#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ ০১ .
ফ্লোরের উপর আছাড় দেওয়া ফোনটা পরে আছে! প্রচণ্ড রাগে মুখের চামড়া লাল দেখাচ্ছে। কপালের ক্ষত জায়গার কাছে নীল রগগুলো ফুলে উঠেছে। রাগের এমন ভয়াবহ আক্রোশ আগে দেখেনি কেউ। শান্তভাবে বিছানায় বসে থাকলেও মুখটা কাঠ-কাঠ ভাবে গম্ভীর। দরজার সরু ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটুকু দেখতেই অজান্তে ঢোক গিললো ফারিন। অবাকে চোখদুটো বড়-বড় করে পাশে থাকা তৌফের দিকে তাকালো। তৌফও দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফারিনের দিকে তাকালে ফিসফিস করে বললো ফারিন,
– এটা রেড সাইরেন তৌফ ভাই! আমার ভয় লাগছে! আমি শিওর খারাপ কিছু হয়েছে। ভাইয়ার এমন চুপ মানেই বিপদ। সবাইকে ডাকো, প্লিজ সবাইকে ডাকো।
তৌফ ভেতরে-ভেতর ভয় পেলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। বাড়িতে বিয়ের আমেজটা পণ্ড হোক, এমন মূর্খতা করা যাবে না। দ্রুত কিছু বুদ্ধি এঁটে গলা নামিয়ে বললো,
– তুই এখুনি নিচে যাবি। যেয়ে চুপচাপ সিয়ামকে ডেকে আনবি। আগেভাগে কিচ্ছু বলতে যাবি না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নীতির রুমে দেখা কর। তাড়াতাড়ি যা! দৌঁড় দে!
দেরি করলো না ফারিন। দু’হাতে লেহেঙ্গা ধরে একদৌঁড়ে সিয়ামের উদ্দেশ্যে ছুটলো। তৌফ সেখান থেকে দ্রুততার সাথে নীতির রুমে ঢুকে পরলো। আয়নার সামনে রঙিন বুরুশে ব্লাশার দিচ্ছিলো নীতি, তৌফকে চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় ঢুকতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। আয়নায় দৃষ্টি রেখে বললো,
– ব্যাপারটা কি? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?তৌফ ভাই, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না?
চিন্তায় বিভোর তৌফ হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে পেলো। চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকাতেই নীতির উদ্দেশ্যে বললো,
– মেবি ঝামেলা হইছে। মাহতিমের এক্সপ্রেশান নরমাল ছিলো না। তুই ভাবতে পারোস, ও নিজের ফোন আছাড় দিছে! আমি সিয়ামরে ডাকার জন্য ফারিনরে নিচে পাঠাইছি। গণ্ডগোল হইছে নীতি, পিঠ-পিছে বিরাট গণ্ডগোল হইছে!
বুকটা ধ্বক করে উঠলো নীতির। ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো সে, হাতের বুরুশটা ফসকে ফেস প্যালেটের উপর শব্দ করে পরলো। নীতি চাপা মুখে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– তুমি খুব ভয় দেখাচ্ছো তৌফ ভাই। এমন ভয় দেখিও না।
তৌফ হঠাৎ তেঁতে উঠলো। মারমুখি আচরণের মতো চিৎকার দিয়ে বললো,
– তোর কি আমার কন্ঠ রিল্যাক্স মনে হইতাছে? টেনশনে শা:লা শেষ হইয়া যাইতাছি, এইদিকে তুই মশকারি লাগাইছোস!
নীতি অপ্রতিভ অবস্থায় নিভলো। কথা বাড়িয়ে কুরুক্ষেত্র ডাকার দরকার নেই। ততক্ষণে সিয়ামকে নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকলো ফারিন। দরজাটা লাগিয়ে চার মাথা একত্র হলো। গোল করে বিছানায় বসতেই সিয়াম প্রথম বললো,
– ঘটনা কি? ফারিন তো কুত্তার মতো আমারে টানতে-টানতে আনলো। কাহিনী জিগাই, কিছুই বললো না।
সিয়ামকে থামিয়ে দিয়ে তৌফ বলে উঠলো,
– সৌভিকরা আসছে?
সিয়াম যেই উত্তর দিবে, তখনই পাশ থেকে ফারিন বলে উঠলো,
– না, রাস্তায়। জ্যামে আঁটকে গেছে।
বুকভরা নিশ্বাস নিলো তৌফ। একে-একে সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললো,
– মাহতিম একটু আগে মোবাইল আছাড় দিছে। কি কারণে দিছে জানি না।
সিয়াম উজবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– কি বলোস? হুর, বিশ্বাস হয়না! সকালেই ভাবীর সাথে বান্দরামি করতে দেখছি। সেকেন্ডের মধ্যে আরেক চেহারা দেখাইবো ক্যান?
তৌফের ইচ্ছে করলো কষে একটা চড় লাগাতে! এমন বোকার মতো কথা শুনে প্রচণ্ড খ্যাঁকিয়ে উঠলো তৌফ,
– ওরে আবা:ল! মানুষ কি সেকেন্ডে-সেকেন্ডে চেন্ঞ্জ হয় না? এমন হাবলার মতো কথা বলতাছোস ক্যান? তুই নিজেও জানোস মাহতিম হুদাই রাগ দেখাইতে যাইবো না। আমার তো মনে হইতাছে —
কথার মাঝখানে দাঁড়ি বসিয়ে চমক কাটলো নীতি,
– অনামিকার জন্য?
বিরক্তি নিয়ে নীতির দিকে তাকালো তৌফ। ডানহাত উঠিয়ে নীতির মাথায় জোরে এক ঘা মারলো। ব্যথায় নীতি আর্তনাদ করে উঠলে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো তৌফ,
– গালে মাখ্খন লাগাইছোস দেইখা থাপ্পড়টা দিলাম না। আমার পুরা কথা শেষ হইতে দিস। ওই জাউরার কথা স্মরণ না কইরা আমার কথা চুপচাপ শোন্!
তৌফের দিকে গরম চোখে তাকালো নীতি। তন্মধ্যে নীতির পক্ষে সাড়া দিয়ে ঝাড়ি মারলো ফারিন,
– তুমি আপুকে শুধু শুধু মারলে কেনো? তোমার হাতটা অযথা কারণে কেনো উঠাও? কারোর মাথায় যে হিট করা নিষেধ এই কমনসেন্স নেই?
সিয়াম পরিস্থিতিটা সামাল দিলো। আড়ালে তৌফের দিকে কনুই গুঁতা দিয়ে ঠান্ডা থাকার ইশারা করলো, ফারিনের উদ্দেশ্য স্বাভাবিক ভাবে বললো,
– প্লিজ, নিজেদের মধ্যে এরকম করিস না। সিচুয়েশনটা কোন্ ফেজে আছে ওইটা বুঝতে দে। তৌফ তুই শুরু কর্।
তৌফ ক্রুদ্ধ ভারি নিশ্বাস ছেড়ে হালকা হয়ে বললো,
– আমি শিওর মাহতিম ফোনে কথা বলছে। ফোনে এমন কিছু শুনছে যেটার জন্য রাগ সামলাইতে পারেনাই। ভোরে ওর নামে কুরিয়ার আসছে। পাক্কা একটা ছোটখাট বক্সের মতোন প্যাকেট। ওই প্যাকেটে কি আসছে আমি জগিংয়ের সময় জিগাইছিলাম। মাহতিম এদিকেও লজিক্যালি টপিকটা স্কিপ করছে। বলছে ভাবীর জন্য নাকি সারপ্রাইজ অর্ডার দিছিলো, ওটা কুরিয়ারে আসছে। অথচ তোরা বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা, আমি কিচেনে যখন হুদাই ভাবীরে মশকারির জন্য জিগাইলাম, ভাবী বললো মাহতিম নাকি রুমে কোনো পার্সেলই আনে নাই। এখন প্রশ্ন হইলো, মাহতিম আসলে কি লুকাইতেছে?
সবাই মন দিয়ে পুরো কথাটা শুনলো। তৌফের কথায় গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। কিন্তু সামান্য একটু খটকা লাগলে প্রশ্ন করলো সিয়াম,
– কিন্তু দোস্ত এদিকে আরেকটা ব্যাপার আছে। যদি ওই পার্সেলটা ভাবীর জন্যই হয়, তাহলে তো চিন্তার কিছু নাই। হয়তো ভাবীরে অন্য বাবে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য মাহতিম ওটা রুমে আনেনি।
সিয়ামের কথা যুক্তি পেয়ে সম্মতি দিলো নীতি,
– কথাটা ভুল বলোনি সিয়াম ভাই। ভাবীকে ইউনিক স্টাইলে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য অন্য কিছুও প্ল্যান থাকতে পারে। কি পারে না?
তৌফ দুজনের কথাকেই সমর্থন করলো। কিন্তু সুক্ষ্ম ফাঁকটা সবার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, সেটাই তৌফ ভালোভাবে বুঝিয়ে বললো,
– তোদের দুজনের কথাই ঠিক। দুইটার কথাই আমি মানলাম। কিন্তু একটা জিনিস চিন্তা কর্, যেই মানুষটা সকালেও ঠিক ছিলো, দুপুরেও ঠিক ছিলো, ওই মানুষ সন্ধ্যার টাইমে রাগের চোটে চুপ হইবো ক্যান? কোনো উত্তর আছে? জানি আমার কথা শুইনা আগা-মাথা কিছু বুঝতাছোস না। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাছি। আমি জানি ওই পার্সেলটা নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধছে। সবকিছুর পিছে ওই পার্সেলটাই আছে, সময়মতো আমার কথাটা মিলায়া নিস।
দুটো মিনিট পুরো নিঃশব্দ অবস্থা চললো। কারো মুখে শব্দ নেই। চারজনের নজর বিছানার ফ্লোরাল ডিজাইনে আঁটকে আছে। একটা সময় ছিলো, যখন নয় মাথা একত্র হয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ করতো। যেকোনো মুশকিল মূহুর্তে উপায় খুঁজে ফেলতো। আজ সেই সংখ্যাটা কমে এসে চারে দাঁড়িয়েছে। দলের সবচেয়ে চন্ঞ্চল সদস্যটা পাকা-পাকা বুদ্ধি মিলানোর জন্য আর নেই। সবার বুকের ভেতরটা যেনো একইসঙ্গে হাহাকার করে উঠলো। একসাথে ভারি নিশ্বাসটা চারটা বুক থেকে বেরুলো। অনেকক্ষণ পর নিচে থেকে হৈচৈ শুরু হলো। ওরা চারজন বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই সৌভিকরা এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দুপক্ষের আংটি বদল হবে। ঠিক পন্ঞ্চম দিনে ঢাক-ঢোলের সাথে সৌভিকের বিয়ে হচ্ছে। নিরবতার রুদ্ধ অবস্থা ছিঁড়ে ফারিন কথা বললো,
– আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। মাহতিম ভাইয়া যদি নিজে থেকে যেচে বলে, তাহলে হয়তো সম্পূর্ণ ব্যাপারটা জানা সম্ভব। কিন্তু আমরা যদি পাকনামি করে জানার আগ্রহ দেখাই, তাহলে বিয়েতে নেগেটিভ ভাইব পরবে।
তিনজনই চোখ তুলে ফারিনের দিকে তাকালো। মুখে কিছু না বললেও ফারিনের কথাকে সবাঈ মেনে নিয়েছে। অপেক্ষা নামক শব্দের কাছে স্থির থেকে রুম ত্যাগ করলো সবাই। কেউ যেন সন্দেহ না করুক, তাই নিচে নামার আগে দলভঙ্গ করে আলাদা হলো প্রথমে নীতি ও ফারিন একসাথে নামলে শেষে বাকি দুজন নামলো।
সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছে মেহনূর। মোটা পাড়টা রক্তজবার মতো লাল। গায়ের ব্লাউজটা লাল পরলেও স্লিভটা কনুই সমান। আজ মারজার জোর-জবরদস্তিতে বেশ সেজেছে মেহনূর। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। মারজার কথা মতোন ফিটফাট হলেও মেহনূরের কাছে ভালো লাগছে না। পার্লারের মেয়েগুলো রাক্ষু:সের মতো মারজা কথাই শুনেছে। তার লম্বা চুলগুলো খোঁপা পাকিয়ে ঘাড়ের কাছে সেঁটে দিয়েছে। মাথার মধ্যভাগে সিঁথি তুলে খোঁপার গোল স্তুবকটা গাজরা দিয়ে পেঁচিয়েছে। আচ্ছা ঠোঁটের মেরুন লিপস্টিকটা খরার মতো শুকালো কেনো? এটাকেই তাহলে নীতি আপু ‘ ম্যাট ‘ বলে পরিচয় দেয়? মেহনূর একবুক অস্বস্তি নিয়ে মেহমান দেখাশোনা করছে। চোখদুটো চুম্বকের মতো সিঁড়ির কাছে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা সিঁড়িটা দিয়ে কখন মাহতিম নিচে নামবে, কখন সবার আড়ালে ডেকে মেহনূরের দিকে তাকাবে, আজকের সম্পূর্ণ সাজটা একজনের জন্যই উৎসর্গ। অন্তত সেই মানুষটা একটাবার দেখুক, হাসি-হাসি ঠোঁটে অবাক চাহনিতে আপাদমস্তক দেখতে থাকুক। ওই মূহুর্তে কিযে লজ্জার পরিস্থিতি হবে, সেটা ভেবেই আনমনে মিচকি-মিচকি হাসছে মেহনূর।
– একা-একা বেকুবের হাসছিস কেন?
পাশ থেকে কন্ঠ শুনতেই চমকে উঠলো মেহনূর। কল্পনার চিন্তাটা কেটে যেতেই বাম দিকে তাকালো। গোলাপী রঙের জামদানী শাড়িতে সাবা দাঁড়িয়ে আছে। চোখের ভেতর প্রশ্ন নিয়ে মেহনূরের কাণ্ডকারখানা দেখছে। সাবার দিকে জোরপূর্বক হাসি দিলো মেহনূর, অপ্রস্তুত গলায় আমতা-আমতা করে বললো,
– এই যা, হাসবো কেনো? হাসির তো কিছুই নেই। ভুল দেখেছো বুবু।
সাবা চোখদুটো ছোট-ছোট করে গোয়েন্দার মতো তাকালো। ভ্রঁ-টা বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো উঁচু করে ভাবুক কন্ঠে বললো,
– আমি দশ মাইল দূর থেকে তোর তামাশা দেখছি। কাঁটাচামচ দিয়ে মিষ্টি গুঁতিয়ে কি করলি হ্যাঁ?
সাবার কথামতো পিরিচে তাকালো মেহনূর। সাথে-সাথে জিহবায় কামড় দিয়ে চোখ খিচুঁনি দিলো। কি সর্বনাশ! মহাজনের কথা ভাবতে-ভাবতে মিষ্টি খুঁচিয়ে শেষ! মেহনূরকে হা-হুতাশ করতে দেখে হো-হো করে হেসে উঠলো সাবা। টিটকারিটা জায়গামতো ছুঁড়ে বললো,
– যার ধ্যানে এতোক্ষন ডুবেছিলি, ওই ব্যক্তি একটু আগে বাইরে চলে গেছে। এখন এদিক-সেদিক না তাকিয়ে অপেক্ষা কর।
সাবার অকপটে কথায় আজ লজ্জা পেলো না মেহনূর। উলটো একরাশ মনক্ষুণ্ণতা ভর করলো তাকে। মাহতিম না বলে বাইরে গিয়েছে? দুপুরের পর থেকে বড্ড অদ্ভুত আচরণ করছে। খুবই অদ্ভুত! প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলো শানাজ। সোনালী রঙের তাঁতের শাড়িতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো তাকে। মেহনূর দূর থেকে শানাজের মুখটা দেখে তৃপ্তির হাসি দিলো। কতগুলো দিন শেষে শানাজের মুখটা হাসিখুশি দেখাচ্ছে। শানাজকে এনে সোফায় বসালো সুজলা। দু’পক্ষের আংটি বদলটা প্রায় শুরু হলো। সৌভিক যখন হাতে আংটি নিলো, তখনই কিছু একটা মনে পরায় আশেপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলো। সৌভিকের হন্য হয়ে খুঁজাটা দৃষ্টি এড়ালো না প্রীতির। সৌভিকের কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো সে,
– কাকে খুঁজো ভাইয়া?
সৌভিক উৎসুক গলায় বললো,
– মাহতিম কোথায়? ওকে ডেকে আন্। ও ছাড়া আংটি বদল করবো, এটা হয় না।
সৌভিকের কথায় চেতন ফিরলো সবার। ঠিকই তো, মাহতিম কোথায়? ও কি বাইরে থেকে ফিরেনি? সবাই একযোগে খুঁজতে লাগলো মাহতিমকে। নীতি নিজ দায়িত্বে রুমে গিয়ে ফেরত আসলো। মাহতিমের ফোন কল দিয়ে কেউই তাকে পেলো না। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে বলতে লাগলো,
– যে নাম্বারটিতে কল করেছেন, তা এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন, ধন্যবাদ।
মাহতিম তো ফোনটা আছাড় মেরেছিলো, তাহলে কি ফোনটা ওভাবেই আছে? কথাটা মনে-মনে আওড়ালো সিয়াম। ভাবনাটা মাথায় খেলতেই দ্রুত তৌফকে আড়ালে নিয়ে বললো। তৌফ আর দেরি না করে সৌভিককে মিথ্যা বুঝ দিয়ে শুভ কাজ সারতে বললো। সৌভিক প্রথম-প্রথম অমত করলেও শেষে সবার জোড়াজুড়িতে আংটি বদল করলো। মাহতিমের উদ্ভট আচরণ দেখে ভীষণ খটকায় আছে মেহনূর। না, এবার শান্ত হচ্ছে না। কাউকে না বললেও অন্তত মেহনূরকে জানিয়ে যায়। যেখানেই কাজ থাকুক, মেহনূরকে আশ্বস্ত করে বাসা থেকে বেরোয়। অপেক্ষা করতে লাগলো মেহনূর। যে পযর্ন্ত না আসবে, ওই পযর্ন্ত একটা খাবারও টাচ করবে না সে।
বাড়ির ভেতরটা কোলাহলে ভরপুর। সৌভিকদের পরিবারের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে বড়রা। মারজার তোষামোদে সৌভিকের কাকা-কাকিমা রাতটুকু এখানেই কাটাবে। বিয়ের পরিবেশটা জমানোর জন্য আজ ভালোই আয়োজন হয়েছে। অন্যদিকে নীতিরা ছাদে আঁড়ি গেঁথেছে। খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে এলাহি কারবার। সবাই নিজেদের ব্যক্তি জীবনের নানা গাল-গল্প নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে মেহনূর। রাগে ভেতরটা দাউদাউ করছে মাহতিমের জন্য। অসভ্য লোকটা এখনো দোরগোড়ায় হাজির হয়নি। গেছে কই? কোন্ চুলায় আগুন ধরাতে গিয়েছে? মেহনূরকে অন্য চিন্তায় বিভোর দেখে জোরে কাশলো সৌভিক। কাশির ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাপারটা কানে যেতেই স্বাভাবিক হলো মেহনূর। সৌভিক একগাল হাসি দিয়ে ফাজলামির সুরে বললো,
– আপনার অভদ্র লোকটা কাজে গেছে ভাবী-শ্যালিকা। চিন্তা ঝেড়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হোন।
সৌভিকের মুখে ডাবল সম্বোধন শুনে হো-হো হাসছে সবাই। সামিক হাসতে-হাসতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
– ভাই জানলে টুট টুট খাবা ব্রো। ভাবীই ডাকো।
সামিকের ইঙ্গিত শুনে কপট রাগ দেখালো সৌভিক। পিঠে জোরে চাপড় মেরে হাসি দিয়ে বললো,
– আমার কাছে বোনই ভালো। এর ঊর্ধ্বে কিছু ভাবা লাগবে না।
কোকাকোলার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো ফারিন। হঠাৎ গ্লাসটা ঝটকা মেরে ছিনিয়ে নিলো তৌফ। সুন্দর করে চুমুক দিলে হা হয়ে গেলো ফারিন। একবার গ্লাসের দিকে তাকালো, আরেকবার তৌফের দিকে দৃষ্টি ঘুরালো সে। রাগে গজগজ করে চেঁচিয়ে বললো,
– অসহ্য তৌফ ভাই! অসহ্য! তোমার জ্বালায় কি শান্তি মতো কোকও খেতে পারবো না? তুমি কি আমাকে বিরক্ত করা অফ করবে?
তৌফ নির্বিকার ভঙ্গিতে পুরো গ্লাস খালি করে করলো। বড় একটা ঢেঁকুর তুলে বললো,
– ওই সিয়াম, শোনতো ব্যাটা, ফটাফট একটা রুম স্প্রের ব্যবস্থা কর। নাইলে একটু পরে যেই কেলেঙ্কারিটা হইবো, ওইটার জ্বালায় টিকতে পারবি না।
ফারিন বাদে সবাই তখন অবুঝের চোখে তাকালো। সিয়াম নিজেই ব্যাপারটা বুঝার জন্য বললো,
– তোর দেখি ভালোই কারেন্ট। রুম স্প্রে চাস ক্যান? কোন্ জায়গায় লাগাবি?
তৌফ রাগী মুখে তাকালো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে থাবড়া মা:রার ভঙ্গি ধরে বললো,
– দূর ব্যাটা! আলগা কথা কস ক্যান? পরিবেশে মাইয়া মানুষ আছে দেখোস না? ফারিন পারদ মারবো বুঝছোস? এজন্য আনতে বলতেছি।
সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করলো,
– আরে ব্যাটা পারদ মানে কি?
তৌফ বিরক্ত ভরে বললো,
– মূর্খ! অশিক্ষিত! আই-কিউ দিয়াও বুঝোস না? পারদ মানে বুঝোস না? মাঝখানের শব্দ আউট কর, এরপর দ্যাখ কি দাঁড়ায়।
একমিনিট পুরো পরিবেশটা ঠান্ডা হয়ে থাকলো। সবাই একে-অন্যের দিকে চাওয়া-চাইয়ি করলো। যেই সবগুলো চোখ ফারিনের দিকে আঁটকে গেলো, তখনই দুম করে তীব্র হাসির ঝড় উঠলো। পুরো ছাদটা তখন হাসির শব্দে গমগম করে উঠলো। ফারিন লজ্জায় নত হয়ে গেলেও শেষে সবার হাসিতে যুক্ত হলো। ছাদের শুকনো কাপড় তুলতে অন্যপ্রান্তে ছিলো মেহনূর। সেখানে আলো জ্বালায়নি বলে জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতাসে উড়তে থাকা কাপড়গুলো তুলতেই হঠাৎ গা ছমছম করলো মেহনূরের। ক্লিপের উপর হাত রেখে স্থির হলো সে। শোঁ শোঁ বাতাস, থেমে-থেমে হাসির শব্দ, ঝিঁঝিপোকার ছন্দপূর্ণ ডাকটা স্পষ্ট কানে শুনতে পাচ্ছে। বুকের স্পন্দনটা একটু-একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওটা কিসের আলো? মেহনূর ধীরপায়ে রেলিংয়ের কাছটায় এগিয়ে গেলো। বাড়ির সদর দরজার বাইরে ‘ হাইজ ‘ গাড়ি থামানো। আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই লম্বা গড়নটা দেখতে পেলো মেহনূর। গেটের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সাদা পান্ঞ্জাবিটা দেখতে পাচ্ছে। তাকে তিনজন ব্যক্তি কি কথা যেনো বললো। ওমনেই মাহতিম রণমূর্তি ধারণ করে তাদের শাষাতে লাগলো। এটুকুতেই ক্ষান্ত হলো না মাহতিম, সোজা তর্জনী তুলে রাগের তেজ ছেড়ে দিলো। ধুক-ধুক তালটা যেনো কানের পর্দায় আঘাত দিচ্ছে। শরীরটা ঠান্ডা মৌসুমের মতো ভয়ে শিউরে উঠছে। মাহতিম এখন পযর্ন্ত কোনোকিছু লুকায়নি! যা জানতে চেয়েছে, যখন জানতে চেয়েছে, সব নির্দ্বিধায় মেহনূরকে বলার জন্য প্রস্তুত থাকতো। হঠাৎ চোখের পলকে প্রথম লোকটার কলার চেপে ধরলো মাহতিম, দু’হাতে কলার খামচে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। দৃশ্যটা দেখার সাথেই মুখে হাত চাপা দিলো মেহনূর। মাথাটা এলোমেলো লাগছে! কি হচ্ছে বাইরে? মাহতিম কেনো ঝগড়া করছে? লোকগুলো কারা? মাহতিমের কবল হতে কোনোভাবেই কলার ছাড়াতে পারছেনা। দুজন লোক অবিরামভাবে কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যর্থ! মাহতিমকে ওরকম অবস্থায় দেখতে পেয়ে বাড়ির দারোয়ান গিয়ে তাড়াতাড়ি আঁটকালো। দারোয়ান-সহ তিনজন মিলে ওই কলার ছাড়িয়ে দিলো। মাহতিম তবুও ওদের শাষাতে থাকলে দারোয়ান লোকটা ভেতর টেনে আনলো। মাহতিমকে শান্ত থাকার কথাটা দূর থেকে বুঝলো মেহনূর, দৃশ্যটা দেখতে-দেখতে আরো একবার ঢোক গিললো। হাতভর্তি কাপড় ফেলে দৌঁড় লাগালো মেহনূর। মেহনূরের দৌঁড় দেখে সবাই একটু প্রশ্নসূচকে তাকালেও মাহতিমকে দেখে হয়তো ছুটে গিয়েছে। মেহনূর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে গেলো, হাঁপাতে-হাঁপাতে ডান-থেকে-বামে তাকালে লন এরিয়ায় দৃষ্টি পরলো। পাকা ছাউনি দেওয়া বসার জায়গাটায় বসে আছে মাহতিম। আবার দৌড় লাগিয়ে একেবারে সামনে থামলো মেহনূর। মুখ হা করে নিশ্বাস নিতেই মাহতিমের কাছে গেলো। বসার পাকা জায়গায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে সে। নিচু করা মাথাটায় হাত রাখলো মেহনূর। চুলগুলো আঙ্গুলে নাড়াতেই মাথা তুললো মাহতিম, সামনে আগত মানুষটার দিকে থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। মুষ্টিবদ্ধ করা হাতদুটো আলগা করে একটা হাত উপরে তুললো, মাথা থেকে কোমল হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরলো সে। প্রচন্ড রাগে-ক্ষোভে-আক্রোশে ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো মেহনূরের, তুমুল আশ্চর্যে চূর্ণ হলো সে। অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবুক ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলো মাহতিমকে,
– বাইরের লোকগুলো কারা?
কোনো জবাব দিলো না মাহতিম। নির্বাকভাবে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহনূর একটু ঢোক গিলে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– ওই তিনটে লোক কারা ছিলো? আপনি ওদের সাথে ঝগড়া করছিলেন। একজনের কলারও চেপে ধরেছেন, ওরা কারা ছিলো?
বুকটা ধড়ফড়-ধড়ফড় করছে। মাহতিম কোনো কথাই বলছে না। বেচইন মেহনূর এবার কাট-কাট ভঙ্গিতে সংযত সুরে বললো,
– আপনি আমার কাছে কোনো কথাই লুকান না আনসারী সাহেব। আজ যদি কথাটা গোপন করেন, তাহলে আপনার ওয়াদাটা ঠিকই ভেঙ্গে যাবে।
চট করে দুই চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। জোরে এক নিশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। অদ্ভুত কঠোরতায়, ভিন্ন শঠতায়, আলাদা গাম্ভীর্য স্বরে বলে উঠলো সে,
– তোমাকে বিয়ে করাই হয়তো আমার জীবনের মস্ত বড় ভুল! নয়তো এই মাহতিমকে পাওয়াটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশা:প!
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ ০২.
মুখের উপর কেউ যেনো ঠাস করে চড় মারলো। কথার আঘাতটা মূহুর্তের ভেতর পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরলো। অকল্পনীয় চিন্তায় স্থির হলো মেহনূর। মুখে কোনো শব্দ নেই, তার শ্রীযুক্ত নমন চোখদুটো বরফের মতো জমে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় সাদা পাণ্ঞ্জাবীর মানুষটাকে শীতল চোখে দেখছে। বিষণ্ণ মুখ, চিন্তিত চাহনি, চোয়ালজোড়া থরথর করে কাঁপছে, এমন দৃশ্যপট মেহনূরের মধ্যে ঝড় তুলে দিয়েছে। একটু আগের বিষাক্ত কথাটা রি-রি করে কানে বাজছে, রক্তের দামাল স্রোতে ভেতরটা যেনো লন্ডভন্ড অবস্থা! মাথা নিচু করে দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর মৌনতা ভাঙ্গলো মেহনূর, পাষাণের মতো ব্যক্তির দিকে একপা এগিয়ে এলো। গরমের উৎকট যন্ত্রণায় সাদা পাণ্ঞ্জাবীর পিঠটা ভিজে দেহের খাপে-খাপে সিঁটিয়ে আছে, ঘাড়ের উপর বিন্দু-বিন্দু ঘাম কণাও দৃশ্যমান। ছাঁটা চুলগুলো ক’দিনের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে ঝলমল করে উঠেছে, সেই চুলগুলো এখন ঘামে ভিজে জবজবে অবস্থা। চুলের ভেতর আঙ্গুল চালিয়ে ভেজা গোড়াটা স্পর্শ করলো মেহনূর। বুকের ভেতর নিম্নচাপের ঝড়টা ঢিপঢিপ করে টের পাচ্ছে ও। হঠাৎ নতমুখটা অবসাদ দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তুললো, মেহনূরের শান্ত চোখের ভেতর ম্লান দৃষ্টি মিলিয়ে চুপ করে রইলো। মেহনূর এসময় ভণিতা করলো না, কপালের সামনে বেপরোয়া চুলগুলো আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে পিছনে ঠেলে দিলো। শান্ত অবস্থা ছিঁড়ে নমনশীল কন্ঠে বললো,
– আপনার তো অনেক ক্ষমতা। আমার মতো ভুলকে শুধু-শুধু জিইয়ে রাখবেন কেন? একেবারে মাটি শুদ্ধো উপড়ে ফেলুন। গ্রামের জঙ্গলি আগাছা কেটে ফেলাই ভালো।
থমথমে দৃষ্টিটা চট করে তীক্ষ্ম হলো। চেহারায় গম্ভীর ছাপ ফেলে শক্ত গলায় বললো,
– তোমাকে ওই ক্ষমতা দেখাতে চাই না। সহ্য করতে পারবে না।
ঠোঁট শক্ত করলো মেহনূর। ও যে খুবই দূর্বল, মাহতিম সেটা কৌশলের সাথে বুঝিয়ে দিলো। এমন বাঁকা কথার খোঁচাটা সহ্য করলো সে। মনে-মনে নিজেকে বললো, মাথাটা ঠান্ডা রাখতে হবে, মুখে-মুখে তর্ক করা যাবে না, পরিস্থিতি বেসামাল হলে বিশ্রী অবস্থা হতে পারে। লম্বা-লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ভেতরের ক্রুদ্ধ আগুনটাকে নিভিয়ে ফেললো মেহনূর, জিভের উপর ঠোঁট বুলিয়ে যথাসম্ভব বিনীতা হয়ে বললো,
– যদি সহ্য করতে না পারি, তাহলে এতো আদর দিয়ে যত্ন করছেন কেন? আপনার সবকিছু আমার সাথে কেন জড়িয়ে দিলেন?
মাহতিম দ্বিধাগ্রস্ত মুখটা অন্যদিকে ঘুরালো। অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে! নিজেকেই অশ্রাব্য-অকথ্য ভাষায় অপদস্থ করছে। দাঁত শক্ত করে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম, ভেতরের দপদপানি অবস্থাটা কন্ট্রোল করতেই মেহনূর ফের বলে উঠলো,
– আপনি যদি তাড়িয়েও দেন, তাও আমি এখান থেকে একচুল নড়বো না। তার চেয়ে ভালো, আপনি আমাকে মে:রে ফেলুন, আমার লা:শটাকে গুম করে দিন।
বজ্রাহতের মতো চমকে উঠলো মাহতিম। শিরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোতটা যেনো কোষাগারে গিয়ে পৌঁছলো। অবচেতন মনটা ইতিমধ্যে দুঃসহ কল্পনাটা করে ফেলেছে। কি ভয়াবহ সেই চিন্তা! কি জঘন্য, কি নিকৃষ্ট ধরনের! ঠাস করে চড় লাগানোর জন্য হাত উঠালো মাহতিম, প্রচণ্ড রাগটা শরীরময় ছড়িয়ে গেলেও চূড়ান্ত মূহুর্তে হাত থামিয়ে ফেললো! মেহনূরের মুখটার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। নিচের ঠোঁট কামড়ালো মেহনূর, অশান্ত মাহতিমের দিকে ভারি নিশ্বাস ছেড়ে তার কোলে এসে বসলো। দু’হাতে মাহতিমের মুখটা ধরে এক ঝটকায় নিজের মুখের কাছে আনলো। দু’হাতের তালুর নিচে শেভড্ গালদুটো গরম হয়ে আছে, ভ্রুঁর নিচে সুদৃঢ় চোখদুটো তপ্ত ক্ষোভে অটল। রাগের কারনে ঠোঁটদুটোর উপর দাঁতের দংশন চলেছে, যার সুবাদে ঠোঁটদুটো এখন টকটকে লাল। যদি সুছাঁদের ঠোঁটদুটোয় স্পর্শ মিলিয়ে দেয়, তাহলে রাগটুকু কি নিভিয়ে দেওয়া যাবে? এই মানুষটা কি একটু আগের বিষদিগ্ধ কথাগুলো তুলে নেবে? ঠোঁটের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সুগভীর চোখদুটোয় দৃষ্টি বসালো মেহনূর। মাহতিমের ডান গালটা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– ঠান্ডা হয়ে যান। আমি শুধু যন্ত্রণা বুঝানোর জন্য ওই কথাটা বলেছি। কিচ্ছু হয়নি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকুন। বলুন কি নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? আপনি অস্বীকার করবেন না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনি ওই লোকগুলোর কথা শুনে টেনশনে আছেন। বলুন, চুপ করে থাকবেন না, আমাকে বলুন।
ডান গাল থেকে হাত নামিয়ে আঁচল টানলো মেহনূর। আঁচলের শেষ অংশ টেনে মাহতিমের ঘামার্ক্ত গলাটা মুছে দিলো। কপালের ডানদিকে কানের কাছটায় চুয়ে-চুয়ে ঘাম ঝরছিলো, সেই ঘামটুকু আঁচলে মুছে দিতেই হঠাৎ জীর্ণ গলায় বললো মাহতিম,
– ভয়টা তোমাকে নিয়ে পাচ্ছি।
কথা থেমে গেলো মাহতিমের। ওর ঘামে ভেজা চুলগুলোয় আঙ্গুল রাখলো মেহনূর। অসম্পূর্ণ উত্তর শুনে মাহতিমের দিকে একপলক তাকালো, পরক্ষণে চোখ সরিয়ে এমনভাবে চুল ঝাড়তে লাগলো, যেনো বাকি কথার মর্মও সে শুনেছে। অনেকটা দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে হাস্যমুখে বললো,
– আমার চারদিকে যেই অদৃশ্য বেড়িবাঁধ গেড়ে আছে, ওটাতো আনসারী সাহেবের অনুমতি ছাড়া খোলে না। উনার বিশেষ অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকলে কি জঘন্য আপ্যয়ন করেন, সেটার নমুনা আমি তরুণ ভাইয়ার কাহিনি থেকে বহু আগেই বুঝেছি।
গম্ভীরভাবে তাকিয়ে থাকা মাহতিম আচমকা হেসে ফেললো। তরুণকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে-পিটিয়ে কিভাবে শায়েস্তা করেছিলো, সেটা এমন মূহুর্তে মনে পড়ায় সত্যিই হাসি পাচ্ছে। মাহতিমের মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে স্বস্তি পেলো মেহনূর, হলদে আলোয় উজ্জ্বল মুখটা দেখতেই হঠাৎ বাতি নিভে গেলো। পুরো পরিবেশটা একমূহুর্ত্তের ভেতর অন্ধকারে ডুব দিলো। চর্তুদিকে মূর্ছার মতো অন্ধকার দেখে বিচলিত হলো মেহনূর, ডানে-বামে তাকিয়ে কিছুটা অস্থির হলে ব্যাপারটা বুঝলো মাহতিম। মেহনূরের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– লোডশেডিং।
উত্তরে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। মুখটা এখন দেখা যাচ্ছে না। একজোড়া চোখ যে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পেরেছে ও। ঝুপ করে অন্ধকার নামা পরিবেশটা চারধারে রহস্য করে দিয়েছে। বাড়ির বাইরে খোলা লনে অদ্ভুত এক নির্জনতা। দখিনের মন-মাতানো বাতাস যেনো সবটুকু গ্লানি টেনে নিচ্ছে, ভ্যাপসা গরমের তপ্তশ্বাসটা একটু যেনো কমলো। মাহতিমের কোল থেকে উঠতে নিলো মেহনূর, চট করে বাঁ-কাধে টান লাগতেই পিছু তাকালো ও। সাদা আঁচলটা কয়েক পাক পেঁচিয়ে ধরেছে মাহতিম। অন্ধকারে থেমে-থেমে দু’দফা তুড়ি বাজালো। ‘ আমার কাছে এসে চুপচাপ বসো ‘ কথাটার ইঙ্গিত দিলো সে। মেহনূর বাঁ-কাধে হাত রেখে আঁচলের পিনটা সামাল দিলো। চুপচাপ আগের মতো মাহতিমের কোলে এসে বসলো। মেহনূর টের পেলো, তার আঁচলটা ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে, খুবই সন্তর্পণে নিরবে-নিভৃতে কোমরের দুপাশে হাত রাখছে। একটু-একটু সংকুচিত হচ্ছে মেহনূর। আজও সেই স্পর্শের কাছে ছোট্ট মনটা রাঙা হয়ে যায়, তার মুখখানাটা প্রথমদিনের মতো লজ্জার ভূষণে ঢাকা পরে। মাহতিমের আদর-স্পর্শ-সুখদ মায়ায় সম্মোহিত হয়। গভীর রাতে যখন সহসা তন্দ্রা ভাঙ্গে, তখন ওই মানুষটার বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে। একজোড়া সুঠাম হাতে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে, যেনো বুকের মধ্যে মুক্তো লুকিয়ে রেখেছে, তাকে দেখতে দেওয়া পুরোপুরি নিষেধ। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে মেহনূর, অনেক সময় ধরে ঘুমন্ত মুখটা নিরীক্ষণ করে। কখনো-কখনো মুচকি হাসিতে মাহতিমের চুলে হাত বুলায়, কখনো-কখনো গালে টুপ করে চুমু খায়। এই টুকরো-টুকরো মূহুর্তগুলো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করছে। যখন মাহতিম চলে যায়, তখন অদ্ভুত ঝিম ধরানো রাতগুলোয় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে মেহনূর। একেকটা মূহুর্ত নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই কখনো হাসে, কখনো আরো বেশি উদাসীনতা ভর করে। নিরবতা চিঁড়ে হালকা গলায় বললো মাহতিম,
– আমার ভাইটাকে মনে পরছে মেহনূর। কতদিন ওকে দেখি না। আমার চোখের সামনে বড় হলো, ওকে আমি বড় করলাম, অথচ আমারই চোখের সামনে চলে গেলো। কোন্ পাপের যে প্রায়শ্চিত্ত করলাম, নিজেই জানি না। ওর কথা মনে হলেই ভেতরটা ছিঁড়ে যায়। এতো কাছে ছিলো, তবুও কি ভাগ্য আমার, ওইটুকু কাছ থেকেও বাঁচাতে পারলাম না। আমার বাবা, আমার ভাই চলে গেলো, সেই যন্ত্রণা এখনো ধুকে-ধুকে সহ্য করছি। তোমার কিছু হলে আমি ম:রেই যাবো মেহনূর।
সাথে-সাথে মুখে ‘ স ‘ জাতীয় শব্দ করলো মেহনূর,
– সসস, এভাবে বলবেন না। নিয়তিচালিত ব্যাপারে কারোর হাত নেই। আপনি যে বুকে কষ্ট পুষে, মুখে হাসি রেখে চলছেন, সেটা কাছ থেকে না দেখলে কেউ বুঝবে না। আমার কিচ্ছু হবে না, ভরসা রাখুন। আমি জানি, আপনি কিছুই হতে দিবেন না।
হাস্য কন্ঠে বললো মাহতিম,
– এতো বিশ্বাস?
মৃদ্যু হাসলো মেহনূর। কোমর জড়ানো হাতদুটোর উপর নিজের হাতদুটো রাখলো, স্বগোতক্তির মতো বলে উঠলো,
– যতক্ষণ এই হাতদুটোর আশ্রয় আছে, ততক্ষণ কোনো ভয় নেই। সেদিন একা-একাই যে ব্যক্তি তিনটা গাড়ি সটকে দিয়েছে, আপনি তাঁর যোগ্যতার কি জানেন?
যোগ্যতার বিচার শুধাতে গিয়ে ঢোক গিললো মেহনূর। বেশ ফটফট করতে গিয়ে ভুলভাল কথা বলে ফেলেছে। কার সাথে বাচালের মতো আচরণ করছে, সেটা মিনিট খানেকের জন্য ভুলে গেছিলো। কোমর থেকে নিজের হাতদুটো উঠালো মেহনূর, ভয়ে-ভয়ে সামনের দিকে তাকাতেই হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো। আবারও ল্যাম্পপোস্টের চিলতে আলোয় উজ্জ্বল মুখটা দেখতে পেলে অপরাধী চোখে তাকালো। কখন যে কোমর থেকে একটা হাত ঘাড়ে এসে পৌঁছলো, টের পায়নি মেহনূর। ঘাড়টায় মৃদ্যু চাপ খেয়ে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হলে মুখ নিচু করলো মাহতিম। মাথাটা বাঁদিকে কিন্ঞ্চি কাত করে গালে অনুরাগের ছোঁয়াটা চেপে দিলো। চোখদুটো নিমিষের ভেতর বন্ধ করলো মেহনূর, ভেজা পান্ঞ্জাবীর পিঠে হাতদুটো রেখে দিলো। থেমে-থেমে গলার কাছটায়, কাধের উঁচু হাড়টায় আদরটুকু ছুঁয়ে দিলো মাহতিম। আবারও দেহে শীতল উচ্ছাস লাগিয়ে দখিনা হাওয়া এলো। দূরের আকাশে মিটিমিটি তারার দিকে মুচকি হাসলো মেহনূর। মনে-মনে সাধুবাদ জানাতেই পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললো।
– উনাকে পাওয়া যদি আমার অভিশাপ হয়, আমি বারবার অভিশপ্ত হতে প্রস্তুত।
.
আনসারী নিবাসটা ঘুমে কাবু। প্রতিটি ঘরের লাইট নিভে আছে। সবাই আমেজের ক্লান্তি শেষে গভীর নিদ্রায় ডুবেছে। আশেপাশে কোনো সাড় নেই, সব যেনো নিঃসাড়-নির্জীব হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটাটা টিক-টিক করে সেকেন্ডের হিসাবে ঘুরছে। রাত গভীর, সময় এখন তিনটা বেজে ত্রিশ। রাস্তার কুকুরগুলো দূর থেকে ঘেউ-ঘেউ করছে, আর্ত স্বরে ডাকছে দু-একটা কুকুর। গাছের ডালপালা নাড়ার আওয়াজ হয়, যেনো ডালে বসে কোনো অশরীরী জিনিস ওৎ পেতে আছে। মাটির গুল্ম পোকাগুলো তাক লাগিয়ে চেঁচাচ্ছে। গায়ে ‘ adidas ‘ ব্রান্ডের কালো টিশার্ট এবং সাদা ট্রাউজার পরে বেরিয়েছে। বাঁহাতে মোবাইল নিয়ে বিশেষ কলের জন্য অপেক্ষা করছে। মোবাইলের স্ক্রিনটা আছাড় মারার জন্য কোণাকুণি ভাবে ফেটেছে, আপাতত ফোনটা কোনোরকমে জোড়াতাপ্পি দিয়ে কলের অপেক্ষায় সময় গুণছে। মুখ ঘুরিয়ে সোজা দোতলায় তাকালো। দৃঢ়তাপূর্ণ চোখদুটো ক্ষণিকের জন্য সতর্ক হলো। দোতলার বদ্ধ জানালায় সন্দেহজনক কিছু আছে কিনা, স্র বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। কিন্তু না, সন্দেহজনক কিছু নেই। সব নরমাল আছে, সব একদম ঠিকঠাক। কিছুক্ষণের ভেতর মোবাইলটার ডিসপ্লে জ্বলে উঠলো, স্ক্রিনের উপর স্পষ্ট অক্ষরে ‘ Incoming call ‘ লেখাটা পরে ফেললো। রিসিভে সোয়াইপ করে কলটা কানে রাখলো, ওপাশ থেকে আসল কন্ঠটা পাওয়ার জন্য চুপ রইলো সে। বাড়তি সতর্কতার জন্য নিজ থেকে কথা টানলো না। হঠাৎ ওপাশ থেকে শক্ত গলায় বললো,
– আমি কি মাহতিম আনসারীর সাথে কথা বলছি?
কন্ঠটা চিনতে পেরে ধীরস্থির ভাবে উত্তর দিলো মাহতিম,
– জ্বী,
চোখটা আবার ঘুরালো মাহতিম। দোতলার সেই বদ্ধ জানালার দিকে একপলক তাকালো। মেহনূর তাহলে টের পায়নি। ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটি বুঝদার ব্যক্তির মতো বললো,
– আপনার মতো পাওয়ারফুল পার্সন আমার হেল্প চাইছে, ম্যাটারটা ধরতে পারছি না আনসারী সাহেব।
দোতলা থেকে চোখ নামালো মাহতিম। উত্তর দিতে গিয়ে বাঁকা হাসলো, কন্ঠে সৌজন্যতা রেখে বললো,
– প্রত্যেকটা পাওয়ারফুল পার্সনের উইক পয়েন্ট থাকে, এটা জানেন তো? যখন শকুনের চোখ ওই উইক পয়েন্টে পরে, তখন কোনো পাওয়ারই কাজে লাগে না। আমার সিচুয়েশনটা কোন স্টেজে আছে, আশাকরি ইন্ট্রোডাকশান-নোট ছাড়াই বুঝেছেন।
ওপাশ থেকে স্বল্প হাসির শব্দ এলো। সম্মতি জানিয়ে বললো,
– আপনি এখন ডেসপ্যারেট সিচুয়েশনে আছেন। এমন দিনগুলো আমিও পাস্টে কাটিয়ে এসেছি। বাট আপনি যেটার হেল্প চাচ্ছেন, সেটা কোয়াইট ইম্পসিব্যাল। বলতে গেলে, আপনি ডেন্ঞ্জারাস ঝামেলায় পরেছেন। আমি এটার জন্যই আমার ওয়াইফকে পাবলিক্যালি ফেস করাতাম না। ইভেন, এখনো কিছু-কিছু জায়গায় রেসট্রিকশান রেখেছি।
মাথাটা কাজ করছেনা মাহতিমের। হুট করে চুপ হয়ে গেলে ওপাশের মানুষটা এবার স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– কাম ডাউন আনসারী সাহেব। আপনার ওয়াইফ যদি বুদ্ধিমতি হয়, উনি আপনার অবস্থা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। তাছাড়া প্রবলেমটা যেহেতু একসেস লেভেলে চলে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে গোড়া থেকে ছিঁড়ে ফেলুন। আপনি তো এসবে যথেষ্ট এক্সপার্ট।
স্মিত হাসিতে মাহতিম হাসলো। ফোনটা বাঁ-কান থেকে ডান কানে পাস করে বললো,
– দ্যান আই হেভ টু কি:ল সাম পিপল্স। এটা ছাড়া অলটারনেটিভ নেই।
চলমান .
#FABIYAH_মোমো
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই ❤
#পর্বসংখ্যা_৬৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ – শেষ .
গভীর রাতে তন্দ্রা ভাঙ্গলো। চোখ খুলে দেখলো মাহতিম নেই! অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগলো মেহনূর, পুরো রুম খালি! ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও অজানা আশঙ্কায় ভয় জেঁকে ধরেছে। রাত চারটা বাজে, অথচ মাহতিম উধাও? ওয়াশরুমের দিকে চোখ ফেললো মেহনূর। সুইচবোর্ডের লাইট বন্ধ। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলো সে, সোজা দরজা খুলে বেরুলো। পুরো বাড়িটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ যদি একা-একা বের হয়, তাও তার সাহসে কুলোবে না, নির্ঘাত সে ভয় পাবে! দুরুদুরু বুকে পা চালালো মেহনূর। সে নিজেও জানেনা মাহতিমকে কোথায় খুঁজবে। একবার চিন্তা করলো, বাড়ির বাতিগুলো জ্বালানো যাক! পরক্ষণে এটাও ভাবলো, সবাই জেগে যাবে। সুতির আঁচলটা টেনে পিঠ ঢেকে নিলো, গায়ে হালকা-হালকা শীত লাগছে। একে-একে নীতি-ফারিন-মাহদির রুম পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসলো। মাহতিম কোথায় থাকতে পারে, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পরে গেলো। একদম গোড়া থেকে চিন্তা স্টার্ট করলো মেহনূর। যে যে জায়গায় থাকতে পারে, তন্মধ্যে দুটো জায়গা নির্দিষ্ট! প্রথমটা হচ্ছে বাড়ির ছাদের দিকে, অন্যটা হচ্ছে বাড়ির লন। মেহনূর মুখ তুলে ছাদের সিঁড়িটা একবার লক্ষ করলো, বিনা বাক্যে নিঃশব্দে সিঁড়ির ধাপে পা ফেললো। শাড়ির কুচিগুলো ডানহাতে সামলে প্রতিটি ধাপে পা ফেলে এগুলো। ছাদের আধ-ভেজানো দরজার দিকে যতো অগ্রসর হচ্ছে, ততই অচিন্তনীয় ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে সে। মনেহচ্ছে, মাহতিম এখানেই! এখানেই আছে! কিছু সাংঘাতিক ঘটনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, সেটা কি খুবই ভয়ানক হবে? আধ-ভেজানো দরজা দিয়ে একফালি আবছা আলো সিঁড়ির উপর পরেছে, ওইটুকু আলো সঙ্গী করে নিঃশব্দে হাঁটছে মেহনূর। দরজাটায় আলতো ধাক্কা দিতেই বিশাল ছাদটা দৃষ্টিগোচর হলো। হুহু অশান্ত বাতাসটা গা ছুঁড়ে দিলো। কনকনে শীতের মতো কেঁপে উঠলো মেহনূর। আঁচলটা দিয়ে জবুথবু হয়ে গা ঢাকা দিতেই মাথা নিচু করে ছাদে ঢুকলো। নিরব ছাদ, ঝিম ধরানো নিঃসাড় রাত। একা-একা খালি ছাদে সত্যিই ভয় করছে। শরীরটা ভয়ের কারনে মৃদ্যু দমকে কেঁপে উঠছে। মেহনূর একবার বামে চোখ ঘুরালো, ওখানে কেউ নেই। রেলিংয়ের কাছ থেকে পুরো খালি। বামদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকাতে নিলো, তখনই পিলে চমকে উঠার মতো শিউরে উঠলো সে! রেলিংয়ের কাছে লম্বা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে! কালো ছায়াটার অবয়ব দূর থেকে গা কাঁপিয়ে দিচ্ছে! ছায়াটার পাশে ওটা কি? ছোটোখাটো আরেকটা মূর্তি? মেহনূর অস্বাভাবিক হারে নিশ্বাস নিতেই স্থির চোখে পিছাতে লাগলো। একপা-একপা করে পিছাতে নিলে হঠাৎ সংবিৎ ফেরার মতো থমকে গেলো। যাকে সে ভয়ংকর কিছু ভেবে চলছে, সেটা ওই কাঙ্ক্ষিত মানুষটা না? কিন্তু পাশে ওটা কে? ঠিক নারীমূর্তির মতো বোঝা যাচ্ছে! কে ওটা? কে হতে পারে?
রেলিংয়ের উপর দৃষ্টি ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্য রাতের প্রশান্তিময় হাওয়া পৃথিবীর বুকে জায়গা নিয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে শোরগোলের শব্দ নেই। রাতটা নিঝুম-নিঃশব্দ-নিস্তেজ। ঠান্ডা হাওয়ায় কালো টিশার্টটা বুকের ভেতর দোল দিচ্ছে। মাথার ঝলমলে বাড়ন্ত চুলগুলো প্রফুল্লচিত্তে উড়ছে। সাদা ট্রাউজারের পকেটে হাতদুটো গুঁজে রাখা। বুদ্ধিদীপ্ত মুখটা চাপা বিষাদের ছায়ায় লেপ্টানো। যেনো কতকাল সেই মুখে হাসির ছোঁয়াটা লাগেনি। এতো ভার, এতো বিমর্ষ চেহারা দেখে দুঃখ পেলেন মারজা। পাশ থেকে ম্লান দৃষ্টিতে তাকিয়ে চুপ করে আছেন। যেই ছোট্ট মাহতিমকে বুকে-পিঠে মানুষ করলেন, সেই মাহতিম আজ জোয়ান, টগবগে, প্রতিষ্ঠিত মানুষ। একসময় ছোট্ট নরম আঙ্গুলগুলো মারজার শক্ত তর্জনীটা খপ করে ধরতো, বিজয়ীর মতো উচ্ছল খুশীতে কি পবিত্র হাসিটাই না দিতো! চোখদুটো যখন কান্নার আয়োজন করতো, তখন নিষ্পাপ-পবিত্র শিশুসুলভ চোখদুটো আরক্তিম লাল হয়ে যেতো। চোখের ভেতর স্তুপ করে পানি জমতো, লাল টকটকে নিচের ঠোঁটটা পুরোপুরি উল্টে দিতো। আসন্ন কান্নার জন্য থুতনি কাঁপাতো ঠিকই, কিন্তু হাউমাউ না কেঁদে আদুরে মুখে ফুলে-ফুলে উঠতো। তখন ছোট্ট অবুঝ মাহতিমের প্রতি সেকি আদর, সেকি চুপ করানোর বায়না! ভাবতেই-ভাবতে এমন দুঃসহ সময়ে মুচকি হাসলেন মারজা। ছেলেটা চোখের সামনেই তরতরিয়ে কবে বড় হলো, ভাবতে পারছেন না মারজা। এইতো সেদিন প্রসব বেদনার যন্ত্রণা সহ্য করে নবজাত শিশুর চিৎকার শুনলেন। কোলের ভেতর ছোট্ট ছানার মতো উষ্ণতা দিলে আদর করলেন। অথচ মনেই হয়না, আজ দেখতে-দেখতে ত্রিশটি বছর ফাঁকিবাজি করে পেরিয়ে গেছে। সেই অবুঝ প্রাণটা বাড়-বাড়ন্ত দৈহিক গঠন নিয়ে সকলের সামনে সুপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাদা অফিশিয়াল পোশাকটা পরে যখন টুপি হাতে দাঁড়ায়, বিদায় নিতে হাসি দেয়, বাঁ চোখটা টিপ মেরে বলে, ‘ আসি তাহলে? ছুটি হলেই আবার চলে আসবো ‘, তখন প্রাণটা তৃপ্তিতে ভরে যায়। চোখটা বন্ধ করে মাথাটা বামে কাত করলেন মারজা, ধীরে-ধীরে ওড়না দেওয়া মাথাটা ছেলের শক্ত বাহুর কাছে ঠেকালেন। ডান বাহুতে ভার অনুভব করলো মাহতিম। সেদিকে দৃষ্টি না দিলেও মায়ের প্রৌঢ় শরীরটা বলশীল হাতে আগলে ধরলো। মায়ের নিচু মাথাটায় নিজের ডান গাল রেখে আকাশে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর শূন্য কন্ঠে বললো,
– আমি বিয়েটা করে ভুল করেছি মা। আমার মতো মানুষের বিয়ে করাটা ঠিক হয়নি। তুমি সেদিন ফোর্স না করলে আমি জীবনেও ওই গ্রামে পা ফেলতাম না। যদি একবার আমার কথাটা শুনতে, যদি ভুলবশত যাওয়াটা ক্যানসেল করতে মা! সেদিন তুমি আমার একটা কথাও শোনোনি।
মারজা সাথে-সাথে ছেলের দিকে মুখ তুললেন। আশ্চর্য গলায় বললেন,
– মাহতিম, চুপ কর! এসব কি ধরনের কথা বাবা? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওখানে যাওয়ার সাথে পাল্লা দিচ্ছিস কেন?
মাহতিম চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে বললো,
– ওর সাথে দেখা না হলে আমি কোনোদিনই বিয়ে করতাম না। তুমি জানো, আমি আজ পযর্ন্ত কোনো মেয়ের দিকে তাকাইনি। শহরে কি কম মেয়ে ছিলো? পাত্রীর ছবিও তো কম আনোনি। তবুও কোনোভাবে আমাকে রাজী করাতে পেরেছো? অনাও তো কোনোদিক দিয়ে কম না। অনা নিজেই মারাত্মক সুন্দরী। রজনী মামী নিজেই ওর জন্য সম্বন্ধ করতে চেয়েছিলো, আমিই নারাজ ছিলাম। সেই আমিই কিনা গ্রাম থেকে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বউ আনলাম?
মাহতিমের কথাগুলো রাগ, নাকি স্বগোতক্তি বুঝতে পারলেন না মারজা। নিজের কাধ থেকে মাহতিমের হাতটা সরিয়ে দিয়ে সোজাসুজি তাকালেন। কথার মারপ্যাঁচ ধরার জন্য তিনি কাষ্ঠ গলায় বললেন,
– শোন মাহতিম, কপালের লিখন না-যায় ভাঙন, না-যায় খণ্ডন। এই কথাটা কোনো সময় ভুলবি না। তুই আজ পরোক্ষভাবে মেহনূরকে দোষ দিচ্ছিস। কথায়-কথায় বারবার বিয়ের ভুল ধরছিস, সেদিন কিন্তু তোর ইচ্ছাতেই বিয়েটা হয়েছিলো। আমি একথাও অস্বীকার করবো না, ওই বাড়ির ছোট মেয়েকে আমার ভালো লাগতো না। কিন্তু মনে রাখবি! আমি নিজের মর্জি তোর উপর কোনোদিন খাটাইনি, মা হিসেবে তোর উপর অবশ্যই আমার হক ছিলো। চাইলে তোকে ধরে-বেঁধে ঠিকই বিয়ে পড়াতে পারতাম, আমি ওইসব ধার দিয়ে যাইনি। তোর বাপের নেচার আমার সামনে দেখাতে আসবি না। ওই বাপ ম:রা মেয়ের উপর জুলুম করলে তোর কপালে শনি আসতে দেরি নেই। এতিমের উপর কষ্টের ঘা দিতে যাস না। তুই যদি আদর-সোহাগে রাখিস, আজীবন একটা সৎ বউয়ের সঙ্গ পাবি। তোর আজকের কথাবার্তা কিন্তু আমার কাছে সোজা লাগলো না। মনে-মনে যেটার আশঙ্কা করছি, ওটা ভুলেও করবি না মাহতিম।
তীব্র ক্ষোভে উত্তরটা দিতে গিয়ে নিজেকে সামলালো মাহতিম। মায়ের দিকে সেও ঝাঁজালো দৃষ্টিতে তাকালো। ঢোক গিলে সবটুকু ক্ষোভ ভষ্ম করেও শান্ত হলো না সে। ভেতরের দপদপানি রাগটা মুখ ফসকে বাজে ভাবে বেরুলো, যেটার দূরদর্শিতা সম্বন্ধে মাহতিম কল্পনাও করতে পারলো না! মাহতিম বুঝতেই পারলো না, অজান্তেই কতো বড় দূর্ভোগ সে নিজের প্রতি টানলো! সে ক্রোধের গলায় রোখা মেজাজে বলে বসলো,
– ওই মোল্লাবাড়িতে না গেলে শান্তিতেই থাকতে মা! তোমার জন্যে ওই বাড়ির —-
ভ্রুঁ কুঁচকে থমকে গেলো মাহতিম। মারজার মুখ ও দৃষ্টি এখন ছাদের দরজার দিকে স্থির। মায়ের অমনোযোগ অবস্থা দেখে ক্ষুদ্ধ হলো সে, মা কিসের জন্য দরজায় তাকিয়ে আছে? তার কথা শুনছে না কেন? কি দেখছে ওইদিকে? সেটা দেখতে গিয়ে নিজেও সেদিকে মুখ ফেরালো মাহতিম। তৎক্ষণাৎ প্রচণ্ড বিষ্ময় ও আশ্চর্যে চোখ বড় করে ফেললো! ভীষণ ঘাবড়ে গেলো সে। একবার মায়ের ভীতিগ্রস্থ মুখটার দিকে তাকালো, এরপর তাকালো দূরের দরজার দিকে। অন্ধকার হলেও দরজা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে চিনতে পেরে ঢোক গিললো মাহতিম। খুবই দূর্বল ভঙ্গিতে ছেলের দিকে মুখ ঘুরালেন মারজা। ছেলের নিষ্কম্প দৃষ্টি দেখে অতি নিচু সুরে বললেন,
– ও যদি কাঁদে মাহতিম, তোর কপালে নিশ্চিত দূর্গতি আসবে! তুই যেই কথাগুলো বললি, ভুলার মতো না।
শাসানো বাণী নিক্ষেপ করে গটগট পায়ে চলে গেলেন মারজা। যাওয়ার অভিমুখে পা থামিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালেন, লজ্জায় নতমুখে মেহনূরের মাথায় হাত রাখলেন তিনি। নিচু সুরে নরমভাবে হাত বুলিয়ে বললেন,
– দাঁড়িয়ে থাকবি? ঘুমাবি না?
কতখানি সময় পেরিয়ে গেছে, জানা নেই মেহনূরের। বুকের ভেতর চাপা নিশ্বাস পৃষ্ট করে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কথা শোনার ইচ্ছে না থাকলেও সব কথা শুনেছে। মেহনূর রাগত ভঙ্গিতে রক্তিম চাহনিতে মাহতিমের দিকে তাকালো, কেবল একপলকের জন্য দেখলো, এরপর দৃষ্টি নামিয়ে অবান্তর চিন্তা থেকে শান্ত হলো সে। প্রশ্ন শুনে ফিকে হাসি দিয়ে বললো,
– ঘুম তো আসার কথা না মা। আমাকে মাফ করবেন। না চাইতেও আপনাদের কথাগুলো শুনে ফেলেছি। যতদূর বুঝলাম, এই বাড়ির জন্য আমি দূর্ভাগা কপাল এনেছি। এই কপাল কাউকে সুখে থাকতে দেয়নি, কাউকে শান্তিতে বাঁচতে দেয়নি, আবার —
কথাটা বলেই থামলো মেহনূর। সরাসরি কথাটা জায়গামতো ছুঁড়ে ফের বলতে শুরু করলো,
– আবার, এটাও ইঙ্গিত পেলাম আমি অন্যের কাজে ঝামেলা বাড়াচ্ছি। এসব শোনার পর আমি কিছুই বলবো না। আপনি যদি মনে করেন, আমার জন্য এসব কিছু হচ্ছে, আপনি সোজাসাপ্টা বেরিয়ে যেতে বলবেন। আমি চুপচাপ আম্মা আর বড়মার সাথে চলে যাবো।
পা ঘুরিয়ে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখলো মেহনূর। ছাদের উঠোনে কাউকে হন্যে হয়ে খুঁজার চিন্তা আপাতত শেষ। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো মেহনূর, একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। দেখলো না, দুটো মানুষ কিভাবে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড জেদ, একবুক রাগ, অত্যধিক ক্ষোভ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলো মেহনূর। শাড়ি ধরে একদৌঁড় দিয়ে রুমের ভেতর এসে ঢুকলো। চোখ থেকে ঝরঝর করে তপ্ত ফোঁটা পরলেও রাগে সবকিছু অসহ্য লাগছে। সবকিছু তছনছ করার প্রবল ইচ্ছা জেগেছে। এমন পৈশাচিক ইচ্ছার উদয় কখন-কিভাবে জেঁকে ধরলো বুঝতে পারেনি মেহনূর। সমস্ত রাগ মনের ভেতর গুটি পাকিয়ে সোজা বিছানায় এসে বসলো। দুই মিনিট ড্রিম লাইটের আলোতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। সাদা চকচকে টাইলসটা নীলচে আলোয় দীপ্যমান। ফ্লোরের উপর গোল-গোল ফোঁটা টপটপ করে পরছে। নীল আলোটা ফোঁটা-ফোঁটা বিন্দুর উপর প্রতিচ্ছবি ফেলেছে। মেহনূর ধ্যানের মতো দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে স্থির ছিলো, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ফোঁটার মতোই ফ্লোরটার জমিনে অশ্রুফোঁটা ঝরলো। নাক টেনে ঢোক গিললো মেহনূর। দু’হাতের তেলোয় সিক্ত চোখদুটো কঠিনভাবে ডলে মুছলো। বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে নিজেকে আবদ্ধ করলো সে, বেসিনের সামনে ট্যাপ ছেড়ে মুখে পানি ছিঁটা দিলো। হাতের কবজিদুটো ট্যাপের নিচে ধুতে থাকলে কানে দরজা খোলার শব্দ পেলো। একটুও বিচলিত না হয়ে ওয়াশরুম থেকে স্বাভাবিক ভাবে বেরুলো সে। আড়চোখে দেখতে পেলো, মাহতিম ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে কালো টিশার্টটা খুলে ফেলছে। সঙ্গে-সঙ্গে চোখ সরালো মেহনূর। তোয়ালেতে ভেজা মুখ মুছতে-মুছতে আলমারির কাছে গেলো। সোনালী রঙের হাতলটায় হাত রাখতেই পেছন থেকে কাঠ-কাঠ বলে উঠলো মাহতিম,
– কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কথা চললে সবসময় নক করে ঢুকতে হয়। কথাটা মাথায় রাখবে, দ্বিতীয় বার রিপিট করবো না।
সোনালী হাতলটা পাঁচ আঙ্গুলে খাবলে ধরলো মেহনূর। হাতলটা যদি নাজুক কোনো বস্তু হতো, তাহলে এখুনি সেটা গোড়া থেকে আলগা হয়ে যেতো। মেহনূর চোখ বন্ধ করে ভারী নিশ্বাস ছেড়ে একটানে দ্বার খুললো। শাড়ির ভাঁজ থেকে খয়েরি মোলাটের ডায়েরী টেনে বের করলো, পাশ থেকে নীল কালির কলমটা বের করতেই আবারও পেছন থেকে বলে উঠলো মাহতিম। এবার অনেকটা আদেশের সুরে সুক্ষ্ম দাপটে বললো,
– হোয়াইট স্ট্রিপের টিশার্টটা দাও।
একবার ভাবলো কথাটা আমলে নিবে না। পরক্ষণে চুপচাপ বাঁ-দিকের দ্বারটা খুলে টিশার্ট বের করলো মেহনূর। মাহতিম তখন শেভিং টুলস বের করতে ব্যস্ত। শেভিং ফোম, ইলেক্ট্রনিক রেজার, হেয়ার ট্রিমার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। মেহনূর টিশার্টটা হাতে না দিয়ে বিছানায় রেখে চলে যাচ্ছিলো। দরজার কাছাকাছি যেতে-না-যেতেই ওয়াশরুম থেকে প্রচণ্ড জোরে ঝংকার উঠলো,
– মেহনূর!
শব্দের তীব্রতায় টালমাটাল হলো সে। চোখ তুলে ওয়াশরুমের দিকে তাকাতেই আরেকবার চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম,
– কানে শুনতে পাও না?
ওয়াশরুমের খোলা দরজার দিকে তীব্র দৃষ্টি ফেলে এগিয়ে চললো মেহনূর। দুই মেরুর মধ্যে উত্তপ্ত হাওয়া ছুটাছুটি করছে। মধ্যবর্তী স্থূলতা কবে মিটে যাবে, কেউ জানে না এখন। একজনের মধ্যে অসম রাগের নিরবতা চলছে, অন্যজনের মধ্যে প্রকাশ্য ক্রোধের ছোবল ঝরছে। মাহতিমের মুখে অপ্রাসঙ্গিক কথা, ইঙ্গিতপূর্ণ খোঁচা, নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতি তিক্ত বিষ সবকিছু দেখে নতুনভাবে ভাবনায় ডুবেছে মেহনূর। হয়তো মাহতিম মুখে কিছু না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে মাহদির জন্য তাকেই দায়ী করছে। অব্যক্ত কথার আভাসে আজ পুরোপুরি সে এই বিষয়ে নিশ্চিত। তাই নিজের দিকটা নিয়ে সাফাই গাওয়ার জন্য সবকিছুই বৃথা লাগছে। অন্যদিকে মাহতিমের ভেতর শুধু এটুকু বিষয়েই রাগ, মেহনূর কেনো অভদ্র ভাবে কথাগুলো শুনলো। মাহতিম একান্তই নিজের মায়ের কাছে মনের ঝাঁজালো কথাগুলো ব্যক্ত করেছে। যে কথাগুলো শুধু মা-কেই অনায়াসে-নির্বিচারে বলতে পারে। সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে কেনো চুপ থেকে কথাগুলো শুনলো? এ কি সভ্য মস্তিষ্কের কাজ? কোনো বিবেক-বুদ্ধির মানুষ এসব করে? কথাগুলো হয়তো ওরকম মিনে বলেনি মাহতিম, কিন্তু কথার বিশ্রী ফলাটা বিশ্রীভাবে আঁচড় কেটেছে।
মেহনূর ওয়াশরুমের কাছে যেতেই মাহতিম তিক্ত গলায় বললো,
– টিশার্টটা আমার হাতে দেওয়ার কথা ছিলো। বিছানা থেকে তুলে ওটা এখানে নিয়ে এসো।
গালদুটোয় শেভিং ফোম লাগিয়ে মাহতিম ইলেকট্রিক সেকশন দেখছে। প্লাগটা সকেটের হোলে ঢুকাতেই মেহনূর টিশার্ট এনে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে টিশার্ট এগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আয়নায় গম্ভীর দৃষ্টি ফেলে বাঁহাতে রেজার চালাচ্ছে মাহতিম। মেহনূরের দিকে একবিন্দু লক্ষ্য না করে ওর দিকে ডানহাত এগিয়ে দিলো। মেহনূর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে টিশার্ট দিতেই হঠাৎ কবজি বিষিয়ে উঠলো। আকস্মিক ব্যথায় কপাল কুঁচকালো মেহনূর, কবজি ছাড়াতে ব্যস্ত হলে মাহতিমের চেহারায় তাকালো সে। হিংস্র জানোয়ার যখন খাদ্য পেয়ে নিষ্প্রভ অবস্থায় থাকে, মাহতিমের শান্ত মুখটা ঠিক তেমনই নিষ্ঠুর দেখালো! মেহনূর অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর ছোট্ট সুরে বললো,
– হাত না ছাড়লে আমি টিশার্ট ফেলে দেবো!
সরল হুমকি শুনে হঠাৎ হাসি পেলো মাহতিমের। এখুনি হাসির ছায়াটা মুখে পরলে বিপদ! চট করে নিজের ভঙ্গিমায় শক্ত আদল টেনে ফেললো। নরম কবজিটা টান দেওয়ার মতলব আঁটলো সে, এদিকে মেহনূর হাত ছাড়ানোর জন্য চরম পর্যায়ে ছুটাছুটি করছে। টিশার্টটা একপর্যায়ে হাতের মুঠো থেকে ছেড়ে দিলো মেহনূর। কবজি ছাড়াতে না পেরে আচানক এক ঝটকা মারলো। ঘটনার ক্ষিপ্ততায় ব্যালেন্স বিগড়ে কবজি ছাড়লো মাহতিম, সাথে-সাথে অস্ফুট আর্তস্বরে চোখ খিঁচে ফেললো! মেহনূর নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেও মাহতিমের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ডানহাতের কবজিটা বাঁহাতে বুলাতে গিয়ে আচানক স্থির হলো সে। আশ্চর্য! শেভিং ফোমটা লাল হয়ে যাচ্ছে না? তখনই চোখ খুলে নিচে তাকালো মাহতিম, ফ্লোরে দুই ফোঁটা লাল বিন্দু পরে আছে। তার বাঁহাতের রেজারটায় সেই ছোপ-ছোপ নমুনা লেগে আছে। রেজারটার দিকে দৃষ্টি রেখে ডানহাতের তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে দু’বার ইশারা করলো। সোজা অর্থ হলো, ‘ বেরিয়ে যাও ‘, ‘ আমার চোখের সামনে থেকে এক্ষুনি দূর হও । ‘
.
ফুটন্ত পানিতে চায়ের লিকার ছাড়লো মেহনূর। চুলার আঁচটা কমিয়ে দিয়ে রুটির কাজটা দেখতে লাগলো। রান্নাঘরের একপাশে পেঁয়াজে ছুড়ি চালাচ্ছে সুরাইয়া। পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখ দিয়ে পানি পরছে, একটু পরপর সর্দি লাগার মতো নাক টানছে। অন্যপাশে সবজি কুটতে সাহায্য করছে সাবা। শানাজের হাতেও আজ রুটি বেলার চাকরি জুটেছে। চার বোন সবাইকে ছুটি দিয়ে নিজেরাই সবার জন্য নাস্তার আয়োজন করছে। পেঁয়াজ কাটার অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসলো মেহনূর। সুরাইয়ার দিকে হাপিত্যেশ করে বললো,
– বুবু ছুড়িটা আমার কাছে দাও। আমি কেটে দিচ্ছি। তুমি এসে চা-টা দেখো।
সুরাইয়া ক্ষীণ স্বরে বাধা দিলো,
– তুই আমার সামনে হাসবি না বলে দিচ্ছি। আমার অবস্থা দেখে হোহো মেরে হাসছিস লজ্জা করেনা? যা অন্য কাজ কর! তোর পেঁয়াজ আমি কাটতে পারবো।
সুরাইয়ার কথা শুনে পাশ থেকে বললো সাবা,
– বুঝলি সুরাইয়া, ভ্যাবলাটা পাক্কা সংসারী হয়ে গেছে। এজন্য আমাদের ভুলচুক দেখে ভ্যা-ভ্যা করে মজা নিচ্ছে। এগুলো খাঁটি হারা:মি বুঝলি। থাক, এদের কথায় কান দিস না। কাজ কর।
দু’বোনের ঠাট্টামস্করায় আরো হেসে উঠলো মেহনূর। এখানে আসার পর থেকে বোনে-বোনে মিল বেড়েছে। আগের মতো সেই চুলোচুলি স্বভাব নেই। ঝগড়া নিয়ে মাতামাতি নেই। সবার মধ্যে মিল-মহব্বতের আমোদটা জোরদার ভাবে এসেছে। একসময় সুরাইয়ার জ্বালাতনে মেহনূর প্রায় কেঁদেই দিতো, আজ সেই সুরাইয়া কতো সুন্দর করে প্রতিটি কাজে সাহায্য করছে। চোখ জ্বলছে, নাক ঝাঁজাচ্ছে, তবুও টু শব্দটি করেনি। ছুড়ি চালাতে পটু নয়, তবুও সুরাইয়া পটুতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরে এই তিনবোনের সখ্যতা দেখে মেহনূর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। দাদাভাই নেই, তবুও কোনোকিছু বিগড়ে যায়নি। সম্পর্কগুলো যেনো আগের তুলনায় মজবুত হয়েছে, যেটুকু ফাটল ছিলো সবটুকু ঘুচে গেছে। মেহনূর চায়ের কাপ নামাতে থাকলে হঠাৎ শেফালি এসে হাজির হলো। চুলার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমারে এক কাপ চা দিবি? সক্কাল-সক্কাল চা খাইলে পরানডা কি যে শান্তি লাগে, কইবার পারুম না।
মেহনূর ফিচেল হেসে শেফালির কাপটা আগে রেডি করলো। দুধ-চিনি মিশাতেই বললো,
– নিমকি দেই? নাকি বিস্কুট খাবেন?
খুশীতে-আমোদে গদগদ হয়ে শেফালি বলে উঠলো,
– আমারে ভালা করিয়া চা-ই দে। নিমকি খাইবার পারি না। এহন হাবিজাবি খাইলে নাস্তা খাইতে কষ্ট হইবো।
মেহনূর তাতে সায় জানিয়ে চুপচাপ চা বানাতে লাগলো। মেজমা এখন আগের মতো তিরিক্ষি মেজাজে থাকে না। বিষবাক্য দিয়ে অন্যের মনে দগ্ধ তৈরি করে না। দাদাভাইয়ের সমস্ত কূটকর্ম সম্বন্ধে যেদিন জানতে পারলো, সেদিন থেকেই বড়মার ভয়ে-ভয়ে বদলে গেছে সে। বড়মার মধ্যে যেই আদর্শগত নীতিনিষ্ঠতা আছে, সেটা দেখে ধীরে-ধীরে সবাই কাবু হয়েছে। বর্তমানে গ্রামের মোল্লা বা মোড়ল অবশ্য বুজুর্গ ব্যক্তি হয়েছে, কিন্তু আজতিনি বড়মার কাছে শলা-পরামর্শ নিয়ে কাজ করে থাকেন। বড়মা সকলের কাছে মায়ের মতো, বোনের মতো ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। সম্মানের জায়গাটাও উনার কম নয়। মেহনূর কাপের তলায় পিরিচ বসিয়ে চা এগিয়ে দিলো। শেফালী সেটা দুহাতে ধরে প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
– তোর চা-ডা খুব মজা হয়। মনে কিচ্ছু লইস না, পারলে বিকালে এই বুড়িরে এক কাপ চা দিস।
বলেই গরম চায়ে ঠোঁট ঠুকলো শেফালি। সুড়ুৎ করে এক চুমুক খেয়ে আবার বলে উঠলো,
– জামাই কই রে? সক্কালতে হেরে দেহি না। নাস্তা-পানি কিছু দিছিলি? নাকি পোলাডায় খালি পেডে বাইরে গেছে?
একটু বিব্রত মুখে হাসি দিলো মেহনূর। ভোরের ওই ঘটনার পর আর মুখদর্শন হয়নি। মাহতিম নিজ থেকেই দেখা দেয়নি। অন্যসময় হলে রান্নাঘর থেকে সবাইকে তাড়িয়ে নিজে আড়ি গেঁড়ে বসতো। শেফালির উত্তরে স্বাভাবিক মুখে বললো, মাহতিম বাইরে দৌঁড়াতে গিয়েছে। শেফালি রান্নাঘর থেকে চলে গেলে নাস্তার বন্দোবস্ত সারলো। সব আইটেম ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে এসে দুপুরের খাবারে ব্যস্ত হলো। সংসারী হলে বুঝি এই এক দুশ্চিন্তা! আজ কি রান্না করবো? কোন পদ করবো? খাবারটা সবার ভালো লাগবে? সবার খাওয়া শেষে খেতে যাবে মেহনূর। সিঙ্কের নিচে গ্লাস ধুচ্ছে সে, তখনই পেছন থেকে ব্যস্ত পায়ে শানাজ এসে ঢুকলো। খালি জগটা ভরার জন্য ফিল্টারের ট্যাপ ছাড়তেই বললো,
– মেহনূর, ভাইয়ার অবস্থা দেখেছিস? উহঃ! দৃশ্যটা মনে পরলেই গা ঝাঁড়া দেয়! রেজারটা কেমন ভাবে ডেবেছে একবার ভাব? পানি দিয়ে আসতে গেলাম। তখন দেখি ওই অবস্থা। তুই চটপট হাতের কাজটা সেরে খেতে আয়। তোর শ্বাশুড়ি কিন্তু চেঁচাবে।
জগটা পানিভর্তি করে চলে গেলো শানাজ। রান্নাঘরটার ভেতর শূন্যতা ছেড়ে গেলো সে। মেহনূর মুখ ফিরিয়ে খালি দরজাটার বাইরে তাকালো। মাহতিমকে এখান থেকে যাচ্ছে না। তার মানে মাহতিম খেতেও নামেনি। বেখাপ্পা ধাক্কাটার জন্য ধিক্কার দিতে মন চাইছে! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ! মানুষ যে রাগের বশে পশুর মতো বিকৃত হয়ে যায়, এটাই তার নিকৃষ্ট উদাহরণ!
.
কোকের বোতল নিয়ে স্টাডি চেয়ারে বসলো মাহতিম। রুমটার মাহদির। দেয়ালে-দেয়ালে মাহদি নিশানা আজও লেগে আছে। টুকরো-টুকরো স্মৃতিগুলো রুমটার ভেতর আবদ্ধ। মাহতিম বহুদিন পর মাহদির বদ্ধ রাজ্যে ঢুকলো। এখনো রুমটার বাতাসে যেনো মাহদির গন্ধ রয়ে গেছে। মিঠে ঘ্রাণটা জোরে নিশ্বাস নিলে একটু-আধটু টের পাওয়া যায়। আবার এটা ভ্রমও হতে পারে। ডেষ্কটপ অন করে নিজের অফিশিয়াল পিসির সাথে কানেক্ট করে নিলো। ইন্টারনেট কানেকশানটা চেক দিয়ে কিছু মেইল দেখতে থাকলো। না, কিছু আসেনি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেই ডান পকেটে বিপ্ করে উঠলো। পকেট থেকে ভাইব্রেট ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনে দেখলো ‘ সৌভিক ‘। কলটা রিসিভ করে সাদা এয়ারপডে কানেক্ট করলো মাহতিম। ওপাশ থেকে সৌভিকের হাসিমাখা গলা এলো,
– আছিস কোথায়? বাসায়, না বাইরে?
মাউস নাড়িয়ে কাজ করতেই জবাব দিলো মাহতিম,
– বাসায়, বাসায়। বাইরে কেন যাবো?
সৌভিক কথাটায় মজা পেয়ে বললো,
– এহহে রে! ভুলে গেছি দোস্তো, ভুলে গেছি। বাড়িতে মৌচাক থাকলে তুইতো অন্য জায়গায় ঢুঁ মারবি না।
হাসির আভাটা কপটভাবে মিলিয়ে গেলো মাহতিমের। গোমড়া মুখে বললো,
– কথার লিমিটটা পজিশন মতো রাখিস সৌভিক। ত্যাঁড়াব্যাকা বিশ্রী ইঙ্গিত আমার সহ্য না।
সৌভিক উলটাটা বুঝে বেঢপ হেসে উঠলো। তার যেনো হাসিই থামছে না। এয়ারপডের ওয়ারলেস কানেকশনে সব শুনছে মাহতিম। কপট রাগ দেখিয়ে বলে ফেললো,
– আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ হ সৌভিক! আমার কিন্তু সত্যিই ভালো লাগছে না!
হাসিটা ঠেলেঠুলে সামলালো সৌভিক। গলাটা হালকা একটু খাঁকাড়ি দিয়ে বললো,
– চল বন্ধু, ম্যাচিং ম্যাচিং শেরওয়ানি পরি। পরবি?
মাহতিম তীর্যক ভাবে বললো,
– তোর মাথার তারগুলো এই লেভেলে নষ্ট হয়েছে জানতাম নাতো! আমাকে কোন্ এ্যাঙ্গেলে ব্যাচেলার পেলি? ঠিকঠাক মতো কাজটা সারলে বউ এতোদিনে প্রেগনেন্ট হয়ে যেতো। এদিকে তুই শেরওয়ানির জন্য ফোর্স করছিস? বা:টপার দেখেছি, তোর মতোন বা:টপার দেখিনি।
হো-হো করে দু’কানে হাসির আওয়াজ এলো। সৌভিকের হাসি শুনে একদিকে রাগও লাগছে, অন্যদিকে ভালোও লাগছে। একি যন্ত্রণা! মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে মৃদ্যু হাসলো মাহতিম। তখনই স্ক্রিনের উপর মেইলের নোটিফিকেশন এলো। ‘ আন-রিড ‘ মেইলটা দেখে সেখানে ক্লিক করলো মাহতিম। বাফারিং করতে-করতে ওপাশ থেকে বললো,
– তুই যাই বল, যেটাই বল, তুইযে আজীবন ব্যাচেলারের খেতাবে থাকবি, এটা তোকে গ্যারান্টি দিয়ে বলছি। তুইতো চান্দু পালটাবি না। যেই ফিগার করছিস, ওটার জন্য আরো দশ বছর ফুড়ুৎ! মাহতিম, কবে চাচ্চু ডাক শুনাবি? আরো টাইম নিবি?
– যখন শোনা শুরু করবি, তখন বছর-বছরই শুনতে থাকবি। অপেক্ষা কর।
বাফারিং শেষে মেইল ওপেন হলো। মেইলের প্রথম লাইন দেখে কপালে অসংখ্য ভাঁজ পরলো তার! কৌতুহল হয়ে নিচের ঠোঁটটা জোরালো ভাবে কামড়ালো। মাউসে হাত রেখে স্ক্রিনের লেখাটা মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলো মাহতিম। শুধু পড়েই গেলো। মুখ দিয়ে কথা বেরুনোর অবস্থা নেই।
সৌভিক কিছুক্ষণ চুপ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না। কলটা কেটে গেলো নাকি? কান থেকে ফোন নামালো, স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো, এখনো ডিউরেশন চলছে। কানে ফোন লাগিয়ে ফের সাড়া চাইলো সৌভিক। বারবার বলতে লাগলো, ‘ হ্যালো? দোস্ত তুই শুনছিস? রাগ করলি দোস্ত? মাহতিম, তুই শুনছিস? হ্যালো? নেটওয়ার্ক কি সমস্যা দিচ্ছে? ‘ কথার মধ্যেই সাংঘাতিক ভাবে ভড়কে গেলো সৌভিক! পরপর সজোড়ে কয়েকটা ঘুষি মারার আওয়াজ হলো! এরপর সব সুনশান। সাড়া নেই, শব্দ নেই, ঝিঁঝি পোকার মতো শূন্য অবস্থা! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলো সৌভিক! কিছুক্ষণ পর কান থেকে আস্তে-আস্তে ফোন নামিয়ে ফেললো। সে কি অস্পষ্ট ভাবে ঠিক শুনলো? মাহতিম কি আসলেই ‘ আই এ্যাম সরি সৌভিক। কান্ট এ্যান্টেড দ্যা ওয়েডিং ‘ বলেছে?
চলমান .
#FABIYAH_MOMO .