#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৫৯)
নাস্তার টেবিলে দাদিজান বললেন,
” মুনছুরকে দেখলাম জীপ নিয়ে বেরিয়ে গেল। তোমাদের মধ্যে কি বোঝাপড়া হয়েছে? ”
স্বর্ণলতা গরম রুটি তুলে দিল প্লেটে। ছোট্ট বাটিটাতে সবজির তরকারিটা নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
” কোন বিষয়ে? ”
খাইরুন নিসা পাকতে ধরা ভ্রূযুগল কুঁচকে ফেললেন। গতকাল এত খোলাখুলিভাবে বুঝিয়ে বললেন, তারপরেও এই মেয়ের মাথায় ঢুকেনি? এখনও প্রশ্নই করে যাচ্ছে! নাকের আগায় বিরক্ত জমা পড়া সত্ত্বেও কণ্ঠটা শান্ত রইল। গম্ভীরমুখে সুধালেন,
” রাতে যে তোমাকে সাজিয়ে দিলাম, মুনছুর পছন্দ করেছিল? ”
” একটুও না। উল্টা রাইগা গিয়া পুরা সাজ নষ্ট কইরা দিছে। ”
” সে কী! কেন? তোমাদের মধ্যে কিছু হয়নি? ”
দাদিজানের নাস্তা সাজিয়ে দেওয়া শেষ। এবার স্বর্ণলতা নিজের জন্য নিচ্ছিল। সহসা থেমে গেল। ঘাড় ফিরে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আচমকা বলল,
” না। উনি তো কিছু করতে চাইল না। আমি আপনের সব কথা রাখছি। ঐ কথাটা কই নাই, বাঁধাও দেই নাই। ”
” কিছুই করেনি? ”
তার কণ্ঠে প্রবল অবিশ্বাস, সন্দেহ। বদনখানা বিস্ময়ের আলোয় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। প্রবীণ চোখজোড়া খানিক বড় হয়ে ওঠল যেন! বউকে কাছে পাওয়ার জন্য নাতি একের পর এক পাগলামি করেছে। তিনি সবই দেখেছেন, সহ্য করেছেন৷ কখনও ঠাণ্ডা মেজাজে বুঝিয়েছেন, কখনও গরম মেজাজে। সেই ছেলে কী না সুযোগ ও সম্মতি পেয়েও বউকে কাছে টানেনি? খাইরুন নিসা কথাটা হজম করতে পারছেন না।
স্বর্ণলতা টেনে টেনে উদাসভাবে বলল,
” একটা কাজ করছে। ”
” কী? ”
” ভুল স্বীকার করছে। এমনি এমনি করে নাই কিন্তু, আমার অনেক খাটতে হয়ছে। ”
” তাই নাকি? ”
” হ, দাদিজান। সারারাত উনার মোটা হাতটা ধইরা থাকতে হইছে। অনেক ওজন! আমার তো হাতটা ব্যথা হইয়া গেছিল। দেখেন, এখনও কাঁপতাছে! রুটিটাও উঁচা কইরা ধইরা থাকতে পারতাছি না। সব শক্তি ফুরাইয়া গেছে। ”
খাইরুন নিসা তার দেখানো হাতটায় তাকালেন। মেয়েটা মিথ্যা বলছে না, হাতটা সত্যি কাঁপছে! তিনি আশ্চর্য হয়ে সেই কাঁপুনি দেখতে দেখতে ভাবলেন, মুনছুর তাহলে ভুল স্বীকার করাও শিখছে! ছেলেটা কি একটু একটু করে বদলাচ্ছে? এই পরিবর্তনের পুরো কৃতিত্বই স্বর্ণলতার। অল্পবয়সী, সাধারণ গড়নের মেয়েটা। যে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি এখনও। ঠিকমতো পর্দা করতে জানত না, তার শাসনে পড়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ে তৎপর হয়েছে। কুরআন তেলাওয়াতও আয়ত্ত করছে।
তিনি ভাবনার মধ্যে আকস্মিক বলে ওঠলেন,
” কলি? এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আয় তো। ”
স্বর্ণলতার হাত থেকে ছেঁড়া রুটির টুকরোটা নিয়ে তার মুখে পুড়ে দিতে দিতে পুনরায় বললেন,
” আজ থেকে তুমি নিয়মিত দুধ ও ডিম খাবে। ”
________
দুপুরবেলায় মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি এলো। দাদিজান ও স্বর্ণলতা মাত্রই খাবার টেবিলে বসেছে। আচমকা সেও এসে বসল তাদের পাশে। খাইরুন নিসা নাতবউকে ইশারা করলেন, তাকেও খাবার দিতে। স্বর্ণলতা উঠে নীরবে খাবার বাড়তে লাগল। তখনই মুনছুর সাখাওয়াত দাদিজানের উদ্দেশ্যে বলল,
” তোমার কি এই বয়সেই বোধশক্তি লোপ পেয়েছে? ”
তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন প্রথমে। পরক্ষণে কপট রাগ নিয়ে সুধালেন,
” কী করেছি? ”
” আমার বউকে ঝি দিয়ে সাজাচ্ছ! ”
খাইরুন নিসা প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। সাজ নষ্ট করে দেওয়ার কারণ তাহলে এই? তিনি ঠোঁট বাঁকালেন। বিদ্রুপের সুরে বললেন,
” ঝিদের হাতের রান্না খেতে পারলে, সাজতে পারবে না? ”
” না, পারবে না। ওরা শুধু রান্না করে, এঁটো করে না। স্বর্ণলতাকে সাজিয়েছ, ওদের ব্যবহার করা জিনিস দিয়ে। তুমি ভাবলে কী করে, ওদের ব্যবহার করা লিপস্টিক আমার বউয়ের ঠোঁটে মেখে দিলে আমি খুশি হব।? ”
স্বর্ণলতার হাত দুটো থমকে গেল। ঝটিতে তাকাল স্বামীর মুখটায়। ঘৃণায় চোখ, মুখ বিকৃত করে ফেলেছে। ঠোঁটের লিপস্টিক মুছে দেওয়ার সময় তো এই কথাটা উল্লেখ করেনি। শুধু বলেছে, এই রঙ না মাখতে। সে ভেবেছিল, লোকটার লিপস্টিক পছন্দ না।
দাদিজান পাশ থেকে প্রত্যুত্তর করলেন,
” ইচ্ছে করে তো ওদেরটা নিইনি। তোর বউয়ের কাছে ছিল না। আমার কাছেও না। ঐ সময় কিনে আনবে কে? ”
” আমি আনতাম। একবার বললেই হতো। ”
” আমি তো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। তোকে বললে কি সারপ্রাইজ হতো? ”
” এই ধরনের সারপ্রাইজ আর কখনও দিবে না। এবার মাফ করে দিয়েছি বলে ভেব না, সবসময় করব। ”
খাইরুন নিসা চুপ হয়ে গেলেন। বিরক্তের ভাব, রাগের গরমটা এখনও যায়নি। নাতির থেকে চোখটা সরিয়ে নিতে পুনরায় শুনলেন,
” কী কী লাগবে, লিস্ট করে দিও। আমি নিয়ে আসব। আর শোনো, নিজে সাজাতে পারলে, সাজাবে। নাহলে ছেড়ে দিবে। তবুও ঝিদের দিয়ে স্বর্ণলতাকে সাজাবে না। অন্য কেউ ও কে স্পর্শ করলে আমার সহ্য হয় না! ”
” ছেড়ে দিলাম। তোর বউকে তুই পকেটে ভরে রাখ। যা। ওখানে হাত দেওয়ার সাহস তো আমারও নেই! ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। গরম চোখে নীরবে একস্থির চেয়ে রইল শুধু। খাবারেও হাত দিল না। খাইরুন নিসা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। নাতিটাকে সহ্য হচ্ছে না একদম। মনের সংকীর্ণতা দূর হয়নি এখনও। মানুষকে প্রকাশ্যে হেয় করার অভ্যাসটা দৃঢ় হচ্ছে যেন!
স্বর্ণলতা স্বামীর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিজের স্থানে যায়নি তখনও। আচমকা গলা ছেড়ে ডেকে ওঠল,
” ময়নাবু? ”
সে রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত ছিল। ডাক পেয়ে দৌড়ে আসতেই স্বর্ণলতা বলল,
” তুমি তো খুব সুন্দর কইরা সাজাতে পার। আমার অনেক পছন্দ হয়ছে। ঠিক করছি, এখন থেইকা রোজ তোমার কাছে সাজতে বসমু। ”
ময়না লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলল। মিটিমিটি হেসে বলল,
” আচ্ছা। ”
” তোমার লিপস্টিকের রঙটা বেশি পছন্দ হয়ছে। কী সুন্দর গন্ধ! ঐটা দিয়া দিবা কিন্তু। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের গরম চাহনিটা স্ত্রীর দিকে চলে গেল। হাতের কাছেই আছে। ইচ্ছে হলো, গালে প্রচণ্ড জোরে একটা চড় বসিয়ে দিতে। সেই ইচ্ছে ধূলিসাৎ হলো স্বর্ণলতা ফিরে তাকাতে। ঝট করে চোখটা নামিয়ে ফেলল। দাদিজানের দিকে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিসে বলল,
” এই মেয়েটাকে একদিন আমি সত্যি কামড়ে দিব। দেখ, মিলিয়ে নিও। সেই দিনটাও খুব দূরে নেই। ”
খাইরুন নিসা হেসে ফেললেন। নাতির মতোই ফিসফিসে বললেন,
” তুই জীবনে একটাই ভালো কাজ করেছিস। সেটা হলো, স্বর্ণলতাকে বিয়ে করা। আমি আগেই বুঝেছিলাম, তুই যাদের ভয় দেখাস, স্বর্ণলতা তাকে সাহস দেয়। এখন বুঝলাম, তুই যাদের অসম্মান করিস, স্বর্ণলতা তাদের সম্মানও দেয়। ”
” আত্মীয়ও বানিয়ে ফেলে। কী সুন্দর করে বুবু ডাকে দেখেছ? যেন মায়ের পেটের বোন! ”
দাদিজানের হাসি চওড়া হলো। মুনছুর সাখাওয়াতের এই হাসিটাও অসহ্য ঠেকল। স্বর্ণলতা সামনে না থাকলে নিশ্চিত কিছু একটা করে বসত! খাইরুন নিসা সহাস্যে বললেন,
” মানুষকে সম্মান দিতে শুরু কর। তাহলে আর আত্মীয় বানাবে না। ”
স্বর্ণলতা এতক্ষণে হেঁটে এলো নিজের চেয়ারটায়। সে বসেছিল, দাদিজানের পাশে। মুনছুর সাখাওয়াত তার পাশে বসতে মাঝে পড়ে গেল। আগে খুব অস্বস্তি হতো, জড়োসড়ো হয়ে থাকত। ঠিকমতো খেতে পারত না, বুকের মধ্যে মৃদু কাঁপুনি চলতেই থাকত! আজকে এসবের কিছুই উপলব্ধি করছে না। বেশ আরাম করেই বসেছে। ভাতের প্লেটটা টেনে সহজভাবে খেতে লাগল। দুইপাশে ভিন্ন বয়সে দুই জোড়া চোখ যে, ভিন্ন ভঙ্গিতে চেয়ে আছে এটাও টের পেল ঠিকই কিন্তু পাত্তা দিল না। খাওয়ার প্রায় শেষের দিকে মুনছুর সাখাওয়াতের দিকে চেয়ে বলল,
” আপনে কি খাইবেন না? তাইলে ঘরে যান, বিছনায় বইসা বিশ্রাম করেন। এখানে বইসা এমনে চাইয়া আছেন ক্যান? আমগো যদি পেট খারাপ করে? ”
সে স্ত্রীর দিকেই একভাবে চেয়ে ছিল। এবার দৃষ্টি সরাল। খাওয়ায় মন নেই। ক্ষুধাটাও চলে গেছে বোধ হয়। ভাতে রুচি আসছে না। তাই গ্লাসে পানি ঢালল। একবারে পুরো পানিটুকু খেল। আবারও গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে শুনল,
” দাদিজান, জিভ কাইটা ফেললে কী হইবো? ”
” ঠিকমতো কথা বলতে পারবে না, খেতেও পারবে না। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? ”
স্বর্ণলতা উত্তর দেওয়ারও সময় পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার এঁটো হাতটা ধরে দাঁড় করাল। টেবিলে ফল কাটার ছুরি ছিল। হাত বাড়িয়ে ছুরিটা নিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
” চুপচাপ ঘরে চলো। ”
খাইরুন নিসাও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। নাতিকে আটকাতে চাইলেন, পারলেন না। ডাকতে ডাকতে তার গলা শুকিয়ে এলো। এক পর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠে ধপাস করে বসে পড়লেন।
_______
স্বর্ণলতাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিল মুনছুর সাখাওয়াত। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
” মুনছুর যা বলে তারচেয়েও বেশি করে দেখায়। ”
বলতে বলতে নিজের গলায় ছুরিটা ধরল। অতঃপর পুনরায় বলল,
” শুধু জিভ কেন, পুরো মাথাটায় কেটে ফেলে দিই? ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্বামীর গলার দিকে। ছুরির ধারাল অংশটা চামড়ায় লেগে আছে। সামান্য চাপেই চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে! মুনছুর সাখাওয়াত তার এই বিস্ফারিত নেত্র জোড়ায় চেয়ে থেকেই আবারও সুধাল,
” স্বর্ণলতা উত্তর দেও। কেটে ফেলব? ”
” না। আপনের গলা তো আমি কাটতে চাইছিলাম। দাউয়ে ধার ছিল না, আপনের গলাটাও ঠিকমতো লাগাল পাইতাছিলাম না দেইখ্যা বাঁইচা গেছেন। আমারে আরেকটু লম্বা হইতে দেন, তারপরে আরাম কইরা আপনের গলাটা কাটমু। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আরও লম্বা হবে? ”
” হমুই তো। আমার বয়স পনেরো। এই বয়সেই মানুষ লম্বা হয়, আমিও হমু। আমার আব্বা আপনের মতো লম্বা না কিন্তু অত খাটাও না। আম্মায় কইছে, আমি আব্বার মতোই লম্বা হমু। ”
” আচ্ছা, মনমতো লম্বা হওয়ার পরে জানিও। তোমাকে বড় দেখে একটা দা কিনে দিব। খুব ধার থাকবে ওটাই। একটানেই আমার গলাটা আলগা হয়ে যাবে। ”
” আপনের কেনা দাউ দিয়া আপনের গলা কাটমু? ভালা দেখাইবো না। আমি যে বাড়ি থেইক্যা দাউ নিয়া আনছিলাম? ওটা ফেরত দেন। ধার দিয়া রাখমু নে। ”
সে সাথে সাথে বুকশেলফের পুরোনো, ময়লা বইয়ের পেছন থেকে একটা দা বের করে দিল। স্বর্ণলতা নিঃসংকোচে আগ্রহের সাথে সেটা নিল, ভালোভাবে পরখ করে বলল,
” হ, এটাই তো! ”
মুনছুর সাখাওয়াত পুরো হতাশ! এই মেয়ের কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই একদিন তার গলা কেটে ফেলবে। কাটুক, সে নাহয় খুশিমনে গলাটা এগিয়েও দিবে। কিন্তু তার আগে, একটু ভালোবাসা চায়। স্বামী হিসেবে স্বীকৃতি চায়।
স্বর্ণলতা দা’টা তার বইগুলোর সাথে সাজিয়ে রাখল। মুনছুর সাখাওয়াতের ধৈর্য, সহনশক্তি এখানেই ভেঙে পড়ল। চট করে দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাইরে একপা রাখতে শুনল,
” আরে, কই যান। আসল কথাটা তো কইলামই না! ”
সে থামল। ঘাড় ফিরে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চাইতে স্বর্ণলতা বলল,
” আমি কি সারাজীবন ঘরে বইসাই পড়মু? স্কুলে যামু না? ”
” স্কুলে গিয়ে কী করবে? ”
” ক্লাস করতাম! সব পড়া কি নিজে বুঝা যায়? আরেক পরীক্ষা আসার সময় হইয়া গেছে তো। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের সহসা কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
” এই যা, পরীক্ষা তো শুরু হয়ে গেছে। সেদিন মাস্টার জানিয়েছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। ”
স্বর্ণলতা দ্রুত কদমে তার কাছে এগিয়ে এলো। প্রথমে অসহায় মুখে চেয়ে থাকল, পরক্ষণে রাগে ফুঁসে উঠে বলল,
” গুরুত্বপূর্ণ কথাটা ভুইলা গেলেন? এত সহজে? নিজের সুদের হিসাব তো কোনোদিন ভুলেন নাই! ”
মুনছুর সাখাওয়াত খানিক ভড়কে গেল। এই মেয়েটা তার ব্যবসা সম্পর্কেও জেনে গেছে? কার থেকে শুনল? সে তো বলেনি। এখন এটা নিয়েও নতুন করে ঝামেলা শুরু করবে না তো!
স্বর্ণলতার রাগটুকুও বেশিক্ষণ থাকল না। চোখদুটি ছলছল করে ওঠল। মুনছুর সাখাওয়াত টের পেয়ে দ্রুত বলল,
” এত ভয় পাওয়ার কী আছে? মাস্টারকে ধরে আনলেই তো পরীক্ষা হয়ে যাবে! ”
” না, হইবো না। আমি এমনে পরীক্ষা দিমু না। স্কুলে সবার লগে বইসা পরীক্ষা দিমু। ”
” কী আশ্চর্য! সবার সাথে বসতে হবে কেন? তুমি পরীক্ষা দিতে চাচ্ছ, ওটা দিতে পারলেই তো হলো। ”
” হলো না। আপনে যদি আমারে পড়ালেখা করাইতে চান, তাইলে সবার মতো করাইবেন। আমি স্কুলে যামু, ক্লাস করমু, সবার সাথে পরীক্ষাও দিমু। ” এতকিছু? ”
” হ। বাড়িত বইসা কি পড়ালেখা হয়? সিলেবাস নাই, সাজেশন নাই। একা একা যা বুঝ, তাই করো। আমার পড়া একটুও আগাইতাছে না। তারমধ্যে আপনার কত কাহিনি! ”
” আমার আবার কী কাহিনি? ”
স্বর্ণলতা বিরক্ত দেখিয়ে বলল,
” জানি না। ঠিকমতো পড়ালেখা করাইবেন নাকি তাই কন। নাইলে বইখাতা সব ফালাইয়া দিমু। কিছু যদি শিখতেই না পারলাম, তাইলে পড়ালেখা কইরা কী লাভ? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। এত কিছু মানতে পারবে না সে। রোজ স্কুলে নিয়ে যাবে কে? ক্লাসে ছেলেমেয়েও অনেক। এই সবার সাথে স্বর্ণলতা মিশবে? আবার না পড়ালেও মেয়েটা কষ্ট পাবে। দাদিজানের কাছে শুনেছিল, তার এই একটায় শখ। জানার পরেও অপূর্ণ রাখবে? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল।
স্বর্ণলতা উত্তরের অপেক্ষা করছিল। না পেয়ে অধৈর্য গলায় পুনরায় বলল,
” কন না ক্যান? ”
” এই পরীক্ষাটা বাড়িতে বসেই দেও, তারপরে দেখি কী করা যায়। ”
সে তখনই রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল।
_______
স্বর্ণলতা প্রতি সন্ধ্যায় ময়নার কাছে সাজতে বসে। সাজ শেষে পড়তে বসে। মুনছুর সাখাওয়াত তাকে বেশকিছু কসমেটিকস কিনে দিয়েছিল। সবই সে ময়নাকে দিয়ে দিয়েছে, স্বামীর সামনেই। সে শুধু চেয়ে দেখেছে, কোনো আওয়াজ করেনি। স্বর্ণলতা আরও প্রশ্রয় পেল যেন! এখন আর দাদিজানের রুমে বসে সাজে না, নিজেদের রুমে বসেই সাজে। মুনছুর সাখাওয়াত দেখেনি এখনও। দেখলে কী হবে, এই নিয়ে স্বর্ণলতার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে নিজের মতো রুমটাকে ব্যবহার করতে লাগল।
এক সন্ধ্যায় স্বর্ণলতা পড়ছে। পরীক্ষার পড়া। এই বিষয়ে পরীক্ষা হলে শেষ। সে খুব সেজেছে! লাল শাড়ি। সাথে মিলিয়ে লাল চুড়ি, লিপস্টিক। চুলের সাজটা তার এত পছন্দ হলো! ঠিক করল, এভাবে মাঝেমধ্যে সাজবে। মুনছুর সাখাওয়াতের পছন্দ না হলেও সাজবে। ঐ লোকটার তো কিছুই ভালো লাগে না! যতভাবেই চুল বাঁধুক না কেন, খুলে খোঁপা করতে বলবে। মাথার ঘোমটাও টানা চায়। লিপস্টিক তো দেখামাত্র রুমাল দিয়ে মুছে ফেলবে। স্বর্ণলতার ভারি রাগ হয়, বিরক্তে চোখ, মুখ কুঁচকে ফেলে। তাতেও কাজ হয় না।
মুনছুর সাখাওয়াত রুমে ঢুকল পড়ার মাঝেই। নীঃশব্দে ধীর পদক্ষেপে এসে বসল বিছানার কিনারে। স্বর্ণলতা খেয়াল করেও তাকাল না। আজকে সে সাজ মুছতে দিতে চায় না। উল্টোদিকে ঘুরে বসল। বইয়ে মুখটা এমনভাবে গুঁজে রাখল যে, তার ঠোঁটের লিপস্টিকটা যেন চোখে না পড়ে।
আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। অথচ মুনছুর সাখাওয়াত একটা কথাও বলল না। নড়াচড়াও নেই। একভাবে বসে আছে। দৃষ্টি একস্থির মেঝেতে। স্বর্ণলতার পড়ায় মন বসছিল না। বার বার মনে হচ্ছিল, এখনই রুমাল বের করে লিপস্টিক মুছে ফেলবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটছিল না। সাড়াশব্দও পাচ্ছিল না। ভাবল, চলেই গেল নাকি! নিশ্চিত হওয়ার জন্য পেছন ফিরতেই দেখল, যায়নি। বসে আছে আগের জায়গাতেই। সে চুপ থাকতে পারল না৷ প্রশ্ন করল,
” ভূতের মতো বইসা আছেন ক্যান? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথেই জবাব দিল। জিজ্ঞেস করল,
” ভূতেরা এভাবে বসে থাকে? দেখেছ কখনও? ”
” না। ওটা তো কথার কথা। তব্দা লাইগা আছেন, তাই কইলাম। ”
” তব্দা খাব কেন? ভাবছিলাম। ”
” কী? ”
সে তৎক্ষণাৎ উত্তরটা দিল না। নীরব থাকল কতক্ষণ। আপনমনে ভাবনা চালাল আরও কিছুক্ষণ। তারপরে আচমকা বলল,
” তোমার ঐ কথাটা সরিয়ে নাও তো, স্বর্ণলতা। ”
” কোনটা? ”
” ঐ যে, সব মেয়েকে মায়ের নজরে দেখতে বলছিলে না? এটা আজকে ভাঙি? কাল থেকে আবার রাখব। ”
” ক্যান? আজকে কী হয়ছে? কারও প্রেমে পড়ছেন? তারে বিয়া করবেন? ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬০)
” ক্যান? আজকে কী হয়ছে? কারও প্রেমে পড়ছেন? তারে বিয়া করবেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রথমে থতমত খেল। পরক্ষণে হতাশায় চোখদুটি বুঁজে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিল,
” না। ”
” তাইলে? ”
স্বর্ণলতা তার দিকেই চেয়ে আছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে রাজ্যের কৌতূহল, সন্দেহ। উত্তরের প্রতীক্ষা দৃঢ় হচ্ছে। মুনছুর সাখাওয়াত এতক্ষণে ভালো করে তাকাল স্ত্রীর মুখটায়। সরল, কচি চোখদুটিতে কাজলের রঙটা বেশ মানায়। মায়া মায়া ভাব ফুটে। কিশোরী ছাপটা খানিক মুছে যায় যেন! কিন্তু লিপস্টিক! অসহ্য লাগে। শরীর শিরশির করে ওঠে। মনে হয়, সাজের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য বস্তুটায় এটা। সে এবার পকেট থেকে রুমাল বের করল না। হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে লিপস্টিক মুছতে মুছতে বলল,
” এক লোক আমার থেকে তিন মাসের মেয়াদে ঋণ নিয়েছিল। গতকালই মেয়াদ শেষ হয়েছে। এরমধ্যে একবারও দেখা করতে আসেনি, ঋণের টাকাও ফেরত দেয়নি। আজকে খোঁজ নিয়ে দেখি, ঐ লোক মা রা গেছে। এখন হিসেবমতে, ওর ভিটে বাড়ি আমার। কিন্তু দখল করতে পারছি না। ”
” ক্যান? ”
” ওর স্ত্রী ঘর থেকে বের হচ্ছে না। একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে খুব কান্নাকাটি করছে। ঐ বাচ্চাটাও আবার মেয়ে। বাচ্চাটাকে ছিনিয়ে নিলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু এই কাজটা আমি করতে পারছি না, কাউকে দিয়ে করাতেও পারছি না। মনে হচ্ছে, দুজনেই আমার মা। মায়ের কোল থেকে মাকে ছিনিয়ে নিই কীভাবে, বলো তো? তাই আজকের জন্য তোমার কথাটা সরিয়ে নেও। ”
মুনছুর সাখাওয়াত লিপস্টিক মোছা শেষ করে চুলে হাত দিতে যাচ্ছিল। স্বর্ণলতা টের পেয়েই মাথাটা খানিক পিছিয়ে নিল। চুলের সাজটা সে কিছুতেই নষ্ট করতে দিবে না। এটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। আরও কতক্ষণ রাখতে চায়। সে চটজলদি মাথায় বড় করে ঘোমটা টেনে দিয়ে বলল,
” এজন্যে কথা সরাইয়া নিতে হইবো ক্যান? মাফ কইরা দিলেই তো হয়। যে ঋণ নিছে সে তো মইরাই গেছে। ”
” মাফ করব কেন? ঋণ দিয়েছি, দান-খয়রাত করিনি। চুক্তি অনুযায়ী এখন বউ শোধ করবে। না পারলে, বন্ধকে থাকা সম্পত্তি আমার। ”
” দান-খয়রাত করলে আপনে মাফ করবেন ক্যামনে? ঐ সুযোগ তো আপনের থাকবো না। যদি আল্লাহ খুশি হয় তাইলে আপনে রে মাফ করবো। আমার আম্মা কয়, দান করলে বড় বড় বিপদ থেইক্যা উদ্ধার পাওয়া যায়। আপনে কখনও দান করছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। সে অকারণে কোথাও এক টাকাও খরচ করে না। ভিক্ষুক দেখলে টাকা দিবে তো দূর মেজাজ নষ্ট হয়ে যায়। পারলে দুই-তিনটা লা থি মারে!
স্বর্ণলতার একহাতে বই, অন্য হাতে কলম। মুনছুর সাখাওয়াত দুটোই ছিনিয়ে নিল। অতঃপর এক এক করে চুড়িগুলো খুলতে খুলতে বলল,
” অন্যদিকে কথা না ঘুরিয়ে যেটা বলেছি সেটা করো। তোমার কথাটা তুলে নাও। ”
” আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। ”
সে সাথে সাথে সত্যিটা স্বীকার করে নিল,
” করিনি। ”
” জানতাম। আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দেন তো৷ ”
” কী? ”
” আমি শুনছি, আপনে যখন ছোট ছিলেন, তখন আপনের আব্বায় কোনো কাজ কাম করত না। আপনের আম্মা করত। তার একা উপার্জনে পুরা সংসার চলত। তারপরে হুট কইরা একদিন তিনি মইরা যান। তখন আপনে গো চলতে কষ্ট হয় নাই? ”
” অনেক কষ্ট হয়েছে। আম্মু তো অনেক ধার দেনাও করেছিল। সবাই এসে টাকা চাইতে লাগল। আমরা দিতে পারছিলাম না। আব্বু তো প্রথমদিনই ভাগছিল। দাদিজানের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে অনেক। শেষে বাধ্য হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। ”
” বাড়ি ছাড়ার সময় আপনের কষ্ট হয় নাই? ”
” না। দাদিজানের জন্য হয়েছিল। ”
” এখন ভাবেন তো, ঐদিন যদি উনারা আপনেগো মাফ কইরা দিত, তাইলে কি আপনাগো বাড়ি ছাড়তে হইত? দাদিজানও কষ্ট পাইত না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত একমনে চুড়ি খুলছিল। খুব সাবধানে, যত্ন করে। গুণে গুণে। এত সুন্দর, কোমল হাতে একটুও ব্যথা দিতে চাচ্ছিল না। সহসা থামতে হলো। ঝটিতে মাথা তুলে চাইতে স্বর্ণলতা মৃদু হাসল। বুদ্ধি চিকচিক করে ওঠল চোখদুটিতে। পলক জোড়া ফেলে আশ্বস্ত করে বলল,
” মাফ করলে কারও মান যায় না। ট্যাকাও ফুরাইয়া যায় না। আপনের তো অনেক ট্যাকা। এত অল্পতেই শেষ হইয়া যাইবো নাকি? ”
স্বর্ণলতা হাত টেনে নিয়ে নিজেই বাকি চুড়িগুলো খুলে ফেলল। ঘোমটা নামিয়ে চুলের সাজটাও নষ্ট করে খোঁপা করতে করতে বলল,
” আপনের এক মাফে দুই মায়ের কষ্ট দূর হইয়া যাইবো। বাড়ি ছাইড়া কই যাইবো কন তো? লগে তো ব্যাটা মানুষও নাই। দেখভাল করব কে? ”
” আমি কী জানি? মাফ-টাফ করতে পারব না। অনেকগুলো টাকা, স্বর্ণলতা। ”
” কত? ”
” এক লাখ। ”
সে তৎক্ষনাৎ কিছু বলল না। আপনমনে কী যেন ভাবল। সহসা নীরবতা ভেঙে সুধাল,
” আমি যদি আপনের থেকে ট্যাকা চাই, দিবেন? ”
” দিব না কেন? কত টাকা লাগবে বলো? ”
” এক লাখ পঞ্চাশ হাজার। ”
মুনছুর সাখাওয়াত চমকে ওঠল! এক মুহূর্তের জন্য কথায় বলল না। সামনের মেয়েটাকে বুঝার চেষ্টা করেও পারছে না। আজকে মুখটা ভীষণ অন্যরকম লাগছে। চোখের চাহনি, মুখের গড়ন সবকিছুতেই আলাদা কিছু এসে পড়েছে যেন! ঠিক ধরতে পারছে না। সে জানে, স্বর্ণলতা অর্থ লোভী না। টাকা জমানো কিংবা খরচ করা কোনোটায় আগ্রহী নেই। বিয়ের পরে এমন করে কিছু চায়নিও। তাহলে আজ কী হলো? হঠাৎ করে এত টাকা চাচ্ছে কেন? সে কৌতূহলটা দমাতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,
” এত টাকা দিয়ে কী করবে? ”
” কী করমু, এই কথা না কইলে দিবেন না? ”
” দিব। কখনও চাওনি তো তাই…”
কণ্ঠটা আপনাআপনি থেমে গেল। স্বর্ণলতা চটপটে বলল,
” আপনের মনে হয় ট্যাকা দিতে কষ্ট হইতাছে, থাক। ”
সে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। বই-খাতা এমনভাবে টেনে নিল যেন কত পড়া বাকি! এখনই একদমে শেষ করতে না পারলেই ফাঁসির দড়িতে লটকে পড়বে। মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসে ছিল। কিনারে, খানিক দূরত্বে। সে সামনে এগিয়ে গেল। স্ত্রীর কাছ ঘেষে বলল,
” তুমি চাইলে পুরো আমিটাকেই দিয়ে দিতে পারি! ”
স্বর্ণলতা মুখ তুলল না। উপুড় হয়ে বই থেকে খাতায় কিছু একটা টুকতে টুকতে জবাব দিল,
” আপনেরে চাই নাই। ”
” আমার টাকা চাচ্ছ তো? ওটাও আমারই অংশ। ”
সে তখনই একটা চাবির গোছা রাখল স্বর্ণলতার খাতার ওপরে। অতঃপর বলল,
” কোথায় টাকা আছে জানোই তো? একদিন বলেছিলাম, মনে আছে না? যত লাগে নিয়ে নাও। আমাকে হিসেবও দিতে হবে না। ”
সে এক মুহূর্তও দেরি করল না। চাবির গোছা নিয়ে চলে গেল বুকশেলফের কাছে। নিচের ড্রয়ারের তালা খুলতেই দেখল, একপাশে দলিলের পাহাড় অন্যপাশে টাকার বান্ডিল। সবগুলোই নতন, চকচকে। একটা বান্ডিল বের করে জিজ্ঞেস করল,
” এখানে কত ট্যাকা আছে? ”
” পঞ্চাশ হাজার। ”
স্বর্ণলতা আরও দুটো বান্ডিল নিল। ড্রয়ারে পূর্বের মতো তালা লাগিয়ে হেঁটে এলো স্বামীর নিকট। মুনছুর সাখাওয়াত ততক্ষণে বিছানায় আধশোয়া হয়েছে। পা দুটি টান টান। দুই হাত বুকের কাছে রেখে নিবিড়ভাবে দেখছে, তার অল্পবয়সী বউটাকে। মুখের রঙটা আজকে অত্যধিক উজ্জ্বল। হাসিখুশি ভাবটা হারাচ্ছে না। স্থায়ীভাবে লেগে আছে চোখের তারায়, গাল ও অধরে। মুখ থেকে নজর সরে এলো চঞ্চল পা জোড়ায়। মুহূর্তেই ভাবনা এলো, স্বর্ণলতা প্রতিদিনই সাজছে। অনেক দিনই চলছে পর্বটা। কিন্তু একদিনও পা সাজায়নি। মেয়েটা কি আলতা পরতে পছন্দ করে না? নুপুর জোড়াও তো নিয়ম করে পরে না! সুযোগ পেলেই খুলে রাখে। যতক্ষণ না মুনছুর সাখাওয়াত বলবে ততক্ষণ পরবে না। আজও নেই। নরম, কমনীয় পা দুটি একেবারে ফাঁকা। অলঙ্কার নেই, রঙও না।
স্বর্ণলতা দুটো টাকার বান্ডিল এক করে স্বামীর দিকে বাড়িয়ে বলল,
” ধরেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আশ্চর্য হলো। পা দুটি টেনে ভাঁজ করে উঠে বসতে বসতে সুধাল,
” আমাকে দিচ্ছ কেন? ”
” আপনের এক লাখ ট্যাকার লোকসান হইতাছিল না? ঐটা পূরণ কইরা দিলাম। আপনের কারও বাড়ি দখল করতে হইবো না, মাফও করতে হইবো না। নিজের ঘরে বইসা ঋণের টাকা ফেরত পাইলেন। ”
” আমার টাকা দিয়ে আমার ঋণ পরিশোধ করছ? ”
” আপনের ট্যাকা হইবো ক্যান? এগুলা আমার। ”
সে টাকাগুলো নিতে নিতে ভাবল, এত কাণ্ড হলো তাকে বোকা বানানোর জন্য? স্বর্ণলতা জিজ্ঞেস করল,
” আপনে কি এখন বাইরে যাইবেন? ”
” কেন? তোমার কিছু লাগবে? ”
বাকি এক বান্ডিলও মুনছুর সাখাওয়াতের হাতে দিয়ে বলল,
” এই ট্যাকাগুলা ঐ বাচ্চার মারে দিবেন। ধার না, আবার দানও না। এইটা হলো সাহায্য। উনাগো এখন অনেক বিপদ, সাহায্য না পাইলে উদ্ধার হইতে পারবো না। যদি ভালা মনের মানুষ হয়, বিপদ থেকে উদ্ধার হইলে ট্যাকাগুলো ফেরত দিয়া যাইবো। আপনে কোনো আশা রাখবেন না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই টাকাটাও নিল। তারপরে একসাথে সবগুলো বুকশেলফের ভেতরে রাখতে রাখতে বলল,
” আমি বিনিময় ছাড়া কাউকে সাহায্য করিনি, করবও না। এটা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। জানাজানি হলে, আমাকে কেউ ভয় তো পাবেই না উল্টো হাসবে। ”
স্বর্ণলতা তার কাছে এগিয়ে এলো ঠিকই কিন্তু কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই সে বলে ওঠল,
” পড়া শেষ করো। আমি বাইরে যাচ্ছি, ফিরে এসে যেন বিছানায় বই-খাতা না দেখি। ”
_______
মুনছুর সাখাওয়াত ফিরে এসে দেখল, তার রুমের দরজা ভেজানো। ভেতরে আলো জ্বলছে ঠিকই কিন্তু স্বর্ণলতা জেগে নেই। বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অন্যপাশটা খালি, পরিষ্কার। কোথাও বই-খাতা ছড়িয়ে নেই। মেয়েটা এই কথাটা রাখল কিন্তু জেগে থাকতে পারল না। সে একটু হতাশ হলো, বিষণ্ণও দেখাল চোখ, মুখ।
মুনছুর সাখাওয়াত দরজা আটকাল। আলো নেভাবে কি নেভাবে না বুঝতে পারছিল না। স্বর্ণলতা ঘুমিয়ে পড়লেও সে ঘুমাতে পারবে না এখনই। তার কাপড় বদলানো দরকার। গোসল করতে পারলে ভালো হয়৷ রাতের খাবারটাও খাওয়া হয়নি। একবার ইচ্ছে হলো, বউয়ের ঘুম ভাঙাতে। পরক্ষণে ইচ্ছেটা পিষে ফেলল। আলোটা নেভাল না। শুধু হাঁটার সময়ে সতর্ক থাকল। হাতের ছোট্ট প্যাকেটটা নীঃশব্দে রাখল স্বর্ণলতার মাথার কাছে। প্যাকেটের মধ্যে একটা আলতার কৌটো আছে। এটা আনতে গিয়েই দেরি হয়েছে। কত দোকান ঘুরতে হলো! বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিল, কড়াভাবে বলে দিবে এটা যেন কাউকে না দেয়। পছন্দ না হলে পরবে না, ফেলে দিবে। তাও কাউকে দিতে পারবে না। যে জিনিসটা তার জন্য ভালোবেসে আনে সেটা অন্য কেউ পরবে! অসম্ভব।
মুনছুর সাখাওয়াত গোসল করে বের হয়ে দেখল, স্বর্ণলতা তখনও ঘুমাচ্ছে। পাশ ফিরেছে। তার দিকে মুখটা! এতদিন ধরে এই রুমে ঘুমাচ্ছে, একসাথে, পাশাপাশি। তারপরেও কখনও তার দিকে ফিরে শুতে দেখেনি। আজ ফিরল যে! তার ইচ্ছে হলো এখনই গিয়ে শুয়ে পড়তে। সেও স্বর্ণলতার দিকে ফিরেই ঘুমাবে। মুখোমুখি, একজন চোখ বুঝে থাকবে আরেকজন চোখ মেলেই থাকবে। এত কাছ থেকে নিশ্চিন্তে নিঃসংকোচে দেখার সুযোগটা পেয়েও অবহেলা করবে?
মুনছুর সাখাওয়াত শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিছানায় উঠতেও পারল না, স্বর্ণলতা নড়ে ওঠল। চোখের পলকে মুখটাসহ ঘুরে গেল অন্যদিকে। মুনছুর সাখাওয়াতের এত খারাপ লাগল! মেজাজটায় চড়ে গেল। কিনে আনা আলতাটা তুলে নিয়ে আছাড় মারতে চেয়েও মারল না। দাঁতে দাঁত চেপে, চোখ-মুখ খিঁচে সেই রাগ নিয়ন্ত্রণে আনল। অতঃপর আস্তেধীরে উঠে দাঁড়াল। আলো নেভানোর পূর্বে আরও একবার ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ শরীরটায় চোখ বুলিয়ে আনছিল সহসা দৃষ্টি আটকে গেল পায়ে। সাথে সাথে মানসপটে একটা ঘটনা ভেসে ওঠল। ঘটনাটা স্বর্ণলতাকে নিয়েই। এভাবেই বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। অসাবধানে পায়ের দিকে কাপড়টা সরে গিয়েছিল অনেকটুকু। মুনছুর সাখাওয়াত ঝুঁকেছিল, লুকিয়ে নুপুর পরানোর জন্য। কিন্তু শরীরের ভেতর খেল গেল অন্যকিছু! তখন মেয়েটা আরও ছোট ছিল, অনেকটায় অবুঝ। তারপরেও কী তীব্র অনুভূতি জাগিয়ে ফেলেছিল। কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিল না। ভাগ্যিস, দাদিজান চলে এসেছিল!
মুনছুর সাখাওয়াত ঘরের আলো নিভিয়ে ফেলল। তারপরে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে এগিয়ে গিয়ে বসল স্বর্ণলতার পায়ের কাছে। আজকে নুপুর না, আলতা পরাবে। আলগোছে শাড়ি উপরে তুলে নিল খানিকটা। কী অদ্ভুত! সেদিনের মতো তীব্র অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতিটা জাগল না। তাহলে কি ধৈর্য ধরা শিখে গিয়েছে? মানছুরার পত্রে লেখা পরামর্শটায় মানছে? সে খেয়াল করেছে স্বর্ণলতা আগের মতো নেই। একটু একটু করে বদলাচ্ছে। সংকোচ বোধ ছেড়ে সহজ হয়েছে। নিজ থেকে পাশে বসছে, কথা বলছে, হাত ধরলে সরিয়ে নিচ্ছে না। বিরক্ত ও রাগের ভাবটাও ক্রমশ কমে আসছে। নিজেকে হয়তো পুরোপুরি মেলে দিয়ে সমর্পণ করেনি কিন্তু তার বিশ্বাস হাত ধরার চেয়েও বেশি করতে চাইলে, করতে পারবে। তারপরেও মুনছুর সাখাওয়াত এগুতে পারে না। বুকের মধ্যে মাছের কাঁটার মতো একটা ভয় আটকেই আছে। এই মুহূর্তে স্বর্ণলতাকে যেভাবে পাচ্ছে, একসময় এভাবে পাওয়ার জন্যও ব্যাকুল ছিল। পেয়েছে তো! এতেই সন্তুষ্ট থাকুক না, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যদি এটাও হারিয়ে ফেলে?
আলতা পরানো শেষ হতেই মুনছুর সাখাওয়াতের সকল ভালো চিন্তা হারিয়ে গেল। ধৈর্যের পাহাড় ধ্বসে পড়ল। বুকে আটকে থাকা ভয়টাও মিলিয়ে গেল নিমিষেই। একটা পায়ে হাত রেখে প্রথমবারের মতো ঠোঁট ছুঁয়াল স্বর্ণলতার পায়ে। উষ্ণ অনুভূতিটা ঠিকমতো অনুভবও করতে পারল না। ফট করে পা’টা সরে গেল। সে কিছু বুঝে উঠার আগেই স্বর্ণলতা ভূত ভূত শব্দে চেঁচিয়ে ওঠল। শোয়া থেকে উঠে বসে সমানে ডেকে চলল,
” আম্মা! আম্মা! ”
মুনছুর সাখাওয়াত এবার সত্যি সত্যিই তব্দা খেল। কী ঘটছে, কী বলছে কিছুই যেন বুঝে আসছিল না। পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় চলে গেল? সে থম মেরে বসেই রইল বিছানার কাছে মেঝেতে। মোবাইলের স্বল্প আলোতে ঘরের ভেতরটা আবছা, দেয়ালে দেয়ালে নানান ধরনের ছায়া পড়েছে। স্বর্ণলতা ততক্ষণে উঠে বসেছে। হাত-পা টেনে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ভয়ে, আতঙ্কে কাঁপছে। সে যে শ্বশুরবাড়িতে, স্বামীর ঘরে আছে বেমালুম ভুলে বসেছে। এটায় মুনছুর সাখাওয়াতের পছন্দ হলো না। গায়ে ফোসকা পড়ল যেন! সে আলোটা জ্বালিয়েই প্রথমে বলল,
” আমি তোমার আম্মা লাগি? ”
আলো পেয়ে স্বর্ণলতার ভীত ভাবটা কেটে গেল অনেকটায়। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বোকার মতো চেয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপরে বলল,
” আম্মা লাগলে কি অত দূরে দাঁড়িয়ে থাকতেন? কাছে এসে আগে ভয় দূর করতেন। তারপরে ধমকাইতেন। আপনে তো জীবনে আম্মা হইতে পারবেন না কিন্তু আল্লাহ চাইলে আব্বা হইতে পারবেন। আর আব্বা হইলে আপনের পোলাপানেরা অনেক দুঃখে থাকবো। তারচেয়ে ভালা আব্বাও হইয়েন না কোনোদিন। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের মন নরম হলো। বউয়ের কাছে বসে বলল,
” অযথায় ভয় পেয়েছ। কোনো ভূত আসেনি। ”
” আসছে। আমার পায়ের কাছে বইসা ছিল। ”
” পায়ের কাছে বসবে কেন? ”
” র ক্ত খাওয়ার জন্য। আমি পা’টা টান না দিলেই তো কামড়টা বসাইয়া দিত। ”
স্বর্ণলতার শরীর শিউরে ওঠল। সে ভূতের গল্প শুনেছে, কখনও দেখেনি। অনুভবও করেনি। আজকেই প্রথম এমন কিছু টের পেল। ওটা কি সত্যি ভূত ছিল? তাহলে কি পৃথিবীতে ভূতের অস্তিত্বও আছে।
” স্বর্ণলতা, তোমার পায়ের কাছে আমি বসে ছিলাম। ”
সে যেন আকাশ থেকে পড়ল! বিস্ফারিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” আপনে? ”
” হুম। ”
স্বর্ণলতার বিস্ময় ভাব কাটল না। স্থাণুভাবে বসে থেকে আচমকা কান্নাপ্রায় গলায় বলল,
” আপনে সত্যি আমারে কামড়াইলেন? ”
” আরে! কামড়াব কেন? আমি কি র ক্ত খাই? ”
” ঐটা তো আপনে জানেন। সেদিন দাদিজানরে কইছিলেন না, আমারে কামড়াইবেন? ”
” ওটা তো রাগের কথা। তাই বলে সত্যি কামড়াব নাকি? বিশ্বাস না হলে পা দেখ। কা মড়ালে তো দাগ থাকার কথা। ”
স্বর্ণলতা পা দেখবে তো দূর শাড়ি দিয়ে আরও ঢেকে ফেলল। তারপরে বলল,
” আপনের লগে আর থাকমু না। দাদিজানের কাছে যামু। ”
বলতে বলতে সে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। দরজার দিকে দৌড় দিতেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” স্বর্ণলতা, কোথাও যাবে না। এই ঘরেই থাকবে, আমার পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ো। নাহলে আবার কা মড়ে দিব। ”
সে দূর হতে জিজ্ঞেস করল,
” তারমানে সত্যি কামড়াইছেন? ”
” হুম। ”
” ক্যান? কী করছি? আমি তো আপনের সব কথাই শুনি। ”
” শোনো না। আমি ময়নার থেকে সাজতে মানা করেছিলাম, শুনেছ? ”
স্বর্ণলতা চোখ নামিয়ে নিতে মুনছুর সাখাওয়াত পুনরায় বলল,
” এখন থেকে কোনো কথা না শুনলেই আমি কা মড়ে দিব। ”
সে নত মাথায় ধীরেসুস্থে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬১)
সকালবেলা। স্বর্ণলতা রান্নাঘরে। দাদিজানের নাস্তা তৈরি হলো নাকি খোঁজখবর নিচ্ছে। সহসা শুনতে পেল,
” আল্লাহ! আপনের পা দুইডা কী সুন্দর লাগতাছে গো, আফামনি। ”
ময়নার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর। প্রশংসার সাগরে ডুব দিয়ে এলো যেন! সে নিচে বসে মাছ কুটছিল। আপামনির পায়ে নজর পড়তেই দৃষ্টি আটকে গেল। চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে তখনও! স্বর্ণলতা প্রথমে তার দিকে তাকাল। পরক্ষণে শাড়ির পাড়ের নিচে আলতা রাঙা পা দুটিতে। মুহূর্তেই দৃষ্টিজোড়া স্থির হয়ে গেল। বিস্ময়ে অভিভূত!
” এতদিনে আলতা পরলেন? আমি পরথমদিনই চাইছিলাম, আপনেরে আলতা পরাইয়া দিই। নতুন বউ, কম বয়স। কী ভালা ভালা শাড়ি, গয়না পরেন। তার লগে আলতা না পরলে ভালা দেহায়? আমার কাছে নাই, তাই পরাইয়া দিতে পারি নাই এদ্দিন। আজকা খুউব সুন্দর লাগতাছে, মানাইছে কিন্তু! এক্কেবারে রাজার বউগো মতো লাগতাছে। এবার যদি নুপুরগুলাও পরেন, পুরাই রানি দেখাইবো। আমগো রানিসহেবা। ”
কলি রুটি ভাজছে। এক ফাঁকে সেও তাকাল। পা জোড়া দেখল মুগ্ধ হয়ে। অতঃপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্মতি দিয়ে বলল,
” হ, ময়না কিন্তু এক্কেবারে ঠিক কথাডায় কয়ছে, আফামনি। আপনের যে দুইখানা সোনার নুপুর আছে? ঐডি পরলে আরও রূপ খুলবো। পা দুইটা ঝিলিক দিবো। ”
সে জবাবে কিছুই বলতে পারল না। একভাবে এক ধ্যানে নিষ্পলক দৃষ্টি জোড়া পায়েই স্থির হয়ে আছে। গতকাল রাতের ঘটনাটা স্বর্ণের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠল মস্তিষ্কে। মুহূর্তেই চাপ অনুভব করল অন্তরে। মানুষটা তাহলে সত্যি তার পায়ের কাছে বসে ছিল? বসে বসে এসব করেছে? কামড়ের কোনো চিহ্ন বা ব্যথা নেই। স্বর্ণলতা দিব্যি হাঁটতে পারছে, সামান্যতম অসুবিধা হচ্ছে না। যে মানুষটা দোষ স্বীকার করে না, ভুল করেও অনুতপ্ত হয় না। সেই মানুষটা দোষ না করেও দোষ স্বীকার করেছে?
স্বর্ণলতা তখনই রুমে ছুটে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত নেই, সে ভোরের দিকে বেরিয়েছে। তারপরেও রুমে বসে থাকল। পা দুটো তুলে কতক্ষণ চেয়ে থাকল। এ পা দুটি তার? বিশ্বাসই হচ্ছে না! লাল রঙটা পূর্ব থেকেই পছন্দ ছিল, এবার বুঝি স্থায়ীভাবে বুকের মধ্যে গেঁথে গেল। সে চট করে উঠে গিয়ে নুপুর জোড়াও পরে নিল। এরমধ্যে ময়না ডাকতে এলে সে ঘোর লাগা কণ্ঠস্বরে জানাল,
” আমারে আর সাজাইতে আসবা না, ময়নাবু। ”
” জি আচ্ছা, আফামনি। ”
” এখন থেইকা আফামনিও ডাকবা না। তোমগো মহাজনে যা কইয়া ডাকতে কইছিল, তাই ডাকবা। ”
” জি আচ্ছা, রানিসাহেবা। ”
_______
মুনছুর সাখাওয়াত এলো দুপুরবেলা। ঘরে ঢুকল না। সোজা গিয়ে বসল খাবার টেবিলে। শ্রমক্লান্ত মুখ, ঘামে ভেজা বুক ও পিঠ। স্বর্ণলতা আড়চোখে তাকিয়েছিল, তারপরেও ধরা পড়ে গেল৷ এত অপ্রস্তুত হলো! বুকের ভেতরটাও কেমন করে ওঠল! মনে হলো, সকাল থেকে চাপ খেয়ে থাকা অন্তরটা এবার কারও মুঠোয় চলে গেল। সমানে সর্বশক্তিতে মন ভরে পিষে যাচ্ছে।
খাওয়ার সময় মুনছুর সাখাওয়াত একটু তাড়াহুড়ো করছিল। জরুরি কাজ ফেলে এসেছে, এখনই বের হতে হবে। দাদিজানকে জানাচ্ছিল, আসতে চাচ্ছিল না, ক্ষুধাটা এত তীব্র হয়ে গেল যে না এসে পারল না। জীপ নিয়ে এদিক দিয়ে যাচ্ছিল। সময় ও সুযোগ মিলে যাওয়ায় বাড়ির ভেতরে ঢুকল। এখন বের হলে রাতে ফেরার নিশ্চয়তা নেই। বেশি দেরি হলে যেন আজকে স্বর্ণলতাকে তার রুমে ডেকে নেয়। একসাথে ঘুমাবে। তার এই তাগাদা, জরুরি কাজ সবই স্মৃতি থেকে বেরিয়ে গেল নুপুরের সুমিষ্ট ধ্বনিতে। সে মূল দরজার দিকে না হেঁটে স্ত্রীর পিছ পিছ নিজেদের রুমে ঢুকল। অজান্তেই, সম্মোহনের মতো। স্বর্ণলতা প্রথমে খেয়াল করেনি। সে এসেছিল অন্য কাজে। পরক্ষণে সন্দেহটা হলো। ঝটিতে পেছন ফিরতে ধাক্কা খেল মুনছুর সাখাওয়াতের বুকের সাথে। ভারী শক্ত! একটুও দমেনি, উল্টো সে ভয়ে, আতঙ্কে পেছনে ছিটকে সরে গেল। বুকের মধ্যে দু’বার থুতু দিয়ে বলল,
” ভূতের মতো দাঁড়াইয়া আছেন ক্যান? উফ! আরেকটু হইলে জান বাইর হইয়া গেছিল। ”
” তাই নাকি! তোমার জানের এত সাহস? আমার সামনে বের হয়ে যাবে? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিল না। আনমনে হয়ে গেল। মনে পড়ল, এই দানবের মতো শরীরের উপস্থিতি আগে চোখ বুঁজেও টের পেত। গা থেকে ভুরভুরে আতরের গন্ধ বের হতো, হাঁটলে মাটি কাঁপত। এখন এসবের কিছুই হয় না। চোখ মেলে না দেখলে, বুঝতেই পারে না মানুষটা কতদূরে, কোনদিকে আছে। এসবের পেছনে কারণ কী হতে পারে? স্বাভাবিক পরিবর্তন নাকি অলৌকিক কিছু?
” গতকাল আমার হাত ধরোনি কেন, স্বর্ণলতা? ”
তার আনমনে ভাব কাটল। সচেতন হয়ে সুধাল,
” হাত ধরতে কইছিলেন? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” হাত ধরে বললে হয়তো ঐ বাচ্চা ও তার মাকে সাহায্য করতাম। তোমার টাকাটা ওদের কাছে পৌঁছাত। ”
স্বর্ণলতা সাথে সাথে তার বামহাতটা চেপে ধরল। কব্জির কাছে। শক্ত, পুরু অংশটা তার একহাতে আঁটে না। সে এবারও আরেক হাতের সাহায্য নিল। ঠিক তখনই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এখন ধরে কী লাভ? তুমি ঐ সুযোগটা হারিয়ে ফেলেছ। ”
সে আশাহত হলো। অপ্রতিভ দেখাল চোখজোড়া। মুখ ভার করে হাত দুটি সরিয়ে নিতে চাইল। ঢিলে হতে হতেও দৃঢ় হয়ে গেল। আচমকা বলল,
” আম্মার কথা খুব মনে পড়তাছে। একটু দেখা করাইয়া আনবেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক সেকেন্ডও সময় খরচ করল না। তৎক্ষনাৎ জানিয়ে দিল,
” না। ”
স্বর্ণলতা হাত দুখানা সরিয়ে নিল। প্রচণ্ড বিরক্ত দেখিয়ে বলল,
” এজন্যই হাত ধইরা কই নাই। যে বিনা খরচের কাজ করতে চায় না, সে টাকা খরচ কইরা কাজ করতে চাইবো? ”
সে মুখ বাঁকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
_______
রাতের বেলা। মুনছুর সাখাওয়াত আগে থেকে শুয়ে ছিল। স্বর্ণলতা এলো তার পরে, টুকটাক কাজ শেষ করে। রুমের দরজাটা সেই আটকাল। আলো নেভানোর পূর্বে একবার তাকাল স্বামীর দিকে। সে চেয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মতামত দিচ্ছে না। স্বর্ণলতার প্রশ্নবিদ্ধ নীরব দৃষ্টি টুকু পড়তে পারল না। বোঝার মতো চেতন বা মনোযোগটুকুই নেই। সে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে স্ত্রীর কচি, তুলতুলে অধর জোড়ায়। কতদিন পরে দেখতে পেল এই কমনীয় পার্থিব সৌন্দর্যটুকু? মুনছুর সাখাওয়াত হিসেব করতে পারে না। তার এলোমেলো লাগে। হৃদয় আকাশে তুফান নামে। কী যেন ভেঙে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র চলতে থাকে! মস্তিষ্ক কাজ করতে পারে না। শরীর অবশ হয়ে আসে। হাত-পায়ের সাধারণ নড়াচড়াটুকুও সম্ভব হয় না।
স্বর্ণলতা সেধে প্রশ্নটা করল না। আলো নিভিয়ে দিল। বিছানায় এসে শুয়ে পড়তে শুনল,
” আম্মার কথা কি খুব মনে পড়ছে? ”
” হ, অনেক। ”
” আচ্ছা, নিয়ে যাব। কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি থাকতে পারবে না। ”
” তাতেই হইবো। ”
তার কণ্ঠে দারুন খুশি, কৃতজ্ঞতা। মুনছুর সাখাওয়াতের এতে কি মন ভরে? সে বলল,
” তাহলে আমার হাতটা ধরে থাকো। যতক্ষণ না ছাড়তে বলব ততক্ষণ ধরে থাকবে। আমি বলার আগেই যদি ছেড়ে দাও, তাহলে আম্মার সাথে দেখা করার ঐ এক ঘণ্টাও পাবে না। ”
” এখন? ঘুমামু না? ”
সে কোনো জবাব দিল না। স্বর্ণলতার খুশির ভাব কেটে গেল। রাগ করতে চেয়েও পারল না। মনে পড়ল, এই লোকটায় তো এমন৷ স্বার্থপর! বিনা পারিশ্রমিকে কিছু করে না। সে চোখ, মুখ কালো করে মুনছুর সাখাওয়াতের একটা হাত স্পর্শ করল। আলগোছে, কনুইয়ের কাছে। সাথে সাথে কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” ঠিক করে ধরো, স্বর্ণলতা। ”
সেও তেজে ওঠল যেন! আঙুল দিয়ে খামচির মতো ছাপ ফেলে বলল,
” ঘুম ধরছে না? হাত ধরাইবেন আরও আগে কইবেন না? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এখানেও নীরব থেকে গেল। হঠাৎ করেই তার এই নীরব থাকাটা পছন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বলার চেয়েও শুনতেই ভালো লাগে বেশি। স্বর্ণলতার এই রাগ ও জেদের নখ বসানোর প্রয়াসটাও হারিয়ে গেল ধীরে ধীরে। স্পর্শ হয়ে উঠল পূর্বের চেয়েও হালকা! ফসকা। নরম, ঈষদুষ্ণ আঙুলগুলো সরেই যাচ্ছিল প্রায় তখনই সে ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”
সে জবাব দিল না। রুমটা অন্ধকার। মুনছুর সাখাওয়াতের চোখে আঁধারটুকু সয়ে এলেও ঠিক বুঝতে পারল না বোধ হয়। মুখটা সামান্য বাড়িয়ে হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” ঘুমিয়ে পড়েছ? ”
স্বর্ণলতা এবারও জবাব দিল না। কিন্তু নড়ল। প্রথমে পুরো শরীরটায় এগিয়ে এলো। তারপরে আচমকা মুনছুর সাখাওয়াতের গলা প্যাঁচিয়ে ধরল। সে প্রথমে ঘাবড়ে গেল। পরক্ষণে অবাক হয়ে আপনমনে বিড়বিড় করল,
” তোমার ঘুমের বদভ্যাসটা তাহলে এই? দাদিজান, একারণেই তোমার সাথে ঘুমাতে ভয় পেত? ”
সে খেয়াল করল, স্বর্ণলতার শুধু হাতটায় তাকে স্পর্শ করে আছে। সময়ে সময়ে প্যাঁচটা আরও দৃঢ় ও শক্ত হয়ে আসছে। কিন্তু বাকি সব দূরে, স্পর্শ বাঁচিয়ে আছে। মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু সুরে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
সাথে সাথে আওয়াজ ভেসে এলো,
” হুম? ”
” জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে? ঘুমাও। আমি তো মানা করিনি কখনও। ”
স্বর্ণলতা উত্তরে কিছু বলল না। অস্পষ্ট, ক্ষীণ আওয়াজটাও দিল না। মুনছুর সাখাওয়াত তার জড়িয়ে ধরার অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। শরীরের কোনো হেলদোল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে সুধাল,
” আমি ধরব? ”
এবারও উত্তর নেই। সে গভীর ঘুমে। ভারী নিঃশ্বাস পতনের শব্দ স্পষ্ট হয়ে ঢুকছে মুনছুর সাখাওয়াতের কানে। স্বর্ণলতার মাথাটা কাছেই, মুখটা ফেরানো তার দিকে। ইচ্ছে হয় আরেকটু কাছে যায়, কোমল ছোট্ট দেহটা গভীরভাবে জড়িয়ে নেই। তারপরে… মুনছুর সাখাওয়াত ভাবতে পারে না। চোখ বুঁজে নেয়। অসহায় লাগে! হাঁসফাঁস শুরু হয় বুকের ভেতরে। টের পায়, দেহের প্রতিটা রক্তবাহীতে কিসের জন্য তীব্র আন্দোলন বয়ে চলছে।
প্রায় মিনিটখানেক সময় চুপ থেকে মুনছুর সাখাওয়াত চোখ মেলল। স্ত্রীর দিকে মাথাটা পুরোপুরি ফিরিয়ে কোমল গলায় পুনরায় ডাকল,
” স্বর্ণা? ”
” হুম? ”
সেই আওয়াজ। ঘুমে জড়ানো নিম্নস্বরের উদাস শব্দটা! মুনছুর সাখাওয়াত তার ঠোঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে কাতর স্বরে জানাল,
” আমার এখানে খুব আদর করতে ইচ্ছে করে। ”
স্বর্ণলতা জবাবে কিছু বলে না। পুরো নিশ্চুপ। কেউ তার ঠোঁট নিয়ে খেলছে, আবেদনীয় আরজি প্রকাশ করছে তার কিছুই অনুভব করছে না। কর্ণগোচরও হচ্ছে না। মুনছুর সাখাওয়াত আবারও ডাকল,
” স্বর্ণা? ”
” হুম? ”
” তুমি উঁচা করে খোঁপা করলে যে ছোট ছোট চুলগুলো তোমার ঘাড়ে পড়ে থাকে? আমার ওদেরকেও খুব আদর করতে ইচ্ছে করে। ”
সে একটুক্ষণ চুপ থেকে আবারও ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণা? ”
” হুম? ”
” তুমি উপুড় হয়ে লেখার সময় শাড়িটা খানিক সরে গিয়ে যে পেটের একপাশ দেখা দেয়? আমার তো ওখানেও খুব আদর করতে ইচ্ছে করে, বউ! কিন্তু আমি কোথাও আদর করতে পারি না। এত পাগল পাগল লাগে! সামলাতে খুব কষ্ট হয়। ঐ সময়টা শুধু ঐ সময়টা তুমি আমাকে সামলানোর দায়িত্ব নিতে পার না? নেও না, বউ! “,
মুনছুর সাখাওয়াতের কাতরতা প্রবল হয়, কণ্ঠস্বর চওড়া হয় তারপরেও স্বর্ণলতার দিক থেকে কোনো উত্তর আসে না। সে চেঁচিয়ে ওঠে,
” এই বউ? বউ! ”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। ছোট্ট বেখেয়ালি আওয়াজটাও না! মুনছুর সাখাওয়াত আরও কয়েকবার ডাকল। রাগে, গরমে সম্বোধনটা বউ থেকে স্বর্ণা হয়ে যেতেই গলা প্যাঁচিয়ে থাকা হাতটা তার মুখ চেপে ধরল। অতঃপর ঘুম ঘুম কণ্ঠে বিরক্ত মেশানো কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” আম্মা! তুমি এখনও ঘুমের মইধ্যে কথা কও? যাও তো, মাধুআপার কাছে যাও। আমার ঘুম নষ্ট করবা না। ”
কথাগুলো শেষ করে সে হাতটা সরিয়ে নিল। বিপরীত মুখী হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নিমিষেই। কিন্তু এই ঘুমটা টেকসই হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত সমানে ডাকতে লাগল,
” স্বর্ণলতা? স্বর্ণলতা, উঠো। স্বর্ণলতা উঠে বলছি। ”
সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। রুমের অন্ধকারে প্রথমে আঁতকে ওঠল। পরক্ষণে শঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করল,
” কী হয়ছে? বাড়িত চোর ঢুকছে? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” ভালো করে দেখ, তোমার পাশে তোমার আম্মা না, স্বামী শুয়ে আছে। ”
স্বর্ণলতা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড বাকহারা থেকে আচমকা জিজ্ঞেস করল,
” এইটা বলার জন্য এই শেষ রাইতে ডাইকা তুলছেন? ”
” মনে করো তাই। ”
” আপনে তো শুরু থেইক্যা পাগল ছিলেন, এখন আমার পাগল হওয়া বাকি। ”
বলতে বলতে সে পূর্বের মতো শুয়ে পড়ল। এতেও তার রাগ বা বিরক্ত একচুলও কমল না। অভিযোগের মতো বলল,
” এখন তো ঘুম আইতে আইতেই ভোর হইয়া যাইবো। ঘুমাবোটা কখন? নামাজে বইসা ঝিমামু তারপরে দাদিজানের কাছে বকা খামু। আপনের তো খুব আনন্দ লাগবে! ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। খানিক এগিয়ে গেল স্ত্রী নিকটে। মাথায় একটা হাত রেখে বলল,
” ঝিমাবে না। আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। ”
স্বর্ণলতা সেই হাত ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল,
” লাগত না। খালি খালি ঘুম ভাঙ্গাইয়া আবার ঘুম পাড়াইতে আইসে! ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রথম ফিরিয়ে দেওয়াকে গায়ে মাখল না। অপমানিত বোধ করল না। আগের মতোই সাগ্রহে সস্নেহে হাত রাখল ক্রোধান্বিতার মাথায়। চুলে হাত বুলানো শুরু করতেই স্বর্ণলতা আবারও জোর করে হাতটা সরিয়ে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত তৃতীয়বারের মতো হাত রাখল। সেকেন্ড দুই পেরুতেই অবাক হলো। তার হাত সরিয়ে দিচ্ছে না।
________
স্বর্ণলতা মায়ের বাড়ি পৌঁছাল সকালে। মুনছুর সাখাওয়াত জীপে করে দিয়ে গেল। এক ঘণ্টা পরে এসে ফেরত নিবে। সে খুশিমনে চপল পায়ে ঢুকল বাড়ির ভেতরে। শবনম বেগম স্বামী ও বড় মেয়ে মাধবীলতাকে নাস্তা খাওয়াচ্ছে। সুবর্ণকে আশপাশে কোথাও দেখা গেল না। সে না চাইতেও দৃষ্টি ঘুরতে লাগল বাড়ির ভেতরের প্রতিটি জিনিসে। সবকিছু নতুন, দামি ও উন্নতমানের। এত সব কে কিনল? আব্বা? সে তো ঠিকমতো বসতেও পাচ্ছে না! শুয়ে শুয়ে আম্মার হাতে খাচ্ছে।
” আব্বার কী হয়ছে? ”
শবনম বেগম প্লেট রেখে মেয়ের কাছে ছুটে এলেন। গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকলেন কতক্ষণ। তারপরে বললেন,
” আয়, বয়। তোরেও খাওয়াই দিই। পান্তা দিয়া মুরগির গোস তোরও তো পছন্দ! ”
স্বর্ণলতা বসতে চেয়েও থেমে গেল। চৌকির বদলে খাট! একেবারে নতুন। কাঠের গন্ধ ছড়াচ্ছে এখনও। সে জিজ্ঞেস করল,
” এইটা কি আব্বায় বানাইছে? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” এত প্রশ্ন না কইরা আগাইয়া ব তো। এক নলা ভাত মুখে দে। শুকাইয়া মুখটা একটুখানি হইয়া গেছে! ঐবাড়িতে তো খাওনের অভাব নাই, তোরে দেয় না? ”
এই জবাবটা সে দিতে পারল না। দরজার কাছে ভিন্ন কণ্ঠটা বাজল,
” স্বর্ণা না? বাপ রে, তোরে দেহি চিনাই যায় না। চোখ, মুখ সব বদলাইয়া গেছে! ”
সে চকিতে ফিরল। নিলু! পাশের বাসায় থাকে। তার বয়সী। একসাথে স্কুলেও পড়ত। কিন্তু বেশিদিন পড়তে পারেনি। মাথা ভালো না, খুব অলসও! দুইদিন পরপর স্কুল কামাই দিত। একসময় পড়ালেখাটা বন্ধই হয়ে গেল। তারপরে স্বর্ণলতার মতোই হুট করে বিয়ে! অদ্ভুত হলেও সত্য দুজনের কেউই কারও বিয়েতে সশরীরে উপস্থিত থাকেনি। বিবাহের পর এই প্রথম মুখোমুখি।
স্বর্ণলতা হাসল। প্রবল আগ্রহে এগিয়ে এসে বলল,
” তোরেও তো চেনা যাইতাছে না। এত ফুললি ক্যামনে? সারাবেলায় কি পইড়া পইড়া ঘুমাস? ”
নিলু তার মাথায় মৃদু আঘাত করল। তারপরে লাজুক হেসে বলল,
” আমি তো পোয়াতি! দেইখাও বুঝস না? ছাগল একটা! ”
স্বর্ণলতার নজর চলে গেল তার পেটে। প্যাঁচানোর শাড়ির ফাঁকেও পেটটা আটকে থাকতে পারছে না যেন! বের হওয়ার জন্য সে কী অস্থিরতা! সে অল্পক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকে সুধাল,
” সত্যি? কবে হইল? ”
” সাত মাস চলতাছে। ”
স্বর্ণলতাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। হাতটা ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলো। উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে নিচু স্বরে সুধাল,
” আব্বায় কইল, তোর নাকি মহাজনের লগে বিয়া হইছে? ”
” হ। ”
” আসলেই? ঐ অতবড় মানুষটা তোর জামাই? বাপ রে! তোর ভয় লাগে না? ”
” আগে লাগত। এখন লাগে না। ”
” এখন লাগে না ক্যান? খুব আদর সোহাগ করে নাকি? ”
সে জবাব দিতে পারল না। নিলুর মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু। সে স্বর্ণলতার কান, গলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলল,
” সব সোনা? কে দিল এইসব? মহাজন? উনার তো মেলা ট্যাকা! তোরে দেয় কিছু? ”
” হুম। ”
” তোর তো রাজকপাল রে, স্বর্ণা! শুনলাম, এখনও পড়তাছস। তাইলে পোলাপান নিবি কবে? ”
” জানি না। ”
” ক্যান, তোর শওরবাড়ির কেউ চায় না? ”
” না। ”
নিলুর বিস্ময় কমে না। শুধু বেড়েই যায়। স্বর্ণলতার এত সুখ! সে মানতে পারে না। অভাব-অনটন লেগে থাকা পরিবারের মেয়েটার পায়ে পৃথিবীর সব সুখ এসে কেমন লুটোপুটি খাচ্ছে!
দুজন ভালোই গল্প করছিল। সহসা স্বর্ণলতা দেখল, ডাক্তার হাদিকে। সোজা তাদের ঘরে ঢুকল। একবারের জন্যে চেয়েও দেখল না, এই দুটি কিশেরী বধূর দিকে। স্বর্ণলতা এত আশ্চর্য হলো! দৃশ্যটা হজমই করতে পারল না। এতদিনে সে এতটুকু তো ঠিকই বুঝেছে, মানুষটা তাকে পছন্দ করত। ভালোবাসত। হয়তো বিয়েও করত! সে তখনই নিলুকে বিদায় দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। খাটের এককোণে বসতে বসতে দেখল, ডাক্তার হাদি তার বাবাকে দেখছে। কী কী যেন প্রশ্নও করছে। সেসবের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। আড়চোখে বার বার তার মুখটা দেখছে আর ভাবছে, মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে!
এই ঘটনার ঠিক পনেরো মিনিট পরেই মুনছুর সাখাওয়াতের জীপ এসে থামল স্বর্ণলতাদের বাড়িতে। সে তখন উঠোনে। রান্নাঘরের দিকে চেয়ে আছে একমনে। হঠাৎ কণ্ঠস্বরটা পেল,
” আম্মাকে দেখা হয়েছে? ”
স্বর্ণলতা চমকে ফিরল। অন্যকেউ না, তার স্বামী। দীর্ঘকায় শরীরটায় পাঞ্জাবি গলানো। মোটা গোঁফ ও বাবরি চুলের মানুষটাকে তার অদ্ভুত লাগল। মুহূর্তেই অসহ্য হয়ে ওঠল মুখখানা। বেফাঁসে বলেই ফেলল,
” বুইড়া ব্যাটা গো মতো সবসময় হাঁটু সমান পাঞ্জাবি পরেন ক্যান? অন্যকিছু পরতে পারেন না? ”
” আর কী পরব? ”
” শার্ট পরবেন। আলাদা আলাদা রঙের। গেঞ্জিও তো পরতে পারেন। সুবর্ণ লাল গেঞ্জি পরলে কী সুন্দর লাগে! ”
তার কথাটা শেষ হতে না হতে ডাক্তার হাদি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দুজনের চোখ গিয়ে পড়ল তার ওপরে। মুহূর্তেই স্বর্ণলতা কেঁপে ওঠল! ডাক্তার হাদির পরনে লাল গেঞ্জি।
মুনছুর সাখাওয়াত ডাক্তারের দিকে চেয়ে থেকেই স্বর্ণলতার হাত ধরল। মুখে আহ্বান করার প্রয়োজন মনে করল না। চুপচাপ টেনে নিয়ে গেল জীপে। খানিক এগিয়ে গিয়ে জীপটা থামিয়ে বলল,
” তুমি বসো। আমি আসছি। দুই মিনিট লাগবে। ”
স্বর্ণলতাকে এইবাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময়ে দুজন পাহারাদার রেখে গিয়েছিল। তারা তখনও ছুটি পায়নি। মুনছুর সাখাওয়াত ঘন ঘন পায়ে পাহারাদারদের কাছেই পৌঁছাল। রাস্তার পাশ থেকে চারাগাছ তুলে দুজনকে এলোপাথাড়ি পি টাল। ক্লান্ত হয়ে, গাছটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পরে সে জীপে ফিরে গেল। পুনরায় রাস্তার দিকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল।
স্বর্ণলতা এক পলক চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ ফিরিয়ে রাখতে পারল না। পুনরায় তাকাতে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত হাঁপাচ্ছে! ঘামে নেয়ে ফেলেছে প্রায়! মুখ থেকে তখনও টপটপে নোনা জল পড়ছে। স্বর্ণলতার এত মায়া লাগল! হাত বাড়িয়ে নিকাব দিয়ে তার কানের পাশে ঘাম মুছে দিল। সাথে সাথে জীপটা থেমে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত মুখটা ঘুরিয়ে অন্যপাশটাও দেখাল। স্বর্ণলতা এপাশটা মুছে দিতেই, সে পাঞ্জাবির বোতাম দুটো খুলে বুকটা উন্মুক্ত করে বলল,
” এখানটাও ভিজে গেছে! ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬২)
পাঞ্জাবির ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসা বুকটা পশমে ঢাকা। বেশ ঘন ও কালো। ঘামে ভিজে চটচটে হয়ে আছে। স্বর্ণলতা এক মুহূর্ত দ্বিধা করল যেন! মুনছুর সাখাওয়াতের মুখের দিকে তাকাতে সে পুনরায় বলল,
” সত্যি ভিজে গেছে। বিশ্বাস না হয় হাত দিয়ে দেখ। ”
স্বর্ণলতা হাত দিয়ে দেখল না। দ্বিধা কাটিয়ে উঠল দ্রুত। নিকাব দিয়েই ঘষে ঘষে ঘাম মুছতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াতের এই নামমাত্র যত্নটুকুও এত ভালো লাগল! আবেশে চোখ বুঁজে ফেলল। তখনই শুনতে পেল,
” এত ঘামছেন ক্যান? দৌড়াইয়া আইছেন? ”
সে চোখদুটি খুলল না। সিটে মাথা এলানো অবস্থায় শুধু আওয়াজ করল,
” হুম। ”
” তারপরেও তো দেরি করছেন। কী করতে গেছিলেন? ”
” মা রতে। ”
স্বর্ণলতা চমকে কেঁপে ওঠল। নিকাবসহ হাতটা সরিয়ে এনে বিস্ফারিত গলায় উচ্চারণ করল,
” মা রতে! কারে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এবারও চোখ খুলল না। উল্টো খিঁচে বন্ধ করে রাখল। যে সত্যটা লুকিয়ে রাখতে চাইল, সেটা নিজেই বেফাঁসে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এতটা বেখেয়ালি হয়েছিল যে, নিজের জীভের উপরেও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি! সে রয়েসয়ে চোখের পর্দা তুলল। পাঞ্জাবির বোতাম দুটো লাগাল। জীপটা পুনরায় চালু করে বলল,
” যার কথা ভেবে ভয় পাচ্ছ, তাকে মা রিনি। নিশ্চিন্ত থাকো। ”
স্বর্ণলতা চোখ নামিয়ে নিল। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে এলো দেহমন। সে যে ডাক্তার হাদির কথায় ভেবেছিল, বুঝল কীভাবে? লোকটা এত দ্রুত মন পড়ে ফেলল! প্রায় মিনিটখানেক সময় চুপ থেকে সে আচমকা সুধাল,
” তাইলে কারে মা রছেন? ”
” আমার দুই চাকরকে। ”
” ক্যান? ওরা কী দোষ করছে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক তাকাল স্ত্রীর দিকে। নিকাবটা ঠিক নেই। বাতাসে টান খেয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে। এই এলোমেলো সাজের মুখটাও তার এত পছন্দ হলো যে, কয়েক সেকেন্ড কথা বলল না। দৃষ্টিও সরাল না। এভাবেই উত্তর করল,
” ওরা ঠিকমতো কাজ করেনি। ফাঁকি দিয়েছে। ”
” কখন ফাঁকি দিল? আমি তো দেখলাম, শুরু থেইক্যাই বাড়ির সামনে দাঁড়াইয়া আছে। ”
” শুধু দাঁড়িয়ে থাকায় কাজ না, স্বর্ণলতা। ওরা থাকতেও ঐ বাড়িতে পুরুষ মানুষ ঢুকেছে। তুমি উপস্থিত থাকা অবস্থায় এমনটা ঘটতে দিল কীভাবে? ”
” আপনে কাউরে ঢুকতে দিতে মানা করছিলেন? স্পষ্ট কইরা কইছিলেন কোনো পুরুষ মানুষ যেন না ঢুকে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত একটু থমকাল। সংশয় চিত্তে জবাব দিল,
” না। ”
” জানতাম। আপনে খালি কইছেন, আমি যেন পালাইতে না পারি তাই দেখার জন্য। ওরা ঐটাই করছে। ”
” সবকিছু স্পষ্ট করে বলে দেওয়ার কী আছে? এটা তো উপস্থিত বুদ্ধি। পাহারায় থাকলে যদি এটুকু উপস্থিত জ্ঞান কাজে লাগাতে না পারে, তাহলে পাহারায় থাকতে হবে না। ”
” ঠিক আছে। কাজ থেইক্যা বাইর কইরা দেন৷ কিন্তু মা রবেন ক্যান? ”
জীপ চালাতে চালাতে কথা বলতে অসুবিধা হয়। চিন্তা থাকে, মনোযোগ বসাতে পারে না। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। মুনছুর সাখাওয়াত আবারও জীপ থামিয়ে দিল। স্বর্ণলতার দিকে ঘুরে বসে সুধাল,
” তুমি সবসময় আমার বিপক্ষের হয়ে লড়ো কেন? সমস্যা কী? আমাকে ভালো লাগে না কিন্তু আমার হার দেখে তো খুব আনন্দ পাও! ”
” আমি সত্য আর ন্যায়ের পক্ষে থাকি। আপনে সবসময় অন্যায় করেন দেইখ্যাই তো বিপক্ষে হয়ে যাই। সমস্যা তো আমার না, আপনের। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের ভ্রূদ্বয় কুঁচকে এলো। কপালের মাঝে শীর্ণ ভাঁজ ফেলে চেয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। এই কম্পনহীন দৃষ্টি, মজবুত কণ্ঠস্বরে কী আছে? যা তাকে থেমে যেতে বাধ্য করে!
স্বর্ণলতা চোখ নিচু করল। খানিক ইতস্তত করে আচমকা বলল,
” আপনের রাগ তো আমার ওপরে। মা রতে ইচ্ছা হইলে আমারে মা রেন। আসল দোষী তো আমি। ”
” তুমি দোষী? ”
” হ। আমার আব্বা অসুস্থ। হাদিভাই আমগো গ্রামের ডাক্তার। তাই দেখতে আইছে। আমার সামনে দিয়াই তো গেল, একবার ফিরাও তাকায় নাই। এইটাই তো আমার ভালো লাগল না! আপনে কইছিলেন না, আমারে খুব ভালোবাসে? বিয়া করতে চাই? তারপর থেইক্যাই আমার তার কথা মনে পড়লে ভালো লাগে। গর্ব হয়। মনে হয়, সারা গ্রামে কত মাইয়া! সবাইরে রাইখ্যা উনি শুধু আমারেই ভালোবাসছে। সেই মানুষটা আমারে একবার চাইয়াও দেখল না? তাই আমি নিজেই বাড়ির ভেতরে গিয়া উনারে দেখছি। উনি দেখতে এমনিতেই সুদর্শন! তারমধ্যে পরছে, আমার পছন্দের রঙের গেঞ্জি। আমার চোখে আরও ভালো লাগতাছিল। ইচ্ছা করতাছিল, শুধু চাইয়াই থাকি! এমন কইরা উনারে আমি কোনোদিন দেখি নাই। আজকেই দেখছি। তারপরে আপনে আইলেন, আমার যে কী হইল! ফট কইরা অমন কইয়া দিছি। আপনের রাগ হয়ছে আমার কথা শুইনা। তাইলে আমার উপরে রাগ না ঝাইড়া অন্যের উপরে ঝাড়তাছেন ক্যান? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। আশ্চর্য হলো খুব। মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে পুরো স্বীকারোক্তিটায় সম্পন্ন করেছে। নিজ থেকেই। সে কোনো জোর করেনি, জেরাও না। তারপরেও এত দ্রুত এত সহজে নিজের দোষ স্বাকীর করে নিল? মুনছুর সাখাওয়াত পুরো সময়টায় স্ত্রীর চোখদুটিতে চেয়ে ছিল। একটা শব্দেও মিথ্যার স্পর্শ ছিল না, বানোয়াটও না। সব সত্য, ঠিক লেগেছে। সে এতক্ষণে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” তোমার উপরে আমার কোনো রাগ নেই। ”
” আছে। আপনে মিথ্যা কইতাছেন। আমার রাগ অন্য কাউরে দিলে কমবো না। হয় আমারে শাস্তি দেন, নইলে মাফ কইরা দেন। ”
” বলেছি তো রা গ নেই। তারপরেও কথা বাড়াচ্ছ কেন? চুপ করে বসো। এখনই বাসায় চলে আসব। ”
স্বর্ণলতা খানিক কেঁপে ওঠল। কণ্ঠটা এত কঠোর ঠেকল! ধমকের কাছ দিয়েই গেল। তারপরেও ঠিক করে ধমক দিল না। স্বর্ণলতা ঠিক বুঝতে পারছে, রাগটা যায়নি। একবিন্দুও কমেনি। তারপরেও স্বীকার করছে না। এদিকে সে নিজেই তীব্র অপরাধ বোধে ভুগছে। বার বার মনে হচ্ছে, সুন্দর হলেই তাকে দেখতে হবে কেন? সে বিবাহিত, হাদিভাইও বিবাহিত। নিশ্চয় বউকে খুব ভালোবাসে। সেজন্যই তার দিকে ফিরে তাকায়নি। তাকানো উচিতও না। এরকম একাগ্র আনুগত্য থাকাটায় ভালো দেখায়।
________
নিজেদের ঘরে ঢোকার পরেও স্বর্ণলতা বোরকা খুলল না। ধপাস করে বসে পড়ল বিছানায়। এত অস্বস্থি হচ্ছে! ঐ ঘটনাটা মাথা থেকে সরছেই না। চোখে আয়নার মতো লেগে আছে।
মুনছুর সাখাওয়াত ঢুকল তার পিছু পিছু। আনমনা ক্লান্ত মুখটায় এক ঝলক চেয়েই কাপড় বদলাতে চলে গেল। ফিরে এসে দেখল, স্বর্ণলতা তখনও একভাবেই বসে আছে। পাখা ছাড়েনি, গরমে নিকাবটাও ভিজে ওঠেছে। সে এগিয়ে গিয়ে পাখা ছেড়ে দিয়ে বলল,
” আরও কোথাও যাবে? ”
” না। ”
” তাহলে বোরকা খুলছ না কেন? ”
স্বর্ণলতা বড্ড বেখেয়াল, নিজের মধ্যে নেই একদমই। বসা অবস্থায় প্রথমে নিকাব খুলল। তারপরে বোরকাটাও। তার সামনে একহাত দূরেই যে মুনছুর সাখাওয়াত দাঁড়িয়ে আছে খেয়ালই নেই। বোরকার আড়ালে থাকা শাড়ির অবস্থা করুণ। কোথাও ঠিক নেই। সব এলোমেলো। ব্লাউজের প্রায় পুরোটায় ভেজা, সামনে-পেছনে উভয় পার্শ্বে দেহের সাথে ল্যাপ্টে আছে। তার এই ঘর্মাক্তকলেবরও যে কারও কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে, বুঝতেই পারল না। সে আপন খেয়ালে ব্যস্ত।
মুনছুর সাখাওয়াত ততক্ষণ স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইল যতক্ষণ না পাখার বাতাসে ঘাম শুকাল। তারপরে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
সাথে সাথে সে উঠে এলো। দাঁড়াল তার কাছে, বুক বরাবর। মাথাটা তুলে চোখে চোখ রেখে বলল,
” আপনে আমারে মা রতাছেন না ক্যান? অন্তত একটা চড় তো দিতেই পারেন। আমি কষ্ট পামু না। কাউরে কমুও না। মা রেন। ”
স্বর্ণলতা গাল পেতে দিল। মুনছুর সাখাওয়াত হতাশ হলো। এরকম কাতর হয়ে তার থেকে ভালোবাসা চাইতে পারত, আদর চাইতে পারত। সে এক মুহূর্তও দেরি করত না। হৃদয় উজার করে ভালোবাসত, দিন-রাত এক করে আদর দিত। তা না, মেয়ে এতদিনে এসে বলছে, আমাকে মারুন! তার জীবনে ভালো কিছু ভালোভাবে আসে না, আসবেও না।
” কী হইলো? মারেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত গালে হাত রাখল আলতোভাবে। ইচ্ছে হলো, ঝটপট কয়েকটা চুমু খেতে। কিন্তু খেতে পারল না। অদৃশ্য এক শক্তিবল তাকে আটকে ফেলল। এই বাঁধাটা সে অনুভব করছে মানছুরার থেকে পত্রটা পাওয়ার পর থেকেই। স্বর্ণলতার ইচ্ছে নেই, এমন কিছুই সে করতে পারছে না। সামনাসামনি না, লুকিয়েও না। অথচ বিয়ের শুরু থেকেই সে নিঃসংকোচে স্ত্রীর সাথে মিশেছে। কত কী করে ফেলার খেয়ালেও ভেসেছে৷ কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল হয়নি। মেয়েটাকেও এক ঘরে একলা করে পায়নি। এখন পায়। রোজই। সময়, সুযোগ সবই তার পক্ষে থাকে তারপরেও সে আটকে যায়!
মুনছুর সাখাওয়াত হাতটা সরিয়ে ফেলল। মানিব্যাগে থাকা ভাঁজ করা কাগজখানা ছিঁড়ে কয়েক টুকরো করল। অতঃপর হেঁটে গিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। স্বর্ণলতা খেয়াল করে দৌড়ে এলো। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করল,
” কী ফালাইলেন? ”
সে এই প্রশ্নের জবাব দিল না। পাল্টা প্রশ্ন করল,
” তুমি শাস্তি চাও? ”
” চাই তো। তখন থেইকা তো এটাই কইতাছি! ”
” দিব না। আমার মনে হয়, কেউ এমন কিছু চাচ্ছে, যেটা তার সামনেই আছে। হাত বাড়ালেই পেতে পারে। কিন্তু হাত বাড়ানোর অনুমতি পাচ্ছে না, পাবেও না। এরচেয়ে বড় কোনো শাস্তি হতেই পারে না। স্বর্ণলতা, তুমি নির্দয়ের মতো আমাকে এমন কঠোর শাস্তি দিয়েছ, দিচ্ছ, হয়তো ভবিষ্যতেও দিবে। আজকে আমিও তোমাকে সেই শাস্তিটায় ফিরিয়ে দিলাম। আমার মনে হয় না, এরপরেও তুমি একই ভুল দ্বিতীয়বার করবে। ”
________
সুবর্ণ রোজ স্কুলে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু পুরো ক্লাস করছে না। টিফিনের ঘণ্টা পড়লেই ব্যাগপত্র নিয়ে ছুটে পালাচ্ছে! আজও তাই করল। বাড়ি ফিরে একদফা ঝাড়ি খেল আম্মার কাছ থেকে। তারপরে শুনল, স্বর্ণা আপা এসেছিল। তার বেজায় মনখারাপ হলো! আপা আসবে আগে জানাতে পারল না? সে নাহয় একদিন স্কুল কামাই করত। তাতে কী এমন ক্ষতিটা হতো? রোজ রোজ স্কুলে হচ্ছেটা কী? ঐ তো কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, নাহয় বেতের বাড়ি খাওয়া। আপাকে ছাড়া কি তার পড়া হয়? কে শেখাবে সরল অংকটা? কে বলে দিবে ইংলিশ গল্পের বাংলা অর্থটা? বাংলাও তো ঠিক করে বুঝে না!
সুবর্ণ মনখারাপ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। মায়ের বেড়ে রাখা ভাতটাও খেল না। ভীষণ আনমনে, উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে লাগল। আপাকে ছাড়া তার দিনকাল ভালো কাটছে না। কিছুতেই মন বসে না, আনন্দ পায় না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুটো পাখির বাচ্চা পেড়েছিল। তার কাছে খাঁচা নেই, রাখে কোথায়? তাই এক বন্ধুর বাসায় রেখেছিল। এতদিনে পাখিগুলো বেশ বড় হয়েছে। উড়তে পারে। সে চাইতে গেলে, দিল না। বলে কি না ঐ পাখির দিকে তাকালে চোখ তুলে ফেলবে!
সুবর্ণ হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো বেহালাদের বাড়ির কাছে। সে খেয়াল করেছে, যেদিন খুব মনখারাপ হয়, কান্না আসতে চায় সেদিন এই বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়ালেই তার কান্না চলে যায়, মনখারাপ থাকে না। বুকের ভেতরটায় ভালো লাগা অনুভূতিতে পূর্ণ হয়ে আসে। প্রতিবারের মতোই সে এবারও বন্ধ গেইটের ফাঁক দিয়ে ভেতরে উঁকি মারছিল, সহসা কণ্ঠটা শুনতে পেল,
” সুবর্ণ না? কাকে খুঁজছ? ”
সে হচকিয়ে যায়। পেছন ফিরতে দেখে বেহালা ও টিয়ামনি। টিয়ামনিকে দেখেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা খুব বাজে, গায়ে ঘেষা স্বভাবের। খুব কথা বলে। সবগুলো অসভ্য ধরনের।
সুবর্ণ বিরক্ত মুখে দেখল, টিয়ামনি তার আপামনিকে ফিসফিস করে কী যেন বলল। তারপরেই বেহালা জিজ্ঞেস করল,
” তুমি ও কে মেরেছে? ”
” হ। ”
” কেন? ”
” কানতে কানতে আমারে জড়াইয়া ধরছিল তাই। ”
বেহালা অবাক হয়ে তাকাল টিয়ামনির দিকে। সে বোধ হয় পুরো ঘটনাটা বলেনি। শুধু মারার কাহিনিটুকুই বলেছে। এবার বাকিটুকুও শুনল। ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল রাতে। টিয়ামনির বাবা মারা গেছে কয়েকদিন হলো। বাড়িতে তার সৎমা ও এক ছোটবোন আছে। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ! জমানো টাকা নেই, তন্মধ্যে পাওনাদাররা বাড়িসুদ্ধ তুলে নেওয়ার জন্য উপঠেপড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায় সুবর্ণ ঐবাড়িতে যায়। সাহায্যের নামে অনেকগুলো টাকা দেয়। ঐসময় টিয়ামনিও ছিল। সে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। যা এক সেকেন্ডও সহ্য করতে পারল না। টিয়ামনিকে টেনে সরিয়েই ঘু ষি মেরে দিল!
” তুমি টিয়ামনির পরিবারকে সাহায্য করেছ, ও খুশি হয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এজন্য কেউ মারে? ”
” খুশি তো ও হয়ছে, আমি হই নাই। তাইলে আমি ক্যান সহ্য করমু? ”
বেহালা খানিক দমে গেল যেন! অযৌক্তিক লাগল না কিছুই। দুজনের দিক দিয়েই দুজনে ঠিক। কিন্তু এভাবে ছেড়ে দিলে কেমন দেখায়? টিয়ামনি বাচ্চা মেয়ে, বুঝতে পারেনি। এত জোরে কেউ মারে? নাকটা এখনও ফুলে আছে! সে বুঝিয়ে বলল,
” কেউ ভুল করলেই তাকে মারতে হয় না। আগে বুঝাতে হয়। তুমি বুঝিয়েছ? ”
সুবর্ণ সাথে সাথে জবাব দিল,
” না। ”
” তাহলে তো মাফ চাইতে হয়, সুবর্ণ। ”
সে বেহালার কাছে এগিয়ে এলো। ফিসফিসের মতো বলল,
” মাফ কইরা দেন। ”
” আমার কাছে না, টিয়ামনির কাছে চাও। ”
” পারমু না। আপনে মাফ চাইতে কইছেন, চাইছি। শ্যাষ! ”
সুবর্ণ দ্রুতপায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করছিল। সহসা বেহালা চেঁচিয়ে সুধাল,
” ঐ টাকাগুলো তোমাকে কে দিয়েছিল? ”
সে না ফিরেই প্রত্যুত্তর করল,
” দুলাভাই। ”
_______
মুনছুর সাখাওয়াত রাতে বাড়ি ফিরল বেশ রাত করে। স্বর্ণলতা তখন ঘুমে। সে ডাকল না। নীঃশব্দে কাপড় বদলাল, গোসল করল। তারপরে খাবার টেবিলে বসে খেয়ে এলো। এত সময়ে স্বর্ণলতা অনেকবারই নড়ল, পাশ বদলাল। কিন্তু ওঠল না।
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর শিয়রের কাছে কিছুক্ষণ বসে থাকল। মাথায় হাত বুলাল। তারপরে উঠে এলো জানালার কাছে। বাইরে তখন আষাঢ় পূর্ণিমা। চারপাশে জোসনা গলে গলে পড়ছে। সে একমনে চেয়ে দেখছিল। হঠাৎ শুনল,
” কখন আইছেন? আমারে ডাকেন নাই ক্যান? ভাত না খাইয়া শুইয়া পড়লেই দাদিজান বকত। ”
” আমি খেয়েছি। ”
” সত্যি? বাইড়া দিল কে? ”
” দাদিজান। ”
” এত রাইতে উনারে ডাইকা তুলছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিল না। টের পেল, দুটো পা হাঁটছে। নুপুর জোড়াও মৃদু সুর তুলছে। তার কাছেই আসছে কি? সে অনেক্ষণ কান খাড়া করে থাকল। সেই পদধ্বনি, নুপুরের ঝুমঝুম শব্দ তার কাছাকাছি পৌঁছাল না। উল্টো হারিয়ে গেল। সে অধৈর্য হয়ে পেছন ফিরল। সাথে সাথে আশাহত হলো! স্বর্ণলতা পুনরায় শুয়ে পড়েছে। শরীরে কাঁথা মেলে নিতে নিতে বলল,
” ঘুমাইবেন না? ”
” না। ”
” ক্যান? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। স্বর্ণলতা একটুক্ষণ চুপ থাকল। শুয়ে পড়বে নাকি ভাবছিল, তার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। চোখ মেলে থাকতে পারছে না। তারপরেও বিছানা থেকে নামল। স্বামীর পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়ছে? আবার কেউ আপনের ট্যাকা না দিয়া মইরা গেছে? ”
” না। ”
” তাইলে? পলাইছে? ”
” না। ”
” তাইলে ঘুম আইতাছে না ক্যান? ট্যাকা ছাড়া আর কী আপনের ঘুম কাইড়া নিতে পারে? ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। যা সে লুকাতে পারল না। পেছন ফিরেই বলল,
” তুমি ঘুমাও, যাও। আমি তো বিরক্ত করছি না! ”
” সত্যি যামু? ”
” যাও। ”
স্বর্ণলতা দ্বিতীয় কোনো কথা বলল না। বিছানার দিকে হাঁটা ধরল। দুই কদম এগুতেই তার আঁচল টেনে ধরল মুনছুর সাখাওয়াত।
চলবে