#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৫)
মুনছুর সাখাওয়াত স্ত্রীকে নিয়ে বিছানায় এলো। পাশাপাশি শুয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তোমার বয়স যেন কত? ”
স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। সে কথা বলার মতো অবস্থাতে নেই। ঝিম মেরে আছে। মুদিত চোখ ও রুদ্ধশ্বাসে অনুভব করছে, বিদ্যুৎগতিতে দেহের মধ্যে কিছু একটা ছড়িয়ে পড়েছে। ভীষণ ক্ষ্যাপাটে, আগুর গরম কিছু! লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাচ্ছে তার ভেতরের সবকিছু। স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনাতেও তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
মুনছুর সাখাওয়াত চিত হয়ে শুয়েছিল। এবার কাত হলো। স্বর্ণলতার মুখটায় চাইতে দেখল, তার বন্ধ চোখজোড়া কাঁপছে। সে কম্পনরত চোখে আলতো চুমু খেয়ে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
সাথে সাথে উত্তরটা এলো,
” ষোল। ”
” এই বয়সে এত সাহস? আদর-সোহাগ নিয়েও জেদ দেখাচ্ছ! ”
” না দেখাইয়া উপায় আছে? সুন্দর কইরা চাইলে তো দেন না। ”
” আমি তো চাওয়ার আগেই দিতে চেয়েছিলাম। তুমি নেওনি। দূরে ঠেলে দিয়েছ। এটার প্রভাবই পড়ল সেদিন। আদর হয়ে গেল অত্যাচার! ”
স্বর্ণলতার ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়িয়ে পুনরায় বলল,
” তোমার যে বয়স কম, ঠোঁটে ঠোঁটে পরিচয় হয়ে উঠেনি এখনও এটা জানার পরেও আমি ভুলে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল, তোমার ঠোঁট নয় শত বছরের সাধনাকে ছুঁয়েছি। সেটাও সময়ের আগেই কঠোর নিষেধ অমান্য করে। একবার ছুটে গেলে আর ছুঁতে পারব না কখনও। এত লোভে পেয়েছিল! আমি সামলে উঠতে পারছিলাম না। স্বর্ণলতা, তোমার কি খুব রাগ হয়েছিল? ”
রাগ হয়েছিল নাকি স্বর্ণলতা মনে করতে পারল না। কিন্তু বিরক্ত হয়েছিল। সেটাও দূর হয়ে গেছিল মুনছুর সাখাওয়াতের স্পর্শেই। সেই ঠোঁটের ছোঁয়া পাওয়ার পর থেকেই সে নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে। এই মানুষটা স্পর্শ করলে তার দেহমনে ভয়ানক ধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়। সেই সাথে সুখ সুখ অনুভূতিও হয়। সুখানুভূতিটা এত তীব্র পর্যায়ের হয় যে, স্বর্ণলতা বেশিক্ষণ সয়ে উঠতে পারে না। এখনও পারছিল না। ঝটিতে চোখ মেলতেই তার অতিষ্ঠভাবটা কেটে গেল। মুনছুর সাখাওয়াতের এই মোহাবিষ্ট দৃষ্টি, ঠোঁটে হাত বুলানোর ধরনটা নতুন নয়, খুব পুরোনো। এর আগেও অসংখ্যবার দেখেছে কিন্তু আজকের মতো শিহরণ জাগাতে পারেনি। তাহলে কি মানুষটা সত্যি বলছে? এই স্পর্শ, চাহনি দিয়ে বুঝাতে চেয়েছিল, কতটা কাছে আসতে চাচ্ছে?
মুনছুর সাখাওয়াত আরও ঘনিষ্ঠ হলো। ঠোঁটের দিকে এগিয়েও থেমে গেল। ভাবুক হয়ে ওঠল নিমিষেই। নীরব সময় কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি সুস্থ তো? ”
” হুম। ”
” তাহলে তো তোমাকে দেখতে পাব। নাকি আপত্তি আছে? ”
স্বর্ণলতা প্রশ্নটা শুনল চোখ খোলা অবস্থায়। এত লজ্জা পেল! নাক, মুখ পুরো রাঙা হয়ে ওঠল। সে চট করে অন্যপাশ ফিরে বলল,
” জানি না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত তার প্রিয় ও প্রার্থিত জায়গাটায় ওষ্ঠাধর রেখে বলল,
” এখনও সময় আছে। সীমানা বেঁধে দিতে পার। দেরি হয়ে গেলে কিন্তু মানব না। তুমি কাছে এনেছ বলে ভেবে না, দূরে ঠেলে দিলেই চলে যাব। ”
স্বর্ণলতা কোনো জবাব দিতে পারে না। টের পায় সেই সুখানুভূতিটা ফিরে আসছে। আগের চেয়েও তীব্র ও ভয়ঙ্কর হয়ে। অসহণীয় হয়ে উঠামাত্র সে স্বামীর দিকে ফিরে তাকে জড়িয়ে নেয় আষ্টেপৃষ্টে। মুনছুর সাখাওয়াত এটাকে প্রশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে। নিজে থেকে সীমানা বাঁধে না। স্পর্শ গভীর করে, সুখের মাত্রা বাড়ায়। নিয়ন্ত্রণের সুতোটাও একটু একটু করে ছেড়ে দিচ্ছিল, সহসা থেমে যায়। স্ত্রীর অনাবৃত পেট থেকে মুখ তুলে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
সে তখন অন্য ভুবনে। অন্য রকম হাওয়াতে এলোমেলো হয়ে আছে সবকিছু। মুনছুর সাখাওয়াতের মতো এত দ্রুত সামলে উঠতে পারল না। কোনো রকমে আওয়াজ দিল,
” হুম? ”
” আমাকে এত কাছে টেনে নিতে কে বলল? তোমার মন নাকি শরীর? ”
বন্ধ চোখজোড়া খুলে গেল ঝটিতে। ভারি আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” শরীর আবার কথা বলে নাকি? ”
” বলে তো। একটা বয়সে পৌঁছানোর পরে সবার শরীরই কথা বলে। তোমার সেই বয়স হয়েছে। তারমধ্যে তুমি বিবাহিত, স্বামীও বেঁচে আছে। এই সময়ে শরীর কথা বলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ”
” আপনি দেখি সবই জানেন। তাইলে আবার আমারে জিগাইতাছেন কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত ভীষণ আহত হলো। ব্যাকুল হয়ে ওঠল মুহূর্তেই। অস্থির ও উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
” এর মানে কী? তোমার মন আমাকে চায়নি? তোমার বুকের মধ্যে আমার জন্য এক ফোঁটা ভালোবাসাও জন্মায়নি? স্বর্ণলতা, তুমি কি আমাকে কখনই ভালোবাসবে না? ”
স্বর্ণলতা পুরো হা হয়ে গেল। বিস্ময়ের রঙে সম্পূর্ণ মুখটা উজ্জ্বল হয়েও নিভে গেল সাথে সাথে। সে ভেবেই পেল না, এই মুহূর্তে এসব কথা আসছে কেন? ভালোবাসা ছাড়াই বুঝি এত সাহসী হয়েছে? নির্লজ্জের মতো নিজেকে এভাবে মেলে ধরেছে? তার এই নীরবতা, নিজের সাথে বুঝাপড়ার সময়টুকুও মুনছুর সাখাওয়াত ধৈর্য নিয়ে সহ্য করতে পারল না। স্ত্রীর কাছ থেকে সরে গেল। চিত হয়ে শুয়ে শূণ্যে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
” শরীরের কথা শুনে না, মনের কথা শুনে আমাকে কাছে টেনো। আমি আসব, ভালোবাসব। দুনিয়া ভুলিয়ে আদরও করব। ”
এটুকু বলে সে স্বর্ণলতার দিকে তাকাল। মেয়েটা তখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মূর্তির মতো শক্ত ও অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। মুনছুর সাখাওয়াত শাড়ির আঁচলটা বুকে ফেলে দিয়ে বলল,
” ঘুমাও। ”
অন্যদিকে পাশ ফিরে সেও চোখ বুঝল। ভেতরে ভেতরে এত আশ্চর্য হচ্ছিল! মনে পড়ে গেল কতকিছু! একটা সময়ে মনপ্রাণ দিয়ে চেয়েছিল, মেয়েটা যেন তার দিকে ফিরে থাকে। একটু কথা বলে। তাতেই সে ধন্য হয়ে যাবে। আর কিছু লাগবে না। তারপরে সেই চাওয়া বদলে গেল। তখন মনেপ্রাণে চাইতে লাগল, মেয়েটার মনে যেন তার জন্য মায়া সঞ্চার হয়। সেই মায়াতেই জীবন পার করে দিবে। ভালোবাসা লাগবে না। এসব কাছে আসা, শরীর নিয়ে মেতে উঠা তো আরও পরের বিষয়। সেই পরের বিষয়টা আগে চলে আসতেই তার মন এত লোভী হয়ে ওঠল? এখন সব ছেড়ে ছুঁড়ে তার ভালোবাসা চাই! মানব মন বড্ড বেহায়া, ভাবনার চেয়েও অধিক লোভী হয়, স্বার্থপর। একটু নিয়ন্ত্রণ হারালেই হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর অসভ্য।
” ভালোবাসি তো। ”
স্বর্ণলতার কণ্ঠস্বরে তার ভাবনার সুটো কাটল। ঘাড় বাঁকিয়ে সুধাল,
” ভালোবাস? ”
” হ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এবার পুরোপুরি ফিরল। স্বর্ণলতা শোয়া থেকে উঠে পড়েছে। পা ভাঁজ করে তার দিকে ঘুরে বসে আছে। ঢিলে হয়ে আসা শাড়ির আঁচল, অগোছাল চুলে মুখটা এত আবেদনীয় লাগছে! সে না চাইতেও চোখ গিয়ে আটকাল লাল হয়ে আসা অধরযুগলেই। মনে পড়ে গেল মিনিট দুই আগের দৃশ্যটা। সঙ্গে সঙ্গে আফসোসের ভারী নিশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিঁড়ে। ঐ মুহূর্তে বাস্তব চিন্তাশক্তিটা ফুরিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হতো?
মুনছুর সাখাওয়াত জোর করে চোখদুটি সরাল। স্বর্ণলতার চোখে চেয়ে বলল,
” শুধু মুখে বললে হবে না। কাজেকর্মে বুঝাতেও হবে। বলো দেখি, ভালোবেসে আমার জন্য কী করেছ? ”
সে উত্তর দিতে চেয়েও পারল না। ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ল তারপরেও এমন কিছু খুঁজে পেল না, যেটাতে বুঝা যায় স্বামীকে ভালোবেসে করেছে। মুহূর্তেই সে অসহায় বোধ করতে লাগল। করুণ চোখে চাইতেই মুনছুর সাখাওয়াত হেসে ফেলল। নীঃশব্দের হালকা ঠোঁট মেলে হাসিটা এত চমৎকার লাগল যে, স্বর্ণলতা পলক ফেলতে ভুলে গেল। মুগ্ধ হয়ে খেয়াল করল, হাসলে এই মানুষটাকে একদম অন্যরকম লাগে। চেহারার রুক্ষভাব, কাঠিন্যতা সবকিছুই অদৃশ্য হয়ে যায়। ভীষণ কোমল ও পবিত্র রঙ এসে পড়ে গাল জোড়ায়। চোখের তারা দুটি এমন ঝলমলে হয় যে, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে ওখানে রাগের তেজ লেগেছিল কখনও।
মুনছুর সাখাওয়াত হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিল। বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় চুমু খেল। অতঃপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আপনমনে ভাবল, ‘ তুমি যে ভালোবেসে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিচ্ছ সেটাও বুঝতে পারছ না? অথচ ভালোবাসলে কী পরিমাণ যন্ত্রণা পেতে হয় সেটা আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছ! ‘
স্বর্ণলতা বুক থেকে মুখ তুলে বলল,
” এই গোঁফটার জন্য আপনার সুন্দর হাসিটা ঠিকমতো দেখতে পারলাম না! ”
” আমার হাসি সুন্দর? ”
” হ। ”
” আমাদের মধ্যে তাহলে সুন্দর কিছু পেলে? ”
সে জবাব দেয় না। মুখ নামিয়ে নেয়। স্বামীর শরীরের সাথে আরও মিশে যেতে যেতে সুধাল,
” কী করলে বিশ্বাস করবেন আমি আপনারে ভালোবাসি? ”
” ঢাকায় ফিরে গেলে। ”
স্বর্ণলতা চকিতে মাথা তুলে। বিস্ময় ভর্তি চোখদুটি মেলে রাখলে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” কাল সকালেই যাবে। ”
” ইকবাল ভাই তো ফেরত চইল্যা গেছে। ”
” ও থাকলেও তোমাকে নিয়ে যেতে পারত না। আমার অনুমতিতে যাচ্ছ মানে আমার সাথে যাচ্ছ। ”
__________
পরেরদিন সকালবেলা। জীপে উঠে বসে স্বর্ণলতা বলল,
” আমি কিন্তু মন থেইক্যা পড়ালেখা ছাড়তে চাইছিলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত জীপ নিয়ে ছুটে যেতে যেতে বলল,
” আমিও মন থেকে তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি। ”
” আপনি একা একা থাকতে পারবেন? ঐ আজরাইলটা আসলে ভয় পাইবেন তো। ”
” আসবে না। কেউ একজন বলছিল, আমি নিজেই আজরাইল। ”
” ওটা তো রাগের কথা। ”
” রাগ করে মানুষ সত্য কথাই বলে। এমন সত্যি কথা যেটা সে অন্য সময় বলতে কুণ্ঠাবোধ করে। রাগ হলো ভয়ঙ্কর সত্যি সামনে আনার অপরিকল্পিত কৌশল। ”
স্বর্ণলতা অনেক চেষ্টা করেও স্বামীকে মানাতে পারল না। হাল ছেড়ে দেওয়া মাত্রই ভাবনাটা মাথায় এলো। আচমকা বলল,
” আমাদের গ্রাম দিয়াই তো যাইবেন। হাদি ভাইয়ের বাসার সামনে একটু দাঁড়াইয়েন তো। ”
” কেন? ”
” দরকার আছে। ”
” ওর সাথে তোমার কোনো দরকার থাকতে পারে না। স্বর্ণলতা, এসব ভুলভাল আবদার করো না। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। ”
” হোক। তবুও দাঁড়াইবেন। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৬)
ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও জীপটা থামাতে হলো ড. আল হাদির বাড়ির সামনে।মুনছুর সাখাওয়াত প্রচণ্ড বিরক্ত ও বিরস গলায় জিজ্ঞেস করল,
” এখানে কী কাজ? ”
স্বর্ণলতা উচ্ছ্বসিত বদনে রহস্য করে বলল,
” ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবেন। ”
উত্তরটা দিয়ে সে জীপ থেকে নেমে পড়ল। স্বামীর মুখভঙ্গি, মতামত কোনো কিছুকে গুরুত্ব দিল না। বাড়ির মূল ফটকটির দিকে কয়েক কদম এগিয়ে পেছনে ফিরল। মুনছুর সাখাওয়াত তখনও জীপেই বসে আছে। শক্তপোক্ত দেহটা সিটে হেলান দেওয়া। কুঞ্চিত ভ্রূযুগল, কপালের মধ্যখানে শীর্ণ ভাঁজ, চোখের কোটরে ক্রোধের আগুন সবকিছুকে উপেক্ষা করে তাগাদা দিল,
” আসেন না কেন? আমি কি একাই ভিতরে যামু? পরে তো এটা নিয়াও তামাশা করবেন। ”
” করব না। যাও। ”
” সত্যি যামু? ”
মুনছুর সাখাওয়াত চোখ বন্ধ করে ফেলল। সাথে সাথে টের পেল, কোথাও আগুন লেগেছে। পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে সেখানের সবকিছু। সে বুঝতে পারছে তারপরেও কিছুই করতে পারছে না। এত অসহায় ঠেকছে! নিজের রাগে নিজের সম্পদ পুড়বে এমনটা কি কখনও ভেবেছিল? সে বাড়ির ভেতরে গেল না ঠিকই কিন্তু গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল।
স্বর্ণলতা উঠোনে পা রাখতে দেখল, বেহালা বেরুচ্ছে। তার পরনে রঙিন শাড়ি। কুঁচি দিয়ে পরেছে। কী ভালো দেখাচ্ছে! মেয়েটা এত সুন্দর করে শাড়ী পরে কীভাবে? সে তো আজও শিখতে পারেনি! সেই শুরুর মতো এখনও শাড়ির কুঁচি হয় অসমান, এলোমেলো। আঁচলটাও সামলাতে হয় কত কষ্ট করে! অথচ বেহালাকে আঁচল ঠিক করতে দেখেনি কখনও। সর্বক্ষণ পোষ্য হয়ে পড়ে থাকে কাঁধ বরাবর। সাথে টিয়ামনিও আছে। তার হাতে ব্যাগপত্র। মুখটা হাসি হাসি।
বেহালা বান্ধুবীকে দেখতে পেয়ে পায়ের গতি বাড়ায়। কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করে,
” স্বর্ণা না? ”
স্বর্ণলতা মুখের কালো রঙা নিকাবটা খুলল। মৃদু হেসে মাথা নেড়ে জবাব দিল,
” হ। কেমন আছ? ”
বেহালা প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়ার পূর্বেই আকাশ কাঁপিয়ে কর্কশ কণ্ঠটা বেজে ওঠল,
” আবার মুখ খুললে কেন? ”
উভয়ে চমকে দেখল মুনছুর সাখাওয়াতকে। স্বর্ণলতা তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলেও বেহালা সরাল না। সে দূর হতে অপলক দৃষ্টি স্থির রেখে সুধাল,
” উনিও এসেছেন দেখি! কোনো বিশেষ দরকার নাকি? ”
” হ। হাদিভাই বাড়ি আছে? ”
এতক্ষণে বেহালার দৃষ্টি সরল। বান্ধুবীর মুখটায় চাইতেই ভাইয়ার মুখটাও মনে পড়ে গেল। এই গ্রাম্য, সহজ-সরল, সাধারণ গড়নের কিশোরী মেয়েটা নাকি তার ভালোবাসা! স্বপ্ন দেখেছে বধূ বেশে ঘরে তোলার। এই ভালোবাসা, স্বপ্ন এতটায় গোপন ছিল যে, সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। জানতে পারল ভাইয়ার বিয়ের পরে, সেটাও ভাবির কাছে! সংবাদটায় সে চমকাবে নাকি আফসোস করবে বুঝতে পারছিল না। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, ভাবি হিসেবে স্বর্ণলতা অসাধারণ হতো। দেখতেও ভারি মিষ্টি হয়েছে। অনেকদিন পরে দেখা! বেহালার মনে হলো মুখের আদলটায় পুরো বদলে গিয়েছে। আগের চেয়েও আরও ধারাল ও ঝকঝকে হয়েছে। হাদিভাই যদি এই রূপটা দেখে নির্গাত আরও মুষড়ে পড়বে।
” আছে। আজ তো ভাইয়ার ছুটি। দরকারটা কি ভাইয়ার সাথেই? ”
” হ। তুমি কই যাও? ”
” বাজারে যাচ্ছি। ছবি তুলতে হবে। কলেজে ভর্তির জন্য লাগবে নাকি। ”
” হ, লাগবো তো। এখনই যাইবা? একটু অপেক্ষা করো? হাদিভাইয়ের সাথে কাজটা শেষ কইরা আসি। একসাথে যামুনে। ”
” আচ্ছা। ”
স্বর্ণলতা বাড়ির মূল দরজার দিকে এগুল। মুখটা যে খোলায় থেকে গেল, এটা তার খেয়ালে না আসলেও মুনছুর সাখাওয়াত দূর হতে দেখছিল। দ্বিতীয়বার আওয়াজ তুলল না। আক্রোশে ফেটে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। এই সময়ে বেহালা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
” ভাইয়া, আপনি যাবেন না? ”
এই সময়ে এই মেয়েটার সঙ্গ একেবারেই ভালো লাগছিল না। তন্মধ্যে ‘ ভাইয়া ‘ ডাকটা তার শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দিল যেন। ইচ্ছে করল ঘুষি মেরে নাক, মুখ ফাটিয়ে দিতে। তেমনটা সম্ভব হলো না। প্রথমত, স্বর্ণলতা কাছেই আছে। দ্বিতীয়ত, এই মেয়েটা তার একমাত্র বান্ধুবী। সে রাগ প্রকাশ না করলেও বিরক্তটুকু আড়াল করতে পারল না। বলল,
” তোকে ভাইয়া ডাকতে নিষেধ করেছি না? ”
বেহালা বিরক্তটুকু ধরতে পারল ঠিকই। কিন্তু কেন জানি খারাপ লাগল না। উল্টো হেসে বলল,
” আচ্ছা, তাহলে দুলাভাই ডাকব। এবার খুশি? ”
মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ, মুখের আঁধার ভাবটা আরও ঘন হলো। ভীষণ অবজ্ঞা ও অবহেলায় চোখটা সরিয়ে নিতে শুনল,
” অনেকদিন হলো আপনাকে মারতে দেখি না। একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন নাকি? ”
সে জবাব দিল না। তার চোখ পড়ে আছে এই বাড়ির বড় দরজাটার কাছে। বউটা তো খোলা মুখে ভেতরে ঢুকে গেল। একটুও লজ্জা করল না? ভয় হলো না? একবারও কি মনে হলো না স্বামীটার কেমন লাগবে? মুনছুর সাখাওয়াত যেমন কষ্ট পাচ্ছে তেমন অস্থির হয়েও আছে।
বেহালা অনেকটা সময় নীরব থেকে সুধাল,
” এই পরিবর্তনটা কি স্বর্ণলতার জন্য? ”
” আমাদের বিষয়ে তোর এত আগ্রহ কেন, মেয়ে? ”
বেহালা থতমত খেল। অস্বস্তিতে জড়িয়ে যেতে মুনছুর সাখাওয়াত জিজ্ঞেস করল,
” তোর ভাই কি বাড়িতে? ”
” হ্যাঁ। ”
_________
স্বর্ণলতা দরজার কাছে পৌঁছাতে একটি নারী কণ্ঠস্বর পেল। খুব চ্যাঁচাচ্ছে! অবিরত, বাড়িঘর কাঁপিয়ে তুলছে। কানে তালা লাগার মতো অবস্থা হলো। অজান্তেই দুই হাতে কান চেপে ধরল। বসার রুমটায় পা রাখতে রাখতে ভাবছে, এই বাড়িতে বেহালা ব্যতীত অন্য কোনো মেয়ে থাকে না। টিয়ামনি বাচ্চা মেয়ে, এখানে কাজ করে। এভাবে চ্যাঁচানোর সাহস হবে না। তাহলে এই কণ্ঠটা কার? একটা নাম মনে আসলেও সে পাত্তা দিচ্ছিল না। ভয় ও তটস্থ চিত্তে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল। সহসা নজরে এলো ড. আল হাদিকে। সে উল্টো চালে রুম থেকে বেরুচ্ছে। হাত দুটি মুখের সামনে দেয়ালের মতো করে ধরে আছে। স্বর্ণলতা কিছু বুঝে উঠার আগেই একটি ফুলদানি উড়ে এসে পড়ল তার পায়ের কাছে। তারপরে একে একে পানির জগ, গ্লাস, বালিশ এমন কি মোবাইলও উড়ে এসে পড়তে থাকল যত্রতত্র স্থানে। সেই সাথে মেয়ে গলায় কেউ সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। স্বর্ণলতা কাছে থাকায় কয়েকটা বাক্য বুঝে এলো। অনেকটা এমন,
” বউরে যদি আদরই করতে না পারবি তাহলে বিয়ে করলি কেন? বুইড়া, কাপুরুষ কোথাকার! তোর এই ন্যাতানো শরীর দিয়ে আমি কী করব? যা বের হ, এই ঘরে যেন তোরে না দেখি। কাঁচা গিলে খাব কিন্তু! ”
কথাগুলো বুঝে আসতে স্বর্ণলতা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। পরক্ষণে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে এলো দেহমন। কারও সাথে দেখা না করে পালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় হচ্ছিল তখনই ড. হাদির কণ্ঠটা ভেসে এলো,
” স্বর্ণা! তুমি এখানে কী করছ? ”
সে হকচকিয়ে গেল। এত অপ্রস্তুত হলো যে, ঠিক মতো তাকাতে পারল না। মুখে জবাবও দিতে পারল না। ঠিক এই সময়ে একটি হ্যাঙ্গার উড়ে এলো কাপড়সমেত। ড. হাদি প্রশ্নটা করে স্বর্ণলতার দিকে এগিয়ে এসেছিল। তাই হ্যাঙ্গারটিও এদিকে ছুটে আসছিল। সে বিপদ আঁচ করে হাত বাড়িয়ে লুফে নিয়ে ধমকাল,
” প্রীতুল! থামো এবার। অনেক হয়েছে। আমি মানা করছি কিন্তু। ”
এমন উঁচুস্বরে তাকে কথা বলতে শোনা যায় না কখনও। স্বর্ণলতাও শুনেনি। তাই ধমকটায় সেও কেঁপে ওঠল। সাথে সাখে জিনিসপত্র ছুঁড়ে মারার যে খেলাটা চলছিল সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। ড. হাদি স্বস্থির নিঃশ্বাস ছেড়ে সুধাল,
” তোমার লাগেনি তো! ”
সে মুখে জবাব দিতে পারল না। দেহটা কেমন গুটিয়ে আসছে! এই মানুষটা দিনে দিনে বড্ড অপরিচিত হয়ে ওঠছে! স্বর্ণলতা ধীরে দু’পাশে মাথা নাড়তে শুনল,
” কখন এসেছ? বেহালার সাথে দেখা হয়েছে? ও তো মাত্রই বের হলো। ”
এই প্রশ্নের উত্তরটা সে মুখ দিয়ে দিতে চাইল। সুযোগ হলো না। তার আগেই প্রীতুল রুম থেকে বেরিয়ে এলো। গটগটে পায়ে এদিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলছে,
” আদর-সোহাগের দেখা নেই, আবার ধমকানো হচ্ছে! এত সাহস কোথা থেকে এলো? আজই বাবার কাছে চলে যাব। তারপরে তার পছন্দের পাত্রের মুখ উন্মোচন করব। গ্রামে গ্রামে যে এত সুনাম কামিয়েছিস, সেটা কীভাবে নষ্ট করতে…”
স্বর্ণলতা নজরে আসতে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো। পর্যবেক্ষকের ন্যায় চেয়ে থেকে আচমকা বলল,
” তুই স্বর্ণলতা না? ক্লাসের সব থেকে ভালো ছাত্রী? ”
প্রীতুল উত্তরের অপেক্ষাও করল না। নিজের স্বামীর দিকে ফিরে বলল,
” সাহসটা তাহলে প্রেমিকাকে দেখে হলো? বাহ! খুব ভালো। বোন নেই, অমনি প্রেমিকাকে ডেকে নিয়ে চলে এলে? রুম তো ফাঁকায়। যাও, দরজা আটকে ঘেঁষাঘেঁষি করো। অবশ্য দরজা না আটকালেও সমস্যা নেই। আমি তো ভুল করেও উঁকি মেরে দেখব না। দেখে কী লাভ! তোমার সাথে তো আমার কিছু হবে না। এই চললাম, বাড়ি গিয়ে আমি ডিভোর্স লেটারটা পাঠিয়ে দিব। ”
সে সত্যি সত্যি চলে যাওয়ার ভান ধরল। ড. হাদি এই নিয়ে মুখে কিছু বলল না। শারীরিকভাবে আটকানোরও চেষ্টা করল না। স্বর্ণলতা এত অবাক হলো! না পেরে সে নিজেই প্রীতুলের হাত ধরে বলল,
” তুমি ভুল বুঝতাছ, প্রীতুলবু। আমারে উনি ডাকে নাই। ”
” নিজে থেকেই আসছ? তোমার চরিত্র যে এত খারাপ জানতাম না তো! তোমার না মহাজনের সাথে বিয়ে হয়েছে? দেখতে তো ভালোই। শরীরেও খুব জোর। তারপরেও তোমার হয় না? আমার জামাই…”
সে কথা শেষ করতে পারল না। ড. হাদি জোর করে হাত ধরে টেনে দূরে এনে বলল,
” সাবধানে কথা বলো। স্বর্ণাকে এসব বলার মতো যোগ্যতাও তোমার নেই। ”
প্রীতুল বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রইল। একের পর এক বোম ফাটছে যেন! এই মানুষটার হুট করে হলো কী? বিয়ের পর থেকেই সে ঝগড়া করে আসছে। একপাক্ষিক ঝগড়া। ড. হাদি অংশ নেয়নি কখনও। সে মুখ বুঁজে বরাবরই সহ্য করে এসেছে। এবারই বিপরীত হলো। মানুষটা শুধু মুখ খুলেছে তাই নয়। তাকে ধমকাচ্ছে, হেয় করছে। তার যেমন কষ্ট হলো তেমন রাগও। ড. হাদি স্ত্রীকে ধরে থেকে স্বর্ণলতার উদ্দেশ্যে বলল,
” এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও। বেহালাকে বলে দিব, তুমি এসেছিলে। ”
সে দূর হতে ভারি অবুঝ গলায় বলল,
” আমি তো আপনার সাথে দেখা করতে আসছি। ”
প্রীতুলের ধৈর্যশক্তি এখানে ধ্বসে পড়ল। স্বামীর হাত থেকে জোর করে ছুটে এসে বলল,
” কেন রে? প্রেম করে মন ভরেনি তোর? আদর-সোহাগ কম পড়ে গেছিল যে, ফাটল ধরার পড়েও আবার এখানে এসেছিস। তোর শরীরে এত জ্বালা? ”
সে একটু দম নিতে চেয়েছিল, পারল না। ঝড়ের গতিতে পাহাড়ের মতো ভারি থাপ্প ড়টা এসে পড়ল ডান গালে। প্রীতুল সয়তে পারল না। টাল হারিয়ে পড়ে গেল। স্বর্ণলতার পিলে চমকে ওঠল। ভ য় ও আতঙ্কে চোখ, মুখ নীল হয়ে ওঠল মুহূর্তে। পাথরের মতো জমে যাওয়া দেহটা দ্রুত টেনে নিয়ে গেল ভূপতিতার নিকটে। দু’পাশে হাত মেলে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করল,
” আল্লাহ! কী করলেন এটা? দূরে গিয়া দাঁড়ান। যান, বলতাছি। ”
মুনছুর সাখাওয়াত দূরে সরল না। দুর্দমনীয় রাগে ফোঁস ফোঁস করছে! মারমুখো হয়ে আছে এখনও। চোখের দিকে তাকালেই আত্মা শুকিয়ে আসে। স্বর্ণলতা স্বামীর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল ড. হাদির দিকে। সে ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে আছে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একভাবে চেয়ে আছে মেঝেতে পড়ে থাকা স্ত্রীর দিকে। স্বর্ণলতা ভীষণ অধৈর্য ও বিরক্ত স্বরে বলল,
” আরে! পাথর হইয়া গেলেন নাকি? আপনার বউ রে সরান। জলদি। দেখতাছেন না, পাগল ক্ষ্যাইপা গেছে? ”
কথাটা শেষ করে সে স্বামীর দিকে অগ্রসর হলো। হাত বাড়িয়ে মুখ স্পর্শ করে বলল,
” আমার এখানে আসা ঠিক হয় নাই। আমি নিজের ভুল বুঝতে পারছি। এজন্যই মুরুব্বিরা বলে, স্বামীর অমান্য হইতে হয় না। মাফ কইরা দেন। চলেন এখান থেইক্যা। ”
” তোমার ভুল হবে কেন? তুমি কেন এসেছ, আমি জানি না। কিন্তু খারাপ উদ্দেশ্যে যে আসোনি এই ব্যাপারে তো নিশ্চিত। এখন প্রমাণ দেও। নাহলে কিন্তু পাগল আবারও ক্ষ্যাপবে। এবার কেউ সামলাতে পারবে না, তুমিও না। ”
স্বর্ণলতা এক মুহূর্তও দেরি করল না। ড. হাদির দিকে ফিরে চটজলদিতে বলল,
” আপনারে একদিন বলছিলাম না, আমার স্বপ্ন ভাঙে নাই তাই দুঃখও নাই? আজ সেটায় দেখাইতে আসছিলাম। আমি ঢাকা যাইতাছি, সেইখানে থাইক্যা পড়মু। উনি আমারে পড়াইবো। আমার হাত দিয়া পায়ের শিকলও খুলতে হয় নাই। উনি নিজে থেইক্যা খুইল্যা দিছে। উল্টা আমি স্বপ্ন ভাঙতে চাইছিলাম, উনি ভাঙতে দেয় নাই। আমারে সাথে কইরা ঢাকা নিয়া যাইতাছে। ”
ড. হাদির বুঝতে বাকি রইল না এই ‘ উনি ‘ শব্দটি দিয়ে যে, মহাজনকে বুঝাচ্ছে। সে শুকনো হাসল। দু’চোখ ভরে দেখল স্বর্ণলতার উপচে পড়া খুশি, উচ্ছ্বাস। গর্বের তাপটাও অনুভব করছে এই চোখ দিয়েই।
যে মানুষটাকে নিয়ে প্রশংসা করছে, গর্বের বাক্য আওড়াচ্ছে সেই মানুষটা সামনে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ভালো-মন্দ কোনো অনুভূতিই গ্রাস করতে পারল না। তার চোখ বিঁধে আছে ড. হাদির দিকে। এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছে? তার বউয়ের রূপসৌন্দর্য্য কি চোখ দিয়ে গিলে খাবে? না জানি মনে মনে কী কামনা করছে! সে দ্রুত হস্তে স্বর্ণলতার নিকাবটা তুলে দিয়ে বলল,
” মুখটা ঢেকেও তো কথা বলা যায়, স্বর্ণলতা। আমার সামনে আমার বউকে অন্য কেউ দেখছে। এসব দেখেও আমি শান্ত থাকি কী করে, বলো তো! ”
ড. হাদির হাসি চওড়া হলো। দৃষ্টি নামিয়ে বলল,
” আপনার বউকে নিয়ে যান। আমার মনে হয়, ওর কাজ শেষ। ”
সে এতক্ষণে নিজের স্ত্রীকে মেঝে থেকে তুলল। একহাতে শক্ত করে দেহটা জড়িয়ে থেকে ফিসফিসে বলল,
” যে থা প্পড়টা আমার দেওয়া উচিত ছিল সেটা অন্য কেউ দিয়েছে, আমি চুপচাপ দেখেছি। এটা সত্যি কাপুরুষতার লক্ষণ। এই কারণ দেখিয়ে তুমি বাবার বাড়ি যেতে পার। আমি আগে আটকাইনি, এখনও আটকাব না। কিন্তু দয়া করে ঐ মেয়েটিকে নিয়ে কিছু বলবে না। ও আমার প্রেমিকা হবে তো দূর আমার মনের মধ্যে কী চলছিল সেটাও আঁচ করতে পারেনি। তোমাকে আমি ভালোবাসি না, তাই স্পর্শ করছি না। এর চেয়ে বড় কোনো কারণ নেই। ”
স্বর্ণলতা স্বামীর বাহুর বাঁধনে থেকে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সহসা পেছন ফিরে বলল,
” একদিন ফোনে যেই অধিকার দেখাইয়া আমারে ধ মক দিয়া বলেছিলেন, প্রীতুলবুর অতীত নিয়ে যেন কিছু না বলি। সেই অধিকারটা যদি আপনার বউয়ের উপরে দেখাইতেন তাহলেও এতদিনে আপনাগোর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক হইয়া যাইত। আপনি এমন এক আলোর দিকে তাকাইয়া আছেন, যা কখনই আপনারে ছুঁইতে আসবো না। এটা জানা সত্ত্বেও আপনি আপনার সবকিছু অন্ধকারে রাইখা দিছেন। এটা কিন্তু ভালো হইতাছে না। বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার কথাটা ভাইবা দেইখেন। ”
______
স্বর্ণলতারা ঢাকা পৌঁছাল সন্ধ্যার দিকে। শবনম বেগম তাদের আগমনের খবর জানতেন না। তারপরেও দ্রুত হস্তে যতটা পারলেন রুমটা গুছিয়ে দিলেন, রান্না বসালেন। মুনছুর সাখাওয়াতের অপেক্ষাটুকু সহ্য হলো না। সে রুম খালি পেয়ে দরজায় খিল টেনে বলল,
” খুব ক্লান্ত লাগছে, বউ। আসো ঘুমাই। ”
স্বর্ণলতা গোসলখানায়। মাত্রই ঢুকেছে। শরীরে পানি ঢালেনি তখনও। ভেতর থেকে চ্যাঁচিয়ে বলল,
” আমি না গোসলে ঢুকলাম? আপনি ঘুমান, আমি রান্না হইলে ডাক দিবোনে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত গোসলখানার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
” আমি একা ঘুমাব? তাহলে বউয়ের কাছে থেকে কী লাভ? গ্রামেই চলে যাচ্ছি। তুমি সারারাত ধরে গোসল করো। কত বছর গোসল করো না! তারপরে আরাম করে পেট ভরে খাও। কত বছর ধরে খাও না। তোমার জামাইয়ের এত অভাব যে, তোমাকে এক মুঠো ভাত খাওয়াতে পারেনি, গোসল করার জন্য এক মগ পানিও দিতে পারেনি। ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৭)
স্বর্ণলতা মুখে পানি ছেটাচ্ছিল স্বামীর বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠস্বর ও অভিমানে মাখা শীতল হুমকিতে থেমে যেতে বাধ্য হলো। তড়িঘড়িতে গোসলখানার দরজা খুলে দেখল, মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে এখনও। যায়নি কোথাও। সে স্বস্থির নিঃশ্বাস ছাড়ল পরক্ষণে কাছে এগিয়ে এসে সুধাল,
” আপনি এত পাগল কেন? নিজেই নিজেরে ছোট করতাছেন! ”
মুনছুর সাখাওয়াত প্রশ্নের জবাব দিল না। সে একভাবে চেয়ে দেখছে স্ত্রীকে। ভেজা মুখের সিক্ত চোখজোড়া আস্ত সমুদ্র বয়ে বেড়াচ্ছে যেন! যেমন গভীর, স্বচ্ছ তেমন অশান্ত, চঞ্চল। ঘনকালো মণিজোড়ায় ভেসে উঠা মায়াটুকু কার জন্যে? গোসল না সেরে এলোমেলো অবস্থায় ব্যস্তচালে ছুটে আসা কার জন্যে? সে বুঝি এতটায় গুরুত্বে চলে এসেছে? ভাবতেই বুকের ভেতরটা এত শীতল হয়ে উঠল যে, মনে হলো স্বর্ণলতার বয়ে বেড়ানো সমুদ্রে কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।
” আমারে গোসল করতে দিবেন না? তাইলে আগেই বলতেন। আমি তো আপনার সামনে দিয়াই গোসলখানায় ঢুকলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত এবারও প্রতুত্তরে নীরব থাকল। কিন্তু বুকের ভেতরের শান্তভাবটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মুহূর্তেই প্রচণ্ড অশান্তি ও অস্থিরতায় গ্রাস করে নিল দেহমন। স্বর্ণলতা কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ভেজা কচি ও তুলতুলে ঠোঁটদুটি দখলে নিয়ে নিল। দীর্ঘ চুম্বন শেষে হতভম্ব ও বেসামাল কিশোরী বউকে কোলে তুলে নিল। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে মুখের দিকে ঝুঁকে বলল,
” এই মুখটা আমার। ”
হাত দিয়ে স্পর্শ করতে করতে পুনরায় বলতে লাগল,
” এই সুন্দর কপাল, ভ্রূ, চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট, চিবুক সব..সবকিছু আমার। এখানে চেয়ে থাকারও একমাত্র অধিকার আমার, তাই না? স্বর্ণলতা, আমি ঠিক বলছি তো? ”
সে তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। মস্তিষ্ক কামড়ে ধরল অন্যকিছু। চোখের তারায় জ্বলে উঠল ড. হাদির মুখটা। সাথে সাথে নিজের ভুল ও বেখেয়ালের কর্মটাও মনে পড়ে গেল। চোখটা খিঁচে বন্ধ করে স্বর্ণলতা উত্তর দিল,
” হ্যাঁ। ”
” অন্যকেউ চেয়ে থাকার সুযোগ পাবে? ”
” না। ”
” ভুল করে যদি পেয়ে যায়? ”
” পাইবো না। ”
” কথা দিচ্ছ? ”
” দিলাম। ”
মুনছুর সাখাওয়াত মৃদু হাসল। ধীরে ধীরে মাথা নামিয়ে রাখল স্ত্রীর বুকে। চোখ বুঁজে বলল,
” ঘুমাও। ”
” এখন? এভাবে? ”
” হুম। কেন? কষ্ট হচ্ছে? ”
প্রশ্নদুটি ছুঁড়ে দিয়ে সে মাথা তুলে ফেলল। স্বর্ণলতার দিকে চেয়ে খানিক উৎকণ্ঠিত ও ব্যস্ত স্বরে সুধাল,
” আমার মাথাটা কি অনেক ভার? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
” আমি তো গোসলে গেছিলাম। কাপড় অনেকখানি ভিজ্যা গেছে। ধূলাবালিও লাইগা আছে। কতদূর থেইক্যা আসলাম! আপনার ঘুম আসবো না। ”
” তোমার আসবে তো? ”
” আমার তো ঘুম ধরে নাই। ”
” সেটা চোখ বুঁজলেই বুঝা যাবে। ”
মুনছুর সাখাওয়াত হাত দিয়ে তার চোখ বন্ধ করে দিল। অতঃপর পূর্বের মতো বুকে মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল। শরীরের ক্লান্তি, অবসন্ন, চোখের ঘুম সবই দমকা হাওয়ার তোড়ে উঠে গেল বহুদূর। সে হাজার চেষ্টাও করেও ধরে রাখতে পারল না, ফিরিয়েও আনতে পারল না। এই প্রচেষ্টার মধ্যে টের পেল, স্বর্ণলতা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। সে মাথাটা তুলে চেয়ে রইল তন্দ্রায় আচ্ছন্ন মুখটায়। ভীষণ অসহায় ও করুণ স্বরে ডাকল,
” স্বর্ণলতা? ”
সে সাথে সাথে নড়ল। মৃদু ও অস্পষ্টভাবে আওয়াজ করল,
” হুম। ”
” তুমি আমাকে ছাড়া কীভাবে থাকো? আমি তো পারি না! কত কষ্ট হয় জানো? বুকের ভেতরে ছটফটে ভাবটা এক মুহূর্তের জন্যও থামে না। মনে হয় আমি মাছ, কেউ বড়শি গেঁথে দিয়ে আমাকে সমানে টানছে। হাতের নাগালে পেলেই কেটে টুকরো টুকরো করে গরম তেলে ছেড়ে দিবে। আমি এই মহাবিপদ থেকে বাঁচার জন্য জলের মধ্যে ছটফট করে চলেছি। ছুটতে পারছি না আবার ধরা দিতেও পারছি না। সেধে কে মরতে চাই বলো? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের জবাব দেয় না। একের পর এক গভীর নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে। মুনছুর সাখাওয়াতের অসহায়ত্ব বাড়ে। ক্ষণকাল নীরব থেকে ঠোঁট ছোঁয়ায় স্ত্রীর মসৃণ কপালে। এই মেয়েটি যখন তাকে ভালোবাসেনি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি তখনই সে দূরে থাকলে মৃত্যু যন্ত্রণা টের পেত, নিজেকে সামলে উঠতে পারত না। এখন তো ভালোবাসে। এটা জানার পরেও সে একা রেখে যাবে কীভাবে? মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও বড় কোনো যন্ত্রণা কি আছে এই পৃথিবাতে? সেটার দেখায় কি পেতে চলেছে?
______
স্বর্ণলতার ঘুম ভাঙল বেশ দেরি করে। আড়মোড়া ভাঙার সময় বুঝতে পারল, পা দুটিতে কিছু একটা প্যাঁচিয়ে আছে। সে ভয়ে ভয়ে পিটপিটে চাইতে আশ্চর্য হলো। মুনছুর সাখাওয়াত তার পায়ের কাছে শুয়ে আছে। পা’দুটি দুহাতে শক্ত করে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষটার ঘুম নষ্ট করতে চাইল না। আজকাল বড় মায়া লাগে! মুগ্ধতাও ভর করতে চায় চোখদুটিতে। এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনের কারণ কী? সে ভাবতে ভাবতে পুলকিত হয় কিন্তু ঠিকঠাক উত্তর পায় না।
স্বর্ণলতা আস্তেধীরে ভীষণ সাবধানে পা দুটো টেনে ছাড়িয়ে নিতে চাইল, পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত আরও শক্ত করে চেপে ধরল। চোখ বুঁজে থেকে ভার কণ্ঠে আবদারের মতো বলল,
” আরেকটু ঘুমাতে দাও না! ”
” আচ্ছা, ঘুমান। কিন্তু ওইখানে কেন? উপরে উইঠা আসেন। ”
” না। ”
” তাইলে পা ছাড়েন, আমি নিচে আসতাছি। ”
” না। ”
সে দৃঢ় স্বরে উত্তরটা দিয়ে মাথা রাখল পায়ের ওপরে। অতঃপর বউয়ের দিকে ফিরে ভীষণ তৃপ্তির সাথে বলল,
” আমি এখন থেকে এভাবেই ঘুমাব। তোমার পা আমার মাথার নিচের বালিশ। ”
স্বর্ণলতা ঝটিতে সবলে পা’জোড়া টেনে নিল। শোয়া থেকে উঠে বসল ব্যস্তসমস্তে। মাথাটায় হাত ছুঁয়ে সালাম করতে করতে বলল,
” আপনি এত পাগল কেন? আল্লাহ! পায়ের উপরে কেউ মাথা রাখে? আমার তো পাপ হইয়া গেল! দাদিজান জানতে পারলে আমারে আস্ত রাখবো না। ”
পাপ-পুণ্য নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তাই এই দিকটাকে এড়িয়ে গিয়ে সুধাল,
” দাদিজানকে জানাবে কে? তুমি? ”
স্বর্ণলতা ভাবল মানুষটা হয়তো ঘাবড়ে গিয়েছে। এই দুনিয়ায় অভিভাবক বলতে ঐ একজনই তো। আদর, শাসন দুটোই করতে পারে। সে ভয় দেখাতে বলল,
” আমার মানা না শুনলে তো বলমুই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় শুয়ে ছিল প্রস্থবরাবর। চিত হয়ে, মাথাটা শুধু কাত করে রাখা স্ত্রীর দিকে। এবার উপুড় হলো। স্বর্ণলতার গুটিয়ে রাখা পা দুটো টেনে নিয়ে অতর্কিতে এলোপাতাড়ি চুমু খেয়ে বলল,
” পায়ে যে চুমু খেয়েছি এটাও বলো। ”
সে প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ। বিস্ময়ে চক্ষুদ্বয় ফেটে পড়ার মতো অবস্থা হয়ে আছে। এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা ইহকালে ঘটেছে বলে শুনেনিও হয়তো। স্বামী আদর করে চুমু খায়, তাই বলে পায়েও খাবে? সে ছোটবেলা থেকে জেনেছে, কারও শরীরে পা লাগাতে নেই। ভুলবশত লেগে গেলেও সালাম করতে হয়। আর এই লোক তো সেধে এসে ঠোঁট লাগাচ্ছে। চোখ, মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই কাজ করতে পেরে সে মহাখুশি, বিশ্বজয় করে ফেলেছে!
মুনছুর সাখাওয়াত ঠোঁট চেপে হেসে পুনরায় বলল,
” যদি জিজ্ঞেস করে কয়টা চুমু খেয়েছি। তাহলে বলবে একশটা। ঠিক আছে? ”
” মিথ্যা শিখান কেন? পঞ্চাশটাও তো খাননি। ”
” তাহলে সত্যি করে দিই। ”
সে পায়ের দিকে এগিয়ে আসতে স্বর্ণলতা বিছানা থেকে নেমে পড়ল একলাফে। কয়েক কদম দূরে সরে গিয়ে বলল,
” হাত-মুখ ধুইয়া আসেন। ভাত দিতাছি। ”
______
ড্রয়িং রুমে খাবার টেবিল ও চারটে চেয়ার সাজানো। সেখানে ভাত, তরকারি রাখা। স্বর্ণলতার নতুন করে বাড়তে হলো না। মায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তোমরা খাইছ? ”
” ওরা খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ছে। আমি খাই নাই এহনও। তোরা না খাইলে আমি খাই ক্যামনে? ”
” অনেক রাত হয়ছে তো, আম্মা। তুমি খাইয়া শুইয়া পড়ো। আমি উনারে নিয়া খাইতাছি। ”
শবনম বেগম মাথা নাড়েন। নিজের জন্য প্লেটে ভাত, তরকারি বেড়ে রুমের দিকে অগ্রসর হতে স্বর্ণলতা ডাকল,
” এখানেই বসো। উনারে রুমের ভিতরে খাইতে দিমু। ”
” ক্যান? ”
সে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। মানুষটা যে যার-তার হাতের রান্না খায় না! এখন অবশ্য একটু বদলেছে। তবুও যদি না খায়? আম্মা কত কষ্ট করে একহাতে এত আয়োজন করল! প্রকাশ না করলেও মনে মনে ঠিকই কষ্ট পাবে। স্বর্ণলতা চাচ্ছিল না কষ্ট দিতে, তাই নীরবে দুজনের খাবার বেড়ে নিয়ে গেল রুমে। একে একে বিছানায় সাজিয়ে রাখল। মুনছুর সাখাওয়াত বিছানায় আসন পেতে বসে আছে। মাঝে কোনো কথা বলেনি, এখনও বলছে না। একস্থির চেয়ে আছে ভাতের প্লেটটায়। মনের ভেতরে যে কী চলছে স্বর্ণলতা বুঝে গেল হাবভাবেই। অভিযোগের মতো বলল,
” আমারে তো রান্না শেখার সুযোগ দেন নাই। টুকটাক যা পারি সেটাও করতে পারলাম না আপনার জন্য। জোর কইরা ঘুম পাড়াইয়া রাখছেন। এখন আম্মার হাতের রান্নাই খাইতে হইবো। কষ্ট কইরা খাইয়া নেন, আমার আম্মার কাজকাম কিন্তু পরিষ্কার আছে। রান্নাও মজা হয়। ”
তার এই প্রশংসাতেও কাজ হলো না। মুনছুর সাখাওয়াতের তাকানোর ধরণ, মুখভঙ্গি কিছুই বদলাল না। স্বর্ণলতা যেমন হতাশ হলো তেমন বিরক্তও। খানিক মনখারাপ এসেও ভর করল আঁখিকোণে। তার আম্মাকে এখনও পর করে দেখছে! সে দীর্ঘশ্বাস টেনে কাঠ স্বরে বলল,
” চাইয়া থাইকাই পেট ভরেন। আমি খাইয়া ভরি। ”
সে সত্যি সত্যি ভাত মাখল। নলা বানিয়ে মুখে তুলবে তখনই মুনছুর সাখাওয়াত তার হাত ধরে ফেলল। সে চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল,
” আমারেও খাইতে দিবেন না? ”
সে জবাব দিল না। মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে স্বর্ণলতার হাতের জমানো খাবারটুকু খেয়ে নিয়ে বলল,
” তুমি খায়িয়ে দিলে আমারও পেট ভরবে। ”
সে এই নিয়ে দ্বিমত করল না। খেতে রাজি হয়েছে এই ঢের! কার হাত দিয়ে খাচ্ছে এটা দেখে কাজ নেই। স্বর্ণলতা খাওয়ানো শেষে সুধাল,
” আমি তো তেমন কিছু রান্না করতে পারি না। আপনিও নিশ্চয় এখানে রান্না কইরা খাইবেন না? এখন কি পোলাপানের মতো আপনারে তিনবেলা আমার খাওয়াই দিতে হইবো? ”
” উহু, দুইবেলা। আমি কাল বিকালেই গ্রামে ফেরত যাচ্ছি। ”
” ফেরত যাইতাছেন মানে কী? আমারে কলেজে ভর্তি কইরা দিয়া যাবেন না? ”
” ওটা তো ইকবালের কাজ। ”
স্বর্ণলতার মুখে মেঘ জমল। চোখদুটিও টলমল হয়ে ওঠল নিমিষে। সে ভেবেছিল, মুনছুর সাখাওয়াত এখানে থেকে যাবে। আগের মতো তার দেখভাল করবে। প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সবকিছু নিজে থেকে বুঝে নেবে। সেরকম কিছু হচ্ছে না। উল্টো তাকে রেখে চলে যাচ্ছে। একটা সপ্তাহ তো থেকে যেতে পারত! নিজের স্বপ্ন ফেলে ছুটে গিয়ে কী লাভ হলো? ভালোবাসে এটা প্রমাণ করল বলেই বুঝি এত গুরুত্বহীন হয়ে গেল? হেলায় ফেলে দিচ্ছে? ঠিকভাবে আদরও করল না। পায়ে মাথা রেখে, ঠোঁট ছুঁয়িয়ে আরও পাপ বাড়িয়ে দিল।
_______
বিকেলের দিকে মুনছুর সাখাওয়াত তৈরি হতে লাগল। স্বর্ণলতা চুপচাপ, মুখ ভার করে তার তৈরি হওয়া দেখছে। এই যে সারাদিন সে মনখারাপ করে থাকল, অভিমানে চোখ ভেজাল এসবের কিছুই চোখে পড়ল না মানুষটার? স্বর্ণলতা চেয়েছে মানুষটার মধ্যে পরিবর্তন আসুক কিন্তু সেই পরিবর্তন যে তার প্রতি আগ্রহটাকে কমিয়ে দিবে, ভালোবাসাটাকে হালকা করে দিবে এটা তো বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারলে কী হতো? পরিবর্তন চাইত না? স্বর্ণলতা ভাবনার মধ্যে ভীষণ উদাস ও বেখেয়াল হয়ে পড়ল। টেরই পেল না মুনছুর সাখাওয়াত যে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
আচমকা ভাবনাচ্ছেদ ঘটতে দেখল, রুমটা শূণ্য। জনমানবের চিহ্ন নেই। তার ব্যক্তিগত, একান্ত আপন পুরুষটা কি না বলে চলে গেল? সে দৌড়ে রুম থেকে বের হলো। ড্রয়িংরুমটায় পৌঁছাতে কণ্ঠটা পেল। পাশের রুম থেকে আসছে। সেদিকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিতে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে নজরে পেল। খাটে বসে আছে। বাবার পাশে। নিচু স্বরে কী যেন বলছে। সহসায় চোখটা এদিকে চলে এলো। চোখাচোখি হতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” স্বর্ণলতা, রুমে যাও। ”
সে আরও কাছে এগিয়ে গেল। দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” দেখছ তো কথা বলছি। ”
” তো? আমি শুনলে সমস্যা? আব্বার সাথে কী এমন গোপন কথা আছে যে, আমি শুনতে পারমু না! ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে নিশ্চুপ থাকলেও চোখ সরাল না। তার কোনো গোপন কথা নেই। সে এসেছিল স্বর্ণলতার বাবার খোঁজ নিতে। এই মানুষটার সুস্থ হওয়া দরকার। বউটা এখানে থেকে পড়বে, ঘরের মধ্যে সুস্থ পুরুষ মানুষ না থাকলে হয়? ইকবালকে দিয়ে কতদিক সামলাবে? তার বয়সও খুব বেশি না। তন্মধ্যে শীঘ্রই পড়াশুনা শুরু করে দিবে। সব থেকে বড় সমস্যাটা হলো সে পরিবারের কেউ না। মন-মতলব কখন, কোন দিকে চলে যায়! এই খোঁজটা সে স্বর্ণলতার আড়ালে নিতে চেয়েছিল, নিজের মতো করে কথা বলবে তাই। শবনম বেগমকে সে কিছুতেই আপনি করে বলতে পারছে না আবার তুমি করে বলবে না কখনও। ওই সম্বোধনটা শুধু আপনজনদের জন্য। এখন স্বর্ণলতার সামনে তুই করে কীভাবে বলবে? সে চট করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। ঠিক এই সময়ে স্বর্ণলতার খেয়াল হলো গ্রামের সবচেয়ে ক্ষমতাসীন, নির্দয়, স্বার্থপর, অর্থলোভী, উগ্র, বদমেজাজী, মহাজন পদবি পাওয়া মানুষটা এতক্ষণ তার অসুস্থ আব্বার সাথে শান্তভাবে কথা বলছিল। পুরাতন, ব্যবহৃত, আচরিত বিছানা চাদরটায় বসা ছিল। মানুষটার জীবনে এই অসম্ভাবনীয় ঘটনাটাও ঘটে গেল?
মুনছুর সাখাওয়াত হেঁটে এসে দাঁড়াল স্ত্রীর পাশে। অতঃপর বলল,
” তুমি কি রুমে যাবে না? আমি বের হব এখন। ”
” রুমে গিয়ে কী করমু? চলেন, আপনারে আগাইয়া দিই। ”
সে ধপ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভ্রূজোড়া সংকুচিত করে ছোট ছোট দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,
” আমি বের হওয়ার সময়ে যে তোমার রুমের বাইরে আসা বারণ, কথাটা কি ভুলে গেছ? ”
স্বর্ণলতা কথাটা সত্যি ভুলে গেছিল। এখন মনে পড়তে সে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে তার বুক ভেঙে কান্না চলে এলো। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ পাষণ্ড! পাষণ্ড! পাষণ্ড! ‘
এই সময়ে রুমের দরজায় সিটকানি লাগানোর শব্দ হলো। স্বর্ণলতা চমকে ফিরতে দেখল মুনছুর সাখাওয়াত। পাষণ্ডটা ফিরে এলো কেন? কিছু কি রয়ে গিয়েছে? সে তো ঠিকমতো গুছিয়েও দেয়নি! অবশ্য গুছিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনিও কখনও। মানুষটা তো সেই শুরুর দিকে বলে দিয়েছিল, তার কোনো গোছগাছ লাগে না। ব্যাগপত্রও বয়ে বেড়ায় না। কিছুর প্রয়োজন পড়লে কিনে নেয়। স্বর্ণলতার আপন ভাবনা কাটল উষ্ণ স্পর্শে, এলোমেলো আদরে। এই অপ্রত্যাশিত, অসংযত, গভীর স্পর্শে সে প্রায় ডুবেই গিয়েছিল ঠিক তখনই মুনছুর সাখাওয়াত দাঁত বসিয়ে দিল তার নরম, কোমল কাঁধে। স্বর্ণলতার অনুভূতির সাগর একেবারে শুকিয়ে গেল। স্বামীকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসল। চোখভর্তি পানি নিয়ে ফুঁসে ওঠল,
” কামড়ালেন কেন? কী ভুলটা করলাম? আপনার কথামতো রুমে চইল্যা আসি নাই? ”
মুনছুর সাখাওয়াত তৎক্ষনাৎ জবাব দিল না। কামড় দেওয়া স্থানটা দেখে রয়েসয়ে বলল,
” আমার চিহ্ন রেখে যাচ্ছি। ”
স্বর্ণলতা তার এই কথাটার অর্থ ধরতে পারল না। ধরার চেষ্টাও করল না। সে চলে গেল আগের সময়ে, আগের কথায়। বলল,
” নিজের ইচ্ছাটা পূরণ কইরাই ছাড়লেন? রাক্ষস একটা। আপনি মানুষ না, জন্তু হইয়া জন্মানো দরকার ছিল। ”
মুনছুর সাখাওয়াত বিছানা থেকে নেমে পড়ল। নিজের পাঞ্জাবি টেনে ঠিক করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
” কোন জন্তুটা হলে বেশি মানাত? ”
স্বর্ণলতা এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মানুষটা তাকে কামড়েছে। সেচ্ছায়, সজ্ঞানে এমন ধারাল ব্যথা দিয়েছে। মুনছুর সাখাওয়াত তার প্রিয় ও প্রার্থিত স্থানে আরও একবার চুম্বন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
_______
ইকবাল ও স্বর্ণলতার একই কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা। সেইরকম কার্যক্রমও সম্পন্ন হয়েছিল। সহসা স্বর্ণলতা মত বদলে ফেলল। অনুরোধের মতো বলল,
” ইকবাল ভাই, আমি মহিলা কলেজে পড়তে চাই। ”
” ওটার পড়াশোনা ভালো না। ঠিকমতো ক্লাস হয় না। আমি এদিকের সব কলেজেরই খোঁজ-খবর নিয়েছি। ”
” তাহলে তো আরও ভালো। রোজ কলেজে যাইতে হইবো না। আমি বাসায় পড়ে নিব। আপনিও তো আছেন। আমাকে একটু গাইড করলেই ভালো রেজাল্ট করতে পারব। ”
এই প্রস্তাবটা ইকবাল ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। স্বর্ণলতা তার চেয়েও দ্বিগুণ মেধাবী। একসাথে পড়লে সে যে পিছিয়ে যাবে এই ব্যাপারেও নিশ্চিত। একজন ছেলে ও সহপাঠী হিসেবে এটা তার জন্য লজ্জাজনক। এই লজ্জা ঠেলেও সে চাচ্ছিল, স্বর্ণলতা ভালো কলেজে পড়ুক। মেধা ঠিকমতো কাজে লাগুক। কিন্তু তার জেদের সাথে পেরে উঠল না। বাধ্য হয়ে মহিলা কলেজেই তাকে ভর্তি করে দিল।
_______
মুনছুর সাখাওয়াত বউকে মোবাইল কিনে দিয়েছে। কিন্তু সেই মোবাইলের কল ধরে না। এদিকে স্বর্ণলতার কলেজের ক্লাস শুরু হবে। তার বড় সাধ হলো প্রথমদিন স্বামীর সাথে যাবে। এই আবদারটা সে করতেও পারছে না।
শবনম বেগম ড্রেসিং টেবিলের একটা ড্রয়ার খুলে বললেন,
” এইটা তো সাজের জিনিস দিয়া ভরা। তুই তো একদিনও খুইল্যা দেখলি না, মা। এমনে পইড়া পইড়া নষ্ট হইতাছে। কাল একটু সাইজা যাইস। পরথম দিন, একটু সুন্দর হইয়া না গেলে অয়? কত মাইনসের লগে পরিচয় হইবো! ”
স্বর্ণলতা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। সমানে কল করে যাচ্ছে নিজের স্বামীকে। বাড়িতে আসছে না, কলও ধরছে না। সমস্যা কী? যদি কল না ধরবে তাহলে মোবাইল কিনে দিল কেন? এটা দিয়ে সে করবেটা কী? দাদিজানের নাম্বারটাও জানে না! সে ব্যস্তভাবে মায়ের কথার বিপরীতে বলল,
” উনার এসব সাজগোজ পছন্দ না। ”
” কার? মহাজনের? উনি কি তোর কলেজে থাকবো নাকি? ”
স্বর্ণলতা ভারি বিরক্ত হলো। মোবাইল ফেলে উঠে গিয়ে ড্রয়ারসুদ্ধ সকল কসমেটিকস ময়লার ড্রামে ফেলে দিয়ে এসে বলল,
” উনি গেছে কতদিন হইলো হিসেব আছে? এরমধ্যে একদিনও যোগাযোগ করে নাই। কোনো দুর্ঘটনায় ঘটল নাকি! আম্মা, আমার কিছু ভালো লাগতাছে না। ”
শবনম বেগম মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
” শান্ত হ। উনি তো মেলা ব্যস্ত মানুষ। ফিরি হইলেই যোগাযোগ করবো। তোরে কত ভালোবাসে! ”
” ছাই বাসে! এজন্যই আমারে কষ্ট দিতে পারতাছে। এই জ্বালা থেইক্যা বাঁচতে আমি চইল্যা গেছিলাম। কিন্তু রাখল না! জোর কইরা দিয়া গেল। আমার কাছে যা চাওয়ার ছিল তা মনে হয় পাইয়া গেছে। তাই আর আগের মতো টান নাই। ”
কথাটা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। শবনম বেগম মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
” এখন তো আমারও চিন্তা হইতাছে রে, মা। মহাজনের খোঁজ পাওয়ার আর কোনো উপায় নাই? ইকবাল কী কয়? ”
স্বর্ণলতা উপায় পেয়ে গেল যেন! তার কাছেও তো মোবাইল আছে। মুনছুর সাখাওয়াত ও স্বর্ণলতার মাঝে ব্রিজের মতো কাজ করছে এই ইকবালই। সে তখনই ছুটে গেল নিচে। ইকবাল রুমে ছিল। দরজা মেলে দাঁড়াতে স্বর্ণলতা হুকুম দিল,
” উনারে কল দেন। এখনই। ”
তার এই কণ্ঠ, তাকানোর ভঙ্গি দেখে বুঝে গেল কিছু একটা হয়েছে। ভিন্ন আচরণ করা যাবে না। ইকবাল রুমের ভেতরে ফিরে গেল। শিখানে থাকা মোবাইলটা তুলে কল দিল
স্বর্ণলতা দরজা থেকে দেখছিল। নীরবে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করছিল। যখনই দেখল, ইকবাল ফোনটা কানে নিয়েছে তখনই তার ধৈর্য ভেঙে গেল। সে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ইকবালের থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিজের কানে নিতে কাঙ্ক্ষিত কণ্ঠস্বরটা পেল,
” ইকবাল, বল। ”
” আমি স্বর্ণলতা। ”
ঐপাশটা এক মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে পুনরায় বেজে ওঠল,
” এই ফোন তোমার কাছে গেল কীভাবে? ”
” আগে বলেন আপনি আমার কল ধরতাছেন না কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত এই প্রশ্নের জবাব দিল না। জিজ্ঞেস করল,
” স্বর্ণলতা তুমি কোথায়? ”
” বাসায়। ”
” কোন রুমে? ”
” ইকবাল ভাইয়ের রুমে। ”
” ইকবাল কোথায়? ”
স্বর্ণলতা রুমে চোখ বুলিয়ে বলল,
” উনার খাটে। ”
” কী করছে? ”
” কিছু না। ”
” তোমার দিকে চেয়ে আছে? ”
সে ইকবালের দিকে তাকাল। সাথে সাথে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার দিকেই চেয়ে আছে! ফোনের ওপাশ থেকে অধৈর্য কণ্ঠটা আবারও প্রশ্ন করল,
” স্বর্ণলতা, তোমার মুখ খোলা? নিকাব পরোনি? ”
চলবে
#মরুর_বুকে_পুষ্পপরাগ
পর্ব (৭৮)
” স্বর্ণলতা, তোমার মুখ খোলা? নিকাব পরোনি? ”
প্রশ্নটা তাকে আরও দিশাহারা করে তুলল। বিধ্বস্ত হয়ে উঠল চোখ-মুখ। যন্ত্রের মতো একটা হাত মুখে স্পর্শ করামাত্র বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠল। বরফে রূপান্তর হতে লাগল ছোট্ট কোমল কিশোরী দেহটা। এতটা পাগল, বেখাল হলো কী করে? সে শুধু নিকাবই পরেনি এমন নয়, মাথায় ঘোমটা’টাও টানেনি পর্যন্ত। ওড়নাটা কোনো রকমে গলায় ও বুকে জড়ানো। বিয়ের পরে এত খোলামেলা ও নির্লজ্জ সাজে স্বর্ণলতা নিজের রুম থেকে বের হয়নি কখনও। অথচ আজ! দো’তলা থেকে নিচতলায় নেমে এসেছে। পরপুরুষের রুমে ঢুকে তার সামনে বেহায়ার মতো কেমন দাঁড়িয়ে আছে!
ফোনের ওপাশ থেকে মেঘমন্দ্র কণ্ঠটা পুনরায় বাজল,
” স্বর্ণলতা? উত্তর দাও। ”
হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বরটা আচমকায় ফিরে পেল যেন! কড়াই থেকে গরম তেল ছিটকে পড়ার মতো কণ্ঠনালী থেকে শব্দটাও ছিটকে পড়ল,
” না। ”
” কোনটার উত্তর দিলে? প্রশ্ন তো দুটো করেছি। ”
স্বর্ণলতা কল কেটে দিল। প্রশ্নের সাথে উত্তরটা মিলিয়ে দেওয়ার চেয়েও এই কাজটায় অধিক সহজ ও নিরাপদ বোধ হলো। মোবাইলটা ইকবালের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার ধৈর্যও হলো না। সে দূর হতে বিছানায় ছুঁড়ে মেরে ঝড়ের গতিতে পলায়ন করল। দো’তলা উঠতেও পারল না। শবনম বেগম উপর থেকে নেমে এলেন। সিঁড়ির মাঝে দেখা হলো মা ও মেয়ের। তিনি বড় বড় শ্বাস টানতে টানতে বললেন,
” কই গেছিলি? তোর মোবাইল বাজতাছে তো! মনে অয় মহাজনই কল দিছে। ”
তার চোখে, মুখে দারুন উত্তেজনা। আনন্দের দ্যুতি উপচে পড়ছে যেন! নিজ থেকে কল করেছে, সুস্থই থাকবে হয়তো। মেয়েটা কতটা বুঝে তিনি জানেন না, কিন্তু মহাজন যে শুরু থেকেই স্বর্ণলতাকে পাগলের মতো ভালোবেসে আসছে বুঝতে পেরেছিলেন। বিশ্বাসযোগ্য লাগত না তার হিংস্রাত্মক মনোভাব ও আক্রমণাত্মক চালচলনের জন্য। সময়ে সময়ে সেটাও বদলে গিয়েছে হয়তো। এখন ঠমক বজায় রেখে ধারাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও কণ্ঠটা হয় নিস্তেজ, শান্ত। স্বর্ণলতার খুশি, সুখ, স্বপ্ন নিয়ে যে আশঙ্কা ছিল সেটা পুরোপুরি দূর হয়ে গিয়েছে।
স্বর্ণলতা মায়ের মতো খুশি হতে পারল না। অবহেলা ভঙ্গিতে উপরে উঠে আসল। রুমে ঢুকতে টের পেল তার হাত-পা কাঁপছে। নিঃশ্বাস ও হৃদস্পন্দনের গতিও অস্বাভাবিক। দেহাভ্যন্তের কোনো যন্ত্রাংশই স্বাভাবিক নেই। সকল কার্যক্রম প্রায় স্থগিত! সে নিজের ফোনটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখারও সাহস করতে পারল না। এই কলটা মুনছুর সাখাওয়াতেরই, যার কাছে করা প্রতিজ্ঞাটা সে ভেঙে ফেলেছে। সাথে সাথে ধরাও পড়েছে। এখন কী হবে? ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে, এই ব্যাপারে সে সুনিশ্চিত। কিন্তু কার সাথে ঘটবে এই নিয়ে একটু দ্বিধাদ্বন্দে আছে। যদিও সে এই এক বছরে বুঝে গিয়েছে, ভুল বা অন্যায় যাই করুক না কেন শাস্তি পায় অন্যকেউ।
এরমধ্যে শবনম বেগমের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। মহাজনের কল ধরার জন্য তাগাদা দিতে স্বর্ণলতা ভীষণ ক্লান্ত ও নিস্তেজ কণ্ঠে বলল,
” ইকবাল ভাইরে বলো লুকাইয়া পড়তে। ”
________
সেই রাতে স্বর্ণলতা রুমের মধ্যে কাউকে থাকতে দিল না। মা ও বড় আপুকে পাশের রুমে পাঠিয়ে দিল। একা রুমে ঘুম আসল না কিছুতেই। বিছানায়ও শুয়ে থাকা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, আগুনের উপরে শুয়ে আছে। জোর করে ল্যাপ্টে থাকলে শরীর পুড়ে যাবে। সে সারারাত জাগল বসে থেকে। ফজরের নামাজ পড়ার সময়ে টের পেল, কেউ একজন রুমে ঢুকেছে। সে না দেখে, না শুনেও বুঝে গেল ঐ মানুষটা এসেছে। যার জন্য তার হৃদয়ে তীব্র অশান্তির ঝড় ওঠে। সেই ঝড়ে তার ভেতর-বাহির সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। গতকালও তো হলো! শুধু যে কারও প্রতিজ্ঞা ভেঙেছে তাই নয়, দাদিজানের শিক্ষাও ভেঙেছে। একটা পরপুরুষের সামনে…. স্বর্ণলতা আর ভাবতে পারছিল না। নামাজের মধ্যে মনোযোগ ছুটে গেল। কত রাকাত যে পড়ল! ভুলে যাওয়া সূরাটাও মনে করতে পারল না কিছুতেই। মনে হচ্ছিল, মুখস্থ থাকবে কী কোনো কালে ভুল করে শুনেনিও!
স্বর্ণলতা সালাম ফিরিয়ে উঠে পড়ল। মোনাজাত ধরল না। জায়নামাজ ভাঁজ করার সময়ে গলাটা পেল,
” আমার কল ধরছ না কেন? কতবার কল করেছি জানো? গুনেও শেষ করতে পারবে না। সারাটা রাস্তায় কল করতে করতে এসেছি। ”
মানুষটা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। স্বর্ণলতার মুখোমুখি হতে সে এক ঝলকের জন্য দৃষ্টি তুলল। সাথে সাথে হৃদয় ব্যথিত হয়ে পড়ল। কান্নার ঢল নামতে চাচ্ছে চোখ দিয়ে। সত্যটা কীভাবে বলবে? মিথ্যা বললেও যে ধরা পড়ে যাবে! সে সামনে থেকে সরে পড়তে চাইল তখনই শক্ত ও বলশালী হাতটা তার কাঁধ চেপে ধরল। তার দিকে মুখটা ফিরিয়ে রেখে সুধীর কণ্ঠে সুধাল,
” ইকবাল তোমার মুখ দেখতে পেয়েছে? ”
স্বর্ণলতা না চাইতেও চোখটা গিয়ে পড়ল মুনছুর সাখাওয়াতের চোখ জোড়াতে। সরাতে পারল না, আঠার মতো লেগে রইল। সেকেন্ড কয়েক উভয়ে নীরব সময় কাটাল। অতঃপর মুনছুর সাখাওয়াতই নীরবতা ঠেলে বলল,
” উত্তরটা কিন্তু ইকবালের কাছেও আছে। এত কল করাও লাগত না। এক কলে একবার জিজ্ঞেস করলেই পেয়ে যেতাম। তারপরেও করিনি, আমি ধৈর্য নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। তোমার মুখ থেকে সত্যিটা শুনব বলে। স্বর্ণলতা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। ”
সে স্ত্রীর একটা হাত বুকে ছুঁয়িয়ে বলল,
” এখানে কী যেন একটা চলছে! সহ্য করতে পারছি না। এবার তো থামিয়ে দাও। আর অপেক্ষা করিও না। ”
” আমি তো উত্তর দিয়াই দিছি। ”
” আমি বুঝতে পারিনি। তুমি না বুঝিয়ে কল কেটে দিয়েছ। তারপরে কতবার কল করলাম! তুমি ধরলেই না। ”
” আপনিও তো ধরেন নাই। ”
উত্তরটা দিয়ে স্বর্ণলতা স্বামীর কাছ থেকে সরে এলো। জায়নামাজ রেখে নিজের মোবাইলটা তুলে নিল। মুনছুর সাখাওয়াত কিছু বুঝে উঠার আগে সে খোলা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিল। আশ্চর্য ভঙ্গিতে ছুটে আসা মানুষটার দিকে চেয়ে বলল,
” যে জিনিস কোনো কাজে লাগে না ঐটা রাইখা কী লাভ? আপনি আমারে আর মোবাইল কিন্যা দিবেন না। ”
মুনছুর সাখাওয়াত জানালায় মুখ গলিয়ে দিল। নিচের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে এনে বলল,
” বাপ রে এত রাগ! কার থেকে শিখছ? আমার থেকে? ”
স্বর্ণলতা কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিল না। এক পলকের জন্য চেয়েও দেখল না। মুখ ফিরিয়ে নীঃশব্দে জানালা থেকে ফিরে এলো। বিছানার এক কিনার ধরে বসতে বুকের ভেতরটায় অনুতপ্তের আগুন লেগে গেল। মস্তিষ্কে এক ঘটনায় বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ভেসে উঠছে বার বার। নিজের ব্যবহারে নিজেই আশ্চর্য হয়ে আছে। কী করে পারল!
মুনছুর সাখাওয়াতও তার পাশে বসল। শরীর ঘেষে, একহাতে কোমর জড়িয়ে। মাথা থেকে ওড়নাটা টেনে ফেলে দিয়ে সুধাল,
” এত সকালে গোসল করলে যে? ”
মানুষটা হুট করে এত কাছে চলে আসল যে! কণ্ঠস্বর, প্রসঙ্গ সবই বদলে গিয়েছে। মনের মধ্যে কী চলছে? স্বর্ণলতা স্বামীর দিকে ফিরল। নিবিড় দৃষ্টি জোড়া বিঁধে আছে তার অধরযুগলে। সে তাৎক্ষণিক ছিটকে দূরে সরে বসল। তারপরে বড্ড তাড়াহুড়ায় গলায় জানাল,
” ইকবাল ভাই আমার মুখ দেখেছে। ”
এটুকুতে থামল না। বসা থেকে উঠে গিয়ে রুমের দরজা আটকে দিল। স্বামীর কাছে ফিরে এসে পুনরায় বলল,
” উনার কোনো দোষ নাই। আমি মুখ খোলা অবস্থায় নিচে গেছিলাম। উনার রুমেও ঢুকছিলাম। ”
” তোমার দোষ? ”
” এতক্ষণ তো তাই ভাবতাছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আমারও দোষ নাই। আসল দোষ তো আপনার। আপনি কল ধরলেন না কেন? যেদিন মোবাইল পাঠাইছেন সেদিন থেইক্যা কল দিতাছি, আপনি একদিনও ধরেন নাই। তাইলে মোবাইল দিছিলেন কেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” দোষ করার জন্য। ”
সে দরজার কাছে হাঁটা ধরতে স্বর্ণলতা সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল,
” কোথাও যাইবেন না। এই ঘরে থাকেন। ”
” শাস্তি দিবে? ”
” হ। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ফিরে এলো। পূর্বের স্থানে বসে বলল,
” কী শাস্তি দিবে, বলো। ”
” আগে বলেন, কল ধরেন নাই কেন? ”
” ইচ্ছে করছে না। ”
স্বর্ণলতার এত খারাপ লাগল! ক্ষণকাল নিষ্পলকে ব্যথিত বদনে চেয়ে রইল স্বামীর দিকে। চোখদুটি এত শুকনো! তেজ ও ক্রোধের আগুন সকল মায়া, দরদ, স্নেহ শুষে নিয়েছে যেন! চোয়ালদ্বয় মৃদু কাঁপছে। শিরদাঁড়া সোজা, বুক টানটান করে এমনভাবে আঁট হয়ে বসে আছে যে, পাথরের মূর্তি মনে হচ্ছে। এই নির্দয়, ক্রোধের আগুনে সারাক্ষণ ছ্যাঁকতে থাকা মানুষটার সাথে সারাটা জীবন কাটাবে? ভাবতেই সে হাঁপিয়ে ওঠল। আচমকা মেঝেতে বসে বিছানায় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠল। সেই অবস্থায় বলল,
” তাইলে যা ইচ্ছা হয় তাই করেন। যান। ”
মুনছুর সাখাওয়াত ঘাড় ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকালও না। সোজা হেঁটে চলে গেল দরজার কাছে। সিটকানি খুলে বেরিয়েও গেল। পায়ের আওয়াজ দূরে হারিয়ে যেতে স্বর্ণলতার কান্না বাড়ল। দুই হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরতে শয়তানটা কাঁধে চাপল বোধ হয়। পাগলামি বেড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে বিছানার চাদর টেনে ফেলল নিচে। বেড সাইড টেবিলটা হাত দিয়ে টেনে পেছনে ধাক্কা দিতে পানির জগ ও গ্লাসটা পড়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে রাখা সাজসরঞ্জামগুলোও এলোমেলো করে ফেলল। ড্রয়ার খুলে মাথার উপরে তুলতে শুনল,
” দাদিজান অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ”
সে চমকে পাশ ফিরল। হাতদুটি থেমে যেতে মুনছুর সাখাওয়াত দৌড়ে এলো। খুব সাবধানে ও কৌশলে ড্রয়ারটা নিজের হাতে নিতে নিতে বলল,
” হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল। এক সপ্তাহের মতো ওখানে থাকতে হয়েছে। দাদিজান খুব দুর্বল হয়ে গেছে, স্বর্ণলতা। শুধু শরীর না মনটাও দুর্বল হয়ে গেছে। আমাকে চোখের সামনে থেকে সরতে দিচ্ছে না। ঐ সময়ে তোমার কল ধরলে দাদিজান হয়তো মরেই যেত। ”
” কেন? আমি কি দাদিজানের জন্য বদদোয়া করতাম? ”
” না। ”
” তাইলে? ”
” যে কণ্ঠটা আমার কান ছুঁয়ে বাজার কথা সেই কণ্ঠটা মোবাইল ছুঁয়ে বাজছে, সেটাও ঢাকা থেকে। আমি বুঝার পরেও ঐ গ্রামে পড়ে থাকি কীভাবে? স্বর্ণলতা, আমি পারিনি আর পারবও না। ”
সে এক মুহূর্তের জন্য শান্ত হলো। পরক্ষণে অশান্ত হয়ে ওঠল। ভীষণ চিন্তিত সুরে ব্যাকুল হয়ে সুধাল,
” দাদিজান পুরাপুরি সুস্থ হয় নাই? ”
” না। ”
” তাইলে এখানে আসছেন কেন? উনারে একা ফেলাইয়া চইলা আসছেন? আপনেরে কি আল্লাহ সত্যি দয়া-মায়া দেয় নাই? ঐ বুড়া মানুষটা আপনারে জানপ্রাণ দিয়া ভালোবাসে। সেই ভালোবাসার দাম এমনে দিতাছেন? ”
মুনছুর সাখাওয়াত জবাবে কিছু বলল না। ম্লানমুখে চেয়ে আছে স্ত্রীর দিকে। একটু আগে এই মেয়েটি কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেছিল! সে যদি ফিরে না আসত তাহলে কী হতো? ভাবতেই তার বুক কেঁপে ওঠল। না চাইতেও অবচেতনে ড. আল হাদির মুখটায় ভেসে ওঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠল। তাহলে কি তার ভবিষ্যৎবাণী মিলে যাচ্ছে? স্বর্ণলতা দিনে দিনে তার মতো হয়ে যাচ্ছে? এরপরে কী হবে? ধোঁকা দিবে? প্রথম ধোঁকাটা তাকেই দিবে বলেছিল না? সে মনে করার চেষ্টা করছিল। সহসা শুনতে পেল,
” এখানে থাইকা লাভ নাই, দাদিজানের কাছে যান। ”
একটু থেমে চোখ মুছতে মুছতে পুনরায় বলল,
” আমারেও নিয়া চলেন। আপনি পুরুষ মানুষ উনারে ঠিকমতো দেখভাল করতে পারবেন না। ”
স্বর্ণলতা স্বামীর হাত ধরে টানতে লাগল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও একচুল নড়াতে পারল না। ব্যর্থ ও বিরক্ত নিয়ে তাকাতে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” মাত্রই তো এলাম। একটু বসি, বিশ্রাম নিই। ততক্ষণে তুমি তৈরি হয়ে নেও। যাওয়ার সময়ে তোমার কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাব। ”
” কলেজে নামাইয়া দিবেন কেন? আমি আপনার সাথে যাব না? ”
” না। তোমার ক্লাস শুরু হচ্ছে, মন দিয়ে ক্লাস করো। বাকিসব আমি দেখে নিব। ”
” কী বলতাছেন এসব? দাদিজানের চেয়েও আমার ক্লাস বড় হইলো নাকি? ”
” হ্যাঁ। বড় হওয়ারই কথা। এই স্বপ্ন তোমার জীবনে আগে এসেছে, তারপরে আমি। সবার শেষে দাদিজান। ”
স্বর্ণলতা এসব মানতে চাচ্ছিল না। জেদ করতে চেয়েও পারল না। মুনছুর সাখাওয়াত সাবধান করল,
” দাদিজানের শরীরের যে অবস্থা তাকে টেনে-ছিঁচড়ে এখানে আনাও সম্ভব না। তাহলে রাস্তার মধ্যে অক্কা পেয়ে যেতে পারে। তাই এসব বলে তোমার-আমার কারও সময় নষ্ট করো না। ”
সে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিল। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,
” তার আগে আমাকে মাফ করে দাও। ”
” কিসের জন্যে? ”
” ঐ যে বললে না, তোমার কল না ধরে দোষ করেছি? ওটার জন্যে। মুখে মাফ চাইলে হবে না? ”
স্বর্ণলতা আশ্চর্য হয়ে সুধাল,
” আপনি সত্যি দোষ স্বীকার করছেন? ”
” করছি তো। মনে হচ্ছে মুখে মাফ চাইলে হবে না। শাস্তি নিতে হবে। কী শাস্তি নিব, বলো তো। ”
সে কিছু বলার সুযোগই পেল না। পূর্বে মুনছুর সাখাওয়াত বলল,
” এখন থেকে তুমি ইকবালের সামনে মুখ খুলে থাকবে। আমার মুখটা আমি ছাড়াও অন্য কেউ দেখছে, এরচেয়েও কষ্টদায়ক শাস্তি আর কী হতে পারে? ”
স্বর্ণলতা এখানেও মতামত দেওয়ার সুযোগ পেল না। মুনছুর সাখাওয়াত ইচ্ছে করে দিল না। সে বউকে আরও কাছে টেনে নিল। আদরে আদরে মন ভুলিয়ে দিতে দিতে আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ আমি ইচ্ছে করে ধরা দিচ্ছি। এবার দেখার পালা, তুমি সত্যি আমাকে ধোঁকা দিতে পার নাকি। ভালোবাসার আসল প্রমাণ তো এবার পাব। যেখানে আবেগ ও বিবেক একই সাথে হেরে যাবে। ‘ সে স্ত্রীর বুকের মাঝ বরাবর গভীর চুমু খেয়ে সরে পড়তে চাইল। স্বর্ণলতা বুঝতে পেরে পিঠ খামচে ধরে বলল,
” যাইবেন না। আমি পুরো আদর চাই। ”
মুনছুর সাখাওয়াত থামল। কিন্তু নতুন করে কিছু শুরু করল না। বলল,
” এখন সময় নেই। তোমার দেরি হয়ে যাবে। যাও, তৈরি হয়ে নাও। ”
সে স্ত্রীর বাঁধন থেকে ছুটতে ছুটতে ভাবল, ‘ আমি তোমার শরীরের ক্ষুধা বাড়াব কিন্তু মিটাব না। তাহলে না পরীক্ষাটা আরও কঠিন হবে। বউ, এতকাল আমি তোমার জন্য ডাক্তারকে হারিয়েছি। এবার আমার জন্য তুমি ও কে হারাবে। হারাতেই হবে। নাহলে মুনছুর যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটাও দেখতে পাবে। ‘
চলবে