মরুর বুকে পুষ্পপরাগ পর্ব-২৭+২৮+২৯+৩০

0
804

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৭)

আবেগ ও বিবেক আলাদা হয়ে গেলে, সিদ্ধান্ত নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে। স্বর্ণলতার কাছে এখন চাঁদনিবু আবেগে পরিণত হয়ে পড়েছে। উত্তাপ শরীর, ফোলা মুখ, ক্লান্ত চাহনি, দুর্বল শ্বাস এসব কিছুকে মায়ার পৃথক পৃথক সুতো বোধ হচ্ছে। ভীষণ শক্ত ও মজবুত প্রতিটি সুতো। মিলেমিশে বেঁধে রাখতে চাচ্ছে স্বর্ণলতাকে। তার বার বার মনে হচ্ছে এই বাঁধন থেকে জোর করে মুক্ত হলে, অসুস্থ মেয়েটির শ্বাস আটকে যাবে। একনিষ্ঠ সেবা ও ভালো চিকিৎসার অভাবে মৃ ত্যু কোলে ঢুলে পড়বে। স্বর্ণলতা পেছন ফিরল। তার রুমের দরজাটা খোলা। আলো নেভানো। জানালা খোলা হয়নি এখনও। দরুন রুমের ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, ঝাপসা দেখা যাচ্ছে সবকিছু। কলি নিজের পাটি ভাঁজ করছে। স্বর্ণলতা গলা ছাড়ল,
” কলিবু? জানালা খুলে দেও। ঘরে আলো-বাতাস না ঢুকলে, চাঁদনিবু আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। ”

সে চমকে তাকাল। পরক্ষণে তটস্থ হলো। পাটি ফেলে দিয়ে অনুগতার মতো বলল,
” এহনই খুলতাছি, রানিসাহেবা। ”

স্বর্ণলতা বাইরে থেকে দেখল, কলি জানালার কাছে ছুটে যাচ্ছে। প্রথমে পর্দা সরাল, পরে পাল্লা দুটো দুইপাশে টেনে নিল। নিমিষেই আলো ও বাতাসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠল রুমটা। কলির ছায়ার মতো শরীরটাও এখন দৃশ্যমান ও রঙিন হয়ে ওঠেছে। পরবর্তী আদেশপ্রাপ্তা হওয়ার জন্য এগিয়ে এলো দরজার কাছে। মাথা ও দৃষ্টি অবনত। আঁচলখনি মাথায় প্যাঁচানো। স্বর্ণলতা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো তার নিকট। থুতনি ছুঁয়ে মাথাটা তুলে দিল। কলির সম্পূর্ণ দেহ কেঁপে ওঠল। চাহনি বিভ্রান্ত, মনিজোড়া চঞ্চল, ঘন ঘন পলক পড়ছে।

” কী হয়েছে? এত কাঁপছ কেন? আমার হাত কি অনেক ঠাণ্ডা? ”

সে হাতটা নিজের গালে স্পর্শ করল। একদমই ঠাণ্ডা না। ঈষদুষ্ণ, কোমল। কলির দিক থেকে উত্তর আসেনি এখনও। স্বর্ণলতা জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চাইতে কলি বলল,
” ঠাণ্ডা না তো, গরম। অনেক নরমও। কচি হাত তো! ”
” তোমার কণ্ঠও কাঁপছে! কলিবু তুমিও কি অসুস্থ হলে? দেখি, জ্বর-টর এলো নাকি আবার! ”

সে সত্যি কলির কপালটা স্পর্শ করল। আঁচল সরিয়ে গলাটাও স্পর্শ করল। কিন্তু মতামত জানাতে হলো না। কলি সামান্য দূরে ছিটকে গেল। আগ বাড়িয়ে বলল,
” আমার কিছু হই নাই, রানিসাহেবা। পুরা সুস্থ। ”
” তাহলে দূরে দূরে থাকছ কেন? তাকাও আমার দিকে। গত রাতেও তো অন্য রকম ছিলে। ”

সে এক ঝলক চাইল, স্বর্ণলতার মুখে। মুহূর্তেই দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
” আজ আপনারে অন্যরকম লাগতাছে। কী পোক্ত গলা! তাকানোর ভঙ্গিও বদলাইয়া গেছে। চোখ দুইডা নিচা হইতে বাধ্য। আজকা বিশ্বাস হইল, ছার সত্যই বিয়া করছে। বাড়িতে নতুন বউ আইছে। ”

এবার স্বর্ণলতাও বিভ্রান্ত হলো। আড়ষ্ট হলো দেহভঙ্গি ও কণ্ঠনালি। চুপ হয়ে গেল আচমকা। মুখজুড়ে দ্বিধার মেলা বসেছে যেন! কলি প্রশ্ন করল,
” আপনি তো, ছারের থেইকাও বেশি সুন্দর কইরা কথা কইতে পারেন। এতদিন কন নাই ক্যান? এহন তো আমার বিশ্বাসই হইতাছে না! স্বপন মনে হইতাছে। ”

স্বর্ণলতা একটু যেন থমকাল! নীরবে স্থির চেয়ে আছে কলির মুখপানে। সহসা হেসে ওঠল। চাপা হাসি! চোখদুটিতে দারুন উচ্ছাস, আমোদ। তার এই হাসি ও চাহনির ভঙ্গিতে কলি থতমত খেল। জিজ্ঞেস করল,
” হাসেন ক্যান, রানিসাহেবা। আমি কি ভুল কিছু কইছি? ”

ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রেখে মাথা নাড়ল দুপাশে। অতঃপর বলল,
” না। কিন্তু ঐ যে কইলা না, পোক্ত গলা? ঐটা তো আমার না। আমার এক বান্ধুবীর। ওরে নকল করতাছিলাম এতক্ষণ। ”
” কী কন! ”
” হ গো, কলিবু। এক্কেবারে হাচা কথা। তুমি অন্ধকার ঘরে পাটি ভাঁজ করতাছিলা যখন? তখন ঐ বান্ধুবীটার কথা মনে পড়ছিল। একদিন আমি মেলা অসুখে পড়ছিলাম। দুইদিন স্কুলে যাইতে পারি নাই। ওর লগে দেখাও করতে পারি নাই। পরে ওই আইছিল, আমার লগে দেখা করতে। আমি পাটির মধ্যে শুইয়া ছিলাম। ওই আইসা আমারে তুলছে, এমন পাটি ভাঁজ করতে করতে আমার মারে কইছিল, ‘ আন্টি, জানালা খুলে দেন। রুমে আলো-বাতাস না ঢুকলে স্বর্ণা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। ‘ তারপরে ওই ডাক্তার ডাইকা আনছিল। ফিস লাগে নাই। কও তো, ফিস লাগে নাই ক্যান? ”
” ক্যান? ”
” ঐ ডাক্তার ওর বড় ভাই ছিল যে তাই। অনেক বড় ডাক্তার! ”

ঘটনাটা বলার সময় স্বর্ণলতার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠছিল। ডাক্তারের কথা আসতে সেই উজ্জ্বলতা আরও প্রকট হলো। আচমকা মাথার মধ্যে বুদ্ধি খেলে গেল। মুখ বাড়িয়ে রুমের ভেতর উঁকি দিল। চাঁদনি ঘুমাচ্ছে। কপালের উপর পট্টিটা শুকিয়ে আলগা হয়ে আছে। স্বর্ণলতা মাথা ফিরিয়ে আনতে আনতে বলল,
” কলিবু, রান্নাঘরে যাও। নাস্তা বানাও। চাঁদনিবুর ঘুম ভাঙলেই কিছু খাওয়াইতে হইব। খালি পেটে ঔষধও কাজ করে না। ”

কলির দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা করল না। দাদিজানের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। দ্বারমুখে পৌঁছাতে শুনল,
” রানিসাহেবা, আপনার বান্ধবীর নামডা তো কইলেন না! ”

স্বর্ণলতা থেমে গেল। মুখটা পেছনে ঘুরিয়ে মিষ্টি হেসে উচ্চারণ করল,
” বেহালা। ”
” হিন্দু? ”
” না। ”

কলির আগ্রহ ও কৌতূহল এখানেই সমাপ্তি টানল। রানিসাহেবার আদেশমতো রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াবে তখনই স্বর্ণলতা পেছন ডাকল,
” কলিবু? ”
” জি? ”
” হঠাৎ কইরা আমারে রানিসাহেবা ডাকতাছ ক্যান? ”
” ছার কইছে। ”
” আর ডাকবা না। আমি দেখতে রানিদের মতো সুন্দর না। কোনো রাজার সাথে বিয়াও হই নাই। হয় নাম ধইরা ডাকবা নাহয় রুমকিবুর মতো আপামনি ডাকবা। ”

_______
দাদিজানের নামাজ শেষ। কোরআন তেলাওয়াত করছেন। স্বর্ণলতা চুপচাপ বসে আছে তার বিছানায়। চোখ বুঁজে নিবিষ্টমনে তেলাওয়াত শুনছিল, হঠাৎ শুনতে পেল,
” কী সিদ্ধান্ত নিয়েছ? থাকবে নাকি চলে যাবে? ”
” চইল যামু। ”

খাইরুন নিসা কুরআন শরীফে চুমু দিচ্ছিলেন। উত্তর শুনে চমকে তাকালেন। হাতটাও কাঁপল সামান্য! মেয়েটা ছোট, অবুঝ। বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন, পরবর্তী সময়টা ভালো যাচ্ছে না। মুনছুরের মধ্যে পরিবর্তন আসেনি, স্বর্ণলতার মধ্যেও না। দুজনের কেউই কোথাও ছাড় দিচ্ছে না। মানিয়ে নেওয়ার মতো মনোবল তৈরি করতে পারছে না। অথচ দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে হলে একে-অপরকে ছাড় দেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার মনোবল থাকা জরুরি। অতি আবশ্যিক পদক্ষেপ।
” ভেবে বলছ তো? ”
” জি। ”
” ভ য় হচ্ছে না? ”
” না। ”

খাইরুন নিসা গভীরভাবে তাকালেন নাতবউয়ের দিকে। কণ্ঠটা এতটা নির্ভয় ও নিঃসংকোচ যে, তিনি বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। কিছু মিনিট পূর্বেও এই মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল! ভ য়ে সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
” কতদিনের জন্য যেতে চাও? ”
” আমি তো সারাজীবনের জন্যই যাইতে চাই কিন্তু সেটা এখনই সম্ভব না। আরও সময় লাগবো। ”

খাইরুন নিসার বিস্মিত কিরণ আরও বেশি স্পষ্ট হলো। দৃষ্টিতে পড়ছে। স্বর্ণলতা উঠে দাঁড়াল। দাদিজানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,
” আপনার মোবাইলটা দিবেন? একটা জরুরি কল করতাম। ”

খাইরুন নিসার ভ্রূযুগল কুঁচকে এলো। চাহনিতে সন্দেহ। মুনছুর তাকে একটা মোবাইল দিয়েছিল। কিন্তু ব্যবহার হয় না। ড্রয়ারে পড়ে আছে। স্বর্ণলতা নিজ থেকেই পুনরায় বলল,
” মোবাইলের কথা বলেন নাই, আমি দেখিও নাই। তাও জানি, আপনার কাছে একটা মোবাইল আছে। ”
” কীভাবে জানলে? ”
” বুদ্ধি দিয়া জানছি। চাঁদনিবুর মুখে শুনছি আপনি তারে একটা মোবাইল উপহার দিয়া কইছিলেন, দরকারে যোগাযোগ করতে। আপনার কাছে যদি মোবাইল না থাকে যোগাযোগ ক্যামনে করবো? আছে বলেই তো কইছেন! ”

তিনি আশ্চর্য হলেন। মেয়েটাকে যতটা নির্বোধ ভেবেছেন ততটাও না। মুখে বেশ বুলিও ফুটেছে! এই পরিবর্তনটা কি মায়ের কাছে যাচ্ছে সেই আনন্দে হলো?

” দাদিজান, খুব জরুরি। দিন না। বেশি ট্যাকা খরচ করমু না৷ ”

খাইরুন নিসা মোবাইল বের করে দিলেন। স্বর্ণলতা এর আগেও মোবাইল দেখেছে কিন্তু দূর থেকে। হাত দিয়ে ছোঁয়া হয়নি। আজই প্রথম স্পর্শ করল। উপরের বাটনগুলোতে চোখ বুলিয়ে অসহায়ভাবে বলল,
” আমি তো কল করতে পারি না। আপনি কইরা দিবেন? ”
” নাম্বার আছে? ”
” আছে। ”
” দাও। ”

দাদিজানের বিছানার উপরে খাতা ও কলম রাখা। মুনছুর সাখাওয়াত দিয়ে গিয়েছে স্বর্ণলতার জন্য। সে এই খাতা ও কলম ব্যবহার করল। মুখস্থ করা নাম্বারটা লিখে দিতেই দাদিজান কল করলেন। স্বর্ণলতা কানে ধরল। ওপাশ থেকে গলাটা ভেসে আসতে স্বর্ণলতা বলল,
” হাদিভাই, আমি স্বর্ণলতা। চিনতে পারছেন? ”
” হ্যাঁ। মোবাইলে কল দিয়েছ যে! কোনো সমস্যা? ”

স্বর্ণলতা উত্তর দিল না। দাদিজানের দিকে তাকাল। তিনি তার দিকেই চেয়ে আছেন। মুখজুড়ে অদম্য আগ্রহ ও জিজ্ঞাসা। সে ফিসফিসে অনুরোধের মতো বলল,
” আমি একটু বাইরে যাই? ”
” কেন? ”
” উনারে দুইটা প্রশ্ন করতাম। ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আপনার সামনে কওয়া যাইব না। ”

খাইরুন নিসা রা গ করতে চেয়েও পারলেন না৷ বিরক্তের হালকা ভাব ফুটে ওঠল শুধু। কী দারুনভাবে সত্যি বলে সত্যতা গোপন করতে চাচ্ছে! তিনি সম্মতিতে মাথা নাড়তেই স্বর্ণলতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সোজা হেঁটে গেল বারান্দায়। এখানে সচরাচর কেউ থাকে না। ঘরের মানুষগুলো খুব একটা বাইরে আসে না, বাইরের মানুষের তো ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই।

” হ্যালো, স্বর্ণা? লাইনে আছ? ”

ড. হাদির ধৈর্য ভেঙে গিয়েছে। কণ্ঠে উৎকণ্ঠা, ব্যাকুলতা। স্বর্ণলতা জবাব দিল,
” জি, আছি। ”
” তাহলে কথা বলছ না কেন? ”

এই প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে হলো না৷ সময়ও নেই। সে চটজলদি বলল,
” এই বাড়িতে আইতে পারবেন? খুব দরকার ছিল। ”
” এখন? তোমার কিছু হয়েছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” চাঁদনিবু খুব অসুস্থ! ডাক্তারের চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ হইব না। ”

ঐপাশটা নীরব হয়ে গেল। স্বর্ণলতা উত্তরের অপেক্ষা করছে না। বেশিক্ষণ ধৈর্য টিকল না। ডাকল,
” হাদিভাই? ”
” সরি, স্বর্ণা। আমি ঠিক করেছি, ঐ বাড়িতে কখনও যাব না। ”
” কেন? ”
” এই উত্তরটা এখন দিতে চাচ্ছি না। ”
” শুধু আজ আসেন, তারপর আর আইসেন না। হইবো না? ”
” না, হবে না। যদি তুমি অসুস্থ হতে তাহলে ভাবতাম। কিন্তু চাঁদনি…”

ড. হাদির বাক্যটা অসমাপ্তই থেকে গেল। স্বর্ণলতা হাল ছাড়ল না। অনুরোধ করেই যাচ্ছে। শেষে বাধ্য হয়ে বলল,
” আচ্ছা, বাড়ির ভিতরে আইতে হইব না। গেইটে আইসা ঔষধ দিয়া যান। আপনি তো জানেনই, গ্রামের ভেতরে কোনো ঔষধের দোকান নাই। ”
” আচ্ছা, দিয়ে যাব। তার আগে বলো, চাঁদনির কী হয়েছে। ”

স্বর্ণলতা একে একে সব সমস্যার কথা উল্লেখ করল। ড. হাদি বুঝা শেষে বলল,
” আমি গেইটে এসে কল দিব। তুমি এসে ঔষধ নিয়ে যেও। ”
” কখন আসবেন? ”
” ঘণ্টা দুয়েক তো লাগবেই! আমি হসপিটালে আছি। ”
” তাইলে আমারে পাবেন না৷ আপনি দারোয়ান চাচার কাছে দিয়া যাইয়েন। আমি কইয়া দিমু নে। ”
” তুমি কি কোথাও যাবে? ”

স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কান থেকে মোবাইল সরিয়ে আনল। দেখল, চার মিনিট শেষ হয়ে গিয়েছে অথচ আসল প্রশ্নগুলো করা হয়নি।

” স্বর্ণা? শুনতে পাচ্ছ? ”

সে চট করে মোবাইলটা কানে নিল। এই মানুষটার সাথে তার দেখা হয়েছে মোট তিনবার। খুব সামান্য কথা হয়েছে। তারপরও কত আপন বোধ হচ্ছে! কথা বলে আরাম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, নিজের বাড়ির কারও সাথে কথা বলছে। এর কারণ কী? স্বর্ণলতার ভাবনার মধ্যে ড. হাদি আরও একবার ডেকে ওঠল। ঠিক তখনই উত্তরটা পেয়ে গেল। ‘ স্বর্ণা ‘ নামটা তার বাড়ির লোক ও আশপাশে ভালো পরিচিত আছে এমন মানুষরাই ডাকে। বাকি সবাই স্বর্ণলতা ডাকে। স্কুলের বান্ধুবীদের মধ্যে কেউ কেউ লতাও ডাকে।

” আপনাকে একটা প্রশ্ন করি? ”
” করো। ”
” উত্তর দিতেই হইব কিন্তু। ”
” আচ্ছা, দিব। ”

স্বর্ণলতা একটু থামল। সতর্ক দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনল আশপাশের পুরোটায়। তারপরে ধীরে সুধাল,
” আপনি চাঁদনিবুরে কবে থেইকা চিনেন? ”
” এটা জেনে তোমার কী কাজ, স্বর্ণা? ”
” পরে কমু। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। ”

হাদি কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে উদাস গলায় জানাল,
” খুব ভালো করে চিনি যে এরকম নয়। তবে উনি আমার প্রথম পেশেন্ট ছিলেন। তখন আমার এমবিবিএসের কোর্সও শেষ হয়নি। ইমম, পাঁচ বছর তো হবেই। ”
” পাঁচ নাকি ছয়? ভালো করে মনে করেন। ”

ড. হাদি আবারও চুপ হয়ে গেল। সময়ের হিসেব চলছে মস্তিষ্কে। সহসা নীরবতা ভেঙে বলল,
” হ্যাঁ, ছয় বছরের কাছাকাছি হবে৷ তুমি জানলে কী করে? ”
” আপনি প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি শুধু উত্তর দিবেন। ”

তার কণ্ঠে সামান্য বিরক্ত ও রা গের ছোঁয়া। ড. হাদি টের পেয়ে হেসে ওঠল। সেই হাসির শব্দ এপাশেও আসছে। স্বর্ণলতার বিরক্ত আরও বাড়ল,
” কী আশ্চর্য! আবার হাসেন ক্যান? ”
” এমনি। পরের প্রশ্নটা বলো। ”

সে একটুও দেরি করল না। জিজ্ঞেস করল,
” কী চিকিৎসা করছিলেন? চাঁদনিবুর কী হয়ছিল? ”
” তোমাকে বলা কি ঠিক হবে? বুঝবেও না। ”
” বুঝমু না ক্যান? ইংলিশ কিছু? আমি ইংলিশও ভালো বুঝি। বিশ্বাস না হলে বেহালারে জিজ্ঞেস কইরেন। ”
” আহা, ইংলিশ বা বাংলা কিছু না। ওটা অন্য বিষয়। তোমার বয়স কম। বুঝবে না। ”
” কম বয়সে বিয়া হইতে পারলে অন্য বিষয় বুঝমু না ক্যান? আপনি কন তো। বুঝার দায়িত্ব আমার। ”

ড. হাদি নিশ্চুপ। স্বর্ণলতা উত্তরের অপেক্ষা করছে। এক, দুই, তিন সেকেন্ড পেরুতেই ধৈর্য ভেঙে গেল। তাড়া দিল,
” কী হইল কন না ক্যান? ”
” বলছি, শুনো। চাঁদনি ম্যাডাম এবরশন করিয়েছিলেন। এবরশন বুঝো? ”
” না। কিন্তু বাচ্চা নষ্ট বুঝি। ওটাই তো? ”
” বাহ! ‘ ছোট মরিচের ঝাল বেশি ‘ প্রবাদটার মান তো ভালোই রাখছ। কোথা থেকে জানলে এসব? ”
” আবার প্রশ্ন করতাছেন! ”
” ওহ, সরি। ”
” আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো। ”
” কী? ”
” বাচ্চা নষ্টের চিকিৎসার জন্য চাঁদনিবু আপনার লগে যোগাযোগ করেছিল নাকি অন্যকেউ? ”
” অন্য কেউ। ”

স্বর্ণলতা কল কেটে দিল। দৌড়ে পৌঁছাল দাদিজানের রুমে। মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে বলল,
” দুই ঘণ্টা পরে ড. হাদি দারোয়ান চাচার কাছে ঔষধ দিয়া যাইব। দাদিজান, আপনি কি উনারে একটু কইয়া রাখবেন? ”
” তুমি কি সত্যি মায়ের কাছে যাচ্ছ? ”

স্বর্ণলতা বিছানা থেকে খাতা ও কলমটা তুলে নিয়ে বলল,
” জি। আপনি যাওয়ার ব্যবস্থা করেন, আমি চাঁদনিবুর লগে দেখা কইরা আসি। ”

_______
চাঁদনির ঘুম ভাঙেনি। স্বর্ণলতা তার পাশে বসল। উপুড় হয়ে খাতায় একটি চিঠি লিখল। সম্বোধনে লিখল,

‘ জনাব মুনছুর সাখাওয়াত,

আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আপনি ও চাঁদনিবু দুজনেই যে মিথ্যা বলেছিলেন এটা আমি ধরে ফেলেছি। পুরো মিথ্যা নয়, আবার পুরো সত্যও নয়। দুজনেই সত্য ও মিথ্যা মিশ্রণ করে আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছেন। আমি অনেক চেষ্টায় মিথ্যাকে সরিয়ে সত্যকে উদ্ধার করেছি। আপনাকে শুনাচ্ছি, দেখেন তো ঠিক আছে নাকি।

চাঁদনিবু ছোটকাল থেকে আপনাকে ভালোবাসে। নিখাঁদ ও প্রবল আবেগ মিশ্রিত সেই ভালোবাসা। কিন্তু সেই ভালোবাসা আপনার মন ছুঁতে পারেনি। নিষ্ঠুরের মতো বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন। একদিন এই ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেল। চাঁদনিবুর ভালোবাসায় আকৃষ্ট না হলেও তার দেহের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। চাঁদনিবু সেটা টেরই পেলেন না। ভালোবাসায় অন্ধ মেয়েটা বুঝতেই পারলেন না, তিনি ভালোবাসা না নারীর সবচেয়ে দামী সম্পদটায় আপনার কাছে সমর্পণ করে ফেলেছে। এর বিনিময়ে সে কিছু পাবে না! যতদিনে টের পেল, ততদিনে আপনি অন্য পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তিনি কান্নাকাটি করেও এই পরিকল্পনা নষ্ট করতে পারলেন না। বাধ্য হলেন আসমান ভাইয়ের জীবনে পা রাখতে। সেখানে যাওয়ার পর জানতে পারলেন, তিনি সন্তানসম্ভবা। খুশির সংবাদটা আপনাকেই প্রথমে জানালেন। চাঁদনিবু এখানেও ধরা খেলেন। আরও একটি পরিকল্পনা হলো। একচোট কান্নাকাটি হলো, জয়টাও আপনারই হলো। পেটের বাচ্চা পেটেই ম রে গেলে। চোখ মেলে পৃথিবী দেখার সৌভাগ্য হলো না! এবারের আঘাতটা আগের চেয়ে শতগুণ গভীর ও তীব্র যন্ত্রণার ছিল। যা সহ্য করতে গিয়ে আপনার প্রতি তার ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়ে গেল। চাঁদনিবু আপনাকে এতটায় ভালোবেসে ছিলেন যে, সেই ঘৃণা প্রকাশ করতে পারেন না। ভীষণ লজ্জা পান। ভাবেন, নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাচ্ছেন। নিজের ভালোবাসাকে বদনাম করছেন।

এই ঘৃণা লুকিয়ে রাখতে কত কষ্ট হচ্ছে জানেন? অনুভব করতে পারছেন? পারবেন না। কারণ, অনুভূতির আসল যন্ত্রটায় তো আপনার মধ্যে নেই! আপনি হলেন হৃদয়শূন্য মানব। আমি ঠিক করেছি, চাঁদনিবুকে এই অসহণীয় কষ্ট থেকে মুক্তি দিব। মুক্তি দেওয়ার একমাত্র পথ, আপনার ক্ষমা প্রার্থনা। আমার বিশ্বাস আপনি ক্ষমা চাওয়ামাত্র চাঁদনিবু কেঁদে ফেলবে। কান্নায় কান্নায় তার সকল দুঃখ দূর হবে৷ তারপরেই তার একটি ফুটফুটে সন্তান আসবে। যে দুই চোখ মেলে পৃথিবী দেখবে।

আমি মায়ের কাছে বেড়াতে যাচ্ছি। আমার চাওয় পূরণ করার পরই ঐ বাড়িতে ফেরত যাব। এখন আপনিই ঠিক করুন, কতদিন মায়ের কাছে থাকব।

ইতি
স্বর্ণলতা

পুনশ্চ: আমি এটাও বুঝতে পারছি ‘ আদুরী ‘ নামের কেউ আপনার খুব কাছের ও প্রিয়। কিন্তু সেই কেউ’টাকে আমি খুঁজার চেষ্টা করেছি, পাইনি। যেহেতু এই নামে পূর্বে কেউ ছিল তাই আমি মনস্থির করেছি, তার সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে আমি আদুরী হব কী হব না এর জবাব দিব না।

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৮)

স্বর্ণলতা চিঠিটা যত্নের সাথে ভাঁজ করে তাকাল চাঁদনির দিকে। সে এখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রোদের তাপ বাড়ছে। হাওয়ায় গরমের ছোঁয়া পড়ছে। খোলা জানালা দিয়ে এক ফালি রোদও ঢুকে পড়েছে ইতিমধ্যে। ছোট্ট একটা চিঠি লিখতে এত সময় লেগে গেল! স্বর্ণলতা বিস্মিত না হয়ে পারল না। সে হাত বাড়াল চাঁদনির কপালে। পট্টি সরিয়ে দেখল, ঘামে ভিজে গেছে৷ ভেজা কপাল ও গলা আঁচল দিয়ে মুছে দিল। অতঃপর নরম ও কোমল হাতটা রাখল মাথায়। পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” ঘুমাও। আরাম কইরা ঘুমাও। সারাটা রাত তো শুধু ছটফটায়ছ আর কানছ! এখন একটু শান্তিতে ঘুমাও। ”

স্বর্ণলতা উঠে গিয়ে পাখাটা ছেড়ে দিল। গতি সর্বোচ্চে বাড়িয়ে ফিরে এলো চাঁদনির কাছে৷ শিয়রে বসে ফিসফিসে বলল,
” এই অসুখের উছিলায় তোমার কষ্ট দূর হইয়া যাক। শরীরের কষ্টের লগে মনের কষ্টও দূর হইয়া যাক। চাঁদনিবু, তুমি শুধু ধৈর্য নিয়া শান্ত হইয়া থাকো। ”

সে আলতো করে কপালে চুমু খেল। চিঠিটা হাতের মুঠোতে আছে। বিছানা থেকে নামবে তখনই কনুই বাড়ি খেল শক্ত কিছুতে। বৈদ্যতিক শকের মতো অনুভব হলো। মুহূর্তেই সারাদেহ কম্পিত হলো, ঝিনঝিনে একটা ভাব থেকে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। স্বর্ণলতা চোখ, মুখ খিঁচে নিয়েছিল। প্রায় মিনিটের মতো সময় ধরে ওভাবে বসে থাকল। অতঃপর কনুইয়ের নিচে অন্য হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে তাকাল পাশে। শক্ত কিছুটার হদিস পেল সাথে সাথেই। গয়নার বাক্স! এটার কথা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। কী করবে এটার সাথে? এখানে রেখে যাবে কি? প্রশ্নটা মাথায় আসা মাত্র চুরি হতে পারে এমন আশঙ্কাও উদয় ঘটল। স্বর্ণলতা বাক্সসহ বিছানা থেকে নামল। দরজার কাছে পৌঁছাতে দেখল, দাদিজান বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দিকে দৃষ্টি পড়তে জিজ্ঞেস করলেন,
” শুধু এই বাক্সটায় নিবে? ”

সে বাক্সটা সামনে বাড়িয়ে ধরে বলল,
” এইটাও নিমু না, দাদিজান। আপনার কাছে রাইখা দেন। ”
” আমি রাখব কেন? এটা তোমার। ”
” হ, কিন্তু আমি তো মায়ের কাছে যাইতাছি। এমনে রাইখা গেলে যদি চুরি হইয়া যায়! আপনি কইছিলেন না, গয়নাগাটি সবসময় লুকাইয়া রাখতে? ”
” হ্যাঁ, বলেছিলাম। কিন্তু আমার কাছে লুকাতে বলিনি। স্বর্ণলতা, এই সম্পদের মালিক তুমি। রক্ষকও তুমি। তাই কীভাবে রক্ষা করবে, সেই উপায়ও তুমি বের করবে। আমার বয়স হয়েছে, স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হয়ে গেছে। কোথাও রাখার পর ভুলে গেলে? ”

স্বর্ণলতা অবাক হলো। কিছুদিন হবে বাক্সটা তাকে দিয়েছে। এর আগে খাইরুন নিসার কাছেই ছিল। এত বছরে ভুলেনি, আজকে রাখলেই ভুলে যাবেন?

” শরীরের যে অবস্থা! ম রেও যেতে পারি। তখন গয়না হারিয়ে এই বুড়িটাকে গালি দিতে এক মুহূর্তও দেরি করবে না। ”

স্বর্ণলতার চোখ বড় বড় হয়ে গেল প্রথমে। পরক্ষণে অসহায়ের মতো বলল,
” গালি দিমু না, দাদিজান। গয়নার উপরে আমার কোনো লোভ নাই। আপনি দিছেন তাই নিছি। না নিলে যদি রা গ করেন, গালের মধ্যে চ ড় মা রেন? এই ভয়ে নিছি। বিশ্বাস করেন আমারে। ”

খাইরুন নিসা ঠোঁট বাঁকালেন। তার অসহায় মুখ ও বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টাকে উপেক্ষা করে বললেন,
” মেয়ে মানুষের মনে আল্লাহ তিনটা জিনিস উজার কইরা দিছে। লোভ, হিংসা ও অহংকার। লোভের অর্ধেকটায় এরা এই গয়নার পেছনেই খরচ করে ফেলে। বুঝছ? আমার সামনে এই মিথ্যা কথাটা আর কখনও বলবে না। ”

স্বর্ণলতা কথাটাকে একদমই মানতে পারল না। প্রতিবাদ করার জন্য ঠোঁটদুটি কেঁপে উঠেও থেমে গেল। কেউ ডাকছে। উভয়ের কান সজাগ হলো। শব্দটা উড়ে আসছে উঠোন থেকে। খাইরুন নিসা চিনতে পেরে বললেন,
” তোমার গাড়ি চলে এসেছে। এই বাক্স নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হবে না। তোমার সাথে নিয়ে যাও। মা, বাবা দেখলে খুশি হবে। ”

স্বর্ণলতা সাথে নিবে না। যেই জিনিসটা এই বাড়িতে এত পীড়া দিচ্ছে, সেটা ঐ বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়া মানে পীড়ার ওজন বাড়ানো। সে গয়নার বাক্সের ঢাকনা তুলল। এরমধ্যে একটি চাবির গোছা আছে। তার মন বলছে, এই চাবি দাদিজান দেননি। মুনছুর সাখাওয়াত দিয়েছে। সে নিজের রুমের তালার চাবি ছাড়া আর কীসের চাবি দিবে? স্বর্ণলতা বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে গেল মুনছুর সাখাওয়াতের রুমের সামনে। সবসময়ের মতো আজও দরজায় তালা ঝুলছে। কয়েকবার চাবি বদলাতেই তালা খুলে গেল। স্বর্ণলতা ভেতরে ঢোকার পূর্বে সতর্ক দৃষ্টি রাখল মূল দরজাটিতে। দাদিজান উঠোনে নেমে গিয়েছিলেন, এখনও আসেননি। এই সুযোগে গয়নার বাক্স ও চিঠি এই রুমে রাখতে হবে। দুটোর মধ্যে একটিও অন্য কারও হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না।

_________
মুনছুর সাখাওয়াত দুপুরবেলাও বাড়িমুখো হয়নি। তার ভূমি কাঁপানো পদধ্বনি পাওয়া গেল রাতের বেলা। বাড়ির ভেতরে ঢুকে গলাটা এত শুকিয়ে গেল! বুকটাকে মনে হচ্ছে, উত্তপ্ত বালুচর। সে হেঁটে গেল খাবার টেবিলের কাছে। নিজ হাতেই গ্লাসে পানি ঢালল। গুণে গুণে তিন গ্লাস পানি খেল। তারপরেই পেটটা কেমন দুমড়েমুচড়ে ওঠল! মনে পড়ল, সারাদিনে কিছু খাওয়া হয়নি। ইচ্ছে হলো, এখনই খেতে বসে যায়। কিন্তু বসল না। সে রাতে বাড়ি ফিরে আগে গোসল করে। তারপরে খেতে ইচ্ছে হলে বা অন্য কোনো কাজ থাকলে রুম থেকে বের হয়। ঐ সময়টাতে দাদিজান সজাগ থাকলে বাইরে আসে, দেখা হয়, কথা হয়। অন্যথায় মুনছুর সাখাওয়াত সেধে গিয়ে কথা বলে না। অপ্রয়োজনে কথা বলা ও সময় নষ্ট করা দুটোই তার ভীষণ অপছন্দ।

মুনছুর সাখাওয়াত রুমের দিকে পা বাড়ালেও বেশিদূর এগুল না। চট করে ঘুরে দাঁড়াল। শানিত দৃষ্টিজোড়া ছিটকে গিয়ে পড়ল দাদিজানের পাশের রুমটায়। দরজা খোলা, আলো বেরুচ্ছে। পাখা চলার শব্দের সাথে ফিসফাস শব্দও ভেসে আসছে। তার মনের মধ্যেও আশার আলো জ্বলে ওঠল। সেই আলোতে স্বর্ণলতার মুখটা স্থিরচিত্রের মতো স্পষ্টভাবে ধরা দিয়ে আচমকা হারিয়ে গেল। এই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটাকে সে মেনে নিতে পারল না। এমনভাবে রুমটার দিকে ছুটে চলল যেন স্বর্ণলতার মুখটা তার সামনে দিয়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে! এক মিনিটের পথ পাঁচ সেকেন্ডেই পার করে ফেলল। সোজা গিয়ে দাঁড়াল খোলা দরজার সামনে। সরাসরি তাকাল রুমের ভেতর। স্বর্ণলতা নেই। খাটের উপর চাঁদনি শুয়ে আছে। পাশে দাদিজান। নিচে বিছানো পাটিতে কলি ও ময়না বসে আছে। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। ভীষণ চমকে আছে! মুনছুর সাখাওয়াত মুখ বাড়িয়ে দৃষ্টি এগিয়ে নিয়ে গেল স্নাগারের দিকে। দরজা বন্ধ, সিটকানি বাইরে থেকে লাগানো। তীব্র তৃষ্ণার্ত ভাবটা ফিরে এলো যেন! দাদিজানের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ও কোথায়? ”

খাইরুন নিসা উত্তর দিলেন না। চাঁদনির পাশ থেকে সরে এলেন। নাতির কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে দৃষ্টি পরিষ্কার লাগছে। মুখটা দেখা যাচ্ছে ভালো করে। দরদরে ঘাম ঝরছে। ভেজা মুখটায় কর্মক্লান্তের ছাপ স্পষ্ট। মুনছুর সাখাওয়াতের দৃষ্টি সরে গিয়েছে দাদিজানের রুমের দিকে। দরজার পাল্লা চাপানো, ভেতরটা দেখা যাচ্ছে না। সেদিকে চেয়ে বলল,
” ও কি তোমার রুমে? ”

কণ্ঠস্বর, চালচলন সবকিছুই শীতল থাকা সত্ত্বেও দাদিজান জিজ্ঞেস করলেন,
” তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াতের ঘাড় সোজা হলো। দৃষ্টি ফিরে এলো দাদিজানের দিকে। তারপরে নিজের দিকে চেয়ে বলল,
” কেমন? ঠিকই তো আছি। ”
” না, ঠিক নেই। ছেঁড়া শার্ট পরে আছিস। ”
” ধূর! ছেঁড়া শার্ট পরতে যাব কেন? এক বে জন্মাকে কো পানোর সময় শার্ট টেনে ধরেছিল তখন ছিঁড়ে গেছে। ”

উত্তর দেওয়ার সময় সে ছেঁড়া অংশ বরাবর হাত রেখেছিল। খামচে ধরে পুরো শার্টটায় টেনে ছিঁড়ে বলল,
” এই বালের কাজ করতে গিয়ে আজকে খাওয়ার সময় পাইনি। ক্ষুধায় তো চোখে অন্ধকার দেখছি! আমি গোসলে গেলাম, তোমার নাতবউকে বলো খাবার বাড়তে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত গোসলে চলে গেল। খেয়ালই করল না, তার দাদিজানসহ আরও তিনটি নারী ভ য়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে! খাইরুন নিসা উপলব্ধি করলেন, তৎক্ষনাৎ উত্তর না দিয়ে ভালো করেছেন। সকলের উদ্দেশ্যে আদেশ দিলেন,
” স্বর্ণলতা যে বাবারবাড়ি গেছে, এই কথাটা যেন মুনছুরের কানে না যায়। ”

কলি ও ময়না একসাথে মাথা নাড়ল। চাঁদনি মুখ বাঁকিয়ে নিল অন্যপাশে। দাদিজান কলির দিকে চেয়ে পুনরায় বললেন,
” ভেতর থেকে দরজা আটকে দে। ”
” আমি আটকামু? তাইলে ছারে রে ভাত বাইড়া দিব ক্যা? ”

খাইরুন নিসা গভীর নিঃশ্বাস টেনে জানালেন,
” আমি দিব। ”

তিনি খাবার বাড়বেন তো দূর, খাবারের কাছে পৌঁছাতেও পারলেন না। তার পূর্বেই বিপদ ঘণ্টা বেজে ওঠল তুমুল শব্দে। মুনছুর সাখাওয়াত রুম থেকে সমানে দাদিজানকে ডেকে চলেছে। তিনি আগে নাতির রুমের কাছে ছুটে গেলেন। ভেতরে ঢোকার সাহস পেলেন না। বাইরে থেকে স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে সুধালেন,
” কী হয়েছে, নাতভাই? ”

সে মুখে উত্তর দিল না। গয়নার বাক্সটা ঢিল মারল। খাইরুন নিসা চমকে পেছনে সরে গেলেন কয়েকপা। মুনছুর সাখাওয়াত কখন তার কাছে চলে এলো টেরও পেলেন না৷ যতক্ষণে টের পেলেন ততক্ষণে জেরার মুখে পড়ে গেলেন,
” স্বর্ণলতা কোথায়? দাদিজান, জবাব দাও। ও কি সত্যি মায়ের কাছে গেছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত তার দুই বাহু চেপে ধরে আছে। প্রশ্নের পাশাপাশি সমানে ঝাঁকাচ্ছে! দাদিজান চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলেন। সেই অবস্থায় ধীরে বহুকষ্টে উচ্চারণ করলেন,
” হ্যাঁ। ”

উত্তর পেয়ে সে দাদিজানের বাহু ছেড়ে দিল। এক কদম পেছনে সরে বলল,
” না। তুমি পাঠিয়েছ। ”

খাইরুন নিসার চোখ খুলে গেল। বিস্ফারিত নেত্র! দৃঢ় গলায় জানালেন,
” না, আমি পাঠাইনি। তোর বউ নিজের মর্জিতে গেছে। ”
” বিশ্বাস করি না। ”
” তুই বিশ্বাস না করলেই সত্য, মিথ্যা হয়ে যাবে না। তোর বউ শুরু থেকেই এই বাড়ি থেকে পালাতে চেয়েছে। একবার তোর সামনে স্বীকারও করেছিল। ভুলে গেছিস? ”

মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। দাদিজানের দিকে শুধু স্থির চেয়ে থাকল। খাইরুন নিসার পিল চমকে ওঠল! এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, ঐ স্থির চোখজোড়া কোনো মানুষের না। অন্য কোনো প্রাণী যার দেহের পুরোটায় অগ্নি দিয়ে গড়া। তিনি চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলেন তখনই পানির জগটা নিচে পড়ে গেল। তিনি খুব একটা চমকালেন না। এরকম কিছু ঘটবে অনুমান করে রেখেছিলেন। মুনছুর সাখাওয়াত গ্লাস হাতে নিলেও ফেলল না। টেবিলে রেখে দিল। দুটো চেয়ার টেনে মুখোমুখি সাজালো। একটাতে দাদিজানকে বসিয়ে অন্যটাতে সে বসল। তারপরে বাম হাতের মুঠো খুলল। কুঁচকে যাওয়া কাগজটা টেনে টেনে ঠিক করে বলল,
” তোমার নাতবউয়ের চিঠি। নাও, তুমিও পড়ো। ”
” আমাকে লিখেছে? ”
” না। আমাকে লিখেছে। ”
” তোর চিঠি আমি পড়ব কেন? ”
” পড়লেই বুঝবে, স্বর্ণলতা নিজে থেকে যায়নি। তুমি পাঠিয়েছ। ”

খাইরুন নিসা চিঠিটার দিকে তাকালেন। সংশয়ের সাথে সুধালেন,
” এই কথা কি চিঠিতে লিখে গেছে? ”
” হ্যাঁ। ”

তিনি এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে দিলেন। তার পড়ার মাঝেই মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়াল। যে চেয়ারটিতে বসে ছিল, সেটি হাত দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে বলল,
” যেটাকে কু পিয়েছি, সেটা তো ম রেনি। কিন্তু তোমার এই চাঁদনি ম রবে নিশ্চিত। ”

দাদিজানের আদেশে কলি দরজা বন্ধ করেছিল। মুনছুর সাখাওয়াত সরাসরি ঢুকতে পারল না। খোলার জন্যও বলল না। হাতের চেয়ারটা মাথায় তুলে দরজায় মা রার জন্য প্রস্তুত হতে শুনল,
” স্বর্ণলতা মে রে ফেলতে বলেনি, ক্ষমা চাইতে বলেছে। ”

সে চেয়ার মাথায় নিয়ে পেছন ফিরল। দাদিজান এগিয়ে এসে বললেন,
” আমার বা চাঁদনি কারও দোষ নেই। সব দোষ তোর, তোর এই রাগের। আমি শুরুতে বলেছিলাম, বউকে ঘরে নিতে হলে রাগকে নিয়ন্ত্রণ কর। আমার কথা শুনেছিস? শুনলে এতকিছু হতো? ”
” দাদিজান, সাবধান। উল্টা-পাল্টা বুঝাবে না। চিঠির কোথাও একথা লিখেছে? ”
” হ্যাঁ। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চেয়ার ফেলে দিল। চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
” কোথায় লিখেছে, দেখাও। ”
” তার আগে তুই দেখা, আমি যে স্বর্ণলতাকে বাড়িতে পাঠিয়েছি এটা কোথায় লিখেছে। ”
” আরে! সরাসরি লিখেনি। কিন্তু তুমি আমার আর চাঁদনির বিষয়টা বলেছ বলেই তো…”
” আমি বলিনি। ”
” তাহলে চাঁদনি বলেছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আবারও চেয়ার তুলে নিতে এলো। খাইরুন নিসা আটকে দিয়ে বললেন,
” তোরটাও সরাসরি লিখেনি। কিন্তু তোর রা গকে ভ য় পেয়ে তোর থেকে দূরে সরে গিয়েছে প্রথমে, তারপর সেই মানুষগুলোর কাছে গিয়েছে যারা তোর এই ভ য়ানক রা গের মুখে পড়েছে। তাদের সাথে মিশেছে বন্ধুর মতো। আর বন্ধুত্ব মানেই ভাগাভাগি। ”
” ভাগাভাগি মানে? ”
” এত সহজ কথাটাও বুঝতে পারছিস না। বুঝবি কীভাবে? তোর কোনো বন্ধু আছে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত প্রচণ্ড বিরক্তে চেয়ারটা লাথি মেরে সরিয়ে দিল। অতঃপর বলল,
” এই চিঠিটা বুঝতে হলে এখন আমাকে বন্ধু পাততে হবে? এটা বন্ধু পাতার সময়? দাদিজান, আমার বউ চলে গেছে। তুমি কি বুঝতে পারছ না? ”
” আমি বুঝতে পেরেছি। তুই বুঝতে পারছিস না। তোর বউ মায়ের কাছে বেড়াতে গিয়েছে, তুই চাইলে সে এখনই চলে আসবে। অথচ তোর ব্যবহারে মনে হচ্ছে, তোকে ছেড়ে একেবারে চলে গেছে। ”
” একেবারেই গেছে কারণ, আমি ওর শর্ত পূরণ করব না। চাঁদনির কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেয়েও ও কে মে রে ফেলা সহজ হবে। ”

খাইরুন নিসা একটা চেয়ার এনে রাখলেন নাতির হাতের কাছে। তারপরে বললেন,
” তাহলে যা মে রে ফেল। আমি আটকাব না। শুধু বুঝিয়ে দিয়ে যাই, যেই কারণ দেখিয়ে স্বর্ণলতা বাপেরবাড়ি গেছে সেই কারণ দেখিয়ে তোকে একেবারে ছেড়ে যেতে পারত। মেয়েটি যায়নি, বিনিময়ে ক্ষমা চাইতে বলেছে। এতে ওর কোনো লাভ নেই, যদি লাভ কিছু হয় সেটা তোরই হবে। ”

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (২৯)

দাদিজান সামনে থেকে চলে গিয়েছেন। মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনির রুমের পাশে, হাতের কাছে চেয়ারটা। চাইলেই বন্ধ দরজাটি ভেঙে আ ক্রমণ করতে পারে চাঁদনির ওপর। শ্বাসরোধ করারও প্রয়োজন নেই। জ্যন্ত পুঁ তে দিলেই শেষ! কেউ বাঁধা দিবে না। মুখ থেকে টুঁ শব্দটা বের হবে না কারও। এই বাড়ির সবাই তাকে যমের মতো ভ য় পায়। চোখ মেলে দেখবে তো দূর, চোখ বুঁজে নিঃশ্বাসটাও নেয় অতি ধীরে, গোপনে।

” ভাত বাড়ছি। গোসল করে খেতে আয়। ”

খাইরুন নিসার গলা পেয়ে তার পাথরের মতো অটল ও দীর্ঘ শরীরটা মৃদু কাঁপল। চেয়ারটা আলগোছে তুলে নিয়ে রাখল খাবার টেবিলের পাশে। রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” ভাত প্লেটের থেকে টেবিলেই বেশি পড়ছে! দাদিজান, তোমাকে দিয়ে হবে না। অন্য কাউকে ডাকো। ”

মুনছুর সাখাওয়াত গয়নার বাক্সটা তুলে রাখল বিছানার ওপর। চিঠিটা ভাঁজ করে রাখল বাক্সটির ভেতরে। অতঃপর বুকশেলফের একটা ড্রয়ারের মধ্যে তালাবন্দি করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দীর্ঘ বসার রুমটা পার হওয়ার সময় শুনল,
” না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? ”

সে হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিল,
” আমি গোসল না করে খাব না। ”
” গোসল করেই তো খেতে বললাম। করছিস না কেন? বার বার ফিরে আসছিস যে? ”

মুনছুর সাখাওয়াত বড় দরজার মুখে এসে থমকাল। দাদিজানের দিকে চেয়ে বলল,
” গোসলখানা খালি নেই। ”
” খালি নেই মানে? তোর গোসলখানায় কে ঢুকবে? বিনা অনুমতিতে ঘরে ঢোকাও তো নিষেধ। সেই নিষেধ ভেঙে গোসলখানায় ঢোকার মতো সাহস কারও আছে? ”
” আছে, একজনের সাহস ও অনুমতি দুটোই আছে। ”

খাইরুন নিসার খাবার বাড়া বন্ধ হয়ে গেল। চমক লেগে আছে চোখজোড়ায়। বুকের মধ্যে ভয়ের অনুপ্রবেশ ঘটল। মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হলো দুশ্চিন্তায়। ভাবছেন, এত বড় স্পর্ধাকারী কে! তার কি মৃত্যুভ য় নেই? মুনছুর সাখাওয়াত দরজা পেরিয়ে যেতেই তিনি রুমে ঢুকলেন। সোজা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন গোসলখানার সামনে। দরজা ভেজানো, সাড়াশব্দ নেই। অদম্য কৌতূহল ও উদ্বেগে তার বুকের ভেতর কাঁপন উঠে গিয়েছে। ভেজানো দরজায় ধাক্কা দিলেন। সহজেই খুলে গেল। ভেতরটা পুরো ফাঁকা, জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। মুহূর্তেই কাঁপুনি থেমে গেল। ভ য়, উদ্বেগ উভয়ই কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেল। ধরে নিলেন, বউ চলে গিয়েছে তাই নাতির মাথা আউলে গিয়েছে। ভুলভাল ভাবছে, দেখছে। বাড়িতে নতুন কোনো হাঙ্গামা সৃষ্টি হবে না এই ব্যাপারে নিশ্চিত। স্বস্থিমনে ফিরে আসবেন তখনই নজরে পড়ল কাপড় রাখার স্ট্যান্ডে। একটি শাড়ি এলোমেলোভাবে রাখা। তিনি আরেকটু এগিয়ে গেলেন। হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন না, রঙটা ধরে ফেলতেই বুঝে গেলেন, এটি স্বর্ণলতার আধোয়া বস্ত্র।

________
মুনছুর সাখাওয়াত বারান্দায় দাঁড়িয়ে পান্নাকে ডেকে পাঠাল। তার সাথে আরও আটজনের একটি দল বানিয়ে পাঠাল সুয়াপুরে। পান্নাসহ ছয়জন পাহারা দিবে স্বর্ণলতার বাড়িতে। বাকি তিনজন থাকবে বিলে। শহরে যাওয়ার ঐ একটি রাস্তা। বাড়িতে কে ঢুকছে, কে বেরুচ্ছে সকল তথ্য সংগ্রহ করার আদেশও দেওয়া হলো। পান্না আদেশ মোতাবেক দল নিয়ে বেরিয়ে গেল সুয়াপুরের উদ্দেশ্যে। মূল ফটকটা পার হতে সে বারান্দার সিঁড়িতে বসে পড়ল। এই সময় আগমন ঘটল খাইরুন নিসার। পেছন থেকে বললেন,
” আমি তো ভাবলাম, তুইও যাবি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত পেছন না ফিরে জবাব দিল,
” সময় হলে যাব। তুমি এখনও জেগে আছ কেন? যাও, ঘুমাও। বিরক্ত করো না। ”
” আমি বিরক্ত করছি? ”
” হ্যাঁ, করছ। ”
” ঠিক আছে, যাচ্ছি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন ছিল। ”

সে মুখ ঘুরাল। দাদিজানের মুখের দিকে চেয়ে ভীষণ অধৈর্য ও বিরক্তের সাথে বলল,
” এখন কোনো প্রশ্ন শুনতে পারব না। তুমি যাও, এখনই। নাহলে আমি ঘাড়ে করে তোমার বিছানায় ফেলে আসব। ”

খাইরুন নিসা পিছিয়ে গেলেন। চুপচাপ সরে পড়লেন তার কাছ থেকে। এই বয়সে নাতির ঘাড়ে উঠতে চান না কিছুতেই। দাদিজান চলে যেতেই মুনছুর সাখাওয়াত উঠোনের দিকে দৃষ্টি রাখল। ইচ্ছে করছে, এখনই ছুটে চলে যায় তার বালিকা বধূর কাছে। তারপরে সেচ্ছায় আসলে ভালো নাহলে জোর করে কাঁধে ফেলে এই বাড়ি নিয়ে আসবে। তার পথে বাঁধা হবে কে? কিন্তু এই শরীরটা কিছুতেই নড়ছে না। জোঁকের মতো সিঁড়ির সাথে সেধে আছে। মনে হচ্ছে, কেউ জোর করে না উঠালে একচুলও নড়বে না। হঠাৎ করে হাত, পা জোর হারিয়ে ফেলল কী করে? কী ভয়ানক ক্লান্ত ও অসারতায় পেয়েছে! মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বুঁজে কল্পনা করল, স্বর্ণলতা ছোট ছোট কদম ফেলে তার কাছে হেঁটে আসছে। আলতা রাঙানো খালি পা। দুইপায়ে সোনার নুপুর। হাঁটার সময় রুমঝুম শব্দ তুলছে। সেই শব্দ এত মধুর হয়ে ঠেকল যে, তার মনের বেপরোয়া ভাব, অস্থিরতা সব দূর হয়ে গেল। শান্তির শীতলপাটির রূপ নিল বুকের পাটাতন। মুনছুর সাখাওয়াত এখানেই থামল না। কল্পনার দৈর্ঘ্য বাড়াল। দেখল, স্বর্ণলতা তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে ভাতের প্লেট। তাকে সাধল না। নিজের ছোট হাত দিয়ে সুন্দর করে মাখল। অতঃপর মুখের সামনে ধরে চোখের ইশারায় খেতে বলল। মুনছুর সাখাওয়াত হাঁ করে ভাত মুখে নিবে, তখনই স্বর্ণলতার হাত উধাও হয়ে গেল। তারপরে এক এক করে ভাতের প্লেট, মুখ ও পা দুটোও উধাও হয়ে গেল। সে শুরুতে ভ য় পেয়ে গেল, উদ্ভান্তের মতো চারপাশে চোখ বুলিয়ে তাকে খুঁজতে লাগল। না পেয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল। দাদিজান রুমে ছিলেন। জানালার কাছে মুখ এনে বললেন,
” এখান থেকে ডাকলে ও শুনবে না। উল্টো সবাই ভাববে তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস! ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ খুলল। দাদিজানের রুমের জানালার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে হাঁক ছুঁড়ল,
” পান্না? এই পান্না। ”

দাদিজান স্মরণ করিয়ে দিলেন,
” ও কে না সুয়াপুর পাঠালি? ”

পান্না না এলেও আলামিন এলো। দূর হতে সভয়ে সুধাল,
” কিছু কইবেন, মহাজন? ”
” তুইও সুয়াপুর যাবি। ”
” এহনই? ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। বারান্দায় উঠে গেল। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে শুনল,
” সবাইকে পাঠিয়ে দে। তারপরও নিজে যাস না। তুই গেলে তো দুনিয়া নষ্ট হয়ে যাবে। ”

সে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। চলতে চলতে ধ মকের সুরে বলল,
” ঘুমাচ্ছ না কেন? চোখের মধ্যে কিন্তু আঠা ঢেলে দিব। ”

মুনছুর সাখাওয়াত একটা খাতা ও কলম নিয়ে এলো। তাতে লিখল,
‘ আজ পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলাম না আর তুমি বলছ, চাঁদনির কাছে ক্ষমা চাইতে? এই অসম্ভব কাজটা আমার দ্বারা হবে না। তুমি নিজ থেকে আসবে নাকি আমি গিয়ে উঠিয়ে আনব?

আরেকটা কথা, ক্ষমা তোমারও চাওয়া উচিত। স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে পা রাখা গুনাহ। এই গুনাহ ভারী করতে না চাইলে বিনাবাক্যে ফিরে এসো। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মুনছুর সাখাওয়াত ‘

সে চিঠিটা দিল কলির হাতে। সাথে নিজের জীপগাড়িসহ আলামিনকে পাঠাল।
___________
কিতাবগড় থেকে সুয়াপুরের দূরত্ব দুই মাইলের মতো। জীপগাড়ি দিয়ে যেতে লাগে প্রায় বিশ মিনিট। স্বর্ণলতাদের বাসা রাস্তা থেকে একটু ভেতরে। পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সেই সব কিছু পেরিয়ে প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় ব্যয় করে আলামিন ফেরত এলো। মুনছুর সাখাওয়াত জীপে তাকিয়ে দেখল, স্বর্ণলতা নেই। শুধু কলি বসে আছে। কলি আড়ষ্টভাবে একটা হাত বাড়িয়ে সভয়ে বলল,
” রানিসাহেবা আইব না। এই কাগজডা আপনারে দিতে কইছে। ”

সে অবাক হলো না। এরকম কিছু ঘটবে অনুমান করেছিল। যেই মেয়ে এতকিছু করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সেই মেয়ে এত সহজে বাড়ি ফিরবে না। মুনছুর সাখাওয়াত কাগজটা নিল। তাতে মাত্র তিনটি শব্দ লেখা,
‘ মাফ করে দিন। ‘

স্বর্ণলতা না ফেরাতেও সে শান্ত ছিল কিন্তু কাগজের লেখাটা পড়ে ক্ষ্যা পে গেল। ইচ্ছে হলো, লাফিয়ে উঠে বসে জীপগাড়িতে। তারপরে রকেটের মতো ছুটিয়ে চলে যায় স্বর্ণলতার কাছে। কিন্তু গেল না। এবারও নিজেকে আটকে রাখল। বড় বড় দুটো তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল। খাতা ও কলম পকেটে রেখেছিল। বের করে তখনই লিখল,
‘ দুই মাইল দূরে থেকে মাফ চাইলে হবে না। আমার সামনে এসে, মুখ দেখিয়ে চাইতে হবে। নাহলে মাফ পাবে না। ‘

এইটুকু লিখে কাগজটা ভাঁজ করে ফেলেছিল। সহসা ভাঁজ খুলল। লেখাটার নিচে অনেকটুকু ফাঁকা জায়গা রেখে একদম নিচে কিনারে ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে লিখল,
‘ আমি কিন্তু খুব রে গে আছি, স্বর্ণলতা। রা গে আমার মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। তুমি কি চাও, আমি মাথা ফেটে মরে যাই? ‘

কলি ও আলামিন দ্বিতীয়বারের মতো রওনা হলো সুয়াপুরের উদ্দেশ্যে। মুনছুর সাখাওয়াত ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠল। পুরো উঠোনে পাক খাচ্ছে। এভাবে যদি সামান্য পরিমাণও রা গ কমত, মন শান্ত হতো তাহলে সে সারারাত ধরেই হাঁটতে রাজি।

আরও একটা ঘণ্টা ব্যয় করে আলামিন ও কলি ফিরে এলো। স্বর্ণলতা এবারও আসল না। মুনছুর সাখাওয়াত ব্যথিত ও হতাশ হলো। মেয়েটার জেদের সীমার নাগাল পাচ্ছে না কেন?

কলি কাগজটা এগিয়ে ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত ভাঁজ খুলে চোখটা খিঁচে বন্ধ করে নিল। প্রায় মিনিটখানেক সময় পর চোখ মেলল। ঠোঁট নাড়িয়ে পড়ল,
‘ না, আমি চাই আপনি কালিমা মুখে নিয়ে মা রা যান। কালিমা পারেন তো? ‘

স্বর্ণলতা চিঠিতে আরবিতে কালিমাও লিখে দিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত দুইহাতে সেই চিঠি দুমড়েমুচড়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারল। খাইরুন নিসার চোখে ঘুম নেই। জানালা দিয়ে নাতির উপর চুপচাপ নজর রাখছিলেন। এবার কথা বলতে বাধ্য হলেন। বললেন,
” বাপ রে, এত রা গ! কী লিখছে? ”

দাদিজানের রুমের জানালাটি বাগানের কাছে। মুনছুর সাখাওয়াত দৌড়ে এলো সেই জানালার কাছে। দুটো গাঁদাফুলের গাছ পিষে গেল পায়ের চাপে! সে চিঠিটা কুড়িয়ে এনেছিল। টেনেটুনে সিধা করে বলল,
” নেও, পড়ো।

তিনি আলোর নিচে গিয়ে পড়ে বললেন,
” ভালো কথাই তো বলছে। রা গ হলি কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত অসিষ্ণুতায় বলল,
” উফ! তুমিও বুঝছ না, দাদিজান। যা বুঝাইনি সেটা ঠিকই বুঝে নিচ্ছে অথচ যা বুঝিয়ে বলছি, সেটা বুঝছে না। ”
” কী করে বুঝবে? এত জ্ঞান কি হয়েছে? এইটুকু তো বয়স। বাচ্চা মেয়ে! বিয়ে করার আগে আমার পরামর্শও করলি না। এখন বুঝ ঠ্যালা। ”

সে কাগজটা টেনে নিল। একটা পকেটে ভরে এগিয়ে গেল জীপগাড়ির দিকে। কলি ও আলামিন গাড়িতেই বসে আছে এখনও। খাতা মেলে লিখল,
‘ তোমার কি বিশ্বাস হচ্ছে না আমি জোর করে তোমাকে তুলে আনতে পারি? ‘

এই চিঠির জবাব এনেছে আলামিন। কলি নেই। সে চিঠিটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
” রানিসাহেবা কলিকে রেখে দিছে। বলছে, তার নাকি ঘুম পাচ্ছে। আর যেন এই দুই লাইনের চিঠি পাঠানো না হয়। পাঠালে সে চিঠি পুড়বে, গাড়িও পুড়বে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত কাগজের ভাঁজ খুলল। তাতে লেখা,
‘ বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি আশা বেঁধে আছি, নিজ ইচ্ছায় খুশিমনে শ্বশুরবাড়ি গমন করব। ‘

চিঠিটা পড়ে মুনছুর নিজের হাত কামড়ে ধরল। দাদিজান দূর হতে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমার নামে কিছু লিখেছে? ”

সে হাত কামড়ানো অবস্থায় মাথা নাড়ল দুইপাশে। খাইরুন নিসা ভ্রূ কুঁচকে সংশয়ের সাথে বললেন,
” তাহলে আমাকে মা রতে ইচ্ছে করছে কেন? ”

মুনছুর সাখাওয়াত হাতটা ছাড়ল। দাদিজান বুঝে গেছেন, সে যাতে মে রে না বসে তাই হাত কামড়ে থাকে। দাদিজানের দিকে চেয়ে বলল,
” তোমাকে না অন্য কাউকে মা রতে ইচ্ছে করছে। উহু, মা রতে না কা মড়াতে ইচ্ছে করছে। ”
” কাকে? ”
” তোমার নাতবউকে। ”

সে আলাদিনের কলার টেনে ধরে নামাল। নিজে লাফিয়ে উঠে বসল ড্রাইভারের সিটে। ইঞ্চিন চালু করতে দাদিজান চেঁচালেন,
” আরে, থাম। খালি গায়ে শ্বশুরবাড়ি যাবি? আমি একটা কিছু এনে দিচ্ছি, পরে যা। ”

মুনছুর সাখাওয়াত সেই চিৎকার করা কথাগুলোকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জীপ নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো।

চলবে

#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৩০)

মুনছুর সাখাওয়াত শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে খানিকটা থমকাল। হাঁটার গতি ধীর হলো আপনাআপনি। সংশয় ঝলকে ওঠল তেজি চোখদুটিতে। কপাল দলা করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে বাড়িটির আঙিনা ও ভেতরের রূপ। স্বর্ণলতাদের একচালা ঘর। সামনে ছোট্ট উঠোন। সেই উঠোনের কিনার ঘেরাও ছিল বাঁশের চিকন কুঞ্চির বেড়া দিয়ে। বেড়াটি নেই। প্রবেশ মুখে একটি বেশ চওড়া, পোক্ত ও দীর্ঘ পুরোনো জাম গাছ ছিল। সেটিও নেই। পান্না একটি ছেলেকে নিয়ে পাহারায় আছে। মহাজনকে দেখে নত মাথায় সালাম প্রদান করল। মুনছুর সাখাওয়াত তাকে উপেক্ষা করে ভেতরে পা বাড়াল। ঢুকতে ঢুকতে হাঁক ছাড়ল,
” শবনম? এই শবনম? কোথায় গেলি? ম রেছিস নাকি! ”

নিশীথ রাত। আকাশে চাঁদ নেই। বাইরে আলোর ব্যবস্থাও নেই। দরুন পুরো উঠোনে আবছা অন্ধকারের ছায়া নেমে আছে। চারপাশ নির্জন, নিস্তব্ধ। নিশাচর প্রাণীগুলোও গাছের পাতার আড়ালে ঝিমুচ্ছে। চিঠি চালাচালি বন্ধ হতে স্বর্ণলতা কুপি বন্ধ করে দেয়। মা ও কলিকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। চোখে ঘুমটাও নামতে পারল না ঠিকমতো। হাঁকাহাঁকিতে তিনটি শয়িতা প্রাণী হকচকিয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল শবনম বেগম ও কলি। স্বর্ণলতা চমকানো ভাবটাকে সামলে বলল,
” আমি ঘুমাইতাছি। কেউ বিরক্ত করবানা কইয়া দিলাম। ”

শবনম বেগম মেয়ের পাশ থেকে সরে এলেন। আগে কুপি ধরালেন তারপরে দ্বার মেলে দাঁড়ালেন। দ্বার খোলার শব্দে মুনছুর সাখাওয়াতের গলার স্বর আরও তীব্র ও সুউচ্চ হলো। দূর হতেই চেঁচাল,
” জামগাছটা কে কাটল? ”

তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন দ্রুতপায়ে। পায়ের তলায় মরা পাতা পড়ে মর্মর শব্দ হচ্ছে। আটপৌরে শাড়ির পাড়ে দুই একটা পাতা আটকেও গেল। হাঁটার তালে থেকেই একহাতে আঁচল টেনে নিলেন মাথায়। মেয়ের জামাইয়ের কাছে পৌঁছে সেই আঁচল আবৃত মাথাটা নিচু হয়ে গেল। অনুদ্ধত ও সমীহের সাথে মৃদু গলায় জবাব দিল,
” কুমোরপাড়ার সুকুমার কাটছে। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আরও এক কদম সামনে এগিয়ে এলো। কুপি হাতে থাকলেও শবনম বেগমের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কথা বলার সময় মুখ ও চোখ নজরে থাকা ভালো। সত্য বা মিথ্যা বলছে নাকি বুঝার সম্ভাবনা থাকে। সে খেঁকিয়ে ওঠল,
” ও গাছ কাটবে কেন? বেচে দিছিস? মেয়ে বেচে পেটে শান্তি হয়নি? এখন গাছ, বেড়াও বেচতে হচ্ছে। ”

শবনম বেগমের মাথাটা সামান্য সোজা হলো। নিচু দৃষ্টিজোড়া উঁচু হতেই ঝা ড়ি খেল,
” চোখ নামা। নামা বলছি। শা লির বেটির স্পর্ধা দেখ, আমাকে চোখ রাঙায়! চোখ উ পড়ে ফেলব একদম। ”

তিনি ভ য়ে কেঁপে ওঠলেন। ঝট করে দৃষ্টিসহ মাথা নুয়িয়ে ফেললেন। কুপির আলো ছড়ানোতেও বিঘ্ন ঘটল। মৃদু মৃদু কাঁপছে। নিভে নিভে ভাব। মুনছুর সাখাওয়াত আগের মতোই উত্তপ্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
” কত টাকায় বেচেছিস? ”
” বেচি নাই, মহাজন। স্বর্ণার বাপের কাছে নাকি ট্যাকা পাইব। চাইতে আইছিল, দিতে পারি নাই তাই গাছ কাইটা নিছে। ”
” টাকা পাবে বলেই গাছ কেটে নিবে? এত সাহস! তুই কিছু বললি না? ঐ গাছ তো আমার কাছে বন্ধক রাখা। কাটার অধিকার শুধু আমার। ”

শবনম বেগম আরেকদফা চমকালেন। চমকের চাপে মাথা উপরে উঠে যাচ্ছিল। তিনি অতিসত্বর সামলে নিয়ে জানালেন,
” আপনার কাছে গাছ বন্ধক আছে জানতাম না। ”
” শুধু গাছ না তোদের এই বাড়ি, জমি সবকিছুই বন্ধকে আছে। তোর জামাই বলেনি নাকি? ”

তিনি জবাব দিতে পারলেন না। কন্ঠরুদ্ধ হয়ে আছে। চোখদুটিতে অশ্রুর ঢেউ বয়ছে। ফুঁপানির অস্পষ্ট ভাব ফুটে উঠতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” মেয়ে বেচার টাকা দিয়ে বন্ধক ছাড়াতে পারত। ছাড়ায়নি। আরেক পাওনাদার আমার গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে! জা নোয়ারটা এতগুলো টাকা দিয়ে করছে কী? ”

শবনম বেগম শিউরে ওঠলেন। তার সামনে মেয়ের জামাই গলা তুলে কথা বলছে। শ্বশুরকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। স্বামী যত খারাপই হোক না কেন, স্ত্রী অন্যের মুখে নিন্দে শুনতে পারে না। মুনছুর সাখাওয়াত তার সামনে দাঁড়িয়ে পান্নাকে ডেকে পাঠাল। আদেশ করল,
” সুকুরের বাচ্চাকে তুলে নিয়ে আয়। সাথে গাছটা আনতেও যেন ভুল না হয়। ”

সে আদেশ পালনে তটস্থ হলো। চটপট পায়ে উঠোন ত্যাগ করামাত্র মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” স্বর্ণলতা কি ঘুমাচ্ছে? ”

কণ্ঠটা এত শান্ত ও কোমল শুনাল যে, শবনম বেগম বিস্মিত হলো। বিস্মিত নেত্রদ্বয় ঝটিতে উপরে ওঠল। সরাসরি পড়ল মুনছুর সাখাওয়াতের চোখজোড়ায়। একটু আগের সেই তেজ, ক্রো ধ কোনোকিছু অবশিষ্ট নেই চোখের কোলগুলোতে। কী নিদারুন ব্যাকুলতা, পিপাসাযুক্ত তারা দুখানা! তিনি ঘোরে চলে গেলেন বোধহয়। স্বর্ণলতার সাবধান বাণী ভুলে সত্য তথ্যটায় দিয়ে বসলেন,
” না। কিন্ত শুইয়া আছে। আসেন না, ঘরে বইবেন একটু। ”

মুনছুর সাখাওয়াত আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। শাশুড়িমাকে অনুসরণ করে চলল। দরজার কাছে এসে দেখল, স্বর্ণলতা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। একহাতে কলির গলা জড়ানো। সে দুজোড়া পায়ের শব্দে চোখ মেলেছিল। কুপির আলোতে মহাজনের দেহাবয়বের উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে বসল। বিছানা থেকে এককোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। শবনম বেগম দরজার ভেতরে পা রাখলেন আগে। মেয়ের একপা নাড়া দিয়ে বললেন,
” আরে, এহনও শুইয়া আছস যে! উঠ, মহাজন আইছে। বয়তে দে। ”

ডাকতে ডাকতে শলার ঝাড়ুটা বের করলেন তোষকের নিচ থেকে। ঝাড় দেওয়া বিছানা আবারও ঝাড় দিচ্ছেন। স্বর্ণলতা মাথা তুলল না, দেহটা সোজাও করল না। শুধু হাত বাড়িয়ে জোর করে ঝাড়ুটা ছিনিয়ে নিল। শবনম বেগম ধ মক দিতে চেয়েও থেমে গেলেন। সভয়ে আড়চোখে তাকালেন দরজার দিকে। মহাজন ভেতরে ঢুকেনি এখনও। স্থির, গভীর চাহনি স্বর্ণলতার পানে। তিনি একটু পাশে সরে বললেন,
” ভেতরে আইসা বসেন। স্বর্ণা একটু আগেই শুইছে। চোখ থেইকা ঘুম সরতাছে না মনে হয়। কাঁচা ঘুম তো! ”

মুনছুর সাখাওয়াত ভেতরে প্রবেশ করল। চৌকির কিনারে আলগোছে বসতেই নড়ে ওঠল। ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ উঠল চৌকির পায়ায়। শবনম বেগম ভারি লজ্জা পেলেন। বিব্রতভঙ্গীতে শুকনো হেসে বললেন,
” আমি একটু শরবত বানাইয়া আনি। কতদূর থেইকা আইলেন! তাপও তো পড়ছে ভালাই। ”

তিনি চৌকাঠ পার হতে পারলেন না৷ মেয়ের ডাক পেলেন। পেছন ফিরতে দেখলেন, সে উঠে বসেছে। দুইহাতে এলোকেশ গুছাতে গুছাতে বলল,
” ফের যদি কেউ তোমার নাম ধইরা ডাকে, তুমি উত্তর দিবা না৷ সামনেও যাইবা না। যদি যাও, তাইলে আমিও তোমারে নাম ধইরা ডাকমু। আর জীবনেও মা ডাকমু না। ”

সে নিচে নামল। পিঠ জড়িয়ে ধরে বলল,
” চলো, শরবত বানাই। ”

স্বর্ণলতা মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপরে দৃষ্টি ঘুরে গেল কোণে, কলির পানে। শামুকের মতো গুটিয়ে যাওয়া দেহের মুখটায় চেয়ে জেরা শুরু করল,
” তোকে কী কাজ দিছিলাম? ”

সে আমতা আমতা করে জবাব দিল,
” রানিসাহেবা আমারে জোর কইরা রাইখা দিছে। বিশ্বাস নাহলে উনারে জিগান। আমার বিশ্বাস উনি মিথ্যা কইব না। ”
” জোর করলেই তোর থাকতে হবে? ভ য় হয়নি? এখন যদি লাত্থি য়ে কোমরটা ভে ঙে দিই? ”

সে চটজলদিতে বলল,
” হয়ছিল তো। কিন্তু পরে মনে হইল, রানিসাহেবার আদেশ অমান্য করলে যদি রা গ করেন? তাই ভ য় নিয়াই থাইকা গেছি। আপনি কি রা গ করতেন না? ”
” অবশ্যই রা গ করতাম। এখন তো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস এই কারণেই। ”

মুনছুর সাখাওয়াত চোখ সরিয়ে নিল। পা তুলে বসল বিছানায়। তার এত অস্থির লাগছে! অসহ্য লাগছে সবকিছু। মনে হচ্ছে, বুকের আগুন নেভাতে এসে বাড়িয়ে দিয়েছে। খোলা দরজার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আচমকা বলল,
” এখানে থেকে কী বালটা করছিস? আমার বউ কাজ করছে আর তুই মহারানীর মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস। এখন কি আদর, ভালোবাসা সব তোকে দিব? ”

কলি মাথা নাড়তে নাড়তে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

_______
” নতুন জামাই, প্রথমবারের মতো বাড়ি আইছে খালি চিনি দিয়া শরবত বানাইয়া দিমু? একটু ট্যাং হইলে ভালা হইত না? ”

মায়ের মিনমিনে কণ্ঠস্বর। আফসোস গড়িয়ে পড়ছে পূর্ণভাবে। লজ্জা ও আড়ষ্টতায় ঝুঁকে পড়া মাথাটা স্বর্ণলতা ঠেলে তুলে দিয়ে বলল,
” গ্লাসে একমুঠ গুড়া মরিচ ছাইড়া দাও ট্যাংয়ের মতো রঙ ধরবো। ”

শবনম বেগম মেয়ের কাঁধে থা প্পড় মারলেন। চোখ রা ঙিয়ে শাসনের সুরে বললেন,
” এসব কী কস? মহাজনের গলাটা না জ্বইলা যাইব? ”
” যাক। যেই গলায় মধু নাই, সেই গলা জ্বইলাপুইড়া কয়লা হয়ে যাক। ”

তিনি আবারও একটা থা প্পড় মারলেন। আগের চেয়ে ভারী ও জোরাল। চোখ রাঙানোভাবও কঠিন হলো। স্বর্ণলতা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
” তোমার কি মনে হয় এই শরবত উনি মুখে তুলবো? ”
” তুলবো না? ”
” মইরা গেলেও না। ”

এরমধ্যে কলি বাতাসের মতো উড়ে এসে বসল দুজনের মাঝে। ফিসফিসের মতো বলল,
” ছার কিন্তু আপনারে মেলা ভালোবাসে। এক সেকেন্ডের জন্যও কাছ ছাড়া করতে চায় না। ”

স্বর্ণলতা ভ্রূ উঁচিয়ে চেয়ে থাকল কতক্ষণ। সহসা সুধাল,
” কাছে ধইরা রাখাকে ভালোবাসা কয়? ”
” হ। ”
” না। এইটা ভালোবাসা না, ভ য়। ”
” ভ য়? ছার আপনারে ভ য় পায়? ”
” না। আমার চালচলন রে ভ য় পায়৷ সে ধইরা নিছে, সুযোগ পাইলেই আমি পালামু। তাই কাছে বসাইয়া নজরবন্দি করতে চায়। ”

কলি একবার রানিসাহেবার মায়ের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলল,
” আপনি পালাইলে ছার কষ্ট পাইব। সেই কষ্টটারেই উনি ভ য় পায়। ”

স্বর্ণলতা আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ কষ্ট তো পাইবই। দুই লাখ ট্যাকা দিয়ে কিনছে! ‘ শবনম বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
” গাছে লেবু ধরছে। কয়ডা পাইড়া নিয়া আসি। যদি রস-টস বাইর হয়! ”

তিনি ব্যস্তপায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কলি আগের মতো ফিসফিসে বলল,
” ছার আপানারে ডাকে। ”
” ডাকুক। ”
” একটু দেখা দিয়া আসেন৷ ”
” পারমু না। দেখছ না, আমি শরবত বানাইতাছি? ”

কলি গ্লাসটা কেড়ে নিল। চামচটা নাড়তে নাড়তে বলল,
” আমি বানাইতাছি। আপনি যান। ”

স্বর্ণলতা চোখ, মুখ শক্ত করে নিল। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল কলির মুখটায়। সে কান্নার একটা দমক তুলে আচমকা পা জড়িয়ে ধরল। কাতর স্বরে বলল,
” আপনার দুইডা পা ধরছি, আমার অনুরোধ রাখেন। নইলে ছার আমার জান কবজ করব। ”

সে নিতান্ত বাধ্য হয়ে ঘরের দিকে এগুল। বড্ড উদাস ও অবহেলায় দাঁড়িয়ে পড়ল দরজার কাছেই। ভেতরে যাবে না। মুনছুর সাখাওয়াত এদিকেই চেয়ে ছিল। স্ত্রীর উপস্থিতির প্রতিটি পদ ধাপ, দেহের নড়ন, মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছে৷ মেয়েটাকে কা মড়ে দেওয়ার যে একটা উগ্র অভিপ্রায় ছিল, সেটা হারিয়ে গিয়েছিল কোনোভাবে। হুট করেই সেটা ফিরে এলো তীব্রভাবে। বসে থাকা দুরূহ ঠেকছে। বাঘের মতো লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? ইচ্ছেমতো যত্রতত্র কা মড়ানো যাবে! মুনছুর সাখাওয়াত ভাবনার মধ্যে মাথা নাড়ল। যত্রতত্র কা মড়ানো যাবে না। অল্পবয়সী মেয়ে, কোমল দেহ। কা মড়ের আঘাত সহ্য করতে পারবে না। দৃঢ় মাংসপেশি ও শক্ত হাড় আছে এমন জায়গায় কা মড়াতে হবে। সে দূর হতে স্বর্ণলতার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। সহসা নজরে পড়ল, তার বউয়ের কাপড়ে। সে শাড়ি না, সালোয়ার কামিজ পরে আছে। খুব পুরোনো ও মলিন পোশাকে মেয়েটাকে কী ভয়ঙ্কর দুঃখী লাগছে! দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে চোখে, মুখে। মুহূর্তেই মেজাজ চটে গেল। কিন্তু উত্তাপটা ঠিকমতো প্রকাশ পেল না। যতটা সম্ভব ঠাণ্ডাভাবেই বলল,
” কী পরে আছ এটা? তোমার স্বামীর কি টাকার অভাব পড়েছে? তার কাছে আর কিছু না পাও বান্ডিল বান্ডিল টাকা পাবে। বুঝছ? এখনই জামা বদলাও। ”

সে উত্তর দিল না। মুখটা বাঁকিয়ে নিল। দেহটাও কিঞ্চিৎ ঘুরে গেল। এখন পিঠটা সম্পূর্ণ মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে। চোখ, মুখ, গলা কিছুই দেখতে পারছে না। তার এত রা গ হলো! বিয়ে করা বউ অথচ দুই দণ্ড শান্তিতে চোখ মেলে দেখতে পারছে না। সারাক্ষণ মুখটা ফিরিয়ে রাখে। তার সামনে ঠোঁট দুটো মেলতেও বুঝি অনেক কষ্ট হয়? কথাবার্তা একেবারেই নেই!

শবনম বেগম ঢুকলেন শরবত নিয়ে। মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে বাড়িতে দিতে সাহস পেলেন না। বিছানার উপর রাখলেন অতি সাবধানে, নীঃশব্দে। অতঃপর সামান্য দূরে সরে বললেন,
” একটু শরবত খান, মহাজন। গলাটা ভিজব। বুকটা ঠাণ্ডা হইব। আমাগো গাছের লেবুর শরবত। কোনো ভেজাল নাই। ”

সে শরবতের গ্লাস হাত দিয়ে স্পর্শ করল না, ছুঁয়েও দেখল না। আচমকা প্রশ্ন করল,
” এটা কি তোর মেয়ে? ইকবালের র ক্ত তো? আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমি কালই লোক পাঠাব। দুই জামাই-বউ হাসপাতালে যাবি। টেস্ট করাবি। ”

শবনম বেগম কোনো প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেল না। এরপূর্বেই স্বর্ণলতা তড়িঘড়িতে বলল,
” শরবত দেওয়া শেষ না? এরপরও দাঁড়াইয়া আছ ক্যান? যাও, এখান থেইকা। ”

মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল,
” ও না। তুমি যাবে। কাপড় গুছাও, আমি গাড়িতে বসছি। ”

সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিল,
” আম্মা, উনারে কইয়া দাও আমি কোথাও যাইতে পারমু না। উনার যদি আমারে নিতেই হয় তাইলে যেন আমার হাত-পা বাঁইন্ধা নিয়া যায়। আমি আটকামু না। ”

চলবে