#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৮)
মুনছুর সাখাওয়াত আলো নেভাল না। সুইচবোর্ডের কাছ থেকে সরলও না। স্ত্রীর দিকে চেয়ে আছে সংশয় নিয়ে। মুখে কথা নেই, দৈহিক প্রতিক্রিয়াও নেই। স্বর্ণলতা ততক্ষণে বিছানায় উঠে গিয়েছে। পালংকে পিঠ ঠেকিয়ে আধশোয়া হলো। স্বামীর দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল। অতঃপর বলল,
” ওখানে দাঁড়াইয়া আছেন কেন? বিছানায় আসেন। ”
এই হাসি, কণ্ঠস্বর, আহ্বান, সাজের অপেক্ষা করেছে সে কতকাল! না পেয়ে আফসোস ও আক্ষেপে মরেছে প্রতি রাত্রিতে। তীব্র অস্থিরতা, কামনার আগুনে দগ্ধ হয়েছে নিঝুম ও আঁধারে ডুবা প্রহরগুলোতে। ঘুম হয়নি, হলেও অভাব থেকে গিয়েছে সবসময়ই। তারপরেও সে আশা ছাড়েনি, ধৈর্য হারায়নি। উপরন্তু প্রতিটি ভোরে নতুন করে আশা বেঁধেছে, স্বপ্ন পূরণের সাহস ও প্রবল ইচ্ছা জাগিয়েছে। সেই শুভক্ষণের দেখা মিলছে কি? স্বর্ণলতা কি আজ তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে? কাছে টেনে নিবে? মুনছুর সাখাওয়াত খুশি হতে চেয়েও পারছে না। শঙ্কিত হয়ে ওঠল চিত্ত-চেতনা। তার বার বার মনে হতে লাগল, আজ ভিন্ন কিছু ঘটবে ঠিকই। কিন্তু তার চাওয়ার মতো কিছুই হবে না।
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় ওঠল। পা তুলে বসতেই শুনল,
” এত দূরে বসছেন ক্যান? আমার কাছে বসলে কি আপনেরে খাইয়ালামু? আমারে কি রাক্ষসের মতো দেখা যাইতাছে? ”
সে ঝটপটে প্রত্যুত্তর করল,
” না, না। ভালো লাগছে তো। খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে। হঠাৎ সাজলে যে, ঘুরতে যাবে? ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। নিজ উদ্যোগে স্বামীর কাছে এগিয়ে এলো। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বুকে মাথা রাখল। একটা হাতে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরল। তারপরে হালকা ও কোমল স্বরে জবাব করল,
” না। ”
” তাহলে? ”
” আপনের জন্য সাজছি। খুশি হন নাই? ”
প্রশ্নটা করে সে মাথা তুলল। সরাসরি তাকাল মুনছুর সাখাওয়াতের চোখে। মুহূর্তেই তার গলা শুকিয়ে এলো। প্রবল চাপ অনুভূত হতে লাগল কঠিন বুকটায়। হৃদযন্ত্রটা প্রচণ্ড শব্দ করে তীব্র গতিতে ছুটছে। শক্ত দেহ, রুক্ষ বদন সবকিছুই মেঘের মতো নরম হতে লাগল। শ্বাসটা আটকে কোনোমতে প্রশ্ন করল,
” সত্যি বলছ, স্বর্ণলতা? ”
” মিথ্যা বলার অনুমতি দেন, কিছু মিথ্যা বলি। ”
” এই অনুমতি কখনই পাবে না। ”
” তাইলে অবিশ্বাস করেন ক্যান? ”
এতক্ষণে মুনছুর সাখাওয়াত শ্বাস ছাড়ল। সাথে সাথে বিদ্যুৎগতিতে উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সম্পূর্ণ দেহটায়। স্বর্ণলতার ছোট্ট মুখখানা দুই হাতে নিবিড়ভাবে ছুঁয়ে বলল,
” অবিশ্বাস না, স্বর্ণলতা। অবাস্তব লাগছে। তোমাকে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মস্তিষ্কের সাজানো কল্পনাও হতে পার। এভাবে তোমাকে আমি রোজই পাই, রোজই ছুঁয়ে দেখি, খুব আদর করি, খুব ভালোবাসি। কিন্তু কল্পনায়, মনে মনে। ”
স্বর্ণলতা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। নীরবে একস্থির চেয়ে থাকল স্বামীর দুঃখপীড়িত মুখটায়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র! তারপরেই চঞ্চল হয়ে ওঠল চোখের তারাদুটি। ছটফট করতে লাগল দেহটা। মুনছুর সাখাওয়াতের হাত জোড়া সরিয়ে দিয়ে বলল,
” সাজটা নষ্ট কইরা আসি, তাহলেই বাস্তব মনে হইবো। ”
সে সত্যি সত্যি সরে যেতে চাইল। জড়িয়ে থাকা হাতটা আলগা হয়ে যাচ্ছিল, পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত তার হাতের উপরে হাত রাখল। অন্য হাতে স্বর্ণলতার কোমর জড়িয়ে ধরল। নিজের সাথে গাঢ়ভাবে মিশিয়ে দ্রুত বলল,
” তোমার না কথা আছে? বলো, শুনি। ”
স্বর্ণলতা থামল। করতে যাওয়া কাজটা ভুলে গেল নিমিষে। ছটফট ও চঞ্চল প্রতিক্রিয়া কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত হলো। জেদ ও বিরক্তে কঠোর হয়ে আসা বদনখানা সহজ হলো। নরম দেহের তুলোর মতো ওজনটা ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে ল্যাপ্টে গেল মুনছুর সাখাওয়াতের দীর্ঘকায় শরীরের সাথে। তারপরে হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
” দাদিজান আমারে একটা উপহার দিছে। ”
” তাই নাকি? ”
স্ত্রীকে ভুলানোর জন্য মুনছুর সাখাওয়াত প্রশ্নটা করলেও ভেতরে ভেতরে বেশ আশ্চর্য হলো। দাদিজান কী এমন দিল যে, এত ঘটা করে জানাচ্ছে? তার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু বলতে পারছিল না। মেয়েটা যদি জিনিসটা আনার জন্য আবারও তার কাছ থেকে সরে যায়?
স্বর্ণলতা বাম হাতটা মেলে ধরল স্বামীর মুখের সামনে। তারপরে রহস্য করে জিজ্ঞেস করল,
” দেখেন তো চিনতে পারেন নাকি? ”
সে সাথে সাথে চিনে ফেলল। হাতের মধ্যমা আঙুলের স্বর্ণের আংটিটা দাদিজানের। তার বিয়ের সময় দাদাজান পরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে খুলেননি কখনও। মারা যাওয়ার পরেও না! ছোটবেলা একবার না বুঝেই মুনছুর সাখাওয়াত খুলে নিয়েছিল। খাইরুন নিসা তখন ঘুমে ছিল বিধায় টের পায়নি। যতক্ষণে টের পেয়েছে ততক্ষণে সে হারিয়ে ফেলেছে। এই অপরাধে তার হাত বেঁধে রেখেছিল। সেভাবেই দাদিজানের সাথো সারা সন্ধ্যা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল, তার খেলার স্থানগুলোতে। শেষে সেই আংটি পাওয়া গেল, হাফ প্যান্টের পকেটে।
মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ফারিত কণ্ঠে সুধাল,
” এটা তোমাকে দাদিজান নিজে থেকেই দিয়েছে? ”
” হ। ”
” এমনিই? ”
” না। আমার উপরে খুশি হইয়া দিছে। ”
” হঠাৎ কী এমন করলে যে, খুশি হয়ে নিজের প্রাণটায় দিয়ে দিল। ”
” আপনেরে নামাজ পড়াইছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের সকল বিস্ময় ও আগ্রহ কেটে গেল। বিরক্তও ধরা পড়ল সংকুচিত ভ্রূদ্বয়ের মাঝে। নামাজই তো পড়েছে! সেটাও বাধ্য হয়ে। বউটাকে স্বাভাবিক করার জন্য। এই নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে? তার ইচ্ছে হলো, আংটিটা খুলে নিয়ে ফেরত দিয়ে আসতে। কিন্তু পারল না। স্বর্ণলতার চোখ, মুখ কী সুন্দর ঝলমল করছে! এই আনন্দ, খুশি সে কখনই দিতে পারেনি। হাজার হাজার টাকার খরচ করেও না। সে আংটিসহ হাতটা নিজের গালে স্পর্শ করে বলল,
” নামাজ পড়লাম আমি অথচ উপহার পেলে তুমি। ঠকানো হয়ে গেল না? আমারও উপহার পাওয়া উচিত। ”
” দাদিজানের কাছে গিয়া চান। ”
” আমার তো তোমার থেকে চাই। স্বর্ণলতা, তুমি কিছু দিতে পার না? ”
তার ভিন্ন রকমের কণ্ঠস্বর, চাহনি, বাক্যার্থ সবই বুঝে এলো। ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠলেও প্রকাশ করল না। লজ্জার ভাব ও রঙটাও জোর করেই দূরে সরিয়ে রাখল। সে আজ মানসিক ও শারিরীক দুইভাবেই প্রস্তুত। তারপরেও রসিয়ে দুষ্টুমি করে বলল,
” পারি তো। কিন্তু একটা কথা দিতে হবে। ”
” কী কথা? ”
” আপনে এখন থেইক্যা সবসময় নামাজ পড়বেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত আবার বিরক্ত হলো। অসন্তুষ্টের ছাপটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল মুখটায়। কিছুক্ষণ কথা বলল না। চুপ থেকে আচমকা আফসোসের সুরে বলল,
” তাহলে এই জীবনে তোমার থেকে কিছু পাওয়া হলো না! ”
” ক্যান? ”
” আমি নামাজ-টামাজ পড়তে পারব না। যদি আমার উপরে এক চিমটিও মায়া হয়, তাহলে অন্য কোনো কাজ করিয়ে নিতে পার। ”
স্বর্ণলতা সাথে সাথে মাথাটা ঘন ঘন দুদিকে নাড়ল। বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বলল,
” না। আমার ঐ কথাটায় চাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বুঝে ফেলল, এই মেয়ের মনোভাব আবারও বদলে যাচ্ছে। জেদি হয়ে ওঠছে। তাই দ্রুত বলল,
” আমার কিছু লাগবে না। যখন লাগবে তখন তোমার সাথে চুক্তি হবে। ঠিক আছে? এখন আমরা অন্য কথা বলি? ”
এবারে স্বর্ণলতা ভুলল না। কঠিন হয়ে বলল,
” না। আমি এটা নিয়াই কথা বলব। আপনের নামাজ পড়তে কী সমস্যা? আগে তো পড়ছেন। আমি দাদিজানের থেইক্যা শুনছি, আপনে ছোটবেলা মাদরাসায় পড়ছেন। কোরআনও মুখস্থ করছেন। আপনে যে মনেপ্রাণে আল্লাহরে মানেন এটাও জানি। কিন্তু স্বীকার করেন না। মিথ্যা ভাব ধইরা থাকেন। কিসের জন্য এমন করেন? কন আমারে। কইতেই হইবো, নাহলে আপনের সাথে আমার কোনো কথা নাই। ”
সে আবারও ছুটে যাচ্ছিল। মুনছুর সাখাওয়াত আটকে জিজ্ঞেস করল,
” বলার সময় দিবে না? ”
” দিলাম। বলেন। ”
সে একটু নীরব থেকে বলল,
” আমি তার কাছে একটা কিছু চাইছিলাম, দেয় নাই। তাই রাগ হয়ছে। ”
” কী চাইছিলেন? ”
” আমার মৃত্যু। ”
স্বর্ণলতা চমকে উঠে পুনরায় সুধাল,
” আপনে মরতে চাইছিলেন! ক্যান? ”
” আমার আম্মা মারা গেছিল তাই। ”
মুহূর্তেই স্বর্ণলতার হৃদয়টা দরদে পূর্ণ হয়ে ওঠল। মায়ার অশ্রুতে চোখদুটি ছলছল করছে। মানুষটা মায়ের শোকে এত কাতর হয়ে পড়েছিল? এরকম তো ভালোবাসা থেকে হয়। কিন্তু সে যে বলে, মাকে ভালোবাসে না!
” স্বর্ণলতা, আমার আম্মু যে বিষ খেয়ে মারা গিয়েছিল? সেটা কেনারও টাকা ছিল না তার কাছে। তাই আমি কিনে এনে দিয়েছিলাম। কিন্তু শর্ত ছিল, অর্ধেক আম্মা খাবে, অর্ধেক আমি। আম্মা সেই শর্ত রাখেনি। পুরোটা একাই খেয়ে নিয়েছিল। তাই আমি আবারও কিনে আনি, আম্মার পাশে বসেই খেয়ে পড়ে ছিলাম। তারপরে সে মারা গেল ঠিকই কিন্তু আমি মরতে পারলাম না! বেঁচে উঠে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে কত করে বললাম, আমাকে মৃত্যু দাও। দিল না! যতবারই চেষ্টা করেছি, ততবারই বেঁচে ওঠেছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত কথাগুলো বলার সময় খানিক উদাস হয়ে পড়েছিল। মনোযোগ হারিয়ে হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসে। এই সুযোগে স্বর্ণলতা ঝটিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। সোজা হয়ে বসে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে সুধাল,
” নিজের আম্মারে বিষ কিইনা দিছেন? আপনে মানুষ না অন্য কিছু? আল্লাহ! মানুষ এতটাও নিষ্ঠুর হয় কীভাবে? তাও অতটুকু বয়সে! আপনের তো মাথায় সমস্যা আছে! ”
সে স্বর্ণলতাকে কিছু একটা বুঝানোর উদ্দেশ্যেই ধরতে চাইল। পূর্বেই স্বর্ণলতা তেজ দেখিয়ে শাসিয়ে ওঠল,
” ছুঁইবেন না আমারে। সরেন, দূরে যান। আমার দিকে তাকাইবেনও না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিস্ফারিত কণ্ঠে সুধাল,
” ছুঁব না? তাকাবও না? ”
” না। এক কথা কয়বার কমু? ”
” সমস্যা কী? এই শাড়িটা পড়লে তোমার মেজাজ এত দ্রুত বদলে যায় কেন? একটু আগেই তো নিজ থেকে আমার কাছে এলে! ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। নিজের জেদে অটুট থেকে পুনরায় শাসাল,
” ভুল কইরাও যদি ছুঁইছেন, তাইলে আমিও বিষ খামু। ”
” বিষ খাবে? কে এনে দিবে? ”
” আপনে। ”
” দিব না। ”
” তাইলে গলায় ফাঁস দিমু। ”
” দড়ি খুঁজেই পাবে না। ”
” আমার শাড়ি দিয়া দিমু। ”
” আমি থাকতে অসম্ভব। ”
” ঠিক আছে। নিজের শ্বাস নিজে আটকাইয়া মরমু। দেখি, আপনে আটকান ক্যামনে। ”
সে পালংকের একেবারে কিনারে গিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্যদিকে মুখ ফিরে, হাত-পা গুটিয়ে। মুনছুর সাখাওয়াত হতবুদ্ধি হয়ে নিজ জায়গাতেই বসে থাকল। পাথরের মতো শক্ত ও নির্জীব হয়ে। প্রায় মিনিট পাঁচেক এভাবে কাটিয়ে বিছানা থেকে নামল। স্বর্ণলতার যত শাড়ি ছিল, সব খুঁজে খুঁজে একসাথে করে নিয়ে গেল উঠানে। আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে রুমে ফিরে এলো। স্বর্ণলতা তখনও চোখ বুঁজে একভাবে পড়ে আছে। সে আলো নেভানোর পূর্বে ভাবল, তার পরনের শাড়িটাও কি খুলে নিবে? এই সময়ে সে পাশ ফিরল। মুখটা নজরে আসতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠল। উপলব্ধি হলো, একাজ সে স্বর্ণলতার সম্মতি ছাড়া কখনই করতে পারবে না।
আলোটা নিভিয়ে মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় এলো। প্রথমে দূরত্ব রেখেই শুয়েছিল। কিন্তু সময়ে সময়ে সে স্বর্ণলতার কাছ ঘেষে এলো। তারপরে নড়ল না অনেক্ষণ। চুপচাপ নিথর হয়ে পড়ে থাকল। এরমধ্যে স্বর্ণলতা তার দিকে ফিরল। চোখ বন্ধ, হাত গুটানো। ঘুমের মধ্যেও যে সাবধানতা অবলম্বন করছে টের পাওয়া যায়। মুনছুর সাখাওয়াত ভাবল, ঘুমিয়েই আছে। তাই হাতটা রাখল মাথায়। পরম স্নেহে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিতে লাগল।
স্বর্ণলতা জেগে ছিল। স্বামীর হাতের স্পর্শ পেয়ে তার কান্না পেয়ে গেল। মনে মনে বলল, ‘ আমি মাফ করতে করতেই ক্লান্ত হইয়া যাইতাছি। আপনেরে সুধরামু কোন শক্তিতে? তারমধ্যে আপনেরে আমার এত ভালো লাগতাছে! মায়া লাগে, কাছে কাছে থাকতে মন চায়। এগুলা কি ভালোবাসার লক্ষণ? কিন্তু আম্মা যে বলল, ভালোবাসলে মানুষ দুর্বল হইয়া যায়? আঘাত দিয়া কিছু করবো তো দূর কিছু বলতেও পারে না! আমিও কি অমন দুর্বল হইয়া যামু? আপনে সারাজীবন এমনই থাকবেন? দাদিজান আফসোস নিয়াই মরবো? খুশি হইতে পারবো না কোনোদিন? মানছুরা বুবু তাহলে ভুল বলছিল, আমি আপনেরে বদলাইতে পারমু না। ‘
তার চোখের কিনার ঘেষে অশ্রুর ধারা নেমে এলো। মুনছুর সাখাওয়াত অন্ধকারে দেখতে পেল না, বুঝতেও পারল না। সে একমনে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে একটা হাত নাকের সামনে এনে পরখ করতে লাগল, স্বর্ণলতার শ্বাসকার্য ঠিকমতো চলছে নাকি।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৬৯)
ঘুম থেকে উঠে স্বর্ণলতা দাদিজানের রুমে গেল। খাইরুন নিসা ওজু করতে যাচ্ছিলেন। নাতবউয়ের ছায়া দেখে থামলেন। সে উৎসুকে তাকাতে স্বর্ণলতা কাছে এগিয়ে গেল। নিজের হাত থেকে আংটিটা খুলে দাদিজানের হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল,
” আপনের নাতি যেদিন পুরাপুরি আল্লাহর পথে ফিরবো সেদিন এই আংটিটা আমারে আবারও উপহার দিবেন। এখন আমি এই আংটির যোগ্য হই নাই। ”
_______
আজ মুনছুর সাখাওয়াত কাজে যায়নি। সকাল থেকে বাড়িতে, নিজের রুমটায়। বিছানার উপর বসে বসে সময় কাটাচ্ছে। মন ভালো নেই, কিছু একটা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। মাঝেমধ্যে উদাস হচ্ছে, ঝিমুচ্ছে। থেকে থেকে চমকে উঠে তটস্থ হচ্ছে। অবাক হয়ে দেখছে নিজের রুমটা। যেন নতুন জায়গা, কীভাবে এলো বুঝতেই পারছে না! স্বর্ণলতা খেয়াল করল ঠিকই কিন্তু বুঝতে দিল না। নিজের মতো রুমময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সহজ চাল, স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি। দুই-একবার স্বামীর সাথে প্রয়োজনীয় কথাও সারল। কিন্তু মুনছুর সাখাওয়াতই স্বাভাবিক হতে পারছে না। বুকটাতে ভয়ের দানা সেই যে বিঁধল, কিছুতেই উপরে ফেলতে পারছে না।
দুপুরবেলা। স্বর্ণলতা গোসল করে বের হলো। থ্রি-পিস পরেছে। মাথায় তোয়ালে জড়ানো। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই আয়নার সামনে দাঁড়াল। তোয়ালে খুলে চুলগুলো আরও কিছুক্ষণ মুছে নিল। অতঃপর স্বামীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
” গোসল করবেন না? ”
” না। ”
” তাইলে খাইতে আসেন। ভাত দিতাছি। ”
স্বর্ণলতা ভেজা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগুচ্ছিল। সহসা তার ওড়না টেনে ধরল মুনছুর সাখাওয়াত। সে থমকে যেতে বাধ্য হলো। চমকে পাশ ফিরতেই শুনল,
” খেতে ইচ্ছে করছে না। ”
” ইচ্ছে না করলে খাইবেন না। ওড়না টাইন্যা ধরার কী আছে? ছাড়েন। আমার ক্ষিধা লাগছে। খাইতে যামু। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ওড়না ছাড়ল না। আরও শক্ত করে ধরে বিছানা থেকে নামল। স্ত্রীর কাছে দাঁড়িয়ে কাতর স্বরে বলল,
” তোমার প্রতিজ্ঞাটা ভেঙে ফেল না, স্বর্ণলতা। ”
” কোন প্রতিজ্ঞা? ”
” ঐ যে, আমি স্পর্শ করলে তুমি নিজের দম আটকে নিবে। ”
স্বর্ণলতা ভারি আশ্চর্য হলো! নিষ্পলকে চেয়ে থাকল স্বামীর মুখটায়। চোখের দৃষ্টিতে কী নিদারুন আকুতি, মিনতি। অসহায়ত্ব। তাকে স্পর্শ করার জন্য এতটায় ব্যাকুল হয়ে আছে যে, এটাও বুঝতে পারছে না কেউ সেধে নিজের দম আটকে রাখতে পারে না। মৃত্যু এত সহজ নাকি? তার রাগ, জেদ ঘুমের সাথে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবুও একটা শক্ত ভাব ধরে বলল,
” করমু না। ”
” কেন? ”
” আপনে খারাপ কাজ করবেন ক্যান? নিজের আম্মারেও পর্যন্ত ছাড়েন নাই। ”
” ওটা খারাপ কাজ না, স্বর্ণলতা। আম্মু মুক্তির পথ খুঁজছিল। আমি খুঁজে দিয়েছি। ”
” আত্মহত্যা করলে মুক্তি হই ক্যামনে? আমি তো জানি, এটা মহাপাপ। জাহান্নামে পুড়তে হয়। আপনে মাদরাসায় পইড়াও এটা জানতেন না? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাব দিতে পারল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। মাথা কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়তে স্বর্ণলতা বলল,
” আম্মার এই মৃত্যু বাইছা নেওয়ার পেছনে আপনের আব্বারও দোষ ছিল। মূল আসামী তো উনি। আপনে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুইল্যা কখনও বলছেন, আব্বারে যেন ভালো মানুষ কইরা দেয়? ”
” না। ”
” ক্যান? ”
” আম্মু বলেছে, দাদিজানও বলেছে। তাদের দোয়া কবুল করেনি। তাই ভাবছি, আমারটাও করবে না। ”
” আপনের ভাবনা ভুলও হতে পারত। এমনও তো হতে পারে, আপনের দোয়াটায় কবুল হয়ছে। তখন আপনে ছোট ছিলেন, আল্লাহরেও মানতেন। দোয়া কবুল হওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলেন। ভালো দোয়া করলে হয়তো পূরণ হয়ে যেত। ”
” হতো না। হলে তো, আমার মৃত্যুটা দিতেন। ”
” মৃত্যু কি ভালো দোয়া? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। দৃষ্টিজোড়া আবারও নিচু হয়ে যেতে চেয়েও হলো না। জোর করে ধরে আনল স্ত্রীর চোখজোড়ায়। অতঃপর বিরক্ত নিয়ে বলল,
” এটা নিয়ে এমনভাবে পড়ে আছ যেন, তুমি চাইলেই আমি বদলে দিতে পারব। স্বর্ণলতা, ওটা অতীত। চৌদ্দ বছরের আগের ঘটনা। আম্মু, আব্বু সবাই মারা গিয়েছে। এখন এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা করছ কেন? ”
” ঘটনা বদলানো যাইবো না কিন্তু মাফ তো চাওয়া যাইবো। ”
সে ভীষণ অধৈর্য হয়ে পড়েছে। এই অশান্তিটা নিতে পারছিল না। তাই কথা না বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” আচ্ছা, মাফ করে দাও। ”
” আমার কাছে মাফ চাইতাছেন ক্যান? আমি কি তখন ছিলাম? ”
” তাহলে দাদিজানের কাছে চেয়ে আসি। ”
সে হাঁটা ধরতে স্বর্ণলতা দ্রুত বলল,
” উনার কাছেও মাফ চাইয়া লাভ নাই। মাফ যদি চাইতেই হয় আল্লাহর কাছে চান। ”
মুহূর্তে মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখের রঙ বদলে গেল। অস্থিরতা, অশান্তি, অধৈর্য সবকিছুই থমকে গেল। কঠিন চাহনি, রুক্ষ বদন ফিরে এলো। স্বর্ণলতা খেয়াল করেও অগ্রাহ্য করল। নিজের মনোভাবে অনড় থেকে পুনরায় বলল,
” আমার কথায় চাইতে হইবো না। যদি আপনে নিজের ভুল বুঝতে পারেন তাইলেই চাইবেন। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের থমকানো ও কঠোর ভঙ্গিটা কাটল আরও কিছু সময় পর। কিন্তু জবাবে কিছু বলল না। বড় বড় তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল কয়েকটা। তারপরে আচমকা দরজার দিকে হাঁটা ধরতেই স্বর্ণলতা দৌড়ে গিয়ে জায়নামাজ নিয়ে এলো। স্বামীর চলনপথে বাঁধা দিতে হাতটা ধরল। মুনছুর সাখাওয়াত ঘাড় ফেরাতে সে কাঁধে জায়নামাজটা রাখল। তারপরে অনুরোধের সুরে বলল,
” হৃদয় নরম করেন। দেখবেন, গরম মাথাও ঠাণ্ডা হইয়া যাইবো। ”
” হৃদয় নরম হবে কীভাবে? তুমি তো বলো, আমার হৃদয় নেই। ”
স্বর্ণলতা স্বামীর চোখের দিকে তাকাল। একস্থির, অন্তর্নিহিত দৃষ্টি। মুনছুর সাখাওয়াতের কঠোর ভাবটা কেটে গেল নিমিষেই। তার মনে হলো, এমন করে স্বর্ণলতা কখনও তাকায়নি। এত মোলায়েম, মায়াপূর্ণ চাহনি! সম্মোহিত করছে যেন! কী একটা শুষেও নিচ্ছে! প্রায় আধ মিনিটের মতো একইভাবে চেয়ে থেকে স্বর্ণলতা আচমকা বলল,
” আছে। কিন্তু মরা। আল্লাহর কাছে মাফ চাইয়া চাইয়া তাজা করতে হইবো। ”
কথাটা বলে সে স্বামীর হাত ছেড়ে দিল। রুম থেকে বের হতে হতে পুনরায় বলল,
” ভাত খাইতে আসেন। আমরা অপেক্ষা করতাছি। ”
_______
মুনছুর সাখাওয়াত খেতে গেল না। সে জায়নামাজ কাঁধে নিয়ে বসে থাকল অনেক্ষণ। এরমধ্যে স্বর্ণলতা একবারও রুমে এলো না। তার গলার স্বর, পায়ের আওয়াজও শোনা গেল না। মুনছুর সাখাওয়াত শরীর ঢিলা করে জমিনে চেয়ে ছিল। চোখের দৃষ্টি উদাস ও ঝাপসা হয়ে আসতেই সে বাস্তব দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেল। মস্তিষ্ক ও হৃদয় জুড়ে গেল কল্পনার রাজ্যে। সেখানে সে খুঁজে পেল তার মাকে। তিনি হাঁটুতে মুখ গুঁজে নীঃশব্দে কাঁদছেন। মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে ডাকল,
” আম্মু? ”
তিনি মাথা তুলে তাকালেন। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াতের শরীর হীম হয়ে এলো। তার মায়ের চোখ থেকে পানি না, র ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মুহূর্তে সম্পূর্ণ মুখটা র ক্তে ডুবে গেল। বৃষ্টির মতো র ক্তধারা পড়ছে গলা, বুক, পেট এমনকি পায়েও। সে ভয়ে ভয়ে আবারও ডাকল,
” আম্মু? কাঁদছ কেন? তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না। ”
তিনি এক মুহূর্তের জন্য থামলেন। আগ্রহ ও কৌতূহলী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন পুত্রের দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত দ্বিধান্বিত চিত্তে কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে থেমে গেল। মায়ের র ক্তে ভেজা শরীরটা এত ভয়ঙ্কর ও নির্মম লাগছে যে, সে সাহস পাচ্ছে না কাছে যেতে। খানিক দূরত্ব রেখে পুনরায় ডাকল,
” আম্মু? ”
সাথে সাথে তিনি চিৎকার করে ওঠলেন। তার গগনবিদারী চিৎকারে পুরো কল্পনার রাজ্যই কাঁপতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াতের এত ভয় হলো! ইচ্ছে করল, এখনই ছুটে পালাতে। পারল না। সে মায়ের আরও কাছে এগিয়ে যেতেই তিনি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠলেন। ছেলের গলা চে পে ধরে বললেন,
” বিষ দে। আমি বিষ খাব। ”
কথাগুলো তার কানে প্রবেশ করামাত্র মায়ের মুখটা স্বর্ণলতার মুখে রুপান্তর হলো। সে প্রথমে অবাক হলো। পরক্ষণে ভীত ভাবটা ফিরে এলো। সর্বাঙ্গে ভয়ের কাঁটা ফুড়তে লাগল। মুহূর্তেই প্রকট ব্যথা ও যন্ত্রণায় তার দেহমন অবশ হতে লাগল। এই অবস্থায়ও সে শুনতে পেল,
” বিষ দে। আমি বিষ খাব। ”
বাক্য দুটি অনর্গল একই কণ্ঠে একই ভাবে বাজতে লাগল। মুনছুর সাখাওয়াত বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না। গলায় বসে থাকা হাতদুটি ছাড়িয়ে চোখ বুঁজে চিৎকার করে ওঠল,
” না। তুমি বিষ খাবে না। আমি তোমাকে মরতে দিব না। তুমি বেঁচে থাকবে। আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব। আমার সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হলেও তোমাকে বাঁচিয়ে রাখব। ”
সাথে সাথে কণ্ঠটা নরম হয়ে গেল। বলতে লাগল,
” কী হয়ছে আপনের? চোখ বন্ধ কইরা কার লগে কথা কন? মাথাটা কি সত্যি খারাপ হইয়া গেল? ”
মুনছুর সাখাওয়াত ঝটিতে চোখ মেলল। স্বর্ণলতা তার দিকে ঝুঁকে আছে। উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি। হাতটা কাঁধ ছুঁয়ে আছে এখনও। সে হাতটা টেনে এনে বুকে চেপে ধরল। অতঃপর ভীষণ ক্লান্ত ও দুর্বল স্বরে বলল,
” আম্মুর সাথে। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। ”
” জাইগা বইসাও মানুষ স্বপ্ন দেখে? ”
সে এই প্রশ্নের জবাব দিল না। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আমার কাছে আসোনি কেন? ”
” খাবার টেবিলে। আপনের জন্য অপেক্ষা করতাছিলাম। আসেন নাই ক্যান? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। নীরবে একস্থির চেয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিটে পরিণত হয় কিন্তু দৃষ্টিজোড়া কাঁপে না। স্বর্ণলতা অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে। অধৈর্য কণ্ঠে পুনরায় সুধাল,
” সত্যি খাইবেন না? ভাতগুলা তো নষ্ট হইয়া যাইবো। পানি দিয়া আসি। ”
সে স্বামীর হাত ও বুকের মাঝ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত হাত চেপে ধরে বলল,
” কোথাও যেতে হবে না৷ এখানে বসে থাকো। ”
” এখন কি বইসা থাকার সময়? সন্ধ্যার আযান দিবো। ”
” দিক। ”
তাদের কথার মাঝে আযান পড়ল। স্বর্ণলতা নামাজ পড়ার জন্য উশখুশ করছিল। কয়েকবার মুখে বলেছেও। কিন্তু মুনছুর সাখাওয়াতের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। সে স্ত্রীর কাছ ঘেষে হাত ধরে বসে আছে। স্বর্ণলতা নামাজের কথাটা আরও একবার তুলল। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” ওজু করে এসো। আমার সাথে নামাজ পড়বে। ”
________
মধ্যরাত। স্বর্ণলতা গভীর ঘুমে অচেতন। উল্টোদিকে পাশ ফেরা। মুনছুর সাখাওয়াত পুরো সজাগ। দুজনের মাঝে কয়েক ইঞ্চির মতো দূরত্ব। সে এই দূরত্বটুকুও কাটিয়ে ওঠল। স্ত্রীর শরীরের সাথে মিশে গিয়ে ফিসফিসে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
প্রথম ডাকে সাড়া এলো না। নড়াচড়াও নেই। মুনছুর সাখাওয়াত কিছু সময় অপেক্ষা করল। তারপরে আবারও ডেকে ওঠল,
” স্বর্ণলতা? ”
এবার মেয়েটার ঘুম ছুটল খানিকটা। চোখ মেলেনি। দেহটা জড়তা কাটিয়ে উঠার জন্য নড়তে চাচ্ছিল, পারল না। ঘুমের ঘোরেও এই বাঁধাটা স্বর্ণলতার মস্তিষ্ককে জাগিয়ে তুলল। ঝটিতে চোখ মেলে আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” কী করতাছেন? ছাড়েন। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তখন প্রবল অনুভূতিতে ভাসছে। হুঁশ থেকেও নেই। সে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
” মাফ চেয়েছি তো। ”
” এখন আমি কী করমু? ”
” সম্মতি দাও। ”
” কিসের সম্মতি? ধূর! ছাড়েন তো। আমি ব্যথায় মইরা যাইতাছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর কাঁধ থেকে মুখ তুলল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” ব্যথা? কিসের ব্যথা? আমি তো কিছু করলামই না! ”
” কিসের ব্যথা বুঝেন না? আমি কত কষ্ট কইরা ঘুমাইছিলাম! আপনের কাছে জাইগাও শান্তি নাই, ঘুমাইয়াও শান্তি নাই। ”
সে ঝটকাতে স্বামীর হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। খোলা ও এলোমেলো চুলগুলো এক করে খোঁপা করল। বিছানা থেকে নেমে বাথরুম ঢুকল। মিনিট দুই পরে বের হয়ে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত ঘরময় পায়চারি করছে। সে ভ্রূদ্বয় কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করল,
” এমনে হাঁটতাছেন ক্যান? আপনেরও কি পেট ব্যথা করতাছে? ”
সে থেমে গিয়ে প্রচণ্ড বিরক্ত ও রাগ নিয়ে বলল,
” মাফ চাইয়া কী পাইলাম? তোমার এই দূষিত রক্ত? আমি এরজন্যে মাফ চাইছিলাম? ”
স্বর্ণলতার এই প্রথম কারও রাগ দেখে হাসি পেল। সে খুব চেষ্টা করল, হাসি আড়াল করার। পারল না। ঘরের আলোতে মুনছুর সাখাওয়াতের চোখে ধরা পড়ে গেল। সে অবাক হয়ে সুধাল,
” হাসছ কেন? আমি হাসির মতো কী বললাম? ”
” কে বলল, আপনের কথা শুইনা হাসতাছি? ”
” তাহলে? ”
” আপনেরে দেইখা হাসতাছি। এত অধৈর্য ক্যান? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের অবাকের মাত্রা দ্বিগুণ হলো। চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে সুধাল,
” আমি অধৈর্য? ”
স্বর্ণলতা মুখে জবাব দিল না। মিটিমিটি হাসতে হাসতে মাথা উপর-নীচ করল কয়েকবার। মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে বলল,
” বিয়ে করেছি নয়মাস। পাঁচমাস হলো বউকে নিয়ে একখাটে ঘুমাচ্ছি। জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর কিছু করেছি? ওটাও তো তোমার সম্মতিতেই। ”
” আমিও তো বিয়া করছি নয়মাস। পাঁচমাস হইলো স্বামীর সাথে একখাটে ঘুমাইতাছি। জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর কিছু করছি? ওইটাও তো আপ…”
তার এই অনুকরণ কণ্ঠস্বরের কথাগুলো শেষ হলো না৷ পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” কার সাথে একখাটে ঘুমাচ্ছ? ”
সে অমনোযোগীতে মুখস্তের মতো বলল,
” আপনের সাথে। ”
” একটু আগে তো ‘ আপনের ‘ শব্দটা ব্যবহার করোনি। যেটা করেছ সেটা বলো। ”
স্বর্ণলতার ভ্রূজোড়া বেঁকে গেল। খানিক বিরক্ত ও অধৈর্য হয়ে বলল,
” আপনে হাঁটেন। আমি ঘুমাই। ঘুম ছাড়া তো আমার এই ব্যথা কমবো না! উফ, আর সহ্য করতে পারতাছি না। ”
সে তলপেটে হাত রেখে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ল।
______
ইকবাল পড়াতে পড়াতে আচমকা জিজ্ঞেস করল,
” আপনি সত্যি ঢাকা গিয়ে পড়বেন? ”
স্বর্ণলতা মন দিয়ে অংক করছিল। ব্যস্ত ও উদাস স্বরে জবাব দিল,
” হ। ”
” ওখানে কি আপনার কোনো আত্মীয় আছে। ”
” না। ক্যান? ”
” তাহলে কোথায় থেকে পড়বেন? মহাজন কি আপনাকে ঢাকায় ম্যাচে থেকে পড়তে দিবে? উনি তো আপনাকে এই বাড়িতেই এক ঘর থেকে আরেক ঘরে একা ছাড়ে না। ”
স্বর্ণলতার কলম থেমে গেল। চকিতে চেয়ে থাকল প্রাইভেট মাস্টারের দিকে। এই সময়ে তার ডাক পড়ল নাস্তা খাওয়ার জন্যে। সে বইখাতা গুটিয়ে তখনই পড়ার রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখল, মুনছুর সাখাওয়াত নেই। স্মরণে এলো, সে ভোরের দিকেই বের হয়েছিল। সাথে সাথে ফেরত এলো। দাদিজান তাদের মাঝের একটি চেয়ারে বসে ছিল। পড়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছেন। স্বর্ণলতা ডেকে জিজ্ঞেস করল,
” আপনের মোবাইল কই? ”
” ঘরে। ”
সে দাদিজানের রুমে গিয়ে মোবাইল খুঁজে বের করল। তারপরে কল ঢুকাল স্বামীর নাম্বারে। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে কলটা ধরল ও কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠটা বাজল। স্বর্ণলতা সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” আপনে আমারে ঢাকার কলেজে পড়তে দিবেন না? ”
” হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? তোমার এসএসসি শুরু হয়নি এখনও। আগে এটা শেষ হোক। তারপরে ভাবব। ”
” ভাববেন মানে? ”
” স্বর্ণলতা, আমি কাজে আছি। এই বিষয়ে বাসায় এসে কথা বলব। ”
” আমার থেইক্যা আপনের কাজ বড় হইয়া গেল? বেশ তো, আপনি কাজ নিয়াই থাকেন। আমার সাথে কথা বলতে হইবো না। ”
সে কল কেটে দিল। সাথে সাথে মুনছুর সাখাওয়াত ফিরতি কল দিল। স্বর্ণলতা ধরল না। একবার কেটে গিয়ে আরেকবার বাজতেই সে ফোন বন্ধ করে দিল।
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭০)
আধঘণ্টার মধ্যে মুনছুর সাখাওয়াত বাড়ি ফিরল। মূল দরজাটা পেরুতে দেখল, স্বর্ণলতা খাবার টেবিলে বসা। দাদিজানের সাথে নাস্তা করছে। মুখটা শুকনো, বিরস। কাঠিন্যের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে কিশোরী বদনখানায়। বুঝায় যাচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে সে প্রচণ্ড বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল খাবার টেবিলটার কাছে। স্ত্রী তার উপস্থিতি টের পেয়ে যে, আরও আঁট হয়ে বসল এটাও নজর এড়াল না।
খাইরুন নিসা নাতির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন,
” খেয়েছিস? ”
সে স্ত্রীর দিকে চেয়ে থেকে কাঠ স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” না। ”
” তাহলে বসে যা। আমরা মাত্রই শুরু করলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বসল না। আরও কিছুক্ষণ নীরবে চেয়ে থাকল স্ত্রীর মুখটায়। সে একবারের জন্যও দৃষ্টি তুলল না। এত কঠিন ব্যবহার? অবজ্ঞা করার সুযোগ পেলে ভুল করেও ছাড়ে না! সে দাদিজানের দিকে চেয়ে রাশভারী কণ্ঠে বলল,
” খাওয়া শেষ হলে তোমার নাতবউকে আমার ঘরে পাঠাবে। ”
সে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ঘন ঘন ও ভারী ভারী পদধ্বনি ফেলে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। স্ত্রীর আগমনের অপেক্ষায় সময় গুণতে লাগল। কখনও রুমময় পায়চারি করছে, কখনও বিছানায় বসে সমানে পা ঝাকাচ্ছে, কখনও শুয়ে পড়ে ঝিম ধরে আছে। এই এতকিছু করে কতটা সময় কাটল সে জানে না। শুধু বুঝল, অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। এতক্ষণে স্বর্ণলতার খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরেও মেয়েটা আসছে না কেন? তার গাম্ভীর্য ভাব আরও ঘন ও স্পষ্ট হয়। চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। ধৈর্য হারিয়ে রুম থেকে বের হয়ে উঁকি মারে খাবার টেবিলের দিকে। কেউ নেই! সবকটা চেয়ার খালি ও গুছানো। মুহূর্তেই মেজাজ চটে যায়। চোখ, মুখ শক্ত হয়ে আসে। রাগের ছায়া পড়ে রুক্ষ বদনজুড়ে। উত্তপ্ত হয়ে উঠে দেহে বয়ে চলা রক্ত ও মস্তিষ্ক।
মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে পা ঘুরিয়ে চলে যায় দাদিজানের রুমে। দরজা মেলা, ভেতরের অংশটা দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। সে হেঁটে যেতে যেতে দেখল, স্বর্ণলতা মেঝেতে বসে একমনে কী যেন করছে! মাথায় ঘোমটা নেই। চুলের খোঁপাটা খুলি খুলি ভাব। মুনছুর সাখাওয়াত সরাসরি রুমে ঢুকে গেল। ভাবভঙ্গি এমন আজ খুব বকবে, ধমকাবে। প্রয়োজনে আঘাতও করে বুঝিয়ে দিবে চূড়ান্ত পর্যায়ের অবাধ্যতা ও জেদি মনোভাব প্রকাশের সুযোগ আজই শেষ। আর কখনও দেখাতে পারবে না।
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ধমকে উঠবে তখনই স্বর্ণলতা মাথা তুলে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ঢিলে ও নড়বড়ে হয়ে আসা খোঁপাটা খুলে গেল। চুলগুলো পিঠে আছড়ে পড়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে। তার জবান আটকে গেল। মুগ্ধতায় বশ করে নিল ক্রোধমতি দৃষ্টি জোড়া। অবাক হয়ে খেয়াল করল, মেয়েটার চুল বড় হয়েছে। কোমর ছাড়িয়ে জমিন ছুঁই ছুঁই করছে। এত ঘন ও মসৃণ হয়েছে যে, দিনের আলোয় ভারি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তার মুগ্ধতা ও বিস্ময় ভাব কাটল স্বর্ণলতার হাতের স্পর্শে। সে পায়ে হাত দিয়ে বলছে,
” সরেন এখান থেইক্যা। দেখতাছেন না, আমি কাজ করতাছি? ”
মুনছুর সাখাওয়াত সরল না। অনড় হয়ে বলল,
” রুমে এসো। ”
” ক্যান? ”
” কথা আছে। ”
স্বর্ণলতা উঠে দাঁড়াল। স্বামীর কাছ থেকে সরতে সরতে বলল,
” আমি কাজে আছি। শেষ করি, তারপরে শুনমু নে। এখন যান এখান থেইক্যা। বিরক্ত করবেন না। ”
সহজ গলা। পরিষ্কার অভিব্যক্তি। কোথাও একটু কাঁপল না। অন্যরকম কিছু বুঝা গেল না। তবুও মুনছুর সাখাওয়াত টের পেল অভিমানে তার হৃদয় কতটা কঠিন হয়ে আছে! সে এগিয়ে যেতে চেয়েও থেমে গেল। দাদিজানের দিকে চোখ রাখতে তিনি নাতবউয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” হয়েছে, অনেক গুছিয়েছ। এবার রুমে যাও। মুনছুর কী বলতে এসেছে, শুনে আসো। ”
স্বর্ণলতা দূর হতে উত্তর দিল,
” পরে শুনমু। আগে গুছানো শেষ করি। ”
খাইরুন নিসা কঠোর হলেন। জোর গলায় বললেন,
” স্বর্ণলতা, যাও। আর একটা কিছুতে হাত দিবে না। ”
তার আদেশটা শোনামাত্র মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীর কাছে চলে গেল। হাতটা ধরে টেনে নিয়ে এলো নিজের রুমে। দরজায় সিটকানি তুলে বলল,
” সুস্থ হয়েছ? ”
স্বর্ণলতা চকিতে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। তাকে টেনে রুমে এনেছে এই কারণে? দেহ নিয়ে খেলবে বলে? আর কিছু নয়? সে যে মোবাইলে রাগ দেখাল, অভিযোগ দাঁড় করাল। এসব নজরে পড়েনি? নাকি পড়েছে কিন্তু মূল্য দিচ্ছে না?
” স্বর্ণলতা, কথা বলো। ”
সে মাথা নেড়ে না বুঝাল। মিথ্যাটা গলা দিয়ে বের হলো না। অভিমানের কান্নারা জমাট বেঁধে আটকে দিয়েছে কণ্ঠস্বর। মুনছুর সাখাওয়াত সন্দেহি ও চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” এখনও আছে? অনেকদিন হলো না? ”
স্বর্ণলতার এবার কান্না পেয়ে গেল। সে যে রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে, কোরআন তেলাওয়াত করছে এসবের কিছুই কি তার নজরে পড়েনি? এত জলদি সে মনোযোগের বাইরে চলে গিয়েছে? আগ্রহ ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে? তার চোখদুটি অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে উঠতেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। মাথা নেড়ে আবারও না বুঝাতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এজন্যে মেজাজ এত চটা! ”
বাক্যটা এমনভাবে উচ্চারণ করল যে, মনে হলো নিজেকে শুনাচ্ছে। স্বগোতক্তির মতো। সে একটুক্ষণ থেমে পুনরায় বলল,
” এতদিন তো থাকার কথা না, স্বর্ণলতা। তোমার কি অন্য কোনো সমস্যা হচ্ছে? ডাক্তার দেখাবে? ”
সে এই প্রশ্নের জবাব দিল না। ঘন ঘন ঢোক গিলল। নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে বলল,
” আপনের কি কাজ শেষ হয়ছে? ”
” না। ”
” তাহলে শেষ করেন। আপনের সাথে আমার কথা আছে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় বসল। স্ত্রীকেও টেনে পাশে বসিয়ে বলল,
” বলো। তোমার কথা শুনতেই এসেছি। যে কাজ আমার বউয়ের কথা শোনার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে, সেই কাজ আমি করব না। ওটা বাতিল। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। ভিন্ন কথাও টানল না। সরাসরি জিজ্ঞেস করল,
” আপনে আমারে আর পড়াইবেন না? ”
” পড়াব। ”
পরের প্রশ্নটা করার সুযোগ পেল না। পূর্বেই মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” কিন্তু ঢাকার কলেজে না, আমাদের এখানেই পড়বে। শহরে নতুন প্রাইভেট কলেজ খুলেছে। সেখানে ভর্তি করিয়ে দিব। শিক্ষকরা আমার পরিচিতই। কষ্ট করে ক্লাস করতে হবে না। শুধু পরীক্ষায় সময়…”
সে কথাটা শেষ করতে পারল না। স্বর্ণলতার তেজাল, জেদেমাখা কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” আমি এখানে পড়মু না। ঢাকার ভালো কলেজে পড়মু। রোজ ক্লাস করমু, সবার সাথে মিশতেও হইবো। নাহলে পড়ালেখা ঠিকমতো হয় না। এখন আপনে বলেন আমারে আমার মতো কইরা পড়াবেন কি না। ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখদুটিও জ্বলে ওঠল। রূঢ়ভাবে কী একটা বলতে চেয়েও থেমে গেল। কম্পন ঠোঁটজোড়া কামড়ে ধরে থাকল কতক্ষণ। চোখ বুঁজে গভীর ও প্রলম্বিত নিঃশ্বাস টেনে রাগ সংবরণ করল। অতঃপর নরম হয়ে বলল,
” সবসময় জেদ দেখালে হয় না, স্বর্ণলতা। পরিস্থিতিও বুঝতে হয়। আমার ব্যবসা এখানে। পরিবারও। সব ফেলে তোমাকে নিয়ে ঢাকা যাই কীভাবে? সেখানে আমার নিজস্ব একটা বাড়ি নেই। একহাত জমিও না। তোমাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠতে হবে। ”
” আমার ভাড়া বাসায় উঠতে সমস্যা নাই। আপনের সমস্যা হয়লে আপনে যাইবেন না। আমি তো একবারও বলি নাই, আপনেও চলেন। ”
” তুমি একা যাবে? ”
” হ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আচমকা পূর্বের প্রশ্নটায় পুনরাবৃত্তি করল,
” স্বর্ণলতা, তুমি একা যাবে? ”
এবার সে এক শব্দে উত্তর করল না। আরও কতগুলো শব্দ মিলিয়ে বলল,
” আপনের যাইতে সমস্যা হইলে তো একায় যেতে হবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। রুম থেকে বেরিয়ে গেল তখনই। স্বর্ণলতা হতভম্ব দৃষ্টিতে স্বামীর চলে যাওয়া দেখল। তাদের কথপোকথন শেষ হয়নি। কোনো সিদ্ধান্তেও আসেনি। তার এত রাগ হলো! আহতও হলো খুব। এভাবে মাঝপথে চলে যেতে পারল?
স্বর্ণলতা দরজা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিল তখনই মুনছুর সাখাওয়াত এসে দাঁড়াল দোরগোড়ায়। সেখান থেকে উঁচু স্বরে অটল গলায় বলল,
” যদি আমার মতো করে পড়তে পার তাহলে পড়ো। নাহলে দরকার নেই। এই নিয়ে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাই না। স্বর্ণলতা, বাড়াবাড়ি করো না। পরে আমি নিজেকে সামলাতে পারব না। আর আমি যদি বেসামাল হয়ে পড়ি তাহলে আমরা দুজনেই খুব কষ্ট পাব। ”
শেষ কথাগুলো কি হুমকি ছিল নাকি অনুরোধ? স্বর্ণলতা বুঝার জন্য সময়ও নিল না। তার পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ পেয়েছে। ইকবাল একটা রুটিন এনেও দিয়েছে। সে ঐ রুটিনটা নিয়ে এসে মুনছুর সাখাওয়াতের হাতে দিয়ে বলল,
” এটারও দরকার নেই। ছিঁড়া ফেলাই দিয়েন। ”
মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ অশ্রুতে টলমল হয়ে ওঠল। গলাটাও কেমন ধরে এলো! সেভাবেই বলল,
” বিশ্বাস করেন, আমি একটুও অবাক হই নাই। কারণ, আমি জানতাম আপনে এমন কিছুই করবেন। যেখানে ভালো জামাইরাই বউগোরে পড়ায় না। সেখানে আপনে পড়াইবেন, এটা স্বপ্নেও ভাবা বোকামি। আমি জাইনা বুইঝাও ভাবছিলাম। স্বপ্নে না, বাস্তবে ভাবছিলাম। তারপরে ধোঁকাটা খাইলাম। ”
” আমি খারাপ জামাই? তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিল না। আচমকা তার মুখের উপরে দরজা আটকে দিল।
________
স্বর্ণলতা স্বামীর কথা শুনল না। সে বাড়িবাড়ি আরম্ভ করে দিল। মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে প্রথমে বিরক্ত দেখাতে লাগল। সে যাই করুক না কেন, তার পছন্দ হচ্ছে না। বিরক্তের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। তারপরে দূরত্ব তৈরী হতে লাগল। একসময় কথা-বার্তাও বন্ধ হয়ে গেল। এই রাগ-অভিমান কমছে না কিছুতেই, বরঞ্চ বাড়ছে। কেউ কারও সিদ্ধান্ত থেকে নড়ছে না, এই নিয়ে নতুন করে আলোচনায়ও বসছে না। এদিকে এসএসসি পরীক্ষার তারিখ ঘনিয়ে এসেছে। স্বর্ণলতার এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সে বইখাতা সেই যে গুটাল আর খুলেনি।
মুনছুর সাখাওয়াত সবকিছু মেনে নিলেও পরীক্ষা না দেওয়ার বিষয়টা মানতে পারছিল না। হাজার চেষ্টায়ও মাথা থেকে ঝাড়তে পারছিল না। শেষে বাধ্য হয়ে একরাতে স্ত্রীকে বলল,
” কাল তৈরি থেকো, তোমার পরীক্ষার কেন্দ্রটা দেখিয়ে আনব। ”
স্বর্ণলতা উল্টোদিকে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। চোখ বুঁজে থাকলেও পুরোপুরি সজাগ। কথাটা কানে প্রবেশ করলেও সে কোনো রকম সাড়াশব্দ করল না। পরেরদিন সকালে তৈরিও হলো না। মুনছুর সাখাওয়াত তার সামনে দিয়ে কয়েকবার ঘুরাফেরা করল। কিন্তু দ্বিতীয়বারের মতো কথাটা বলল না। জোরও করল না।
_________
পরীক্ষা শুরু হওয়ার দুইদিন পূর্বে ইকবাল দেখা করতে এলো মুনছুর সাখাওয়াতের সাথে। সে তখন উঠোনে, কাঁঠাল গাছটার নিচে চেয়ারে বসা। চোখ বন্ধ, মাথা ঠেকানো চেয়ারের পেছনে। দুটো পা তুলে টানটান করে রেখেছে টেবিলের ওপরে। ইকবালের উপস্থিতি টের পাওয়া সত্ত্বেও সে পা নামাল না। চেয়ারে বসার অনুমতিও দিল না। চোখ বুঁজা অবস্থায় তাগাদা দিল,
” কিছু বলার থাকলে বল৷ নাহলে চলে যা। আমি ঘুমাব। ”
ইকবালের চোখ চলে গেল আকাশে। দুপুরবেলা। সূর্যটা ঠিক যেন মাথার উপরেই স্থির হয়ে আছে। খুব রাগ, উত্তাপ। অন্য সময়ে কাঁঠালতলায় ছায়া পড়লেও এখন পড়ছে না। এত কড়া রোদে মুনছুর সাখাওয়াত বসে আছে কীভাবে? সে ভারি আশ্চর্য হলো। মানুষটার কি সূর্যের চেয়েও তেজ বেশি? হতে পারে। নাহলে সহ্য করতে পারত না। সে তো দুই মিনিটেই ঘেমে ওঠেছে। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।
ইকবাল দৃষ্টি নিম্নে এনে বলল,
” শুনলাম, আপনার স্ত্রী পরীক্ষা দিচ্ছে না। কথাটা কি সত্যি? ”
” হুম। ”
” কেন? ”
এই পর্যায়ে মুনছুর সাখাওয়াত চোখ মেলল। ভ্রূদ্বয় কুঁচকে কপালের মাঝে শীর্ণ ভাঁজ ফেলে নীরবে চেয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। সহসা নড়ে ওঠল। পা দুটি নামিয়ে নীরবতা ভেঙে শান্ত স্বরে সুধাল,
” আমার কাছে জবাব চাচ্ছিস? ”
” না। কৌতূহল মিটাতে চাচ্ছি। ”
” কিসের কৌতূহল? ”
” এই যে, আমাকে দিয়ে জোর করিয়ে রানিসাহেবাকে পড়ালেন। আমাকে দিয়েই কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের বিরক্তের ভাবটা বেড়ে গেল। কিন্তু প্রকাশ করল না। ইচ্ছে হলো উঠে চলে যায়। উঠার জন্য উদ্যত হয়েও পুনরায় বসে পড়ল। শক্ত আসনে আরাম করে বসে বলল,
” তোমাকে সঠিক পথে আনার জন্য। ”
” আপনি আমাকে সঠিক পথে আনতে চান? ”
কণ্ঠটায় একইসাথে বিস্ময় ও সন্দেহ। ইকবালের ভ্রূজোড়া খানিক উপরে উঠে গিয়েছে। চোখগুলো দেখাচ্ছে বড় বড়৷ মুনছুর সাখাওয়াত সাথে সাথে জবাব দিল,
” না। তোমার রানিসাহেবা চায়। ”
দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। ইকবাল একের পর এক প্রশ্ন করে গেল। মুনছুর সাখাওয়াত ধৈর্য নিয়ে শান্তভাবে নিঃসংকোচে সবগুলো প্রশ্নেরই উত্তর দিল। সবশেষে এক আকাশসম বিস্ময় নিয়ে মহাজনের কাছ থেকে সরে পড়ার সময়ে আচমকা শুনল,
” তোমার ছাত্রীর সাথে কথা বলো। দেখ, পরীক্ষা দেওয়াতে পার নাকি। ”
সে থেমে পেছন ফিরে অবাক কণ্ঠে সুধাল,
” আমি বললে রাজি হবে? ”
” হবে না কেন? শিক্ষক হয়ে যদি ছাত্রীকে পরীক্ষাই দেওয়াতে না পার তাহলে এতদিন শেখালে কী? যাও, এখনই কথা বলো। ”
” উনি তো পড়ার রুমে আসে না। ”
” তাহলে যে রুমে আসে সেই রুমে যাও। ”
ইকবাল দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না৷ পূর্বেই সে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। বারান্দার কাছে এসে দাদিজানকে ডাকল। তিনি উঁকি দিতেই বলল,
” ইকবালকে আমার ঘরে নিয়ে যাও। ”
খাইরুন নিসা তখন কোনো প্রতিবাদ না করলেও ইকবালকে নাতির ঘরে নিল না। পড়ার রুমে বসিয়ে স্বর্ণলতাকে ডেকে আনল। জোর করে একই রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
ইকবাল কিছুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি সত্যি পরীক্ষাটা দিচ্ছেন না? ”
স্বর্ণলতার নত মাথায় ভার স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” না। ”
” কারণটা জানতে পারি? ”
” উনি চান না। ”
” কিন্তু মহাজন তো আমাকে পাঠালেন আপনাকে মানানোর জন্য। ”
” শুধু এই পরীক্ষা। উনি চান না, আমি ঢাকায় গিয়া পড়ি। ”
ইকবাল একটু থামল। চুপ করে কিছুক্ষণ ভেবে সহসা সুধাল,
” এই না চাওয়ার পেছনের কারণটা কী হতে পারে? ভেবেছেন কী? ”
” উনার ব্যবসা। ”
” শুধু ব্যবসা? আর কোনো কারণ পাননি? ”
” আর কী? ”
” ভাবুন। ”
স্বর্ণলতা প্রথমে বোকার মতো চেয়ে থাকল তার প্রাইভেট মাস্টারের দিকে। চেয়ে থাকতে থাকতেই তার হৃদয়ে কিছু ঘটল। মুহূর্তেই চোখের কোলদুটি টলমল হয়ে উঠল অশ্রুতে। ব্যথা উঠল বুকে, শরীরে, অন্তরে। আঁতকা কান্নাপ্রায় কণ্ঠে বলল,
” উনি ভালো নাই! আমার তো এটা সহ্য হইতাছে না। ইকবাল ভাই, আমার পড়াশুনা লাগবো না। উনারে কন, আমি উনারে ছাড়া কোথাও যামু না। ”
ইকবাল মৃদু হাসল। অশ্রুসিক্ত কাতর দৃষ্টি জোড়ায় চেয়ে বলল,
” আপনিও ভালো নেই। স্বীকার করতে এত দ্বিধা কেন? ”
” আমার ভয় করে! আম্মায় বলছে, ভালোবাসা মানে দুর্বলতা। উনার সামনে আমি এখনই দুর্বল হইতে চাই না। আমার অনেক কিছু করা বাকি। ”
” সবাই দুর্বল হয় না। কেউ কেউ সাহসও হয়। আমার বিশ্বাস আপনি সাহস হবেন। দুর্বল তো মহাজন হয়েই আছে। এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে সাহসী হোন, শক্তিশালী হোন। কিন্তু লুকিয়ে রাখবেন না। লুকিয়ে রাখতে গিয়ে আপনাদের সম্পর্কটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, ভালোবাসাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ”
সে একটু থেমে পুনরায় বলল,
” মহাজন যে, কাউকে ভালোবাসতে পারে এটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। এখন তো দেখছি, সাধারণ ভালোবাসা না পাগলের মতো ভালোবাসে। রানিসাহেবা, আমি চাই না আমার আপার মতো জীবন আপনারও হোক। ”
স্বর্ণলতা একমনে কথাগুলো শুনছিল ও নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছিল। সহসা জিজ্ঞেস করল,
” উনি কি বাড়িতেই আছেন? ”
” হ্যাঁ। ডাকব? কথা বলবেন? ”
সে গলার স্বরে বা আকার-ইঙ্গিতে কিছুই বলল না। ক্ষণকাল চুপচাপ থেকে আচমকা খাতার মধ্যে দ্রুত হস্তে লিখল,
” যে সুখ পেতে হলে আপনাকে দুঃখ দিতে হয় সেই সুখ আমি চাই না। আমাকে ক্ষমা করুন। এরকম জেদ আর কখনও করব না। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলব। দয়া করে রুমে আসুন। আমি ভাত নিয়ে অপেক্ষা করছি। ”
এতটুকু লিখে সে কাগজটা ছিঁড়ল। ভাঁজ করতে গিয়েও করল না। দ্রুত কলম হাতে নিয়ে আবারও লিখল,
” আমি সুস্থ হয়েছি। ”
স্বর্ণলতা কাগজটা ভাঁজ করে ইকবালকে দিয়ে বলল,
” এটা এখনই উনার কাছে পৌঁছাইয়া দিবেন। ”
চলবে