলে,

– ভয় লাগছে?

মেহনূর প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছে। চোখের কোণ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। প্রসববেদনায় তার শরীরটা ভেঙে আসছে। তবুও তার চোখের কাছে প্রসন্ন হাসি ছুঁড়ে বলল,

– না। আপনার বাlঘিlনী ভয় পায় না।

একপলকের জন্য থমকে গেল মাহতিম। এইতো আর কিছু সময়। তারপরই জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দে অভিসিক্ত হবে। তার কোলের মধ্যে ছোট্ট কেউ ঘুমিয়ে থাকবে। ছোট-ছোট লালচে নরম আঙুলে চুমু খাবে। মাহতিম মুখ নামিয়ে মেহনূরের কপালটায় আদর ছুঁয়ে দিল। ফোলা পেটটায় আরেকবার হাত বুলিয়ে বলল,

– এখন উঠি ঠিক আছে? দ্রুত আমার মেয়ে-সহ চলে আসো। তোমাদের দুজনকে আমি বুকে রেখে দিবে। তোমাকে যেভাবে রেখেছিলাম, আমার মেয়েকে তার চেয়ে বেশি গুণ রাখব। তুমি শুধু সুস্থ ভাবে চলে এসো। আমি আর কিছু চাইব না।

প্রlসlববেদlনায় মুখটা লাল হয়ে আসছে। কি পরিমাণ ব্যlথা হচ্ছে মেহনূর বলতে পারবে না। শরীরের নিম্ন ভাগ যেন ছিঁlড়ে যাচ্ছে। মাহতিম ভিজিট শেষ করতেই ডাক্তার দুজন প্রবেশ করল। যদিও নরমাল ডেলিভারির জন্য কথা বলা আছে, কিন্তু বিপদের কথা বলা যায় না। পুরো ফ্লোর জুড়ে মারজা-তৌফ-নীতিরা। কেউ বাদ যায়নি। মেহনূরের কথা শুনতে পেয়ে চলে এসেছে সবাই। বন্ধুর এই সময়টুকুতে আবারও হাজির হয়েছে সৌভিক। সিয়াম ও তৌফ ইনিয়ে-বিনিয়ে মজা চালিয়ে পরিবেশ গরম করছে। মাহতিম আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক যুগ আগে একই কায়দায় চিন্তিত ছিল। সেদিন দুশ্চিন্তায় ছিল মা ও ভাইয়ের জন্য; আজ চিন্তিত বউ ও মেয়ের জন্য। সময় যেন কাটছেই না। অস্থির ভাবে পায়চারী করতেই সারি বদ্ধ চেয়ারে বসলো। কিন্তু স্বস্তি পেল না। আবার উঠে দাঁড়াল। বন্ধ দরজার দিকে চিন্তিত মুখে তাকাল। মনে-মনে দুয়া করে যাচ্ছে মাহতিম। তার দুটো মানুষ যেন সুস্থ-সবল চলে আসুক। তার মেহনূর, তার মেয়ে, তার দুটো প্রাণ যেন সুস্থ থাকুক। মেহনূরের কাল রাত থেকে ব্যথা উঠেছে, সেই কখন থেকে ব্যথাটা সহ্য করেছে, আর যেন কষ্ট না পাক। মাহতিম মায়ের দিকে চাইল, দৃষ্টি ঘুরিয়ে সকলের দিকেই এক-এক করে দেখতে লাগল। সবাই চিন্তিত। সময়ের পাল্লা আরো ক’ঘন্টা অতিক্রম হলো। সবার চিন্তাকে নস্যাৎ করে উপস্থিত হল সময়। অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণটি তিরতির করে চলে আসলো। দরজার ভেতর থেকে নবজাতকের কান্নার সুরে ভেসে এলো। সবাই একসঙ্গে দরজার দিকে দৃষ্টি তাকাল। নবজাতকের কান্নাটা জানান দিয়ে যাচ্ছে, সে এসে গেছে। মায়ের গর্ভ ছেড়ে পৃথিবীর আলো দেখেছে। মারজা ওড়নার নিচে দুটো মোনাজাত ভঙ্গীতে করলেন। সকলের দৃষ্টি বাঁচিয়ে তিনি দু’ফোঁটা অশ্রু ছেড়ে শোকর গোজার করলেন। কিছুক্ষণের ভেতর দরজা খুলে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। ভদ্রমহিলা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে সকলের সামনে এনে বললেন,

– মা ও মেয়ে দুজনই সুস্থ। চিন্তার কারণ নেই। আনসারী সাহেব, নিন। আপনার স্ত্রী বারবার বলেছেন, আপনার হাতে যেন সুস্থ মেয়েকে তুলে দেই। আপনার স্ত্রী এখন ঘুমিয়ে আছেন। উনাকে বিরক্ত করা যাবে না।

কাপড়ে মোড়া ছোট্ট প্রাণকে কোলে নিল মাহতিম। আবারও সেই পুরোনো দিনের মতো দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। এমনই করে একদিন ছোট্ট মাহদিকে কোলে নিয়েছিল। এইটুকুনি মুখ, ঘুমন্ত চোখ, লাল টকটকে ঠোঁট। দুটো ক্ষুদ্র হাত নরম-নরম আঙুলে মুঠো করে আছে। এই হাতেই একদিন মাহদিকে ধরেছিল, আজ সেখানে নিজের মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। মায়া ভরা মুখটার দিকে চেয়ে মাহতিম পরিতৃপ্তির হাসি দিল। কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে ঘুমন্ত মুখে চেয়ে বলল,

– তুমি আমার মেহসানা আনসারী।

মাহতিম সবার সামনে অশ্রু ছেড়ে দিল। আজ কেন জানি নিজেকে আঁটকাতে পারল না। তার বুকটার কাছে ছোট্ট প্রাণটা ক্ষণেক্ষণে পুরোনো দিনগুলোকে তাজা করে দিচ্ছে। ঠিক একইভাবে সেই মানুষটার নামকরণ করেছিল সে, যেভাবে প্রাণের শিশুকে আজ করেছে। মাহতিমকে চর্তুদিক থেকে ঘিরে ধরলো সবাই। সৌভিক-নীতিদের মতো বন্ধু-কাজিনের শক্ত প্রাচীরের বলয়টা জড়িয়ে ধরলো। সবাই যেন একই সুরে একই আমোদে বলল,

– এবার কিন্তু ট্যূর চাই!!

.

প্রিয় মাহদি, তুমি এই উপন্যাসের ছোট্ট চরিত্রে ছিলে। তোমার ভাই ক্ষণেক্ষণে তোমাকে স্মৃতির আদলে মূখ্য বানিয়ে দিয়েছে। তোমার মত অনেক আপনজন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় হুট করে চলে যায়। আর কখনো তাদের ফিরে পাওয়া হয় না। তাদের কোনোদিন বলাও হয় না, আমরা তাদের কতটা ভালোবাসি। তারা কোনোদিন জানতেও পারে না, এই পৃথিবীর বুকে অনেক স্নেহ-ভালোবাসা তাদের জন্য জমা ছিল। দিনশেষে আমরা তাদের হারিয়ে ফেলি। কথাগুলো আমাদের বুকে রয়ে যায়।

—– সমাপ্ত .

#FABIYAH_MOMO .